একবার দাপ্তরিক কাজে বাংলাদেশ সচিবালয়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম। দুপুর হয়ে গেল। কোন একটা ভবনের এক তলা থেকে আরেক তলায় সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ বিপুল আওয়াজে জোহরের নামাজের আজান শুনতে পেলাম। মনে হল যেন পুরো ভবনটি মাইক্রোফোনের বিরাট আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছে। যদিও নামাজের ওয়াক্তের সময় চারদিকের মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসার শব্দ শোনানোর আয়োজন আমাদের কানে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, কিন্তু সচিবালয়ের মতো কেতাদুরস্ত ভবনে এভাবে তলায় তলায় মাইক্রোফোন সহযোগে আজানের শব্দ শুনে আমার মন বিচলিত হয়ে উঠল। তখন আমার মনে পড়ল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস লালসালুর কথা, যেখানে গল্পের নায়ক মজিদ (মসজিদ থেকে দন্তস্য বাদ দিলে মজিদ) ভিনগ্রাম থেকে এসে মহব্বতনগর গ্রামে ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে আস্তানা গাড়ে। ডারউইনের সারভাইবল অব দ্য ফিটেস্ট (বেঁচে থাকতে পারাটাই যোগ্যতার পরিমাপ) তত্ত্ব অনুযায়ী মজিদ জীবন ধারণের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে, যে অর্থে খালেক ব্যাপারি জমিকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকে: ‘‘একজনের আছে মাজার, আরেক জনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক।” (পৃ. ৩১) মজিদের ধর্মপ্রচার তাই প্রচলিত অর্থে আমরা ধর্মের নামে ব্যবসা বলতে যা বুঝি তাই। মানুষ কিছু একটা করে খায়, সে অর্থে মজিদ ধর্মকে ব্যবহার করে খাচ্ছে, তাই সে ভ-পীর।
সচিবালয়ের আজানের ব্যবস্থা যেমন আমার কাছে ধর্মের অতি প্রচারণামূলক ও আক্রমণাত্মক (কেন না তা অন্যের সহনশীলতা ও ধৈর্যের ওপর আঘাত করে) ব্যবস্থা মনে হয়েছিল, মজিদের ধর্মের প্রচারদর্শনও ঐ একই অতিপ্রচারণামূলক দর্শন থেকে সৃষ্ট, যার মূলে রয়েছে অতি মৌলিকভাবে জীবনধারণ করতে পারার প্রয়োজনীয়তা, এবং সম্প্রসারিতভাবে ব্যবসা করার রাস্তা তৈরি করা। বস্তুতান্ত্রিক তত্ত্বের একটি শক্তিশালী মতবাদ হল যে মানুষের যে কোন কর্মের পেছনে অর্থনৈতিক অভিপ্রায় থাকে। সচিবালয়কে কেন্দ্র করে যেমন আজান প্রচারের একটি ভবন পুঁজি হিসেবে পাওয়া গেল, তেমনি মজিদের ধর্মব্যবসার জন্য একটি স্থাপনা দরকার, যা কি না সে সৃষ্টি করে নিল ঐ নাম না জানা ‘‘ঝালরওয়ালা সালু দ্বারা আবৃত . . . মাছের পিঠের মতো” (পৃ. ৭) কবরটি বাছাই করে। অর্থাৎ বস্তুতান্ত্রিক অর্থে কবরটি তাকে একটি স্থাপনা বা ফর্ম দিল যেটার তারই সৃষ্টি অদৃশ্যমান আধ্যাত্মিকতা দিয়ে সে সরলমনা গ্রামের মানুষের মনকে উপনিবেশিত করবে: ‘‘ – আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ্। মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?” (পৃ. ৬) উপনিবেশিত শব্দটি আমরা সচেতনভাবে ব্যবহার করলাম, কারণ একজন অভিযাত্রী যেমন নতুন একটা আবিস্কৃত জায়গার নামকরণ করেন, তেমনি মজিদ, যে এক অর্থে একজন অভিযাত্রীও বটে, মহব্বতনগরে খুঁজে পাওয়া কবরটির নামকরণ করে নিজের কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে।
কীভাবে মজিদ মহব্বতনগরের গ্রামবাসীর মনে ধর্মের নামে কুসংস্কার ঢুকিয়ে তাদের মন দখল করে সে পদ্ধতি ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা দু’টো সূত্রের উল্লেখ করব। একটি হল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নিজস্ব একটি বক্তব্য, আরেকটি হল শেক্সপিয়ার পণ্ডিত নব্যইতিহাসবাদ তত্ত্বের প্রবক্তা স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাটের ইউরোপিয় অভিযাত্রীদের নতুন মহাদেশ আমেরিকায় নেইটিভ ইন্ডিয়ানদের মন ক্রিস্টান ধর্মের নামে কব্জা করার বর্ণনা, যে অর্থে মজিদ মহব্বতনগরের গ্রামবাসীদের মন কব্জা করে। মন কব্জা করার ভৌত স্থাপনা হচ্ছে কল্পিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার যেটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য: ‘‘মজিদের শক্তি ওপর থেকে আসে, আসে ঐ সালুকাপড়ে আবৃত মাজার থেকে। মাজারটি তার শক্তির মূল।” (পৃ. ১২)
লালসালুর মূল বিষয় মাজারকেন্দ্রিক ধর্মব্যবসা সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহ বলছেন: ‘‘ . . . একটি উপন্যাসের বিষয় নিয়ে অনেকদিন ধরে ভাবছি। একজন গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ যার সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, সে ব্যবসা হিসেবে বেছে নিল কবর পূজা। এ লোকটি কি রকম আচরণ করে তা আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। চট্টগ্রামে আমাদের বাড়ির কাছে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। একজন লোক হঠাৎ উঁচু একটা মাটির ঢিবির ওপর চুনকাম করে তার ওপর লালসালু বিছিয়ে পথচারীদের কাছ থেকে পয়সা নিতে লাগল। সরলবিশ্বাসী পথচারীরা চিরন্তন বিশ্বাসের ভারে এতই অভিভূত যে তারা নানাবিধ কামনায় সেখানে টাকা পয়সা দিতে লাগল। আমাদের দেশে এরকম দরগা কিন্তু অনেক গড়ে উঠেছে। ইসলাম এটা সমর্থন করে না জানি, তবুও এ ব্যবসা ক্রমান্বয়ে প্রসারের পথে [চট্টগ্রামে পাঁচলাইশ মোড়ে ও দেওয়ানহাটের ফায়ারব্রিগেডের কাছে স্থাপিত দু’টি দরগা সম্পর্কে আমার নিজের দেখা তাই বলে।] । এরকম একজন ব্যবসায়ীর চাতুর্যকে আমি আবিষ্কার করতে চাই, মিথ্যাচারকে আবিষ্কার করতে চাই, আবার মমতার মধ্যেও তাকে পেতে চাই। . . . ” মোকাম্মেল, পৃ. ২৪।)
স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাটের উপনিবেশিকরণ পদ্ধতিটি ম্যাকিয়াভেল্লীর নৃতাত্ত্বিক তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে। ম্যাকিয়াভেল্লীর ডিসকোর্সেস গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে গ্রিনব্ল্যাট বলছেন যে কেউ একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তার জন্য সুবিধাজনক হবে কোন সভ্যতাবিহীন পার্বত্য গোষ্ঠীর ওপর সেটি চেষ্টা করা, কারণ কোন সভ্য নগরকে সে অর্থে উপনিবেশিত করা যায় না। ম্যাকিয়াভেল্লীর সূত্র ধরে গ্রিনব্ল্যাট তাঁর শেক্সপিয়ারিয়ান নেগোশিয়েশানস (১৯৮০) গ্রন্থেও ‘‘ইনভিজিবল বুলেটস” শীর্ষক দ্বিতীয় পরিচ্ছদে আলোচনায় আনছেন এলিজাবেথিয় যুগের অংকশাস্ত্রবিদ, বিজ্ঞানী ও অভিযাত্রিক টমাস হ্যারিয়টকে যিনি নতুন বিশ্বে গিয়ে নেইটিভ ইন্ডিয়ানদেরকে নানা উপকরণ দিয়ে – যেমন বাইবেল, বই পড়ার ক্ষমতা, লেখার ক্ষমতা, দূরদর্শন কাচ, বারুদ ইত্যাদি প্রদর্শন করে – ম্যাকিয়াভেল্লীর নৃতত্ত্বচিন্তাটি প্রমাণ করলেন যে সভ্য ইউরোপিয়দের পক্ষে অসভ্য (?) রেড ইন্ডিয়ানদের মনে নিজেদের বিচারবুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ জাগানো খুব সহজ। উপনিবেশিত শিকারকে কব্জা করার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে তার আত্মবিশ্বাসে চিড় খাওয়ানো। যেটি ওথেলো নাটকে ইয়াগো করে ওথেলোর ওপর, কিংবা আরো পরে ১৮৩৫ সালে টমাস ম্যাকলে তাঁর শিক্ষানীতি ভারতবাসীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল এই বলে যে সমগ্র প্রাচ্যদেশের সাহিত্য প্রতীচ্য দেশের গ্রন্থাগারের কেবল একটি শেলফ ভরবে। ম্যাকলে সৃষ্ট এই হীনম্মন্যতা থেকে ভারতবাসী আজ অবধি মুক্তি পায়নি।
হ্যারিয়টের ঔপনিবেশিক নীতি গ্রিনব্ল্যাট বিস্তৃত করছেন আরো একটি বড় প্রমাণ সহকারে। সেটি হল আধুনিক ঔপনিবেশিক যুগের অন্যতম অভিযাত্রিক কলম্বাসের জীবন থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ। নতুন মহাদেশে ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে কলম্বাস তাঁর চতুর্থ সফর করেন। নেইটিভ ইন্ডিয়ানদের মনে সন্দেহ জাগে যে এই স্প্যানিশ লোকটা বোধহয় দীর্ঘদিন থাকার জন্য ঘাঁটি গেড়েছে। তারা কলম্বাস ও তাঁর নাবিকদের খাদ্য সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানালো। কলম্বাস তাঁর পঞ্জিকা পড়ে দেখে নিলেন যে একটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ তখন আসন্ন। কলম্বাস নেইটিভ ইন্ডিয়ানদেরকে এ বলে সতর্ক করে দিলেন যে তারা যে অসহযোগিতা করেছে সে জন্য ঈশ্বর একটি চিহ্নের দ্বারা তাঁর উষ্মা প্রকাশ করবেন কয়েকদিনের মধ্যে। চন্দ্রগ্রহণ হল, তা’তে ভয়ার্ত ইন্ডিয়ানরা পুনরায় কলম্বাসদের খাদ্য সরবরাহ করল। অর্থাৎ, মজিদ যেভাবে মাজারটাকে ব্যবহার করল, ঠিক সেভাবে কলম্বাস চন্দ্রগ্রহণকে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু গ্রিনব্ল্যাট বলছেন, চন্দ্রগ্রহণতো সবসময় সুবিধামতো আবির্ভুত হয় না – কিন্তু খাদ্যের প্রয়োজনতো থেমে থাকে না, তাই শুরু হয় বলপ্রয়োগ।
এই শক্তিপ্রয়োগের সঙ্গে জুড়ে আছে আধুনিক ঔপনিবেশিকতার গূঢ় একটি মাজেজা – আর সেটি হল পরের ঘামে নিজের জীবিকা নিশ্চিত করা। গ্রিনব্ল্যাটের ঔপনিবেশিকীকরণ তত্ত্বটি আমরা এখানে কাজে লাগাচ্ছি লালসালুর মজিদের ঔপনিবেশিকতাপুষ্ট মনোভাবের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে, কিন্তু এটির একটি সহব্যাখ্যাও গ্রিনব্ল্যাট হাজির করছেন এই বলে যে ঔপনিবেশিকতার মূল লক্ষ্য ছিল একটি সাহেবী বা অভিজাত শ্রেণি তৈরি হওয়া যারা অন্যের ঘাম দিয়ে পুষ্টিত হবে। যে পথ এক অর্থে মজিদও অনুসরণ করে। গ্রিনব্ল্যাট প্রশ্ন করছেন, যে অভিযাত্রিকরা সাধারণভাবে খুবই সবল সমর্থ বলবান একটি গোষ্ঠী ছিল তারা কেন নতুন বিশ্বে গিয়ে সামান্য জমি চাষ করে জীবিকানির্বাহ করতে চাইতো না, বরঞ্চ অপেক্ষা করত কখন নেইটিভরা তাদেরকে খাদ্য যোগান দেবে, এবং তার কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, আসলে পুরো ইউরোপে ঔপনিবেশিক যুগের প্রারম্ভে এই ধারণা বিস্তার লাভ করে যে ”টু লিভ বাই দ্য সোয়েট অব আদার মেনস ব্রাউস” ছিল অভিজাত বা জেন্টলম্যান হবার মোক্ষম উপায়। আর ভারতে ম্যাকলের ধারণানুসারে এই সাহেবিয়ানার প্রতিষ্ঠা পেলে বিরাট আমলার দল সৃষ্টি হয়। দূরাগতভাবে মজিদও ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতার আমলা।
কিন্তু ম্যাকিয়াভেল্লী মনে করতেন বলপ্রয়োগ করে কখনো পুরোপুরি কর্তৃত্ব বজায় রাখা যায় না। এটির প্রয়োজন আছে, কিন্তু এটি কখনো যথেষ্ট নয়। তাই ম্যাকিয়াভেল্লী ধারণা দেন, শাসকপক্ষের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক অস্ত্র হল শাসিতদের ওপর একটি উত্তম-ইতর দ্বান্দ্বিকতাস্পৃষ্ট বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া যা একটি ভয়ের আকারে তাদের মনে প্রভাব বিস্তার করবে। যেমন, আমরা যদি কলম্বাসের উদাহরণটা টানি, তা হলে কলম্বাস এই ধারণাটি নেইটিভ ইন্ডিয়ানদের মনে প্রবিষ্ট করিয়ে দেন যে ক্রিস্টান ঈশ্বর হল অমিতপরাক্রমশালী, এবং ক্রিস্টানদের রক্ষা করা তাঁর (ঈশ্বরের) প্রধান দায়িত্ব। এই কথাটি ইংরেজ অভিযাত্রিকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে গ্রিনব্ল্যাট বলছেন, নেইটিভ ইন্ডিয়ানদের মনে এই ভয় জাগিয়ে দেওয়া হয় যে তারা যদি ইংরেজদের অমান্য করে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তা হলে ক্রোধান্বিত ক্রিস্টান ঈশ্বরের অভিশাপের ফলে তাদের শস্য বিনষ্ট হবে এবং তাদের প্রাণহানি হবে। এই ভয়টি মানবমনকে উপনিবেশিত করার জন্য একটি মোক্ষম অস্ত্র।
নেইটিভ ইন্ডিয়ানদের মনে কলম্বাস যেভাবে ভয় ঢুকিয়েছিলেন, মজিদের মনস্তত্ত্বও যে অনেকটা সেভাবে কাজ করছে নিম্নোক্ত উক্তিটি তাই প্রমাণ করবে:
‘‘মাঠের প্রান্তে একাকী দাঁড়িয়ে মজিদ দাঁত খিলাল করে আর সে-কথাই ভাবে। কাতারে কাতারে সারবন্দি হয়ে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো কাস্তে নিয়ে মজুররা যখন ধান কাটে আর বুক ফাটিয়ে গীত গায় তখনো মজিদ দূরে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাবে। গলার তামার খিলাল দিয়ে দাঁতের গহ্বর গুঁতোয় আর ভাবে। কিসের এত গান, এত আনন্দ? মজিদের চোখ ছোট হয়ে আসে। রহিমার শরীরে তো এদেরই রক্ত, আর তার মতোই এরা তাগড়া, গাট্টাগোট্টা ও প্রশস্ত। রহিমার চোখে ভয় দেখেছে মজিদ। এরা কি ভয় পাবে না?” (পৃ. ৯)
আর মজিদের পরশ্রমে পুষ্ট হবার ইপ্সা ঢাকা পড়ে যায় তার ধর্মীয় শঠতামির তলায়:
‘‘ওদের গান আকাশে ভাসে, ঝিলমিল করতে থাকা ধানের শীষে এদের আকর্ণ হাসির ঝলক লাগে। ওদের খোদার ভয় নেই। মজিদও চায়, তার গোলা ভরে উঠুক ধানে। কিন্তু সে তো জমিকে ধন মনে করে না, আপন রক্তমাংসের শামিল খেয়াল করে না? শ্যেনদৃষ্টিতে অবশ্যি চেয়ে চেয়ে দেখে ধানকাটা; কিন্তু তাদের মতো লোম-জাগানো পুলক লাগে না তার অন্তরে। হাসি তাদের প্রাণ, এ-কথা মজিদের ভালো লাগে না। তাদের গীত ও হাসিও ভালো লাগে না। ঝালরওয়ালা সালুকাপড়ে আবৃত মাজারটিকে তাদের হাসি আর গীত অবজ্ঞা করে যেন।” (পৃ. ৯)
শ্রমের সঙ্গে নিজেকে বিযুক্ত রাখা মজিদের জীবনাচরণের বৈশিষ্ট্য। তাই সমবেত গ্রামবাসীকে মজিদ বলে, ‘‘খোদাই রিজিকদেনেওয়ালা।” (পৃ. ৯) তারপর ইঙ্গিতে মাজারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, আর তানার দোয়া (পৃ. ১০)। এ-কথা গ্রামবাসীর মনে প্রবিষ্ট হয়েছে এবং তারা বুঝে গেছে যে ‘‘মাঠের বুকে গান গেয়ে গজব কাটানো যায় না” (পৃ. ১০)। তারা ‘‘তার কাছেই শোকর গুজার করবার ভাষা শিখতে আসে।” (পৃ. ২৩) এই আস্থা অর্জনের পর মজিদের ঔপনিবেশিকতাপুষ্ট মন ভৌগোলিক সম্প্রসারণের দিকে যায়। ম্যাকিয়াভেল্লী যেমন বলেছিলেন সভ্যতাবিহীন জনগোষ্ঠীকে মানসিকভাবে পরাভুত করা সহজ, তেমনি মজিদ তার কব্জাকরণের পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে আসে মানবশরীর। সকল ধর্মে যেমন সমস্ত আচার-রীতির বিরাট অংশ জুড়ে থাকে মানবশরীর, ইসলাম ধর্মেও তাই আছে এবং সাত ছেলের বাবা দুদু মিঞাকে মজিদ সে কলমা জানে কি না এ-কথা জিজ্ঞেস করার পরপরই সোনার খনি আবিষ্কারের মতো তার কাছে পরিষ্কার হয় যে গ্রামের ধাড়ি ধাড়ি ছেলেদের খৎনা হয় নি। শুধু তাই নয়, দুদু মিঞার ছেলের যেমন হয় নি, দুদু মিঞারও হয় নি। ‘‘আপনাগো দেশটা বড় জাহেলের দেশ” খৎনা করার উদ্দেশ্যে কঞ্চি ছিলতে ছিলতে মজিদ তার অনুগত সামন্তনেতা খালেক ব্যাপারিকে বলে। ‘‘আধ ঘন্টার মধ্যে দু-দুটো খৎনা হয়ে গেল” (পৃ. ১১)–এইটি দুদু মিঞার ছেলের ক্ষেত্রে কিছুটা রীতিসিদ্ধ হলেও বৃদ্ধ দুদু মিঞার ওপর এটি পাশবিকতার নামান্তর, কিন্তু এই পাশবিকতাই মজিদ ধর্মপালনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গীকার হিসেবে প্রমাণ করে। এইখানে একটি প্রশ্ন যদিও থেকে যায় যে লালসালু উপন্যাসে যদিও কালনির্ধারক কোন চিহ্ন নেই, কিন্তু মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাসের ইস্কুল দেবার সংকল্পে – যেহেতু সে ”কোত্থেকে শিখে এসেছে ইস্কুলে না পড়লে নাকি মুসলমানদের পরিত্রাণ নেই” (পৃ. ৪৫) – মনে হয় ঘটনার ঐতিহাসিক পটভূমি সে সময়কার হবে যখন মওলানা মুহম্মদ আলী এবং মওলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয় ভারতীয় মুসলমানদের আধুনিকতার পথে যেতে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, এবং তাই যদি হয়, তা হলে এটা মনে হয় না যে এটি উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম আগমনের প্রথম পর্যায়ের কাহিনী, এবং তা যদি না হয় তা হলে কোন গ্রামীণ সমাজে কোনকালে মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে কলমা জানা থাকবে না কিংবা খৎনার আচার সম্পর্কে তারা থাকবে অজ্ঞ এ কথা কল্পনা করা যায় না, তারপরও এই পাশবিকতার প্রতীকী অর্থ হল দুদু মিঞা তার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং মজিদের প্ররোচনায় নিজের বৃদ্ধা স্ত্রীর ওপর সন্দেহপরবশ হয়ে একদিন ঝড়ের পর সন্ধ্যায় ‘‘বুড়ো কোথায় চলে” (পৃ. ২০) যায়, তার আর খোঁজ পাওয়া যায় না।
মজিদের বস্তুতান্ত্রিক চেতনায় জোতজমির মতো মেয়েমানুষের শরীরও পণ্যের মতো উদ্ভাসিত হয়। যে ‘‘চওড়া বেওয়া” (পৃ. ৭) মহিলাকে সে বিয়ে করেছে, যে রহিমার গোসল করা সিক্ত বসন দেখে সে বলে ‘‘পখালা জাগায় অমন বেশরমের মতো” (পৃ. ৮) দাঁড়াতে নেই, সে মজিদ হাসুনির মা’র খোলা পিঠ দেখে যেমন লালায়িত, তেমনি খালেক ব্যাপারির প্রথমা স্ত্রী আমেনার ‘‘সাদা মসৃণ পা” (পৃ. ৩৮) দেখে ‘‘তার জিহ্বা লিকলিক করে” (পৃ. ৩৯) ওঠে। সাপের মতো এই অনুভূতি মজিদের হয়েছে ঠিক মাজারের পাশে যখন নিঃসন্তান আমেনা বাচ্চা পাবার আকাঙ্ক্ষায় পানিপড়া খেতে আসে এবং জ্ঞান হারায়।
আমেনা বিবিকে কেন্দ্র করে মজিদের মানসিকতার জৈবিক কামনার সাথে সূক্ষ্ম ঔপনিবেশিক প্রবণতা মিলে একটি ছক তৈরি হয় যেটির সঙ্গে ইউরোপিয় ঔপনিবেশিকদের প্রতিপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবেলা কৌশলের মিল খুঁজে পাই। মহব্বতনগরের পাশের গ্রাম আওয়ালপুরে এক বুজর্গ পীর আস্তানা গেড়েছে বলে মজিদ খবর পায়। পীরের বংশ খানদানী, পক্ষান্তরে মজিদের ছিল নিরন্ন অতীত। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া মাত্রই তাকে বিনাশ করা ঔপনিবেশিক কৌশলের অন্যতম কলা। মহব্বতনগরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সময় আপাতঃবিদ্রোহী দুদু মিঞার ওপর যেমন খৎনার কথা বলে তার বিজয় নিশ্চিত করতে হয়েছিল, তেমনি আওয়ালপুরের পীরের বিরুদ্ধেও ‘‘বে’দাতি কাজকারবারের” (পৃ. ২৮) অভিযোগ এনে মজিদ অন্তত মহব্বতনগরের লোকদের আওয়ালপুরের পীরের কাছে ছোটা বন্ধ করতে পারে। কিন্তু আমেনা বিবির গোপনে আওয়ালপুরের পীরের পানিপড়া গ্রহণের অভিলাষের কথা জানতে পেরে মজিদের আঁতে ঘা লাগে। আমেনাতো তারই পানিপড়া খেতে পারে! সে খালেক ব্যাপারিকে বলে, ‘‘খালি আমার দুঃখডা এই যে, আপনার বিবি আমারে একবার কইয়াও দেখলেন না। আমার থিকা ঠগ-পীর বেশী হইল? আমার মুখে কি জোর নাই?” (পৃ. ৩৪) যখন বলে যে ‘‘পেটে বেড়ী পড়ে বইলাই তো স্ত্রীলোকের সন্তানাদি হয় না” (পৃ. ৩৪)। আগে বেড়ী ছাড়াতে হয়। খালেক ব্যাপারি বোকার মতো প্রশ্ন করে, ‘‘আমার বিবিরডা ছাড়ানো যায় না?” (পৃ. ৩৪) মজিদ বেফাঁস বলে, ‘‘ক্যান যায় না? তয় কথা হইতেছে, আগে দেখন লাগব কয় প্যাঁচ তানার।” (পৃ. ৩৪) তারপরের লাইনটি মজিদের সূক্ষ্মসতর্কতামূলক মনের গভীর পরিচয়: ‘‘কথাটি শুনে ব্যাপারি আবার না ভাবে যে মজিদ তার উদরাঞ্চল নগ্নদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে দেখবে – তাই তাড়াতাড়ি বলে, এর একটা উপায় আছে।” (পৃ. ৩৪)
স্ত্রীলোকের অঙ্গবৈশিষ্ট্যের প্রতি মজিদের কামাসক্তি নিছক স্বাভাবিক পুরুষপ্রবৃত্তি হয়ত বা, কিন্তু যে কারণে এটি দ্ব্যর্থবোধকতা লাভ করেছে সেটি হচ্ছে এটি মাজারের ভিতরেও পানিপড়া খাবার প্রক্রিয়ায় সারাদিন পানাহাররহিত আমেনা বিবিকে যখন মাজারের চারপাশে পাক দিতে বলে তখন তার মনে কাজ করে শুধু কামাসক্তি নয় বরং প্রচণ্ড প্রতিহিংসা, কেন না এই মহিলা তার অস্তিÍত্ব সম্পর্কে অবগত থেকেও আওয়ালপুরের পীরের পানিপড়া খেতে চেয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মোকাবেলার ক্ষেত্রে মজিদের থাকে শুধু কপট ধর্মাশ্রিত কৌশল নয়, থাকে প্রতিহিংসা: ‘‘যে-আমেনা বিবির পীরের পানিপড়া খাবার শখ হয়েছিল সে-আমেনা বিবির ওপর আকার-ইঙ্গিত বা মুখের ভাবে প্রকাশ না করলেও – মজিদের মনে একটা নিষ্ঠুর রাগ দেখা দিয়েছিল। তার একটা নিষ্ঠুর শাস্তিও সে স্থির করেছিল।” (পৃ. ৪১) দুদুমিঞাকে খারিজ করার সময় যে প্রতিহিংসা কাজ করেছিল, আমেনা বিবির ক্ষেত্রেও সে একই প্রতিহিংসা সাপের মতো বিষ-ছোবল মারতে উদ্যত হয়। এইজন্য এ অংশটুকুর বর্ণনায় লেখক সাপের প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন:
‘‘ঘরের কোণে একটি পাত্রে পানি ছিল। এবার সেটি তুলে নিয়ে মজিদ অন্য ধারে গিয়ে বসে। পানি পড়বে, যে- পড়াপানি খেয়ে আমেনা বিবি পাক দেবে। তার ঠোঁট তেমনি বিড়বিড় করে, হাতে পানির পাত্রটা তুলে নেয়ায় হয়তো-বা তা ঈষৎ দ্রুততর হয়। ঘরের মধ্যে প্রগাঢ় নি:শব্দতা। এ-নিঃশব্দতার মধ্যে তার গলায় অষ্পষ্ট মিহি আওয়াজ কোন আদিম সাপের গতির মতো জীবন্ত হয়ে থাকে। তার কণ্ঠে যদি সাপের গতি থাকে তবে তার মনেও এক উদ্যত সাপ ফণা তুলে আছে ছোবল মারবার জন্য। আমেনা বিবির বোজা চোখ মজিদের ভালো লাগে না, কিন্তু পালকি থেকে নাববার সময় তার যে সাদা সুন্দর পা-টা দেখেছিল, সে পা-ই তার মনে সাপকে জাগিয়ে তুলছে। সাপ জেগে উঠছে ছোবল মারবার জন্য। তার জিহ্বা লিকলিক করে, উদ্যত দীর্ঘ গলা বেয়ে উঠে আসে বিষ। সুন্দর পা-দেখে স্নেহ-মমতা না উঠে আসে, আসে বিষ। স্নেহ-মমতাই যদি গলগলিয়ে, গদগদ হয়ে জেগে উঠত তবে মজিদ রূপালি ঝালরওয়ালা চমৎকার সালুকাপড়টাই ছিঁড়ে এখানকার ঘরবাড়ি ভেঙে অনেক আগে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যেত। এবং যেত সেখানেই যেখানে নির্মল আলো-হাওয়া রোগজীবাণুভরা লালাসিক্ত কেতাবের জালির মধ্যে দিয়ে নিঃসৃত হয়ে আসে না, আসে উন্মুক্ত বিশাল আকাশপথে – যেখানে কাদামাটি লাগে নি এমন পা দেখে অন্তরে বিষাক্ত সাপ জেগে উঠে ফণা ধরে না।” (পৃ. ৩৯)
লক্ষণীয় যে পুরো বর্ণনাটিতে সাপের চিত্রকল্পের সঙ্গে সাধারণভাবে পুরুষাঙ্গের উত্থানজনিত কামাবেগের সম্পর্ক স্থাপন করার যে রীতি সাহিত্যে বর্তমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সযত্নে সেটি পরিহার করে সাপের বিষাধার চিত্রকল্পটি অক্ষুণ্ণ রেখে মজিদের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির প্রতি ঘৃণামিশ্রিত প্রতিহিংসাপরায়নতাকে উচ্চকিত করেছেন। ফলে তার স্ব-আরোপিত মাজারের শুদ্ধতা, যেটা পাকরত আমেনার মনে এক পবিত্র শুচিতার শুরু করে, সেটি কলুষিত হতে সময় লাগে না, মাজারটিও মজিদের মনের ভাষায় ভাষান্তরিত হয়। এবং মজিদ যে দিক থেকে অস্ত্র ক্ষেপণ করে দুদুমিঞাকে নিরস্ত্র করেছিল – যেটি শেক্সপিয়ারের ওথেলো নাটকে ইয়াগো প্রয়োগ করে স্বামীর মনে বিবাহিতা স্ত্রীর ওপর সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ জাগিয়ে – সেটি সে খালেক ব্যাপারির স্ত্রী আমেনা বিবির ওপরও প্রয়োগ করে, এবং সফল হয়। আমেনা বিবি মূর্ছা যাবার পর মজিদ অনুযোগ তুলে খালেক ব্যাপারির কাছে যে তার পানিপড়া এত পবিত্র অথচ সে পানিপড়া খেয়ে কেন আমেনা বিবি জ্ঞান হারাবে!: ‘‘তয় ক্যান তানি অজ্ঞান হইছেন?” (পৃ. ৪১) ঠিক ইয়াগো যেমন ওথেলোর মনে সন্দেহ জাগানোর জন্য জিজ্ঞেস করে: “Did Michael Cassio, when you wooed my lady, / Know of your love?” (৩.৩.১০৫-৬) (মাইকেল ক্যাসিও কি আপনি যখন শ্রদ্ধেয়া ডেসডেমোনাকে ভালোবাসছিলেন তখন এ ব্যাপারে জানতেন?) এই সন্দেহের বীজ ওথেলোর মনে মহীরূহতে পরিণত হয়ে ওথেলোর হাতে ডেসডেমোনার মৃত্যু ঘটায়, আর যে ট্র্যাজেডি শেক্সপিয়ারের নাটকে প্রেমের চিরকালের সংকট ত্রিকোণী ছক থেকে উদ্ভুত, তা ওয়ালীউল্লাহ লালসালু উপন্যাসে মজিদের ইয়াগোস্বরূপ শয়তানি বুদ্ধি দিয়ে চারিত করেন, এবং যেহেতু সমাজটি পশ্চাদপদ একটি মুসলিম সমাজ এখানে ত্রিকোণী ছকে ক্যাসিওর মতো কারো নাম উল্লেখ না করলেও চলে, শুধু সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারাটাই যথেষ্ট: ‘‘হঠাৎ ব্যাপারির চোখ সন্ধিগ্ধ হয়ে ওঠে এবং তা একবার কানিয়ে চেয়ে লক্ষ করে দেখে মজিদ। ব্যাপারির চোখে সন্দেহের জোয়ার আসুক, আসুক ক্রোধের অনলকণা।” (পৃ. ৪১) ব্যাপারির ব্যগ্র জিজ্ঞাসা – ‘‘ভিতরে কি কোনো কথা আছে?” – এর উত্তরে ইয়াগোরূপী মজিদ বলে, ‘‘না। কওন যায় না। থেমে আবার বলে, তয় একটা কথা আমার কওন দরকার। তানারে তালাক দেন।” (পৃ. ৪১) এবং আমেনা বিবি তালাকপ্রাপ্তা হয়ে এই ঘটনার তিনদিনের মাথায় বাপের বাড়ি রওয়ানা হয়।
আমেনা বিবিকে খারিজ করার পর মজিদের প্রয়োজন পড়ল মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাসকে নিয়ন্ত্রণ করার, যে নাকি গ্রামে একটি ইস্কুল দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, কারণ – যেটি আগেও উল্লেখ করেছি – সে ‘‘কোত্থেকে শিখে এসেছে ইস্কুলে না পড়লে নাকি মুসলমানদের পরিত্রাণ নেই” (পৃ. ৪৫)। কিন্তু সন্ধ্যার পর এ নিয়ে বৈঠক বসলে মজিদ তাকে ‘‘ঠাস করে চড় মারার ভঙ্গিতে” (পৃ. ৪৫) বলে, ‘‘তোমার দাড়ি কই মিঞা?”
দাড়ি নেই বলে যেন আক্কাস ইসলাম ধর্মের শুদ্ধচারী বান্দা নয়, এবং সেজন্য মানুষও নয়। এ প্রসঙ্গে টিভি’র বিভিন্ন চ্যানেলে আজকাল যে সব ধর্ম শিক্ষার অনুষ্ঠান হয় তা’তে অনেক সময় শ্রোতাদের নানারকম প্রশ্নের বিষয় থাকে দাড়ি রাখা না রাখা, পায়জামা খাটো করে পরা বা না পরা ইত্যাদির ওপর, যেগুলি মানুষের আচার আচরণের অত্যন্ত বাহ্যিক দিক, অন্তরের কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু মজিদের শিকার বধ করার কৌশল যে ঐ বাহ্যিকতার ওপর এবং তার নীচের শঠতা সম্পর্কে সে অবহিত থাকলেও গ্রামবাসীতো থাকে না। আক্কাসের কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকার অবস্থায় ”কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে মজিদ হাঁক ছাড়ে, – ভাই সকল। পোলা মাইন্ষের মাথায় একটা বদ খেয়াল ঢুকছে – তা নিয়া আর কী কমু। দোয়া করি তার হেদায়েত হোক। কিন্তু একটা বড় জরুরি ব্যাপারে আপনাদের আমি আইজ ডাকছি। খোদার ফজলে বড় সমৃদ্ধিশালী গেরাম আমাগো। বড় আফসোসের কথা, এমন গেরামে একটা পাকা মসজিদ নাই।” (পৃ. ৪৬)
মসজিদ হল মহব্বতনগরে, পাকা মসজিদ। মাজার এবং মসজিদ মিলে শক্ত স্থাপনা হয় যার ওপর ভিত্তি করে মহব্বতনগরে মজিদের ‘‘দীর্ঘ রাজত্বকালে” (পৃ. ৫৪) ধর্মপ্রচারের দিক থেকে সে আত্মতুষ্টি লাভ করে এই ভেবে যে ‘‘সাধারণ চাষাভুষা পর্যন্ত আজ কলমা জানে।” (পৃ. ৪৬) কিন্তু ইয়াগো যেমন ভিলেন হলেও আকর্ষণীয় ভিলেন, কারণ তার কদর্য মনেও মানবচরিত্র বিশ্লেষণের অপূর্ব ক্ষমতা সংস্থিত হয়েছে, তেমনি ওয়ালীউল্লাহ যেমন আগে উৎকলিত একটি উদ্ধৃতিতে বলেছিলেন যে ভণ্ড পীরকে তিনি ‘‘আবার মমতার মধ্যেও” পেতে চান, সে মমতা তৈরি হচ্ছে মজিদের মধ্যে বিপরীত চিন্তার কিছু সংমিশ্রণ এনে, অর্থাৎ মজিদকে আকর্ষণীয় করার প্রচেষ্টায়।
একদিন নবনির্মিত মসজিদে যাওয়ার পথেই তার মনে হল সে ছিল ‘‘ভাগ্যান্বেষী দুস্থ মানুষ” (পৃ. ৪৮) কিন্তু তার জোত-জমিসহ সব হয়েছে। কীসের কল্যাণে? ঐ নাম-না জানা কবরটির কল্যাণে। ‘‘কার কবর এটা? যদিও মজিদের সমৃদ্ধির, যশমান ও আর্থিক সচ্ছলতার মূল কারণ এই কবরই, কিন্তু সে জানে না কে চিরশায়িত এর তলে।” (পৃ. ৪৮) সে কবরের প্রতি তার ভয় জাগে। ভয়ের পাশাপাশি ঠক লোকের জীবনের নির্মম হতাশা তাকে খানিকক্ষণের জন্য জেঁকে ধরে। তার ‘‘নেশার প্রয়োজন” (পৃ. ৪৯)। জীবনে সে লোক ঠকিয়েছে, কিন্তু জীবনকেতো উপভোগ করে নি। ”জীবন উপভোগ না করতে পারলে কিসের ছাই মান-যশ-সম্পত্তি? কার জন্য শরীরের রক্ত পানি করা আয়েশ-আরাম থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা?” (পৃ. ৪৯)
মজিদের উপোরোক্ত উক্তি কবরটির সংশ্লিষ্টতায় যে বিরোধাভাসের সূচনা করল তা’তে এ কথাই বরঞ্চ প্রমাণিত হয় যে মজিদের বস্তুতান্ত্রিক মনে কবরের অস্তিত্ব কেবল কবরই – মাছের পিঠের মতো একটি অবয়ব সর্বস্ব গাঁথুনি কেবল, কিন্তু এর তলে একদা শায়িত লোকটির মৃত্যু-উত্তর জীবন সম্পর্কে তার মনে ভয়ের উদ্রেক হয়েছে, মমতা তৈরি হয়নি, এবং আরো বরঞ্চ যা হয়েছে সেটি হচ্ছে জীবনের ওপারে কী আছে সে ব্যাপারে তার নিস্পৃহতা। সে জন্য তার মন কার্পে ডিয়েম বা সিজ দ্য ডে বা ওমর খৈয়ামী ভঙ্গিতে ‘‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও” বলে কাতর হয়ে ওঠে, এবং রহিমাকে বলে, ‘‘বিবি, আমাগো বাড়িটা বড়ই নিরানন্দ। তোমার একটা সাথী আনুম?” (পৃ. ৪৯)
সাথী এল বিড়ালছানারূপী জমিলা, কিন্তু সহসা যে হয়ে উঠল এমন একজন প্রতিদ্বন্দ্বী যাকে মজিদ জানে না কিভাবে খারিজ করতে হবে। (পৃ. ৫৪) মজিদ সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে বুঝতে পারে যে এ ‘‘মেয়েটির চোখে বিন্দুমাত্র খোদার ভয় নেই – মানুষের ভয় তো দূরের কথা।” (পৃ. ৫৫) জমিলা নামাজ পড়তে পড়তে জায়নামাজে ঘুমিয়ে যায়, এটাও একটা বে’দাতি কাজ। মজিদ ব্যবস্থা নেয় যে জমিলাকে মাজারে যেয়ে তারাবির নামজ পড়ে মাফ চাইতে হবে। কিন্তু একটি প্রতীকী ঘটনা মজিদের ভন্ডামি নির্ভর জীবনের সমস্ত অর্জনকে যেন তছনছ করে দেয়। জমিলা মজিদের বুকে থুতু নিক্ষেপ করে।
‘‘মাঝ-উঠানে হঠাৎ বেঁকে বসল জমিলা। মজিদের টানে স্রোতে-ভাসা তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যাচ্ছিল, এখন সে সমস্ত শক্তিসংযোগ করে মজিদের বজ্রমুষ্টি হতে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও হাত যখন ছাড়াতে পারল না তখন সে অদ্ভুত একটা কান্ড করে বসল। হঠাৎ সিধা হয়ে মজিদের বুকের কাছে এসে পিচ করে তার মুখে থুতু নিক্ষেপ করল।” (পৃ. ৬১)
প্রতীকী ব্যঞ্জনায় এই থুতু ভন্ড জীবনাচারী মজিদের কর্মকাণ্ডের প্রতি যেমন চূড়ান্ত ঘৃণার নির্দয় প্রকাশ, তেমনি বক্রার্থে এটি লালসালু উপন্যাসের গঠনশৈলীর আরেকটি প্রকোষ্ঠকে উন্মোচিত করে। ঔপনিবেশিকতার কাঠামোয় আমরা যখন উপন্যাসটির আলোচনা করছি, যখন বলছি যে মহব্বৎনগর গ্রামবাসীদের মন-মানসিকতাকে মজিদ ধর্মের নামে কব্জাগত করেছে, এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, সে সাথে এটাও বলতে হবে যে ইউরোপ-সৃষ্ট রাজনৈতিক ঔপনিবেশিকতার মূলচালিকা শক্তি যেমন ছিল পুরুষতান্ত্রিক শৈর্যশীলতা, তেমনি মজিদের ভন্ড-ধর্মীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠার মূল চালিকা শক্তির অন্যতম হল পুরুষতান্ত্রিকতা। অর্থাৎ রাজনৈতিক ঔপনিবেশিকতা যেমন পুরুষতন্ত্রকেন্দ্রিক তেমনি ধর্মীয় বা বক-ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতাও একান্তই পুরুষতান্ত্রিক। তাই লক্ষ করলে দেখা যায় মজিদের অনুশাসনগুলো রচিত হয়েছে মেয়েমানুষের জীবনাচরণকে ভিত্তি করে, যেখানে মেয়েমানুষ হচ্ছে পাপের আধার, বিশেষ করে সতীত্বের দিক থেকে। দুদু মিঞা হারিয়ে যায় বা আত্মহত্যা করে কেন না মজিদ তার মনে তার স্ত্রীর সতীত্ব সম্পর্কে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। একই উপায়ে খালেক ব্যাপারির মনেও সে আমেনা বিবির সতীত্ব সম্পর্কে সফলভাবে সন্দেহ জাগাতে পারে। তার প্রথমা স্ত্রী রহিমা বিশাল দেহসৌষ্ঠব নিয়েও তার মনের খোরাক জোগাতে পারে না, শুধু থাকে তার পা টেপার কাজে নিয়োজিত, আর সেখানে জমিলার বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে মোক্ষম মনে হলেও, ঠিকই দেখা যায় মজিদের দেওয়া ধর্মীয় অনুশাসনগুলো জমিলা ঠিকই পালন করছে, এমন যে মাজারের সঙ্গে যখন জমিলাকে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখল সারা রাতের জন্য তখন জমিলা ভয় পেয়ে প্রায় বাকশক্তিহীন হয়ে গেল। তাই জমিলার থুতু নিক্ষেপের প্রতীকী ব্যঞ্জনা আমাদের মনে গেঁথে রইলেও বাস্তবতার অর্থে এই কাজটা তেমন ফলপ্রসূ হয় না। কারণ মজিদতো বদলায় না। তার পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতাপুষ্ট মন জমিলার থুতু নিক্ষেপে কিছুমাত্র টলে না।
এখানে মজিদের স্ত্রীলোকের প্রতি ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিজাত মনোভাবের একান্ত বৈশিষ্ট্য হল নারীকে পাপের আধার হিসেবে বিবেচনা করা।
‘‘তোমার জন্য আমার মায়া হয়। তোমারে কষ্ট দিতেছি তার জন্য দিলে কষ্ট হইতেছে। কিন্তু মানুষের ফোড়া হইলে সে-ফোড়া ধারালো ছুরি দিয়া কাটতে হয়, জিনের আছর হইলে বেত দিয়া চাবকাইতে হয়, চোখে মরিচ দিতে হয়। কিন্তু তোমারে আমি এইসব করুম না।” (পৃ. ৬৩)
নারীর ওপর ডাইনি ভর করে এরকম প্রচলিত কথাকে পুঁজি করে মজিদ ধারণা দেয় জমিলার ওপর জিনের আছর হয়েছে, এবং সে জিন তাড়াতে ‘‘মাজারপাকের কাছে রাতের এক পহর থাকলে যতই নাছোড়বান্দা দুষ্ট আত্মা হোক না কেন, বাপ-বাপ ডাক ছাড়ি পলাইব।” (পৃ. ৬৩) অনেকটা যে ভঙ্গিতে ওথেলো ডেসডেমোনাকে হত্যার আগে বলে যে সে ডেসডেমোনাকে হত্যা করছে না, কিন্তু ডেসডেমোনার মধ্যে যে পাপ ভর করেছে তাকে হত্যা করছে, যেন সে দেবতাপ্রেরিত দূত পাপকে স্খালন করার জন্য। কিন্তু ওথেলো যেমন ডেসডেমোনাকে হত্যার পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত ডেসডেমোনার আকর্ষণের প্রতি দ্রবীভূত না হবার জন্য নিজেকে সংবরণ করে হত্যা করার স্থির সংকল্পে দৃঢ়বদ্ধ থাকতে চায় (O balmy break, that dost almost persuade / Justice to break her sword!” (৫.২.১৬-৭), মজিদের মধ্যে কিন্তু সেরকম কোন বিকার আসেনা, এতটাই নিশ্চিত সে তার প্রতীতীতে যে মেয়েমানুষের ওপর জিন আছর করতে পারে। সে জন্য আবারও থুতু ছিটানোর ঘটনাটি শক্তিশালী বুনিয়াদ পায় না।
ওথেলোর মধ্যে এই প্রচন্ড মায়ার অস্তিত্ব সে জন্য তার ডেসডেমোনার মৃত্যুর পর অনুশোচনাকে প্রকৃতভাবে দগ্ধ অন্তরের অনুভূতিময় কান্না মনে হয় (Then must you speak / Of one that loved not wisely but too well” (৫.২.৩৮৬-৭)), অথচ মজিদের অর্ন্তঘাতমূলক অনুভূতি এতটাই মেকী মনে হয় যে তা আর আমাদের হৃদয়কে ষ্পর্শ করে না। লক্ষ করা যাক:
‘‘মজিদের কণ্ঠে গানের মতো গুনগুনিয়ে ওঠে পাঁচ পদের ছুরা আল-ফালাখ। সন্ধ্যার আকাশে অস্তগামী সূর্য দ্বারা ছড়ানো লাল আভাকে যে কুৎসিত ভয়াবহ অন্ধকার মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, সে-অন্ধকারের শয়তানি থেকে আমি আশ্রয় চাই, চাই তোমারই কাছে হে খোদা, হে প্রভাতের মালিক। আমি বাঁচতে চাই যত অন্যায় থেকে, শয়তানের মায়াজাল থেকে আর যত দুর্বলতা থেকে, হে দিনাদির অধিকারী।” (পৃ. ৬৫)
মজিদের চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য হল তার মধ্যে সত্যিকারের কোন উত্তরণ হয়নি। তার মানবিক খলতা উৎপন্ন করা এবং বোঝার ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতা থাকলেও সে উপন্যাসের ঘটনাক্রম দিয়ে চেতনার কোন এক স্তর হতে অন্য স্তরে উন্নীত হয়েছে তা নয়। বরঞ্চ যে শঠতাকে আশ্রয় করে উপন্যাসে সে যাত্রা শুরু করেছিল, সে শঠতাকেই সে চেতনার অবিবর্জিত অংশ মনে করে যাত্রা শেষ করে। সে রহিমাকে বলে, ‘‘দুনিয়াটা বিবি বড় কঠিন পরীক্ষাক্ষেত্র। দয়া-মায়া সকলেরই আছে। কিন্তু তা যেন তোমারে আঁধা না করে।” (পৃ. ৬৬) ‘তোমারে আঁধা না করে’ উক্তিটির মর্মার্থ হল মজিদ বদলাবে না।
উপন্যাসের গঠনশেলীর মধ্যেও মজিদের এই উত্তরণবিহীনতা প্রভাব ফেলেছে। বস্তুত লালসালু এবং ওয়ালীউল্লাহর পরবর্তী দু’টি উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) এবং কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৭১) এই সীমাবদ্ধতায় ভুগছে যে কোথাও ক্লাইমেক্স ঠিক জমতে পারছে না। উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি ঔপন্যাসিক এমিল জোলার স্বাভাবিকতাতত্ত্বানুযায়ী লিখিত লালসালু উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র মজিদ ভণ্ডপীর, কিন্তু শেষাবধি সে ভণ্ড পীরই বটে। বস্তুত আমার মনে হয়েছে জমিলার আগমনের সাথে সাথে উপন্যাসটির কাঠামো শিথিল হয়ে যায়, কাহিনীপট উচ্চনীচ থাকে না, বরঞ্চ কথার পর কথা এসে ভাবনার পর ভাবনাকে সাজিয়ে তুলে একটি অত্যন্ত উঁচুদরের কথাসাহিত্যকে কথার বেসামাল স্তূপে ভরিয়ে তোলে। মজিদ পরিবর্তনহীন রয়ে যায়, কিন্তু তার পরিবর্তনহীনতা উপন্যাসের গঠনশৈলীকে ঢিলা করে ফেলে। অতিকথনে দুষ্ট যদি হয় লালসালুতে জমিলার আগমনের পর বয়ানটি, চাঁদের অমাবস্যাতে সেটি মহামারীর রূপ নেই। কোন ভাবনাটি কোন চরিত্রের সেটির আর হিসেব থাকে না। অনর্গল ভাবনার ফেনায় যুবক মাস্টারের চরিত্রটি পর্যন্ত শেষে দাঁড়াতে পারে না। আর ওয়ালীউল্লাহর শেষ উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো-ও ঐ একই দোষে দুষ্ট।
লেখক: অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম, বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
1 Comments
numan
নামাজ শেষ করে মজিদ কোন দিকে যায়???