ক. শশী ডাক্তারের গল্প
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ আদ্যোপান্তই শশী ডাক্তারের গল্প। 1 তবে দশম এবং একাদশ দুটি পরিচ্ছেদে ব্যাপ্ত মতি ও কুমুদের গল্পটির স্বাবলম্বিতা দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। গাওদিয়া গ্রামে বিনোদিনী অপেরা পার্টির আগমনসূত্রে শশীর বন্ধু কুমুদের আর্বিভাব একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এতে খেয়ালী স্বভাবের কুমুদের সঙ্গে শৃঙ্খলাপরায়ণ শশীর একটি তুলনার অবকাশও তৈরী হয়েছিল। অপর দিকে যাত্রার প্রবীর তথা কুমুদের প্রতি কিশোরী মতির মোহ জন্মানোরও প্রয়োজন ছিল যাতে শশী-কুসুমের চৌহদ্দীতে অন্য কোন নারীর রমণীয় উপস্থিতি না-থাকে। বস্তুত: মতির সঙ্গে বিয়ে পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল কুমুদের উপস্থিতি, কিন্তু পরবর্তীতে কুমুদ ও মতির বিশদ দাম্পত্য উপাখ্যান এ উপন্যাসের মূল কাঠামোর অন্তর্সঙ্গতি ক্ষূণ্ণ করেছে। 2
এ কথা বলার তাৎপর্য আদৌ এই নয় যে উপন্যাসের আখ্যানে এককেন্দ্র্রিকতা আদর্শস্থানীয় কোন কৌশল। বস্তুত: আখ্যানের কেন্দ্রে একজন নায়কের আধিপত্য বজায় রেখেও অনেকগুলো চরিত্র সমতালে বিরাজমান থাকতে পারে, হয়তোবা এরূপ ক্ষেত্রে বিষয়গত ঐক্যতানের প্রয়োজন হবে যার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হবে বিভিন্ন চরিত্রের অন্তর্লগ্নতা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘যাও পাখি’ উপন্যাসে এরকম বহুকেন্দ্রিক একটি আখ্যান পরিলক্ষিত হয়।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ প্রধানত শশী ডাক্তারের গল্প হলেও অনেক মানুষের সমাবেশে সমাজের একটি অখন্ড চিত্র আভাসিত হয়ে উঠেছে। যাদের আমরা দেখি যেমন উপন্যাসের শুরুতেই বজ্রপাতে নিহত হারু ঘোষ, হারুর পুত্র পরান ও পরানের বৌ কুসুম, যাদব পন্ডিত ও স্ত্রী পাগলদিদি, বৃদ্ধ যামিনী কবিরাজ ও যুবতী স্ত্রী সেনদিদি, শশীর পিতা গোপাল দাস ও অনুজা বিন্দু, বিন্দুর বর কোলকাতাবাসী নন্দ, মতি ও কুমুদ, এরা সবাই একটি দৃঢ় সংহত প্রেক্ষাভূমি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এমনকী মুদি দোকানী শ্রীনাথ, জমিদার শীতল বাবু, ভূতোর বাবা বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, নৌকার মাঝি গোবর্ধন, কুসুমের বাবা অনন্ত, যাদের উপস্থিতি নেহায়েৎই আপতিক, প্রায় গুরুত্ববিহীন, এদের ভূমিকাও ঔপচারিক। গাওদিয়া কেন্দ্রিক এই পটভূমিতে নানা ঘটনা ও অঘটনের মধ্য দিয়ে শশী চরিত্রটি ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি করেছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত এ চরিত্রটি একদিকে কাহিনীর বুনটকে দিয়েছে মেরুদণ্ডের দাঢ্যতা, অন্যদিকে অন্ধকারে জোনাকীর মতো একটি গতিসূত্র জ্বেলে দিয়েছে।
২.
উপন্যাসের দ্বিতীয় পাতায় হারু ঘোষের নি®প্রাণ দেহ উদ্ধারের লক্ষ্যে নদীর পাড়ে নৌকা ভেড়ানো হলে মাঝি গোবর্ধন বলে, “আপনি লায়ে বসবে এস বাবু, আমি লাবাচ্ছি”। এ প্রস্তাবে শশীর উত্তর “দূর হতভাগা, তোকে ছুঁতে নেই” এর মধ্য দিয়ে শশীর চরিত্র নির্মাণ শুরু হয়। সংস্কারমনস্কতার অব্যবহিত পরেই যুক্তিশীলতার লক্ষণ গেঁথে দিয়েছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। প্রত্যুত্তরে গোবর্ধন যখন বলে “ছুঁলাম বা, কে জানছে? আপনি ও ধুমসো মড়াটাকে লাবাতে পারবে কেন?” তখন শশীর যুক্তিশীলতা প্রাধান্য লাভ করে; সে বলে, “আয় তবে, দুজনে ধরেই নামাই।” উপন্যাসের শেষ অনুচ্ছেদে “জোরে আর আজকাল শশী হাঁটে না, মন্থর পদে হাঁটিতে হাঁটিতে গ্রামে প্রবেশ করে” অবধি চরিত্র নির্মাণের পালা অব্যাহত থেকেছে।
লক্ষ্য হয়, মড়া ছোঁয়ার প্রশ্নে সংস্কারের ওপর যুক্তির প্রাধান্য দিতে বিলম্ব করেনি শশী, যা বাস্তবমনস্কতার পরিচায়ক; একই সঙ্গে তার চরিত্রের স্থিতিস্থাপকতারও অভিজ্ঞান। এই স্থিতিস্থাপকতার উৎস কী তা মনোযোগী পাঠকের পক্ষে ন্যায্য কৌতূহলের বিষয়। গ্রামের সন্তান শশী শহরের মেডিকেল কলেজে প’ড়ে ডাক্তার হয়েছে। বন্ধু কুমুদের সাহচর্য্যে সে পৃথিবীর সুপ্রসার ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। শাহরিক জীবন এবং বিজ্ঞানের অধ্যয়ন তার গ্রাম্যতা ঘুচিয়েছে যদিও তবু আশৈশব আহৃত নানা দুর্মর গ্রামীণ সংস্কার রয়ে গেছে তার চরিত্রের গহনে যা উপেক্ষা ক’রে সে কখনই নিজের মতো হয়ে উঠতে পারে না। শশীর মানসিক দোদুল্যমানতা আখ্যানের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিলক্ষ্য।
অন্যদিকে একেবারেই গ্রাম্য মেয়ে কুসুম শশীর তুলনায় অনেক স্থিতধী। সে স্বীয় উপলব্ধি ও আকাক্সক্ষা, ইচ্ছা ও অনিচ্ছার বিষয়ে আত্মপ্রত্যয়ী, নি:সংকোচ। তবু কুসুম নয়, শশী ডাক্তারই এ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু, আপাতদৃষ্টিতে প্রোটাগোনিস্ট। কুসুমের চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক হলেও মানিক বন্দোপাধ্যায় এ চরিত্রটি পূর্ণ মাত্রায় ফুটিয়ে তোলেন নি। শশী ডাক্তারের নিরব প্রেমিক হিসেবে কুসুম যথাযথ অবয়ব লাভ করেছে মাত্র, সে মুখ্য কোন চরিত্র হয়ে ওঠেনি। যেমন পিতা গোপাল দাস, সাধক ব্রহ্মচারী যাদব পন্ডিত, যামিনী কবিরাজ এবং বন্ধু কুমুদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ ও ডাক্তার শশীর নানা চারিত্রিক মাত্রা রেখায়িত হয়েছে তেমনি কুসুমের অনতিঘন সাহচর্যের মধ্য দিয়ে পুরুষ শশীর আরেকটি দিক চিত্রায়িত হয়েছে।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অগ্রজ বাঙলা সাহিত্যের প্রধান তিন ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারীচরিত্রের ব্যাপারে বিশেষ কৌতূহলী ছিলেন। তাদের হাতেই সৃষ্ট রোহিণী (‘কৃষ্ণকান্তের উইল’), কুমুদিনী (‘যোগাযোগ’) আর রাজলক্ষী (‘শ্র্রীকান্ত’)। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কুসুম এই তিন চরিত্র থেকেই লেখক-আরোপিত ভূমিকার বিবেচনায় পৃথক। বালবিধবা রোহিণী গোবিন্দলারের হাত ধ’রে গৃহত্যাগ ক’রে মৃত্যুর পথে পা বাড়ায়; দুশ্চরিত্র স্বামী মদুসূদনকে শ্রদ্ধা করতে ব্যর্থ হয়ে কুমুদিনী দৃঢ় সংকল্পে তাকে পরিত্যাগ করে; অন্যদিকে সমাজচ্যূত রাজলক্ষী পেশাদার বাঈজীর জীবন বেছে নেয়। এরকম বিদ্রোহী কোন সমাজসম্পৃক্ত কি আদর্শনিষিক্ত ভূমিকায় অধিষ্ঠিত নয় কুসুম। পূর্বসূরীদের ধারাবাহিকতায় মানিক বন্দোপাধ্যায় কুসুমকে কোনরূপ প্রোটাগনিস্টের মর্যাদায় উত্তীর্ণ করেননি। তবে তিন অগ্রজের রচনায় যে আপ্ত উদ্দেশ্যমুখীনতা প্রত্যক্ষ হয়, প্রতীয়মান হয় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র লেখক তা’ সযত্নে বর্জন করেছেন।
৩.
শশী-কুসুম সম্পর্কের বিবেচনায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ একটি বিয়োগান্তক উপাখ্যান। শুরুতে হেঁয়ালী দিয়ে শুরু হলেও শশী ডাক্তারের প্রতি পরাণের বৌ কুসুমের প্রগাঢ় অনুরক্তি ক্রমশ নিরাবরণ হয়েছে। তবে মানিক বন্দোপাধ্যায় শশী ডাক্তার এবং পরানের স্ত্রী কুসুমের অনতিপ্রকাশ সম্পর্কটি শেষাবধি লালন করেছেন অতি সতর্কতার সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে তাঁর পরিমিতিবোধ অনন্যসাধারণ:– ফলশ্রুতিতে শশীকে মনে হয় নিরাবেগ, অসংবেদী, অতিসংযত। উপন্যাসের নিতান্ত শেষ পরিচ্ছেদে গাওদিয়ার পাট গুটিয়ে বাপের গ্রামে চলে যেতে উদ্যত কুসুমকে ফেরাতে গিয়েই শশী প্রথম তার অন্তর্গত অনুরাগ ব্যক্ত করে স্পষ্ট কণ্ঠে। উত্তরে কুসুমও নিরাবরণ করে দীর্ঘকাল আগেই অঙ্কুরিত কামনা-বাসনা।
শশী তালবনে কুসুমকে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে: “কুসুমের যে শরীর আজ অপার্থিব সুন্দর মনে হইতেছিল তার সমস্তটা শশী জড়াইয়া ধরিতে পারিল না, হঠাৎ করিল কি, খপ করিয়া কুসুমের একটা হাত ধরিয়া ফেলিল”। কিন্তু এটুকুতেই শশীর সমস্ত আবেগ সীমাবদ্ধ থাকে, সে কুসুমকে আলিঙ্গন ক’রে উঠতে পারে না। শুভবোধ, নৈতিক বিবেচনা, সমাজানুগত্য অথবা ভীরুতা — ঠিক কী কারণে শশী ডাক্তারের দ্বিধা তা অবশ্য কখনোই স্পষ্ট হয় না। মানিক বন্দোপাধ্যায় শশীর চরিত্র-পরিকল্পনায় একটি মুক্ত অভিমুখ সংরক্ষণ করেছেন।
কারণ যাই হোক কার্যত: দৈহিক সংযম এবং সুনীতিবোধ উভয়েরই আনুগত্য করেছে শশী। যদি তা’ না হতো তবে উপন্যাসটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে প্রবাহিত হতে পারতো। কুসুম ধরা দিয়েই ছিল। সে নি:সংকোচে বলেছিল, “আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু?” অত:পর অন্ততঃ দুটি খাতে প্রবাহিত হ’তে পারতো কাহিনী। প্রথমত: জৈবিক তাড়না প্রবল হয়ে দু’জনের মধ্যে দ্রুত গ’ড়ে উঠতে পারতো দৈহিক সম্পর্ক; গ্রামের আদর্শস্থানীয় যুবক শশী বহিরাঙ্গিক জীবনের সমান্তরালে সঙ্গোপনে বন্ধুস্ত্রী কুসুমের সঙ্গে চালিয়ে যেতে পারতো অবৈধ প্রণয়। এতে হয়তো বিবেকের দংশনে সে ক্ষত-বিক্ষত হতো, তবু এড়াতে পারতো না শরীরের দাবী, সুযোগের প্রশ্রয়। পাঠক এরকম ‘অবৈধ’ প্রণয়ের কাহিনী সফোক্লিসের যুগ থেকে পড়ে অভ্যস্থ।
শরীরী প্রণয়ের কাছে সুনীতি, শুভবোধ ও সামাজিক অনুশাসনের পরাজয়ের গাঁথা বহু লেখকের প্রিয় বিষয়। বাঁধ না-মানা অবৈধ প্রণয় বহুবিধ সামাজিক-মানসিক সমস্যার জন্ম দেয় যার মধ্য দিয়ে মানব চরিত্র, সমাজ ব্যবস্থা এবং নর-নারী সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরার প্রশস্থ অবকাশ রয়েছে। এমিল যোলা তাঁর প্রথম জীবনের ‘তেড়েস রাকেঁ’ (১৮৬৭) উপন্যাসে মানুষের উদগ্র জৈবিক তাড়না ও এর নির্মম পরিণতির যে রেখাচিত্র অংকনের দু:সাহস দেখিয়েছিলেন বিশ্ব কথাসাহিত্যের ভাণ্ডারে আজো তার তুলনা পাওয়া যায় না। আপাত দৃষ্টিতে ত্রিভূজ প্রেম মনে হ’লেও বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাসটি শুভবোধের উপর মানুষের শারীরিক আকর্ষণের বিজয়েরই গল্প যার মধ্য দিয়ে মালতী, তাঁর স্বামী নয়নাংশু এবং মালতীর প্রেমিক জয়ন্ত — এই তিনটি মানুষের অনুপুঙ্খ মানসপ্রক্রিয়া অনবদ্য ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে।
৪.
গৌরকিশোর ঘোষের ‘এই দাহ’ উপন্যাসে গোলক বলে, ‘আমি তোমার সব চাই। শুধু স্থুল শরীরটাই নয়, তোমার মনটাও চাই।’ উত্তরে চারুলতা হেসে স্পষ্ট ক’রে বলে, ‘কিন্তু মনের সঙ্গে তো শোয়া যায় না গোলকবাবু।’ বিপরীতে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের শেষে কুসুম বলে, “আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন ক’রে কেন ছোটবাবু?”
শরীর! শরীর!
“তোমার মন নাই কুসুম।”
হয়তো শশীর দৈহিক শুচিতাবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপের অভিপ্রায়েই মানিক বন্দোপাধ্যায় সংযোজন করেছেন এই বাক্য। “শরীর! শরীর!” অংশটি শশীর স্বগতোক্তি, সে তা প্রকাশ করে না,। মুখে সে উচ্চারণ করে, “তোমার মন নাই কুসুম।” শশীর প্রশ্নোক্তি, ক্ষেদোক্তি কিংবা বিস্ময়োক্তি “তোমার মন নাই কুসুম” বাঙলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় সংলাপ। বিকল্পে, কুসুমের অকপট প্রশ্নটির সঙ্গে-সঙ্গে পরিচ্ছেদটি শেষ হ’য়ে যেতে পারতো পাঠকের মনে তীব্র কৌতূহলের জন্ম দিয়ে। শশী ডাক্তারের সান্নিধ্যে পরানের যুবতী স্ত্রী কুসুমের শরীর কেমন যেন করে — কুসুমের এমত নি:সংকোচ নিবেদনে শশীর কী প্রতিক্রিয়া হয় তা’ জানার জন্য ব্যগ্র হ’য়ে উঠতো পাঠক; আর উপন্যাসের পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে লেখকের পক্ষে এই কৌতূহলের জবাব দেয়া সম্ভব ছিল কাহিনীকে সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে।
৫.
কুসুমের প্রশ্নের সঙ্গে-সঙ্গে পরিচ্ছেদ শেষ হতো কিন্তু প্রশ্নটি ছোটবাবু তথা শশী ডাক্তারের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকতো অবিরাম। পরবর্তী তথা সপ্তম পরিচ্ছেদে অবিকল থাকতে পারতো বিন্দু ও নন্দর কাহিনী এবং মতি ও কুসুমের খোঁজে শশীর কোলকাতা গমন। হয়তো অষ্টম পরিচ্ছেদে কুসুমের প্রশ্নটি নিয়ে ভাবতে-ভাবতে একদিন অন্ধকার কি আড়ালে কুসুমকে একান্ত ক’রে পেতে পারতো শশী। তারপর, যেমন আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ক্রমশঃ গোপন অভিসার, সংশ্লিষ্ট সমস্যা, জটিলতা ও ঔপসংহারিক পরিত্রাণ কিংবা সমাধান, এই সব আনুপূর্বিক গল্পের মধ্য দিয়ে কাহিনী তিক্ত কি মধুর যে কোন একটি পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে পারতো। লরেন্সের ‘লেডী চ্যাটার্লীয লাভার’ উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে এরকমই একটি প্ররোচনা ও মিলনের দ্বন্দ্বান্তিক কাহিনী।
কিংবা আরেকটু পরিচ্ছন্ন হতে পারতো ঘটনাক্রম: যদি পরানের গলার ঘা হতো ক্যান্সার আর এই ক্যান্সারের কারণে মৃত্যু হতো পরানের, তবে অন্তত: পরস্ত্রীর সঙ্গে ব্যাভিচারের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া যেত শশীকে। বিপরীতে নারকীয়ও হতে পারতো শশী ও কুসুমের মিলন। শেক্সপিয়রীয় কায়দায় শশী ডাক্তার চিকিৎসার পরিবর্তে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারতো পরানকে, দূর হতো পথের কাঁটা।
এমনকী সর্বশেষ পরিচ্ছদেও মিলনাত্মক পরিণতি সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল অতি সহজে: গাওদিয়ার পাট চুকিয়ে বাপের গ্রামে চলে যাবে কুসুম; এই আকস্মিক বিচ্ছেদের মুখোমুখি হ’য়ে শশী হঠাৎ নতুন ক’রে নিজেকে আবিষ্কার করে, কুসুমের প্রতি তার আকর্ষণ হঠাৎ দুর্নিবার হয়ে জেগে ওঠে। অতপর লেখক জানাচ্ছেন : “ঝোঁকের মাথায় কাজ করার অভ্যাস শশীর কোনোদিন ছিল না। মনের হঠাৎ-জাগা ইচ্ছাগুলিকে চিরদিন সামলাইয়া চলিবার চেষ্টা করে। তবে এমন কতকগুলি অসাধারণ জোরালো হঠাৎ-জাগা ইচ্ছা মানুষের মধ্যে মাঝে-মাঝে জাগিয়া উঠে যে সে সব দমন করার ক্ষমতা কারো হয় না। সকালে উঠিয়া কিছুই সে যেন ভাবিল না, কোনো কথা বিবেচনা করিল না, সোজা পরানের বাড়ি গিয়া রান্না ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াইয়া বলিল, “একবার তালবনে আসবে বৌ?” তালবনে কথার পিঠে কথা ওঠে। শশী এক পর্যায়ে অপ্রত্যাশিতভাবে কুসুমকে বলে :
“… আমার সঙ্গে চলে যাবে বৌ?”
“চলে যাব? কোথায়?”
“যেখানে হোক। যেখানে হোক চলে যাই, চল আজ রাত্রে।”
কুসুম সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “না।”
শশী ব্যাকুলভাবে কহিল, “কেন? যাবে না কেন?”
হ্যাঁ একদিন যেত কুসুম — লেখক ব্যাখ্যা করেছেন — স্পষ্ট ক’রে ডাকা কেন, কেবল ইশারা ক’রে ডাকলেই ছুটে যেত। কিন্তু চিরদিন একরকম যায় না — মানুষ তো লোহায় গড়া নয় যে চিরকাল একরকম থাকবে, বদলাবে না। আজ হাত ধ’রে টানলেও কুসুম যাবে না। ইত্যবসরে তার উন্মাদ ভালবাসা নির্জীব হয়ে পড়েছে। কাকে ডাকছে শশী ? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে। চপল রহস্যময়ী, আধো-বালিকা আধো রমণী জীবনীশক্তিতে ভরপুর, অদম্য অধ্যবসায়ী কুসুম মরে গেছে। কেন মরে গেছে কুসুম তার বিশদ কোন ব্যাখ্যা নেই, তবে শশী ডাক্তারের ডাকে সাড়া দিতে কুসুম আজ নি:সন্দেহে অপারগ। বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলে আবারো কুসুমকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে শশী। বলে, “নাই-বা গেলে।” কুসুমের উত্তর, “থেকে কি করবো ছোটবাবু? তাতে আপনার কষ্ট, আমারও কষ্ট। এ বয়সে আর কি কষ্ট সইতে পারবো। গলায় দড়ি-টড়ি দিয়ে বসবো হয়তো।”
কিন্তু লেখক সার্বভৌম। তাঁর অভিপ্রায় হ’লে ‘না’ ‘না’ ক’রেও শেষপর্যন্ত গাওদিয়ায় থেকে যেতে পারতো কুসুম। কিংবা বাপের বাড়ী চ’লে গিয়েও শেষপর্যন্ত মত বদলাতে পারতো সে। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে শশীর হাত ধ’রে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে পারতো দূর কোন শহরে। সুতরাং, দ্বিতীয়তঃ, যে পর্যায়েই হোক, শশী ও কুসুম পালিয়ে গিয়ে বিয়ে ক’রে সংসার পাততে পারতো। এতে গাওদিয়ার মানুষ ছি ছি ক’রে উঠতো বটে, হয়তো লোকসমাজে কুসুমের বাবার মাথা কাটা যেত, কিন্তু তার স্পর্শ হয়তো দূরে শহরে পৌঁছাতো না। সামাজিক প্রভেদ সত্বেও কুসুম শশীকে নিজের ক’রে পেয়ে সুখী হ’তে চেয়েছিল, সে সুখী হতো। শশী গ্রামের শেকড় ছিঁড়ে শহরের বৃহত্তর জগতে অভিবাসী হতে চেয়েছিল, সে সুযোগও জুটে যেত একই সঙ্গে। কিন্তু নিজ ইচ্ছায় নি:শর্ত বিবেচনার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত সফলভাবে বাস্তবায়নের কাহিনী ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ নয়।
খ. কেবলই শশী ডাক্তারের গল্প নয়
তবে শুরু থেকে শেষাবধি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ শশী ডাক্তারের গল্প হ’লেও এর ভাঁজে-ভাঁজে বিবিধ মানুষের বিচিত্র মনোজগতের সন্ধান করেছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। বাজিতপুর শহরের সন্নিকট গাওদিয়া বাংলাদেশের যে কোন একটি গ্রাম। এরকম গ্রামের যে ভূগোল তা’ বাঙ্গালী পাঠকমাত্রের জানা; দরিদ্র মানুষের জীবনসংগ্রাম ও সরল জীবন-যাপন এবং সেই সঙ্গে কিছু মানুষের লোভ, লালসা আর তঞ্চকতা, কুসংস্কারচ্ছন্নতা, কোনো কিছুই আমাদের অভিজ্ঞতার অনধিগত নয়। যা অভিনব তা হলো লেখকের অন্তর্দৃষ্টিতে মানবচরিত্র অবলোকন। প্রকৃতপক্ষে এখানেই কাহিনীর শিল্পোত্তীর্ণতার সম্ভাবনা নিহিত। মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণের পশ্চাতে ক্রীয়াশীল অন্ধকার মানব মনের মানচিত্র অঙ্কনের মধ্যেই লেখকের মননশীলতার অভিজ্ঞান। লেখকের এই উদ্দেশ্যর স্বার্থেই প্রত্যক্ষ হয় কী ভাবে আখ্যানভাগ থেকে-থেকে নতুন বা অপ্রত্যাশিত গতিপথ লাভ করেছে উপন্যাসের বিভিন্ন পর্যায়ে।
যাদব পণ্ডিতের ইচ্ছা-মৃত্যু এবং তাঁর দান করা অর্থে তাঁরই অভিপ্রায়ে শশীর নেতৃত্বে গ্রামে একটি হাতপাতাল নির্মাণ এ উপন্যাসের প্রধান একটি গল্প। যাদব পণ্ডিত সংসারী সাধক হিসাবে পরিচিত। গ্রামের ভক্তিপ্রবণ মানুষ তাঁকে দেবতূল্য জ্ঞানে ভক্তি করে। তাঁর প্রতি বয়সানুগ শ্রদ্ধা প্রদর্শনে শশীর কার্পণ্য নেই, তবে এর অতিরিক্ত কিছু নয়। যাদব পন্ডিত তা বোঝেন, তিনি উপলব্ধি করেন তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার জনশ্রুতিতে শশীর আদৌ বিশ্বাস নেই। শশীকে অভিভূত করার জন্য তিনি মরিয়া। আলাপচারিতার একপর্যাযে তিনি দাবী ক’রে বলেন সকল বিদ্যার আদিবিদ্যা সূর্য্যবিদ্যা তাঁর আয়ত্ব আর এরই বলে তিনি দেহ রাখবেন স্বনির্ধারিত দিন-ক্ষণে। ঘটনাক্রমে এই কথা গ্রামব্যাপী প্রচার হয়ে যায়। এই দাবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য যাদব পণ্ডিত আফিম খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার উইল পাওয়া যায় যাতে তিনি তার সব সম্পত্তি, অর্থকড়ি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য দান ক’রে এ গুরু দায়িত্ব সম্পাদনের ভার, আর কেউ নয়, শশীর ওপর চাপিয়ে গেছেন। তারপর প্রয়োজনীয় আয়োজনের মধ্য দিয়ে শশীর উদ্যোগে হাতাপাতাল নির্মিত হলো। শশীর জীবন যাপন হয়ে উঠলো হাসপাতাল কেন্দ্রিক। পুরো অষ্টম পরিচ্ছেদ জুড়ে বিবৃত এই ঘটনা গাওদিয়ার মানুষ তথা শশীর জীবনে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই হাসপাতালটি শশীকে গাওদিয়ার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলে।
এরকম আরেকটি গল্প শশীর বোন বিন্দুর গ্রামে প্রত্যাবর্তনের কাহিনী। পিতা গোপাল দাস উদগ্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী মানুষ। তিনি সুকৌশলে কোলকাতাবাসী সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী নন্দকে বাধ্য করেছিলেন বিন্দুকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণে। নন্দ এর শোধ তুলেছিল কোলকাতায় নিয়ে বিন্দুকে রক্ষিতার জীবনে আবদ্ধ ক’রে। শশী বিন্দুকে গ্রামে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু যে অস্বাভাবিক জীবনে নন্দ তাকে অভ্যস্ত ক’রে তুলেছে তার বাইরে বিন্দু প্রকৃতিস্থ থাকতে পারেনি। এমনকী শেষাবধি নন্দ বিন্দুকে স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে সংসারে গ্রহণ করতে চাইলেও বিপ্রলব্ধ বিন্দু অসম্মতি জানিয়ে দেয়। কেন বিন্দুর এমত সিদ্ধান্ত? নন্দ আরোপিত জীবনে সে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে? এ জীবনেই সে সুখী, সন্তুষ্ট তবে?
সেনদিদির বসন্ত হ’লে বৃদ্ধ স্বামী যামিনী কবিরাজ চিকিৎসা থেকে বিরত থাকে; এমনকী ঘটনানুক্রমে শশী চিকিৎসার দায়িত্ব নিলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। শেষাপর্যন্ত শশীর প্রাণপণ দিনাতিপাত সেবা ও চিকিৎসায় সেনদিদি যদিবা বেঁচে ওঠেন তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃতভাবে যামিনী কবিরাজ ভুল ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিল: ভাল হ’লেও সারা মুখে ছড়িয়ে থাকে বসন্তের গভীর দাগ। যামিনী কবিরাজের মৃত্যু হয় হঠাৎ; তখন সেনদিদি সন্তানসম্ভবা। সন্তান প্রসবের সময় সেনদিদির মৃত্যু হয়। অনাথ শিশুটির সুব্যবস্থায় আগ্রহী হয়ে ওঠে শশীর বাবা গোপাল। এটি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র আরেক গল্প।
শশীর বাবা গোপাল দাস — সে আরেক কাহিনী। সে উচ্চাকাঙ্খী, অন্যদিকে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য হেন কাজ নেই যা তার অসাধ্য। ফলে তার কুখ্যাতির অভাব নেই কোনো; নীতিবোধ বলে কিছু নেই তার। লোকে বলে অন্যের গলায় ছুড়ি দিয়ে গোপাল দাস পয়সা করেছে। তিন জন বৃদ্ধকে সে তরুণী স্ত্রী জুটিয়ে দিয়ে দুরভিসন্ধির চূড়ান্ত দেখিয়েছে। পিতার ঠিক বিপরীত চরিত্র পরিগ্রহ করেছে শশী। সে বিষয়ী নয়, অর্থ-সম্পত্তির বিষয়ে সে উদাসীন। বাবাকে সে অসম্মান করে না, সম্মানও করে না। শশীর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে গোপাল দাসকে অবজ্ঞা ক’রে। গ্রামীণ জীবনের গ্রাম্যতা তাকে পীড়া দেয়। অন্তর্সত্তায় সে অনুভব করে বৃহত্তর পৃথিবীর আহ্বান ও প্রতিশ্রুতি। গাওদিয়ার সংর্কীণ জীবন ছেড়ে সে শহরের বৃহত্তর পরিমণ্ডলের অধিবাসী হতে চায়। শশীকে ভয় পায় গোপাল দাস। শশী চ’লে গেলে কে দেখবে গোপাল দাসের রক্ত-পানি-করা সম্পত্তি? গাওদিয়া ছেড়ে শশীর নির্বাসন ঠেকাতে গোপাল দাস নিজেই নির্বাসন বেছে নেয়। সে কাশী চলে যায়। ফলে শশীর আর শহরবাসী হওয়া হয় না। শশী ডাক্তার পুরোপুরি গ্রামীণ গৃহস্থ বনে যেতে বাধ্য হয়। পিতার শেষ চালে শশীর সব স্বপ্ন-কল্পনা চিরতরে ভূপতিত হয়ে পড়ে। এখানেই শেষ হয়েছে কাহিনী কেননা এরপর জীবনের কাছে প্রত্যাশার আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
এরকম অনেক ছোট-বড় গল্পের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই নাতি দীর্ঘ উপন্যাসের আখ্যানভাগ। কী সেই সূত্র যা এই গল্পগুলোকে সহঅবস্থানে ন্যায্যতা দিয়েছে? কুমুদ ও মতির গল্পটির কথাই বা কেন বাদ যায়: কুমুদের স্বেচ্ছাচারীতার কাছে মতির নিরালম্ব আত্মাহুতি। এ গল্পও কি অন্যান্য গল্পগুলোর সঙ্গে এক সূত্রে গাঁথা নয়?
যেমন শুরুতেই বলা হয়েছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ আনুপূর্ব শশী ডাক্তারের গল্প, তেমনি একই সঙ্গে গাওদিয়ার বিভিন্ন মানুষের কাহিনীও বটে। মানিক বন্দোপাধ্যয় শশীর চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার তাগিদে নয়, শশী চরিত্রটির মধ্য দিয়ে কোন বক্তব্যও প্রচারিত হয়নি। হঠাৎ মনে হ’তে পারে শশী নব্যশিক্ষিত শহরমুখী গ্রামীণ মানুষের প্রতিনিধি। কিন্তু মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বয়ানের মধ্যে এরকম একটি উদ্দেশ্য স্বতঃস্ফুট নয়। বস্তুততঃ শশী কোন ‘শ্রেণী চরিত্র’ নয়। বরং এরকম একটি তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য যে শশী চরিত্রটিকে অবলম্বন ক’রে গাওদিয়ার মানুষের ছবি তুলে ধরা হয়েছে বড় একটি ক্যানভাসে যার একেকটি অংশে ক্রমশতঃ আলোকপাতের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি অগ্রসর হয়েছে। যে অর্থে নায়ক বা প্রোটাগনিস্ট শব্দটি উপন্যাসের সচরাচর ব্যবহার করা হয়ে থাকে তা যেন শশীর ক্ষেত্রে ঠিক খাটে না। বরং প্রোটাগনিস্ট-স্থানীয় চরিত্রের যথেষ্ট উপাদান রয়েছে যাদব পন্ডিত, যামিনী কবিরাজ, বিন্দু, মতি এবং শশীর পিতা গোপাল দাসের চরিত্র চিত্রণে। এদের কার্যকলাপ ও চিন্তাধারা কৌতূহলোদ্দীপ, পর্যালোচনা ও ভাবনার খোরাক।
২.
পৃথিবীতে যূথবদ্ধ মানুষের অভ্যূদয়ের কাল থেকেই গল্প বলা প্রচলিত। গল্প মানুষের জীবনেরই অংশ: মানুষ গল্প শুনতে ভালবাসে, গল্প বলতে ভালবাসে মানুষ। এ তার স্বভাবী প্রবণতা। সুতরাং গল্প রচনা বিশেষ নতুন ঘটনা নয় কোন। পক্ষান্তরে শিল্প হিসাবে উপন্যাস অভিনব কেননা সাহিত্যের এই আধুনিক শাখাটি গল্পকে ছাড়িয়ে অবলম্বন করেছে অনুগল্পের মিছিল, ধারণ করেছে ঘটনা-অনুঘটনার বুনট, জগৎ-ব্যাপ্ত মানবজীবন ছেঁকে সংগ্রহ করেছে সমরূপ কাহিনীর বিভিন্ন দৃষ্টান্ত। গল্পের আকর্ষণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়েছে বর্ণনার নানা কলাকৌশল; বর্ণনার ব্যাপ্তিতে গৃহীত হয়েছে মানুষের চিন্তা এবং চেতনার অনুসৃতি। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের দর্শনসিক্ত কথকতা, জীবনবোধের অনুদ্ঘাটন ও মৃত্যুচিন্তা; চিহ্নিত হয়েছে সমাজপ্রবাহের চালিকাশক্তি। লেখকের গভীর পর্যবেক্ষণ, দৃষ্টিউন্মোচনী বিশ্লেষণ, দিকনির্দেশী মন্তব্য উপন্যাসকে করেছে মননশীল। এসব নানাবিধ উপচার পরিবেশনের জন্য উপন্যাসের প্রয়োজন একটি সুচিন্তিত স্থাপত্যের : প্রথমত একটি কাঠামো এবং দ্বিতীয়ত বিভিন্ন ঘটনা ও গল্পের যথাযথ বিন্যাস। মাত্র দুই শত বৎসরে কত না অভিনব কাঠামো উদ্ভাবন করেছেন মনস্বী ঔপন্যাসিকেরা। অন্যদিকে ঘটনা, মন্তব্য আর চিন্তা-চেতনার বিচিত্র-বিচিত্রতর বিন্যাস এক ঔপন্যাসিককে আরেকজন থেকে অবিস্মরণীয়ভাবে বিশিষ্ট ও পৃথক করে দিয়েছে। উপন্যাসের ইতিহাস তাই গদ্যকৌশলের ইতিহাস, বর্ণনাভঙ্গির ইতিহাস।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে আমরা বিভিন্ন কাহিনী-অনুকাহিনী, ঘটনা-অনুঘটনার অন্তর্বয়ন 3 লক্ষ্য করি। কখনো নতুন পরিচ্ছেদে নতুন কাহিনীর সূত্রপাত, প্রায়শঃ একই পরিচ্ছেদের নানা কাহিনীর উল্লেখ। কুসুমের সঙ্গে শশীর সম্পর্কের সূত্রপাত প্রথম পরিচ্ছেদেই কিন্তু এর ওপর আলোকপাত অধারাবাহিক কেননা মানুষের বাস্তব জীবনে যেমন ঘটে তেমনি শশীর জীবনের ব্যস্ততাবিস্তারী নানা ঘটনার ওপর পর্যায়ক্রমে আলো ফেলেছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। কাহিনী একরৈখিকতার পরিবর্তে পরিগ্রহ করেছে জালিকাবিন্যাস। এমত অন্তর্বয়ন উপন্যাস রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। মানিক বন্দোপাধ্যায় শুরু থেকেই এই কৌশলটি দক্ষতার সঙ্গে অবলম্বন করেছেন যদিও মতি ও কুমুদের গল্পটির ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়। দশম এবং একাদশ দুটি পরিচ্ছেদে মতি ও কুমুদের বিয়ে-পরবর্তী কোলকাতা বাসের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বিবৃত যে বিষয়ে শুরুতেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শুরু হয়েছে শশীর বাবা গোপার দাসের কীর্তিকাহিনী ওপর আলোকপাত করে;– এই সূত্রে ডাক্তারী পড়ার জন্য শশীর কোলকাতায় গমন এবং সেখানে কুমুদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা সন্নিবেশিত। অতপর লেখকের ক্যামেরার প্রবেশ হারু ঘোষের বাড়ীতে — লেখকের বয়ানের সেখানে অতীত থেকে বর্তমানে প্রত্যাবর্তন: হারু ঘোষের মৃত্যুর পর দিন সাতেক পার হয়েছে। মেয়ে মতির জ্বর এখনো কমেনি। পরানের মুখে তলব পেয়ে মতিকে দেখতে যাচ্ছে শশী। তখন সন্ধ্যেবেলা, শশী যখন পথে তখন উপক্রমণিকা হিসেবেই যেন মতিদের বাড়ী দৃশ্যপটে উঠে আসে। মতির মা মোক্ষদা আর পরানের বৌ কুসুমের সাংসারিক ঝগড়াঝাটির কৌতুকাবহ বর্ণনার মধ্য দিয়ে দু’জনারই চরিত্রের আভাস পাওয়া যায়। কুসুমের চলন-বলন-মেজাজের কিছুটা হদিশ হয়। দেরীতে হলেও ঘরে ঢুকে প্রদীপ জালিয়ে গাল ফুলিয়ে কুসুম তিনবার শাঁখে ফুঁ দেয়ার অব্যবহিত পরেই শশীর প্রবেশ। কুসুম হারু ঘোষের পুত্র পরানের স্ত্রী আর সেই সুবাদে শশী তাকে স্থানীয় রীতিমাফিক কখনো ‘বৌ’, কখনো ‘পরানের বৌ’ সম্বোধন করে। ম্যালেরিয়ার রোগী মতিকে সযত্নে পরীক্ষা করে শশী, মোক্ষদার সঙ্গে কথা বলে, চলে আসার সময় কুসুমের সঙ্গে খানিকটা কথাবার্তা, তারপর শশীর ঘরে ফেরার পালা।
ফেরার পথে ভূতোর বাবা বাসুদেব বন্দোপাধ্যায় শশীকে ডেকে বাড়ী নিয়ে গেলেন। কয়েকদিন আগে গাছের মগডাল থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙ্গেছে ভূতো। যথাযথ চিকিৎসা না-হওয়ার কারণে তার অবস্থা সংকটাপন্ন। শশীর পরামর্শ সত্বেও তাকে হাসপাতালে দিতে রাজী হয়নি তার স্বজনেরা। মরণাপন্ন ভূতোকে শশী পরীক্ষা করে, একটি ইনজেকশান দেয়। ঠিক এ সময়েই ভূতো শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে, বাড়ীতে মড়া-কান্নার রোল ওঠে। এ হেন পরিস্থিতিতে ডাক্তারের করণীয় থাকে না কিছু; শশী নি:শব্দে বেরিয়ে এসে ফের বাড়ীর পথে ওঠে–অদূরে পথের ধারে শ্রীনাথ দাসের মুদী দোকান।
শ্রীনাথ দাসের মুদি দোকানের সামনে যথারীতি অলস জটলা। শ্রীনাথ তাকে সাদরে ব’সে যেতে বলে। শশী বসে; তারপর ভূতোর সদ্য অকালমৃত্যুর খবরটি দেয়। পঞ্চানন চক্রবর্তী জানায় ভূতো যে মারা যাবে হিসাব ক’রে আগেই হদিশ পেয়েছিল সে। এরকম নানা গাল-গল্প চলতে থাকে। শান্ত অবহেলার সঙ্গে শশী সব শুনে যায়। উঠি-উঠি করছিল শশী এমন সময় উপস্থিত হলেন সংসারী সাধক যাদব পন্ডিত। যাদব পন্ডিত ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ হলেও শক্ত মানুষ। তিনি কোলকাতা গিয়েছিলেন কী এক কাজে। শশীকে তিনি বাড়ী নিয়ে গেলেন। যাদব পণ্ডিত শশীর ডাক্তারী বিদ্যাকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। তাঁর মতে সূর্যবিজ্ঞানই আদি বিজ্ঞান; আর সেই বিদ্যাই যাদের নেই তাদের সব বিদ্যে ফাঁকা হতে বাধ্য। শশীর চিবুক ধ’রে যাদব পণ্ডিতের বৃদ্ধা স্ত্রী পাগলদিদি রঙ্গ ক’রে বলেন, ‘বড়কর্তা বাড়ি ছিল না জানতে না বুঝি ছোটকর্তা? এলে না কেন গো? ডুরে শাড়িটি পরে, চুলটি বেঁধে কনে বৌটি সেজে বসেছিলাম তোমার জন্যে?’ শশী অনুভব করে, এ বাড়ীতে একটি পবিত্র পরিচ্ছন্নতা আছে যা মনের জ্বালা জুড়িয়ে দেয়। অথচ এ বাড়ীতে যেচে আসার তাগিদ অনুভব করে না সে।
৩.
নানা গল্প-অনুগল্পের সমন্বয়ে স্বল্প পরিসরেই কী নিখুঁতভাবে পরিব্যাপ্ত একটি রেখাচিত্র তৈরী করা সম্ভব তার আদর্শ প্রমাণ এই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। লক্ষ্য করা যেতে পারে উপন্যাসটির কাঠামোর সঙ্গে এই পরিচ্ছেদের প্রত্যক্ষ সংযোগ কেবল শশীর ডাক্তারের মৃত হারু ঘোষের কন্যা অসুস্থ মতিকে দেখতে যাওয়ার মধ্যে। আর এই সূত্রেই শশী ডাক্তারের সঙ্গে পরানের বৌ কুসুমের অন্তরঙ্গ সম্পর্কটির অবতারণা, অন্তত শশীর প্রতি কুসুমের অনুরাগের কথাটি পাঠককে জানিয়ে দেয়া। মতিকে দেখে বাড়ী ফেরার পথে বেগুনক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে হয়, সেখানে হাজির হয় কুসুম। শশী বলে, “কি আবার হল তোমার?” কুসুমের জবাব, “ পরানের বৌ বলে যে ডাকলেন আজ? পরানের বৌ বললে আমার গোসা হয় ছোটবাবু …।” এই অংশটি পরিচ্ছেদের মাঝামাঝি; আগে-পরে গোপাল দাস, কুমুদ, ভূতোর মৃত্যু, শ্রীনাথ দাসের মুদী দোকানের জটলায় শশীর অংশগ্রহণ এবং সবশেষে যাদব পণ্ডিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং অনুরুদ্ধ হয়ে তাঁর গৃহে গমন এইসব অনুকাহিনীর পরম্পরায় পরিচ্ছেদটির বিন্যাস।
কী উদ্দেশ্য এমত বিন্যাসের? প্রতীয়মান হয় গাওদিয়া গ্রামের নানা ঘটনাবলীর সঙ্গে একই রাগিনীতে শশী-কুসুমের কাহিনী মিশিয়ে দিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায় এ দু’জনের মধ্যকার সম্পর্কটিকে বিশেষ গুরুত্ববহ হ’য়ে ওঠা থেকে রক্ষা করেছেন। ফলে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ লায়লী-মজনু শিরি-ফরহাদ ছাঁচে শশী-কুসুমের কাহিনীতে পর্যবসিত হয়নি। আখ্যানবিন্যাসের এই কৌশলটি সচরাচর দেখা যায় না। এখানে মানিক বন্দোপাধ্যায় তিন প্রধান অগ্রজ বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র থেকে পৃথাকান্ন।
পরানের স্ত্রী হিসাবে চৌদ্দ বৎসর বয়সে গাওদিয়ায় এসেছিল কুসুম, তারপর শশীর সঙ্গে পরিচয়। এই পরিচয় কোন এক পর্যায়ে অন্তরঙ্গতায় উত্তীর্ণ হয়েছে দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু শশীর প্রতি গভীর অনুরক্তির কথা মুখে উচ্চারণ করেনি কখনো কুসুম। তার রমণীসুলভ আচার-আচরণে সেই নিরব প্রণয় বারংবার আভাসিত হয়েছে যদিও, তবু শশী তা’ সম্যক উপলব্ধি ক’রে উঠতে পারেনি যেন; ফলে কুসুমের সঙ্গে তার সম্পর্কটি দশ বৎসরেও ক্রীড়া-কৌতুকের মাত্রা ছাড়িয়ে ঘনীভূত হতে পারে নি। উপন্যাসটির নিতান্ত সর্বশেষ পরিচ্ছেদে লেখক কুসুম-শশীর সুপ্ত প্রণয়কে পারস্পরিক স্বীকৃতির স্তরে নিয়ে গেছেন দু’জনের উপান্তিক বাক্য বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তাতে অনিবার্য বিচ্ছেদের নিশ্চায়ন ভিন্ন অন্য কোন প্রতিশ্রুতির জন্ম হয় নি।
যে গ্রন্থগুলোকে আমরা মহৎ উপন্যাস বলে জানি, সেগুলোতে প্রায়শঃ সম্পর্ক বা সমস্যাকে ধারাবাহিকভাবে বিকশিত ক’রে একটি আত্যন্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে সৃষ্টি হয় নাটকীয় পরিণতির অবকাশ। পাঠকের জানা আছে প্রাচীন ট্র্যাজেডীর বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে একে বলা হয়েছে ‘ক্যাথারসিস’ যা বাৎসায়ন কথিত যৌনসঙ্গম কালে নারীর ‘রাগমোচন’ সদৃশ একটি চূড়ান্ত পরিণতি। এর জন্য প্রয়োজন সম্পর্ক বা সমস্যার ঘনীভবন। প্রত্যক্ষ হয়, মানিক বন্দোপাধ্যায় ঘনীভবনের পরিবর্তে তরলীকরণ করেছেন, নানা ঘটনার অন্তর্বয়নের কৌশল এতে সহায়তা দিয়েছে। ফলে তাঁর রচনায় ‘ক্লাইম্যাক্স’ নেই, ‘ক্যাথারসিস’ নেই, উচ্চকিত কোন পরিণতি নেই। কুসুম ও শশীর কাহিনী তাই প্রকটিত হয়ে ওঠেনি; প্রকটিত হয়ে ওঠেনি পিতা গোপাল দাস ও পুত্র শশীর দ্বন্দ্ব, উন্মোচিত হয়নি স্ত্রী সেনদিদির চিকিৎসায় যামিনী কবিরাজের অনীহার কারণ, রহস্যমণ্ডিত থেকে গেছে রক্ষিতার জীবন পরিত্যাগে বিন্দুর দৃঢ় অসম্মতির কারণ।
গ. বন পেরোনোর পথ
নায়কের চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে মানিক বন্দোপাধ্যায় একই সঙ্গে দুটি বয়ানকৌশল অবলম্বন করেছেন। প্রথমত শশীর আচার-আচরণ ও সংলাপে তার চারিত্র্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত লেখক সবজান্তা কথকের দায়িত্ব নিয়ে তথ্য দিয়েছেন, জুড়েছেন টীকা-টিপ্পনী। কথকের অবস্থান সন্নিকট। যেমন সে জানায়, “হারুর মরণের সংশ্রবে অকস্মাৎ আসিয়া পড়িয়া শশীর কম দু:খ হয় নাই; কিন্তু তার চেয়েও গভীরভাবে নাড়া খাইয়াছিল জীবনের প্রতি তাহার মমতা।” কারণ … “জীবনটা তাহার কাছে অতি উপভোগ্য বলিয়া মনে হয়” অথচ অন্যমনস্কতার কারণে মানুষ জীবনের অনেকাংশ অপচয় করে ফেলে। পরানের বোন মতির প্রসঙ্গে এরকম শোনা যায়: “সংসারের কাজ না করিলে কুসুম তাহাকে বকে। তালপুকুরের ধারে কাজ-ফাঁকি দেওয়া আলস্যটুকু মতি ভোগ করে ভবিষ্যতের চিন্তা করিতে করিতে। সুদেবকে মনে মনে মরিবার আশীর্বাদ করিয়া আরম্ভ না করিলে ভাবনাটা তাহার যেন ভালো খোলে না। মতির ভারি ইচ্ছা, বড়লোকের বাড়ীতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। কাজ নাই, বকুনি নাই, কলহ নাই, নোংরামি নাই, বাড়ির সকলে সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, হাসে, তাস-পাশা খেলে, কলের গান বাজায়, আর–আর বাড়ীর বৌকে খালি আদর করে। চিবুক ধরিয়া তাহার লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া বলে লক্ষ্মী বৌ, সোনা বৌ, এমন না হলে বৌ?”
মানিক বন্দোপাধ্যায় শশী ডাক্তারের গল্প শোনাতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর মূল অভীষ্ট তো গল্প ফাঁদা নয়, বরং গল্পের ছলে বিভিন্ন মানব চরিত্রের অজানা চরিত্র ও চেতনার ওপর আলোকপাত করা; এই আলোকপাত কখনো লেখকের পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে, কখনো-বা পাত্র-পাত্রীর উপলব্ধির মধ্য দিয়ে। কখনো লেখক আর নায়কের সত্বা মিশে একাকার হয়ে যায়। বিন্দুর খোঁজ নিতে কোলকাতা থেকে গাওদিয়া প্রত্যাবর্তনের আগে নন্দ’র বাসায় গেল শশী। না, নন্দর ছোট বউ হয়ে বাড়ীতে অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি বিন্দু, আসেনি সে শত অনুরোধেও। “শশীর মনে কি এ আশা ছিল গাওদিয়ার বাড়ীতে টিকিতে না পারিলেও নন্দর গৃহে গৃহিনী হইয়া বিন্দু থাকিতে পারিবে? বিন্দু আসে নাই শুনিয়া সে যেন বড় দমিয়া গেল। নন্দর বাড়ীঘর দেখিয়া সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছিল। … অন্দর বোধহয় বেশি তফাতে নয়–কোমল গলার কথা ও হাসি শশীর কানে আসিতেছিল–সে অনুভব করিতেছিল অন্তরালে একটি বৃহৎ সুখী পরিবারের অস্তিত্ব। তারপর একসময় সাত-আট বছর বয়সের একটি সুশ্রী ছেলে কি বলিতে আসিয়া শশীকে দেখিয়া নন্দ’র গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। … ‘গরমে যে ঘেমে উঠেছিস?’ বলিয়া নন্দ নিজে ছেলের জামা খুলিয়া দিতে শশী যেন অবাক হইয়া গেল। একি অসঙ্গতি নন্দ ও নন্দর আবেষ্টনীর মধ্যে? তার এই পুরুষানুক্রমিক নীড়ে শান্তি আছে নাকি? এই গৃহের সীমাবদ্ধ জগতে সুখ ও আনন্দের তরঙ্গ ওঠে আর পড়ে?”
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র শুরু থেকে শেষ অবধি এমনি অনেক মানুষ চেনার গল্প। বন পেরুলে মামার বাড়ী। বন পেরিয়ে মামা বাড়ী যাওয়ার দুটি পথ আছে। বনের ভেতর দু’সারি গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে, ঘাস আর পাতা মাড়ানো সরু পথে হেঁটে যাওয়া যেতে পারে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, সরাসরি মামার বাড়ী। এ পথ হ্রস্ব ও সহজ, সময়ও বেঁচে যাবে হয়তো। কিন্তু যার বনটি দেখে নেবার বাসনা রয়েছে সে যাবে ঘুরে ফিরে, হয়তো বামের জলাশয়টি ছুঁয়ে, ডানে – অনতিদূরে – বজ্রাহত মরা গাছটিরও খানিকটা ওপাশে ঘাসে ঢাকা খানিকটা ফাঁকা জায়গা ঘেঁষে, যেখানে খেলা করে কাঠবেড়ালীর বাদামী ছানাপোনা, অদূরেই জারুলের ডাল ছেড়ে হঠাৎ উড়ে যায় এক ঝাঁক সবুজ টিয়া। এই ঘুর পথে পুরো বনটি সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণার জন্ম হয়। সমাজ পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেও এই সূত্র প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষের চরিত্র তার সমগ্র প্রতিবেশে প্রোথিত। প্রতিবেশের আয়নায় মানুষ স্বচ্ছতর হ’য়ে ধরা পড়ে। তার চেয়েও বড় কথা নানা মানুষের কাহিনীর মধ্য দিয়ে সমাজের গহনে বহমান প্রধান অন্ত:স্রোতগুলো পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। লেখক কেবল আনন্দসঞ্চারী গল্প রচনা করেন না; একজন সমাবিজ্ঞানীর মতোই মানুষের জীবনের প্রধান নিয়ামকগুলোকে সমাজের ঘন ক্বাথ থেকে পৃথক ক’রে দৃশ্যমান ক’রে তোলেন।
২.
মানিক বন্দোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ লিখতে গেয়ে ঘুর পথটিই অবলম্বন করেছেন। তাঁর গতি ছিল ধীর, অথচ সুবিন্যস্ত। তাঁর গদ্যের বুনোট নিপাট। কেবল ঘটনার বর্ণনা নয়, হৃদয়ের জটিল অনুভূতিটুকু প্রকাশে এই গদ্য সক্ষম। এই যে ঘুর পথে বন পেরোনো এর চমৎকার উদাহরণ প্রথম পরিচ্ছদে বিবৃত হারু ঘোষের মৃতদেহ তার বাড়ী বয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র প্রথম পরিচ্ছদ খুব দীর্ঘ নয়, মাত্র সাত পাতায় লেখা। 4 পঞ্চম পৃষ্ঠার শুরুতে হারুর মরদেহ বহনের জন্য গ্রামবাসীকে ডেকে নিয়ে আসে মাঝি গোবর্ধন, তারপর হারু ঘোষের বাড়ী পৌঁছাতে তিন পাতা লেগে গেল কেননা হারু ঘোষকে কাঁধে ক’রে নিয়ে যাওয়ার আগে গাঁয়ের লোকেরা উবু হ’য়ে বসে জটলা পাকিয়ে গল্প করে; শশী তাগাদা দিলে তবেই রসিক বাবুর বাগান থেকে বাঁশ কেটে এনে মাচা বাঁধে; হারুর মরদেহ সরাসরি শ্মশানে না-নিয়ে বাড়ী নিয়ে যাওয়া সাব্যস্ত হয় কারণ হারু ঘোষের মেয়ে মতি খুব অসুস্থ, শ্মশানে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
গাওদিয়া যাওয়ার রাস্তাটি চওড়া কিন্তু কাঁচা। রাস্তার বর্ণনায় গ্রামীণ পরিবেশের কিছু আভাস ফুটে ওঠে। গাওদিয়া গ্রামে প্রবেশের আগে খালের সঙ্গে সংযুক্ত নালার ওপর পুল। তার নিচে স্রোতের মুখে বিকেল থেকে জাল পেতে বুকজলে দাঁড়িয়ে আছে নবীন মাঝি। নিতাই ঘোষ রুগ্ন ছেলের জন্য মাগুর মাছ ধরা পড়েছে কি-না জানতে চায়। অকপটে নবীন মিথ্যা জবাব দেয়। হারু ঘোষের অপমৃত্যুর খবর সে গ্রহণ করে শান্ত মনে। এসূত্রে লেখক তাঁর মন্তব্য গুঁজে দেন: “দিন নাই রাত্রি নাই, জলে-স্থলে নবীনের কঠোর সংগ্রাম। দেহের সঙ্গে মনও তাহার হাজিয়া গিয়াছে। হারুর মৃত্যুতে বিচলিত হওয়ার সময় নাই।”
পুল পার হয়ে সড়কের ডানে সাত ঘর বাগদীর বাস। লেখক জানাচ্ছেন, “দিনে ওরা যে গৃহস্থের চাল মেরামত করে, রাত্রে সুযোগ পাইলে তাহারই ভিটায় সিঁধ দেয়।” ধরা পড়ে জেলে যায়। জেল থেকে বেরিয়ে বলে, “শ্বশুর-ঘর থে ফিরলুম দাদা। বেশ ছিলাম গো।” বাগদি পাড়া ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলে অবস্থাপন্ন লোকদের বাস। লেখক জানাচ্ছেন, “মাঝে মাঝে কলাবাগান, সুপারিরবাগান ও ছোট ছোট বাঁশঝাড় … কোনো কোনো বাড়ীর সামনে কামিনী, গন্ধরাজ ও জবাফুলের বাগান করিবার ক্ষীণ চেষ্টা চোখে পড়ে।”
ঘনায়মান অন্ধকারে আলো হাতে সর্বাগ্রে শশী চলেছে; সর্বত্র নিরবতার মধ্যে কেবল শববাহকদের আলাপচারিতা ঘোষণা ক’রে চলেছে জীবনের অস্তিত্ব। আরো খানিকটা পথ এগিয়ে বাজার। বাদলার দিন আগেভাগেই প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। একটি চালার নিচে এক সন্ন্যাসী ধুনির আগুনে মোটা মোটা রুটি সেঁকে। লেখকের কিংবা শশীর চোখে পড়ে, “ওদিকের চালাটায় লোমওঠা শীর্ণ কুকুরটা থাবায় মুখ রাখিয়া তাহাই দেখিতেছে।”
কায়েত পাড়ার পথ শ্রীনাথ দাসের মুদি দোকানের পাশ ঘেঁষে। এ পথের একেবারে শেষে হারু ঘোষের বাড়ী। তারপর বিস্তীর্ণ মাঠ। পথের মোড়ে বাঁধানো বকুল তলা সরকারী আড্ডার জায়গা। এখানে পৌঁছে শশী বিড়ি ধরায়। সে লক্ষ্য করে শ্রীনাথের মেয়েটি বিকেলে বাবার দোকানের কাছে খেলতে এসে ন্যাকড়া-জড়ানো মাটির পুতুলটি ফেলে গেছে। সে ভাবে, যামিনী কবিরাজের বৌ ভোরবেলা বকুলতলা ঝাঁট দিতে এসে ভক্তি ভ’রে পুতুলটি তুলে নিয়ে যাবে।
গ্রামের কাদা মাখা পায়ে-হাঁটা রাস্তা। এগিয়ে যেতে যেতে শশী শববাহকদের সতর্ক ক’রে বলে, “সাবধানে পা ফেলে চল নিতাই, আস্তে পা ফেলে চল। ফেলে দিয়ে হারুকে কাদা মাখিয়ো না যেন।” এ উক্তিতে কেবল মৃতের প্রতি মমতা নয়, বাস্তববোধও গ্রথিত।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র গল্প এমনি ধীরলয়, বিরতিঘন; যেন দেয়ালে পরিব্যাপ্ত সুপ্রশস্ত একটি ক্যানভাসের ওপর ধীর পদক্ষেপে আলো ফেলে চলেছেন লেখক; কোন ত্বরা নেই; কেন্দ্রবিচ্যূত মূল ঘটনার অন্বেষণে এমত সন্ধানী পরিক্রমার বিকল্প নেই। বরং নানা ঘটনাপুঞ্জ ছুঁয়ে এগোতে-এগোতে একটি সর্বজনীন জীবনসূত্র আবিষ্কারই যেন লেখকের অভীষ্ট।
৩.
মহৎ শ্রেণীর কথাসাহিত্যের বড় একটি অংশে আমরা প্রত্যক্ষ করি নায়ক বা নায়িকার নোঙর ছিঁড়ে জীবনের নৌকাটি টালমাটাল বেসামাল হয়ে পড়েছে। এটি জমিদারের জন্য যেমন সত্য, ডোম-চাড়ালের ক্ষেত্রেও সমধিক সত্য। নায়ক একদিকে, পৃথিবী আরেক দিকে–এরকম একটি দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়া গল্প জমে ওঠে। কখনও এই দ্বন্দ্বের সমাধান হয়, কখনও থাকে অমীমাংসীত। কিন্তু এরকম গল্পের কাঠামো একরৈখিক না-হ’য়ে উপায় নেই; কেননা একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, বা একটি বক্তব্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকে বলে লেখককে এগোতে হয় নির্ধারিত লক্ষ্যভেদী পথরেখার সংলগ্ন থেকে। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় উদ্দেশ্যমনস্কতা প্রকট, তাঁর উপন্যাসের আখ্যানভাগ স্বীয় মতবাদের ছাঁচে ঢালাই করা; শরৎচন্দ্রের প্রায় সমগ্র রচনার প্রণোদনায় রয়েছে তীব্র সমাজসচেতনতা; রবীন্দ্রনাথেরও উপন্যাসে গভীর শুভবোধের নিবিড় নিয়ন্ত্রণ। তাঁরা বন পেরিয়েছেন সোজা পথে, নিবিষ্ট মনে, গভীর চিহ্ন রেখে রেখে। মানিকে উদ্দেশ্যহীনতা নেই, তবে অন্তত: ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় কোনরূপ উদ্দেশ্যমুখীনতাও প্রত্যক্ষ হয় না। তিনি এগিয়েছেন ঘুরপথে, থেমে থেমে, চারপাশে দৃষ্টি ফেলে। কোন বিশেষ পটভূমির নেই; কোন বিশেষ মতবাদ নেই; সম্পূর্ণ অনুপস্থিত কোন আদর্শ কি চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের আঙ্গিকে, বিন্যাসে এবং বর্ণনাকৌশলে শিল্পীজনোচিত নিস্পৃহতা স্পষ্ট। তবে নানা সচেতন কৌশল প্রত্যক্ষ হয় মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বর্ণনাভঙ্গিতে।
উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শুরু হয়েছে শশীর বাবা গোপাল দাসের কীর্তিকাহিনী ওপর আলোকপাত করে, এই সূত্রে শশীর ডাক্তারী পড়ার জন্য শশীর কোলকাতায় গমন এবং সেখানে কুমুদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা। এই দুটি অনুকাহিনী ফ্ল্যাশব্যাকে বর্ণিত; তারপর আবার বর্তমানে ফিরে আসা। হারু ঘোষের মৃত্যুর পর দিন সাতেক পার হয়েছে, মেয়ে মতির জ্বর এখনো কমেনি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, পরানের মুখে তলব পেয়ে মতিকে দেখতে যাচ্ছে শশী। শশী যখন পথিমধ্যে তখন উপক্রমণিকা হিসেবেই যেন মতিদের বাড়ীর ভেতর আলোকসম্পাত। এতে কুসুমদের বাড়ীর আবহ উঠে আসে, কুসুমের মেজাজ-মর্জ্জিরও কিছু আলামত পাওয়া যায়। এ অংশটি যেন অনেকটা ফ্ল্যাশফরওয়ার্ড। বস্তুত মানুষের সক্রিয়তা বর্তমানে, কিন্তু তাকে প্রভাবান্বিত করে তার অতীত, অন্যদিকে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। ‘পুতুর নাচের ইতিকথা’ লিখতে গিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায় লাগসই ভাবে ফ্ল্যাশব্যাক আর ফ্ল্যাশফরওয়ার্ড দিয়ে বর্তমানকে সংগ্রন্থিত করেছেন অতীত আর ভবিষ্যতের সঙ্গে। এ যেন বনের ভেতর কোথও মরা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগের সঙ্গে-সঙ্গে একবার স্মৃতি রোমন্থন, আরেকবার ভবিষ্যতের কোন স্বপ্নে বিভোর হয়ে যাওয়া।
সঙ্গীতের আস্বাদন যেমন শ্রবণসাপেক্ষ, চিত্রকলা যেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য, সাহিত্য তেমনি পাঠের মাধ্যমে অধিগম্য। তবু বর্ণনাই কেবল লেখকের সম্বল নয়। কথাসাহিত্যে সংলাপ যেন ছবিকে ধ্বনিময় ক’রে তোলে। সংলাপ গল্প পরিবেশনার লয় দ্রুততর করে। সংলাপের ওপর জোর নেই মানিক বন্দোপাধ্যায়ের যদিও অনবদ্য সংলাপ রচনার স্বাক্ষর ঢের আছে এ উপন্যাসের অবয়বে। সেই সঙ্গে সংলাপকে টানা গদ্যে বর্ণনারও ঝোঁক লক্ষ্য হয়। শশীর প্ররোচনায় স্বামীকে না ব’লে কোলকাতা থেকে পালিয়ে বাপের বাড়ী চলে এসেছে বিন্দু। কারণ শুনে শশীর সঙ্গে কলহ করলো গোপাল দাস : “চেঁচামেচি করিয়া সে বলিতে লাগিল যে এমন কাণ্ড জীবনে সে কখনো দ্যাখে নাই। স্ত্রীকে মানুষ নিজে খুশিমতো অবস্থায় রাখিবে এই তো সংসারের নিয়ম। মারধর করিলে বরং কথা ছিল। কিছুই তো নন্দ করে নাই। যা সে করিয়াছে বিন্দুর বরং তাতে খুশি হওয়াই উচিত ছিল। স্ত্রীকে ভিন্ন বাড়ীতে হীরা-জহরত দিয়া মুড়িয়া রাখিয়া চাকর-দারোয়ান রাখিয়া দিয়া কেহ যদি নিজের একটা খাপছাড়া খেয়াল মিটাইতে চায়, স্ত্রীর সেটা ভাগ্যই বলিতে হইবে। স্বামীর সে অধিকার থাকিবে বৈকি। মদ খায় নন্দ? সংসারে কোন্ বড়লোকটা নেশা করে না শুনি? তখন বলিলেই হইত, অত কষ্টে বড়লোক জামাই যোগাড় না করিয়া একটা হা-ঘরের হাতে মেয়েকে সঁপিয়া দিত গোপাল–টের পাইত মজাটা!”
সংলাপের এমতরূপ পরোক্ষ বিবরণ (বলা যায়, ‘সংলাপের বর্ণনাকরণ’) অন্য কোন লেখকের রচনায় চোখে পড়ে না। এই বর্ণনাংশের ঠিক পরই এসেছে প্রত্যেক্ষ সংলাপ। গোপাল বলে :
“কেন ওকে তুই নিয়ে এলি শশী! তোর কর্তালি করা কেন! ছেলেখেলা নাকি এসব, অ্যাঁ? রেখে আয়গে, আজকেই চলে যা।”
“তা হয় না বাবা। আপনি সব জানেন না–জানলে বুঝতেন ওখানে বিন্দু থাকতে পারে না।”
“এতকাল ছিল কি করে?”
এ প্রশ্নের জবাব ব্যতিরেকেই পিতা-পুত্রের কলহ শেষ হয়। কিন্তু এই অংশটিও কি সংলাপের পরোক্ষ বিবরণে পুরে দেয়া যেত না? না, যেত না, কারণ গোপালের প্রশ্ন “এতকাল ছিল কি করে?” এ উপন্যাসের অন্তর্নিহিত বাণীর বিবেচনায় বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তাই সংলাপের মধ্য দিয়ে গোপালের মুখে এই প্রশ্নটি জুড়ে দিয়েছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়।
এই যে গোপালের প্রশ্ন “এতকাল ছিল কি করে?”, বিন্দু কে নিয়ে গাড়ীতে ক’রে বাড়ী ফেরার পথে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল শশীও। প্রশ্নের উত্তরে পথের পাশে সাজানো দোকানের দিকে চোখ রেখে বিন্দু বলেছিল, “ভেবেছিলাম ক্ষমা করবে।” এই উত্তর অপ্রত্যাশিত। নিজের কষ্টের কথা ভাবেনি বিন্দু, তাকে নন্দর হাতে গছাতে গিয়ে পিতা গোপাল দাস যে অন্যায় কারচুপি করেছিল তারই ক্ষমার প্রত্যাশায় এতদিন বিন্দু নন্দ’র ঠাঁই থেকে পালিয়ে আসেনি।
৪.
বিয়ের পর বিন্দুকে নিজ পৈত্রিক সংসারে তোলেনি নন্দ, পৃথক রেখেছিল রক্ষিতার মতো, দীর্ঘ সাতটি বছর। সব জেনেও গোপাল দাস বিন্দুর পিত্রালয়ে পালিয়ে আসাকে বলেছে “ছেলেখেলা”। “খেলা” শব্দটি এ উপন্যাসটির প্রচ্ছদনামের মধ্যেও নিহিত। প্রচ্ছদনাম কখনো কখনো উপন্যাসের নিহিতার্থ সন্ধানে সমস্যার কারণ হ’য়ে দাঁড়ায়। এ উপন্যাসটি পড়ে পাঠকের মনে এই প্রশ্ন ওঠা ন্যায্য এর নাম ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ কেন। মানুষের জীবন কখনো নিছকই পুতুল নাচের পুতুলের মতো; নিজের ইচ্ছায় চলতে পারে না মানুষ, সে চলে সূতোর টানে। জগৎ-সংসারে মানুষই তবে পুতুল? মানুষ নাচছে ঈশ্বরেরই সূতোর টানে? — এভাবেই জীবনের, সমাজের, জগতের সব কিছুকে সব ঘটনাকে ন্যায্যতা দেয়া সম্ভব। যে নাস্তিক সে একটু ঘুরিয়ে হয়তো বলবে ‘সবই অদৃষ্টের খেলা’। কিন্তু ঈশ্বর বা অদৃষ্ট কাউকেই নিয়ামক মেনে নেননি মানিক বন্দোপাধ্যায়। ‘পুতুল নাচের ইতিকথার’ গল্পগুলোতে আমরা দেখি, ঈশ্বর নয়, ভবিতব্য নয়, মানুষ নাচছে মানুষেরই সূতোর টানে । মানুষেরই প্রভাবে মানুষের জীবন খেলায় পর্যবসিত হয়ে যায়।
মানুষ মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে চায়, চায় অনুশাসনের শৃঙ্খলে বাঁধতে। মানুষের এই প্রবণতা মজ্জাগত। নানা প্রণোদনা কাজ করে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার পশ্চাতে। মানুষের জীবন নিয়তি নির্দিষ্ট নয়, তা’ আন্দোলিত হয় অন্য মানুষেরই হাতে। মানুষ পরিণত হয় অন্যের ক্রীড়নকে। একজনের খেয়াল মেটাতে আরেকজনের জীবন আমূল ধ্বস্ত হয়ে পড়ে। ভেঙ্গে পড়ে স্বপ্ন, সাধ, আকাঙ্ক্ষা। এই উপলব্ধিটিতেই মানিক বন্দোপাধ্যায় পাঠককে অংশীদার করতে চেয়েছেন এ উপন্যাসের নানা ঘটনা-অনুঘটনার মধ্য দিয়ে ।
হারু ঘোষ বজ্রাহত হয়ে প্রাণ দিয়েছে সন্দেহ নেই কিন্তু শশীর পাগলদিদিকে সহমরণ বেছে নিতে হয়েছে যাদব পণ্ডিতের অহং সিদ্ধির স্বার্থে। শহরের লেখাপড়া করা ছেলে কুমুদ কিশেরী মতিকে বিয়ে করতে আগ্রহী কেননা এই কোমলমতি, অবোধ, অশিক্ষিত গ্রাম্য কিশোরীতাকে ‘মনের মতো’ ক’রে গড়ে তোলা সম্ভব। কোলকাতার নন্দ গাওদিয়ায় এসে বিন্দুকে বিয়ে করে চাপে পড়ে, কিন্তু কোলকাতায় ফিরে তাড়িয়ে দেয় না; সে বিন্দুকে রক্ষিতার মতো রেখে মজা লুটতে চায়। বসন্তে আক্রান্ত সেনদিদির চিকিৎসা হয় না স্বামী যামিনী কবিরাজ অনিচ্ছুক বলে। শশী ডাক্তার শহরে যেয়ে বৃহত্তর পৃথিবীর স্বাদ নিতে ব্যর্থ হয় কারণ গোপল দাস স্বীয় সম্পত্তি রক্ষার প্রয়াসে শশীকে গ্রামে বেঁধে রাখতে চায়। এ ভাবেই ঈশ্বর নয়, মানুষই মানুষের জীবনধারা ওলোটপালট ক’রে দেয়। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পাত্র-পাত্রীরা সমাজের কেউকেটা নয় কোন, অতি সাধারণ মানুষ। গাওদিয়ার এই সাধারণ মানুষের জীবনের ওপরই আলো ফেলতে চেয়েছেন লেখক; এই সাধারণ মানুষগুলোর জীবনকেই সাহিত্যে ধারণ করেছেন তিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে। তাঁর পর্যবেক্ষণে নিরাবরণ হয়েছে মানুষ কেমন ক’রে মানুষের জীবন নিয়ে খেলে। ঈশ্বর নয়, ভবিতব্য নয়, মানুষই মানুষের খেলার পুতুল।
ঘ. উপসংহার
মানিক বন্দোপাধ্যায় আধুনিক বাঙলা কথাসাহিত্যের অন্যতম স্থপতি। বাঙলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের যে যুগস্রষ্টার অবদান, মাত্র আটচল্লিশ বছরের জীবনে মানিক বন্দোপাধ্যায় বাঙলা কথাসাহিত্যে সমতূল্য কীর্তি রেখে গেছেন। যৌবনের প্রারম্ভেই ব্যাধি ও দারিদ্র তাঁকে যুগপৎ ছেঁকে ধরেছে; উভয়ের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে তাঁকে আমৃত্যু;– তবে সকল প্রতিকূলতার ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য ক’রে তিনি চল্লিশটি উপন্যাস এবং দুই শত গল্পের বিশাল বিচিত্র ভাণ্ডার রেখে গেছেন। নি:সন্দেহে বলা যায় ১৯৩৫-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য এবং পরবর্তী বৎসর প্রকাশিত ‘‘পদ্মা নদীর মাঝি’’ ও ‘‘পুতুল নাচের ইতিকথা’’ বাদ দিয়ে আধুনিক বাঙলা কথাসাহিত্যের ইতিহাস রচিত হ’তে পারে না।
তাঁর আলোচনা সূত্রে সাধারণত: যে প্রসঙ্গটি প্রায়োবধারিতভাবে উত্থাপিত হয়ে থাকে তা’ হলো তাঁর বিশিষ্ট গদ্যরীতি। এ কথা অনস্বীকার্য যে তিনিই সর্বপ্রথম মুখের ভাষাকে সাহিত্যে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেই থেকে কথ্যরীতির ভাষা বাঙলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু ভাষাকেন্দ্রিক আলোচনার অবকাশে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আড়ালে পড়ে যায় তা’ হলো মানিক বন্দোপাধ্যায় তাঁর গল্প-উপন্যাসে এমন সব বিষয় ও অনুষঙ্গ, ঘটনা ও দুঘর্টনা সন্নিবেশ করেছেন যা এক কথায় অভূতপূর্ব।
কী অতীত কী বর্তমান সর্বত্র সাহিত্যের উপচার বিরাজমান। তা’ সংগ্রহ ক’রে বিভিন্ন লেখক বহুবর্ণ রচনার মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে সাহিত্যের ভান্ডার গড়ে যাচ্ছেন। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া অবিশ্রান্ত। এই অর্থে সাহিত্য সদা জায়মান যা নতুন লেখকের নব অবদানে সমৃদ্ধ হওয়ার আশায় নিয়ত অপেক্ষমান। বস্তুত: সাহিত্যের বেলাভূমিতে দৃঢ়মূল গোড়া পত্তনের স্বার্থে লেখককে ‘অকথিত বাণী’র পসরা নিয়ে উপস্থিত হতে হয়। জগৎ-সংসারে প্রতিনিয়ত কত না কিছু ঘটে চলেছে যা সচরাচর সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে, অনুধাবনের ঊর্দ্ধে থেকে যায়। লেখক তা আবিষ্কার করবেন, অত:পর কল্পনার ময়ান দিয়ে তাকে রসসমৃদ্ধ ক’রে পরিবেশন করবেন যাতে পাঠকের চিত্ত আন্দোলিত হয়, মননে আলোড়ন ওঠে। এটি কথাসাহিত্যিকের প্রধান দুটি দায়। মানিক বন্দোপাধ্যায় এই দায় মেটাতে আপ্রাণ খেটেছেন। মানিক বন্দোপাধ্যায় নিম্নশ্রেণীর খেটে খাওয়া, দরিদ্রপ্রপীড়িত, অশিক্ষিত, অসহায় মানুষের জীবনকে তাঁর রচনার উপজীব্য করেছিলেন অন্তর্দৃষ্টির তাগিদে। এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “মধ্যবিত্ত আর চাষাভুষো ওই মুখগুলো মৃম্ময় অনুভূতি হয়ে চেঁচাতো ‘ভাষা দাও’, ‘ভাষা দাও’।” এই দাবীর উত্তর তিনি আমৃত্যু দিয়ে গেছেন বিচিত্র সব রূপবন্ধ অবলম্বনে।
টীকা:
- ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায়, ধারাবাহিক পর্বে। পুস্তকাকারে এটি প্রকাশিত প্রথম হয় ১৯৩৬-এ; প্রকাশক ডি. এম. লাইব্রেরী, কলকাতা। ↩
- মানিক বন্দোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র একটি দ্বিতীয় পর্ব লিখবেন বলে মনস্থ করেছিলেন বলে জানা যায়। হয়তো কুমুদ-মতির উপাখ্যান সে দ্বিতীয় পর্ব থেকেই তুলে আনা একটি অংশ। ↩
- ‘অন্তর্বয়ন’ বা ইন্টারউইভিং; ‘অন্তর্বয়ান’ বা ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি নয়। ↩
- বাংলাদেশের অবসর প্রকাশনী প্রকাশিত ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। প্রথম অবসর প্রকাশ ২০০৪। পুনর্মুদ্রণ ফ্রেব্রুয়ারী ২০০৮। ↩