শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
বিকালে দোকানে বসে চা খাচ্ছেন হেমেন গাঙ্গুলী আর মকবুল সাহেব। এটাই তাদের রুটিন কাজ। সত্তরোর্ধ্ব মানুষরা সুযোগ পেলেই পেছনের ইতিহাসে চলে যায়। তাঁদের স্মৃতিচারণের নেশায় পেয়ে বসে।
মকবুল সাহেব বললেন, ‘তোদের বাড়িতে তিনটা বিশাল বিশাল পুকুর ছিল। পুকুর কীসের, একেকটা দীঘির মত। একটা ছিল তোদের পারিবারের ব্যবহারের জন্য। তোর বাবার কড়া হুকুম ছিল অন্য কেউ ওটা ব্যবহার করতে পারবে না। একটা ছেড়ে দেওয়া ছিল মুসলমান, ছোটজাতের হিন্দুদের মাছ-টাছ মেরে খাওয়া, স্নান করার জন্য। আর একেবারে দক্ষিণে, চকের পর একটা পুকুর ছিল লোকে বলত কালিপুকুর।’
হেমেন গাঙ্গুলী মাথা নাড়লেন। তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বললেন, ‘এই সেদিনের কথা।’
‘কালিপুকুর নিয়ে ছিল নানা কুসংস্কার। কেউ সেখানে মাছ মারতে যেত না। বড়বড় গাছ জন্মে গেছিল ব্যবহার না করার ফলে। ভেতরে এত বড়বড় মাছ দেখা যেত যে সেসব মাছ নিয়েও নানা গল্প চালু হয়েছিল। একটি গজার মাছ ছিল, সেটা কারো চোখে পড়লে তাকে কালিবাড়ি নিয়ে ঝেড়ে আনা হতো। মুসলমান হলে ফকির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হতো। লোকে বিশ্বাস করতো, ওই মাছটার বয়স কত কেউ জানে না। ওটা নাকি অশুভ একটা কিছু ছিল। আবার ওইটাই নাকি গ্রাম রক্ষা করতো।’
‘আমার সব মনে আছে।’ হেমেন গাঙ্গুলী বললেন।
মকবুল সাহেব বললেন, ‘হিন্দু বড়বড় পরিবারের দাপট তো এই সেদিনও ছিল। এই এলাকায় মুসলমানেরা কোনো অনুষ্ঠান করতে হলে যে কোনো বড় হিন্দু পরিবারের সামনে হাত জোর করে দাঁড়াতে হতো। কারণ, যে জমি ব্যবহার করা হবে তা যে হিন্দুর!’
হেমেন বাবু বললেন, ‘এসব কারণেই তো দেশটা পূর্ব পাকিস্তান হলো। তা না হলে হাজার মাইল দূরের একটি অচেনা জাতির সঙ্গে যোগ দেবে কেন?’
মকবুল সাহেব বললেন, ‘যাই বলিস, বড়বড় বংশের, নাক উঁচু হিন্দুরা কিন্তু ঠিকই তাদের ইজ্জত নিয়ে চলে গেছে। বিশাল বিশাল জমিদারি ফেলে রেখে প্রায় খালি হাতেও ওপারে চলে গেছে। পূর্ব-পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা বুঝে গেছে, অলিমুদ্দিন-ছলিমুদ্দিনরা মাথায় উঠে উকুন বাছবে। এগুলা সহ্য হবে না।’
হেমেন বাবু বললেন, ‘একদিকে ঠিকই হয়েছে। ২৩ বছর কষ্ট করলেও আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি।’
মকবুল সাহেব নাক সিটকে বললেন, ‘আরে রাখ তোর স্বাধীন দেশ! স্বাধীন দেশ ধুয়ে তুই পানি খা!’
একটু থেমে আবার বললেন, ‘পেশিশক্তি দিয়ে কারো স্বাধীন হওয়া উচিত না। স্বাধীনতার জন্য যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। এই জাতি স্বাধীনতার জন্য লায়েক হয়নি। এখনো ব্রিটিশের অধীনে থাকা উচিত ছিল। তাহলে ভবিষ্যতে একটি নিউজিল্যান্ড বা একটি কানাডার মত সভ্য দেশ পেতাম।’
হেমেন গাঙ্গুলীও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু চেয়ে দেখলেন সামনে অখিল পোদ্দার দাঁড়িয়ে। বললেন, ‘অখিল। তুই বাঁচবি বহুদিন। তোর কথাই ভাবছিলাম।’
অখিল পোদ্দার হেসে বললেন, ‘বহুদিন বাঁচব কাকা? এসব আপনিও তাইলে বিশ্বাস করেন?’
‘আমার বিশ্বাসে কী যায় আসে। সমাজ যা মানে করে তাকে তো আর উপেক্ষা করা যায় না। সেসব অন্তত ব্যবহার করতে হয়।’
মকবুল সাহেব বললেন, ‘এই একটা কথা তুই ঠিকই বলেছিস।’
হেমেন গাঙ্গুলী বললেন, ‘এই যেমন তোর মকবুল কাকা। একটা ঘোর নাস্তিক মানুষ। কিন্তু সেও কথায় কথায় ইনশাল্লাহ বলে, খোদা হাফেজ বলে। এগুলো কালচারের ভাষা হয়ে গেছে।’
অখিল পোদ্দার লোকমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাকা গনিমাতের মাল জিনিসটা কী? সেইটাও কি কালচারের ভাষা?’
লোকমান সাহেব বললেন, ‘গনিমাতের মাল। ইংরেজিতে বলে ওয়ার বুটি। ইসলামে যুদ্ধে জয়ের পর পরাজিত পক্ষের দখল করা নারী-পুরুষ, সহায় সম্পদকে বলে গনিমাতের মাল। গনিমাতের মালের ভাগ বাটোয়ারারও কিছু নিয়ম-কানুন আছে ইসলামে। কোরআন শরীফের ৩৩ নম্বর সুরার ৫০ নম্বর আয়াতে আছে, ‘হে নবী, আপনার জন্য আপনার স্ত্রীদের হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা দেন। আর দাসদাসীদের হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ আপনার করায়ত্ব করেন। আবার কোরআন শরীফের ৪৮:২০-এ আছে, আল্লাহ তোমাদের বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ওয়াদা দিয়েছেন। তিনি তা তোমাদের জন্য ত্বরান্বিত করবেন।’
অখিল পোদ্দারের চোখে মুখে দুশ্চিন্তা ফুটে উঠল। মকবুল সাহেব তা লক্ষ্য করে বললেন, ‘কেন, তুমি এ শব্দ শুনলে কোথায়?’
অখিল পোদ্দার মহাচিন্তিত মুখে বললেন, ‘সেদিন আমার মেয়েটারে রাস্তায় দেইখা দুইটা ছেলে বলছে গনিমাতের মাল। ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।’
হেমেন গাঙ্গুলী এবং মকবুল সাহেব একে অপরের দিকে চাইলেন। তারপর মকবুল সাহেব বললেন, ‘অল্পবয়সী ছেলেদের মধ্যে ইসলামাইজেশন চলছে। ভয়ানক অবস্থা তৈরি হচ্ছে।’
হেমেন বাবু বললেন, ‘থাক, এসব কানে তুলিস না।’
মকবুল সাহেব বললেন, ‘ব্যাপারটা কিন্তু হেমেন, কানে না তোলার নয়।’
হেমেন গাঙ্গুলী বললেন, ‘ও কি এখন যুদ্ধ করতে যাবে?’
‘না, তা কেন। কিন্তু ঘুমিয়ে থাকলেও চলবে না।’ মকবুল সাহেব সতর্ক করে দিয়ে বললেন।
মুখে যাই বলুন, হেমেন গাঙ্গুলীরও একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। চেম্বার বন্ধ করে একা বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যার বাতাস এসে গায়ে পরশ দিয়ে গেল। কেন কে জানে তার অসহায় বোধ হল। চারদিকে মাইকে একসঙ্গে আজান শুরু হয়েছে। হেমেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলী ধীর পায়ে আজান শুনতে শুনতে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলেন।
আশেপাশে বিদ্যুতের লাইন সব বাড়িতেই আছে। শুধু হেমেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর বাড়িতে নেই। আনি আনি করে আনা হচ্ছে না। একসাথে অনেকগুলোর টাকার দরকার। রাস্তার খুটি থেকে বাড়ি পর্যন্ত অনেক তারের দরকার। প্রায় দেড়শ গজ। হাউজ মিটার, মিস্ত্রী, অফিসে ঘুষসহ হাজার পাঁচেক টাকা তো চাই। একসাথে এতগুলো টাকা জোগাড় করা হেমেন বাবুর জন্য কষ্টকর।
দ্বিতীয় আরেকটি কারণ বোধহয় আছে। হেমেন বাবু চিরকুমার মানুষ। চিরকুমারদের নাকি কোনোকিছুতেই আগ্রহ থাকে না। তারা ভোগ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারেন। কারো বাড়িতে গিয়ে যখন বসেন তখন টিউব লাইটের ধবধবে আলোয় তার ভালোই লাগে। ঘরের ভেতরে সবকিছু একেবারে আলোকিত। কিন্তু তার বাড়িতে এই আলোর খুব প্রয়োজন আছে কি? নিজের যতটুকু আলো দরকার তা তো হারিকেনেই চলে যাচ্ছে। বাড়িতে বিদ্যুৎ আসলে টেলিভিশনের কথাও চলে আসে। ইদানীং ঘাটের মরার ঘরেও টিভি চাই। কিন্তু হেমেন বাবুর বাড়িতে ঘাটের মরাও তো কেউ নেই।
এক আছে শ্যামলী। সে পড়াশোনা জানে না। তার টিভি দেখার নেশা রীতিমতো অমানবিক। মাঝে মাঝে সে তরকারি পুড়িয়ে ফেলবে। এর রহস্য হেমেন বাবু জানেন। তরকারি চুলায় দিয়ে সে দৌড় দেয় রতনদের বাড়ির দিকে। হা করে টিভি দেখতে দেখতে যখন মনে পড়ে তরকারির কথা, তখন দেখা যায় তরকারি নাই, হয়ে গেছে কয়লাকারি।
হেমেন বাবু টিউবওয়েলের জলে হাত-পা ধুয়ে ঘরে এলেন। গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে ডাকলেন, ‘শ্যামলী।’
‘কন দাদু।’
‘রেডিওটা আন তো।’
‘রেডিওর তো ব্যাটারি নাই।’
‘এরমধ্যেই ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল?’
‘কী জানি। আমি রেডিও বাজাই না।’
‘মেকানিক দেখাতে হবে। কি আর করা যাবে। তাহলে ভাত দে দাদু, খেয়ে ফেলি।’
শ্যামলী দু’জনের জন্যই ভাত বেড়ে আনল। আজকের তরকারীটা খারাপ হয়নি। নছি-কাতলের বাচ্চা। ঝোল করে রেঁধেছে। এরচে’ আর কি ভালো হবে। এসব মাছ ছোট হলে খেতে কাদা কাদা লাগে। বড় মাছ দেশ থেকে ফুরিয়ে গেছে। যা আছে তা হেমেন বাবুর কেনার সাধ্য নেই।
প্রায় প্রতিদিনই খেতে বসলে অতীত দিনের কথা মনে পড়ে। হেমেন বাবুদের বাড়ি যখন জমজমাট ছিল তখন গজাল মাছ, টাকি মাছ তাদের বাড়িতে ঢুকতো না। এসব মাছ তারা খেতেন না। ওসব মাছ ছিল চাষা-ভুষাদের খাবার। হেমেন বাবুর ভাইবোন ছিল আট জন। লোকজন, ভাইবোন, চাকর বাকর দিয়ে বাড়িঘর গমগম করতো। এখন তিনি যেখানে খড়ির মাঁচা করেছেন, ঠিক ওইখানে ছিল তুলসীতলা। তুলসীতলা থেকেই একেবারে পুকুর পর্যন্ত ছিল বাড়ির আঙিনা। তরমুজের ফালির মতো কাটতে কাটতে এখন এই টুকরোতে তিনি এসে ঠেকেছেন। মাত্র কয়েক বছরেই অবস্থা এমন যে হেমেন বাবুর একটিমাত্র ঘর। চারপাশে বাঁশের বেড়া। উপরে একচালা টিন দেওয়া। ঘরের মাঝখানে একটা বেড়া দিয়ে পার্টিশন। পার্টিশনের কোন দরজা-টরজা নেই। ওপাশে থাকে শ্যামলী। রাতে ঘুমানোর সময় হারিকেনের আলো টিমটিম করে মাঝখানে রাখা হয়, যাতে দুপাশেই হালকা আলো পড়ে।
হেমেন বাবুর খাবার শেষে শ্যামলী এঁটেকাটা ছোট রান্নাঘরটায় রেখে এল। কাল সকালে ধুয়ে ফেলা যাবে। সে দরজা আটকিয়ে বিছানায় শোবার আগে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদু, আর কিছু লাগবে?’
হেমেন বাবু পান চিবাচ্ছেন আধশোয়া হয়ে। তিনি বললেন, ‘নারে শুয়ে পড়।’
শ্যামলী বিছানায় শুতেই ওপাশ থেকে হেমেন বাবু বললেন, ‘একটা গান শুনবি রে শ্যামা?’
‘কন।’
‘গান আবার কয় কীভাবে রে, গান মানুষ গায়।’
‘তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে
মলিন মর্ম মুছায়ে।
তব পুণ্য কিরণ, দিয়ে যাক মোর
মোহ কালিমা ঘুচায়ে’
তিনি চেষ্টা করলেন। বুড়ো মানুষের গলা। সুর ঠিকভাবে আসে না।
শ্যামলী খিক্খিক্ করে হাসছে। বুড়ো মানুষের মুখে গান শুনলে তার হাসি পাবারই কথা।
‘হাসছিস কেন, জানিস, এই গান হল একটি প্রার্থনা। আমরা যেসব কথা বলে প্রার্থনা করি তা আসলে নোংরা স্তুতি। স্তুতি মানে বুঝিস?’
‘না।’
‘ধর, তোষামোদ করা।’
‘তোষামোদ কী দাদু?’
‘তোকে কী করে বোঝাই, এই ধর, আমি সারাক্ষণ বললাম, তোমার চেয়ে সুন্দর কেউ নাই, তোমার চেয়ে ক্ষমতাশালী কেউ নাই, তুমি আমার রক্ষা কর্তা, তুমিই সব।’
‘এইবার বুঝছি দাদু হিহিহি।’
হেমেন বাবু তার বৃদ্ধ গলায় আবার গাইলেন –
‘লক্ষ শূন্য লক্ষ বাসনা
ছুটিছে গভীর আঁধারে
জানি না কখন, ডুবে যাবে কোন
অকূল গরল পাথারে…’
হেমেন বাবু থামলেন। বললেন, ‘একে বলে প্রার্থনা। আত্মশুব্ধির সঙ্গীত। আমরা পুরো জাতি ধরে যা করি তা হল আব্রাকাডাব্রা।’
‘হিহিহি আব্রাকাডাবরা।’ শ্যামলী রিপিট করল। শব্দটা তাকে বেশ মজা দিয়েছে।
একসময় ভালো গাইতে পারতাম রে। টুকটাক হারমোনিয়মে গানও তুলতে পারতাম। তবে আমার ছোট বোনটা, মানে আমার পরেই যে বোনটা ছিল, গাইতো সে! চমৎকার!! সে তোর মতোই স্বাস্থ্যবান ছিল। তোর মতোই শ্যামলা ছিল। তোর নামটা স্বার্থক হয়েছে রে। অবশ্য তার নামটা স্বার্থক হয়নি। তার নাম ছিল কৃষ্ণা। আহা, ছিল বলছি কেন? সে তো এখনো কলকাতা রেডিওতে গায়। তার নাম এখন কৃষ্ণা সেন। তুই বোধহয় শুনিসনি? সে গায় উচ্চাঙ্গ সংগীত।’
‘সেইডা আবার কী? হি: হি: হি:।’
‘আরে বোকা, গানের গোড়াই তো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত…’
তিনি আবার ডাকলেন, ‘শ্যামলী।’
‘দাদু?’
‘আগামী বছরই তোকে বিয়ে দিয়ে দিব। তোকে যখন তোর মায়ের কাছ থেকে আনি তখন কথা দিয়েছিলাম তোর বিয়ে দিব।’
‘আমারে বিয়ে দিয়ে দিলে আপনের ভাত রানবে কে? হি: হি: হি:।’
‘সেটা অবশ্য একটা কথা। কিন্তু আমার ভাত রান্নার জন্য তো তোর বিয়ে আটকে থাকতে পারে না। বুঝলি শ্যামলী, বিয়ে হল একটা বায়োলজিক্যাল ডিম্যান্ড।’
‘সেইডা আবার কি? হি: হি: হি:।’
‘অত হাসিস না। অত হাসতে নেই।’
‘দাদু, কে যেন আইছে, বাইরে টর্চের আলো দেখা যাইতেছে।’
কে এল রাত করে? রাত তো এগারোটার মতো বাজে। সুকুমার? না সুকুমার খবর নিতে আসলেও দশটার পর আসে না।
কে যেন দরোজায় টোকা দিচ্ছে। হেমেন গাঙ্গুলী বললেন ‘কে?’
ওপাশ থেকে খুক খুক করে কাশি দিয়ে কেউ একজন বলল, ‘আদাপ কাকু।’
হেমেন বাবু উত্তর নিলেন,‘আদাপ, কে?’
‘কাকা, আমি ছাত্তার।’
‘ছাত্তার মোল্লা।’ তিনি উঠে গিয়ে দরজা খুলে ডাকলেন, ‘আয়, ভেতরে আয়।’
ছাত্তার ভিতরে এল না। বলল, ‘ভেতরে আসপ না। জরুলি রুগী আছে, এটটু যাইতে হবে।’
ভেতরে ভেতরে হেমেন বাবু একটু অবাক হলেন। আবার খুশিও হলেন। ইমার্জেন্সি রোগী তার কাছে অনেকদিন আসে না। মানুষের মনে ধারণা হয়ে গেছে হোমিওপ্যাথি ব্যবস্থা ইমাজেন্সি রোগীর জন্য না। তা ছাড়া চারদিকে সব পাশ-করা এলপ্যাথি ডাক্তার। প্রত্যন্ত গ্রামেও যেখানে চার-পাঁচটি দোকান রয়েছে সেখানেও একজন মেডিকেল পাশ ডাক্তার বসে গেছে। টেথিস্কোপসহ নানা যন্ত্রপাতি রয়েছে। আছে হাই পাওয়ারের পেইন কিলার ট্যাবলেট।
তবে ছাত্তারের আসার হয়তো একটি বিশেষ কারণ আছে। হেমেন বাবুর বাড়ির উপর ছাত্তারের দুর্বলতা হয়তো জন্ম থেকেই। ছাত্তারের বাপ নুতা মোল্লা ছিল হেমেন বাবুদের বাড়ির পরেত। সকালে সে কাঁচি হাতে আসত। সারাদিন তাদের বাড়িতে এটা ওটা করত। কখনও গোলা পিটিয়ে ঠিক করা, পুকুরের চারিপাশে আগাছা তোলা, গোয়াল ঘরের সামনে ইট বিছানো এসবই ছিল নুতা মোল্লার দায়িত্বে। দু-আড়াই বছর বয়সের ছাত্তার সারাক্ষণ তার বাবার পেছনে পেছনে দৌড়াত। দুপুরে যখন উঠানে খাবার দেওয়া হতো কলাপাতায়, তখন বাবার সাথে বসে আয়েস করে খেতো। সত্যিই ছাত্তার এ বাড়িতে নতুন না।
কৈশোরে ছাত্তারের ধারণা হয় যে গাঙ্গুলীবাড়ি হল এই পৃথিবীর সবচে’ ধনী বাড়ি। তাই যখন যে ছোটখাটো চুরি-চামারি শুরু করে তখন গাঙ্গুলী বাড়িই ছিল তার মুল টার্গেট।
এ বাড়িকে ঘিরে ছাত্তারের অনেক কাহিনী আছে। ১৯৭১ সালের কথা। হেমেন বাবুর বাবা অতীন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী গত হয়েছেন তখন বছর পাঁচেক হয়ে গেছে। পাকবাহিনী যখন নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন হেমেন বাবুরা কয়েক ভাইবোন মাকে নিয়ে মহাবিপদে পড়ে গেলেন। যদিও ততদিনে বড়দা কলকাতায় চলে গেছেন। বাদবাকি ভাইবোনরা সব এখানেই। বৃদ্ধা মায়ের শরীর ভালো না। তিনি বিছানা ধরেছেন। এই অবস্থায় মাকে নিয়ে কলকাতা পর্যন্ত যাওয়া সহজ ব্যাপার না। তারা মাকে নিয়ে এই বাড়িতেই পড়ে থাকার চেষ্টা করলেন।
পাকবাহিনী এলাকায় পৌঁছে গেছে। শোনা যায় শুধু তাদের মুখে নাকি একই কথা, হিন্দু কাহা, লাড়কি কাহা !
হিন্দু পুরুষ হলে নিশ্চিত গুলি। আর মেয়ে হলে আটকে রেখে ধর্ষণ হত্যা। ঘরে সেয়ানা বোন। তারপরও ঘাপটি মেরে হয়তো থাকা যেত। কিন্তু সমস্যা হল এদেশেরই কিছু বাঙালি মুসলমান বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে তারপর পাক বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিচ্ছে।
অবশেষে মৃত্যু যখন ঘাড়ের উপর এসে দাঁড়াল, তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হল প্রত্যন্ত গ্রামে এক জ্ঞাতি বাড়ি আশ্রয় নেওয়ার।
যুদ্ধের প্রথম দিকেই ছাত্তারের বাপ একদিন হেমেন বাবুদের বাড়ি এসেছিল। তাকে কে-কী বুঝিয়েছে জানা নেই। নুতা বাড়িতে ঢুকে সবার কাছে বলল, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাইতেছি, দোয়া কইরেন। দ্যাশ স্বাধীন হইলে আর কষ্টের জীবন থাকপে না।’
হেমেন বাবুর বোন শিউলি সবার চাইতে জ্ঞানবুদ্ধি বেশী রাখে। সে বলল, ‘আপনে যুদ্ধ করবেন!’
নুতা মোল্লা হাসতে হাসতে বলল, ‘আমাগো গ্যারামে ডাকাইত পড়লে আমরা কি করি? লাঠি-সোটা নিয়া নামি না? আমাগো দেশটাও তো একটা গেরাম। এই বিরাট গিরামে ডাকাইত পড়ছে। বইসা থাকার সময় নাই দিদি!’
সেই যে নুতা মোল্লা পাকিস্তান আর্মি নামক ডাকাতের পেছনে ধাওয়া করল, আর ফিরে আসে নাই। সে ডাকাতের পেছনে ছুটছে। অনন্তকাল ধরে নুতা মোল্লা ডাকাতের পেছনে ছুটতে থাকবে। নুতা মোল্লাকে মনে হয় বিজয়ের এক চিরন্তন ভাস্কর্য। কোনো এক অজানা অস্তিত্বে অস্ত্র তুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে বিজয়ের হাসি। সত্যি কথা কি, এদেশে নুতা মোল্লারাই যতটুকু যুদ্ধ করেছিল। আর সব গালগল্প।
নুতা মোল্লা যুদ্ধে যাওয়ার দিন সাতেক পরের কথা। প্রত্যন্ত গ্রামে হেমেন বাবুদের জ্ঞাতি বাড়িতে কাউকে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তারপরও উপায় নেই, রওয়ানা হতে হবে। ঘাটে নৌকা রেডি হয়ে আছে। শুধু যার যার প্রয়োজনীয় দু-একটি জিনিস সঙ্গে নেওয়া হল।
গাঙ্গুলী বাড়ি থেকে ঘাটও মাইল দুয়েক দূর। মাকে পালা করে কোলে তুলে নেওয়া হল। ছাত্তারের হাতে একটা ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলছে। ছাত্তারের গায়ে তখন বেশ জোর। বয়স পনেরো-ষোলো হয়েছে।
সেই বয়সে ছাত্তার কারো কথা শুনতে চাইতো না। কিন্তু গাঙ্গুলী বাড়ির কেউ কিছু করতে বললে সে মাঝে মধ্যে শোনে। হয়তো ছোটবেলা থেকে বাপকে এই বাড়ির কাজ করতে দেখে কিছুটা উত্তরাধিকারের দায়িত্বপালন করে।
যুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে তখন যার কিছু নেই সেও একটা হাতিয়ার কাছে রাখার চেষ্টা করত। তিন-চার ফুট লম্বা রডের আগা চোখা করে কাছে রাখত। এক ধরনের আশ্রয়। ও-ই দিয়েই তারা পাক আর্মিদের ঠেকিয়ে দিতে চায়। এমন একটি রড ছাত্তারের হাতেও ছিল।
ঘাটের কাছে আসতে সবার নজর গিয়ে পড়ল খালের তীরে। অর্ধেক পানিতে, অর্ধেক ডাঙায় একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহ। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাথায় কালো, ঘন কোঁকড়ানো চুল। সবাই লাশটা দেখেও না দেখার ভান করে হাঁটতে থাকল। হেমেন বাবু বোনদের হালকা করার জন্যই বললেন, ‘একটা লাশরে।’ তার কণ্ঠস্বরে এমন একটা ভাব আনতে চেষ্টা করলেন যেন লাশ পড়ে থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু গলা কেঁপে গেল।
কেউ উত্তর দিল না। অসম্ভব এক সময়। সবাই লাশের স্থানটুকু দ্রুত পার হয়ে যেতে চায়। বোনরাও বড় বড় পা ফেলছে।
হঠাৎ ছাত্তার তার হাতের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। এক দৌড়ে লাশটার কাছে চলে গেল। সবাই তখন ওই দিকে ফিরে তাকাল। কী করছে ছাত্তার? ছাত্তারের কা- কেউ বুঝতে পারছে না। প্রথমেই সবার ধারণা হল লাশটাকে টেনে হয়তো পানিতে ভাসিয়ে দিতে গেছে। অথবা জীবিত আছে কি না দেখতে গেছে।
ছাত্তার লাশটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দু’পাশে দুইপা দিয়ে দাঁড়াল। বা হাতে ধরা শিখটা লাশের বুকসোজা খাঁড়া করে ধরল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গায়ের জোরে দু-তিন বার লাশের বুকের উপর রডের চোখা মাথা গেথে দিল! মনে হল মৃতদেহটি কেঁপে উঠল। ছাত্তার থু-থু করে দুবার থুথু ফেলল লাশের গায়ে। লাশটা যেন একটু নড়ে উঠল।
ছোট দুবোন ‘ও-মা-গো’ বলে শব্দ করে উঠল। শুধু শিউলী বিস্ফারিত চোখে ছাত্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী করলি! কার লাশ!’
ছাত্তার দাঁত বের করে হাসছে। বলল, ‘চিনি না, মরাতা।’ শিউলী চিৎকার করে উঠল। ‘খবরদার! তুই আমার ব্যাগে হাত দিবি না!’
কৃষ্ণা ডুকরে কেঁদে উঠল।
সবাই যখন নৌকায় উঠল তখন ছাত্তার ঘাড় কাৎ করে তাকিয়ে আছে।
নৌকা ছেড়ে দিল। ছাত্তারের ডান হাতে রড। বা হাত উঁচু করে চিৎকার করে বলল, ‘পলা-পলা মালাউন…।’
নৌকার ভেতরে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল শিউলী। সে বলল, ‘মরে গেলেও আমি আর ছাত্তারের মুখ দেখব না! তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল।’
ছাত্তারের মুখ সত্যি তার দেখতে হয়নি। এরপর ভাইবোনেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শিউলী চলে গেছে ওখান থেকে ভারতে। আর কোনোদিন বাড়ি ফিরে আসেনি। কিন্তু হেমেন বাবুরা ফিরে এসেছিলেন।
সম্ভবত সেই সময় থেকেই হেমেন বাবু ছাত্তারকে একটু-আধটু ভয় পান। তবে ছাত্তারের খারাপ চান না। শত হলেও সে নুতার ছেলে। নুতা দুইবেলা খেতে পায়নি ভালো করে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে যাবার সুবুদ্ধি তাঁর হয়েছিল। যা হেমেন বাবু নিজে পারেনি। আজও যে কারণে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। নুতা ছিল গাঙ্গুলী বাড়ির একজন। এ বাড়ির জন্য নুতা জান দিতে প্রস্তুত ছিল।
যুদ্ধের পর হেমেন বাবুরা যখন বাড়ি ফিরে আসেন – তখন তাদের বাড়িতে একটি মাছ কাঁটার বটিও নেই। বড় ঘরটিও ভেঙে নিয়ে গেছে কারা যেন। তবে কাঁসার জিনিসপত্র, কাঠের সিন্দুক থেকে শুরু করে অধিকাংশ জিনিস পাওয়া গেছে ছাত্তারের বাড়িতে। হেমেন বাবুরা কিছু ফেরত এনেছেন, কিছু ওদেরকে দানও দিয়েছিলেন। তাও ওই একই চিন্তায়, নুতা মোল্লার ছেলে তো।
ছাত্তারের আর্থিক অবস্থা এখন বেশ ভালো। কি করে অবস্থা ফিরেছে তা হেমেন বাবুর জানা নেই। সেই ষোলো বছর বয়সের ছাত্তারের শারীরিক গঠন আর বাড়েনি। সেই মুখে শুধু দাড়ি-মোচ গজিয়েছে। এক সময় তাতে পাক ধরেছে। কিন্তু বয়স বোঝা যায় না। মনে হয় যুবক। মানুষ বদলায়। এখন ছাত্তার বোধ করি নামাজ-টামাজও পড়ে। ধর্মে মন এসেছে। মাথায় গোল টুপিও দেখা যায়।
হেমেন বাবুর ধারণা, ছাত্তারের বৌ ভাগ্য ভালো না। পরপর তিনটা বৌ মারা গেছে।
ছাত্তারের সাথে যোগাযোগ না থাকলেও উপজেলা ছোট জায়গা, এখানে সব খবরই জানা যায়।
প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয় যে মেয়েটিকে ছাত্তার বিয়ে করেছিল, সেই মেয়েটি একবার হেমেন বাবুর কাছে এসেছিল। দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ মেয়েটি বসেছিল। হেমেন বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে মা? কী সমস্যা?’
মেয়েটি ছোট করে উত্তর দিল, ‘আমি ছাত্তার মোল্লার ইস্তিরি।’
‘তোমার কি সমস্যা?’
মেয়েটি কোন উত্তর দিল না। হেমেন বাবু ভাবলেন চিকিৎসা করাতে এসেছে। মেয়েলি সমস্যা হয়তো। মেয়েরা সাধারণত মেয়েলি সমস্যার কারণেই হোমিও চিকিৎসা করাতে আসে।
হেমেন বাবু যে দুজন রোগী দেখলেন তাদের বিদায় করে দিয়ে বললেন, ‘এখন বল মা, খুলে বল।’
ইতস্তত করে মেয়েটি বলল, ‘খুলে বলবো?’
‘হ্যাঁ, খুলে বল। লজ্জা শরমের কিছু নেই, চিকিৎসায় লজ্জা নেই। তা ছাড়া আমি তোমার বাবার মতো।’
‘আপনি আমার বাপের মতো?’
‘নিশ্চয়ই। কেন নয়?’
‘তাইলে কাকা আমারে বাঁচান !’
সে উঠে আসল। হেমেন বাবুর পায়ে পড়তে গেল। মেয়েটি থরথর করে কাঁপছে।
হেমেন বাবু তার পা সরিয়ে নিলেন। তিনি অস্বস্তি বোধ করলেন। বললেন, ‘আহা, সমস্যা কি বল না।’
সে বলল, ‘কাকা, আমারে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আমি তার সাথে ঘর করবার পারব না!’
‘কেন, সমস্যা কি?’
‘আমারে মাইরা ফেলাবে কাকা ! আমার মনটায় কইতেছে?’
‘তোমাকে মারবে কেন? কি দোষ তোমার?’
‘জানি না কাকা। তয় মারবে।’
‘আরে না বোকা। মানুষ মেরে ফেলা কী এত সোজা?’
মেয়েটি চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘সে মাঝেমধ্যে নেশা করে ঘরে আসে। আমারে মাঝে মধ্যে কয় – ’
‘কী বলে?’
‘এই সেই দিন যেমুন। সে নেশা কইরা আইছে। পর্থমে আমি বুঝতে পারি নাই। আমি তারে কইলাম খবর জানেন? সে কইল, কীসের খবর? আমি কইলাম আমি মনে হয় মা হবো। সে বলল, অত সুময় পাবা নাহ্। আমি অবাক হইয়া তার দিকে চাইলাম। সে কইল, তুমার সাথে একটা ইয়ার্কি করলাম। মাইনষের বাঁচা-মরা আল্লাহর হাতে। বাঁইচা থাকলে তো ভাল কতা।’
হেমেন বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এর মানে কি?’
‘আল্লা জানে কাকা। এর দুই দিন পর ঘরে আইছে। নেশা কইরা। খুটির কোণা থেকে একটা কিরিচ বাইর করছে। সেইটা হাতে নিয়া বিছানায় শুইল। আমি ভয় পাইছি দেইখ্যা কয়, মাইয়া মানুষ হইল জামের আটি। জাম খাওয়া শ্যাষ। আটি ফেলায় দেওয়ার নিয়ম। তুমার ভয় নাই। তুমি তো জামের আটি না, তুমি অইলা আনাম জাম।’
‘আমি তার কতা কিছুই বুঝতে পারলাম না কাকা। জিগাইলাম, মাইয়া মানুষ জামের আটিই-বা অয় কেমনে আর তারে ফেলায় ক্যামনে, কী কন এই সব? সে আমারে হাতের কিরিচ দেখাইয়া কয়, জামের আটি ফেলানোর সবচে সুবিধা এই জিনিস দিয়া। মুখ আটকাইয়া শুধু-শইলের খারাপ জায়গায় নাম নিয়া কয় – সেই যায়গা দিয়া ভইরা দিতে হয়। অবশ্য দুজন মানুষ অইলে ভালো হয়। তারপরে মুখের কোণায় একটু তাজা বিষ। কিল্লা ফতে।’
মেয়েটি এরপর অস্থির হয়ে উঠেছে। চাপা গলায় বলেছিল, সে তার আগের বৌরে মাইরা ফ্যালাইসে কাকা! আমি শুনছি। সে একা না। তার সাথে আরো অনেকগুলা মানুষ আছে। লোক সাথে লইয়া মারে। আপনে জানেন না, তারা সবকিছু করতে পারে। আমি জানি সে আমারে একা মারবে না। দুই তিন জন নিয়া মারবে। একজন হাত পা ঠাইসা ধরবে, একজন মুখ ঠছাইসা ধরবে।’ মেয়েটি ডুকড়ে কেঁদে উঠল, ‘আমি শুধু জানে বাঁচতে চাই কাকা! আপনে মুরুব্বি মানুষ জাইনা আপনের কাছে আইছি কাকা! আমার জীবনটা ভিক্ষা দেন।’
হেমেন বাবু অসহায়ের মতো চারদিকে তাকিয়েছেন। তারপর মেয়েটিকে বলেছিলেন, ‘তুমি ভুল জায়গায় আসছো মা। আমি এখন বনের ভেতর একটি বৃদ্ধ আগাছা।’
একবার হেমেনবাবু ভাবলেন মেয়েটি সাইকিয়াট্রিক পেসেন্ট কিনা। স্বামী, শাশুড়ির সঙ্গে উপরে উপরে ভালোবাসার অভিনয় করে অনেকে হাঁপিয়ে ওঠে। মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তারা নিজেরাও জানে না।
সর্বোপরি হেমেন বাবুর এখন কাউকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার অবস্থা নেই। সমাজে নিজেই এখন বহুকালের পুরানা জামার মতো, যিনি নিজের অন্নবস্ত্রের তাগিদেই কার্নিশ ধরে ঝুলে আছেন। হোমিওপ্যাথির পসার বসিয়ে শকুনের মতো বসে থাকেন। এর বাইরে সব ভূমিকা থেকে সমাজ তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
মেয়েটাকে নিয়ে হেমেন বাবু সারাক্ষণ চিন্তা করলেন। সন্ধ্যার পর তার মতোই আরেক বৃদ্ধ মকবুল সাহেব যখন চেম্বারে আসলেন, তখন হেমেন বাবু তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মকবুল কিরিচ কি জিনিসরে?’
মকবুল সাহেব কপাল ঘুচিয়ে চশমার ভেতর দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘কি? ইয়ার্কি মারিস? কিরিচ কী তা দিয়ে তুই কী করবি? কোমরে রাখবি!’
‘না জানতে চাইছি জিনিসটা কি? শব্দটা আমার কাছে নতুন।’
‘শব্দটা আসলে কিরিচ না, ক্রীস্। এটা মালয় দেশে ব্যবহার হতো। এক ধরনের লম্বা চিকন ছোরা, আমাদের দেশে আউট ল’ শ্রেণীর মানুষরা এগুলো এখন ইউজ করে। তবে এরা একটু ভিন্ন কায়দায় জিনিসটা বানায়। এরা লোহার রড জাতীয় কিছুকে চেপ্টা করে তার দুপাশে ধারালো করে নেয়। বড় খারাপ জিনিস।’
এর মাস দুয়েক পরে হেমেন বাবু চেম্বারে যাবার পথে শুনতে পেলেন ছাত্তারের বৌটা মারা গেছে। কেউ একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ‘প্যাটে বেদনা আছিল। সহ্য করতে না পাইরা বিষ খাইছে।’
এইতো বছরখানেক আগে ছাত্তারের তিন নম্বর স্ত্রী মারা গেল। হেমেন বাবু দোকানে বসে খবর পেয়েছিলেন। এই নিয়ে উপজেলার মৃদু ঝড় উঠেছিল। কেউ কেউ বলেছে ছাত্তার বৌগুলারে মাইরা ফেলায়। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কিন্তু মানিক সরদারের ধমকে সব নীরব হয়ে গেছে। আজকাল কেউ আর নিজের খেয়ে বনের মোষ দাবড়াতে যায় না। মানিক সরদার ক্ষমতাশীল লোক। কী দরকার তার চোখে শত্রু হয়ে। ব্যাপারটা কী চিন্তা করেও হেমেন বাবু কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। আসলেও কী ছাত্তারের স্ত্রীরা মরে যায়, নাকি হত্যা?
প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। অমাবস্যার রাত। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছাড়া ছাড়া বাড়িগুলোর কোনো কোনোটি ঘরের বাইরে দরজার সাথে ষাট পাওয়ারের বাল্ব মিট মিট করে জ্বলছে।
ছাত্তারের দেখানো পথ ধরে হেমেন বাবু অনেকটা দূরে চলে এসেছেন। মিটমিট করে জ্বলা বাল্বগুলোর এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে পথ চলতে কোনো অসুবিধা নেই। ছাত্তারের সাথে আরো অন্তত তিনটি ছেলে । দুজনের হাতে টর্চ রয়েছে।
এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো হেমেন বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও ছাত্তার, অসুখ কার? কী হয়েছে?
‘আপনি কাকা চিনবেন না। তারা নতুন বাড়ি করছে। চলেন।’
‘অসুখটা কী, বলতে পারিস?’
‘প্যাটের বেদনা। গেলেই দেখতে পারবেন। কাকা, এই ডাইনপাশ দিয়া নামতে অবে।’
‘বলিস কি! এই চকের মাঝ দিয়ে?’
‘হ, চকের মইধ্যে দিয়া।’
ছাত্তারের গলায় একটা আদেশের ভাব। হেমেন বাবুর এখন একটু একটু ভয় লাগছে।
ছেলেগুলোকে তিনি চিনতে পারেন নি। এরা বয়সে সবাই ছাত্তারের ছোট। ছাত্তার এদের সাথে তুই-তুমি করে কথা বলছে। এরা সবাই ছাত্তারকে কেউ আপনি সম্বোধন করছে। হাতখানেক পিছনে থাকা ছেলেগুলো সমানে বিড়ি সিগারেট ফুকছে।
ভয় ভয় করলেও তার মনে একটা আত্মবিশ্বাস আছে। শত হলেও ও ছাত্তার তো। নুতা মোল্লার ছেলে। নুতা মোল্লা মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্ক আছে এমন মানুষ অন্তত বিনা কারণে হিন্দুর কোনো ক্ষতি করবে না। মুক্তিযুদ্ধ আর হিন্দুর মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে।
ছাত্তার খুকখুক করে কাশলো। বলল, ‘কাকা, ভুটাভুটি তো চইলা আইল। ভুট দিবেন কীসে? নৌকা না ধানের শীষ?’
হেমেন বাবু বললেন, ‘দেখা যাক। এখনো ঠিক করিনি।’
ছাত্তার বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘বুড়া হইয়া গেলেন, এখনো মিথ্যা কথা কন ক্যা?’
হেমেন বাবু এই প্রথম নিশ্চিত বুঝলেন, ছাত্তারের ডাকে বের হয়ে আসা ঠিক হয়নি। ওর মর্জি ভাল বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বললেন, ‘মিথ্যা কী বললাম?’
‘নৌকা থুইয়া হিন্দুরা আর কিছুতে ভুট দেয় নাকি।’
হেমেন গাঙ্গুলী একটু বিব্রত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, কথা তো মিথ্যা না। এর উত্তর কী? শেষে বললেন, ‘তুমি নৌকায় ভোট দাও না? তুমিও তো নৌকার লোক।’
ছাত্তার খিক খিক করে হাসল। বলল, ‘নাইড়া ব্যালতলা যায় একবার। বাংলাদেশের মানুষ গ্যালো দুইবার। আর না। মুসলমান ভুট দিয়া হিন্দুগো ক্ষমতায় আর আনবে না।’
‘তুমি না এতকাল আওয়ামী লীগ করলে?’
ছাত্তার আবার হাসল, ‘আসলে অভাবে থাকতে থাকতে আমার মাথাডাও গ্যাছে।’
হেমেন বাবু কোনো কথা বললেন না।
ছাত্তার বলল, ‘আমি একজন খারাপ লোক। আমার যেদিক সুবিধা আমি সেইদিক আছি। বাংলাদেশে আমার মত লোকের সংখ্যাই বেশি। আচ্ছা, আপনেরে একটা কতা জিগাই?’
হেমেন বাবু তাকিয়ে থাকলেন।
ছাত্তার জিজ্ঞেস করল, ‘বলেন তো মওদুদ আহমেদ আসলে কোন দলের লোক?’
হেমেন বাবু কিছু বললেন না। ছাত্তারের সঙ্গে কেন বের হয়ে এলেন তা নিয়ে ভেতরে ভেতরে রাগ হচ্ছে।
ছাত্তার বলল, ‘সেই হইল আমার আসল গুরু। যাইক, রাজনীতির কতা বাদ দেন। কাকা, এইডা আপনে কী করতেছেন?’
‘কোনটা?’ হেমেন বাবু জানতে চাইলেন।
‘আপনে বুড়া মানুষ, বাপের চাইতেও বেশি বয়স, বিয়া শাদি করেন নাই, ভালো কতা। কিন্তু এইডা কী?’
‘তুই কীসের কথা বলছিস?’
‘আপনে এক ঘরের মইধ্যে অল্প বয়সী একটা মাইয়ারে পুরা ন্যাংটা কইরা সারা রাইত ফূর্তি করতেছেন, ছি: কাকা ছি:।’
‘কী! কী বলছিস তুই!’
‘হাটেন! ঠিকই কইছি। ফূর্তি করতে করতে আবার গান বাজনা করেন, ছি:।’
‘ছাত্তার! আমি বৃদ্ধ মানুষ! ও আমার….’
ওই কতা কইয়েন না। বুইড়া মাইনষের জন্য ঔষুধ বাইর হইছে, আমরা জানি। সেইডা কোন কতা না। আমাগো এইডা ইসলামের দ্যাশ। ঐসব নুংরা কাম অইতে দেওয়া যায় না।’
‘ছাত্তার, আমি কী দুঃস্বপ্ন দেখছি!’
‘দুঃস্বপ্ন দ্যাখপেন ক্যান? আইজ আপনের বদলে আমরা একটু ফূর্তি করব।’
তিনি কিছু বলার আগেই কে যেন পিছন থেকে ঘাড়ের উপরে শক্ত করে চেপে ধরল। তিনি ধপাস্ করে মাটিতে বসে পড়লেন। শরীরের ঝাঁকিতে তার মাথার মধ্যে চক্কর দিয়ে উঠল। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করতে থাকল।
‘ছাত্তার সঙ্গের ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলল, যা, মাইয়াডারে নিয়া যা। জোরজারি করিস না। ভদ্দরমত যাইয়া ক’ ডাক্তার কাকা অসুস্থ অইয়া পড়ছে। তুমারে এহনি যাইতে কইছে!’
তিনটি ছেলে হন্হন্ করে হেমেনবাবুর বাড়ির দিকে রওনা হল। পেছন থেকে ছাত্তার বলল, ‘পথের মইধ্যেই আবার সুহাগ করতে যাইস না, সাবধান!’
হেমেন বাবুর সারা শরীর ঝিমঝিম্ করছে। তিনি কোনো দিশা পাচ্ছেন না। মাথার মধ্যে মনে হচ্ছে ফাঁকা হয়ে গেছে। তিনি মিনতির সুরে বললেন, ‘ছাত্তার, তোর বাপ, আমাদের আপন লোক ছিল। তার দোহাই লাগে বাবা, এত বড় সর্বনাশ করিস না….’
ছাত্তার কোমর থেকে পিস্তল জাতীয় কিছু একটা বের করল। হাঁটু গেড়ে হেমেনবাবুর সামনে বসল। দাঁত কিরমির করে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কলাপাতায় ভাত খাইলেও খাইছি। তাই জানে মারব না! কিন্তু এইটা নিয়া লোক জানাজানি করলে ঠিক্ কাইল রাইতে এইখানে লাশ পইরা থাকবো মালাউনের বাচ্চা… ফিরানের কেউ নাই। এক ফোঁটা ঝামেলা অইলেই ডাইরেক্ট চিতা। এই দ্যাশে কিন্তু মালাউন কাটার বিচার নাই!’
পুরো ঘটনা হেমেনবাবুর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ওরা তাকে ছেড়ে চলে যাবার পর তিনি সাধ্যমতো দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটলেন। তার মনে হচ্ছে হয়তো কিছুই হয়নি। তিনি বাড়ি গিয়ে দেখবেন শ্যামলী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তার ডাক শুনে কাচা ঘুম থেকে জেগে দরজা খুলে দেবে। বলবে, ‘এত দেরি করলেন ক্যা দাদু?’
তিনি বাড়ি পৌঁছে দেখলেন দরজা হা করে খোলা। টিমটিম করে হারিকেন জ্বলছে। ছুটে গেলেন শ্যামলীর খাটের কাছে। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলেন, ‘শ্যামলী…।’ কেউ নেই। ফাঁকা চৌকি পড়ে আছে। শুধু সারা ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে শ্যামলীর হাসি, ‘ও দাদু, হি: হি: হি:…।’
আপদে-বিপদে মানুষ সর্বপ্রথম ছুটে যেতে চায় আপন মানুষের কাছে। কাছের মানুষের কাছে। কিন্তু কে আছে তাঁর? ভাই-বোন যারা বেঁচে আছে তারা সীমান্তের ওপারে। সবাই যার যার সংসার, কাজের চাপ নিয়ে ব্যস্ত। তাঁর নিজের বলতে তিনি এই জগতে একা। সম্পূর্ণ একা।’
এগারো বছর বয়সে হেমেন বাবু সর্বশেষ কেঁদেছিলেন। একটা ছেলে তাঁর ঘুড়ি কেঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল। কান্না দেখে বড়দা তিনটি ঘুড়ি কিনে দিয়েছিলেন। এরপর কলকাতায় মায়ের মৃত্যু হয়েছে শুনে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু কাঁদেননি। বয়স্ক মানুষের কান্নাকাটি মানায় না। আজ তিনি ঘরের মেঝেতে লেপ্টে বসে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।