শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
কাঠের একটা চেয়ার টেনে হেমেনবাবুকে বসতে দেওয়া হয়েছে। তাঁর চোখে-মুখে ফুটে আছে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। আল্পনা ফুপিয়ে কাঁদছেন। নিয়তি বড়বড় চোখ করে হেমেন দাদুকে দেখছে। সে বাবার খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা থরথর করে কাঁপছে। সুকুমার গেছে নোমানকে ডাকতে। কী করা যায় তার একটা বুদ্ধি বের করা দরকার। এত বড় ঘটনায় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়?
অখিল টিনের সাথে মাথা ঠেক্ দিয়ে বসেছিল। তাঁর চোখও টল্টল্ করছে। সহ্য করা কঠিন। কিন্তু চারপাশে বাঘ-হায়না দিয়ে বেষ্টিত কয়েকটি ছাগল জাতীয় প্রাণী কী করবে? কী করার আছে। তিনি বললেন, ‘আর কতকাল এমন সহজ সরল থাকপেন কাকা? ছাত্তারের মতো একজন ভয়ঙ্কর মানুষ গিয়ে ডাক দিল আর বাইর হইয়া গেলেন! কইতেন যে আমার শরীরডা ভালো না, আইজ কোথাও যাবো না।’ হেমেন বাবু মাথা নিচু করে আছেন। অখিলের কথার জবাব দিলেন না।
অখিল নিজেকে সামলাতে পারছে না।
একটা মা-বাবা হারানো মেয়ে। শুধুমাত্র হিন্দুর সন্তান বলেই আজ ধর্ষণের শিকার হবে? এর কোন প্রতিবাদও হবে না? আর হেমেন কাকা? দেবতাতুল্য এই মানুষটিকে এই রকম চোখের সামনে নাজেহাল হতে হচ্ছে। অথচ অখিলদের কিছুই করার নেই! মুখ ফুটে প্রতিবাদও করা যাবে না। মহাভারতে দুঃশাসনের পরাজয় হয়েছিল বলীয়ান ভীম সেনের হাতে। কিন্তু আধুনিক দু:শাসনের অফুরন্ত শক্তি। বধ করে কার সাধ্য? অখিল হেমেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাকা, আইজ আমার বুঝ আইছে। আপনে ওপার চইলা যান।’
হেমেন গাঙ্গুলী ধীরে ধীরে বললেন, ‘তোর মনে আছে অখিল, এরশাদের সময় কতবড় বিপদে পড়লাম। দেশজুড়ে বঙ্গভূমির রব উঠল। এরশাদ, কিছু না বুঝে শুনেই অর্ডার দিল, ধর। এনএসআই, পুলিশের হলো পোয়া বারো। এনএসআই অফিসাররা লিস্ট তৈরি করে তারপর ব্লাকমেইল করতে থাকল। আমার মতো না খাওয়া মানুষ নাকি বঙ্গভূমির নেতা। দফায় দফায় আসতে থাকল। অতিষ্ট করে তুলল। দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে কী কষ্ট হয়েছিল তা তো জানিস। তুই দিলি, মকবুল দিল, বাড়ির গাছ বিক্রি করলাম। দশ হাজারের বিনিময়ে তারা সন্তোষ্ট হল যে আমি বঙ্গভূমির লোক না…।’
বলতে বলতে নোমান আর সুকুমার এসে ঘড়ে ঢুকল। নোমনের চোখ মুখে ভয়ানক ক্ষোভ-দু:খ। মাথা নিচু বরে থেকে বলল, ‘মামলা করতে হবে।’
অখিল পোদ্দার বললেন, ‘মামলা করে কী হবে ভাই?’
‘হয়তো কিছুই হবে না। কিন্তু তারপরও একটা রেকর্ড থেকে যাবে।’
‘পাগল অইছ তুমি, পুলিশ মরলেও মামলা নিবে না।’
‘পুলিশ না নিলে আদালতে সরাসরি মামলা করতে অবে।’
সুকুমার আস্তে আস্তে বলল, ‘কাকারে যদি সত্যিই মাইরা ফেলায়, মামলা চালাবে কে?’
নোমান হতাশা নিয়েই বলল,‘এইটাও মুক্তিযুদ্ধের একটা অংশ। চুপচাপ প্রতিবাদ না করে বসে থাকলে এরা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠে।’
সুকুমার বলল, ‘এই বিপদের সময় একটু বাস্তব চিন্তা কর। তুই কি লক্ষ করছেস, প্রকৃতপক্ষে, বিশেষ করে অধিকার ও বিচার-আচারের প্রশ্নে হিন্দুরা এইখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকও না। সাড়ে তিন যুগ পার হয়ে যাইতেছে এই ‘অসাম্প্রদায়িক দ্যাশের। আইজ পর্যন্ত দেখছিস যে হিন্দু বিচার পাইছে?’
‘কি মুশকিল, হিন্দুরা বিচার চায়ই তো না। পাবে কি?’
সুকুমার আস্তে আস্তে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হিন্দুরা ক্যান বিচার চায় না? বিচার থাকলে তো পাবে!’
নোমান রাগ হয়ে বলল, ‘তারপরও বিচার চাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। ঝুঁকি থাকলেও।’
হেমেন কাকা মাথা নিচু করে বসে আছেন। মনে মনে নানা ধরনের উপলব্ধি হচ্ছে। নিজেকে হেমেন বাবুর এখন অষ্টাদশ শতাব্দীর আমেরিকার ক্রীতদাস মনে হচ্ছে, যাদেরকে নিয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যা কিছু করতে পারে।
অখিল পোদ্দার বললেন, ‘মানিক সরকাররে জানানো দরকার যে ওরা তলে তলে বিএনপির হইয়া কাজ করতেছে। এইটা কেমনে জানানো যায়?’
সুকুমার উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, ‘খবরদার দাদা, ভুলেও এই কাজ করতে যাইও না। এই কথা আর মুখেও আনবা না। আওয়ামী লীগের নেতারা কারো পরামর্শ নেয় না। এইটা তাদের মজ্জাগত! উল্টা কইতে গেলে মহাবিপদ ডাইকা আনবা!’
অখিল পোদ্দার প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, ‘কিন্তু ক্ষতি হইয়া যাবে তো!’
নোমান নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘সুকুমার ঠিকই বলছে দাদা, আওয়ামী লীগ ক্ষতি মানে, পরামর্শ মানে না।’
আজ প্রচণ্ড গরম পড়েছে। বছরের মাঝামাঝি এই সময় দেশে ভীষণ গরম পড়ে। ভাবাই যায় না যে এই দেশেই শীতের প্রকোপে, শীত বস্ত্রের অভাবে মানুষ মারা যায়! চারপাশে একটি গাছের পাতাও নড়ছে না। হাওয়া বলতে কিছু নেই। গাছগুলোকেও মনে হচ্ছে গরমে ঝিমিয়ে পড়েছে। তৃষ্ণার্ত, একটু পানি চায়।
ইলেকট্রিসিটি নেই ঘণ্টাদুয়েক। এসি চালু করা যাচ্ছে না। গত বছর মানিক সরদারের বাড়িতে এসি লাগানো হয়েছে। সে স্যান্ডোগেঞ্জি গায়ে বৈঠক খানা থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে একটা তালের পাখা। তার পিছে পিছে ছাত্তার মোল্লা আর সাথের তিনটি ছেলেও বের হয়ে এসেছে। ছেলে তিন জনই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা মানিক সরদারের হাত থেকে পাখা নিতে চাচ্ছে। তারা থাকতে কষ্ট করে মানিক ভাই নিজে বাতাস খাবেন কেন?
বাড়ির সামনে শাদা একটা জিপ এসে থামল। দেখলেই বোঝা যায় সরকারি গাড়ি। জিপ থেকে লাফ দিয়ে নামল একজন অল্পবয়সী অফিসার। জিপের পেছনের ডালা খুলে বের হয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকল একজন। গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
অল্পবয়সী এই কর্মকর্তার সাথে মানিক সরদারের সামান্য পরিচয় আছে। লোকটি ফরিদপুরের এসি ল্যান্ড।
এসি ল্যান্ড হাত তুলে মানিক সরদারকে সালাম করলেন। জবাবে মানিক সরদার মাথা দোলাল। মানিক সরদার আরেকটি চেয়ারের জন্য এদিক-ওদিক তাকাল। তার কাছে দাঁড়ানো একটি ছেলে বুঝতে পারল। সে দৌড়ে ভিতরে গিয়ে একটি চেয়ার তুলে নিয়ে এল।
এসি ল্যান্ড হাসতে হাসতে বললেন, ‘ডিসি সাহেব থানায় ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। ওসি জানাল, আপনি ঢাকায় রওনা হচ্ছেন। বনমন্ত্রীর সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তাই দেরি না করে চলে আসলাম।’
‘ভাল করছেন। তয় আমার নতুন ইটের ভাটার জন্য জমি কই?’
‘আপনার জন্য তিনটা অর্পিত সম্পত্তির কাগজ নিয়ে আসছি মানিক ভাই?’
মানিক সরদার মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হে, তয় দিতেছেন না ক্যান? দেরি কীসের?’
‘এই যে তহসীলদাররে সঙ্গে নিয়া আসছি।’ এসি ল্যান্ড পেছন ফিরে ইশারা করলেন। জিপের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মোটা কালো লোকটি প্রায় দৌড়ে কাছে আসল। তার হাতে কয়েকটি ফাইল।
মানিক সরদার বলল, ‘নাম কী আপনার?’
‘স্যার অব্দুর রহমান।’
‘বাড়ি কুথায়?’
‘তালমা ইউনিয়নে স্যার।’
মানিক সরদার মাথা দোলাল, ‘ভাল, বাড়ির খাইয়া অফিস করতেছেন।’
‘স্যার, আপনার দোয়া স্যার।’
‘কুনো অসবিধা নাই তো?’
‘না স্যার, অসুবিধা অইলে তো আপনার কাছেই আসব স্যার।’
মানিক সরদার আবার মাথা দোলাল।
তহসীলদার হাতের ফাইলগুলো এসি ল্যান্ডের সামনে খুলে ধরল। এসিল্যান্ড কাগজের উপর আঙুল রেখে বলতে থাকল, ‘এইটা স্যার মালিক ছিল শ্যামল নাগ। এখানে আছে তিন একর ১৮ শতাংশ। ওয়ারিশ কেউ নাই।’
কাগজ উল্টিয়ে বলল, ‘আর এইটা স্যার মালিক ছিল সত্যানন্দ চক্রবর্তী। এখানে আছে দুই একর ৪৩ শতাংশ। এইটা একেবারে রাস্তার পাশে। এর কিছু ওয়ারিশ আছে। কিন্তু তারা আর ধারে কাছেও ভিড়ে না। জয়নাল মোল্লা নামে একজন চাষ করে খায়। আর এই যে এইটা, এখানে আছে দুই একর ৯ শতাংশ। এইটাও ভাল জমি।’
মানিক সরদার টান হয়ে বসে বললেন, ‘আইচ্ছা ঠিক আছে। ভাল করছেন। তিনটাই জব্বর জায়গা। আমি পরের দুইটা জমি চিনি। জলদি ব্যবস্থা করেন। এক সপ্তাহের মইধ্যে করবেন। সামনে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসতেছে। তখন তো আবার আপনেগো চেহারা পাইল্টা যাবে। আমার ভাটার কাজ শুরু করতে অবে।’
এসি ল্যান্ড হাসছেন। কাগজ তিনটি গুটাতে গুটাতে বললেন, ‘পাকিস্তান সরকার এ জমিগুলার নাম দিছিল শত্রু সম্পত্তি। আমরা দেশ স্বাধীনের পর ভদ্রভাষায় নাম দিছি অর্পিত সম্পত্তি। নাম পাল্টেছে, বিধি বিধান কিছু পাল্টায় নাই, আগের মতই আছে।’
এতক্ষণ ছাত্তার এবং তার সঙ্গের ছেলে দুটি দূরে বাড়ির সামনের পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এসি ল্যান্ড আসতেই ওদের ইশারায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানিক সরদার ওদের ডাক দিল। এসি ল্যা-ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একটু চা খান?’
‘না মানিক ভাই, আরেকদিন খাবো। আগে আপনার কাজটা করি।’ তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘আপনারা দেশ স্বাধীন করছেন। এই জমিগুলায় আওয়ামী লীগের একটা আলাদা হক আছে।’
ছাত্তাররা এবং ছেলে তিনটি কাছে এসে দাঁড়াল। মানিক সরদার এসি ল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে ভাই সমস্যাই তো আওয়ামী লীগারদের। এই যে দ্যাখেন এই লোকটা, এর নাম ছাত্তার মোল্লা। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে। অথচ কে বা কারা একটা হিন্দু মেয়েরে অপহরণ কইরা খুন করছে, বিএনপি’র লোকেরা কইতে চায় যে এইটা নাকি ছাত্তার ভাইগো কাম, আওয়ামী লীগের ছেলেগো কাম! চিন্তা করতে পারেন?’ এবার মানিক সরদারের কণ্ঠে একটা ভাষণের সুর চলে এল। বলল, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, তারা স্বাধীনতার পক্ষশক্তিরে দুর্বল করতে চায়। কিন্তু বাংলার জনগণ তা কোনোদিন মাইনা নিবে না! ’৭১ সালে একবার প্রতিরোধ করেছে, আবারো তারা প্রতিরোধ করবে।’
এসি ল্যান্ড একটু নিচু হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই ভাই। তাহলে এবার আসি?’
মানিক সরদার হাতের ইশারায় এসি ল্যান্ড আর তহসীলদারকে বিদায় দিল। এইবার ছাত্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আইচ্ছা ঐ নোমানডা কেডা?’
উত্তর দিল অন্য একটি ছেলে, ‘মোয়াজ্জেম সাহেবের ছেলে। আগে ভার্সিটিতে গুন্ডামি করত। তাড়া খাইছে। এখন উপজেলায় আইছে।’
ছাত্তার বলল, ‘সে তো ঢাকায় ফেনসিডিলের ব্যবসা করে। বিরাট এন্টি-আওয়ামী লীগ ভাই! মৌলবাদি কানেকশন আছে।’
‘মোয়াজ্জেম মিয়াও তো মৌলবাদী লোক। তাঁর পোলা তো মৌলবাদীই অবে। গুন্ডামি আমি ওর পাছার ভিতর দিয়া দিব। শালা শুয়োরের বাচ্চা। কেস মারায়! এই শালারে দেইখা দিবি, যা আছে আমি দেখপো।’
ছাত্তার বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘ভাই, চরভদ্রাসনের ওসি মোবারকরে এইখানে বদলি কইরা আনেন। সে আমাগো খাঁটি লোক।’
‘চুপ কর! বেশি বুঝিস না। ওসি এইটা গোপালগঞ্জের লোক, কুনো সমস্যা নাই।’
ছাত্তার নিচু গলায় বলল, ‘ঠিক আছে ভাই, কিন্তু মাঝে মইধ্যে ভয় করে। গোপাইলাগো ঘাড়ের রগ ত্যাড়া থাকে। দ্যাখেন না, শেখ মুজিব।’
মানিক হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘এই! শেখ মুজিব কে, তোর বাপ!’
ছাত্তার তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল, ‘থুক্কু, বঙ্গবন্ধু।’
মানিক সরদার দ্রুত কোথাও বের হয়ে গেল।
ছাত্তার পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,‘বর্তমান আওয়ামী লীগার গো মাথা মুটা। একটু খানি ত্যাল লাগাইয়া যা কবি, তাইতেই বিশ্বাস। এরা যুক্তি তর্কের ধার ধারে না।’
পাশের ছেলেটি দাঁত বের করে হাসল। সে এতকিছু বোঝে বলে মনে হল না।
ছাত্তার বলল, ‘একটা কথা মনে রাখপি, মাথামুটা লোকেগো আইজকাল শত্রু লাগে না। এরা নিজেরাই নিজেগো পায়ে কুড়াল মারে।’