কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
তিন.
বর্ষা গিয়ে শরৎ এলো, প্রসূন মাইতির ভিটায় কাশ গজাল, অথচ স্কুল ওঠার খবর নেই। সব গুছিয়ে এনেও স্কুলের কাজটা শেষ পর্যন্ত শুরু করতে পারলেন না কেশব মাস্টার। পারবেন কী করে? তার বড় মেয়ে মুসলমান হয়ে মুসলমান স্বামীর ঘর-সংসার করলে বাপ হিসেবে তার কি আর মাথা ঠিক থাকে? ঘর সামলাবেন, না মানুষের সেবা করবেন।
ধর্মের ব্যাপারে মাস্টারের উদারতা নিয়ে কেউ কোনোদিন প্রশ্ন তোলেনি। চিরকালই তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং আন্তধর্মীয় ঐক্যের পক্ষে। গরানপুর বা হরিনগরে যখনই হিন্দু-মুসলমানে রেশারেশি দেখেছেন, তিনি মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছোটখাটো ঝগড়া-ফ্যাসাদ মীমাংসা করেছেন। কেউ হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাঁধানোর পাঁয়তরা করলে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তার বিরুদ্ধে। চৈতনদাস খুনের ঘটনায় আটক নির্দোষ ভক্তদাসকে মুক্তি দিয়ে আসল খুনিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে গ্রামবাসীকে নিয়ে এসডিও এবং থানার বড় দারোগার সঙ্গে দেখা করেছেন। আজহার চেয়ারম্যানও গিয়েছিলেন সঙ্গে। জনমতের চাপে পড়ে এজাহার থেকে ভক্তদাসের নাম বাদ দিতে বাধ্য হয় দারোগা। গরানপুরের দাসবাড়িতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় সবার আগে তিনিই প্রতিবাদ করেছেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিকার চেয়ে এসডিও বরাবর দরখাস্ত দিয়েছেন। মুসলমান ছেলেমেয়েদের ঘরে ঢোকা নিয়ে চারুবালার আপত্তি কখনোই তিনি গ্রাহ্য করেননি। সবাই তো মানুষ, একই ঈশ্বরের সন্তান। ‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ’ – এই গতিশীল বিশ্বে যা কিছু চলমান বস্তু আছে তা ঈশ্বরের বাসের নিমিত্ত মনে করবে – উপনিষদের এই বাণীতে তার পূর্ণ বিশ্বাস। মানুষ এই ‘যা কিছু’র বাইরে নয়। হোক সেই মানুষ হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ অথবা খ্রিস্টান। বামুন কায়েত শুদ্দুর ডোম মুচি মেথরও ঈশ্বরের কাছে সমান। তিনি প্রত্যেকের অন্তরে বাস করেন। হিন্দুর ঘরে মুসলমান ঢুকলে, মুসলমানের ঘরে হিন্দু ঢুকলে জাতধর্ম সব চলে যাবে – বাইরে প্রকাশ না করলেও মনে মনে ধর্মের এমন স্পর্শকাতরতাকে কখনোই গুরুত্ব দেননি। তাই বলে বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে কেউ হিন্দু থেকে হুট করে মুসলমান হয়ে যাবে, এটা তিনি মানতে নারাজ। মানতে হয়ত পারতেন, যদি না হিন্দু হওয়ার অপরাধে তার বাবাকে খানসেনারা চুনকুড়ির হিম জলে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখত, কুকুর-বিড়ালের মতো গুলি করে যদি না তার বুকটা ঝাঁঝরা করে দিত।
ধর্মাচারী মানুষ ছিল অনন্ত মণ্ডল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী আর তাদের বাঙালি ভাই-বেরাদরদের নানা হুমকি-ধমকির পরও ধর্ম ছাড়েনি। নির্যাতন-নিপীড়নে অতীষ্ঠ হয়ে তখন গরানপুরের বহু হিন্দু বারাসত, হিঙ্গলগঞ্জ বা সন্দেশখালী চলে গেছে। যারা পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে দেশান্তরী হতে চায়নি কত না জুলুম সইতে হয়েছে তাদের! পাকবাহিনী ও তাদের বাঙালি দোসররা এসে মারধর করেছে। কখনো শান্তি কমিটি, কখনো আল-বদর, আল-শামস বা রাজাকার নাম নিয়ে তারা এসেছে। কারো বসতঘর, কারো ঠাকুরঘর, কারো গোলাঘর, কারো-বা গোয়ালঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। কারো বউ-বেটির সম্ভ্রম লুটে নিয়েছে। কাউকে বেয়নেটে খুঁচিয়ে অথবা গুলি করে জন্তু-জানোয়ারের মতো মেরেছে, তবু কেউ ধর্মান্তরিত হয়নি। কেশব মাস্টারের তখন দুই সন্তান। নমিতা দুধ ছেড়েছে, দীপিকার বছর দেড়েক। তারা তো তখন সন্দেশখালী, আর তিনি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলে কাশিমারি কোথায় কোথায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছেন। বাবা-মাকেও সন্দেশখালী পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা যেতে রাজি হলো না। অনন্ত মণ্ডল তো ক্ষেপেই গেল, ‘চোদ্দপুরুষির ভিটে ছাইড়ে আমি কোনে যাবো? ক্যানো যাবো?’ আত্মীয়-স্বজনরা কত করে বোঝাল, ‘চুলে আস অনন্তবাবু। এই দেশ আমাগো না, এই দেশে এট্টা হিন্দুরেও বাঁচতি দ্যাবে না খানেরা। জীবনে না বাঁচলি চোদ্দপুরুষির ভিটে দে করবেটা কী?’
অনন্ত মণ্ডল হো হো করে হেসেছে, ‘তোমরা একেকটা ভীতু, কাপুরুষ। মেরুদ- আচে তোমাগো? সব মিচে কতা। গুজবে কান দে তোমরা দেশ ছাইড়তেচ। আহা দেশ! এই দেশডার জন্যি কোনো মায়া নি তোমাগো। আচ্চা, হুলোই না-ই সত্যি, আইলোই না-ই খানেরা। তাতে কি? গরানপুরি আমাগো বাপ-ঠাকুদ্দাগো বাস, কোন জাগার কোন খানসেপাইরা আইসে বুললো চুলে যাও, আর পোটলা-পুটলি বাঁইদে চুলে যাবো? এরাম সোজা! আসুক তারা, এই গ্রামেত্তে আমি এক ফোঁটাও নড়বো না।’
না, এক চুলও নড়েনি সে। তার এই একগুঁয়েমির পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ। মুন্সিগঞ্জের আতা মৌলবি যেদিন তার দলিজে আগুন দিয়ে পাকবাহিনীর চার সেপাইকে পুড়িয়ে মারল তার পরদিনই গরানপুরে প্রথম মিলিটারি এলো। এলো, কিন্তু ক্ষতি কিছু করল না। এক সপ্তাহ পর আবার হানা দিল। গেরস্তবাড়িগুলোতে লুটপাট চালাল, ঘরে ঘরে আগুন দিল, জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারল, নারী-পুরুষকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে বেয়নেটের খোঁচায় রক্তাক্ত করল, পশুপাখির মতো গুলি করে মারল। হিন্দু-মুসলমান বাছবিচার করল না। দুধের বাচ্চাটাও নির্যাতন থেকে রেহাই পেল না।
যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে, তখন পৌষের শুরু, মিলিটারিরা আবার গরানপুরে হানা দিল। অনন্ত ম-লকে বাড়ি থেকে ধরে এনে চুনকুড়ির হিম জলে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। এক বেলুচ-সেপাই খুলি বরাবার রাইফেলের নল তাক করে হুমকি দিল, ‘কাল্মা পড় সালে মালাউন কা বাচ্চা। ওয়ারনাহ গুল্লি মার কর জঙ্গল মে ভেক দোঙ্গা।’
অবোধ বালকের মতো অনন্ত মণ্ডল দু-হাতে কান দুটো ধরে রেখে সেপাইটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর হাসে। বুকে তার অসীম সাহস, ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। সে তার সিদ্ধান্তেই অটল – কিছুতেই কলমা পড়বে না। কেন পড়বে? যুদ্ধ চলছে দেশ নিয়ে, ধর্মের কী দোষ। প্রয়োজনে সে মরবে, তবু ধর্ম ছাড়বে না। ধর্ম ছেড়ে বেঁচে থেকে কী লাভ। ধর্মহীন জীবনের চেয়ে তো মরে যাওয়া অনেক ভালো। ডেয়ারিং ছবু চোখ রাঙাল, মেরে ফেলার ভয় দেখাল, তবু সে টলল না।
ছোটবেলা থেকে দেখা প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অনন্ত মণ্ডলকে হিম জলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝি মায়া হলো ছবুর। গলাটাকে নরম করে বলল, ‘কলমাডা পড়ো অন্তকা, নালি হুজুরিগো হাতেত্তে তোমারে আমি বাঁচাতি পারবো না।’
বিদ্রুপের বাঁকা হাসিটা আরো প্রসারিত হলো মণ্ডলের ঠোঁটে। দু-চোখের কুঁচকে যাওয়া কোণা দেখে বোঝা গেল ভীষণ রাগ তার মাথায় পাক খাচ্ছে। ঠোঁট দুটোকে শক্ত করে যতটা পারে ঘৃণা মাখিয়ে বলল, ‘তুই বাঁচানের কেডা রে ছবু? তুই তো এট্টা খুনি, মান্ষির রক্তে তোর হাত রাঙা। তোর কতায় আমি জাতধর্ম ছাড়বো?’
মেজাজ কি আর ঠিক রাখতে পারে ছবু। তার জেহাদি জোশ উস্কে উঠল। ওপরের ঠোঁটটা বাঁকিয়ে, চোখ দুটো করমচার মতো লাল করে, চেহারায় দাঁতালের হিংস্রতা ফুটিয়ে রাইফেলধারী বেলুচ-সেপাইটার মুখের দিকে তাকাল একবার, তারপর তেরচা চোখে তাকাল অনন্ত মণ্ডলের দিকে। নিশপিস করতে থাকা হাত দুটো চাদরের নিচ থেকে বের করে আনল। বাঁ হাতে লুঙ্গির খুঁট ধরে হাঁটুজলে নেমে মণ্ডলের মুখোমুখি দাঁড়াল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বাঘের থাবার মতো কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল অনন্ত মণ্ডলের গালে, ‘এ্যাতো বড়ো কলজে তোর হারামজাদা। পোদ্ হুয়ে মোসলমানরে তুই খুনি বলিস! শালা মালাউন, কিচ্চু বলতিচেনে বুলে মাতায় উটিচ্ বেজম্মার বাচ্চা।’
থাপ্পড় খেয়েও অনন্ত মণ্ডল টলল না, ঝাপসা চোখে ছবুর মুখের দিকে তাকাল। ছবু তখনো ফুঁসছে। যেন একটা কালকেউটে তার মরণফণা ধরে আছে, যে কোনো মুহূর্তে ছোবল হানবে। ভয়ে অথবা ছেলের বয়সী ছবুর হাতে থাপ্পড় খাওয়ার অপমানটা চাপা দিতে চোখ বন্ধ করল। ভাঁজ পড়া দুই কোণ বেয়ে গড়াতে লাগল ফোঁটা ফোঁটা নোনাজল।
ছবু নদীর আড়ায় উঠে দাঁড়াল। তার হুকুমে সাঙ্গপাঙ্গরা অনন্ত মণ্ডলের কাঠের ঘরটায় আগুন ধরিয়ে দিল। মণ্ডলবাড়িতে হৈচৈ চিৎকার আর আর্তনাদ শুরু হলো। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে ‘হা ভগবান’ বলে চিৎকার দিল মণ্ডল। আল্লার দুনিয়ায় ভগবান কোন ছার! চোখের সামনে ঘরটা পুড়ে ছাই হলো। বীণাদেবী পুড়ে মরল, না কোথাও পালিয়ে বাঁচল – কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার কারণে কিছুই ঠাওর করতে পারল না তার হতভাগা স্বামী।
শেষে কনকনে জলে দাঁড়ানো অবস্থায় মণ্ডলের ছিনা বরাবর রাইফেল তাক করল বেলুচ-সেপাই। মুহূর্তে বিকট শব্দে একটা গুলি তার বুক ছেঁদা করে ওপারের হেতালঝোপে গিয়ে পড়ল। আবার ‘ভগবান’ বলে আর্তনাদ করে ঢলে পড়ল মণ্ডল। আর্তনাদের শব্দটা জলস্বরে চাপা পড়ল। তারপর সূর্য অস্ত গেল কালিন্দীর ওপারে, চুনকুড়িতে জোয়ার এলো। তার লাশটা স্রোতে ভেসে গেল, নাকি নদীর কামোট-কুমিরে টেনে নিয়ে গেল গরানপুরের কেউ দেখল না, কেউ জানল না।
কি কলিকাল! সেই অনন্ত মণ্ডলের নাতনি নমিতা রানী মণ্ডল কিনা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান ছেলেকে নিকে করল! কেশব মাস্টারের মাথা ঘুরে যায়। বড় আশা করে মেয়েকে তিনি শহরের কলেজে পড়তে দিয়েছিলেন। টাকা-পয়সা যাক আপত্তি নেই, মেয়েটা বিএ পাস করুক। তার বড় স্বাধ, লেখাপড়া শেষ করে নমিতা মাস্টারি করবে, জ্ঞানের পিদিম জ্বালাবে গরানপুর-হরিনগরের ঘরে ঘরে। অন্তত আইএ পাসের আগে বিয়ে-থা নয়। কত ভালো ভালো প্রস্তাব আসে, অথচ তিনি ফিরিয়ে দেন।
খুলনা শহরে চারুবালার এক মাসতুতো বোনের বাড়ি। মংলা বন্দরে বোনাই অতুলচন্দ্রের ঠিকেদারি কারবার। অনেক দিন যোগাযোগ ছিল না, হঠাৎ একদিন খালিশপুরে মাস্টারের সঙ্গে অতুলচন্দ্রের দেখা। নমিতার তখন ম্যাট্টিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে, দুই বিষয়ে লেটার মার্কস্সহ সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে। চাইলে সাতক্ষীরার কোনো কলেজে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু মেয়েকে খুলনা শহরের বড় কোনো কলেজে পড়াতে চান মাস্টার। সরকারি মহিলা কলেজের হোস্টেলের খোঁজখবর নিতে সেদিন তিনি খুলনায় গিয়েছিলেন। অতুলচন্দ্র বলল, ‘হোস্টেলে থাকার দরকার কী? আমার এত বড় বাড়ি, কত ঘর খালি পড়ে থাকে, নমিতা তো আমার কাছেই থাকতি পারে।’
মাস্টারের আপত্তি ছিল না, আপত্তি করল চারুবালা। বলল, ‘ইষ্টিকুটুমির বাড়িতে বেশিদিন থাকা ভালো না। সম্পর্ক নষ্ট হয়। তারচে বরং হোস্টেলে থাকাই ভালো।’
হোস্টেলেই থাকল নমিতা, হোস্টেলে থেকেই আইএ পাস করল। ছুটিছাটায় মাসির বাড়ি বেড়াতে যেত। হালিম তখনো সরকারি চাকরি পায়নি। সকাল-বিকাল বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করছে, বাকি সময় চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। সপ্তায় পাঁচ দিন নমিতার মাসতুতো বোন অর্চনাকে ইংরেজি পড়াতে আসে। আইএ পরীক্ষা শেষে নমিতা ভেবেছিল রেজাল্ট বেরোবার আগের ক’মাসে টাইপ রাইটিংটা শিখে নেবে। মেয়েরাও এখন চাকরি-বাকরিতে ঢুকছে। শুধু সার্টিফিকেট থাকলে তো হয় না, চাকরির জন্য হাতের কাজও জানা থাকা চাই। শহরের এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে যোগাযোগও করেছে। মাসে এক শ টাকা ফি। তিন মাসের কোর্স।
মাসির বাড়ি বেড়াতে এসে মতি পাল্টে গেল তার। বরাবরই সে ইংরেজিতে কাঁচা। ম্যাট্টিকের আগেই রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, তারাশঙ্কর ও মানিকের বহু গল্প-কবিতা পড়ে ফেলেছে। বাবার কাছ থেকে বাংলা ব্যাকরণটাও মোটামুটি রপ্ত করে নিয়েছে। কিন্তু ইংরেজিতে দুর্বল। ইংরেজিতে হালিমের দক্ষতার কথা জেনে তার কাছে ইংরেজি ব্যাকরণটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। তার মাসি-মেসোও একই মত দিল। টাইপ শেখার চেয়ে ইংরেজি শেখাটা জরুরি। ভালো চাকরি পেতে হলে ইংরেজি জানা দরকার।
প্রাইভেটে ইংরেজি ব্যাকরণ পড়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে বাবার কাছে চিঠি লিখল নমিতা। ফিরতিপত্রে বাবার অনুমতি পেয়ে অর্চনার সঙ্গে হালিম মাস্টারের কাছে ইংরেজি ব্যাকরণ পড়তে শুরু করল। প্রথম দিন হালিমকে দেখে নমিতার একবারও মনে হয়নি তার যুবক মাস্টার কোনোদিন কোনো মেয়ের প্রেমে পড়তে পারে। বয়স প্রায় সাতাশ-আটাশ, দেখতে লম্বা-চওড়া, স্বভাবে গম্ভীর। হাসে কম, কথাও বলে কম – দরকারি কথা ছাড়া একটাও নয়। ঠাট্টা-তামাশার ধারেকাছেও থাকে না। পড়াতে আসবে ঠিক চারটায়, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটার দাগে ঠেকলে চলে যাবে।
এমন সাধাসিধে যুবক মাস্টার মাত্র পনেরো দিনের মাথায় কিনা বদলে যেতে শুরু করল! আগে সপ্তাহ-দশ দিনেও দাড়ি কামাত না, এখন দুদিন পরপরই সেলুনে যায়। পারলে তো রোজই যায়। রোজ ইস্ত্রি করা প্যান্ট-শার্ট পরে মাঞ্জা মেরে আসে, সেন্টের ঘ্রাণে সারা ঘর ভরিয়ে রাখে। দেড় ঘণ্টার জায়গায় কোনো কোনোদিন দু-আড়াই ঘণ্টা কেটে গেলেও খবর থাকে না। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা পড়ে থাকলেও যেন ক্লান্তি আসবে না। পড়ানোর ফাঁকে এটা-সেটা নিয়ে নমিতার সঙ্গে আলাপ জমাতে চায়। ভাইবোন কজন, বাবা কী করেন, পশ্চিমের বাদা তো বাঘের আস্তানা, লোকালয়ে কখনো বাঘ হানা দেয় কি না – এমন সব প্রশ্ন করে।
নমিতা প্রথম প্রথম বিব্রত হলেও পরে স্বাভাবিক হয়ে যায়। বুঝতে পারে, মোম গলতে শুরু করেছে। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা তো তার কম হয়নি। বহু দাপুটে ছেলেকে, বংশ-মর্যাদা আর অর্থবিত্তের গরিমায় যাদের পা মাটিতে পড়ে না, তার সামনে এসে হাবাগোবা বনে যেতে দেখেছে। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবি ছাত্রটা, যে তাকে প্রথমে পাত্তাই দিতে চায়নি, মাসখানেকের মধ্যে মোমের মতো তাকে গলে যেতে দেখেছে। আর হরিনগরের ছেরু তো চান্নিরাতে তার কথামতো চুনকুড়ি পাড়ি দিতে গিয়ে কামোটের কবলে পড়ে ডান হাতের কব্জিটা পর্যন্ত খোয়াল। হালিম তো তুচ্ছ প্রাইভেট মাস্টার, তার মনের কথা বুঝতে তার অসুবিধা হবে কেন। কিন্তু এমন ভাব নিয়ে থাকে যেন কিছুই বোঝে না। পড়ার বাইরে হালিমের অন্য সব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আচার-আচরণে সবসময় সতর্ক থাকে ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্ক যেন অন্য কোনো দিকে না গড়ায়। সে যদি মুসলমান হতো হালিমের সঙ্গে প্রেমে জড়াতে তার আপত্তি থাকত না। সে হিন্দু, তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী হিন্দু। এটুকু বোঝার মতো জ্ঞান তার আছে, তেলে কখনো জল মেশে না। যতই চেষ্টা করা হোক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলাদা হয়ে থাকবেই।
পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হালিম, কথায় কথায় কেবল বিজ্ঞানের সূত্র আওড়ায়। আউটবই পড়ে গুছিয়ে কথাও বলতে শিখেছে বেশ। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ধরে সে ইশারা-ইঙ্গিতে তার সুন্দরী ছাত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করে – মানুষ তেল নয়, জলও নয়। মানুষ সব উপাদানে গড়া এক পরিপূর্ণ প্রাণী। মানুষ বেঁচে থাকে সম্পর্কের ওপর। হ্যাঁ, পৃথিবীজুড়ে মানুষে মানুষে সম্প্রদায়গত বিভাজন রয়েছে সত্যি, তবে সম্পর্ক কখনো কখনো এই বিভাজনকে পাশ কাটিয়ে এক মহত্তম সম্পর্কে উন্নীত হতে পারে। সেই মহত্তম সম্পর্কের কিছু দৃষ্টান্তও সে হাজির করে। নমিতা চুপ করে থাকে। মৌনতার মধ্য দিয়ে সে বোঝাতে চেষ্টা করে তার বাবা-মা আছে, সমাজ-সংসার আছে। চাইলেই সে যা ইচ্ছে তা করতে পারে না। বাবা তাকে যে আদর্শে বড় করেছেন, যে আদর্শে চলার জন্য সবসময় অনুপ্রাণিত করেন, ইচ্ছে করলেই সেই আদর্শকে সে পরিত্যাগ করতে পারে না। হালিমও কি পারে? তার কি সমাজ-সংসার নেই? সেও কি প্রকাশ্যে তার সামাজিক পরিমণ্ডলের বাইরে যেতে পারে?
কিন্তু যৌবন এমনই দুর্বার, যে সমাজ-সংসার মানে না, জাতপাতের ধার ধারে না। হালিমও সংযমী হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। প্রেমের প্রমত্ত জোয়ারে সে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে থাকে। দুর্বার যৌবন নমিতার সাম্প্রদায়গত বোধের কঠিন বাঁধটাকে ধসিয়ে দিতে থাকে। সর্বনাশা টান উপেক্ষা করে সে বাঁধটাকে ধসে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে চায়। কিন্তু প্রেম এমন এক প্লাবন যার সঙ্গে লড়ে টিকে থাকা কঠিন। উত্তাল প্লাবনের স্রোতে নমিতা ভেসে যায়, তার বোধের কঠিন বাঁধ ধসে যায়। ধসে যাওয়া বাঁধ সে আবার মেরামত করে, আবার ধসে। সে আবার গড়ে, আবারও ধসে।
দারুণ হাঁপিয়ে ওঠে নমিতা। শেষ পর্যন্ত হালিমে সমর্পিত না হয়ে আর পারে না। এমনই সমর্পণ, যেদিন সে হালিমের সঙ্গে খালিশপুর জামে মসজিদের ইমামের বাড়ি গিয়ে কলমা পড়ে নমিতা রানী থেকে নওশেবা আক্তার হয়ে গেল, তার পরের দিন কোর্টে গিয়ে এক লাখ টাকা দেনমোহরের শর্তে হালিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো, তার মাসি-মেসো তো নয়ই, মাসতুতো বোন অর্চনাও কিছু জানতে পারল না। বিয়ের পর প্রায় দেড় মাস হালিম যথারীতি নমিতাকে পড়াতে এসেছে। দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে, চিঠি চালাচালি হয়েছে, হয়ত দৈহিক মেলামেশাও হয়েছে, অথচ অর্চনা কিনা একবারও টের পেল না!
প্রায় চার মাস পর, সরকারি চাকরি নিয়ে হালিম তখন যশোরে, ডাকপিয়ন একদিন নমিতার একখানা চিঠি দিয়ে গেল অর্চনাকে। চিঠি পড়ে তো অর্চনা থ। হালিমের সঙ্গে সম্পর্কের পূর্বাপর, ধর্মান্তর, বিয়ে এবং বর্তমানে যশোরে সরকারি কোয়ার্টারে সাংসারিক জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছে নমিতা।
কেশব মাস্টারের মাথা কী করে আর ঠিক থাকে। তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মান্তরের ঘটনা নেই, অথচ তার মেয়েই কিনা মুসলমান হয়ে গেল! বড় মুখ তার ছোট হয়ে গেল, মাথা তো বেঠিক হওয়ারই কথা। তার জীবনটা ছিল সাদা কাপড়ের মতো ধবধবে, কোথাও ছিতের দাগটি পর্যন্ত ছিল না। গরানপুর-হরিনগরের মানুষ অন্তত তাই মনে করত এতদিন। ঝকঝকে তকতকে জীবনের খাতায় এবার কালির দাগ পড়ল। গ্রামের মানুষ তাকে যে মর্যাদা দিত তাতে কিছুটা ভাটা পড়ল বৈকি। রাস্তাঘাটে তাকে দেখলে লোকে কানাঘুষা করে। যেসব ছেলেমেয়ে আদাব-নমস্কার দিত তারাও এখন দূর থেকে হাসাহাসি করে। মোল্লেপাড়ার হিন্দুরা তো সব দোষ তার ওপরেই চাপাল। যুবতী মেয়েকে কেউ বাড়ির বাইরে রাখে? মেয়েমানুষের এত লেখাপড়ার কী দরকার ছিল? বড় হয়েছে, দেখেশুনে বিয়েটা দিয়ে দিল তো এমন একটা কাণ্ড ঘটত না।
সমস্ত নিন্দা মুখ বুজে হজম করে নিতে হয় মাস্টারকে। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সব আদর-স্নেহ পায়ে দলে চিরদিনের জন্য নমিতাকে মন থেকে মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।