উপন্যাসে ব্যক্তি তার অস্তিত্ব, হ্রাদ্যিক শক্তি, সৃজনমুখরতার পথটি দেখাতে সক্ষম হন। এ মাধ্যম এক হিসাবে ব্যক্তিনির্ণয়েরই মাধ্যম। এতে একটা সময়, অভিজ্ঞতা, সমাজ-রাষ্ট্রকে চেনা যায়। ব্যক্তি তার উন্মেষ, ভাংচুর, গড়ন-পেটন ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে চেনায়। এতে লেখক তার জীবন দেখান, রূপকার্থ নির্ণয়ে ব্রতী হন। উপন্যাসের ভিতর দিয়ে নানান প্রত্যয় সম্পর্কে একটি ধারণারও বিস্তার ঘটে। এই হিসাবেই ‘শেষের কবিতা’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ ইত্যাদি উপন্যাস যোগে কিছু কথাবার্তা জেনে নেয়া যেতে পারে। আমরা এক্ষেত্রে পরিবার, প্রতিষ্ঠান হিসাবে এর শক্তি, যৌনতার মুক্তি ইত্যাদি বিষয়ের সাথে খানিক বোঝাপড়া করে নেব। এতে খানিক অন্তর্দৃষ্টি, খানিক হতচকিত অবস্থা, খানিক মানবিক আচরণের ব্যাকুলতা দেখে নিতে পারব। তাতে আমরা হয়ত-বা অবাক হই, মুগ্ধতায় আমাদের শরীর-মন ভরে যায় – মন কেবল ভরে ভরে যায়, তারও পরে কী যেন রেখে যায়। আসলে একে রেখে যায় না-বলে খুদাই করে ফেলে বলাটাই প্রাণময় হয়।
আমার এ অবস্থা হয় দুইটি কাব্যময় উপন্যাস পড়ার সময় – অত্র সূত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ পাঠ করি। উপন্যাস দুটি বহুদিন পর আবারও পড়ায় মন লাগাই। পড়তে পড়তে আমার এমনই মনে হচ্ছে, যত দূরেই যাই, বই দুটি থেকে দূরে যাওয়া যাবে না। হদয়-মন-শরীর রীতিমতো ভালোবাসার জোয়ারে কেঁপে কেঁপে উঠবে। লেখার এত শক্তি! ফলত মিলনতত্ত্বের গন্ধে নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করি।
রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’কে সময়ের কাব্যগল্প বলা যায়, বলা যায়, জীবনের এক থরথর প্রয়াস, কিংবা বলা যায় প্রেমনির্ণয়ের ভিতর দিয়ে ভাষার একটা অবস্থান দেখে নেয়া। কিংবা তিনি হয়ত তার চেতনালোক আর সাহিত্যিক অবস্থানটি কাব্যময় উপন্যাসে আবারও পরখ করে নিতে চেয়েছেন। তার ধর্মবিশ্বাসকে যে এখানে নির্মাণ করা হয় নি তা বলা যাচ্ছে না। বরং যোগমায়া, লাবণ্য আর শোভনলালের জ্ঞানতপস্যার ভিতর দিয়ে লেখক একটা ধর্মবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তিনি এখানে প্রচুর ডায়লগ ব্যবহার করেছেন। তার ন্যারেশনের ভিতরও চিত্রনাট্যের এক আবহ আছে। এর আঙ্গিকই একালের দৃশ্যকাব্যরূপে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। এতে দ্বন্দ্ব তত স্পষ্ট না হলেও লাবণ্য আর অমিতের অন্তর্চৈতন্য নানাবিধ দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত। লাবণ্য একধরনের চৈতন্য নির্মাণ করতে সক্ষম হন, আর তাতে নির্জনে সাই দিয়ে যান যোগমায়া। এখানে এই মাসিমা যেন মাসিত্বের বাঙালি প্রতিনিধি হয়ে লাবণ্য-এর মনস্কামনার দিকনির্দেশনা দেন। অত মায়ামায়, অত সহ্যশীলা, রোদনকাতর, অত ধৈর্যশীলা পিসি বাংলাসাহিত্যে বিরল। তিনি সৃষ্টিই হয়েছেন লাবণ্যের মনোপীড়নকে পাঠকের মনে গেঁথে দেয়ার জন্য। চরিত্রটি রবিঠাকুরের অভিনব সৃষ্টি।
এর ভাষাও যুগসন্ধিক্ষণের একটা প্রত্যয়কে ধারণ করে। তিনি সবে উপন্যাসে সাধুভাষার প্রাবল্যকে কিছুটা দূরে রেখে চলিত ভাষার দিকে মুখ ফেরালেন। কিন্তু তাই বলে সাধুভাষার ভাবগাম্ভীর্যকে একেবারে তালাক দিলেন না কিন্তু। আবার চলতি ভাষার ভিতর যে মুখনিঃসৃত ভাষার ব্যাকুলতা আছে তাও ছাড়লেন না। বলা যায়, ঘরে বাইরে আর শেষের কবিতায় গদ্যভাষার একটা সাংস্কৃতিক রাজনীতি তিনি বহাল রাখতে পেরেছেন। তিনি রবিঠাকুরের বিপরীতে এখানে যেমন ছায়া-রবিঠাকুর সৃষ্টি করেছেন, তেমনি চলতি ভাষার স্রোতময়তাকেও নির্মাণ করে যেতে পেরেছেন। এই যে সমকালীন আবহের সাথে তার চলাচল তাতে মনে হয়, জ্ঞানত্বের একধরনের ওহি নাজেলের ব্যাপার তার অন্তর্জগতে যেন ছিল। এখানেই তার নান্দনিক জয়ও নির্ণয় হতে থাকে। লাবণ্য আর অমিতের জন্য সাধু আর চলিত ভাষার পরও আড়ালের এক ভাষার কামনা তিনি করেছেন। এখানেই রবিঠাকুরের ঐন্দ্রজালিক বাহাদুরী। আলাদা এক ভাষিক জগতের ইঙ্গিত পায় এখানে। তা তার নিজের তৈরি নীরব এক ভাষা? লৌকিকতার প্রতি মোহ? নাকি আগামীজনদের জন্য অবারিত দুয়ার খুলে রাখার সার্বভৌম এক ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন তিনি!
‘শেষের কবিতা’র ভাষামাধুর্য হৃদয়ে গেঁথে থাকার মতো। একটা শব্দ আরেকটাকে ছুঁয়ে থাকার ব্যাকুলতা এখানে আছে। তা কিন্তু প্রথম থেকে একেবারে শেষাব্দি বিরাজমান। গদ্যের ভিতরও যে ছন্দময়তার ব্যাকুল-বিন্যাস থাকে বা থাকতে পারে তাই রবিঠাকুর তার স্বভাবজাত ক্ষমতাসহযোগে দেখিয়ে দিলেন। কিছু শব্দ খুবই চমৎকারভাবে উঠে এসেছে – কবুল, জাহান্নাম, খটকা লাগে, চিকন শ্যাম, মান্যতা বেশ নতুন স্বাদ নিয়ে আমাদের পাঠের স্বাদুতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
এখানে ব্রাহ্মত্যের জয়গান আছে। নতুন/পুরানের দ্বন্দ্ব যেমন আছে, আছে প্রতীমা পূজার সাথে বিমূর্ত পূজনের দ্বন্দ্ব, আছে মধ্যবিত্তের গড়ন-পেটনের ইঙ্গিত। একপর্যায়ে বিমূর্ত পূজনের জয়গান অতি কৌশলে প্রয়োগ করেন তিনি। লাবণ্য কর্তৃক স্টাইলের জয়লীলা আমরা দেখি। মানবিক চৈতন্যের এক বিকাশমান অবস্থা দেখি। আমরা দেখি রবিঠাকুরের বিরুদ্ধে যেন আরেক যৌবনমুখর রবীন্দ্রনাথ নিবারণ চক্রবর্তী নামযোগে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করছেন। আসলে এতে কিন্তু চিরযৌবনের একজন মানুষ তার অবস্থান দৃঢ় করতে থাকেন। এখানে ব্রাহ্ম ধর্মের বিকাশ বা প্রচার আরো একটা অবস্থান নিতে দেখা যায়। ধর্মীয় অবস্থান তখন সনাতন ধর্ম একেশ্বরবাদের ক্রমাগত আক্রান্ত হতে থাকে। ইসলাম ধর্মের কথিত সাম্যরূপ আর খ্রিষ্টত্বের আধুনিকতা এই ধর্মকে ওই সময় একেবারে মিশিয়ে ফেলার একটা অবস্থানে ফেলে দেয়। সপ্তদশ শতকে চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবান্দোলনের প্রভাবে এ ধর্ম কিছুটা কিছুটা রক্ষা পায়। আবার পরবতী সময়ে রামকৃষ্ণ এবং ব্রাহ্মধর্মের আলাদা আলাদা কৌশলে সনাতন ধর্ম দৃশ্যত জাতপাতের উর্ধ্বে ওঠে বেঁচে থাকার শক্তি পায়। লাবণ্য আর যোগমায়ার বিমূর্ত-সৌন্দর্যের প্রেরণা তার কার্যক্রমকে একটা নান্দনিক পন্থা দেখানোর উপায় হিসাবেই আমরা পাই। আর মধ্যবিত্তের বিকাশ একটা স্তর তো এখানে স্পষ্ট হচ্ছেই।
যোগমায়ার চরিত্রে যে বৈরাগ্য দেখি তা যেমন বৈষ্ণবীয় নয়, তেমনি নয় ঐতিহ্যগত বাঙালি-মাসির মানবিক চরিত্র। এই মাসি অ-সুরের বিপরীতে সুর তৈরি করে, চিত্তচাঞ্চল্যের স্থলে ধীর-স্থির এক চৈতন্য বহন করে, যা আসলে ১৯ শতকের ঠাকুর বাড়ির ব্রাহ্মআশ্রিত এক মমতাকেই ধারণ করে। লাবণ্যকে তিনি নির্মাণ করেন। অমিতের অবিবেচনা, প্রেমকে একধরনের পদদলিতকরণের নমিত ইচ্ছা, বেইনসাফিকরণের জায়গাটিতে একধরনের চলমান স্নিগ্ধতা ওর মারফতে প্রকাশ হতে দেখি আমরা। এই মাসি এমন এক ঐন্দ্রজালিক মমতার ছায়া বিস্তার করতে থাকেন, মনে হয়, ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিভ্রান্ত পথিককে ভালোবাসার অমিয় পরশ বুলিয়ে দেন। যেন শিক্ষিত বাঙালির প্রকৃত মমতার প্রতীক হচ্ছেন তিনি। বড়ো লোভনীয়, আরামদায়ক, স্নিগ্ধ এক চরিত্র এই যোগমায়া। তাকে বাঙালি পাঠক স্মৃতিতে না-রেখে থাকতে পারেন না!
পঞ্চপাণ্ডব বা নতুন কবিসকলের সরব উপস্থিতি কি রবি ঠাকুরকে কিছুটা হলেও বিচলিত করে নি? এখানে কি সেই বিচলিত অবস্থা কিছুটা হলেও প্রকাশ পায় না? ‘শেষের কবিতা’য় সময়কে জয় করার প্রবণতা প্রবল। রবিঠাকুর তার শৈল্পিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবেলা করার একটা টেন্ডেন্সি জারি রেখেছেন।
ডায়লগপ্রবণ এ উপন্যাসের কিছু কিছু ডায়লগ বড়োই চমৎকার – ১. অমিত বলে, ‘কেতকির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসারই। কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের ভালোবাসা, সে রইল দীঘি; সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।’ ২. অমিত বলে, ‘ফ্যাশন হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী।’
কখনও কখনও কোনো কোনো পাঠকের মনে হতে পারে যে অমিত একেবারে বীর্যহীন, বেহুদা চরিত্র, কথা কওয়া ছাড়া কার আর কোনো কাজ নেই। তবে তা কিন্তু নয়, শৈল্পিক বিমূর্ততাই রবিঠাকুর একে রক্তমাংশেরও করতে পেরেছেন! তবে তাতে মানসিক প্রশান্তি যে একেবারে পাওয়া যায়, তা কিন্তু নয়। এই যেমন, পাহাড়ের আড়ালে, সন্ধ্যার সময়ে লাবণ্য-অমিত যখন নির্জনতার ভিতর সময় পার করবে, তখন তারা শুধু পরস্পরকে হাত ধরেই থাকবে? জীবন এখানে শুধুই হাতময় হয়ে থাকবে!!! অথবা যোগমায়া দুইজনের হাতকে মালার বন্ধনে বেঁধে যখন বহুসময়ের জন্য অন্যত্র চলে গেলেন, এমনই নির্জনতা তারা শুধু নির্জনতার ভিতরই থাকে! এরা নির্জনতাকেও নির্মাণ করতে জানল না তারা! এখানে রবিঠাকুরের শুদ্ধতা বা অহমিকা হয়ত কাজ করেছে। কারণ গল্প তো লাবণ্যের হাহাকার নিয়ে জ্ঞানের জগতে প্রবেশের একটা রাস্তা তৈরি হবেই। সেখানে লাবণ্যের জীবনকে জীবনের যথার্থ আয়োজনের পরিবর্তে তিনি ব্রাহ্মত্যের অহমিকা হয়ত বিরাজমান করেছেন! কারণ আমরা শোভনলাল চরিতামৃত পান করতে গিয়ে দেখেছি, জ্ঞান তার যৌনতাকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে – যেন আলাদা এক বৈরাগ্যসাধনায় রবীন্দ্রনাথের এ এক মীমাংসা! তবে একধরনের কুটনৈতিক তৎপরতা আমরা দেখি, যেন ‘কন্সট্রাক্টিভ এনগেজমেন্ট’ তিনি নির্মাণ করে গেছেন। এটি তার প্রথম লাইন থেকে শেষ পর্যায় পর্যন্ত একধরনের অন্তর্জাল এখানে আছে।
মানিকের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ নিয়ে কথা বলতে বরাবরই আমার ভালো লাগে। আমার প্রথম বিস্ময় যে কী তা বলা মুশকিল, কারণ এখানে মাল্টিকালার বিস্ময় যোগ হয়েছে। একজন লেখকের একুশ বছর বয়সে এমন এক কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা কি মুখের কথা!!! তার বর্ণনার কী যে নিখুঁত ব্যাপার, জীবনকে মনে রেখে রেখে অতি সূক্ষ্ণ বিষয় আরোপ করা দারণ বিস্ময়ের ব্যাপার। সাংসারিক, সামাজিক, জৈবিক, যৌনতাঘেঁষা এত কথা বললেন তিনি, কিন্তু কোথাও রিপিটেশনের গন্ধও নেই। আমার কেবলই মনে হয়, এই বয়সে এত প্রস্তুতি, এত দেখার ভিতর তিনি কি করে থাকলেন।
এটি তিনভাগে বিভক্ত – প্রথম ভাগ: দিনের কবিতা, দ্বিতীয় ভাগ: রাতের কবিতা এবং তৃতীয় ভাগ: দিবা-রাত্রির কাব্য। প্রথম ভাগে আছে হেরম্ব আর সুপ্রিয়ার কথিত অবাধ প্রেমের ইশারা, দ্বিতীয় ভাগে আছে মনোজটিলতার আরেক নির্যাস – হেরম্বের বত্রিশ বছর বয়সপ্রাপ্তির পর মালতীর সাথে দেখা হয়, তখন মালতীর ঘরে আছে আনন্দ – সে তো ভালোবাসার এক অবাধ জমিন বিছিয়ে রেখেছে। তৃতীয় ভাগে হেরম্বের সাথে সুপ্রিয়া, মালতী, সর্বোপরি আনন্দ’র অদ্ভুত প্রেম। এখানে মানসিক দ্বন্দ্বের এক চমৎকার আবহ তৈরি হয়। আমরা বিস্ময়-মুগ্ধতায় মানিকের অসাধারণ শব্দচিত্রের মুখোমুখি হয়। জীবনের মনোজাগতিক জৈবিক ক্রিয়া এখানে বহমান হয়। এ এক আবিষ্কার, নারী-পুরুষের যৌনতাঘেঁষা জীবন কোলাহলের এক দৃশ্যকাব্য প্রত্যক্ষ করি। জীবন-রূপকের এমন কার্যকর চৈতন্য বাংলা উপন্যাসভুবনে খুব একটা দেখা যায় না। এক এ উপন্যাস নিয়ে কিছু গঁৎবাধা কথা বলা হয়। তাও শিখানো কথা – তা হচ্ছে, তিনি এসময় ফ্রয়েড দ্বারা ভারাক্রান্ত— ছিলেন, এখানে অবৈধ প্রেম আছে, এখানকার সব চরিত্র বিকারগ্রস্ত। এর সব কটিই শেখানো কথা, বা টেক্সটি পাঠের অভাবজনিত প্রতিক্রিয়া বা এসবের কিছুতেই না গিয়ে, না বুঝে একটা কিছু বলে দেয়ার প্রবণতা ছাড়া কিছুই নয়। আসলে আমি যেটা বুঝি, তিনি ব্যক্তিসত্তার আনন্দ-মুগ্ধতা-বিপন্নতা-রোদনমুখরাকে একেবারে চাক্ষুষ করিয়েছেন। প্রেমকে চেনার আগেই বৈধতার সার্টিফিকেট দেয়ার নাবালকত্ব থেকে আমাদের মুক্তি নাই। আমরা যে অবৈধতার সার্টিফিকেট বিলি করছি, তা আমাদেরকে প্রদান করছে আমাদের স্যোশাল ভ্যালুজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সর্বোপরি পলিটিকেল হেজিমনি। এখানে পলিটিকেল হেজিমনিকেই বেশি জোর দেব, কারণ মানিককে একেবারে সামনের কাতারে রাখার কাজটি করছে প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ, আবার তার কিছু কিছু লেখার ব্যাপারে বৈধতার সার্টিফিকেটও তারা দিচ্ছে। এখানেই গণতান্ত্রিক শুদ্ধতার প্রশ্নটিও আছে। কারণ আমরা শিখেছি যে, ফ্রয়েড যৌনতাকে বড়ো করে দেখছেন, শ্রেণীদ্বন্দ্বের বিষয়টি তার মৌলিকত্বে তেমন নেই, কাজেই ফ্রয়েড শ্রেণীশত্র“ এবং পরিত্যাজ্য। আমরা অতঃপর ধর্মগ্রন্থের মাহাত্ম্য স্মরণ করি? এ এমন এক গ্রন্থ যেখানে সর্বসমস্যার সমাধান আছে! যা নাই ধর্মগ্রন্থে, তাহা নাই ত্রিভুবনে। আমরা, কথিত গ্রগতিবাদীরা, এই ধরনের উত্তেজনার বশবর্তী থাকতে পছন্দ করি। এ আলোচনা ভিন্ন ফোরামে ব্যাপক আকারে করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও একেবারেই স্বল্পমাত্রায় বলে রাখতে হয়, সর্বহারার গণতন্ত্রের স্থলে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র এই প্রাবল্যবাদের জন্ম দিয়েছে কিনা ভাবতে হবে।
আমরা যে মরালিটির কথা বলি, অর্থাৎ ‘দিবারাত্রির কাব্য’-এর উপর চাপাতে চাই, তা কতটুকু যৌক্তিক? পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমই বৈধ/অবৈধ এই দুইভাগে বিভক্ত। কারণ পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম যার-তার মতো করেই তার বান্দাদের পক্ষে রাখতে চায়। আমার কাছে মনে হয়, দিবারাত্রির কাব্য-এর প্রায় সবকিছুই ব্যক্তিসত্তার রূপ অন্বেষণের কাজটিই করছে। হেরম্ব, সুপ্রিয়া, মালতী, আনন্দ. এমনকি অনাথ বা অশোকও মুক্তচৈতন্যকে লালন করতে চায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এখানে প্রথাগত কোনো ভিলেন নেই, সবাই যার-তার মতে মুক্ত হতে চায়। আনন্দ এই উপন্যাসের অদ্ভুত চরিত্র, এত সৃজনউন্মুখ চরিত্র বাংলা উপন্যাসে খুব একটা চোখে পড়ে না। এত সংস্কারের ভিতর থেকেও সে প্রকৃতিমুখর হয়ে থাকে। তার শরীর, নৃত্যকলার ব্যবহার, নিজেকে সাজানোর ক্রিয়াশীলতা, প্রেমের যত্নশীল মুগ্ধপ্রকাশ সত্যিই দুর্লভ এক প্রাপ্তি যেন। পরবর্তী সময়ে ইউসুফ যা বললেন, হেরম্ভের উদাসীনতা বা সমাজবিচ্ছিন্নতাকে তার কাছে কামুর এন্টিট্র্যাডিশনাল এলিয়েনেশনকেই মনে করায়। কামুর আউটসাইডারের মূলচরিত্র যেমন তার মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারে দারুণ উদাসীন থাকে, তেমনি হেরম্বও স্ত্রী, মেয়ে বা মায়ের মৃত্যু বিষয়ে দারুন নির্লিপ্ততা বজায় রাখে।
‘দিবারাত্রির কাব্য’কে কখনও বিকৃত প্রেমকাহিনী বলা যাবে না। মানুষ মূলত এই রকমই- যৌনতা নিয়ে তাদের লুকোচুরি, ফাজলামোর শেষ নাই। এ গল্পের চৈতন্যপ্রবাহ যেমর চমৎকার, তারচেয়ে বড়ো কথা, নারীর অন্তর্জ্বালা, হাহাকার, একাকিত্ব, না-পাওয়ার বেদনা অতি আবশ্যকীয়ভাবে উঠে এসেছে। মানিক এত কম বয়সে এত পরিপক্ব লেখা লিখতে পারলেন! এটিই এক দারুণ বিষয় হতে পারে।
জীবনকে দেখার, বুঝার, বুঝানোর এক পরিপক্ব রূপ এখানে আমরা প্রত্যক্ষ করতে থাকি। যৌনতার এক মুক্তপ্রাবল্যে আমরা øাত হই। গল্প বুনে যাওয়ার কী চমৎকার এক প্রয়াস আমরা পাই। অন্তর্চৈতন্যের বিস্তার আমরা দেখি, দেখে দেখে তৃপ্তিতে তৃপ্তিতে ভরপুর হতে থাকি। হেরম্ব এক চরিত্র, এক চরিত্রের বহু চরিত্র, আবার বহুচরিত্রের এক চরিত্র। এই চরিত্রে লাম্পট্য বলতে কী আছে ্আমি অন্তত বুঝতে পারছি না। জীবনকে সুতীব্রভাবে দেখার প্রয়াস নানান চরিত্রের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। জ্যান্ত আকারে আমরা বুঝতে পারছি। শুধু আনন্দ, সুপ্রিয়া, মালতি নয়, একেবারে ছোটখাটো অবস্থানের গোসাইবাবুও জীবনের তৃষ্ণার এক আচরণ রেখে যেতে পারে। চরিত্রের নানান মাত্রার প্রবহমানতা এতে আলাদা এক-এক রূপে ভাস্বর হয়ে আছে। জীবনকে দেখার, বোঝার, বুঝানোর এক পরিপক্ব রূপ আমরা ক্রমাগত প্রত্যক্ষ করি।
উপন্যাস দুটি সৃজনে কালের পার্থক্য তো আছেই, এর চরিত্রসমূহের সামাজিক অবস্থান, বিকাশ, ভালোবসা-জৈবিক-যৌনতার মেজাজও আলাদা। শেষের কবিতা ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের দিকের লেখা, আর দিবারাত্রির কাব্য লেখা হয়েছে ১৯৩০ সালে। রবিঠাকুর উচ্চবিত্তকেই তার চরিত্র করেছেন, এরা ফলত শ্রেণীগত বা সামাজিক রাষ্ট্রিক অবস্থান নিয়ে খুব একটা ভাবিত নন। রাষ্ট্র যেন তাদের সহোদর হয়েই আছে। তারা রাষ্ট্রের অঙ্গ নন, যেন সমাজ-রাষ্ট্রের বিকাশটা তারাই ঠিক করে দিবেন। মানিকের চরিত্রসমূহ সরাসরি নৈতিক বিষয়-আশয়ে থাকেন না, তবে তাদের ভিতর মধ্যবিত্তীয় টানাপড়েন আছে। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রকে তাদের বাঁচার তাগিদেই কাজে লাগান। ভালোমতো খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার ফন্দিফিকির করে। রবিঠাকুরের চরিত্রসমূহ ইংরেজ শাসনের আনুকুল্য পায় বলে ধারণা রাখা যেতে পারে। এর সহায়ক কথন হচ্ছে, এরা তাদের সামাজিক জৈবিক আচরণসমূহ একেবারে নির্বিঘ্নে করে যায়। কিন্তু মানিকের চরিত্রসমূহ রাষ্ট্র, শাসন, প্রতিষ্ঠান, পুলিশি আচরণের সাথে নিজেদের আচরণের বোঝাপড়াটা করে রাখে। ভাষার আচরণে রবিঠাকুর অধিক পরিকল্পনার অধিকারী। এটি তার উপন্যাসজীবনের শেষপাদের লেখা। আবার মানিকের সৃজনকর্মটি প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। মানিকের এ লেখা ফ্রয়েড আর শৈল্পিক রিয়েলিটির এক মিলিত প্রয়াস। রবিঠাকুর তার সামাজিক, কাব্যিক আর বিশ্বাসের জায়গাটা এখানে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। ভাষার কাব্যমাধুর্য রবিঠাকুরে অধিক পরিলক্ষিত হয়, আর মানিকের ডিটেইলের কাজে আছে তীব্র-তীক্ষ্ণ সচেতনতা।
এখানে যৌনতার খানিক মৌলতা নির্ণিত হয়েছে। এভাবে দেখাটা বিশেষত মানিকের দেখার ধরনটা আমরা খুব একটা পাই না। কতক কথন, কতক ইশারা, কতক শরীরী আয়োজন আমরা ক্রমাগত পাঠ করি, শুদ্ধতায় জারিত হই, এই শুদ্ধতাই আমাদের সামগ্রিক মেজাজে স্বাধীন যৌনতার পিপাসা জাগে। সমাজের চলমান হিসাবকে নতুন করে দেখতে থাকি। এ এক নান্দনিক বিগ্রহ যাতে আমরা জীবনের আয়োজনকে বাড়াতে পারি। আমরা আমাদের চৈতন্যে আধুনিক মিলনতত্ত্বের ভাববিগ্রহ নির্মাণ করতে প্রবৃত্ত হতে পারি। এক-একটা চরিত্র, বিশেষ করে মানিকের আনন্দ এমনই দীর্ঘ প্রতিধ্বনিময় চরিত্র যে মনে হতে থাকে, এর চরিত্রবিন্যাস রোজ কেয়ামত পর্যন্ত আবিষ্কার করতে থাকলেও তার তলানি মিলবে না। এতে অনেক ধরনের মনোবিকলন নয়, মনোজাগরণে স্নাত হতে পারি হয়ত। আনন্দ আনন্দ আনে, যেখানে বন্ধনের ফাঁকফোকর থেকে মুক্ততার সৌগন্ধ পাই।
উপন্যাস দুটিতে ভিন্ন ঘরানার নির্মাণশৈলী বা ভাষার অপূর্ব কারুকাজই শুধু আমরা প্রত্যক্ষ করি না, এতে প্রচলিত মানবিক সম্পর্কও তছনছ হয়ে যেতে থাকে। ট্যাবু হতচকিত হয়, পরিবারের নামে পেষণমূলক মূল্যবোধে, এর প্রাতিষ্ঠানিক ধরনে দারুণ আঘাত আসে। পরিবার মূলত পুঁজিবাদের এক নিরাপদ আশ্রয়। এতেই পুঁজির ডানা নিরাপদে পতপত করে প্রবহমান হয় – নানান সংস্কার, রাষ্ট্রের ঐতিহ্য, নিয়মাবলী আরামে বিরাজ করার ক্ষেত্র পায়। রীতি-নীতি, পুঁজির বিকাশ এর মৌলতাকে আশ্রয় করে বাড়-বাড়ন্ত থাকে। সভ্যতা বিকাশের নামে কালা-কানুন তার দীর্ঘ ছোবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। নারী স্বাধীনতা খর্ব হয়। পারিবারিক ডেমোক্রেসি বাধাগ্রস্ত করণের নানান ফাঁদ পাতা হয়। কাব্যগন্ধী এ উপন্যাসদ্বয়ে মুক্তির নানান ইশারা আছে, তাই মানবিক গণতন্ত্রের সহায়ক নান্দনিক আবহে তা সীমিত মাত্রায় ক্রিয়াশীল হতেও পারে।