সংস্কৃত ‘নীতিশতকে’ লাভ কী? দুঃখ কী? ক্ষতি কী? বীর কে? প্রিয়তমা কে? ধন কী? এমন সব প্রশ্নের ছোট ছোট উত্তর আছে। তার ভেতরে একটি প্রশ্ন আছে – সুখ কী? উত্তরে বলা আছে, বিদেশে গমন না করা। সুখ কী – এর অনেক উত্তরই তো হতে পারত, কিন্তু তার বদলে বিদেশে গমন না করার কথা বলাটা আমাদের একালে মনে হতে পারে একেবারেই বেখাপ্পা। মনে হতে পারে সেকালের বাস্তবতায় বিদেশে গমন মানেই অবিরাম বিপদের মধ্যে পড়া, জীবনের আরাম, স্বস্তি, সুখ সব হারানো। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সে নিম্নবিত্ত, কী মধ্যবিত্ত, কী উচ্চ-মধ্যবিত্ত – যেই হোক না কেন, অনেকের কাছে বিদেশ তথা পরবাসই হলো এ দেশের বিচিত্র যন্ত্রণা ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির প্রধানতম বিকল্প। উচ্চবিত্তদের প্রায় বেশির ভাগ উন্নত বিশ্বের নানা দেশকে তাঁদের ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়েছেন। কারো একাধিক দেশে বাড়ি, স্থাপনা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। বাংলাদেশের যে বিপুল পরিমাণ মানুষ এখন প্রবাসে জীবনযাপন করছে, কারো কারো মতে, এই সংখ্যা প্রায় কোটির কাছাকাছি। ফলে ধরেই নেওয়া যেতে পারে, আগে পশ্চিমারা এশিয়া, আফ্রিকায় উপনিবেশ তৈরি করছিল, এখন তৈরি হচ্ছে পাল্টা উপনিবেশ। কিন্তু বড় পার্থক্য হলো, পশ্চিমারা সেই উপনিবেশে বাস করেছিল প্রভুর মতো, আর এরা বাস করছে এমন এক মানুষের মতো, যাদের অস্তিত্ব দ্বিখণ্ডিত, তা যে ভৃত্য তা-ও না। কিন্তু আর যা-ই হোক, তার সেখানে ‘ডমিনেন্ট’ কেউ নয়। সেই দ্বিখণ্ডিত অস্তিত্বের ক্ষয় ও ক্ষরণের বিচিত্র বীক্ষণ সালমা বাণীর ‘ইমিগ্রেশন’।
সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসী জীবন নিয়ে এমন বিপুল বিশাল উপন্যাস আর কেউ লিখেছেন কি না আমাদের জানা নেই, তাও যার পটভূমিতে আছে কানাডা, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ এখনো অভিবাসী হওয়ার স্বপ্ন দেখে চলেছে। এক সময় বাঙালির কাছে প্রবাস বলতে প্রধানতম পছন্দ ছিল আমেরিকা, বর্তমানে সেখানে যোগ হয়েছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ। তবে অস্ট্রেলিয়ার চেয়েও বোধ করি কানাডাই এখন পছন্দের তালিকায় এগিয়ে। ভালো থাকার, ভালো পরার, ভালো খাওয়ার ও ভোগের ভাগীদার হওয়ার মতো দেশও কানাডা। সেই কানাডায় গড়ে ওঠে ‘ইমিগ্রেশনে’র কাহিনী।
গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে কবির নামের এক তরুণের কানাডা যাওয়া দিয়ে এই উপন্যাসের শুরু। বোধ করি এই ‘গলাকাটা পাসপোর্ট’-টাই প্রতীকী হয়ে উঠেছে পুরো উপন্যাসে। কারণ আমরা পুরনো কথাটাই নতুন করে জানি যে বিদেশ কখনো নিজের দেশ হয় না, বিদেশ পরবাসী কাউকে গ্রহণ করে না, বরং গ্রাস করতে চায়। তাই তা ইমিগ্রেশন হয়ে ওঠে এক অদ্ভুত আগ্রাসনের নাম, এমন এক গিলোটিন- যেখানে অভিবাসী হতে চাওয়া মানুষ নিজের ইচ্ছায় গলা পেতে দেয়, আর তা তার অস্তিত্বকে চিরদিনের মতো দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। তার মন পড়ে থাকে স্বদেশে ফেলে আসা স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজনের জন্য, আর তার দেহ পড়ে থাকে বিদেশে। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, অন্যের শরীরে নিজের মাথা বসিয়ে যে যাত্রায় শামিল হয় কবিরের মতো মানুষ, সেখানে কাগজ-কলমে মাথাটা যায়, দেহ নয়। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক এর উল্টো। দেহটা থাকে বিদেশে, মাথাটা নয়। বিদেশে যাওয়ার এই উল্টো-পুরাণই হয়ে উঠেছে ইমিগ্রেশনের কাহিনীমালা। হ্যাঁ, কাহিনীমালাই বলতে হচ্ছে, কারণ প্রায় ২০০টি পরিচ্ছেদ দুটো খণ্ডে ভাগ করে নির্মিত হয়েছে প্রায় ৬৫০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস। প্রতিটি পরিচ্ছেদের আছে আলাদা আলাদা শিরোনাম, যেমন প্রথম খণ্ড থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক – ‘নাইন পেজ’, ‘মন্ট্রিয়াল যাত্রা’, ‘ময়ূরী নাচে’, ‘চুন্নু চৌধুরী যৌনতত্ত্ব’, ‘লাশ’, ‘হাহাকার’, ‘দেশে কথা বলার আনন্দ’, ‘গন্ধহীন গোলাপ’, ‘বই’, ‘সম্মোহন’, ‘অ্যানাল সেক্স’, ‘রিয়ামণি গালে চড়’, ‘ফিরে যাওয়া’; তেমনি দ্বিতীয় খণ্ড থেকে দেওয়া যেতে পারে- ‘মন্ট্রিয়াল থেকে টরন্টো’, ‘জুয়া খেলতে নায়াগ্রায়’, ‘ক্যাসিনোর আরো রহস্য’, ‘সারপ্রাইজ পার্টি’, ‘দোয়েলকে নিয়ে ফ্যান্টাসি’, ‘বিউটি ব্রেসিয়ার’, ‘ইমিগ্রেশন সাকস’, ‘গ্যারি ও ক্লাউডিয়া’, ‘ভাষাহীন বন্ধুত্ব’, ‘নিখোঁজ’। এই উপন্যাসে মূল চরিত্রদের মধ্যে কবির, দিলদার, রবি, চুন্নু চৌধুরী, মিলি, ফাজ্জুর মতো চরিত্র দেশান্তরের বিচিত্র পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যে বিদেশ হওয়ার কথা সুখ ও স্বপ্নের, সেখানে উপন্যাসজুড়ে মেখে আছে এ অমোচনীয় বিষণ্নতা। চরিত্রগুলো অবিরাম সুখের পেছনে ছুটছে বলেও মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে টিকে থাকাটাই যেন তাদের মোক্ষম কাজ হয়ে আছে। চরিত্রগুলোর বেদনার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকেরও অস্বস্তি তৈরি হবে, যখন তিনি ‘অ্যানাল সেক্স’-এর মতো পরিচ্ছেদ পড়বেন, কতটা নিরুপায় মূঢ়তায় মানুষ নিজেকে নামাতে পারে, এর একটা নমুনা এই পরিচ্ছেদ। এটা বিশেষ করে বলতে হয়, কারণ কানাডার অভিবাসীদের বিচিত্র দিকের কথা ও কাহিনী তুলে আনতে সালমা বাণী কোনো রকম ‘কনভেনশন’ মানেননি, কী লেখা যাবে, আর কী লেখা যাবে না- সেসব গণ্য করেননি। একটা প্রবল-প্রচণ্ড তাড়নায় অভিবাসী মানুষরা কী করে সে দেশে ক্রমশ ক্ষয়ে যায়, সামান্য কিছু কাগজপত্রের জন্য ভেতরে ভেতরে কতটা রক্তাক্ত হয় প্রতিদিন- সেসব বাস্তবতা একেবারে ভেতর থেকে দেখানোর প্রয়াস নিয়েছেন তিনি। আর সঙ্গে প্রতি পদে আছে বাঙালির স্বভাব-চরিত্রের হাস্যকর সব দিক, যা বিদেশে গিয়ে ভিন্ন এক মাত্রা পেয়ে যায়। কেউ আত্মপ্রতিষ্ঠায়, কেউ ভাগ্য ফেরাতে, কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য, কেউ ভোগে-কামে কত রকমে সেখানে দিন কাটায়- সেসব খণ্ড খণ্ড করে হাজির হয়েছে এতে, তৈরি হয়েছে অখণ্ড এক বাস্তবতা, যার শেষ কথা প্রবাসে গিয়ে এ দেশের মানুষ আসলে নিজেকেই হারিয়ে ফেলে, সে হয়ে ওঠে নোবডি বা না-মানুষ। তাই বোধ হয় এর শেষ পরিচ্ছেদের নামও হয়েছে ‘নিখোঁজ’। তার পরও বলতে হয়, বাঙালির অদম্য মনটারও যে এখানে দেখা মেলেনি, তা তো নয়। কারণ ইমিগ্রেশন মানেই জন্মের ভেতরেই ঘটে যাওয়া জন্মান্তর, এক জীবনে দুই জীবন যাপন করা। আর সেখানে ভেতরে-বাইরে লড়াই ছাড়া আর কোনো কিছুই সত্য হতে পারে না। সালমা বাণীর ‘ইমিগ্রেশন’ সেই লড়াইয়েরও বৃত্তান্ত।