সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ উপন্যাস’ গ্রন্থের ভূমিকায় ‘খেলারাম খেলে যা’-কে ‘এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস’ হিসেবে অভিহিত করে লিখেছিলেন –
‘রচনার প্রায় কুড়ি বছর পরও এর জন্যে আমাকে আমার অন্যান্য রচনার চেয়ে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়।… আমি খুব কম পাঠককে জানি, যিনি উপন্যাসের একেবারে শেষ বাক্যটি লক্ষ্য করেছেন। আমার বিশ্বাস, এই শেষ বাক্যটিতে দাঁড়িয়ে কেউ এ উপন্যাসের জন্যে আমাকে তিরস্কার করতে পারবেন না।’
এখনও তিনি এ উপন্যাসের জন্য তিরস্কৃত হন কী না জানি না, কিন্তু এই মন্তব্যের পরও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি ঘটেছে বলে মনে হয় না। আমাদের পাঠ-কৈশোর কালে অনেকের কাছে এ উপন্যাসটিকে ‘অশ্লীল’ ‘পর্ণোগ্রাফি’ ইত্যাদি বিশেষণে অভিহিত হতে শুনেছি। যারা এগুলো বলতেন, এখনও তারা একই মত পোষণ করেন এবং তিরস্কারের জন্য প্রস্তুত হয়েই থাকেন। আজকের পাঠক হয়তো বিতর্কের জন্য আরো অনেক বিষয়বস্তু পেয়ে গিয়েছেন বলে কিংবা নানা কারণে তিরস্কৃত হওয়ার মতো আরো অনেক লেখক সাহিত্যজগতে এসে পড়েছেন বলে সৈয়দ হক খানিকটা রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর কথিত ‘শেষ বাক্য’টিও ‘খেলারাম খেলে যা’ সম্বন্ধে এসব পাঠকের মনোভাব বিশেষ পরিবর্তন করতে পারেনি। কী আছে ওই শেষ বাক্যে? সে প্রসঙ্গে না হয় একটু পরেই আসি, আপাতত বরং ভেবে দেখা যেতে পারে – একটি রচনার জন্য কতোটা বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হলে সৈয়দ হকের মতো নিজের লেখা সম্বন্ধে এমন নিশ্চুপ-নির্মোহ লেখকও ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন! এ পরিপ্রেক্ষিতে কি আমরা ‘খেলারাম খেলে যা’-কে আরেকবার, নতুনভাবে, বিবেচনা করে দেখতে দেখতে পারি না?
২
অবশ্য সৈয়দ হক যেভাবে উপন্যাসটির শেষ বাক্যের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, আমার কাছে সেটিকে খুব একটা কার্যকরী পদ্ধতি বলে মনে হয়নি। বরং একজন মনষ্ক পাঠক, যিনি প্রকৃত অর্থেই উপন্যাসটির গভীরে প্রবেশ করতে চান, একটু সমস্যায়-ই পড়ে যাবেন শেষ বাক্যটি নিয়ে। তার দৃষ্টি ওই এক দিকেই নিবদ্ধ হয়ে গেলে মুশকিল, উপন্যাসের মূলসুরটি তার কাছে অধরাই রয়ে যাবে। আমার তো মনে হয় – উপন্যাসটি বোঝার জন্য শেষ বাক্য পর্যন্ত যাওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না, তার আগেই এর প্রধান চরিত্র বাবর আলী স্পষ্টভাবে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। কীভাবে? আমরা না হয় উপন্যাসের শুরু থেকেই বিবেচনা করে দেখতে পারি।
শুরুতেই ‘নায়ক’ বাবর আলীকে আমরা দেখতে পাই একটি জেলা শহরে। সেখানে তার উপস্থিতির উদ্দেশ্য ‘লতিফা’ নামের এক কলেজ পড়ুয়া কৈশোরোত্তীর্ণ সদ্য তরুণীর সঙ্গে দেখা করা, যার সঙ্গে বাবরের শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। লতিফার বাড়িতে নিজের উপস্থিতির কারণটি ঢাকার জন্য মিথ্যের ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে, সারা বেলা ভালো মানুষের মুখোশ পরে রাতে লতিফার সঙ্গে সঙ্গমের ব্যর্থ চেষ্টা করে মুহূর্তেই পাঠকের কাছে সে তার কামুক, লম্পট, মিথ্যেবাদী ভাবমূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে।
পরদিন ঢাকায় নিজের দরজায় দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতে ফোন এবং একটি নারী কণ্ঠ – মিসেস নফিস। কিন্তু ‘মিসেস’দের ব্যাপারে তার বিশেষ আগ্রহ নেই! অতএব অচিরেই নতুন আরেকটি চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে – বাবলী। বাবর এবার বাবলীকে শয্যাগত করতে চেষ্টারত – যেন এ-ই তার একমাত্র কাজ। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সে লতিফার কাছ থেকে ফিরেছে, বাবলীর প্রতি তার আচরণ দেখে কে মনে করবে? পাঠক দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে, তারা এক অভিনব লম্পটের দেখা পেয়েছেন!
৩
উপন্যাসের চতুর্থ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত বাবর আলী নিজেকে এভাবেই উপস্থাপন করে পাঠকের কাছে। পঞ্চম পরিচ্ছেদে এসে প্রথমবারের মধ্যে উপন্যাসটির বাঁক পরিবর্তন ঘটে। আমরা দেখতে পাই হঠাৎই বাবর খানিকটা নিঃসঙ্গ বোধ করছে আর শৈশব-কৈশোর এসে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে তার মনের দরজায়। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হতে-হতে সে পার পেয়ে যায় হঠাৎ একটি বাক্য মনে পড়ে গেলে। একবার –
‘এয়ারপোর্টের বাথরুমে দেখে কে লিখে রেখেছে লাল পেন্সিল দিয়ে বড় বড় হরফে – খেলারাম খেলে যা।… বাক্যটি আজ পর্যন্ত ভুলতে পারেনি বাবর। যে লিখেছে জগৎ সে চেনে। যে লিখেছে সে নিজে প্রতারিত। পৃথিবী সম্পর্কে তার একটি মাত্র মন্তব্য বাথরুমের দেয়ালে সে উৎকীর্ণ করে রেখেছে – খেলারাম খেলে যা।’
উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ ধরে এগিয়ে গেলে আমরা দেখতে পাবো – এই একটি বাক্যই বাবরকে পরিচালিত করেছে তার পরবর্তী জীবন জুড়ে। তবে কি এটাই বাবরের জীবন-দর্শন? বাবর কি প্রতারিত? কীভাবে, কার কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছে সে? প্রথমবারের মতো বাবর সম্বন্ধে এরকম ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগ ঘটে আমাদের। চতুর্থ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত বোঝা যায়নি – লাম্পট্য ছাড়াও অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে তার। কিন্তু এই বাক্যের পরই উপন্যাস বাঁক নিতে থাকে, বাবরের চরিত্র স্পষ্ট হতে থাকে। আমরা লক্ষ না করে পারি না – ‘যে লিখেছে সে জগৎ চেনে’ – এভাবে না লিখে – ‘যে লিখেছে জগৎ সে চেনে’ – এভাবে লিখে, অর্থাৎ ‘সে’-এর অবস্থান পরিবর্তন ঘটিয়ে, বাক্যের ঢঙ পাল্টে দিয়ে লেখক এক জগৎ-চেনা মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর পাঠকদের। লোকটার নাম – বাবর আলী!
৪
এরপর উপন্যাস এগিয়ে যায় আগের মতোই বাবরের লাম্পট্যের খোলামেলা বিবরণসহ, তবে ‘খেলারাম খেলে যা’ বাক্যটিতে সঙ্গে নিয়ে। বাবরের চরিত্র একটু-একটু করে উন্মোচিত হতে থাকে। তবে এ উন্মোচন অন্যমনস্ক পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে, মনে হতে পারে সঙ্গমের জন্য সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ তরুণীদের পটানোর জন্যই তার জন্ম হয়েছে, তার সমস্ত কার্যকলাপ ঐ একটি উদ্দেশ্যেই ব্যয় হচ্ছে। দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে এসব বাক্যও –
‘ঝুঁকির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার প্রবল একটা আকর্ষণ চিরকাল অনুভব করেছে বাবর। বিপদ তার স্বাভাবিক পরিবেশ। উদ্বেগ তার পরিচ্ছেদ। এই দুয়ের বিহনে সে অস্বস্তি বোধ করে, মনে হয় বিশ্বসংসার থেকে সে বিযুক্ত। তাই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, স্বাভাবিকতার প্রয়োজনে, সে অবিরাম সৃষ্টি করে বিপদ আর ঝুঁকি।’
[… অথবা…]
তার কেবলই মনে হয় কেউ যেন তাকে খুঁজছে। বাসা থেকে বেরুলেই মনে হয় কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। তখন বাসায় ফেরবার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে। আবার বাসায় ফিরলে মনে হয় বাইরে, শহরে, কী যেন হয়ে যাচ্ছে যা সে জানতে পারছে না।’
বোঝাই যাচ্ছে, সর্বদা অস্থিরতায় ভোগা এক মানুষ বাবর, যে মাঝে-মাঝেই আক্রান্ত হয় একাকীত্বে। উপন্যাসে সেই প্রসঙ্গ বারবার ফিরে ফিরে আসে। ইতিমধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে – জাহেদা। অবশ্য আরো কয়েকটি চরিত্রেরও দেখা মেলে – উপন্যাসে যেমনটি হয়ে তাকে আর কী – কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বাবরের কামোদ্যত কার্যকলাপই প্রধান হয়ে ওঠে। হতরন সাহেবের বিপদের সময়, তার মেয়ের বিয়েতে – ব্যবসায়িক পার্টনারের আপত্তি উপেক্ষা করে – গয়নার সেট উপহার দিয়ে সে একটু মানবিক বোধের পরিচয় দিলেও এবং মাঝে-মাঝে দু-চারটে দার্শনিক ভাবনা তাকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলেও জাহেদাকে উত্তরবঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য তার প্রায় অসম্ভব চেষ্টা দেখে অবাক হতে হয়। সঙ্গমের জন্য তার এত তৃষ্ণা? জাহেদা যেহেতু কলেজ ছাত্রী এবং হোস্টেলে থাকে, ওখানকার কড়া নিয়মবদ্ধতা থেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য বাবর চট্টগ্রাম উড়ে গিয়ে একটি বানোয়াট টেলিগ্রাম পাঠায়। বিস্মিত হতে হয় – শুধু সঙ্গমের জন্য এতকিছু? সে তো বাবর সহজেই করতে পারে। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার সুবাদে সে সর্বত্রই পরিচিত মুখ, তারকাই বলা যায়। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গী, মনোহর কথামালা, দুর্দান্ত স্মার্টনেস তাকে স্বভাতই কাম্য পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। চাইলেই সে বহু নারীকে শয্যায় নিতে পারে, মিসেস নফিস যাদের একজন। কিন্তু তার চাই কেবল সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণী, অন্য কোনো কিছুতে তার রুচি নেই। তাকে যেন ঠিক চেনা যায় না, জগৎ যে চেনে, যার নিজস্ব কিছু দার্শনিক চিন্তা মাঝে-মাঝে চমকে দিয়ে যাচ্ছে পাঠককে, তার এসব কীর্তিকলাপের অর্থ কী?
‘আমাকে কে কতটুকু জানে, বাবর ভাবল এবং হাসল। বাবর কি সেই জন্যেই এমন একেকটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় যাতে আরো অচেনা হয়ে যায় অপরের কাছে? এতে সে মজা পায়। মনে মনে হাসার সুযোগ হয় আরো। নিজেকে এক নির্বোধ পৃথিবীতে চতুর কোনো যাদুকর বলে মনে হয় তার।… আমি জীবনের যাদুকর এক নির্বোধ পৃথিবীতে।… তার কবরের ওপর লিখে দিলে হয়। বাবর যেন চোখেই এখন দেখতে পেল তার কবর, তার মাথার মার্বেলে লেখা ঐ পরিচিতি, ঐ ঘোষণা, ঐ শব্দসমূহের অন্তরালে প্রবহমান অট্টহাসি।’
না, বাবরকে ঠিক চেনা যায় না, ক্রমশই সে অপরিচিত হয়ে ওঠে আমাদের কাছে।
৫
বাবর আলীকে পুরোপুরি আচেনা লাগে দশম পরিচ্ছেদে এসে, যেখানে উপন্যাসটিও এক মারাত্মক বাঁক পরিবর্তন করে। এতক্ষণ পর্যন্ত বাবরের লাম্পট্য অবদমিত পাঠককে যে আনন্দে ও বিস্ময়ে রেখেছিলো, হঠাৎই যেন তা দপ করে নিভে যায়। আমরা দেখি, বাবর আলী চট্টগ্রামে দুপুরে ঘুমিয়ে তার বাবাকে স্বপ্ন দেখেছে আর রাতে ফেরার পথে বিমানে বসে রাতের ঢাকাকে ‘ছেলেবেলার জোনাক জ্বলা বনের মত’ লাগছে। ‘জোনাক জ্বলা বন’ আর ‘কাজলা দিদি’ যেন বাঙালির শৈশব-কৈশোরের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বুঝতে পারি, কৈশোর এসে হানা দেবে বাবরের স্মৃতিতে আর সে নিঃসঙ্গ বোধ করবে, একা হয়ে যাবে নিজের কাছে। দেখি, বাবরের ‘কেন যেন মন খারাপ লাগছে খুব’, বেড়ালের ডাক শুনে ছেলেবেলার ভয়ের কথা মনে পড়ছে, মাকে মনে পড়ছে, বাবাকে মনে পড়ছে, মায়ের মৃত্যুর দিনটি এসে তাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলছে আর – ‘ চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল তার।’ চমকে উঠতে হয়! এমন একটি চরিত্রের – কামুক, বিকৃত, লম্পট – ভেতরেও যে থাকে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস, একান্ত মুহূর্তে তারও চোখ ভিজে ওঠে – উপন্যাসের ঘটনাক্রমে এর আগে তা বোঝা যায়নি।
এখানে এসেই পাঠকের দেখা হয় এই উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হাসনুর সঙ্গে, নেপথ্যে থেকেও যে আগাগোড়া নিয়ন্ত্রণ করেছে বাবরকে – এক অর্থে পুরো উপন্যাসটিকেই। কৈশোরে, ওপার বাংলায়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক ভীতিকর-জটিল সময়ে এক আকস্মিক বিপদের মুখে পড়ে নিজের বোন হাসনুকে সাম্প্রদায়িক পশুদের হাতে ফেলে পালিয়ে এসেছিল বাবর। কিন্তু সত্যিই কি পালাতে পেরেছিল সে? আজও হাসনু তার ‘পোকায় খাওয়া দাঁত’ নিয়ে, সরল কিশোরী সেজে হাজির হয় বাবরের কাছে আর সে এলেমেলো হয়ে যায়, ভেঙেচুরে ফেলে নিজেকেই। স্বাভাবিক থাকতে পারে না বাবর, প্রায় উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকে – হাসনু উপস্থিত হলে। কেন পালিয়েছিল বাবর? এ নিয়ে তার ভেতরের গভীর দ্বন্দ্ব ও ক্ষরণটিকে সে নিজে কোন চোখে দ্যাখে? –
‘কোনটা স্বাভাবিক? পালিয়ে আসা? না, লড়াই করা? গল্পে উপন্যাসে মানুষের আদর্শে রুখে দাঁড়ানোটাই চিরকাল নন্দিত। সিনেমা হলে তালি পড়ে। বই পড়তে পড়তে প্রশংসায় পাঠকের মুখ লাল হয়ে ওঠে। কিন্তু সে নিজে, নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। আমি কি ঘৃণিত বলে চিহ্নিত হবো? নাকি আদর্শটাই ভুল?’
হ্যাঁ, বাবরের নিজের কাছেই প্রশ্ন আছে, ক্ষরণ আছে, দ্বন্দ্ব আছে। যদিও উপন্যাসের দু-একটি জায়গায় সে বলেছে যে, অনুতাপ তার স্বভাব বিরুদ্ধ, তার মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই – কিন্তু কথাটি সত্যি বলে মনে হয় না। ‘আমার মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই’ – কথাটি বলার অর্থই হচ্ছে – এ নিয়ে আমার মধ্যে প্রশ্ন-দ্বন্দ্ব-ক্ষরণ আছে, নইলে আর ফলাও করে অনুতাপহীনতার কথা বলতাম না। এ হচ্ছে নিজেকে আড়াল করার একটা পদ্ধতি মাত্র। বাবর চরিত্রটি এখানে এসেই দ্বন্দ্ববহুল-বহুমাত্রিকতার পরিচয় দেয়, তার অর্ন্তগত এই রক্তক্ষরণ আর দ্বন্দ্বটি খেয়াল না করলে পুরো উপন্যাসটির কোনো মূল্যই থাকবে না। এবং সেটিই এই উপন্যাসের ভাগ্যে জুটেছে। যেসব পাঠক এ উপন্যাস সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন তারা সম্ভবত বাবরের চরিত্রটিকে একমাত্রিক হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন – সে লম্পট, কামুক, বিকৃত। তার মধ্যে খুব গভীর কিছু কষ্ট আছে, চোখ-ভিজে ওঠা কিছু বেদনা আছে, দ্বন্দ্ব আর ক্ষরণ আছে, অন্যমনষ্ক পাঠক তা খেয়ালই করেননি।
শুধু বোনকে পশুদের কাছে ফেলে রেখে পলায়ন-ই কি তার বেদনার একমাত্র কারণ? না, তা-ও নয়। সে নিঃসঙ্গ। যে অনিবার্য, পরিত্রাণহীন অন্তর্গত নিঃসঙ্গতায় প্রতিটি মানুষ যাপন করে তার দুর্বহ জীবন, বাবরের নিঃসঙ্গতা তারচেয়ে খানিকটা অধিক। দেশভাগ তাকে টেনে এনেছে এখানে। এ দেশ তার নয়। এ মাটির জন্য জন্মগত কোনো টান নেই তার, এবং সঙ্গত কারণেই সে এখানকার কোনোকিছুর সঙ্গে সংলগ্ন বোধ করে না। তার যা কিছু মমতা বর্ধমানের জন্য, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি যেখানে ফেলে এসেছে সে। এমনকি ঘরের কোণে লেবু গাছটার জন্যও তার গভীর প্রেম। সে স্বজনহীন। মা-বাবা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে অন্তর্হিত, বোন অপহৃত ও নিহত, যার জন্য বাবরের ভেতরে আছে গভীর গ্লানি ও কান্না। তার স্মৃতি বলতে আছে এই একটি মাত্র ঘটনা, যা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়!
‘এখন আরো একা লাগল বাবরের। রক্তের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক তাদের কথা মনে পড়তেই এই বোধ বিরাট হয়ে উঠেছে – এখন তার চারপাশে এদেশে কেউ নেই। আপন কাকে বলে সে ভুলে গেছে বলেই যারা আপন তারা তাকে এমন একা করে যাচ্ছে।…। আমার কেউ নেই। কেউ নেই। কোনো কিছু আমার নয়। না মাটি, না মন, না মানুষ।’
কোনো কিছুই তার নয় – এ দেশ তার জন্মভূমি নয়, এখানকার মানুষগুলোকে সে চেনে না। তার কেউ নেই। এখানে তার কোনো আশ্রয় নেই, ভালোবাসার মানুষ নেই, প্রেম নেই, মমতা নেই, ঘরে প্রতীক্ষিত মুখ নেই। তার বর্তমান নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত, অতীতকে ঘিরে আছে এক দুঃসহ স্মৃতি – সুখময় স্মৃতিগুলো তাই মৃত; আর আছে ছোট্ট বোনটির আর্তচিৎকার। এমন ‘নেই’ মানুষ, এমন শেকড়হীন মানুষ তো কোথাও শেকড় গেড়ে বসবার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে। সে কেবল ভেসে বেড়াতে পারে অবিরাম, অন্তহীন। বাবরও ভাসমান, যেহেতু সে শেকড়হীন – ‘লাইক আ ফ্লেক অফ ডাস্ট দ্যাট নেভার রেস্টস অন এনিথিঙ অ্যান্ড ফ্লোটস থ্রু টাইম ওনলি!’
অতঃপর আমরা কি এখন থেকে বাবর আলীকে একটু ভিন্নভাবে বিচার করবো? উপন্যাসটি যে স্রেফ ‘পর্ণোগ্রাফি’ নয় সেটি বোঝার জন্য বাবরের এই ভিন্নমাত্রিক রূপটি বিবেচনা করার কোনো বিকল্প নেই। সেটি করার জন্য আমাদের দরকার হবে আরেকটু মনোযোগী পাঠ। সেক্ষেত্রে এই পরিচ্ছেদেই আমরা দেখতে পাবো, হাসনুকে পশুদের কাছে রেখে পালিয়ে আসার দুঃসহ স্মৃতি-বেদনা-অপরাধবোধের ভার সইতে না পেরে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু মুক্তি মিলছে না তাতেও। বারবার হাসনু তার পোকায় খাওয়া দাঁত নিয়ে হাজির হচ্ছে তার সামনে, আর সে কেবলই তাড়াতে চাইছে তাকে – যা হাসনু, যা! ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে এসেছে মিসেস নফিসের কাছে। কেন?
বোধহয় মনে মনে সে এমন কাউকে খুঁজছিল যা সঙ্গে বিরোধ পদে পদে। যাকে দেখলেই নখগুলো শানিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। যদি কোণঠাসা করে প্রতিশোধ নেবার প্রবৃত্তিটা শান্ত করা যায়। কিন্তু প্রতিশোধ কেন? কার ওপর?
কার ওপর? এ প্রশ্ন পাঠকেরও। কার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায় বাবর? উপন্যাসটি আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক নয়; হলে, আমরা বলতে পারতাম – সে প্রতিশোধ নিতে চায় তাদের ওপর যারা তাকে শেকড়-ছাড়া হতে বাধ্য করেছে, যারা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে একটি দেশকে ভেঙে দু-টুকরো করেছে, আর সে তার বোনকে হারিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঘটনা সেটিই। বাবরের প্রতিশোধস্পৃহা আসলে তাদের প্রতিই। আর এখানে এসেই যেন আপাত-অরাজনৈতিক উপন্যাসটিও হয়ে ওঠে ভীষণভাবে রাজনৈতিক। কিন্তু ইঙ্গিতটা এতটাই প্রচ্ছন্নভাবে দেয়া হয়েছে যে, বোঝাই কঠিন – এই জটিল ঘটনাপ্রবাহ সম্বন্ধে লেখকের রাজনৈতিক ভাষ্যটা কি!। এ-ও সত্য যে, একজন লম্পট, কামুক, বিকৃত মানুষের যৌনতাড়িত আচরণের বিপুল বর্ণনায় যে উপন্যাস এগিয়ে চলছিল, কখনো মনে হয়নি – একে রাজনৈতিকভাবে দেখবার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু হয়ে তো পড়লো! কোনোকিছুই তো আসলে রাজনীতির বাইরে নয়। একান্ত ব্যক্তিগত যে জীবন, প্রতিমুহূর্তে সেখানেও ঢুকে পড়ছে রাষ্ট্র ও রাজনীতি। ভয়াল এই রাজনীতি, যা দেশকে ভেঙে ফেলে; একটি জাতিকে বিভক্ত করে ফেলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায়। যাহোক, এখনই আমরা কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং অপেক্ষা করতে পারি। এবং মনোযোগ দিয়ে, বাবরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় না করিয়ে, খুব মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার দ্বন্দ্ব-বিক্ষুদ্ধ অর্ন্তলোকটি বিবেচনা করে উপন্যাসের পরবর্তী অংশটুকু পাঠ করে যেতে পারি।
৬
প্রিয় পাঠক, এবার আমি উপন্যাসের পরবর্তী অংশটুকু থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি দেবো। যদিও উদ্ধৃতি-সর্বস্বতা খুব একটা ভালো লাগার বিষয় নয়, তবু বাবরকে বোঝার জন্য এগুলো সাহায্য করবে। আমরা দেখবো, বাবর জাহেদাকে নিয়ে বেরিয়েছে উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে, যেতে যেতে বলছে নানারকম কথা, আর সেইসব কথার ভেতরে রয়েছে এমনই এক রাগি মানুষের ছবি যে সমস্ত প্রচলিত নৈতিকতা, মূল্যবোধ আর সংস্কারকে ভেঙে ফেলতে চায়। একসময় উত্তরবঙ্গে পৌঁছে যায় তারা, প্রথম রাতে সঙ্গম করতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত বাধা পায় বাবর, দ্বিতীয় রাতে অবশ্য সেই বাধা আর থাকে না এবং অবশেষে জাহেদা-সুধা পান করে ফেরার পথ ধরে সে। কীভাবে সে জাহেদাকে পটিয়ে ফেললো, সে-ও এক অসাধারণ বর্ণনা, কিন্তু আমরা ওগুলো নিয়ে কথা না বলে অন্যত্র মনোযোগ দিতে চাই। যে বাবর জগৎ চেনে, ‘খেলারাম খেলে যা’ দর্শনটি আর কৈশোরের দুঃসহ স্মৃতি যার নিত্যসঙ্গী, সেই বাবর জীবন ও পৃথিবীকে, আমাদের দৈনন্দিন সংস্কার, বিশ্বাস আর রীতিনীতিকে কী চোখে দেখে সে বিষয়ে কয়েকটি উদ্ধৃতি –
‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি’ – জাহেদাকে এই বাক্য বলার পর –
‘বিশ্বাস না কচু। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল বাবরের। দু’পয়সার দাম দিই না। আমি যা চাই তা এমনি তোমার পাজামা ছিঁড়ে ভেতরে যেতে। কি ক্লান্তিকর এই অভিনয়, এই সহাস্য মুখ তৈরি করা; এই কথার মালা গাঁথা।’
‘বিয়ে করবেন না নাকি?’ জাহেদার এ প্রশ্নের উত্তরে –
‘বাবর ভাবল যা সত্যি তা বললে ও বুঝতে পারবে না। বিয়ে সে করবে কেন? শরীরের জন্যে? সে প্রয়োজন বিয়ে না করেও মেটান যায়। বরং তাতে তৃপ্তি আরো অনেক। … বিয়ে করবে সন্তানের জন্যে? সন্তান সে চায় না। চায় না তার উত্তরাধিকার কারো উপরে গিয়ে বর্তাক। আমার জীবনের প্রসারণ আমি চাই না। মৃত্যুর পরেও আমি বেঁচে থাকতে চাই না। আমার এমন কিছু সম্পদ নেই, অর্জন নেই, উপলব্ধি নেই যা যক্ষের মতো আগলে রাখার স্পৃহা বোধ করি ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্যে। এ জীবন আমি চাইনি, অতএব কারো জীবনের কারণও আমি হতে চাই না। বিয়ে করব ভালবেসে? ভালবাসা বলে কিছু নেই। ওটা একটি পন্থা। পন্থা কখনো লক্ষ্য হতে পারে না। নিবৃত্তি নেই তাতে। ভালবাসা একটা অভিনয়ের নাম।’
জাহেদাকে বলা বাবরের কয়েকটি কথা –
‘মানুষের যত আবেগ আছে, যত অনুভূতি আছে, যত রকম প্রতিক্রিয়া আছে তার, আমি বলি, মূলতঃ তা দুটো ভাগে ভাগ করা যায়।… একটা হচ্ছে তার রক্তমাংসের অনুভূতি, জান্তব অনুভূতি, তার মৌলিক অনুভূতি, আবেগ। আর একটা তার অর্জিত অনুভূতি যা সে শিক্ষা দীক্ষা চিন্তাভাবনা সভ্যতার ফলে অর্জন করেছে। একটা ভেতরের, আরেকটা বাইরের।… মনে কর আমার কারো ওপর খুব রাগ হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি সে আমার শত্রু। তখন আমার মৌলিক আবেগ হবে তাকে হত্যা করা।… কিন্তু আমরা হত্যা করি না, সাধারণত করি না। আদিমকালে… যখন ইতিহাস ছিল না, ভাষা ছিল না, তখন আমরা ক্রুদ্ধ হলে হত্যা করতাম। এখন যে করি না তার কারণ আমরা আইন করে নিয়েছি, কতগুলো নিয়ম বানিয়েছি। আর মনে রাখবে, নিয়ম-কানুন আইন এসব দুর্বল মানুষের সৃষ্টি। আমরা এখন হত্যা করি না, দয়া করি, সহানুভূতি দেখাই। দয়া হচ্ছে অর্জিত আবেগ। মানুষের রক্তে তা নেই, সভ্যতা যার নাম তারই একটা অবদান ঐ দয়া। … দৈহিক মিলন মৌলিক অনুভূতি, প্রেম অর্জিত অনুভূতি জাহেদা।’
তার দার্শনিকতা –
‘মৃত্যুকে যেভাবেই দ্যাখ জাহেদা, পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক এই মৃত্যু। যদি একটা অনড় অবিচল সত্য থেকে থাকে তো তা মৃত্যু।’
আরেকটি –
‘যা ভাল লাগে তা ধরে রাখা বোকামি। মানুষ ধরে রাখতে চায় বলেই দুঃখ পায়। আসলে সব কিছুই একটা স্রোতের মতো। সুখ, ঐশ্বর্য, জীবন, আকাশ, বিশ্ব, মহাবিশ্ব, ছায়াপথ, তারকাপুঞ্জ, সব কিছু। সমস্ত কিছু মিলে আমার কাছে প্রবল শুভ্র জ্বলন্ত এক মহাস্রোত মনে হয়। দুঃসহ কষ্ট হয় তখন। আমার জীবনে যদি একটা কোনো কষ্ট থেকে থাকে তাহলে তা এই। এই মহাস্রোতের সম্মুখে আমি অসহায় তুচ্ছ, আমার অপেক্ষা সে রাখে না। তুমি, আমি, এই শহর, মহানগর, সভ্যতা সব অর্থহীন বলে মনে হয়। আমি কি করলাম, তুমি কি করলে, ন্যায়-অন্যায় পাপ-পূণ্য, মনে হয় সবই এক, সব ঠিক আছে কারণ সবই কত ক্ষুদ্র।’
শৈশবের স্মৃতি তাড়ানোর জন্য –
কবে কোনদিন ভেবেছে বাবর। ভাববে না সে। সব ভাবনার গলা টিপে মেরেছে সে বহুকাল আগে। ভাবনা তার শত্রু। এই তো সে বেশ আছে, ভাল আছে।
জাহেদা তাকে ভালোবেসে ফেলেছে, এই সন্দেহ হওয়ায় সে ভাবে –
‘আমি কাউকে ভালবাসি না। কাউকে না। ভালবাসা বিশ্বাস করি না। এ হতে পারে না। এ আমি চাই না।… নিষ্ঠুরতা যেন আরো প্রবল হয়ে ওঠে বাবরের মনের মধ্যে। স্নেহ, দয়া, ভালবাসা! হাঃ! এ কিসের মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে চায় তাকে জাহেদা? জানে না, বাবরের জানা আছে কি করে বেরিয়ে আসতে হয়! বেরিয়ে সে আসবেই। ভালবাসার জন্য জাহেদাকে সে আনেনি।… না কিছুতেই সে প্রশ্রয় দেবে না। তার কেউ নেই। কেউ হবেও না কোনোদিন। যত জ্বালা এই মানুষে মানুষে এই অন্ধ বন্ধন থেকে। হাঃ খেলারাম। চোখে স্পষ্ট দেয়ালে সেই অপটু হাতে বড় বড় করে লেখাÑ খেলারাম খেলে যা। এই তার দর্শন, এই তার সত্য।
‘খেলারাম খেলে যা’ তাহলে বাবরেরই জীবন দর্শন! কয়েকটি মাত্র উদ্ধৃতি, প্রিয় পাঠক, তাতেই কি মনে হচ্ছে না জগৎ সে চেনে’! মনে কি হচ্ছে না জীবন সম্বন্ধে, পৃথিবী সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা খুব স্পষ্ট? এই চরিত্রকে কি আর স্রেফ কামুক, লম্পট হিসেবে ভাবা যায়?
৭
অবশেষে আমরা দেখি বাবর জাহেদাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসছে। তার কাজ শেষ, জাহেদাকে সে এবার ব্যবহৃত টয়লেট পেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্যত্র (যেমন, বাবলী বা রংপুরে দেখা শ্যামল মেয়েটি) মনোনিবেশ করতে চায়। কিন্তু জাহেদা নাছোড়বান্দা, হোস্টেলে সে ফিরবে না, বাবরের সঙ্গে তার বাড়িতে যাবে। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে, পথিমধ্যে বাবর গাড়ি থামিয়ে দিলে দুর্ঘটনাটি (বা ঘটনাটি) ঘটে। কয়েকজন লোক এসে তাদের ঘিরে ফেলে (সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে; বর্ধমানের সেই সন্ধ্যাটি যেন ফিরে এসেছে আবার – যে সন্ধ্যায় বাবর হাসনুকে হারিয়েছিল), আর –
‘জাহেদাকে ওরা নিয়ে যায় কোলের মধ্যে ছাগলের বাচ্চার মতো। সমস্ত ঘটনা ঘটে মাত্র আধ মিনিট কিংবা তার কম সময়ে। চোখের একটা পলকে মাত্র। এর জন্যে তৈরি ছিল না বাবর। কিন্তু আশ্চর্য, তার কোনো দুঃখ হচ্ছে না, রাগ হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে, এই-ই দরকার ছিল। মনে হচ্ছে, জাহেদার হাত থেকে সে এবার অতি সহজে বাঁচতে পারবে। তার হাসি পেল ভেবে যে লোকটা অহেতুক তাকে এত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাকে ছেড়ে দিলেও সে চেচাঁবে না, পাল্টা আক্রমণ করবে না। যুবক দু-চারটে ঘা লাগাল বাবরকে। বুকের ওপর ঘোড়ার মতো চড়ে আছে সে।’
প্রায় ঘৃণা উৎপাদন করার মতো মনোভঙ্গি তার। কিন্তু সেসব নিয়ে ভাবার সুযোগ পাঠকের হয় না। অচিরেই জাহেদার আর্তচিৎকার ‘বা-বা’ ভেসে এলে বাবর শুনতে পায় ‘দা-দা’ (এ যেন হাসনুর আর্তনাদ) এবং ‘কোথা থেকে দানবের মতো শক্তি এলো বাবরের।’ অবশেষে সে ছুরির আঘাত খেয়েও উদ্ধার করে জাহেদাকে। জাহেদাকে? নাকি হাসনুকে? আমরা অবাক হয়ে দেখি বাবরের যেন স্মৃতিভ্রম ঘটেছে। জাহেদাকে সে ক্রমাগত সম্বোধন করছে হাসনু বা হাসু বলে – ‘সরে যা, হাসু, পালিয়ে যায়, পালা, পালা! হাসু, তোকে আমি বাঁচাবো। ভয় নেই হাসু।’ -‘চল হাসু, চল, চল চলে আয়।’ – ‘হাসনু আয়। হাসু আয়।’ – ‘ভয় নেই হাসু, আমি এসে গেছি হাসু, আমি এসে গেছি।’ – ‘বাবর স্বপ্নাবিষ্টের মতো বলে, হাসু তোকে আমি ফিরিয়ে এনেছি। আর ভয় নেই। বাড়ি এসে গেছি।’
বাবর বস্তুত হাসনুকেই উদ্ধার করেছে। কৈশোরে বোনকে রেখে পালিয়ে আসার ফলে তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল সীমাহীন গ্লানি, অপরাধবোধ, যন্ত্রণা ও অনুতাপ; এসব ভুলে থাকার জন্য সে বেছে নিয়েছিল প্রতারণা ও লাম্পট্যের পথ, আর নিজের পরস্পবিরোধী এই দুটো চরিত্র তাকে করে তুলেছিলো দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ। কার প্রতি প্রতিশোধ নেবে বাবর তার একটি উত্তর যেন পাওয়া যাচ্ছে এবার। সে আসলে নিজের প্রতিই প্রতিশোধস্পৃহা লালন করে, নিজের সঙ্গেই নিজের নিরন্তর দ্বন্দ্ব তার, নিজের সঙ্গেই যাবতীয় বোঝাপড়া। বেদনাময়, যন্ত্রণাকাতর আর গ্লানিকর সমস্ত ঘটনার জন্য অন্য কাউকে নয়, নিজেকেই দায়ী করে এসেছে সে বরাবর, আর এসব ভুলে থাকার জন্য, জীবনের বর্ণ-গন্ধময় স্বপ্নীল আয়োজনে শরীক হবার জন্য নিজের ভেতরে তৈরি করেছে ভিন্ন আরেকটি চরিত্র – সে মাতাল, লম্পট, কামুক, প্রতারক। বাবর হয়তো পুরোপুরি ‘সুস্থ’ মানুষও নয়। কৈশোর থেকে বয়ে বেড়ানো আত্মপীড়ন, ক্ষরণ, দ্বন্দ্ব ও দহন তাকে পরিণত করেছে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক অসহায়-ভাসমান-বীতশ্রদ্ধ মানুষে। এবার আপনিই বলুন পাঠক, উপন্যাসটিকে কি আর স্রেফ একজন কামোত্তেজনায় উন্মাদ লোকের অদ্ভুত কীর্তিকলাপের রসালো বর্ণনা – বা পর্ণোগ্রাফি – বলে ভাবার কোনো অবকাশ থাকে?
৮
উপন্যাসের শেষে বাবরকে দেখা গেল জাহেদাকে উদ্ধার করে গাড়িতে এনে বসিয়েছে এবং –
‘হঠাৎ তার গাড়ি পুলের শেষ থামে ধাক্কা খেয়ে ডান দিকে ঘুরে যায় একবার। তারপর সেই নক্ষত্র প্রতিফলিত নদীতে গড়িয়ে পড়ে জাহেদাকে নিয়ে, বাবরকে নিয়ে! আরো একজন ছিল, সে হাসুন।’
এই সেই বিখ্যাত শেষ বাক্য – ‘আরো একজন ছিল, সে হাসনু।’ বাবর যাকে উদ্ধার করে এনেছে তার শরীরটিই কেবল জাহেদার, প্রকৃতপক্ষে সে হাসনু – একথা তো একটু আগেই বলা হয়েছে। সৈয়দ হকের ধারণা – এই বাক্যে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে তিরস্কার করতে পারবেন না। হ্যাঁ, পারবেন না যদি তিনি বাবরের দ্বন্দ্ব-বিক্ষুদ্ধ অন্তর্লোকটি বিবেচনায় আনেন। শেকড়হীন, স্বজনহীন, প্রেমহীন এক চোখ-ভিজে-ওঠা চরিত্রের লাম্পট্যের চেয়ে সেক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্ব পাবে তার মর্মান্তিক এক ভাসমান জীবনের হাহাকার।
উপন্যাসটি শেষ হয়েছে বাবরের মৃত্যু দিয়ে। এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, প্রশ্ন উঠতে পারে – আদৌ এর প্রয়োজন ছিল কী না! প্রশ্ন আরো অনেক কিছু নিয়েই হতে পারে – কিন্তু এ-ও মনে হয়, তার আর কী-ই বা পাওয়ার ছিল মৃত্যু ছাড়া! জীবন ও পৃথিবীর কাছে যে প্রতারিত ও বঞ্চিত, মৃত্যুকে যে একমাত্র অমোঘ সত্য জেনেছে ও মেনেছে, হাসনুকে – যে তার অনন্ত গ্লানি, অনন্ত বেদনা ও পরাজয়, একমাত্র স্নেহ ও মমতার জন্য নাম – উদ্ধার করার পর মৃত্যুই বুঝি তার একমাত্র প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়।
৯
আর এসব কিছু নিয়ে বাবর হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্য জীবন্ত চরিত্র; সবচেয়ে আধুনিক ও প্রগতিশীল, দার্শনিক ও দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ ট্র্যাজিক এক চরিত্র। আর ‘খেলারাম খেলে যা’ হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের অসামান্য এক আধুনিক উপন্যাসের নাম।
প্রথম প্রকাশ: ২৪ মে ২০০১, আজকের কাগজ সাময়িকী
1 Comments
Sanjoy Sarkar
প্রকাশকাল কত?