দেশবিভাগের বিষাদমথিত হাহাকার ও কান্না নিয়ে ক’টি উপন্যাস আমাদের হৃদয়ে অমোচনীয় হয়ে আছে। হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ এবং মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’ আমাদের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে যেমন বিস্তৃত করেছে, তেমনই দেশভাগ অনিবার্য ছিল কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে।
সম্প্রতি করুণাময় গোস্বামী এই বিষয়ে ‘ভারতভাগের অশ্রুকণা’ র্শীষক একটি উপন্যাস লিখেছেন।
করুণাময় সংগীতে বিশেষজ্ঞ, নজরুল ইসলামের গান নিয়ে তাঁর গবেষণা এবং কয়েকটি গ্রন্থ সমাদৃত হয়েছে। এটি লেখকের প্রথম উপন্যাস। বইটি ভিন্নধর্মী, ব্যাপক ক্যানভাসভিত্তিক।
দেশভাগ নিয়ে কথা উঠলে আমরা বাংলা-পঞ্জাবের দাঙ্গা, কয়েক কোটি মানুষের বাস্তুত্যাগ, বিপর্যয়ের কথাই সাধারণত বুঝি। কিন্তু এ বই শুধু বাংলা এবং পঞ্জাবরে দুঃসহ যন্ত্রণাভিত্তিক নয়। এক ব্যাপক পরিসর, বিস্তৃত পটভূমিতে বেঁচে থাকার আর্তির হৃদয়বিদারক চিত্র। আমরা দেশভাগ নিয়ে চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশককে চিত্রিত করে যে সব উপন্যাস পাঠ করেছি, সেই ছবি আরও খোলামেলাভাবে উপস্থিত এ গ্রন্থে। একই সঙ্গে করুণাময় চরিত্র-চিত্রণে গভীর এক বোধ তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসের পটভূমি কলকাতা, করাচি, লাহৌর, লন্ডন ও ঢাকা এবং বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম গুরগাঁও। ঔপন্যাসিক দেখিয়েছেন, ব্যক্তিগত যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে দেশভাগের প্রভাব পড়েছিল ভারতীয় মানসে, রাজনীতি, অর্থনীতি, এবং জীবন সংগ্রামে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন অঞ্চলে। দেশভাগ শুধু মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন করেনি, ভারতর্বষকেও কত ভাবে অমানবিক ও বিশাদগ্রস্ত করে তুলছিল, বিপর্যস্ত হয়েছিল মূল্যবোধ, তা বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এমনই যে রাজনৈতিক কারণে উপন্যাসের কুশীলবের স্থান বদল হতে থাকে, তারা কোথাও থিতু হতে পারে না। নিয়তি ও বিড়ম্বনা জীবনকে করে তোলে তিক্ত। এটি কিন্তু ইতিহাসের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস নয়। বরং উপন্যাসের মাধ্যমে ভারতভাগ – ইতিহাসের অনুষঙ্গ চিত্রই এই বইয়ের ব্যাপক ক্যানভাস। উপন্যাস এখানে গৌণ, সেই কাল বা সময়খণ্ডকে সময়ের নিরিখে বিশ্লেষণই মূল প্রতিপাদ্য। ঘটনার পরিসর নির্মাণে লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বাস্তব-অবাস্তবের আলোছায়ায় প্রতীক-চরিত্রগুলোর পদচারণা। প্রতীক ঘটনাবলি মনকে আর্দ্র করলেও কাহিনির গতিপথ রুদ্ধ হয় না।
এর প্রধান প্রতীক চরিত্র সেলিম বেগ, লেখকের মানসপুত্র। দেশের প্রতীক নিজের মাকে নিয়ে তার ভাষ্য, ‘তাঁর মা মানুষের অনন্তকালের সাধনা রূপমূর্তি। সেলিম রবীন্দ্র মানসের আর্দশের শক্তিতে বলীয়ান, মুক্তচিন্তার অধিকারী। জীবনের শেষ প্রান্ত ছুঁয়ে বৃদ্ধ সেলিম চান তাঁর অভিজ্ঞতার সম্পদ উত্তরকালের মানুষকে দিয়ে যেতে। ঘটনাচক্রে এক কুয়াশা মলিন শীতের সকালে ঢাকায় এক পুকুরঘাটে সদ্য-পরিচিত এক মানুষের হাতে তাঁর এই অভিজ্ঞতা-হস্তান্তর পালা শুরু হয়। একে একে তাঁর বয়ানে ঠাঁই নেয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নখরে ছিন্নভিন্ন জীবনধারা, উন্মূল ছুটে চলা। গুরগাঁও থেকে শুরু, মাঝে কলকাতা, আবার বিহারে ফিরে আসে উপন্যাসের পথ। পরতে পরতে ফুটে উঠতে থাকে সাম্প্রদায়িকতার নৃশংস চিত্র। জীবন হাতে নিয়ে ছুটে চলা লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে মিশে যায় উপন্যাসের চরিত্ররা। তার পর ট্রেনে করে মুম্বই, সেখান থেকে জাহাজে করাচি। জাহাজ থেকে লঞ্চ। পথ যেন ফুরায় না, ঠিকানা মেলে না একটু থিতু হওয়ার। শুধুই পালিয়ে বেড়ানো, শুধুই উৎকণ্ঠা, শুধুই উগ্রবাদীদের শাণিত অস্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
উপন্যাসের পরের অংশে টগবগে তরুণ সেলিম বেগের জাহাজি হওয়ার স্বপ্নে স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন যাত্রার গল্প থেকে কাহিনি মোচড় নেয়। এই সেলিমও উন্মূল। বাবা-মা, ভাইবোনকে হারিয়ে সে মানুষ হয়েছিল এক বাঙালি পরিবারে। সেখানেই রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি অনুরাগ জন্মে তার। তবে সবাইকে পরিচয় দিত পঞ্জাবি বলে। কিন্তু সেলিম লন্ডন যাওয়ার পরই লাহৌরে সাম্প্রদায়িকতার তরবারি কেটে দু ভাগ করে দেয় তার পালক মাকে। বইয়ের মধ্যে চাপা দিয়ে পোড়ানো হয় পালক বাবা এবং প্রিয় ভাইকে। দগদগে এ ক্ষত বুকে নিয়েই নিয়েই সেলিমের পথচলা। জীবন যখন একটু ধীরস্থির, তখনই দেশভাগের পাহাড় চেপে বসে ভারতর্বষীয়দের ঘাড়ে। সেলিম সিদ্ধান্ত নেয় সপরিবারে করাচি ফিরবে, সেখান থেকে লাহৌর। তবে স্ত্রী লিলিকে সে কিছুই জানায় না। কারণ ভয়ঙ্করতম দাঙ্গার সাক্ষী তার স্ত্রী কখনই লাহৌরে ফিরতে রাজি ছিল না। জাহাজে যখন পরিবারটি করাচির পথে তখন লিলি ছেলের মুখে জানতে পারে তারা লাহৌরে যাবে। আর জ্বালা বাড়াতে চায়নি লিলি। অতল সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিরতরে সরে গিয়েছে এই পৃথিবী থেকেই। তার পরও থেমে থাকে না জীবন। মুক্তিযুদ্ধকে সেলিমেরা দেখেন মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রাম হিসেবে। গল্পের শেষে এসে তিনি বিস্ময়কর ভাবে জানতে পারেন, তাঁর উত্তরসূরিটি তাঁর অতি আপনজন, রক্তের সর্ম্পক না থাকলেও তাঁর আত্মার আত্মীয়, একই সম্পদ হারানোর বেদনায় তাঁরা দু’জনেই ছোট বৃত্ত থেকে বড় বৃত্তে পা ফেলার সাধনা করছেন।
‘ভারতভাগের অশ্রুকণা’-র ব্যাপ্তি বিশাল। এখানে মানবিক হওয়ার সাধনার কথা যেমন আছে, তেমনই আছে রুচি ও সংস্কৃতির কথাও। বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থটির প্রকাশ কেবল বিশালত্বের জন্য নয় নানা প্রশ্নকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরবার জন্যও তাৎর্পযময় হয়ে উঠেছে।
প্রবন্ধটি প্রথমে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।