এই যুগেও যদি কোনো জাপানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীর্ঘতম উপন্যাস ‘গোরা’ মূল বাংলা থেকে অনুবাদ করতে আগ্রহী হন তাঁকেও বেশ ভাবতে হবে নানা কারণে। একে তো রবীন্দ্রনাথ বলে কথা, বিশ্বমাপের কবি, লেখক, দার্শনিক তাঁর রচনার যথার্থ অনুবাদ না হলে নয়। কোন্ লক্ষ্য, বিশ্বাস এবং অনুপ্রেরণা থেকে তিনি এই বড়মাপের উপন্যাস লিখেছেন সেটাও বুঝতে হবে। কোন্ সময় এবং পরিস্থিতিতে তিনি এই উপন্যাসের পটভূমি রচনা করেছেন তারও একটি গ্রহণযোগ্য ভূমিকা সংশ্লিষ্ট না করলে নয়। সর্বোপরি থাকতে হবে বাংলা ভাষার ওপর গভীর জ্ঞান ও দখলত্ব।
কথাগুলো এই জন্যই বলা যে, বাংলা এবং জাপানি দুটো ভাষাই প্রাচীন ভারতের সিদ্ধাম, প্রাকৃত, তামিল এবং সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে গভীরভাবে আত্মজ হওয়া সত্ত্বেও দুটো ভাষাই বিশেষরূপে ভিন্ন ভাষা। দুটোই সাধারণ ভাষা নয় আদতেই। তাই দু’ভাষাতেই কোনো রচনা অনুবাদ করা হাড় ভেঙে যাওয়ার মতো কঠিন এবং পরিশ্রমসাধ্য।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে একজন জাপানি ক্রীড়াবিদ ‘গোরা’ উপন্যাসটি পাঠ করতে আগ্রহী হয়েছিলেন বা ‘গোরা’ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল এই ঘটনা আমাদের তো বটেই, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও আনন্দে আপ্লুত করেছিল নিঃসন্দেহে। এই ঘটনা রবীন্দ্রনাথকে একবার কি অন্ততপক্ষে ভাবায়নি যে, একজন বিদেশি কবি বা সাহিত্যিক অথবা পণ্ডিত না হয়ে একজন জুদো ক্রীড়া প্রশিক্ষক কেন ‘গোরা’র মতো দীর্ঘ ও জটিল উপন্যাস পাঠে আগ্রহী হয়েছেন! ভাবিয়ে থাকারই কথা। শুধু পাঠ করেই ক্ষান্ত হননি সেই ক্রীড়াবিদ সেটা জাপানি ভাষায় তাঁর সমাজে পরিচিত করানোর জন্য অনুবাদ করার দুঃসাহসিক ভূমিকাও নিয়েছিলেন! যা অবাককরা ঘটনা বলেই প্রতিভাত হয়।
ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকে কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারকল্পে যে ক্ষণায়ু নবজাগরণের উত্থান ঘটে যাকে বলা হয়ে থাকে ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’, বিশেষ করে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরে সংস্কারের বৈপ্লবিক হাওয়া বইতে শুরু করে তারই ফলশ্রুতি ব্রাহ্মসমাজের উত্থান এবং এর প্রগতিশীল আন্দোলন, পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের সংঘাত, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, স্বদেশী আন্দোলন, নারীজাগরণ প্রভৃতি চেতনাসমৃদ্ধ উপন্যাস ‘গোরা’ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। ১৯০৯ সালে এটা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বলাবাহুল্য, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রভাবও রবীন্দ্রনাথের দুটি উপন্যাস ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘গোরা’তে গভীরভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। আর ঠিক এই ১৯০৫ সালেই ভারতের মাটি তথা অবিভক্ত বাংলার কলকাতায় পা রাখেন জাপানি জুদো (জুজুৎসু) খেলার প্রথম প্রশিক্ষক এবং পরবর্তীকালে সম্ভবত ‘গোরা’ উপন্যাসের প্রথম জাপানি পাঠক জিননোসুকে সানো।
১৯০২ সালে জাপানের পন্ডিত ও শিল্পাচার্য ওকাকুরা (কাকুজো) তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩) কলকাতায় যান এবং ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। প্রায় দশ মাস ভারতে অবস্থানকালে ওকাকুরা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ওকাকুরার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ জাপানের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে পড়েন। তাঁর বুকের ভেতরে তখন রুশ-জাপান মহাযুদ্ধে (১৯০৪-৫) এশিয়ার মাঝারি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জাপান কর্তৃক শ্বেতাঙ্গ রুশদের বিরুদ্ধে সদ্য মহাবিজয়ের প্রতিধ্বনি প্রকম্পমান। রবীন্দ্রনাথ চিন্তা করলেন যে, বাংলার ছেলেমেয়েদেরকে দৈহিক কসরৎ জানতে হবে জাপানিদের মতো তাঁদের কাছ থেকে। তার জন্যই জুদো তথা জুজুৎসুকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাই বন্ধু ওকাকুরাকে অনুরোধ করেছিলেন শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে একজন জুদো প্রশিক্ষককে পাঠানোর জন্য। ওকাকুরা তখন জাপানের প্রসিদ্ধ বেসরকারি উচ্চ বিদ্যাপীঠ কেইও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও জুদো ক্রীড়াবিদ জিননোসুকে সানোকে কলকাতায় পাঠান ১৯০৫ সালে।
সানো ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে জুদো শেখানোর পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জাপানি ভাষাও শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন শান্তিনিকেতন তথা অবিভক্ত বাংলার প্রথম জাপানি ভাষার শিক্ষক। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথের রচনা ও কর্মতৎপরতার দিকে আকৃষ্ট হয়ে বাংলা ভাষাও রপ্ত করে ফেলেন। গভীর আগ্রহ নিয়ে পাঠ করতে থাকেন রবীন্দ্ররচনাসহ ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, শিল্পকলা প্রভৃতি। এসব পাঠের প্রতিফলনই তাঁর একাধিক গ্রন্থে পাওয়া যায় যেগুলো তিনি পরবর্তীকালে জাপানে ফিরে গিয়ে লিখেছেন।
খেলোয়াড় হয়েও তিনি একজন মননশীল লেখক ছিলেন তাঁর সময়কালে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিশ্বমাপের উপন্যাস ‘গোরা’ বাংলা ভাষা থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে কালজয়ী হয়ে আছেন। ভারত থেকে ফিরে আসার ১৭ বছর পর ১৯২৪ সালেই অনুবাদের কাজে হাত দেন। এই বছর রবীন্দ্রনাথ তৃতীয় বারের মতো জাপান ভ্রমণ করেন জুন মাসে এবং অনুবাদের খসড়া দেখেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। পরের বছর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বিষয়টির বাস্তবতা এই যে, ১৭ বছর পর যেখানে বাংলা ভাষা ভুলে যাওয়ার কথা একজন বিদেশির অথচ দেখা যাচ্ছে সানো অনুবাদের কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন বিদেশি ভাষা থেকে আপন মাতৃভাষায়। অত্যন্ত ধৈর্য ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ সম্পাদন করেছেন নিঃসন্দেহে। সে সময় জাপানি কোনো সাহিত্য গ্রন্থ কী বাংলা ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল ভারতে? মনে হয় না।
জাতিগতভাবে কৌতূহলপ্রবণ জাপানি জিননোসুকে সানো কী গভীরভাবে বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদী জাগরণ এবং বাঙালির দেশপ্রেমের চিন্তা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আবিষ্কার করেছিলেন তারই প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে এই দীর্ঘ উপন্যাসটির অনুবাদে। কলকাতা তথা তখনকার বাঙালি সমাজকে নিবিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তারও প্রমাণ পাওয়া যায় গ্রন্থের মুখবন্ধ এবং সমাপ্তি বক্তব্যে। ‘গোরা’র পটভূমি এবং ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসও বর্ণনা করেছেন এই দুটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে যথাক্রমে ১১ এবং ২২ পৃষ্ঠাব্যাপী। সর্বমোট গোরার অনূদিত পৃষ্ঠার সংখ্যা ৭১৮! বিশালাকার গ্রন্থটি প্রমাণ করে যে, তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল ছিল এর প্রকাশনা।
এই গ্রন্থের ব্যতিক্রম বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অবয়ব। গ্রন্থটি হার্ড কভারে বাঁধানো, সিল্ক কাপড়ে ছাপা মলাটে মোড়ানো এবং ফুলের মাঝখানে সোনালি রঙের বিন্দু অর্থাৎ পরাগ মুদ্রিত। ভাবতে অবাক লাগে ৯০ বছর আগে কী চমৎকার বই বাঁধা হত জাপানে! টাইটেল পৃষ্ঠায় নীল রঙে গোরা, লেখক, অনুবাদক এবং প্রকাশনা সংস্থার নাম লেখা আছে। পরের পৃষ্ঠায় একই রঙে মূল উপন্যাসের সূচনার তিনটি প্যারা বাংলায় হুবহু মুদ্রণ করা হয়েছে, নিচে বন্ধনীতে লিখিত আছে বাংলা মূল লেখার একটি পৃষ্ঠা। এর পরের পৃষ্ঠাটির ওপরে ফিনফিনে পাতলা ট্রেসিং পেপারে অঙ্কনচিত্রের পরিচিতি মুদ্রিত, পাতাটি উল্টালে শক্ত কাগজে রবীন্দ্রনাথের একটি আলোকচিত্র মুদ্রিত সেটা টেকিওর কোনো এক উদ্যানে গৃহীত ১৯২৪ সালের ৮ জুন তারিখে। পরের পৃষ্ঠায় গোরার নায়ক গোরা এবং আনন্দময়ীর একটি চিত্রকর্ম এঁকেছেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। পরবর্তী পৃষ্ঠায় উপন্যাসের চরিত্র নায়িকা সুচরিতার চিত্র এঁকেছেন শিল্পী চারুচন্দ্র রায়। এর পরের পৃষ্ঠায় অন্যতম চরিত্র ললিত ও সুচরিতার চিত্র এঁকেছেন প্রখ্যাত জাপানি চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধু কাৎসুতা শৌকিন। ধারাবাহিকতার শেষ পৃষ্ঠায় লালনের ‘অচিন পাখি’ গানের প্রথম সঞ্চারীটির অনুলিপি স্বহস্তে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (যদিও ‘কেমনে’ শব্দটির ‘একার’টি মুদ্রিত হয়নি।)
২০১১ সালের আগস্ট মাসের একদিন দুপুরে টোকিওর পুরনো গ্রন্থ শহর জিনবোওচোওতে ইন্ডিয়া সেন্টার অফিসে গিয়েছিলাম। ভবনের নিচে আছে একটি পুরনো বইয়ের দোকান। দুএকটি বই ঘাঁটতে গিয়ে চোখ আটকে গেল ছেঁড়াফাড়া শক্ত মোড়কের ভেতরে উঁকি দেয়া জাপানি কাতাকানা অক্ষরের ‘গোরা’ শব্দটি! মুহূর্ত দেরি না করে হাতে তুলে নিয়ে খুলে দেখি মূল্য ১,৫০০ ইয়েন। মনকে চিন্তা করার সুযোগ দেইনি। কিনে ফেললাম, বুকের ভেতরে টকবগ করে লাফাচ্ছে আনন্দধারা কেননা বইটি জাপানিতে অনুবাদ করেছিলেন জিননোসুকে সানো জানতাম কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি এমনকি অনেক গ্রন্থাগারেও। এমনকি জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমার কাছেও খুঁজেছিলাম।
শুধু জিননোসুকে সানোই নয়, গোরা নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন পরবর্তীকালে আরও চার জন। এঁরা হলেন কবি, লেখক, ঔপন্যাসিক ও সমালোচক নোমা হিরোশি, অধ্যাপক কাজুও আজুমা, অধ্যাপক উসুদা মাসাইউকি এবং অধ্যাপক তোমিও মিজোকামি। সাহিত্যিক নোমা হিরোশি এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং জাপানের জাতীয় উচ্চবিদ্যাপীঠ ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস কাজুও আজুমা যৌথভাবে ‘গোরা’র অনুবাদ করেছেন বাংলা থেকে জাপানিতে ১৯৮২ সালে। অধ্যাপক উসুদা ‘গোরা সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক আলোচনা করেছেন। ওসাকা ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাক-ভারত ভাষা বিভাগের অধ্যাপক তোমিও মিজোকামি ‘‘গোরা’য় ভারতীয় নবজাগরণ’ বিষয়ে আলোচনা করেছেন একটি প্রবন্ধে।
কিন্তু কেন ‘গোরা’ উপন্যাসটি জিননোসুকে সানোকে আকৃষ্ট করেছিল সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জাপানি ও ভারতীয় সমাজে কয়েকটি বিষয়ে বেশ মিল বিরাজমান ছিল। প্রথমত ধর্মীয় সংস্কার, জাতীয়তাবাদ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্পকলার নবজাগরণ। ধর্মক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দর ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনর্থক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে পক্ষান্তরে খিস্ট্রধর্মের উদারমনস্কতা এবং আধুনিকতার প্রভাবগ্রহণ তৎকালীন জাপানি বুদ্ধিজীবী মহলেও প্রভাব ফেলেছিল। জিননোসুকে সানো তাঁদেরই একজন। সেই সময় জাপানেও রাষ্ট্রীয় ধর্ম শিন্তোও ক্রমশ উদারপন্থা গ্রহণ করে বিশ্বমানবতাবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ‘গোরা’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু জাতীয়তাবাদ যে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ মঙ্গল ও কল্যাণ বয়ে আনবে না তা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত করেছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং বাড়াবাড়ি যে সার্বজনীনতার পরিপন্থী উপন্যাসের নায়ক গোরা তার মা আনন্দময়ীর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেছিল। যখন সে তার আসল পরিচয় জানতে পারলো যে সে এক খ্রিস্টান দম্পতির সন্তান ভাগ্যক্রমে আনন্দময়ী তাকে লালন-পালন করে বড় করেছে তখন তার সমস্ত হিন্দুত্ব নিমিষে উবে গেল। এখানে রবীন্দ্রনাথ একটি চিরন্তন বার্তা উহ্য রেখেছেন আর তা হলো: মানবগোষ্ঠী আসলে একটিই জাতি কিন্তু বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত। মানব-স্রষ্টা একজনই কিন্তু বিভিন্ন তার রূপ। কমপক্ষে ষাট হাজার বছর ধরে মানুষ চতুর্দিকে স্থান বদল করে চলেছে। একই উৎসে জন্ম নিয়ে বারংবার সেখানেই ফিরছে ফলে সকল ভাষা সকল চিন্তা সকল দর্শন সকল ধর্মে অজস্র অজস্র মিল বিদ্যমান। কিছু মানুষ যুগে যুগে নিজ স্বর্থের জন্য এগুলোকে বিকৃত ও অপব্যাখ্যা দিয়ে মানব সম্প্রদায়কে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছে যুদ্ধ করার জন্য। আর ধর্মীয় যুদ্ধ হচ্ছে সবচে ভয়াবহ। তাই প্রয়োজন ঐক্য, সর্বধর্মের – সর্বমতের একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেটাও ‘গোরা’র নায়ক গোরার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন এভাবে: “সুচরিতা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল দেখিয়া গোরা কহিল, [আমাকে আপনি একটা গোঁড়া ব্যক্তি বলে মনে করবেন না। হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে গোঁড়া লোকেরা, বিশেষত যারা হঠাৎ নতুন গোঁড়া হয়ে উঠেছে, তারা যে ভাবে কথা কয় আমার কথা সে ভাবে গ্রহণ করবেন না। ভারতবর্ষের নানাপ্রকার প্রকাশে এবং বিচিত্র চেষ্টার মধ্যে আমি একটা গভীর ও বৃহৎ ঐক্য দেখতে পেয়েছি, সেই ঐক্যের আনন্দে আমি পাগল। সেই ঐক্যের আনন্দেই, ভারতবর্ষের মধ্যে যারা মূঢ়তম তাদের সঙ্গে এক দলে মিশে ধুলোয় গিয়ে বসতে আমার মনে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ হয় না। ভারতবর্ষের এই বাণী কেউ বা বোঝে, কেউ বা বোঝে না – তা নাই হল – আমি আমার ভারতবর্ষের সকলের সঙ্গে এক – তারা আমার সকলেই আপন – তাদের সকলের মধ্যেই চিরন্তন ভারতবর্ষের নিগূঢ় আবির্ভাব নিয়ত কাজ করছে, সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহমাত্র নেই।]” এই ঐক্য শুধু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেই নয়, জাপানি সমাজের জন্যও একটি শিক্ষণীয় বার্তা বলে জিননোসুকে সানো উপলদ্ধি করেছিলেন বললে অত্যুক্তি হয় না। কারণ জাপানেও প্রাচীনকাল থেকে মেইজি যুগ (১৮৬৮-১৯১২) পর্যন্ত ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান ছিল প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে স্বদেশী ধর্ম শিন্তো ও বহিরাগত বৌদ্ধধর্মের মধ্যে।
দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদ। সেই সময় দুদেশেই শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী উত্থান ছিল সঙ্গত। বৃটিশবিরোধী বাংলার জাগরণ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। সেই চিত্র তিনি জাপানি সমাজেও তুলে ধরতে চেয়েছিলেন ‘গোরা’ থেকে জাপানি ভাষায় কারণ শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে জাপান বরাবরই সন্ধিগ্ধ চোখে দেখত।
তৃতীয়ত, লুপ্ত ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং শিল্পকলার পুনরুদ্ধারে ঠাকুর পরিবার যেমন নেতৃত্ব দিয়েছিল তেমনি জাপানেও একই আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন শিল্পকলার পন্ডিত ও ইতিহাসবিদ ওকাকুরা তেনশিন, জিননোসুকে সানো ছিলেন যাঁর একনিষ্ঠ ভাবানুসারী।
উপরোক্ত তিনটি বিষয় জাপান-বাংলা মৈত্রী বন্ধনের ক্ষেত্রে যাতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সম্ভব হয় তাই বাংলাপ্রিয় জিননোসুকে সানো বাঙালিমনস্কতায় পরিপূর্ণ ‘গোরা’ অনুবাদ করে জাপানি পাঠককে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন বলে জোরালো ধারণাই জন্মে।
probirsrkr06@gmail.com