শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
খুব ভোরে খানিকটা বৃষ্টি হল। বর্ষা মৌসুম ছাড়া খুব ভোরে সচরাচর এমন বৃষ্টি হয় না। এমন বৃষ্টিতে আরো জমিয়ে ঘুম হয়। কিন্তু অখিল পোদ্দারের ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেল। ব্যস, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করতে শুরু করল। রাতে ঘুম ভাল হয়নি। এ সবই বোধকরি বয়সের লক্ষণ।
তিনি বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। জানালা দিয়ে ঘরে শীতল বাতাস ঢুকছে। সকালের আলো ঢুকছে। হালকা-পাতলা মধ্যবয়স্ক শরীরে ঠান্ডা ভাবটা এসে লাগছে। তিনি আয়নার দিকে ঝুকে দুই আঙুল দিয়ে কণ্ঠনালীর চামড়া টেনে দেখলেন। হুম, কাপড়ের মত ঢিলে হয়ে আসছে। তিনি শুনেছেন, মানুষের বার্ধক্য নাকি প্রথম উঁকি দেয় কণ্ঠনালীর চামড়ায়। এরপর ধরা দেয় চোখের দু-কোণে। তারপর মুখে বলিরেখাগুলো ছবি আঁকতে শুরু করে। মাকড়শার জালের মতো মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই জাল জীবনকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর কাছে অবাঞ্ছিত করে তোলে। এক সময় লাথি মেরে পৃথিবী থেকে বের করে দেয়। এই মাঝ বয়সেই অখিল পোদ্দারকে লাথি খাওয়ার সেই ভয় চেপে ধরতে শুরু করেছে।
তিনি আয়নার দিকে আরো খানিকটা ঝুঁকে চোখের দু’কোণ ভাল করে লক্ষ করলেন। দু’-চোখের কোণায় অতি চিকন রেখা দেখতে পেলেন। হাত তুলে চোখের সামনে ধরলেন। চামড়ার সেই টানটান ভাব যেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই একটি ছোট নিঃশ্বাস বুক থেকে ঠিকরে বের হল। জীবনকে যদি একদিনের চারটি স্কুল ক্লাসের সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে বাংলা-ইংরেজি প্রথম দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। সামনে পড়ে আছে জীবনের নিরস দুই সাবজেক্ট-অঙ্ক আর ধর্ম। এ জীবনে এখন আর নতুন কোনো গল্প সৃষ্টি হবে না। ফেলে আসা জীবনের গল্পগুলোর হিসাব কষতে কষতে কেটে যাবে বাকি সময়। নিজেকে সান্ত¦না দিয়ে অখিল ভাবলেন, হবে না কেন? আর কত! মনে মনে নিজের বয়স হিসাব করতে চেষ্টা করলেন। পয়ষট্টির যুদ্ধের সময় তো বেশ বড়! এখনো সব স্পষ্ট মনে আছে। ১৭ দিনের সেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকেও কেমন মোচড় দিয়ে গেল। তারপর থেকে কত কাহিনি ঘটে গেল! কত চড়াই-উৎরাই, কত আনন্দ, কত ব্যাথা। ইদানীং তার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে সেগুলো তাঁকে এক ধরনের আনন্দ দেয়। এক সময় তিনি ফুটবল খেলতেন। তখন বাংলাদেশে ছিল ফুটবলের জমজমাট অবস্থা। আহারে! গ্রামগঞ্জ থেকে কৃষিকাজ ফেলে রেখেও মানুষ ফুটবল খেলা দেখতে ছুটে আসতো। এখনকার দিনের মত বিদেশি ফুটবল খেলা দেখা হতো না। দেশের ফুটবল নিয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই মাতোয়ারা হয়ে থাকতো। জেলায় জেলায় ফুটবলের আসর বসতো। এখন আর সেই আনন্দ নাই। ফুটবলে বাংলাদেশ যেন পেছনে ফিরে হাঁটছে। কোথায় গেল সেই দিন? অখিল পোদ্দারের তখন কী কদর! বল ড্রিবলিং করে যখন গোলের কাছে নিয়ে যেতেন তখন দর্শকের কি চিৎকার! বুকটা স্ফীত হয়ে যেত সেই চিৎকারে। পায়ে দ্বিগুণ জোর পাওয়া যেত। মনে হতো সেই চিৎকার থেকে যেন শক্তিসুধা বাতাসে ভর করে শরীরে এসে প্রবেশ করতো। এখনো তিনি হঠাৎ মনের অজান্তে সে চিৎকার শুনতে পান। বুকটা হঠাৎ স্ফীত হয়ে ওঠে। এই ছোট শহরের সব মানুষ তাঁকে কত আদর করতো! কত সমীহ করতো! মানুষগুলো ছিল অনেক সহজ-সরল। তিনি ভাল ফুটবল খেলতেন বলে লোকে মনে করতো ভাল হাডু-ডু খেলতে পারবেন। তাই দূর-দূরান্ত থেকে হাডুডু খেলার জন্য তাঁকে ভাড়া করতে আসতো।
অখিল পোদ্দার খাটের দিকে চেয়ে দেখলেন নিয়তির মা গভীর ঘুমে। তিনি একা একাই মুচকি হাসলেন। নিয়তির মা’ও আগের মত নেই। গতরাতের কথা মনে পড়ল। বেশ কয়েকদিন পর তিনি আল্পনার সাথে মিলিত হয়েছিলেন। ইদানীং মাসে দু-একবারের বেশি হয় না। বয়সের কারণে। অনেকটা বাংলাদেশের ফুটবলের মত অবস্থা। আল্পনা এখন আর বিশেষ আগ্রহ দেখায় না। জোরাজুরি করলে ফিস্ফিস্ করে বলে, ‘নিয়তি বড় হইতেছে, এখন এগুলা বাদ দেন। ও যদি জাগুন থাকে? শব্দ পাবে তো! তারপর আর বাধা দেয় না।’
সংসারের ঝক্কি ঝামেলায় আল্পনাও শরীরের চেয়ে মনের দিক দিয়ে যেন বেশি বুড়িয়ে গেছে। অথচ বিয়ের পর নবদম্পতির কী উদ্যম ছিল! অখিল পোদ্দার এ ছুতায় ও ছুতায় তাড়াহুড়ো করে দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকে ছুটতেন। তখন মা জীবিত ছিলেন। জেঠি-পিসিরা সব যার যার ঘরে ব্যস্ত। আল্পনা মায়ের পেছনে বসে মিটিমিটি হাসত। মতলব বুঝত পারতো। কাছে ঘেঁষতে চাইত না। একটু সরে থেকে অখিল পোদ্দারের অস্থিরতা দেখে মজা পেত। অখিল গম্ভীর হয়ে বলতেন, ‘কই, একগ্লাস জল দিয়া যাও তো।’
প্রায় অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে উঁকিঝুকি করতেন। তর সইত না।
মায়ের পেছন থেকেই ইশারায় ভেংচি কাটত আল্পনা। যার অর্থ, পারব না জল দিতে! জল হল ছুতা, আমি বুঝি না কেন ডাকতেছেন?
বয়স্ক মানুষের মাথায় সবসময় যৌনতার চিন্তা থাকে না। অখিলের মা বিষয় না বুঝেই পান বানাতে বানাতে বলতেন, ‘দেখ্ তো মা, অখিল জল চাইতেছে মনে অয়।’
আর গতি কী। পরাজিত হয়ে মায়ের সামনে ঘোমটা টেনে কাঁসার গ্লাসে জল নিয়ে ঘরে ঢুকত। এ পরাজয় কাঙ্খিত পরাজয়, মধুর পরাজয়। নিশ্চয়ই আল্পনার এ পরাজয় ভাল লাগতো। মুখে তাঁর মিষ্টি এক টুকরো আপত্তি। চোখে সলজ্জ আহ্বান। জলটল আসলে কিছু না। হাতের জল টেবিলে রাখার সুযোগ মিলতো না। রিন-ঝিন করে বেজে উঠত আল্পনার হাতের চুড়ি-শাখা জল তরঙ্গের মত। ছন্দে ছন্দে আদিম নৃত্যের লঘুলয়ে, দীর্ঘলয়ে ঝুমুরের মত বাজতে থাকত। পরেশপুর গ্রামের প্রকৃতিও যেন চুড়ির শব্দ কান পেতে শুনত। নিস্তব্ধ গ্রাম লজ্জায় যেন আরো গুটিয়ে যেত।
ঘর থেকে বের হয়ে আসত আল্পনা। পা চলত না। এলোমেল শাড়ি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কপালে যতœ করে দেওয়া সিঁদুরের ফোঁটা লেপ্টে গেছে। আল্পনার হলদেটে মুখ কেমন লাল হয়ে গেছে। নিজেকে সে লুকানোর পথ খুঁজত। অখিল ঘরের খাটে বসে মিটিমিটি হাসতেন। বৌয়ের লজ্জা উপভোগ করতেন। ততক্ষণে মা উঠে গোয়াল ঘরের দিকে চলে গেছেন। গরুগুলো ঠিকঠাক আছে কি না দেখতে।
সন্ধ্যার আগেই অস্থির হয়ে দৌড়ে ফেরার মোহ এখন আর নেই। অখিল বাবুর অজান্তেই নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার মত সে তৃষ্ণা যেন শুকিয়ে আসছে। এ কি শুধুই নিজের ফুরিয়ে যাওয়া? সব মোহই নাকি একদিন ফুরিয়ে যায়, সব আকর্ষণের মাত্রা মিটারের কাঁটার মত নামতে থাকে। এটাই নাকি প্রকৃতির নিয়ম।
সারাদিন এই রোদ, এই মেঘ করে কেটে গেল। অখিল পোদ্দার সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে থাকলেন। আজই তিনি প্রথম উপলব্ধি করলেন, মানুষ মনে মনে গান গায়। বেচাকেনা করতে করতে আজ সারাদিন তিনি মনে মনে একটি গান গুনগুন করেছেন – দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়, রইল না, রইল না সেই সে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
বয়সের সঙ্গে মানুষের গানের রুচিও ঘুরে যায়। যৌবনে তিনি অনেক গান শুনেছেন। কয়েকজন বন্ধু মিলে একসঙ্গে বসে রেডিওতে গান শুনতেন। এক সময় টেপ রেকর্ডার আসল। তখন মান্না দে, হেমন্ত, পিন্টু ভট্টাচার্যের গানের খুব কদর। লতা, মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার কত শিল্পী! রবীন্দ্র সঙ্গীত খুব একটা শোনা হতো না। এখন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভাল লাগতে শুরু করেছে। তিনি সারাদিন গুনগুন করে ‘দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায়’ গানটি গাইলেন।
সন্ধ্যায় বাজার মসজিদের মাইকে ফু দিচ্ছে। আজানের প্রস্তুতি। বাজারের সবক’টি দোকানের বাতি জ্বলে উঠল। শুধু অখিল পোদ্দার দোকানের বাতি না জ্বালিয়ে ঝাঁপ নামিয়ে তালা দিলেন। ভাল করে তালা টেনে দেখলেন ঠিকমতো লেগেছে কিনা। একটি বিষয় অখিল পোদ্দারের বড়ই ভাল লাগে। তিনি লক্ষ করেছেন, মাইকে আজান শুরু হলেই হিন্দু দোকানদাররা গনেশ ঠাকুরের পুজো দিতে শুরু করে। মনে হয় যেন পুজো দেওয়ার জন্য মসজিদ থেকে ডাক দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এ ঘটনায় তিনি হিন্দু মুসলমানকে কোথায় যেন একই পথের যাত্রী দেখতে পান। শুধু ব্যাখ্যা করতে পারেন না।
পাশের দোকানের হরিপদ বণিক গনেশ ঠাকুরের সেবা শেষ করে দেখল অখিলদা দোকান বন্ধ করছে। বলল, ‘দাদা দোকান বন্ধ করতেছেন ক্যা, কোথাও যাবেন নাকি?’
অখিল পোদ্দার ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাবো। হরিপদ, একটা জামা গায়ে দিয়া বয়! আর না হোক একটা গেঞ্জি গায়ে দে। খালি গায়ে দোকান করিস ক্যান? তার মধ্যে আবার একটা ভুঁড়ি বাহির হইতেছে।’
হরিপদ নিজের পেটের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, ‘কী করবো দাদা, গরমে টেকা দায়! দুকানের মধ্যে তো আগুন। জামা গায়ে রাখলে কিটকিট কইরা কামড়ায়। আপনে যান কই?’
‘যাব আর কোথায়? মোল্লার দৌড় মসজিদ আর ঠাকুরের দৌড় মন্দির পর্যন্ত। তেমন কোথাও যাই না। শরীরটা সারাদিন ম্যাজ ম্যাজ করতেছে। একটু নড়াচড়া করি। হেমেন কাকার সাথেও একটু দেখা কইরা আসপো। বেচারা একা মানুষ, কী খায় কী করে তার ঠিক নাই। মাটি কামুড় দিয়া পইড়া থাকা স্বভাব।’
হরিপদ চারদিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘হেমেন জ্যাঠারে চইলা যাইতে কন! তার তো আর ঐখানে কোনো সমস্যা নাই। ভাই-বেরাদার আছে, ভালই থাকপেন। এইখানে পচতেছে ক্যান?’
অখিল পোদ্দার ঠোট উল্টিয়ে বললেন, ‘অনেক কইছি। যাবেন না। ঐখানে সবাই ভাল আছে শুইনা কী কয় জানিস?’
‘কী কয়?
‘কয়, ভাল আছে কি-রে? পরদেশে কোনো দিন ভাল থাকা যায়?’
হরিপদ আরো নিচু স্বরে গোস্বা করে বলল, ‘এই হইলো কাকার ঠ্যাটামি। কলকাতা বলে পরদেশ! মাথা নষ্ট হইছে জ্যাঠার। ওই যে মুসলান এক বুড়া আছে না মকবুল কাকা, মাথাডা সে খাইছে।’
হরিপদ একটু সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘রাজনীতির কী অবস্থা, কিছু বুঝতেছেন!’
অখিল পোদ্দার গায়ে মাখলেন না। হাঁটতে শুরু করলেন। হাঁটা একটু থামিয়ে পেছন ফিরে বললেন, ‘আমাগো কি! রাজা আসে রাজা যায়, গাঙের তাতে কী! কিন্তু একটা কথা জানিস হরিপদ? এই যুগে আইসা, এখন আর মুর্খ লোকের মত মার্কা দেইখা ভোট দেওয়া ঠিক না। বহুবছর তো দিলাম, লাভ হইছে কোনো? এইবার লোক যে ভাল হবে, বুইঝা শুইনা তারে ভোট দিব। কোন দলের লোক তা আর দেইখা লাভ নাই।’
হরিপদ বণিক দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘হে হে, আপনি কী কইতেছেন?’
‘ঠিকই কইতেছি, তুই দেখিস। এবার ভাল লোক যারে মনে হবে, তারে ভোট দিব।’
অখিল পোদ্দার উত্তরের অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করলেন। হরিপদ পেছন থেকে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আপনের মাথায়ও খাইতেছে, এইসব হেমেন কাকা ঢুকাইছে!’
অখিল পোদ্দার শুনলেন। কিন্তু আর পেছন ফিরলেন না। হরিপদ’র কথা যে পুরোপুরি মিথ্যা না সেটা অখিল পোদ্দারও উপলব্ধি করেন। হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন। হেম কাকার সাথে নিজের মিল যে কিছু আছে সেটা অখিল পোদ্দার বুঝতে পারেন। অন্তত একটি বিষয়ে দু’জনের মিল আছে। অনেক বছর আগে হেম কাকার পরিবারের অবশিষ্ট সবাই যখন ওপার চলে যায় তখন তাকেও খুব চাপাচাপি শুরু করল। অখিল পোদ্দারের সে কথাগুলো স্পষ্ট মনে আছে। সবাই হেম কাকাকে জোর করে নিয়ে যেতে চায়। তখন কাকা ছিলেন লম্বা, একহারা গড়নের এক মধ্যবয়সী সুপুরুষ। সবাই তাঁর কথা খুব মেনে চলত। কিন্তু সেদিন কেউ তাঁর কথা মানতে চায়নি। ভাই, বোন সবাইকে কাছে ডেকে এনে হেমেন কাকা শক্ত কণ্ঠে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বললেন, ‘আমি বিদেশ যাব না!’
বাড়ির সবাই হা করে ফেলল। এমন অদ্ভুত কথা কেউ কখনো শুনেনি! কলকাতা নাকি বিদেশ! কলকাতা কি বিলাত না আমেরিকা?
হেম কাকা বললেন, ‘আমার কাছে বিলাতও যা, ওই ভারতও তাই। বিলাতেও আমি যেমন ফরেইনার, ভারতেও আমি ফরেইনার। তোমরা থাকবা না যাও। তোমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে কোলকাতা ফিভার। যাও, চোরের মতো থাকগে। আমার কাছে পরদেশের রাজপ্রাসাদের চাইতে নিজ দেশের জেলখানাও ভাল।’
তারপরও হেমেন কাকার ভাই, বোন, পরিবারের সবাই জোরাজুরি করতে থাকল।
হেমেন কাকা রাজকীয় ভঙ্গীতে একটি ইজি চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী একটি হাসি দিয়ে ছোট ভাই নৃপেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ জন মিলটনের একটি উক্তি আছে জানিস?’
ছোটভাই নৃপেন গাঙ্গুলী বললেন, ‘বল শুনি তোমার উক্তি।’
‘বেটার টু রেইন ইন হেল দেন টু সার্ভ ইন হ্যাভেন।’
নৃপেন চোখ তুলে বললেন, ‘তার মানে তুমি নরকের রাজা?’
হেমেন কাকা মুখে কিছু বলেননি। শুধু হ্যাঁ সুচক মাথা নেড়েছেন।
নৃপেন গাঙ্গুলী ধরা গলায় বলেছিলেন, ‘নরকের রাজা হয়ে থাকতে পারলে যেতাম না দাদা। থাকতে হবে নরকের রাস্তার কুত্তা হয়ে, এটাই সমস্যা।’
কয়েকদিন পর এক ভোরে অখিল পোদ্দার গিয়েছিলেন ওই বাড়িতে। আগে থেকেই বলা ছিল সে যেন কিছুদূর পর্যন্ত সবাইকে এগিয়ে দেয়। হেমেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর মা তখনো বেঁচে ছিলেন। চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট। বোধশক্তি কমে গেছে। এত বেশি বয়সের মানুষের সিদ্ধান্ত সংসারে টেকে না। তাঁকে শুধু বস্তার মত নামানো ওঠানো হয়। সে তুলনায় অবশ্য গাঙ্গুলী বাড়ির কালচার ভাল ছিল। শেষ মুহূর্তে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কত্তা (অখিল পোদ্দাররা তাঁকে কত্তা ডাকতেন) হেমেন কাকার কাছে এলেন। কাকা ভক্তিভরে মাকে প্রণাম করলেন। কত্তা হেমেন কাকার মুখটা দু’হাত দিয়ে ধরে কপালে একটি গভীর চুম্বন করে ঘুরে দাঁড়ালেন। একটি কথাও বললেন না। যেন ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেলেন। নীরব মানুষটিকে দেখে অখিল পোদ্দারের মনে হয়েছিল তিনি আসলে যেতে রাজি ছিলেন না। হেমেন কাকার মা বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। মনের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত হলে তাঁর মাথাটা শুধু কাঁপতে থাকতো। সেদিন ভোরে তাঁর মাথা থরথর করে কাঁপছিল।
তেমনি বছর দুয়েক আগের ঘটনা। জানুয়ারি মাসের এক শীতের ভোর। অখিল পোদ্দারের এক ভাই আর দুই কাকা দেশ ছেড়ে চলে গেল। যাবার কয়েকদিন আগে সবাই মিলে তাঁকেও খুব চাপাচাপি করেছে। কিন্তু অখিল পোদ্দার কোনোক্রমেই যেতে রাজি না। এক পর্যায়ে কলহের মতো শুরু হয়ে গেল।
অখিল পোদ্দার চোখ গরম করে ছোট ভাই দুলাল পোদ্দারকে বললেন, ‘সারা জীবন তো গেলাম না! আইজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, আর এখন ওপার যাব?’
দুলাল ক্ষোভ নিয়ে বলল, ‘দাদা, এই দ্যাশে আমাগো কোনো দল নাই। আমরা হইলাম মাইনরিটি। বাংলাদেশের কথা বাদ দেও, কোন সভ্য দেশের মাইনরিটি হওয়ার চাইতে বনে গিয়া বাঘের সাথে বাস করাও ভাল।’
অখিল পোদ্দার উঁচু গলায় প্রতিবাদ করে ছোটভাইকে বললেন, ‘আমি মাইনরিটি-ফিটি না! একই ভাষায় কথা কই, একই রকম গায়ের রঙ, একই পুকুরের মাছ খাই, একই খেতের ফসল খাই। আমি মাইনরিটি কীসের? আমার যেমুন আনন্দ বেদনা আছে, মুসলমানেরও তেমনি আনন্দ বেদনা। দেখিস নাই, আমি যখন ফুটবল খেলতাম, তখন কি শুধু হিন্দুরাই অখিল-অখিল কইরা চিৎকার করতো? নাকি মুসলমানরাও? একটা কথা মনে রাখিস দুলাল, অখিলের পরিবাররে কেউ হিন্দু বইলা দ্যাখে না। জাত দিয়া বিচার করে না! তাই খামোখা দ্যাশ ছাইড়া যাইয়া এই দ্যাশের মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ছাড়া আর কিছু না! দেখিস নাই বাংলাদেশের সংবিধান? কোথাও লেখা আছে যে হিন্দুর অধিকার মুসলমানের চেয়ে কম?’
দুলাল একদিকে গাল বাঁকা করে হাসল। ঘরের সবাই তার দিকে তাকাল। সে নিচুস্বরে বলল, ‘লেখা আছে দাদা। পরিষ্কার লেখা আছে, এই রাষ্ট্রের ধর্মের নাম ইসলাম! পরিষ্কার লেখা আছে, আল্লাহর নামে শুরু করতে হবে! ভগবান, ঈশ্বর, গড সবাই হইল এইখানে আল্লাহর অধীনস্ত!’
অখিল পোদ্দার বললেন, ‘এইগুলা রাজনীতিবিদরা তাগো প্রয়োজনে করছে। তোর আমার কী? রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হওয়ার পর তুই দুর্গাপূজা করিস নাই? করতেছিস না?’
‘করতেছি দাদা। নজরুল কবির কবিতায় আছে না – আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুস্পের হাসি। ওরকম আগুনে বইসা হাসতেছি। শুধু একটা কথা কই। মুসলমানের যেমুন ধর্ম আছে, আমারও তেমুন ধর্ম আছে। সন্ধ্যাবেলা মুসলমান যেমন নামাজ পড়তে যায়, আমিও তেমনি পূজা দিতে যাই।’
‘তুই কবে পূজা দিতে যাস?’
‘আহা, কথা বুঝ না কেন! আমি না যাই, আর দশটা হিন্দু তো যায়। আমি সেই হিন্দুগো কথা কইতেছি। ঢাক ঢোল, শঙ্খ হইল মন্দিরের অংশ। সেই বছর কী হইল মনে নাই? সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ একদল টুপি মাথায় লোক এসে বলল, আযানের সুময় ঢাক-ঢাল শঙ্খ এসব বন্ধ রাখতে হবে। সেই থেকে আযানের সময় সম্পর্কে পূজারিগের সজাগ থাকতে হয়! এক ধর্ম পালিত হবে তাই আরেক ধর্ম বন্ধ! সেই আদেশ যারা দিছিল, মনে আছে দাদা, তারা কারা? সব তুমার স্কুলের বন্ধু-বান্ধব, একই পাড়ার লোকজন। এমুন অবস্থা সারা দেশেই।’
অখিল পোদ্দার একটা পান মুখে দিয়ে বললেন, ‘শোন্ দুলাল, মাইনরিটির এত সমান-সমান হিসাব করতে নাই। ওরা সংখ্যায় বেশি, ওরা তো একটু বেশি সুবিধা চাবেই।’
‘কি কও দাদা! কলকাতায় তো মুসলমান সংখ্যালঘু। কবে কে তাগো কইছে যে আজান একটু পরে দ্যাও, পূজার কাজটা সাইরা নিই! আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনে মুসলমানরা বহাল তবিয়তে পরের দেশে যখন খুশি ধর্ম করতেছে। শুনছো কেউ কোনোদিন কইছে চার্চের কামডা হোক, তারপর নামাজ পইড়? সেদিন টেলিভিশনে দেখলাম ইংল্যান্ডে রাস্তার মাঝখানে দাড়াইয়া ছয়জন মুসল্লি নামাজ পড়তেছে। রাস্তা বন্ধ হইয়া আছে।’
অখিল পোদ্দার গলা নামিয়ে বললেন, ‘মানুষ সামনে আগাইতেছে, আধুনিক হইতেছে। এগুলা থাকবে না দেখিস।’
দুলাল মুখ বাঁকিয়ে প্রবল জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘এগুলা যাবেও না দাদা। তুমি আমি কেন, তোমার নাতিও-পুতিও দেইখা যাইতে পারবে না। বরং বাড়বে। আমার কথা মনে রাইখো।’
অখিল পোদ্দার দ্বিমত পোষণ করে মাথা নাড়লেন, ‘যাই বলিস, মানুষ এখন আধুনিক হইতেছে।’
দুলাল হেসে বলল, ‘দাদা, তুমি আর বাস্তবে আসলা না। চারপাশে তাকাইলা না। মানুষ আধুনিক হয় নাই। উল্টা হাঁটতেছে।’
অখিল পোদ্দার ক্ষুব্ধচোখে বললেন, ‘কুনদিকে হাঁটতেছে?’
‘কও তো, বাংলাদেশ কী সেই ’৭১ সালের জায়গায় আছে?’
অখিল পোদ্দার এবার হেসে বললেন, ‘’৭১-এ থাকপে ক্যান, কইলাম না মানুষ সামনে আগাইতেছে?’
দুলাল বেয়াদবের মত বলল, ‘আর আমি কইলাম না যে তুমি বোকার স্বর্গে বাস করতেছ! দাদা, গত ত্রিশ বছরে এই দ্যাশের মানুষ হাঁটতে হাঁটতে ছয় শো বছর পিছনে চইলা গ্যাছে।’
‘দুলাল, এইডা হইল তোর নিজের ধারণা।’
‘দাদা, তুমি কী সাতই মার্চের ভাষণের ছবিটা ভাল কইরা দেখছ?’
‘দেখছি, দেখপো না কেন?’
‘তুমি দেখ নাই। ওই ছবির মধ্যে হাজার হাজার মানুষের মাথা দেখা যায়। কও তো, সেই মিটিঙে কয়জনের মাথায় টুপি ছিল?’
‘লক্ষ করি নাই। আর টুপি থাকলে সমস্যা কী? আমার টুপি গোনার দরকার কী?
‘দরকার আছে। ওই ছবিতে লাখো মানুষের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচটি টুপি দেখা যায়। আর এখন সব মিটিঙে অর্ধেকের বেশি মানুষের মাথায় টুপি থাকে! এমুন কি কমিউনিস্ট পার্টির মিটিঙেও দেখবা কয়েক গণ্ডা টুপি!’
অখিল পোদ্দার অস্থির হয়ে বললেন, ‘কী মুশকিল, টুপি থাকলে সমস্যা কী? টুপি কী দোষ করল? মানুষ ধর্ম করবে না, টুপি পড়বে না?’
দুলাল গলার স্বর নামিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিল, ‘করবে, ধর্ম করবে, টুপি পড়বে! কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু মুসলমানের টুপির ফাঁক দিয়া একসময় ভূত ঢুইকা যায় দাদা! সেই ভূত মাথার মধ্যে জলাতঙ্ক রোগের মত যন্ত্রণা করে! তখন ওরা কামড়ানোর জন্য পাগল হয়ে উঠে!’
‘যা ব্যাটা! তোর মাথার মধ্যে হিন্দু ভূত ঢুকছে। কামড়াকামড়ি করতেছে! ভূতের নাম রামচন্দ্র!’
এই কলহের সময় হেমেন কাকাকে ডেকে আনা হয়েছিল। তিনি বেশ খানিকক্ষণ নীরবে ভাইদের তর্ক শুনলেন। তারপর অখিল পোদ্দারকে সমর্থন করে বললেন, ‘তোমরা তো জানো না, এদেশে অনেক ভাল মানুষ ছিল, এখনো আছে। এটা শেখ মুজিবের হাতে গড়া দেশ। এদেশে ভাল মানুষ না থেকে পারে না। আমার জীবনে আমি বহু টুপি দাড়িওয়ালা মানুষ দেখেছি। বন্ধুত্ব হয়েছে। তাদের মধ্যে আমি অসাধারণ মানুষ পেয়েছি। যাদের মনুষ্যত্ব ধর্মকে ছাড়িয়ে গেছে।’
দুলাল বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আমার কথা কিন্তু কাকা বুঝতে পারেন নাই। আমি কিন্তু কই নাই যে এদেশে ভাল মানুষ ছিল না, বা নাই। কিন্তু দ্রুত সেই চেহারা পাল্টাইতেছে। কারণ ধর্মের ব্যখ্যা পাল্টায় গেছে।’
হেমেন কাকা বললেন,‘তোমরা তো জানো না, বহু নির্মম ঘটনা…’
ছোট ভাই দুলাল কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, ‘কাকা, ওইখানে সব ঠিক করা আছে। সিপিআইএমের লোকদের সাথে কথা হইয়া আছে। সেইখানে গেলেই রেশন কার্ড হবে। তাইলে তো আর আমাগো কোনো সমস্যা নাই?’
বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এমনভাবে তাকিয়ে হেমেন গাঙ্গুলী বললেন, ‘তোরা বলিস, ইনডিয়া নাকি খুব সভ্য দেশ, আইনের দেশ? গেলেই নাগরিক?’
দুলাল কেতাবি হাসি দিয়ে বলল, ‘ওয়ান-টুর ব্যাপার। সিপিআইএম পশ্চিমবঙ্গে পারে না কী, সবই পারে।’
হেমেন কাকা বললেন, ‘এজন্য, এই সব পারার জন্য একদিন তোর ওই সিপিআইএমকেও খেসারত দিতে হবে, দেখিস।’
প্রসঙ্গ পাল্টে যাচ্ছে দেখে দুলাল বলল, ‘সে দিক কাকা। আমাদের কাজ হওয়া নিয়া কথা।’
খানিক সময় উপস্থিত কেউ কথা বলল না। সবাই কী করা যায় তা নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছে। পরিবার ভাগ হয়ে পুরো অদৃশ্য হয়ে যাওয়া তো মুখের কথা না। অঙ্গহানির মত কষ্টের। এর একটা বিহিত তো করা দরকার। হঠাৎ দুলাল গম্ভীর গলায় বলল, ‘সামনের ইলেকশনে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’
অখিল পোদ্দার আবারো রাগ হয়ে বলে উঠলেন, ‘তোর কানে কানে আওয়ামী লীগ আইসা বইলা গেছে?’
‘কইলাম তো, দেইখা নিও!’
হেমেন কাকা তাঁর বড় দুটি চোখ তুলে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘দুলাল, কেন তোর মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না, বলতো শুনি?’
দুলাল হেমেন কাকার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই দ্যাশের মানুষ এখন অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ। তাদের কাছে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি হইল মুসলমানের দল কোনটা। দ্যাশের মানুষ বিএনপিরে মুসলমানের দল মনে করে। পাকিস্তানের সঙ্গে এত বড় যুদ্ধ হইল, কয়টা বছর মাত্র হইছে? অথচ সেই পাকিস্তান এখন এদেশের মুসলমানদের কাছে ভারতের চাইতে আপুন। সেইটা কাকা শুধুই ধর্মবোধের কারণে।’
‘এইটাই তোর ব্যাখ্যা?’
দুলাল বলতে থাকল, ‘তার চাইতেও বড় কথা হইল, বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমতার পরিবর্তনের মধ্য দিয়া নিজেগো ভাগ্যের পরিবর্তন দেখতে চায়।’
হেমেন কাকা উত্তরে বললেন, ‘সেটা তো সবাই চায়। দেশ জাতির ভাগ্য তো সত্যিই রাজনীতিবিদদের উপর নির্ভর করে।’
‘তা করে। কিন্তু কাকা, এই দ্যাশের মানুষ জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের চিন্তায় ক্ষমতাসীনদের পাল্টায় না। পাল্টায় নিজের একার ভাগ্যটা পাল্টাইতে। রাস্তার যে ফকির, সেও মনে করে সরকার পরিবর্তন হইলে ভিক্ষা বেশি পাওয়া যাবে!’
হেমেন কাকার এই তর্ক ভাল লাগছিল না। বিরক্ত হয়ে অখিল পোদ্দারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওরা যখন এত করে বলছে, রাজি হচ্ছিস না কেন অখিল? চলে যা!’
অখিল পোদ্দার হেমেন কাকার মুখের ওপর বললেন, ‘বাপের ভিটা ছাইড়া আমি কুত্থাও যাব না কাকা! এই দ্যাশের মানুষ কি আমারে কামড়াইছে? আপনে নিজে গেলেন না ক্যান? এই যে উঠানের আমগাছটা দেখতেছেন কাকা, ওই যে জানলা দিয়া পিয়ারা গাছটা দেখা যায়, এগুলা জন্মের পর থিকা আমারে ছায়া দিয়া আসতেছে! আমি কুথায় যাবো? কী কন কাকা!’
হেমেন কাকা চুপ হয়ে রইলেন।
অখিল পোদ্দার রাজি না হওয়ায় তার সাথে ছোটভাই সুকুমারও রয়ে গেছে। সে বলেছে, ‘দাদা যাইতেছে না যখন, আমিও থাকি। এইখানে বিএ পাস করলাম। ভাল চাকরি-বাকরি কিছু জুটলে মন্দ কি? আর নাইলে তো পথ খোলাই আছে। চইলা আসপো।’
তার ব্যাপারে কেউ আর বিশেষ আপত্তি করে নাই। সুকুমারের কথার যুক্তি আছে। ছোট কাকা শুধু বললেন, ‘ও বিয়ে থা করে নাই। যখন তখন চইলা আসতে পারবে। কিন্তু সুকুমার, একটা কথা। তোমার চাকরির জন্য টাকা পয়সা যা লাগে আমি আছি, অখিল-দুলাল আছে, কোনো সমস্যা নাই। শর্ত হইল পুলিশ, দুর্নীতিদমন, ফুড, এজি, এলজিআরডি, পিডব্লিউডি, ওয়াপডা এসব ডিপার্টমেন্টে চাকরি হইলে এই দ্যাশে থাকবা। আর বিচার বিভাগে হইলে তো কথাই নাই। কিন্তু ওই সমাজকল্যাণ, পরিসংখ্যান, যুবকল্যাণ এসব ডিপার্টমেন্টে চাকরি চেষ্টা করবা না। তারচেয়ে ওপার গিয়া মুদি দুকান করাও ভাল।’
সুকুমার কৌতূহলের সঙ্গে বলল, ‘কাকা, পাস কোর্সের থেকে বিএ পাশ করলাম। চাকরি তো সমাজকল্যাণ বা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরেই হবে। খামোখা প্রকৌশল বিভাগে কী চাকরি করবো?’
ছোট কাকা মাথা নেড়ে বললেন, ‘আরে বোকা, ওইসব ডিপার্টমেন্টে কেরানির চাকরি করলেও তিন-চার বছরের মধ্যে বাড়ি করতে পারবি। ওইসব ডিপার্টমেন্টের টেবিল চেয়ারও পয়সা কামায়। পাঁচ বছরের মধ্যে কলকাতার আশেপাশে কোথাও জায়গা কিনবি। তা না হইলে সারাজীবন দেখপি সংসারের টানাটানি যায় না।’
সুকুমার ঘার কাত করে তার কথায় সায় দিয়েছিল। সে বড়দের সঙ্গে কোনো তর্কে যেতে চায় না।
একসময় দিন-তারিখ ঠিক হল। বাড়িতে চাপাকান্নার রোল পড়ল। জিনিসপত্র খুব গোপনে দিনে দিনে বিক্রি করা হয়েছে। সোনা-গয়না আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। টাকাও হুন্ডির মাধ্যমে চলে গেছে। ছোট ছোট কয়েকটি ব্যাগে পরনের জামাকাপড় নিয়ে দুলাল ও অখিল পোদ্দারের দুই কাকা ও তাদের পরিবার রওয়ানা করল। নতুন স্বপ্ন, নতুন জীবনের দিকে। ভোররাতে যখন পরেশপুরের কুকুর বিড়ালও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে, তখন একঝাঁক মানবসন্তান ভেজা চোখ নিয়ে শেকড়ের জট উপড়ে ফেলে পশ্চিমের দিকে রওয়ানা হল। পেছনে পড়ে থাকল মাটি, যে মাটিতে রয়ে গেল শেকড় উপড়ে ফেলার ক্ষত।
অখিল পোদ্দার একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ঘর-বাড়ি, সারা জীবনের চেনা জগত ছেড়ে যে বাকি জীবনের জন্য কাঁটাতারের বেড়া পাড়ি দেয়, তার বুক ভেঙে যায় বটে, কিন্তু প্রতিবেশী অন্য হিন্দুরা এই করুণ বিদায়কে অতি স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়। এ যেন খাঁচাবন্দী মুরগির জীবনের মত। খাঁচা থেকে যখন দুটিকে তুলে নেওয়া হয় গলায় ছুরি চালানোর জন্য, তখন অন্যগুলো গলা বাড়িয়ে দেখে। ব্যস। ওই পর্যন্তই। তারপর নিরুপায় অপেক্ষা করে ওদের থেকে পরবর্তী আর দুটোর পরিণতির জন্য।
’৪৭-এ দেশভাগের পর থেকেই এই ভোরবেলা উঠে চোরের মত সীমান্তের ওপারে নিরুদ্দেশ হওয়ার কালচার হিন্দুরা দেখে আসছে। তিক্ত অভিজ্ঞতা, সামাজিক নির্যাতন ও অজানা এক ভয় শিশিরের মত জমে জমে বরফের চাঁই হয়ে দাঁড়ায়। তখন যেন দম আটকে আসে। মনে হয় সীমান্ত পার হলেই শুধু বুক ভরে দম নেওয়া যাবে। এভাবেই একদল দেশ ছাড়ে, জন্ম নেয় নতুন প্রজন্মের আরো অনেক হিন্দু। পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠে। চারদিকের আবহ কেমন যেন ‘নিজের না’ হয়ে ওঠে। একসময় জেগে ওঠে নতুন এক চেতনা। আবার তারা অনুভব করে জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়ার তাগিদ। আবার আসে নতুন প্রজন্ম । হিন্দু ফুরায় না। কারণ এই মাটি হিন্দুর সিঁদুরে রাঙানো। তারাই এ মাটির বহুকালের রঙমাখা মানুষ। কামার, কুমার, বণিক, মালো সব জাতির হিন্দুভিটা দিয়ে সারা বাংলায় যেন আল্পনা আঁকা রয়েছে। মাটির অনেক গভীরে এই আল্পনার দাগ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মাশরুমের মতো হিন্দু বেড়ে ওঠার উর্বর ভূমি এই দেশ। তাই অনেক হিন্দু চলে যাওয়ার পরও অনেক হিন্দু রয়ে যায়।
এই দেশের মাটি দিয়ে মায়ের প্রতিমা গড়া হয়। এই মাটি কি এত নিষ্ঠুর হতে পারে? কিন্তু তারপরও মানুষ যায়, যাচ্ছে। জগতের সব প্রাণীর যখন ঘরে ফেরার তাগিদ, তখন টুপ করে ঘর ছাড়ে একটি হিন্দু পরিবার। কেন? অখিল পোদ্দারের এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। আজও সে বুঝতে পারে না।
অখিল পোদ্দার বাইসাইকেল থেকে নেমে একটা ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রাখলেন। তালা দিয়ে টেনে দেখলেন। তারপর ধীর পায়ে হেমেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের চেম্বারে প্রবেশ করলেন। হেমেন কাকা বসে আছেন একটি কাঠের চেয়ারে। সামনে একটি ছোট টেবিল। টেবিলের পেছনে তাকে সাজানো সারি সারি ওষুধ। ডানপাশে একটি চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছেন মকবুল কাকা। হেমেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী একেবারে বন্ধুবান্ধবহীন মানুষ না। অন্তত একজন বন্ধুকে অখিল পোদ্দার দীর্ঘকাল যাবৎ দেখে আসছেন। তিরি এই মকবুল হোসেন মিয়া। সরকারি চাকরি করতেন। তিনি আর হেমেন কাকা একেবারে সমবয়সী, ব্রিটিশ আমলের মানুষ। মকবুল কাকা পাকিস্তান সরকারের অধীনে বহুদিন সিও রেভিনিউ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বিভিন্ন জেলায়, মহাকুমায় তার পোস্টিং ছিল। শেষ জীবনে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে রিটায়ার করেছেন। মুখে শাদা ধবধবে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে পুরু চশমা। মোটা ভ্রু’র পশম সব শাদা হয়ে গেছে। চশমার ওপাশে চোখ দুটোতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ছাপ। কারো দিকে তাকাতে হলে তিনি সোজাসুজি তাকান। বাঁকা চোখে তাকাতে পারেন না। আচরণেও অনেকটা চাহনির মত সোজাসাপটা। হেমেন কাকা প্রায়ই বলেন, যারা মানুষের দিকে সোজাসুজি তাকান, বাঁকাচোখে তাকাতে পারে না, তাদের মনটাও সোজা। বড় গভীর, বড় মজার বন্ধুত্ব এই দুটি মানুষের। অখিল পোদ্দার এ মানুষ দু’জনকে একসঙ্গে দেখলে খুশি হয়ে ওঠেন।
অখিল পোদ্দার শেষবার যখন এসেছেন তখনো মকবুল সাহেব ছিলেন। চারপাশে বেড়া, উপরে একচালা টিনের ছোট চেম্বারটায় দুজন বসে আছেন। চেম্বারে কোনো রোগী নেই। দুই বুড়ো বসে ঝগড়া করছেন। ঝগড়া বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। মকবুল সাহেব সেদিন বললেন, ‘তোর কাছে আমি আর আসছি না, এই শেষ।’
হেমেন কাকা বললেন, ‘না আসলি। এহ্ উনি ব্রিটিশ লর্ড। না এলে আমার বয়েই গেল।’
‘আর তুমি? ডা. বিধান চন্দ্র রায়! ওষুধের তাকের দিক দেখিয়ে বললেন, স্পিরিট আর পানি মিশিয়ে মানুষকে ধোকা দিস্, সবাইকে তাই পেয়েছিস?’
তিনি উঠে চলে যেতে থাকলেন। হেমকাকা পেছন থেকে বললেন, ‘আর আসবি না বলেছিস, মনে থাকে যেন!’
মকবুল সাহেব ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যদি আসি, এই যে অখিল ছেলেমানুষ বসে আছে, ওকে দিয়ে কান ধরিয়ে বের করে দিস্, যাহ্।’
এমন সম্পর্ক আর মজার কাণ্ড অখিল পোদ্দার আর দেখেননি। আজও অখিল পোদ্দার ছোট চেম্বারটায় ঢুকে দেখলেন মকবুল সাহেব আর হেমকাকা বসে চুকচুক করে চা খাচ্ছেন। সেদিনের ঝগড়ার ব্যাপারে দু’জনের কারো মধ্যে লজ্জার কিছু দেখা গেল না। কারো কোনো ভাবান্তর নেই। দুজনকে দেখে কেউ বলবে না এদের মধ্যে অমন বাক্যালাপ কখনো হয়েছে। বরং তাকে দেখে মকবুল সাহেবই আগে বললেন, ‘কী খবর অখিল, তোমাকে আজকাল দেখা যায় না যে?’
‘সময় কইরা উঠতে পারি না কাকা। সারাদিন দোকানদারি করি, বাড়ির ঝামেলা একা সারতে হয়। আমাগো সুকুমার তো সুকুমারই।’
হেমেনবাবু বললেন, ‘বাড়ির সব ভাল রে অখিল?’
‘বাড়ির সবাই ভাল কাকা, আমি নিজে ভাল না।’
‘কেন, ব্যবসা খারাপ?’
‘ব্যবসা তো আছে মোটামুটি। সমস্যা হইল কাকা, আমার রাইতে ভাল ঘুম হয় না। কাশি হয়। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করে।’
প্রসঙ্গ পাল্টে অখিল পোদ্দার ঠাট্টা করতে চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘ওষুধে কি কাজ হবে কাকা? সেদিন মকবুল কাকা যে কইলেন আপনের ওষুধে শুধু স্পিরিট আর পানি?’
তাঁর কথায় দু’জনের কেউ হাসলেন না। বিব্রতও বোধ করলেন না। মকবুল সাহেব গম্ভীরমুখ করে বললেন, ‘অসুখবিসুখ হেলাফেলার বিষয় না অখিল। সত্যিই বোধ হয় তোমার শরীর ভাল না। কেমন ক্লান্ত লাগছে। হেম কি বলে মন দিয়ে শোন।’
হেমেন বাবু ধীরেসুস্থে পরীক্ষা করলেন। পাল্স দেখলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঠান্ডা লাগেরে?’
‘হ কাকা। মাঝেমাঝেই লাগে।’
‘মন কি বিষণ্ন থাকে?’
‘হ কাকা। বিষণ্ন লাগে ক্যান কইতে পারি না।’
হেমেন কাকা একটু থেমে আবার জানতে চাইলেন, ‘মন বিষণ্ন থাকলে কী ইচ্ছা হয়? ঘুমাতে ইচ্ছা করে, নাকি অন্ধকারে বসে থাকতে ইচ্ছা করে, নাকি কাঁদতে ইচ্ছা করে?’
অখিল পোদ্দার একটু ভেবে বললেন, ‘কানতে ইচ্ছা করে কাকা। মনে হয় কানতে পারলে ভাল হইত।’
হেমেন বাবু চোখ বুজে কী যেন ভাবলেন। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, গান শুনতে তোর কেমন লাগে?’
অখিল পোদ্দার রাগের ভান করে বললেন, ‘রাগ লাগে কাকা। মনে অয় নিজের মাথার চুল নিজে ছিঁড়া ফেলাই। গানের তালে তালে ছিঁড়ি।’
হেমেন বাবু মকবুল সাহেবের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘বুঝলি মকবুল, ও হচ্ছে অ্যাম্ব্রাগ্রিসিয়ার রুগী। এই অ্যাম্ব্রাগ্রিসিয়া ওষুধটা তিমি মাছের মলের থেকে হয়। তীব্র গন্ধযুক্ত। স্নায়ুর উপর দ্রুত কাজ করে।’
অখিল পোদ্দার শুনেই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘এই ওষুধ আমি খাইতে পারবো না কাকা।’
‘কেন? খাবি না কেন?’
‘আমার আছে শুচিবাই রোগ। যেই ওষুধ কোনোকিছুর গু’র থিকা তৈরি, তা না খাইয়া মরাও খারাপ না।’
‘তা হলে তো শুচিবাই রোগটাই আগে চিকিৎসা করতে হয়।’
অখিল পোদ্দার হেসে বললেন, ‘তাই করেন কাকা। একবার শুনলাম নোমানের আব্বা মোয়াজ্জেম সাহেবরে তেলাপোকার চা খাওয়ানো হইতেছে। সকাল-বিকাল দুই বেলা তাজা তেলাপোকা চায়ের মধ্যে জাল দিয়া খাওয়ায়। এহ্! তাতে নাকি হাঁপানীর ব্যারাম সারে, শুইনা আমার চা খাওয়া বন্ধ হইয়া গেল। আমার তো কাকা হাঁপানীও নাই, আর কেউ আমারে তেলাপোকার চা-ও খাওয়াবে না। কিন্তু চা দেখলেই মনে হইত, এই চা নিশ্চয়ই তেলাপোকা দিয়া বানানো হইছে। তিন-চার মাস চা খাইতে পারি নাই!’
অখিল পোদ্দার একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘আর কাকা, ওই যে গান শুনলে আমার মিজাজ খারাপ হয় কইলাম, তার একটা কারণ আছে। সব গান শুনলে মিজাজ খারাপ অয় না। আইজকাল ক্যাসেটের দুকানে, সিডি না কি যেন কয় সেগুলার দুকানে বড় বড় চুলআলা শিল্পীগো গান বাজে। এই গান শুনলে মনে অয় মাথার মধ্যে ঢুইকা পুলাপান চুলগুলা ঝাঁকাইতেছে। মনে অয়, আমার নিজের মাথা ভরাই ঝাকড়া চুল। টাইনা টাইনা ছিঁড়ি। এ কোন দুনিয়ায় আইসা পড়ছি কাকা? এমুন গানও শোনা যায় যার কোনো কথা নাই, খালি পাগলের মত কয় ঝাকানাকা ঝাকানাকা! আবার শচীন কত্তার গান শুনলে বা ওই যে তালাত মাহমুদের গান শুনলে ভাল লাগে। মাথা ঠান্ডা হইয়া যায়।’
মকবুল সাহেব প্রশ্রয়ের হাসি দিলেন। তারপর বললেন, ‘সবকিছু সবার ভাল লাগবে কেন? অখিল, তোমারও তো চুলে পাক ধরেছে। তাই ওসব তোমার কাছে ভাল লাগে না। ওগুলো নতুন প্রজন্মের গান। যুগ পরিবর্তনের গান। বলতে পার সময়ের দাবি। ওরা ওসব শুনে মজা পায়। শচীন কত্তার গান শুনে ঠিক তুমি যতটা মজা পেতে, ওরাও ঠিক ততটাই মজা পায় ঝাকানাকা শুনে।’
অখিল পোদ্দার এ কথা মানতে নারাজ। বললেন, ‘আপনের এই কথা কাকা মানতে পারলাম না। ভাল আর মন্দের একটা বিচার থাকপে না কাকা? সময় পাল্টাচ্ছে বইলা ভালটা মানুষ কদর করবে না?’
‘নিশ্চয়ই করবে। ভাল-মন্দও তো সবার কাছে এক রকম না। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ঠাকুর গল্পের মত তোমার মাথায় ওই ছেলেদের একজনের মস্তিস্ক ঢুকিয়ে দিলে আর ওদের কারো মাথায় তোমারটা ঢুকিয়ে দিলে দেখবে তুমি নাচানাচি করছ। আর ওই তরুণ ছেলেটি তোমার মত আচরণ করছে।’
অখিল পোদ্দার তর্কে আর বাড়তে পারলেন না। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘অসুখটা কোথায় বুঝতে পারতেছি না কাকা, আইজকাল নিজেরে কেন জানি অসহায় মনে হয়। ভিতরে কোথায় যেন একটা অশান্তি বাস করে। চাইরদিকে কেমন এক গায়ে কাঁটা দেওয়া পরিবেশ। শুধু আপনেগো কাছে আইসা বসলে মনটা একটু শান্ত হয়।’
মকবুল সাহেব চশমার ভেতর দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে অখিল পোদ্দারের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘পাথর হয়ে যাও অখিল। কম দেখবা, কম শুনবা। শান্তিতে থাকবা।’
হেমেন কাকা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ভাল বুদ্ধি দিছিস মকবুল। চোখ কান বন্ধ রাখতে। কানা-বোবা হয়ে হাঁটতে।’
মকবুল কাকা হেমেন কাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই যা, চোখ কান খোলা রাখ! চারপাশের সবকিছুর প্রতিবাদ কর। বিপ্লব কর!’
চায়ের দোকানের দশ বারো বছরের ছেলেটা সামনে দিয়ে যাচ্ছে দেখে মকবুল সাহেব ডাকলেন। পকেট থেকে দশ টাকা বের করে দিয়ে তিন কাপ চা আনতে বললেন।
হেমেন গাঙ্গুলী বললেন, ‘বিপ্লব হবে। তুই-আমি না দেখলাম। কিন্তু হবে। সমাজে অন্যায়-অত্যাচার জমতে জমতে যখন ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন বিপ্লব হয়। হয়তো সে বিপ্লবের চেহারা বাস্তিল দুর্গ পতন বা বলশেভিক বিপ্লবের মত হবে না। অন্যরকম করে হবে, যা আমরা এখনো জানি না।’
‘আমি এখন আর সে পথে হাঁটতে রাজি নই হেমেন। আমার বিশ্বাস, এখনকার দিনে একমাত্র শিক্ষা দিয়েই সব অন্যায়-অত্যাচার দূর করা যায়। জোর করে অনেক পেশিবহুল মানুষের দেশকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু একটি শিক্ষিত জাতিকে এখন আর কেউ হজম করতে পারবে না।’
‘তোর কথা ঠিক না। তাই যদি হতো, তা হলে ইরানের জনগণকে শাসকরা আটকে রাখতে পারতো না।’
মকবুল সাহেব বললেন, নিশ্চয়ই পারবে না। একটি সাময়িক সময়ের জন্য মাত্র আটকে রেখেছে। ভারতের মানুষ যখন শিক্ষায় এগিয়েছে, সচেতন হয়েছে, তখনই ব্রিটিশরা ভারত ছেড়েছে।’
হেমেন কাকা টেনে টেনে বললেন, ‘ভারতবর্ষের মানুষ আন্দোলন করল, জীবন দিলÑএসব কী স্বাধীনতায় কোনো অবদান রাখেনি?’
‘নিশ্চয়ই রেখেছে। তবে ইংরেজ চাইলে আরো কিছুকাল থাকতে পারতো। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও ভারতের স্বাধীনতার একটি কারণ। নে, ওই যে চা নিয়ে এসেছে। জ্ঞানের কথা রেখে চা খা।’