বাংলা কথাসাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে যে গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবন ও তার নানাবিধ আন্তর অসঙ্গতির চিত্র কথাসাহিত্যিকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির আঁচড়ে উন্মোচিত হয়েছিল তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্যদের বিচিত্র পথ অতিক্রম করে বহুবর্ণিল বর্ণনা বিন্যাসে এক ভাস্কর্যসুলভ সৌধ নির্মাণের পর দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সাহিত্যে ক্রমপ্রসার লাভ করেছে অনিবার্য গতিসূত্রে। স্বাধীনতা-উত্তর (১৯৭১) বাংলাদেশে নগরায়ণ এবং নাগরিক জীবনের ক্রমবর্ধমান প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জীবন প্রণালি ও রুচির পরিবর্তন হতে থাকে। জীবনের নানাবিধ অনুষঙ্গ যেমন- প্রেম-ভালোবাসা, নর-নারীর জটিল মানসিক ও দৈহিক সম্পর্ক এবং অন্যান্য মূল্যবোধের পরিবর্তনকে আত্মস্থ করে কথাসাহিত্যিকরা তাঁদের সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিক সমাজে ব্যক্তির প্রথাগত পথের বিপরীতমুখীন হবার প্রবণতা ও তা থেকে পারিবারিক জীবনে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উন্মেষ এবং সর্বোপরি ব্যক্তি চৈতন্যের অতল গহ্বরে টানাপড়েনের ফলে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় তারই কুশলি উপস্থাপন করেন গ্রামীণ জীবনকে গুরুত্ব দিয়েই। আর ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হওয়ায় লেখকের জীবন-দর্শন সূক্ষ্মতা অর্জনে সক্ষম হয়।
মহীবুল আজিজ আশির অন্যান্য নতুন প্রজন্মের মতই মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব সংকট, চেতনালোকের নানাবিধ ক্ষরণ, গ্রামীণ জীবনের অসুস্থ জীবনাচার ও মূল্যবোধের টানাপড়েনকে তাঁর কথাসাহিত্যে সুদক্ষ শিল্পীর কুশলি বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। কবি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও তাঁর গল্পগ্রন্থগুলো বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য। জীবনের প্রতি প্রবল অনুরাগ, মানবিক সম্পর্কের জটিল অন্ধিসন্ধির জালভেদ ও মানব সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর গল্পে তীব্র মঙ্গলাকাক্সক্ষায় উৎসারিত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ মহীবুল আজিজের গল্পগ্রন্থের অন্যতম সার্থক প্রাপ্তি। তাঁর ‘গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ’ (১৯৮৮), ‘দুগ্ধগঞ্জ’ (১৯৯৭), ‘মৎস্যপুরাণ’ (২০০০), ‘আয়নাপড়া’ (২০০৬), ‘বুশম্যানের খোঁজে’ (২০১২), ‘নীলা মা হতে চেয়েছিল’ (২০১৪), ‘তপনশীল ও তার বিবাহ-প্রকল্প’ (২০১৫-প্রকাশিতব্য) প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত দুটি উপন্যাস যথাক্রমে- ‘বাড়ব’ এবং ‘যোদ্ধাজোড়’- উক্ত মন্তব্যের সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপনযোগ্য। মহীবুল আজিজ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সামরিক শাসনের বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন। এসময় সাহিত্য জগতে প্রবেশের পর গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের চিন্তা ও আবেগকে অন্তরে লালন করে নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি মানুষকে অবলোকন করতে চেয়েছেন বিভিন্ন গ্রন্থের গল্পসমূহে। তিনি নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনে ব্যক্তি মানুষের অতল গহীনে ডুব দিয়ে তাঁর যন্ত্রণা, কষ্ট, ভয়, হতাশা, সংশয়, সাহসিকতাকে পরিস্ফুট করেছেন অসামান্য আলোকসম্পাতে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো একদিকে যেমন নাগরিক রুচি এবং আবেগকে লালন করে তেমনি অপরদিকে নাগরিক সভ্যতার যে নেতিবাচক অবদান- সংশয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গতা, আত্মানুসন্ধানের আত্মদহন প্রভৃতি মনোজগতের অতল গহ্বরের অন্ধকারের পুঞ্জিভূত উপাদান চরিত্রের মনের মধ্যে থেকে লেখক আবিষ্কার করেছেন বিশ্লেষণমুখী প্রক্রিয়ায়। পুঁজিতন্ত্রের অভিঘাতে যেখানে ব্যক্তির সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো অগ্রাহ্য হয়েছে, অনিকেত সঞ্চারী করে তুলেছে তার দৈনন্দিন জীবন, সেখানে যন্ত্রণাদগ্ধ সেই ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বিবরণ ও বিশ্লেষণ হয়ে উঠেছে প্রধান। নাগরিক সভ্যতাও যে ধর্মীয় আবেষ্টন থেকে ব্যক্তির যন্ত্রণা ও অবচেতনের কামনাকে অগ্রাহ্য করতে চায় এবং এরই ফলে ব্যক্তি মানুষ কীভাবে প্রতিবাদী সত্তায় জাগরিত হয় তারই শিল্পরূপ অধিকাংশ গল্পের গতিচঞ্চল প্রান্ত। অন্যদিকে আবার গ্রামীণ জীবন অবলোকনে তাঁর স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর গল্পে গ্রামীণ জীবন, রাজনীতি ও নাটকীয়তা এবং মুক্তিযুদ্ধের রূপায়ণ সম্পর্কে আমার নেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন- ‘আমার শৈশব গ্রামেই কাটে। জন্ম যশোরের নড়াইলে ১৯৬২-র ১৯ এপ্রিল। ১৯৬৬-তে বাবার চাকরিসূত্রে চলে আসি চট্টগ্রামে। সেই থেকেই এখানেই। আমরা থাকতাম চট্টগ্রামের দোহাজারিতে। এমন যে এলাকা, রাতে হাতি যেতো আমাদের ঘর ঘেঁষে। ওখান থেকে কখনও কখনও বাবার সঙ্গে জিপে করে আরও ভেতরে যেতাম বান্দরবানে- পাহাড়, বন-জঙ্গল এসব মিলে মিশে সে এক অবর্ণনীয় শৈশব অভিজ্ঞতা। আমার গল্পে গভীর গ্রাম নেই, যে গ্রামীণতাটুকু এসেছে তা গল্প বা চরিত্রের প্রয়োজনেই। রাজনীতি এবং নাটকীয়তার কথা যদি বলি পৃথিবীর সব সাহিত্যেই এই দুটি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ। সেই কতকাল আগেরকার ‘ডেকামেরন’ কিংবা চসারের কাব্যগুলি দেখুন রাজনীতি এবং নাটক দুই-ই আছে। নাটকীয়তাও আসলে এক ধরনের সামাজিক অবস্থা বা সামাজিক পরিস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমার পুরাণ আমার ইতিহাস। আমার নয় বছর বয়সে বাংলাদেশে এ অসাধারণ ঘটনার সংঘটন। আমার বোধোদয়, চিন্তার বিস্তীর্ণতা, অনুভবের সামাজিকতা সবই আশ্চর্য এক বিদ্য
ুতে স্পৃষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনায়। পৃথিবীর এত বড় একটি ঘটনার মধ্যে কোনভাবে আমিও ছিলাম এটা ভাবতে পারাটাও বিস্ময়কর। আমার যে চারটি গল্পগ্রন্থ(বর্তমানে ৭টি) হিসেব করলে তার প্রতিটিতেই একটি করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প রয়েছে- ‘‘হোমো স্যাপিয়েন্স’’ (গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ), ‘‘তাড়িখানার বিস্ময়কর বালক ও পশ্চাতকাহিনী’’ (দুগ্ধগঞ্জ), ‘‘মৎস্যপুরাণ’’ (মৎস্যপুরাণ), ‘‘আয়নাপড়া’’ (আয়নাপড়া), ‘‘অনবয়ব’’ (বুশম্যানের খোঁজে), ‘‘বোরখাঅলি সুচিত্রা’’ (তপনশীল ও তার বিবাহ-প্রকল্প)। এটা কোন সমাপতনের ফল নয় হয়তো আমার চিন্তা প্রক্রিয়ার বিশেষ একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সংরক্ষিত।’(অরুন্ধতী, সেপ্টেম্বর ২০১০)
২.
বাংলাদেশের কথাশিল্পীরা প্রথম থেকেই বৃহত্তর গ্রামীণ জীবনকে তাঁদের গল্পের পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, সরদার জয়েনউদদীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শাহেদ আলী, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবু ইসহাক প্রমুখ যাঁরা বিভাগপূর্ব কাল থেকেই গল্প লিখেছেন তাঁদের অধিকাংশ গল্পেরই উপজীব্য গ্রামীণ জীবন। বিভাগোত্তর কালে ’৪৭ থেকে ’৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহে নবোদ্ভূত মধ্যবিত্তের মোহ ও মোহভঙ্গ, শোষণ ও চক্রান্তের ফলে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবন ও স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং নগরজীবনের বিকাশ না হওয়াতে এসময় মুখ্যত গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক জীবনের রূপায়ণই বাংলাদেশের ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বাস্তব সত্য। এঁদের গল্পের বিষয়ে যেমন দেশবিভাগ পূর্বকালের জীবনচিত্র রূপায়িত তেমনি আছে বিভাগ পরবর্তীকালের উদ্বাস্তু সমস্যা, মন্বন্তর, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দাঙ্গা ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা গল্প লিখেছেন, তবে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের গ্রামজীবন, গ্রামের বা শহরের যে ধরনের বিষয় তখনকার গল্পকারেরা অবলম্বন করুন না কেনো, গল্পে যাপিত জীবনের সংকট ও সমস্যার আলেখ্যই তাঁরা রচনা করেছেন। কোনো কোনো শিল্পীর রচনায় শ্রেণী সংগ্রামও প্রমূর্ত হয়েছে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে কালের সংকট ও দেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছোটগল্পের বিষয়ে অঙ্গীকৃত হয়েছে। এ সময়ে ছোটগল্পের বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৌশল ও ভাষিকরীতি অধিকতর প্রাগ্রসর, অগ্রগামী ও তীক্ষ্ণ। এ পর্বে প্রথম থেকেই কথাসাহিত্যিকরা রোমান্টিক পটভূমিতে প্রধানত গ্রামীণ জীবনকে নিরীক্ষণ করেছেন। গ্রামীণ জীবনের দারিদ্র্য-দুঃখ-আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটলেও অনেকের গল্পের পাত্র-পাত্রী বাস্তবানুগ হয়ে ওঠেনি। প্রধানত সামন্ত সমাজের নানা অসঙ্গতিকে বিন্যস্ত করে কখনো কখনো ব্যক্তির প্রতিবাদ রূপায়ণ করেছেন আবার কেউ কেউ। গ্রামীণ সমাজের দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানব জীবনের জীর্ণতার প্রতিচ্ছবি এবং তৎসঙ্গে অবক্ষয়িত সামন্ত সমাজের ধারাবাহিকতার প্রতীকরূপে মহীবুল আজিজের ‘নবিতুনের ভাগ্য চাঁদ’ উদিত হয়েছে।
ছোটগল্পের বিষয় ও প্রকরণে বিশিষ্ট গল্পকার মহীবুল আজিজ। পূর্বে উল্লিখিত তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে মনে হতে পারে তিনি গ্রামীণ জীবনকে ঠিক ধরতে পারেননি কিন্তু আমাদের পর্যবেক্ষণে বাঙালি সমাজের অস্তিত্বের সংকট ও স্বরূপ রূপায়ণে গ্রামীণ জীবনকে অবলম্বন করেছেন তিনি। তাঁর ‘দুগ্ধগঞ্জ’ গল্পগ্রন্থের নামগল্পে মন্বন্তর ও অতীতের বৃহত্তর গ্রামীণজীবন বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন শান্তির পরিবর্তে অপূর্ণতা ও অপ্রাপ্তি এবং সে সঙ্গে সমাজের বুর্জোয়া মুৎসুদ্দী শ্রেণীর ভেতর-বাড়ির দীনতা, বঞ্চনা, হতাশার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে অনেক গল্পে। অপরদিকে গ্রামীণ জীবনের সামগ্রিক রূপের প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন গল্পের লিবিডোতাড়িত চরিত্র উপস্থাপনে। ‘দুগ্ধগঞ্জ ছিল দুর্ভিক্ষের দেশ। তবু লোকলস্কর, যন্ত্রজাহাজ নিয়ে বিদেশী লোকেরা সে-দেশে এলো রতেœর সন্ধানে।’ এ তথ্যই বলে দেয় এটি বাংলাদেশের কাহিনী। গল্পের শুরুতে ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বিবৃতি উপস্থাপিত। এর পরই গল্পকার একজন অজ্ঞাতনামা চারণ কবির বরাত দিয়ে পদ্য-উপাখ্যান পেশ করেছেন, যদিও তা গদ্যে লিখিত। গল্প বলার এই কৌশল গুরুত্বপূর্ণ। লেখকের কল্পনা রাজা-প্রজা এবং কৃষকের জীবনকে স্পর্শ করে আবর্তিত হয়েছে। কাশেমের কাহিনী হয়ে উঠলেও গল্পটি আসলে স্বৈরশাসকের রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতাকেই নির্দেশ করে শেষ হয়েছে। ২৫ থেকে ৩৫ বছরের লোকদের রাজার বন্দি করার ফরমান জারির মধ্যে যুব সমাজের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইঙ্গিতও রয়েছে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী স্বৈরশাসকের আমলে আমাদের জাতীয় চৈতন্যে মুক্তিকাক্সক্ষা ও সংঘশক্তির বিকাশ ক্রমান্বয়ে উন্মোচিত হতে থাকে। এজন্য এসময় থেকে গল্পকাররা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁদের গল্পে গ্রামীণজীবন বাস্তবতার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ আশির দশকের গল্পে শ্রেণীশোষণ ও ধর্মশোষণ বাস্তবনিষ্ঠভাবে অনুসৃত হয়েছে। ‘গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ’ গ্রন্থের ৮টি গল্পের একটি ‘‘দ্বীপবাসীদের গল্প’’। এ গল্পে খাদেম চরিত্রের মধ্য দিয়ে মহীবুল আজিজ সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবনে ধর্মের বাতাবরণকে অঙ্কন করেছেন। জঙ্গলে প্রাকৃতিক কাজ করার সময় খাদেমের একটি ক্ষুদ্র ডিম প্রাপ্তির ঘটনাকে তিনি যুক্ত করে দিয়েছেন গ্রামীণ মানুষের ধারণা-বিশ্বাস ও স্বপ্নের জগতের সঙ্গে। ডিমটি ভেঙে গেলে তাদের জল্পনা-কল্পনার নাটকীয় সমাপ্তি দৃশ্যের অবতারণা হয়। গ্রামীণ জীবন অন্তর্গত মানুষের আর্তনাদ ও অপ্রাপ্তিজনিত যন্ত্রণা অঙ্কিত হয়েছে অনেক গল্পে। বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পকার গ্রামীণ জীবনের রূপায়ণ করেছেন তাঁর ‘গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ’ গল্পগ্রন্থের নামগল্পে। এর কেন্দ্রীয় বিষয় বলয়িত হয়েছে রাষ্ট্রের গ্রাম উন্নয়নের প্রচেষ্টার হাস্যকর উদ্যোগে এবং গরিবের জন্য করুণ ঘটনার উদ্ভবে। নবিতুন খেতে পায় না। গ্রামের এক প্রান্তে তার বাস। অথচ রাষ্ট্র গ্রাম উন্নয়নের যে উদ্যোগ নেয় সেখানে তাকে দিয়ে উদ্বোধন করানো হয় কর্মসূচির। টিপ সই নিয়ে তার জমি অন্যে দখল করে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী সন্তান হারিয়ে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম এক অর্থে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সংকটের সংগ্রাম।
জীবন বাস্তবতার রূপ-রূপান্তরে মহীবুল আজিজের অধিকাংশ গল্পে ব্যক্তির দ্রোহ ও প্রতিবাদ একই সঙ্গে প্রতিফলিত। গল্পগ্রন্থে শাসকশক্তির বিরুদ্ধে গ্রামীণ জীবনে পরিবর্তনের সূচনা ও স্থবির নিশ্চল ব্যবস্থার প্রতিপক্ষে ব্যক্তির প্রতিবাদ উচ্চারিত, উচ্চকিত। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর প্রতিবাদ মূলত ধর্মশোষণ ও সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধেই মুখরিত। তিনি সূক্ষ্মদৃষ্টিতে আধুনিক জীবনের বিবর্ণ-বিচূর্ণ রূপ অঙ্কন করেছেন এবং নেতিবাচক সমাজকাঠামোকে উপস্থাপন করেছেন। ‘অয়নাপড়া’ গ্রন্থের(সংকলিত ৬টি গল্পের শেষ গল্প) ‘‘আতশিকাচে দেখা একটি ক্ষুদ্র ঘটনা’ গল্পে পাশাপাশি দুই বাড়ির দুই নারী মেরিনা ও দিলরুবাকে ঘটনার মধ্যে রেখে তিনি সমাজের কলুষিত জীবনের বিচিত্র অনুষঙ্গ তুলে ধরেছেন। আকস্মিক ঘটনায় দিলরুবার দ্বারা মেরিনার চোখ সুই বিদ্ধ হলে দুই বন্ধুর সম্পর্কে ফাটল ধরে। দুটি পরিবারের মধ্যে বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে গল্পের পরিণতিতে দিলরুবাকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। অতীতের খুন, ধর্ষণ এবং বর্তমানের বিবাদ ও যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গে কাহিনীর যে বর্ণনাত্মক বিবৃতি তাতে গল্পকারের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের পরিচয় পাওয়া যায়। সূচনায় নাটকীয় পরিচর্যা এবং ঘটনা বর্ণনায় অনুপুঙ্খতা গল্পটির বিশিষ্ট প্রান্ত। স্বৈরশাসকের রাষ্ট্রে ব্যক্তির রক্তাক্ত চৈতন্য, মধ্যবিত্তের আত্মঅন্বেষণ-আত্মবিশ্লেষণ, তাদের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক অবক্ষয়চিত্র রূপকে-প্রতীকে-বাস্তবে তীক্ষ্ণ ঋজু ভাষায় উপস্থাপন করেছেন গল্পকার। তাঁর ‘আয়নাপড়া’র ‘‘মাইমিসিস’’ গল্পটি আলী আনোয়ারের নির্মম অভিজ্ঞতার সমকালীন বাস্তবতার বয়ান। অন্যদিকে ‘‘কলাজ’’ নিখোঁজ ও মৃত ছেলে রোকনালির দেহ সন্ধানে পিতা ইনসান আলীর অভিযাত্রার এক ভয়ঙ্কর প্রতিবেদনের আখ্যান। এসব ক্ষেত্রে লেখক সমাজের ক্ষতগুলোকে উন্মোচন করেছেন নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে। মূলত তাঁর গল্পে অবক্ষয়িত জীবনাচার এবং দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও ভয়াবহ পরিণতির মধ্য দিয়ে সমাজকাঠামোর অন্তঃসারশূন্যতা উন্মোচিত হয়েছে।
আশির দশকে নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে নাগরিক জীবন ক্রমবিকশিত হলো এবং গ্রামীণ জীবনে নগরের রুচি ও সভ্যতার তরঙ্গ স্পর্শ করেছিল। অপরদিকে অবরুদ্ধ সমাজচেতনা ও জটিলতম সমাজ গঠন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য রীতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য, আমাদের গল্পকারদের সমকালীন জীবন চিত্র অঙ্কনে সেই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করে। এজন্য গল্পকারদের পূর্বদৃষ্টি পরিবর্তিত হয়েছে। আর রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বস্তুবাদে নিবিষ্ট হলেন অনেকেই। এসময় মননসিদ্ধ শিল্পরীতির মধ্যে জাতিসত্তার সংকট রূপায়ণ করেছেন মহীবুল আজিজ। জীবনে অস্তিত্বের প্রাথমিক প্রয়োজনের সঙ্গে লিবিডোকে যুক্ত করে মনোবাস্তবতাকেন্দ্রিক জীবন রূপায়ণ করেছেন তিনি। সমাজের বিকৃত ভোগ-লালসার অস্থির-বিশৃঙ্খল বিবর্ণ চিত্র চিত্রিত হয়েছে তাঁর গল্পে। ‘আয়নাপড়া’র ‘‘প্রেম-অপ্রেম ও বোকামির গল্প’’ তরুণ সমাজের বিকৃতির উন্মোচন। বাল্যের লিবিডো-তাড়না বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সন্ত্রাসী ছাত্র রাজনীতির পথ ধরে একজন নারীর লাথির কাছে এসে শেষ পরিণতি লাভ করে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের পরিণতি দেখিয়ে গল্পকার আমাদের সমাজ জীবনে এ ধরনের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন গল্পটিতে। এ গল্পে সন্ত্রাসীর মনোজগৎ, তার প্রতিষ্ঠা, ভোগ লালসা সমস্তই উদ্ঘাটিত হয়েছে। ‘মৎস্যপুরাণে’র(৯টি গল্প সংকলিত) ‘‘নিয়মাবলী’’তে ঠিক একই ধরনের কিন্তু ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ উচ্চারিত। ছিনতাইকারী শিক্ষিত দুই যুবককে যে ঘটনার মধ্য দিয়ে লেখক রূপায়ণ করেছেন তা অভিনব। গল্পটির শেষে তাদের বিহ্বল করে আক্রান্ত ব্যক্তির নগ্ন হয়ে বেরিয়ে আসার ঘটনায় জননিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্তা ব্যক্তিদের গালে চপেটাঘাত পড়েছে। ‘‘বিপজ্জনক কালরেখা’’, ‘‘পতেঙ্গায় স্বর্ণের খনি’’, ‘‘বেদনানুবাদ’’, ‘‘পকেট মারে যে’’, ‘‘আমাদের সমুদ্র-দিন’’, ‘‘নীলা মা হতে চেয়েছিল’’- এ ছয়টি গল্পের সংকলন হচ্ছে ‘নীলা মা হতে চেয়েছিল’ গ্রন্থ। গ্রন্থটি মহীবুল আজিজের ষষ্ঠ গল্পগ্রন্থ। সবগুলো গল্পই ধারণ করেছে পারস্পরিক বিষয় ও আঙ্গিক-বিভিন্নতাকে। মা হওয়ার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত মানুষের যুদ্ধ কিংবা পৃথিবীর আপাত আলো হয়ে জ্বলা কোনো নারীর মনোবাঞ্ছার ভয়ঙ্কর উন্মোচন সবই এই চলতে থাকা জীবনের কঠোর বাস্তবতার বৃত্তান্ত। সরল গল্প নয় বলেই হয়তো তাতে ওঠানামার পরম্পরা। কখনো হাস্যরসের প্রবলাবর্তে দৈনন্দিনতার আড়ালে থাকা অজ¯্র উপাদানের চিত্রিত সমন্বয় এবং কখনো মানুষের অসহায় অনিরাপত্তার কারুণ্য মিলেমিশে আসে। জেগে থাকে কেবল জীবনের প্রণোদনা জীবন নিংড়ানো এবং জীবনের দিকে দৃষ্টিফেড়ানো। গল্পগুলোতে গল্পকারের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনচেতনার পরিপূর্ণ প্রকাশ লক্ষণীয়।
৩.
মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক গল্প-উপন্যাস রচনায় মহীবুল আজিজ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘‘বাড়ব’’(২০১৪) এবং ‘‘যোদ্ধাজোড়’’(২০১৪) উপন্যাস দুটি একই বছর প্রকাশিত কিন্তু বিষয় বিন্যাসের ক্ষেত্রে লেখক ভিন্নতর কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বুননে অন্য সব লেখক থেকেও আলাদা। ‘‘বাড়ব’’ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে ১৯৭১-এ মানুষের আনন্দ-বেদনার দিনগুলোর কর্মকা-। তখন ছিল প্রতিরোধ ও দ্রোহের শক্তি, সম্মিলিতভাবে প্রতিটি প্রাণে। আক্রমণ এসেছিল প্রাণসংহারি, জীবনবিদারি। তার বিরুদ্ধে নিঃশেষ হয়ে অর্থহীন আত্মসমর্পণে নিরর্থকভাবে ব্যয়িত হতে চায় নি যুগের পর যুগ মাথা তুলে বেঁচে থাকা এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মানব। কত তার কাহিনি কত তার কীর্তি। পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে জীবন ও যুদ্ধ নামক মহাকালের হাজারও উপাদান। ফলে মুক্তিযুদ্ধের বিয়াল্লিশ বছর পরেও শুরু হয় বাঙালির সেই বিজয়গাঁথার মাহাত্ম্য-দর্শন। এ যেন কখনই ফুরোবার নয়। হাসি-কান্নার আনন্দ-বেদনার সেই পরিচিত মানুষদেরই অমর ইতিহাসের মানবসংলগ্ন উপাখ্যান এই ‘‘বাড়ব’’ উপন্যাস। এ যেন আবার একবার ফিরে আসা, ফিরে এসে উৎস থেকে বিস্তারের দিকে যাত্রা। অন্যদিকে ‘‘যোদ্ধাজোড়’’-এ দুই যমজ ভাইয়ের গল্প বিবৃত হয়েছে। আলাল-দুলাল দু’ভাইয়ের একজন মুক্তিযোদ্ধা অপরজন রাজাকার। কিন্তু একই চেহারার দুই ভাইয়ের কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার তা সাধারণ মানুষের কাছে ধাঁধার মতো মনে হয়। কেবল তাদের মা এবং একজনের প্রেমিকার দৃষ্টিতে দুজনের ভিন্নতা ধরা পড়ে। ঔপন্যাসিক সুকৌশলে বর্ণনার পর বর্ণনা দিয়ে সেই রহস্যের প্রান্তে নিয়ে গেছেন আমাদের। মূলত যুদ্ধ আর জীবনের ভয়াবহ এক উদ্যাপন আছে এখানে। ১৯৭১ সেই কঠিন সংগ্রাম আর ¯œায়ুছেঁড়া উথাল-পাথাল আবর্তের আখ্যান। বিয়াল্লিশ বছর পরে এক অদ্ভুত গল্পের মুখোমুখি হই আমরা। যদিও যুদ্ধই এর উৎস কিন্তু মানব-জীবনের পরস্পর সন্নিহিত অথচ বিপ্রতীপ বোধের তা এক বিচিত্র কাহিনী। এতে আছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সংশয়-সত্যের দোলাচল। নেই পিছু-হটার পরাজয়ের চেতনা। তবুও সত্য বড় নির্মম, আসে আকস্মিক বজ্রের বেশে, আসে মারাত্মক অবিমৃষ্যে। ‘‘যোদ্ধাজোড়’’ মহীবুল আজিজের সেই উপন্যাস যা মুক্তিযুদ্ধের পরিব্যাপ্ত বাস্তবতার এক সুনির্বাচিত উৎকলন।
উপন্যাসের মতো ছোটগল্প রচনায় মহীবুল আজিজের সামাজিক দায়-দায়িত্ব বড় বেশি সোচ্চার। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পর দেখা গেছে সমাজপ্রবাহের নানা ভাঙা-গড়া হয়েছে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও পরিবর্তন এসেছে। শোষণ আর বঞ্চনা আগের তুলনায় বেড়ে গিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের কোনো অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনি। যদিও বঙ্গবন্ধু সরকার(১৯৭২-৭৫) মানুষের মঙ্গলচিন্তায় নানান কর্মসূচি নিয়েছিল। তবু এর মধ্যে গজিয়ে উঠেছে স্ফীতকায় একটি উচ্চবিত্ত শ্রেণী যার জীবনযাপনের কেন্দ্র ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রভৃতি বড়ো বড়ো শহর। এই শহরবাসীদের সঙ্গে গ্রামের অখ- সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন; ফলে দারিদ্র্যক্লিষ্ট গ্রামীণ সমাজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হবার প্রেরণা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। অন্যদিকে একাত্তরে শোষিত ও পীড়িত মানুষের যে অংশটি যুদ্ধ জয়ের নেশায় ছিল তারাও বিপর্যস্ত নানা কারণে। মানুষের দৃষ্টিতে এসেছে রাজাকারদের সমাজপতি হবার কৌশল, ঘাতকদের অধিষ্ঠান। ফলে আশাহত মানুষের নানা অনুষঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক গল্পগুচ্ছের প্রাণ। মহীবুল আজিজের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্পগুলোর নাম আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ‘গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ’ গল্পে গ্রামীণ পরিবেশে যুদ্ধ এসে কীভাবে নবিতুনের সাজানো সংসার ভেঙে দিয়েছিল সেই কাহিনী বর্ণিত। শহীদ জননীর নীড় ভাঙার কাহিনীই মুক্তিযুদ্ধের আবহ এনেছে। তবে গল্পটিতে যুদ্ধোত্তর স্বৈরশাসকের গ্রাম উন্নয়নের কর্মকা-ের ইতিবৃত্ত প্রাধান্য পেয়েছে। লেখকের ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি অলক্ষ্যে থাকেনি। ‘‘অনবয়ব’’ (বুশম্যানের খোঁজে) মহীবুল আজিজের একটি বিশিষ্ট গল্প। এ গল্প সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও অনুপুঙ্খ বর্ণনার অনন্য নিদর্শন। খ্যাতনামা পোর্ট্রটে শিল্পী শিমুল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাজ হিসেবে শহীদ যোদ্ধাদের পোর্ট্রেট করার সময় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাদাত কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে সাদাতের বড় ভাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদের পোর্ট্রেট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু শহীদ সাজ্জাদের কোনো ফটো নেই। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ৩৬ বছর দূরে দাঁড়িয়ে তার মুখচ্ছবির চিত্র অঙ্কন শিমুলের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। শহীদ সাজ্জাদের পোর্ট্রেট করার জন্য বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে শিমুলের যাত্রা হয়ে ওঠে মুক্তিসংগ্রামের মতই গুরুত্ববহ। শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে শিল্পী শিমুল হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাতারের একজন। ‘‘হোমো স্যাপিয়েন্স’’(গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ) মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ডাক্তারের কাহিনী। গল্পটিতে লেখকের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ প্রসংশনীয়। ডাক্তার আসিফ ও ফরিদার সংসারে তনিমার জন্ম মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হয়। সে সময় আসিফ শহরে থেকে যায়, ফরিদা গ্রামে। যুদ্ধ শেষে তনিমাকে নিয়ে ফিরে এলে স্বামীর অনুপস্থিতি তাকে স্মৃতির তাড়নায় দগ্ধ করে। যুদ্ধের সময় নিহত আসিফের হত্যাকা-কে ভাষার জাদুকরি বিন্যাসে লেখক তুলে ধরেছেন এ গল্পে। ইঙ্গিতময় বর্ণনা ও ফরিদার চেতনা জগতের পরিচয় ব্যক্ত করার জন্য লেখকের এ কৌশল অনন্য- ‘আজও মা মেয়েকে শোনায় গল্প। সে গল্পে বর্তমান বলতে কিছুই থাকে না। ভবিষ্যত বহু আলোকবর্ষ দূরে। কেবল অতীতের ঢাকনা খুলে যায় আর সেখান থেকে মানুষেরা অন্ধকার ফুঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে বিচিত্র সব অবয়ব-আকৃতি নিয়ে। ফরিদা তনিমাকে রিপ ভ্যান উইংকেলের গল্প শোনায়।’
‘‘তাড়িখানার বিস্ময়কর বালক ও পশ্চাতকাহিনী’’(দুগ্ধগঞ্জ)-এর কাহিনী উত্তম পুরুষের ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। কথক তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্য আড্ডার সূত্রে শুড়িখানায় উপস্থিত হয়েছেন। যেখানে বিহারি বা অবাঙালিদের প্রসঙ্গ এসেছে। নিজেদের শিল্প জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় রেলওয়ে কলোনিতে কথকের পিতৃব্য হত্যার ঘটনা। ইয়াকুবনগরে বিহারিদের নারকীয় হত্যাকা- এবং কথকের পিতৃব্য হত্যার প্রসঙ্গ একীভূত হয়েছে তাড়িখানার বিস্ময়কর বালক হায়দার আলীর ঘটনার সঙ্গে। বালক হায়দার বাজি ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। তাদের চেয়ে বেশি তাড়ি পান করে এবং কথকের বন্ধু এজাজসহ সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়। অবাঙালিদের তাড়ির রাজ্যে থেকেও কথকের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসার জন্য গল্পটি আমাদের অস্তিত্বের চেতনাপুঞ্জের বয়ান হয়ে উঠেছে। ‘‘মৎস্যপুরাণ’’ (মৎস্যপুরাণ) গল্পে লোকপুরাণের রাজ্যে ভ্রমণ করেছেন লেখক। রাজাকারের পুকুরে ধৃত মাছের পেটে পাওয়া মাদুলি খুলে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধের সময় নিখোঁজ কিশোরী-রূপসী আমিনা তাকে খুনি হিসেবে চিহ্নিত করে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের নারী সরবরাহকারী রাজাকার খালেখাজি বৃদ্ধ বয়সে চপেটাঘাত প্রাপ্ত হয় এভাবেই। তার মৃত্যু দেখিয়ে গল্পকার গল্পটি শেষ করেন। তবে গল্পের আখ্যানে রাজাকারের মনোজগতের উন্মোচনে এবং মাছের বিবিধ লোককথায় লেখক সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও রাজাকাররা এখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত এ বাস্তবতাও গল্পে বর্ণিত হয়েছে।
‘‘আয়নাপড়া’’(আয়নাপড়া) গল্পে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবার পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বর্তমান সময়ের আইনের ধারায় সন্ত্রাসী চিহ্নিত হয়। রাষ্ট্র যন্ত্র খননকৃত অস্ত্র ৩০ বছর পূর্বের জানা সত্ত্বেও নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করে একজন নিরীহ বেকার যুবককে ফাঁসানোর মাধ্যমে। এ গল্পে ব্যঙ্গ আছে। চুরি যাওয়া অলঙ্কার উদ্ধারের জন্য ধর্মগুরুর তৎপরতা ব্যঙ্গের শাণিত বাক্যবিন্যাসে উন্মোচিত হয়েছে। ধর্মগুরুর হার-উদ্ধার পর্ব বর্ণনায় গল্পকার পরিবেশ সৃজন করেছেন। মননশীল দৃষ্টির অনুপুঙ্খতা শেষ পর্যন্ত ইয়াসিনের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের স্মৃতির পর্বে প্রবেশ করে গল্পের পরিণতি ত্বরান্বিত করেছে। আয়নাপড়ানো গুরু লোহার ট্রাঙ্কের অস্ত্র উদ্ধারের কৃতিত্ব অর্জন করে আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শিহাব গ্রেফতার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। বৃদ্ধ ইয়াসিনের ওপর লেখকের সমস্ত সহানুভূতি বর্ষিত হয়েছে। আর আয়নাপড়ায় বিশ্বাসীরা হয়েছে তাঁর ব্যঙ্গের লক্ষ্য। আলোচ্য মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্পগুলোতে গ্রামীণ জীবন ও সমাজের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ আছে। কিন্তু গ্রামীণ জীবনের উদ্বাস্তু উন্মূলিত মানুষের রূপায়ণ নেই। জীবনের সুস্থ দিকের প্রতি লেখকের দৃষ্টি; অসুস্থ, কুৎসিত দিকে নয়।
মূলত মহীবুল আজিজের মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো ব্যাপক অর্থে দেশীয় রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক কথাবস্তুর রূপায়ণ। লেখকের গীতল বর্ণনা, বিবরণে বীভৎসতা পরিহার, শব্দে গ্রামীণ প্রেক্ষাপট বজায় রাখা এবং ছোটগল্পের সূক্ষ্ম কারুকার্যের প্রতি মনোযোগ তাঁর ছোটগল্পগুলোকে আস্বাদিত করে তুলেছে। সমাজের সপ্তরঙা রূপাঙ্কনে মহীবুল আজিজ রাজনীতি সচেতন। জীবনের নানাবিধ সংকট, রাষ্ট্র ও সমাজের মূল্যবোধের পরিবর্তন ও অবক্ষয় তাঁর লেখনিতে ধৃত হয়েছে। উপরন্তু সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে ১৯৭১’এর পরপরই নতুন একটি জোয়ার এসেছিল, জনজীবনে মুক্তির একটি উল্লাস। কিন্তু অচিরকালের মধ্যে মানুষ ক্রমশ হতাশ ও আর্থ সামাজিক পীড়নের মধ্যে এসে পড়ে। চতুর্দিক এই অসুস্থ আবহের মধ্যে কিশোর-তরুণেরা একটি উৎক্ষিপ্ত অবস্থায় ঘূর্ণিত হতে থাকে। এই সময়ের তরুণদের গল্পে সেই সময়ের স্বাক্ষরই ক্রমাগত মুদ্রিত হয়েছে। গল্পকার এই তরুণদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন। তাঁর গল্পে এজন্য আধুনিক শিল্পকলার পরিচর্যা লক্ষ করা যায়। নাগরিক রুচি, নাগরিক ভাষারীতি, নাগরিক জীবন, নাগরিক পরিচর্যা সংযোগে গ্রামীণ জীবনের শূন্যতা সুস্পষ্ট অভিব্যক্ত হয়েছে মহীবুল আজিজের কথাসাহিত্যে। গ্রামীণ মানুষের অস্তিত্বহীনতা দারিদ্র্য চিরপ্রসন্নতাবর্জিত জীবনের রূপকল্প আছে অনেক গল্পে। লেখকের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও মৌখিক কথোপকথনের ভঙ্গি কিংবা সর্বজ্ঞ লেখকের বর্ণনা অধিকাংশ গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে। ঘটনার বর্ণনায় তির্যকতা, নাটকীয়তা ও তীক্ষèগতি এই কথাসাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মহীবুল আজিজের ভাষিকরীতির কিছু দৃষ্টান্ত নি¤েœ দেয়া হলো-
ক) সমুদ্রে সূর্যোদয়ের দৃশ্য তুলনারহিত। একটা ঝাপসা গম্ভীর নেপথ্য-প্রবাহ যেন সৃষ্টিরও আগেকার ঘটনার মত দুর্বোধ্য চরিত্র নিয়ে বিরাজ করতে থাকে। ঢেউগুলি ভারী সিসা’র মত দুর্বহ অস্তিত্ব নিয়ে কোত্থেকে যে গড়াতে-গড়াতে আসে। হঠাৎ শতসহস্র লক্ষকোটি কিউসেক জলের গর্ভে সামান্য একটুখানি ইশারা সমস্ত দৃশ্যপট পাল্টে দেয়। (আমাদের সমুদ্র-দিন)
খ) কী যে সব গল্প চালু হতে থাকে নিমপুরে। কাজেই তারা যখন একদিন অবাক হয়ে দেখল তাদের সমস্ত চেতনায় যাবতীয় প্রভেদ বিলুপ্ত হয়ে দুটো পৃথক সত্তা এক হয়ে যাওয়াটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পথে তখন আলাল এবং দুলাল আর আলাল-দুলাল নেই, তারা আলাল ও দুলাল হয়ে গেছে। তারা আর এক পথের পথিক নয়। (যোদ্ধাজোড়)
গ) যুদ্ধ ছড়াতে থাকে। সর্বত্র এবং মানুষের মনের মধ্যে। মাটিতে গেঁথে থাকা যুদ্ধের শেকড় ডালপালা মেলে পল্লবিত হয়েই চলে। সেই বিস্তৃতির যেন শেষ নেই। কিশোরের পক্ষে এই যুদ্ধ ব্যাপারটার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। (বাড়ব)
ঘ) বাসের জানালাটা অদ্ভুত এক ফ্রেমের ধরনে উদ্ভূত হলে আমি দেখতে পাই সেই পাহাড়ি রমণীকে, যে তখন রূপ নিয়েছে রণেশ্বর চাকমার। দাঁড়িয়ে থাকা তার পেছনেই আনুভূমিক পাহাড় অনেকটা জায়গাজুড়ে। পাহাড়ি মেয়েটির সামনে মাটিতে রাখা তিনটি মৃৎপাত্রের একটি মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। সেই পাত্রটি এখন মনে হচ্ছে আর কেউ নয়, বন্ধু হাফিজ রহমান।(পাহাড়ে ওঠা-নামার দিন)
৪.
মহীবুল আজিজের কথাসাহিত্যের বিষয় যেমন মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালের জীবন তেমনি আছে যুদ্ধোত্তর সামাজিক সমস্যা, মন্বন্তর, সামরিক শাসন, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দাঙ্গা ইত্যাদি। তিনি অনেক বিষয় নিয়ে গল্প লিখেছেন তবে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন। গ্রাম বা শহরের বিষয় অবলম্বন করে গল্পে যাপিত জীবনের সংকট ও সমস্যার আলেখ্যই উন্মোচিত হয়েছে। তাঁর কোনো কোনো গল্পে শ্রেণী সংগ্রামও প্রমূর্ত হয়েছে। মূলত মহীবুল আজিজ নাগরিক জীবনের নানাবিধ সংকটকে ব্যক্তির বহুমাত্রিক চেতনার সংস্পর্শে দৃশ্যমান করতে চেয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তি তো শুধু গণ্ডিবদ্ধ পরিবারের সংকটের চূড়ান্তসীমায় ক্ষয়ে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। সচেতন শিক্ষিত নাগরিক জীবনযন্ত্রণার মূলে থাকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনা¯্রােত। লেখক সযতেœ সে সবের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক কাহিনীর অবয়ব নির্মাণ করেছেন। তবে তিনি শিথিল বিবরণ ও একঘেঁয়েমী কাহিনীসূত্র বর্জন করেছেন। বস্তুত মহীবুল আজিজের কথাসাহিত্যে রাজনৈতিক পটপরির্বন ও পাশ্চাত্য শিল্প আঙ্গিক জীবন বাস্তবতা রূপায়ণে অনিবার্য প্রভাব ফেলেছে। এজন্য বিশ্লেষণ, মননধর্মিতা, তীক্ষ্ণ, ঋজু, নির্মেদ ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে আখ্যান প্রতিমায়। তিনি এখনো গল্প-উপন্যাস লিখে চলেছেন। সাহিত্যচর্চায় তিনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন এভাবে- ‘আমি সর্বদাই পরিকল্পনার মধ্যেই থাকি।’ তাঁর সেই পরিকল্পনায় আছে নতুন গল্পগ্রন্থ, অপ্রকাশিত কবিতা এবং ৪০টির মতো গান প্রকাশের সম্ভাবনা। তিনি নিজের ভেতর দীর্ঘ সময় ধরে গল্পের প্লট লালন করেন। একটি গল্প ২৮ বছর ধরে লালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস দুটি ঠিক একইভাবে তিনি লিখেছেন; দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা লালন করে। কবি-কথাসাহিত্যিক মহীবুল আজিজের পরিকল্পনাগুলো নতুন গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সার্থকতা অর্জন করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
(মিল্টন বিশ্বাস, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা)
1 Comments
Mohibul Aziz
Prio Milton, amar lekha apnar monojogi drishtite bichar korbar jonne antorik dhonnobad o kritoggtaota.