কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
চার.
এই জল-জঙ্গলের দেশে রোজ কত ঘটনাই তো ঘটে, মানুষ কটা মনে রাখে? নমিতার ধর্মান্তরের ঘটনাও মানুষ ভুলে যাচ্ছিল, দিন দিন কানঘুষাও কমে আসছিল। আর কটা দিন গেলে হয়ত নমিতার কথা কারো মনেই থাকত না, কেউ তার নামটা মুখেও আনত না। কিন্তু পূর্বজন্মে কী পাপ করেছিলেন মাস্টার, এক কলঙ্কের কথা মানুষের মন থেকে মুছে যাওয়ার আগে আরেক কলঙ্ক উঠল তার পরিবারে। বড় মেয়ের মতো মেজ মেয়েটাও তাকে না জানিয়ে মুসলমান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলল।
হয়ত নমিতার প্রভাব পড়েছিল দীপিকার ওপর। অজানা-অচেনা একটা মুসলমান যুবকের সঙ্গে মন দেয়া-নেয়া, দৈহিক সম্পর্ক এবং কাউকে না জানিয়ে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করার পেছনে সে হয়ত এই যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল, বড়দি যদি মুসলমান ছেলের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করতে পারে, আমি কেন পারব না?
ভাইবোনদের মধ্যে দীপিকা ছিল একটু আলাদা। স্বভাবে চঞ্চল। দুষ্টুমি আর হাসি-আমোদে সারাক্ষণ বাড়িটা মাতিয়ে রাখত। তার উছল হাসির জন্য মাঝেমধ্যে চারুবালাও বিরক্ত হতো। মেয়ে মানুষ। মরদের মতো এভাবে হাসাহাসি করলে লোকে কী বলবে। কিন্তু দীপিকা কি লোকের ধার ধারে? তার যা ইচ্ছে হয় তাই করে। ইচ্ছে হলে মুকনোলির প্রান্তরে গিয়ে গোল্লাছুট খেলবে, ইচ্ছে হলে বই-খাতা ফেলে আরেক বাড়ি গিয়ে লুডু খেলতে বসে যাবে, ডিঙি নিয়ে বনে যাবে, বড়শি দিয়ে মাছ ধরবে, গরু নিয়ে মাঠে যাবে। পারলে তো লাঙল-জোয়াল নিয়ে জমিনে হাল দিতে যায়।
মেয়ের কাণ্ড দেখে মাস্টার হাসেন, ‘বুজলে চারু, ছাইলে বানাতি গে ভগবান ভুল কইরে তারে মাইয়ে বানিয়ে ফেলাইচে।’
এই ধিঙি স্বভাবের জন্য ছোটবেলায় কম পিটুনি খায়নি মায়ের, তবুও তার স্বভাব বদলায়নি, যেই ধিঙি সেই ধিঙি। বড় হওয়ার পর তার এই চটফটে চঞ্চল ধিঙি স্বভাবটা বাবা-মায়ের প্রিয় হয়ে ওঠে। অন্য সন্তানদের চেয়ে তার প্রতি তাদের আদর-স্নেহ ছিল খানিকটা বেশি। যতই অন্যায় করুক, মা তার গায়ে আর হাত তুলত না। বাবা তো জীবনে কোনোদিন তোলেননি।
যতই চঞ্চল হোক দীপিকা, অবাধ্য যাকে বলে তা সে ছিল না। বড়দির মতো বিয়ের আগে প্রেম-ভালোবাসায় জড়াতে চায়নি। বাবা-মা যার সঙ্গে বিয়ে দেবে, হোক সে গণ্ড মূর্খ মৌলে বাউলে, তার সঙ্গেই সংসার করবে – মনে মনে এমন একটা সিদ্ধান্ত সে নিয়ে রেখেছিল।
কিন্তু মানুষ তো জেনেশুনে প্রেমে পড়ে না, প্রেম তো হঠাৎ করেই আসে। যৌবন জীবনের বসন্ত, আর প্রেম বসন্তের কোকিল। কখন ডেকে উঠবে কোকিল আগে থেকে কি বলা যায়? দীপিকা হঠাৎ করেই শুনল প্রেমকোকিলের ডাক। জোগার গোন এলো তার দেহমনে, প্রমত্ত জোয়ার তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কোকিলডাকা এক গহিন বনে। মনকাড়া মিষ্টি মধুর ডাকের পিছে ছুটতে ছুটতে সে এতটাই গহিনে চলে গেল, ফিরে আসাটা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াল। বাবার কথা, পরিবারের কথা এবং সমাজের কথা ভেবে তবু সে ফিরতে চেয়েছিল। দিদারের সঙ্গে দৈহিক মেলামেশার পরও সে চেয়েছিল সম্পর্কটা ভেঙে যাক, মণ্ডলবাড়িতে ধর্মান্তরের ঘটনা ফের না ঘটুক। পারেনি ওই একটা কারণে, নমিতা। দিদারের সঙ্গে তার সব সম্পর্ককে একটা যৌক্তিক ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয় নমিতার ধর্মান্তরের ঘটনা।
বসন্তের কোকিলের মতোই গরানপুরে আসে দিদার। গ্রামে প্রথম তাকে প্রকাশ্যে দেখা গেল খানবাড়িতে যেদিন বাঘ হানা দিল সেদিন। এক মাস ধরে সে আলাউদ্দিনের বাড়িতে লজিংমাস্টার হিসেবে আছে, অথচ গ্রামের দু-একজন মেয়েলোক ছাড়া, সারাদিন যারা এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বেড়ায়, আর কেউ তাকে দেখেনি। দেখবে কেমন করে? সে তো একদিনও বাড়ি থেকে বেরোয়নি। লজিংমাস্টার কেন খানবাড়ির পর্দানশীন মহিলাদের মতো রাতদিন আলাউদ্দিনের দলিজে অন্তরীণ থাকবে, ব্যাপারটা গ্রামবাসীর কাছে একটা রহস্য হয়ে দাঁড়াল। তুমুল কানাকানি শুরু হলো সারা গ্রামে। কে এই যুবক? কোথায় তার বাড়ি? নিঃসন্তান আলাউদ্দিন কেনই-বা লজিংমাস্টার রাখল?
লোকের মুখ বন্ধ করতে আলাউদ্দিনকে একটা জুতসই জবাব দিতে হয়, ‘এ্যাতো কানাঘুষোর কী আচে? ছাইলেপিলে পড়ানির জন্যিই কি শুদু লজিংমাস্টার রাখে মানুষ? এতিম-অসহায়রে সাহায্য করা ছোয়াবের কাজ। ছাইলেডা এতিম। বাপ নি, ঘরে সৎমা। সৎমার জ্বালা-যন্তনায় অতীষ্ঠ হুয়ে বেচারা বাড়ি ছাইড়েচে। তার ওপর সে তালেবুল এলেম। আলিম পাস কুরে টাকা-পয়সার জন্যি আর পড়ালেখা করতি পাত্তেচে না। তারে এট্টু জাগা দে কি খুব দোষ কুরে ফ্যাল্লাম?’
দিদার তালেবুল এলেম! মানুষ তো আহমক বনে যায়। মুখে দাড়ি নেই, গায়ে পাঞ্জাবি নেই, মাথায় টুপি নেই, স্কুল-কলেজের ছেলেদের মতো যে কিনা প্যান্ট-শার্ট পরে এবং তামাক-বিড়িও নাকি খায় – এ কেমন তালেবুল এলেম! গ্রামবাসীর সন্দেহটা আরো পোক্ত হয়।
সন্দেহের মেঘ ঘনাতে ঘনাতে যখন বৈশাখী পাগলা বয়ালের মতো কুচকালো হয়ে উঠল, সবাই যখন দিদারকে একটা আত্মগোপনকারী চোর-ডাকাত হিসেবে ধরে নিল, তার দুর্দান্ত সাহসিকতা তখন তাকে ঢাল হয়ে রক্ষা করল। সে যদি সেদিন দুর্ধর্ষ বাঘটার ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ত, আজিবর বাওয়ালিকে হয়ত আজরাইলের হাত থেকে বাঁচানো যেত না।
বাদার বাঘ আবাদে হানা দেয়ার ঘটনা নতুন নয়। দস্যু-ডাকাতের মতো মাঝেমধ্যে বাঘও হানা দেয়। খাল-নদী সাঁতরে লোকালয়ে হানা দিয়ে মানুষ ও গবাদি পশুর ওপর হামলা চালায়। বছর বছর বাঘের থাবায় মানুষ মরে, আবার মানুষের হামলায় বাঘও মরে। বাঘে-মানুষে এ লড়াই চিরায়ত। যতদিন বাদা থাকবে, বাদার কাছে মানুষ থাকবে, ততদিন এ লড়াই থাকবে।
সেদিন বাঘ হানা দিল খানবাড়ির গোয়ালে। শেষরাতে ভাটাপড়া চুনকুড়ি সাঁতরে খানদের কালো বলদটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেল, অথচ বাড়ির কেউ টের পেল না।
তখন মাঘের শীতভোর। জাবেদ খান ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিল। ঘাটায় এসে দেখল খড়ের গাদার আড়ালে ভোরের মিষ্টি রোদে পিঠ ঠেকিয়ে আরামসে শুয়ে আছে বড়মিয়া। চোখের সামনে খোদ আজরাইল দেখে তার তো দম আটকে যাওয়ার জোগাড়। কোন দিকে পালাবে সে? চিৎকার দিলে তো আর রক্ষা নেই, এক লাফে ছুটে এসে ঘাড়টা মটকে দেবে। আচমকা সে ঘরমুখী দৌড় লাগাল। কুয়াশাভেজা পিছল জুতো জোড়া দূরে ছিটকে পড়ল। এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগল। ‘বাঘ বাঘ’ বলে তার হুঁশিয়ারি চিৎকারে সারা বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল, দরজা-জানালা বন্ধ করে সবাই হৈচৈ শুরু করে দিল।
মুহূর্তে খবরটা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। লাঠিসোঁটা দা-বঁটি খুন্তি কুড়াল – হাতের কাছে যা পেল তা নিয়ে লোকজন ছুটে আসতে লাগল। মানুষ আসে উত্তর থেকে, মানুষ আসে দক্ষিণ থেকে, মানুষ আসে পশ্চিম থেকে। খানিকের মধ্যে শত শত মানুষ এসে খানবাড়ি ঘিরে ধরল। এত মানুষের হল্লা শুনে বড়মিয়া তার রাজসিক ভঙ্গিত শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। চোখের শ্যেনদৃষ্টি পড়ল জানালার ফাঁকে কুড়াল হাতে দাঁড়ানো জাবেদ খানের ওপর। বুঝতে পারল মরণ তার ঘাড়ের কাছে। ভুঁড়ি নাচিয়ে, গাল ফুলিয়ে হালুম শব্দে একবার হুঙ্কার ছাড়ল। তারপর একলাফে গাদার পেছনে ছোট নালাটা পেরিয়ে আজিবর বাওয়ালির বাড়িতে গিয়ে উঠল।
আজিবর তখন পায়খানায়। বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে আর চাপাশব্দে কাশি দিতে দিতে পেটটা খালি করার চেষ্টা করছে। ঘরের সামনের দরজাটা খোলা। বউ গেছে খানবাড়ির পুস্কুনি ঘাটে, ছেলেমেয়েরা মক্তবে। পায়খানার বেড়ার ফাঁকে হঠাৎ তার নজর গেল ঘরের ডবায়। বাঘটা এক দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে এক লাফে ডবায় উঠে ঘরে ঢুকে পড়ল। আজিবরের পিলে চমকে যায়, একটা বোবা স্বর বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। বিড়িটা লোটার পানিতে চুবিয়ে ধরে। ধোঁয়া দেখলে রক্তপিপাসু জানোয়ারটা যদি পায়খানায় হানা দেয় তখন নাপাক শরীর আর পাক করার ফুরসত পাবে না। লোটার পানিটা ঢালতেও তার ভয় হয়। পাছে বাঘটা শব্দ শুনতে পায়! দুর্ধর্ষ শিকারি, এক মাইল দূরের শব্দও কান এড়ায় না। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না বেচারা।
হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেল। ঘরেই যখন ঢুকে পড়েছে নরখাদকটা, জ্যান্ত আটক করতে পারলে মন্দ কি। খবর পেয়ে পিটেলবাবু তার দলবল নিয়ে এসে যদি ঠিকঠাক মতো ধরতে পারে তাহলে তো আর কথা নেই। সরকারের তরফ থেকে আজিবর কিছু টাকা পেলেও পেতে পারে। জ্যান্ত ধরতে না পারুক, মারতে তো পারবে অন্তত। লোকালয়ে বাঘ হানা দিলে তাকে না মেরে ছাড়তে নেই। একবার পালিয়ে বাঁচতে পারলে সাহস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। রাতবিরাতে আবার গ্রামে হানা দিয়ে গরু-ছাগল এমনকি মানুষের ওপর হামলা করতে ভয় পায় না।
দ্রুত লোটা খালি করে বেরিয়ে পড়ল আজিবর। হেঁশেলে ঢুকে কুড়ালটা নিয়ে মালকোচা মেরে নিঃশব্দে পা ফেলে শুঙ্কিদ্দোরের দিকে এগোতে লাগল। ভয়ে তার দু-হাঁটু থরথরিয়ে কাঁপছে। দক্ষিণরায়ের নাম জপছে মনে মনে। চোখের পলকে এক লাফে দরজার সামনে এসে একটানে কপাটটা বন্ধ করে ঝটপট শিকলটা টেনে দিল। ভয়ে বুঝি বাঘটা ভয়ংকর শব্দে গর্জে উঠল। চারদিক থেকে হৈচৈ করে উঠল লোকজন। বেচারা বাঘ পড়ল দারুণ বেকায়দায়। নিজের রাজ্য ছেড়ে অপর রাজ্যে হানা দেয়ার অপরাধে মৃত্যু বুঝি এবার অবধারিত। বাড়ির চারদিকে শত্রুরা সতর্ক পাহারায়, বাঁচার কি আর কোনো পথ আছে।
কুড়ালটা হাতে নিয়ে উঠোনের উত্তর কোণায় দাঁড়িয়ে আজিবর দোয়া-কালাম আওড়াচ্ছে। লোকজন তাকে নিয়ে রসিকতা করছে, ‘ছিঃ ছিঃ আইজবর! মামায় আর তামায় সমান। বুনপোর বাড়ি বেড়াতি আইলো মামা, কোনে তুমি যত্নখাতির করবা, তা এইসব কুত্তচো! যাও যাও, মামার খানাপিনের একটা ব্যবস্থা কর।’
‘হ, কারো পোঙ্গায় বাঁশ ঢোকে, কেউ বুসে বুসে গিরু গোনে’, খিস্তি করে আজিবর, আর লোকজন হা হা করে হাসে। জাবেদ খান বলল, ‘ঘরে যখন ঢুকে পুড়েচে পচাব্দী গাজীকে খবর দ্যাও। সে ছাড়া এই বাঘ কাবু করার সাদ্য আর কারো নি।’
গাবুরার বিখ্যাত বাঘশিকারি পচাব্দী গাজী তখন চুনকুড়ির মোহনার পাড়ে একটা ঘুমটি দোকানের মাঁচায় বসে বিড়ি ফুঁকছিল। ভোরে বুড়ো গোয়ালিনী রেঞ্জ অফিসের তিনজন লোক নিয়ে কী এক কাজে এদিকটায় এসেছিল। চুনকুড়ির মোহনায় নৌকাটা নোঙর করে ঘুমটি দোকানের মাঁচায় বসে কারো জন্য অপেক্ষা করছিল। লোকমুখে গ্রামে বাঘ ঢোকার খবর শুনে গাদা বন্দুকটা নিয়ে খানবাড়ির দিকে ছুট লাগাল।
ভয়ংকর শব্দে বাঘটা আবারও গর্জে উঠল। ঘরটা নড়ে উঠল, মাটিও বুঝি কেঁপে উঠল একবার। লোকজনের হাসাহাসি থেমে গেল। অবাক চোখে সবাই দেখল, এক ঢুঁশে বাঁশের বেড়া ঠেলে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে উঠোনে লাফিয়ে পড়ল বাঘটা। মাগো বাবাগো বলে লাঠিসোঁটা ফেলে সবাই দিল ভৌঁ দৌড়। দুর্ভাগ্য আজিবরের, দৌড়ে পালাতে গিয়েও রেহাই পেল না, প্রথম থাবাটা পড়ল তার পিঠে। হিং¯্র বাঘ তাকে ধরাশায়ী করে খাবলাতে লাগল, বিষাক্ত দাঁতের কামড় বসিয়ে দিতে লাগল সারা শরীরে। আজিবরের মরণচিৎকার গরানপুরের সীমানা ছাড়িয়ে হরিনগর পৌঁছায়, কিন্তু তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার সাহস পায় না কেউ।
ছিঁড়েখুঁড়ে তাকে মেরেই ফেলত, যদি না কুড়াল হাতে দিদার ছুটে আসত। পেছন থেকে উন্মত্ত বাঘের পেটে জোরসে এক কোপ বসিয়ে দিল সে। ডোরাকাটা চামড়া কেটে ধারালো কুড়ালটা ঢুকে গেল পেটে। আজিবরকে ছেড়ে দিয়ে দিদারকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল বাঘ, ঠিক তখনই দিদার প্রচ- বেগে তার চোয়ালে আঘাত হানল। আঘাতটা লাগল ডান চোখে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। হুঙ্কার ছেড়ে লতাপাতা মাড়িয়ে নালাটার দিকে ছুট লাগাল। পায়খানার কাছাকাছি গিয়ে একটা সোনালু গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়ল। মাথায় বুঝি চোট পেল প্রচ-, দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল আহত কুস্তিগীরের মতো। কিন্তু বাঘ তো বাঘ, অপরাজেয় শক্তি তার। মোচড় দিয়ে উঠে আবার দৌড় লাগাল। নালাটা পার হতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল আবার, কচুক্ষেতে গড়াগড়ি খেতে খেতে মরণগর্জন করতে লাগল। সেই সুযোগটাই কাজে লাগাল পচাব্দী গাজী, গাদা বন্দুকটা তাক করে দ্রুত সে ট্রিগার চাপল। খুলিতে গিয়ে বিঁধল গুলিটা। এক গুলিতেই কুপোকাত।
দিদারকে তো তখন সবাই মাথায় নিয়ে নাচে। তার দুর্দান্ত সাহসিকতার কথা নারী-পুরুষ সবার মুখে মুখে। চোর ডাকাত খোজারু বা ফেরারি আসামি বলে এতদিন যারা তার বদনাম করেছে তারাই এখন তার সুনামে পাঁচমুখ। আহা বেচারা এতিম ছেলেটা! অকারণে তার নামে বদনাম করেছে লোকে। এমন সাহসী ছেলে কটা আছে দেশে?
অল্পদিনেই গরানপুরবাসীর আপনজন হয়ে উঠল এই অচেনা যুবক। কারো ভাই, কারো ভাইপো, কারো বোনপো। আজিবরের তো ধর্মভাই। আলাউদ্দিনের অনুরোধে কেশব মাস্টার তাকে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিতেও আপত্তি করলেন না। অজানা-অচেনা মুসলমান যুবক, শুরুতে তাই খানিকটা শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু স্বভাব-চরিত্র ভালো দেখে ক’মাসের মধ্যেই শঙ্কাটা কেটে গেল। তাকে পেয়ে মাস্টারের বরং সুবিধাই হয়েছে। তার ওপর স্কুলের দায়িত্ব দিয়ে মাঝেমধ্যে তিনি রোগী দেখতে এদিক-ওদিক চলে যান। গ্রামে রোগের যেমন শেষ নেই, রোগীরও শেষ নেই। আজ এর জ্বর, কাল ওর পাতলা পায়খানা, পরশু তার আমাশয়। ডাক্তার তো একজনই। ওষুধ তিনি দেন না দেন, নাড়িতে হাত দিলেই রোগীর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়। প্রতিদিনই তার ডাক পড়ে। তার অনুপস্থিতিতে দিদার বেশ ভালোভাবেই স্কুলটা চালিয়ে নেয়। ততদিনে সে গোপেশের সঙ্গে বেশ খাতির জমিয়ে তুলেছে, তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে ভেতরবাড়িতেও যায়। ছেলে সঙ্গে থাকে বলে কিছু মনে করেন না মাস্টার। কিন্তু গোপেশকে তো রোজ স্কুলে যেতে হয়, দীপিকা বা তাপসীও স্কুলে যায়। দীপিকা যদি কোনোদিন শরীর খারাপের অজুহাতে স্কুল কামাই দিয়ে জানালার ফাঁকে তার মনের মানুষের সঙ্গে ঠারে ঠারে কথা বলে, কার নজরে পড়বে! কে খেয়াল রাখে এত দিকে? চারুবালা তো সারাক্ষণ সংসারের কাজে ব্যস্ত। ঠিক দুপুরে, মাস্টার যখন জমিনের আলে আলে কামলা-কিশেনদের কাজ তদারকি করে বেড়ান, আর কুয়োতলায় কাপড় কাচতে কাচতে চারুবালার মাজায় ব্যথা ধরে যায়, দিদার তখন পেছন দরজা দিয়ে দীপিকার কামরায় ঢুকে পড়লে কারো তো দেখার কথা নয়। অথবা দুপুরে তো স্কুল ছুটি হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা চলে গেলে দিদার চুপচাপ বৈঠকখানায় ঢুকে দরজার হুকটা লাগিয়ে দিলেই তো হলো। মাসে তো একবারও কেউ বৈঠখানার দরজা খোলে না। ভেতরে দীপিকাকে নিয়ে, নাকি মোল্লেপাড়ার অন্য কোনো মেয়েকে নিয়ে শুয়ে আছে দিদার, কারো তো টের পাওয়ার কথা নয়।
টের কেউ পেল না বটে। সাত মাস ধরে দিদার তার গোপন অভিসার নির্বিঘেœই চালিয়ে গেল। সেদিন বাসন্তী ভোরে দীপিকাকে যখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, জগতী বেওয়া এসে বলল, ‘মাইয়ে নিচ্চই দিদারের সঙ্গে চম্পট দেচে বাবু’ – মাস্টার তো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। মানুষ কি এতটা বিশ্বাসঘাতক হতে পারে!
মেয়ের চিন্তায় তার দিশা হারানোর মতো অবস্থা। মেয়ে সত্যি সত্যি দিদারের সঙ্গে পালাল, নাকি বনের দস্যু-ডাকাত তাকে তুলে নিয়ে গেল নিশ্চিত হতে পারছিলেন না তিনি। গ্রামবাসী ধরল আলাউদ্দিনকে। আলাউদ্দিন বলল, সে এ ব্যাপারে কিছু জানে না। লোকে বলল, তাহলে দিদারের বাড়ির ঠিকানা দাও। কিন্তু না, বাড়ির ঠিকানাও সে জানে না। বলল, মুন্সিগঞ্জে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। অসহায়ত্বের কথা জানতে পেরে তাকে লজিংমাস্টার হিসেবে থাকার প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয়ে যায়। ব্যস, এটুকুই। এর বাইরে তার ব্যাপারে সে কিছুই জানে না।
মানুষ কি এত সহজে আলাউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করে? অজানা-অচেনা একটা ছেলে গ্রামের একটা মেয়েকে নিয়ে চম্পট দিল, এ কি যেন-তেন কথা। গ্রামের মান-সম্মান বলে তো একটা কথা আছে। এই ছেলে এত সাহস পেল কোথা থেকে? নিশ্চয়ই গ্রামের কেউ না কেউ তার পেছনে আছে। ওই নাটের গুরুকে খুঁজে বের করতে হবে আগে। সবার সন্দেহের চোখ আলাউদ্দিনের দিকে, তার যোগশাজশেই দিদার এমন একটা দুঃসাহস করেছে। মিথ্যা বলছে আলাউদ্দিন, নিশ্চয়ই সে তার বাড়িঘরের ঠিকানা জানে। গরানপুর বাজারে কেশব মাস্টার তার বিরুদ্ধে সালিশ ডাকলেন। সালিশেও তার একই কথা, সে দিদারের বাড়িঘরের ঠিকানা কিচ্ছু জানে না। আল্লাখোদার নামে কসম খেয়ে কথার সত্যতা প্রমাণ করতে চাইল। সালিশদাররা তাকে নাজেহাল করে ছাড়ল, ‘বললিই হুলো? সে তোমার লজিংমাস্টার। তোমার বাড়িতি খাইয়েচে থাইকেচে। বাড়িঘরের ঠিকানা না জাইনে তুমি তারে আশ্রয় দিলে ক্যানো? এর দায় তুমি কিছুতিই এড়াতি পারবা না।’
আলাউদ্দিন তো চিরকালের ত্যাদড়। সালিশ না মেনে সে উল্টো সালিশানদের মন্দশক্ত বলে চলে গেল। অগত্যা থানায় অপহরণ মামলা ঠুকতে হলো মাস্টারকে। দিদারের সহযোগী হিসেবে আসামি করলেন আলাউদ্দিনকেও। তার খুঁটির জোর যতই থাকুক, যতই সে সিংহড়তলির লেঠেলদের ভয় দেখাক, এবার ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারল না। হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া, তাও তারা গোপনে, গ্রামের সবাই তার বিপক্ষে চলে গেল। সবারই এক কথা, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার, নইলে এমন ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটবে।
আলাউদ্দিন বাঁচার পথ খুঁজে পায় না। একে ধরে ওকে ধরে। কেউ তার পাশে দাঁড়ায় না। শেষ পর্যন্ত তার শেষ ভরসা ছবেদালির ধন্না ধরল। ছবেদালি মারল উল্টো ঝাড়ি, ‘অন্যায় করবা তুমি, আর মীমাংসা করব আমি? তোমার জন্যি ক্যানো আমি মাস্টারবাবুর সাতে নতুন কুরে ঝগড়া বাদাবো?’
ছবেদালির ঝাড়ি গায়ে মেখেছে আলাউদ্দিন কোন কালে? ঝাঁটাপেটা করলেও পোষা কুকুরের মতো লেজ নাড়াতে নাড়াতে পেছনে ঘুর ঘুর করবেই। তার প্যানপ্যানানিতে অতীষ্ঠ হয়ে এজাহার থেকে তার নামটা বাদ দেয়ার জন্য মাস্টারকে অনুরোধ না করে পারল না ছবেদালি। কিন্তু মাস্টার কি ছবেদালির কথায় টলার পাত্র? অগত্যা গ্রেপ্তার এড়াতে আলাউদ্দিনকে গ্রাম ছাড়তে হলো।
প্রায় তিন মাস পর গরানপুরে মাটির হাঁড়িকুড়ি বেচতে আসা এক কুমারের মারফত খোঁজ পাওয়া গেল দিদারের বাড়ি রতনপুর। কুমোর জানাল, দুই বছর ধরে দিদার নিপাত্তা, খুনের মামলায় আসামি হয়ে ফেরারি। কেশব মাস্টারের তো মাথায় হাত। মেয়ে কিনা শেষ পর্যন্ত একটা খুনির সঙ্গে পালাল! কিছু করার মতো উপায় খুঁজে পান না তিনি। জাবেদ খান বুদ্ধি দিল, ‘এজাহারে দিদারের বাপের নামডাও জুড়ে দ্যাও মাস্টার। ভালো বাপের ছাবাল হলি দিদার তোমার পা’র পর আইসে পড়বে।’
বুদ্ধিটায় কাজ হলো। এজাহারে বাপের নাম ওঠায় অগত্যা দিদারকে বাড়ি ফিরতে হলো। বউকে নিয়ে এতদিন দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছে। শ্বশুরবাড়ি এসে দীপিকা জানল তার স্বামীর বিরুদ্ধে দু-দুটি মামলা – একটি খুনের, অন্যটি অপহরণের। মাথায় তার হামানদিস্তার বাড়ি পড়ল। যাকে ভালোবাসে বাড়ি ছাড়ল তার বিরুদ্ধে কিনা খুনের মামলা! বলার মতো মুখে কি আর ভাষা থাকে তার। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে কেঁদেকেটে হয়রান হয় সে। শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে বোঝাল, এই মামলা ষড়যন্ত্রমূলক, ছেলে তাদের সম্পূর্ণ নির্দোষ।
দোষী হলেও কী করার আছে আর? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। হতে পারে তার স্বামী খুনি, কিন্তু সে তো কলমা পড়েই তাকে কবুল করেছে। তার গর্ভে এখন দিদারের সন্তান। তার তো আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই, এই খুনির সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। অতএব বাবার উপস্থিতিতে, তার আদর-স্নেহের কথা একটুও না ভেবে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাকে বলতে হলো, দিদার তাকে অপহরণ করেনি, স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে সে তার সঙ্গে পালিয়ে এসেছে। শাস্ত্রমতে সে তার স্বামী।
অতএব মামলা খালাস। নতমুখে মাস্টার বাড়ি ফিরলেন, হত্যা মামলায় জামিন বাতিল হয়ে দিদার গেল জেলে। ভুরুরিয়ার বিলকিস বেওয়া হত্যা মামলার সে দুই নম্বর আসামি। জামিনের জন্য তার বাপ বড় বড় উকিল ধরল, একজনের বদলে দুজন। শত শত টাকা দিল উকিল-পেশকার-মুহুরিকে, কিন্তু কোনোভাবেই জামিন করাতে পারল না। উকিল বলল চাঞ্চল্যকর মামলা, ধারা খারাপ। সহজে জামিন হওয়ার নয়। অন্তত ছ’মাস-বছর হাজতে থাকা লাগতে পারে।
উকিলের কথা মিথ্যে নয়, মামলা চাঞ্চল্যকর বটে। বিলকিস হত্যার ঘটনায় সারা জেলায় তোলপাড় হয়েছিল। স্থানীয় এবং ঢাকার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছিল। ঘটনা আড়াই বছর আগের। মামলার প্রধান আসামি শ্যামনগরের খালেক বেপারি। পেশায় সে কাপড়ের দোকানি। শ্যামনগর ইসলামিয়া মাদ্রাসার কাছে তার দোকান। হেদায়াতে ইসলামির প্রথম সারির একজন কর্মী সে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, প্যান্ট পরে টাখনু গিরার ওপরে, গায়ে কাটাপাঞ্জাবি আর মুখে ছাটা দাড়ি। তবে মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধার নয়। বাড়ি মণিরামপুরে। মানুষের মুখে এমন কথা চালু আছে, আখক্ষেতে গাভি বলাৎকারের অভিযোগে গ্রামবাসী তাকে জুতোপেটা করে জুতোর মালা গলায় পরিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলে শ্যামনগরে এসে এক ছুতোরের মেয়েকে নিকে করে ঘরজামাই হয়। দুর্ভাগ্য তার, বছর না ঘুরতেই কালাজ্বরে পড়ে বউটা অক্কা যায়। পরে শালীকে নিকে করে নতুন সংসার পাতে। হেদায়াতে ইসলামিতে যোগ দিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই থানা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পায়। সেই সুবাদে জিয়ারত আলীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। শ্যামনগর বাজারের লোকজন তাকে অল্পবিস্তর সমীহ করার পেছনে কারণ এই একটাই। সামনে সমীহ করে বটে, কিন্তু পেছনে তার বদনাম করে বেড়ায়। বদনাম করার বহু কারণের এক কারণ তার বিকৃত রুচি। বাইরে সে পরহেজগার-মোত্তাকি, কিন্তু ভেতরে ঘোর সমকামী। তার কথাবার্তা এবং আচার-আচরণেও এই বিকৃত রুচির প্রকাশ ঘটে। সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে কেউ শায়েস্তা করতে পারে না। একবার মাদ্রাসার এক ছাত্র তার বিরুদ্ধে বলাৎকারের অভিযোগ তুলেছিল। হেদায়াতে ইসলামির নেতাদের মধ্যস্থতায় টাকা-পয়সা দিয়ে, ছাত্রের বাবার হাত-পা ধরে ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়। নইলে ওই ঘটনায় চিরতরে তাকে শ্যামনগর ছাড়তে হতো। তবু তার বদঅভ্যাসটা যায়নি, নাদুস-নুদুস ছেলে দেখলেই চোখেমুখে কামভাব জেগে ওঠে, তার সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করে। পারেও। তার দোকানে কাঁচা বয়সের যেসব ছেলেপিলের যাতায়াত, তাদের সঙ্গে সে কুকর্ম করে না, নিশ্চিত করে কে বলবে?
বিলকিস হত্যার ঘটনা ঘটেছে তারই দোকানে। তার জবানবন্দি মোতাবেক মামলার এজাহারে উল্লেখ, ভুরুরিয়ার বিলকিস বেওয়া সেদিন বিকেলে ব্লাউজের কাপড় কিনতে এসে বৃষ্টির কারণে তার দোকানে আটকা পড়ে। দোকানে দিদারও ছিল, আর ছিল এনায়েত নামের এক লোক। শেষ বিকেলে হঠাৎ তুমুল ঝড়বাদল শুরু হয়। রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ে। আকাশের হাল খারাপ দেখে হাটুরেরা ঝড় শুরুর আগেই বাড়িঘরে চলে যায়। আশপাশের দোকানিরা দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে। খালেকের দোকানটা উত্তরমুখী। দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস বইছিল বলে বৃষ্টির ছাট দোকানের ভেতরে ঢুকতে পারছিল না। তবু খালেক দোকানের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বদ্ধ ঘরে ভুতুড়ে অন্ধকার নামে। দরজা বন্ধ করার আগে তাদের কামাতুর চোখ ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তায় বিলকিসের সন্দেহ হয়। কিন্তু বৃষ্টিটা এতই তুমুল ছিল, বেরোনোর কোনো উপায় ছিল না তার।
অন্ধকারে হঠাৎ তার বুকে হাত দেয় খালেক। সে চিৎকার করতে গেলে এনায়েত তার মুখ চেপে ধরে। পরে তিনজনে মিলে জোরপূর্বক তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ধর্ষিতা বিলকিস মামলার হুমকি দিলে শ্বাস রোধ করে তাকে হত্যা করে তারা। ঝুমবৃষ্টি আর ঝড়-তুফানের কারণে এত বড় ঘটনা কেউ টের পায়নি। দুদিন পর খালেকের দোকানে মানুষপচা গন্ধ পেয়ে লোকজন থানা-পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে দোকানের দরজা ভেঙে বিলকিসের লাশ উদ্ধার করে। পাঁচ দিন পর যশোর রেলস্টেশন থেকে খালেক গ্রেপ্তার হয়। তার জবানবন্দি মোতাবেক পুলিশ এজাহারে দিদার ও এনায়েতকে আসামি করে।
স্থানীয়রা এনায়েত নামের কাউকে চিনতে পারল না। খালেক বেপারিকে দফায় দফায় রিমান্ডে এনেও এনায়েতের বিস্তারিত পরিচয় বের করতে পারল না পুলিশ। মাথা ছুঁয়ে চোখ ছুঁয়ে, বাবা-মা আল্লাখোদার নামে কসম খেয়ে সে বারবারই বলল এনায়েতের ঠিকানা সে জানে না। জানে শুধু এটুকু, তার বাড়ি কালীগঞ্জ, ভারতের সন্দেশখালী তার শ্বশুরবাড়ি। পেশায় মধুর পাইকার। গাবুরা থেকে মধু কিনে চোরাইপথে কলকাতায় পাচার করে। মাসে একবার শ্যামনগর আসে।
এনায়েত ছাড়াও ঘটনার সঙ্গে দিদারের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে লোকজন আগেই সন্দেহ করেছিল। সেদিন ঝড় শুরুর আগে আশপাশের দোকানিরা খালেকের দোকানের কাঠের টুলটায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে তাকে বিড়ি ফুঁকতে দেখেছে। তা ছাড়া ঘটনার পর থেকেই সে নিপাত্তা। এটাই সন্দেহের মূল কারণ। সে নির্দোষ হলে গা ঢাকা দেবে কেন?
সন্দেহের কারণ আরো আছে। বয়সে ছোট হলেও খালেকের সঙ্গে তার একগলা খাতির। শ্যামনগর ইসলামিয়া মাদ্রাসায় দাখিল ক্লাসে পড়ার সময় খাতিরটা জমে ওঠে। খালেকের সুবাদেই সে হেদায়াতে ইসলামিতে যোগ দেয়। মেধাবি ছাত্র হিসেবে তার সুনাম ছিল। দাখিলটা ভালো রেজাল্ট নিয়েই পাস করেছে। কিন্তু পরে খালেকের পাল্লায় পড়ে লেখাপড়া গোল্লায় গেল, দু-দুবার পরীক্ষা দিয়েও আলিমটা পাস করতে পারল না। লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাজনীতি করলে পাস করবেই-বা কেমন করে। প্রতিটা মিছিল-মিটিংয়ে তাকে প্রথম সারিতে দেখা যায়। প্রতিপক্ষ দলের কর্মীদের সঙ্গে মারামারিতেও সে সবার আগে। দেখতে লম্বা-চওড়া মোটাসোঁটা। মারামারিতে দু-তিনজনও তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারে না। পার্টির নেতারা তাই মারপিটে তার ওপর ভরসা করে বেশি। এই বিশেষ গুণটার কারণে জিয়ারত আলীর আস্থা অর্জন করতে তার বেশি সময় লাগেনি। ধর্ষণ মামলায় না জড়ালে পার্টির বড় নেতাটেতা হয়ে যেতে পারত। এজাহার থেকে নামটা বাদ দেয়ানোর জন্য বহু চেষ্টা-তদবির করেছে। দালাল ধরে মামলার আয়ুকে মেলা টাকা-পয়সাও দিয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। জিয়ারত আলীর সঙ্গেও দেখা করেছিল একবার, তিনিও পাশে দাঁড়ালেন না। মুখের ওপর সাফ বলে দিলেন, ‘তোমার কুকর্মের দায় তো পার্টি ন্যাবে না ভাই। নিজির ঠ্যালা নিজিই সামলাও।’
দিকদিশা না পেয়ে শ্যামনগর ছেড়ে বাড়ি ফিরল দিদার। বাড়িতে পুলিশ হানা দিলে বাড়িও ছাড়তে হলো। প্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরতে ঘুরতে একদিন পার্টির এক কর্মীর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জ বাজারে ছবেদালির সঙ্গে পরিচয় হয়। ছবেদালি এত কিছু জানত না, দিদার তাকে আসল ঘটনা জানায়নি। শুধু বলেছিল, সরকারি দলের হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়ে সে ফেরারি আসামি। পরিস্থিতি অনুকূলে না আসা পর্যন্ত তাকে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। ছবেদালি ভাবল, পার্টিরই তো লোক। বিপদে পড়েছে, পাশে তো দাঁড়ানো উচিত। আলাউদ্দিনকে বলে তার বাড়িতে লজিংমাস্টার হিসেবে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল।
তা প্রায় আট মাস জেল খাটার পর জজ কোর্ট থেকে জামিন পেল দিদার। বিলকিস হত্যা মামলা আদালতে দুই বছর গড়ানোর পর রায় হলো – খালেক বেপারি ও এনায়েতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দিদার বেকসুর খালাস। খালেকও হয়ত খালাস পেত, যদি না সে পলাতক থাকত। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই সে হাওয়া।