কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
দুই.
শিক্ষার যে বীজ বুনলেন কেশব মাস্টার তা বেশ ভালোভাবেই গজিয়ে উঠতে লাগল। ছাত্রছাত্রী বাড়তে বাড়তে ছোট্ট ছাওড়াটায় একেবারে ঠাসাঠাসি অবস্থা। আমতলা জামতলা পেয়ারাতলায় মাদুর পেতে বসতে দিতে হয়। ছেলেমেয়েদের হৈচৈয়ে বাড়িটা সারাবেলা সরগরম। যেন মৌচাক ঘিরে মধুপের গুঞ্জরণ। মাস্টারের বুকটা ভরে ওঠে। যুদ্ধের সময় বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনদের হারিয়ে বুকের ভেতর যে খাদটা তৈরি হয়েছিল ধীরে ধীরে তা ভরাট হয়ে উঠতে থাকে। জন্মভূমি গরানপুর ছেড়ে পাততাড়ি গুটিয়ে সন্দেশখালী চলে যাওয়ার যে ইচ্ছাটা জাগত, এখন আর জাগে না। রাস্তাঘাটে ছেলেমেয়েরা তাকে দেখলে যখন হাত তুলে আদাব-নমস্কার দেয় তখন মনে হয় এ দেশটা তো তারই, এই গরানপুর-হরিনগরের হিন্দু-মুসলমান সবাই তো তারই স্বজন। এই দেশ ছেড়ে, এমন সোনার মানুষ ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন?
কিন্তু অসহ্য লাগে চারুবালার। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে সে, তার চৌদ্দপুরুষ বামুন, ঘরে কোনোদিন ম্লেচ্ছ যবনের পা পড়েনি, অথচ এখন কী যন্ত্রণা তার, মুসলমান ছেলেমেয়েরা যখন-তখন ঘরে ঢোকে। বারণও করা যায় না। বারণ করলেও কি কারো কানে ঢোকে! পতঙ্গের পালের মতো হৈহৈ করতে করতে হেঁশেল পর্যন্ত চষে বেড়ায়। দুয়ারটা কতক্ষণ বন্ধ রাখা যায়। বন্ধ রেখেও কি নিস্তার আছে? আংটা ধরে খট খট করবে, কপাট ধরে ধাক্কাধাক্কি করবে। কত সওয়া যায় এই অনাচার? মাস্টারেরও যা বিবেক, ছোটখাটো দরকারে নিজে না এসে ছাত্রছাত্রীদের পাঠাবেন। তা পাঠান, দরকারে তো পাঠাতেই হয়। তাই বলে সবসময় মুসলমান ছেলেমেয়েকে পাঠাতে হবে? স্কুলে কি হিন্দু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে না?
এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে শোয়ামির সঙ্গে ঝগড়া বাঁধে তার। বউকে বোঝাতে চেষ্টা করেন মাস্টার, ‘দ্যাখো, ছোট ছোট ছাইলেপিলে, তাদের আবার জাতপাত কী।’
বউ মারে উল্টো ঝাড়ি, ‘তোমার জাতপাতের দরকার নি, আমার আচে। দিনির পর দিন বাড়িতি এই অনাচার ভগমান সবে? ধর্ম গিলি আর কী থাকে মানষির। মাস্টারির এ্যাতো শক হলি বাড়ির বাইরি কোনো জাগায় ইস্কুল দেচ্চ না ক্যানো?’
বাড়ি তো বাড়ি, বসবাসের জায়গা। বাড়িকে স্কুল আর স্কুলকে বাড়ি বানালে তো চলে না―কথা তার যুক্তিসংগত। মাস্টারও চান স্কুলটা বাড়ি থেকে সরাতে। দিন দিন যে হারে ছাত্রছাত্রী বাড়ছে, কদিন পর উঠোনেও ঠাঁই হবে না। তা ছাড়া শুরু থেকেই তিনি খেয়াল করছেন খানবাড়ির ছেলেমেয়েরা তার স্কুলে পড়তে আসে না। খানদের কত বড় বাড়ি, জ্ঞাতিগোষ্ঠী মিলে প্রায় পনেরো গিরির বাস। বাড়ির ছেলেমেয়েরা মক্তবে যায়, অথচ স্কুলে আসে না। বাবার রক্ষণশীলতার প্রভাব হয়ত ছেলের মধ্যে রয়েছে। মালেক খান ছিল উদার মুসলমান। বরিশালের পীরজাদা পীরের মুরিদি নেয়ার পর থেকেই রক্ষণশীল হয়ে গেল। পীরজাদা মোহাম্মদ মখফুর রশীদ দেওবন্দ তরিকার পীর। তার বাবাপীর ছিলেন চিশতিয়া সাবিরিয়া ইমদাদিয়া রশিদিয়া তরিকার বিখ্যাত খলিফা। বাবাপীরের এন্তেকালের পর থেকেই মখফুর রশীদ গদ্দীনশীন পীর। মুরিদরা সম্মান করে তার নাম মুখে নেয় না, তাদের কাছে তার নাম পীরজাদা পীর।
পীরজাদা পীরের শিক্ষা, ‘দুনিয়ায় তোমার সঙ্গে যার মেলামেশা আখেরাতে তার সঙ্গেই তোমার হাশর-নসর। সুতরাং বেদ্বীনের সঙ্গ ছাড়।’ পীরের কথামতো বেদ্বীন হিন্দুদের সঙ্গ এড়িয়ে চলত মালেক খান। কে জানে, তার হিন্দুবিদ্বেষের পেছনে হয়ত দাঙ্গাও একটা কারণ ছিল। মুসলিম লীগের কট্টর সমর্থক ছিল সে। ছেচল্লিশের দাঙ্গার জন্য একতরফা হিন্দুদের দায়ী করত। দাঙ্গার পর গ্রামের হিন্দুদের সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল।
জাবেদ খান অবশ্য বাবার মতো অত গোঁড়া নয়, তবু পারিবারিক সংস্কার বলে কথা! সহজে কি ওই সংস্কার দূর করা যায়? গ্রামের হিন্দুদের খানবাড়ি যেতে বাধা নেই, কিন্তু খানবাড়ির ছেলেমেয়েরা হিন্দুবাড়ি গিয়ে পড়ালেখা করবে – এটা খানবংশের ইজ্জতের প্রশ্ন। ইজ্জতের খাতিরে কেশব মাস্টারের দেখাদেখি জায়গির মাস্টার রেখে বাড়িতে স্কুল একটা চালু করেছিল জাবেদ খান। দুর্ভাগ্য, যুবক মাস্টারের প্রেমে পড়ল তার ভাতিজি সুরাইয়া। কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন মাস্টারের সঙ্গে চম্পট দিল। সেই সঙ্গে স্কুলটাও বন্ধ।
গরানপুরে একটা প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জাবেদ খানের বহুদিনের। কথা প্রসঙ্গে একদিন কেশব মাস্টারকে বলেছিল, প্রয়োজনে সে একজন শিক্ষকের বেতন দেবে। বাকি যে কজন শিক্ষক লাগে গিরিপ্রতি মাসিক চাঁদা ধার্য করে তাদের বেতনের ব্যবস্থা করবে। তার কথাটা তখন গুরুত্ব দেননি কেশব মাস্টার। প্রাইমারি স্কুল চালানো কি সোজা কথা! স্কুলের জন্য জায়গা কোথায়? জায়গার ব্যবস্থা না হয় হলো। খানদের কত ভুঁই, চাইলেই দু-এক বিঘা দিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু পড়ানোর জন্য শিক্ষক পাবে কোথায়? ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত চালাতে গেলে অন্তত পাঁচজন শিক্ষক তো লাগবে। তাদের বেতন আসবে কোথা থেকে? যতই বলুক জাবেদ খান, গরানপুরের বনজীবী গরিব মানুষরা মাসে মাসে চাঁদা দেবে – এই আশা বৃথা।
বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে জাবেদ খানের প্রস্তাবটা নতুন করে ভাবলেন মাস্টার। সেদিন বিকেলে গরানপুর বাজারে ফেলুর দোকানে জাবেদ খানকে পেয়ে স্কুলের কথাটা ওঠালেন। জাবেদ খান এখনো আগের কথাতেই আছে, স্কুল সে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু সমস্যা জায়গা নিয়ে। স্কুলের জন্য এত বড় জায়গা কোথায়? জাবেদ খান চাইলে অবশ্য বিলান জমি দিতে পারে। কিন্তু তাতে মাটি ফেলে ভিটা তৈরি করা অনেক খরচের ব্যাপার। ছয় কক্ষের একটা ঘর তুলতে দশ-বারো হাজার টাকার কমে তো হবে না। এই টাকার খবর নেই, মাটি ফেলার টাকা দেবে কে!
ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করলেন কেশব মাস্টার। গরানপুর বাজারের পশ্চিমে গোনের দিঘির উত্তর পাড়ে প্রসূন মাইতির ভিটটা মেলা দিন ধরে পরিত্যক্ত। এককালে সেখানে প্রসূন মাইতির বাড়ি ছিল। চৌষট্টি সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় খুন হয় প্রসূন মাইতি। মুকনোলির প্রান্তরে তার গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। খুনি অজ্ঞাত। থানা-পুলিশ বহু তদন্ত করেও খুনির সন্ধান পেল না। কে জানে, হয়ত পেয়েছিল। কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তির ইশারায় চেপে গেছে। মামলা তুলে নেয়ার জন্য তার বউ-ছেলেমেয়ের নামে উড়োচিঠির মাধ্যমে হুমকি আসতে লাগল। প্রাণের ভয়ে তারা মামলা তুলে নিল। তবু চিঠি আসা বন্ধ হলো না। এবার হুমকি এলো দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার। নইলে সবাইকে জ্যন্ত পুড়িয়ে মারা হবে। বেগতিক বুঝে তারা বারাসত চলে গেল। তারপর এক গভীর রাতে কাঠের দোতলা ঘরটায় আগুন লাগল। কে লাগাল তাও জানা গেল না। পুরো ঘর ছাই হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেল। সেখানে এখন বট-পাকুড়ের জঙ্গল। কেশব মাস্টার বললেন, গ্রামবাসী একমত হলে জঙ্গল পরিষ্কার করে মাইতির ভিটায় স্কুল করলে মন্দ হয় না।
দ্বিমত করল না জাবেদ খান। বিরান পড়ে আছে ভিটাটা, স্কুল হলে খারাপ কি। দেশান্তরী হিন্দুদের কত জমিই তো বেদখল হয়ে গেছে। হিন্দুর জমিতে মসজিদ উঠেছে। মুন্সিগঞ্জ, নূরনগর, দাঁতিনাখালী কি বুড়োগোয়ালিনির বহু জায়গায়, একসময় যেখানে মন্দির ছিল, এখন পাকা মসজিদ। কোথাও কোথাও মক্তব-মাদ্রাসাও উঠেছে। আর যে যেভাবে পারছে লুটেপুটে তো খাচ্ছেই। কালের মতি এমনই। এককালে এই মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে বলতে গেলে মুসলমান ছিলই না। ছিল হিন্দুরা, আর ছিল সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডারা। তাদের কেউ এসেছিল মেদিনীপুরের কাঁথি থেকে, কেউ এসেছিল তমলুক থেকে। আর গাঙ-জঙ্গল পেরিয়ে কেউ এসেছিল খুলনা-যশোর থেকে। তারা এসেছিল দলে দলে, জমির লোভে। জমি পেয়েছিল, নতুন নতুন আবাদপত্তনও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে পারল না, দাঙ্গার শিকার হয়ে ভিটেমাটিটুকুও ছাড়তে হলো। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর কত হিন্দু যে ইন্ডিয়া চলে গেল! বাকি যারা ছিল চৌষট্টির দাঙ্গার সময় তাদের কেউ বারাসত, কেউ সন্দেশখালী, কেউ ভাগলপুর বা ছোট নাগপুর চলে গেল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় খানসেনাদের বেয়নেটের খোঁচা থেকে বাঁচতে যারা গেছে তারাও আর ফিরল না। এখন যেদিকে তাকাও কেবলই মুসলমান। যে ক’গিরি হিন্দু আছে তাদের তো থাকা না থাকা সমান। সব দিকেই মুসলমানদের রমরমা, হিন্দুরা কোণঠাসা। কোণঠাসা হলেও, মারধর খেলেও, ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়ে হলেও তাদের থাকতে হয় মায়ার কারণে। পূর্বপুরুষের ভিটার মায়া, গাছবিরিক্ষির মায়া, চুনকুড়ির জোয়ার-ভাটার মায়া, বনদুর্গা আর শাজঙ্গলীর মায়া। সব মায়া দল পাকিয়ে এমন একটা জাল ফেলে রেখেছে, জালটা ছেঁড়া কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। যারা এই মায়ার বাঁধন ছিঁড়েফুড়ে চলে গেছে তাদের অধিকাংশ জমিজমা এখন মুসলমানদের দখলে। প্রসূন মাইতির ভিটাটা কে কখন দখল করে নেয় তার তো ঠিক নেই।
কেশব মাস্টারের দূর সম্পর্কের আত্মীয় প্রসূন মাইতি। তার মায়ের পিসি হলো মাইতির কাকিমা। সেই হিসেবে মাইতির পরিত্যক্ত ভিটাটার ওপর তার কিছুটা অধিকার আছে বৈকি। কিন্তু গরানপুরে বদলোকের তো অভাব নেই। যেখানে রাম সেখানে রাবণ, যেখানে যুধিষ্ঠির সেখানে দুর্যোধন। জাবেদ খানের মতো সজ্জন যেমন আছে, দুর্জনও ভুরি ভুরি। মাইতির ছাড়াভিটায় স্কুল হবে – দুদিনের মধ্যেই কথাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। সেদিন বিকেলে স্কুলের ব্যাপারে আলোচনার জন্য গ্রামবাসীদের নিয়ে ফেলুর দোকানে বসার কথা কেশব মাস্টারের, অথচ দুপুরেই কিনা দিঘির পাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করতে লেগে গেল আলাউদ্দিন!
বদের বদ এই আলাউদ্দিন। আশপাশের দু-চার গ্রাম বিচরিয়ে তার মতো একটা বদ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। দেখতে বেঁটে-খাটো হ্যাংলা-পাতলা, খাদেঢোকা কুতকুতে চোখ দুটো বিড়ালের চোখের মতো। মাথাটা দুনিয়ার কূটচালে ভরা। তার মগজের শিরায় শিরায় যত কুচিন্তা, সমপরিমাণ সুচিন্তা ঢুকিয়ে দেয়া গেলে নিশ্চিতভাবেই সে নিজামউদ্দিন আওলিয়াকে ছাড়িয়ে যেত। বাইরের লোকে তো বটেই, ঘরের বউও সহজে তাকে বিশ্বাস করে না। প্রথম নিকেটা করেছিল প্রায় দশ বছর আগে, তেইশ বছর বয়সে। কপাল খারাপ, চার বছরেও সন্তানের মুখ দেখল না। এ নিয়ে বউয়ের সঙ্গে নিত্য ফ্যাসাদ। বউকে বাঁজা বলে গালি দিলে বউ আঁটকুড়া বলে পাল্টা দেয়। তর্কাতর্কির একপর্যায়ে শুরু হয় কিলাকিলি। বউ তার লম্বা-চওড়া মোটাসোঁটা। বউকে এক কিল দিলে বউ দেয় দুই কিল। হাতে না পেরে সে লাঠি নিলে বউ নেয় হেঁসো। সপ্তা-দশ দিন পরপরই বউ-ভাতারে মারপিট বাঁধে। মারামারি করে করে মান-ইজ্জত তো সব খোয়ালই, বউয়ের হাতে মার খেতে খেতে ধৈর্য-সহ্যের বাঁধটাও তার ভেঙে গেল। টিকতে না পেরে শেষ অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে হলো তাকে। একদিন মাঝউঠোনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে খিস্তিখেউড় করে সাচ্চা মুসলমানি তরিকায় বীরপুরুষের মতো ঘোষণা করল, ‘তোরে তালাক দেলাম মাগী, এক দুই তিন তালাক। আজকেত্তে আমার ভাত তোর জন্যি হারাম।’
দ্বিতীয় নিকে করেছে বছর চারেক হলো। দ্বিতীয় বউ প্রথমটার চেয়ে রূপবতী, গুণবতীও। কিন্তু কপাল তার আসলেই খারাপ, এই বউটাও মনের হাউস মেটাতে পারল না তার। সমস্যাটা যে আসলে তার দেরিতে হলেও বুঝতে পারল। মুন্সিগঞ্জের এক কবিরাজের ধন্না ধরল। কবিরাজ বলল, ধাতু দুর্বল, শাহী-হালুয়া খেতে হবে। টাকা-পয়সা খরচা করে কয়েক মাস ভাত-তরকারির মতো শাহী হালুয়া খেয়ে গেল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। নিজের দুর্বলতার কারণেই হয়ত দ্বিতীয় বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে না, বউ বরং উল্টো ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো তার নাকে রশি লাগিয়ে ঘোরায়।
আলাউদ্দিনের বাপও বুড়ো বয়সে বিয়ে একটা করেছিল। আগের ঘরে দুই ছেলে – আলাউদ্দিন ও মহব্বত হোসেন, আর শেষের ঘরে চার ছেলেমেয়ে। বাপের জমিজিরাত কম ছিল না, ভিটা-নাবাল মিলিয়ে দশ-বারো বিঘা তো হবেই। বাপ বেঁচে থাকতেই আলাউদ্দিন তার ভাগের জমি আদায় করে নেয়। বাপের এন্তেকালের পর ভাইবোনরা জমিজিরাত ভাগ-ভাটোয়ারা করতে গেলে আলাউদ্দিন দাবি করে বসল ভিটা-নাবাল সব জমিই তার। ভাইবোনেরা তো বটেই, গ্রামবাসীও অবাক। বলে কি আলাউদ্দিন! পাগল হয়ে গেল নাকি!
ভাইয়ে ভাইয়ে লাগল ফ্যাসাদ, লাঠালাঠিও হলো কয়েক দফা। গ্রামের মোড়ল-মাতবররাও এই মহা ফ্যাসাদের মীমাংসা করতে পারল না। অগত্যা মহব্বতকে ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান আজহার উদ্দিন তালুকদারের শরণাপন্ন হতে হয়। চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে হরিনগর বাজারের রাখাল ময়রার শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বিরাট সালিশ বসল। আলাউদ্দিন দাঁড়িয়ে বলল, ‘উঁহু, পাগল আমি হইনি চ্যারমেন শায়েপ, পাগল ওরা, ওগো চৌদ্দগুষ্ঠি পাগল। এই দ্যাখেন দলিল, বাপ মুরে যাবার আগে সব জাগাজমি আমার নামে লিকে দে গেচে। মিত্যে মনে কল্লি টিপসই মিল আচে কিনা যাচাই কুরে দ্যাকেন।’
টেবিল চাপড়ে দাঁড়িয়ে গেল মহব্বত, ‘তালি নিচ্চই আমার বাপ পাগল? নালি সব ভুঁই কোন ইনসাফে বড় ছাবালের নামে লিকে দে যাবে? ক্যানো, আমার কি বগলের লোম উটিনি? আমারে বেকুব পাইয়েচ? কিচ্ছু বুঝিনে আমি? সব জাল দলিল, সব এই শালার জালিয়াতি।’
লোকজন হা হা করে হেসে উঠল। পাল্টা হুঙ্কার ছাড়ল আলাউদ্দিন, ‘এ্যাঁহ, জাল দলিল! ভূমি অফিসির লোকজন তো আমার শালা-দুলাভাই হয়। তাগো তো কাজকাম নি, বুসে বুসে আমার জন্যি শুদু জাল দলিল বানায়। শালা!’
আজহার চেয়ারম্যান ধমক দিয়ে বিবদমান দুই ভাইয়ের প্যাঁচাল থামান। আলাউদ্দিনের ছোট মা ও তার ছেলেমেয়েরা কেঁদেকেটে বাজার গরম করে তুলল। এতিম-অসহায়ের কান্না দেখে বুঝি চেয়ারম্যানের দিলটা ভিজে গেল। বলল, ‘দ্যাখো আলাউদ্দিন, তোমার বাপ মইরেচে, আল্লা তারে বেহেস্তে নিক। ভুঁই না হয় সব তোমার নামে লিকে দে গেচে। কিন্তু তুমি তার বড় ছাবাল, তোমার তো ইনসাফ থাকা দরকার তাই না? ভাইবোনরা না খাইয়ে মইরবে এটা কি তোমার অপমান নয়?
চেয়ারম্যানের মুখের ওপর বলে দিল আলাউদ্দিন, ‘মান-অপমান রাকেন চ্যারমেন শায়েপ, এক কাটা ভুঁইও আমি কারো দ্যাবো না। পাল্লি তারা মামলা করুক। হাকিম যে রায় দ্যাবে আমি মাতা পাইতে ন্যাবো।’
হাল ছেড়ে দিলেন চেয়ারম্যান। গ্রামবাসীও। কেউ আর এ নিয়ে মাথা ঘামাল না। মহব্বত ও তার ছোট মা বাদী হয়ে কোর্টে মামলা একটা করেছিল। কিন্তু কপাল খারাপ, প্রায় চার বছর গড়ানোর পর রায় হলো আলাউদ্দিনের পক্ষেই। বাদীপক্ষ জজ কোর্টে আপিল করতে পারত, উকিল তাদের সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন। কিন্তু মামলার খরচ জোগাবে কে? কোর্টের ইটসুদ্ধ ঘুষ খায়। এমনিতেই ধারদেনায় তাদের বেহাল দশা, আপিল করতে গেলে রক্ত বেচেও টাকার জোগান দিতে পারবে না। ছোট মা বলল, ‘বাদ দ্যাও বাবা, জমিজমা তকদিরে না থাকলি মামলা কুরেও পাব না।’ কিন্তু মহব্বত কি আর এত সহজে বাদ দেয়? মামলায় হেরে কয়েক বছর সে চুপচাপ দম নিল, তারপর তো দুই ভাইয়ের মামলাবাজিতে থানার ওসি এমনকি কোর্টের উকিল-মোক্তাররাও বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল।
প্রথম মামলাটা নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাপের আমলের ভিটা ছেড়ে নাবাল জমি ভরাট করে নতুন বাড়ি করল আলাউদ্দিন। বাপ বেঁচে থাকতে বাড়ির পুবের ভিটায় একটা মাটির গুদাম তুলে বউকে নিয়ে উঠেছিল মহব্বত, ঘরটার দখল সে ছাড়ল না। আলাউদ্দিনও এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করল না। আলাউদ্দিন নতুন বাড়িতে ওঠার পর দুই ভাইয়ের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গেল। ছোট মা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রাম ছাড়ে মামলাটার রায় হওয়ার পরপরই। কোথায় আছে কেমন আছে কেউ খোঁজ নেয় না। আলাউদ্দিন তো জীবনে কোনোদিন খোঁজ নেবে না, মহব্বতেরও খোঁজ নেয়ার সময় কই? সে এখন সাজুনি, লটবহর নিয়ে বছরে ছয় মাস বাদায় পড়ে থাকে, বাকি ছয় মাস বাগ্দিদের সঙ্গে সাগরে যায় মাছ ধরতে।
ভাইবোনদের সব জমি গ্রাস করেও তৃপ্ত হলো না আলাউদ্দিন, কোথায় কোন খাসজমি আছে, কোথায় কোন হিন্দুর পরিত্যক্ত ভিটা আছে, দখলের ফিকিরে থাকে সবসময়। কারো দখলে থাকলে দলিলপত্র দেখিয়ে, প্রয়োজনে লেঠেল লাগিয়ে নিজের দখলে নিয়ে নেবে। সিংহড়তলির লেঠেলরা তো বলতে গেলে তার কেনা, তার হুকুমের অপেক্ষায় তারা এক পায়ে খাড়া থাকে। সে হুঁ করলে হৈহৈ করে লাঠিসোঁটা নিয়ে পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসবে। লেঠেল অবশ্য লাগাতে হয় না, দলিল দেখালেই দখলদার ভয়ে তার দখলিস্বত্ব ছেড়ে দেয়। বদলোকের সঙ্গে কে ঝামেলায় জড়ায়! আসল হোক জাল হোক দলিল তো একটা আছে তার কাছে। দলিল যার ভুঁই তার – হিসাব সোজা। টাকাপয়সা খরচা করে দলিলটা জাল প্রমাণ করতে কে যাবে ভূমি অফিসে! আর দলিল না থাকলেই কী? দাসবাড়ির দেশান্তরী পাঁচ গিরি হিন্দুর ভিটেটা যে দখল করে নিল সে, কে কী করতে পেরেছে? বেশিদিন আগের কথা তো নয়। রাতে দাসবাড়িতে কে বা কারা আগুন দিল। পাঁচ গিরির পাঁচটা ডেরা পুড়ে ছাই হলো। সবাই সন্দেহ করল হরিনগরের ডেয়ারিং ছবুকে, কিন্তু সরাসরি কেউ অভিযোগ করার সাহস পেল না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে এত বড় বুকের পাটা কার! ডেয়ারিং ছবু থেকে তখন সে ছবেদালি মোড়ল হয়ে উঠছে, সালিশ-দরবারে তার ডাক পড়ছে। কিন্তু মোড়ল-মাতবর যা-ই হোক স্বভাব-চরিত্র তো আর বদলায়নি। দেশ স্বাধীনের পর পাঁচ বছর পলাতক ছিল। পাঁচ বছর পর, যে ছবুর কোনোদিন বাড়ি ফেরার কথা ছিল না, হঠাৎ একদিন বাড়িতে হাজির। যুদ্ধের সময় সে বাইশ-তেইশ বছরের দামাল, ডেয়ারিং ছবু বললে সবাই একনামে চিনত। শ্যামনগরের শান্তি কমিটির নেতা জিয়ারত আলীর সঙ্গে তার দহরম-মহরম। তখন তো জিয়ারত আলী তল্লাটের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার কথায় সারা শ্যামনগর ওঠবস করে। ছবেদালি ওরফে ছবু তার ডান হাত, তার নামে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মাটিসুদ্ধ কাঁপে। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে যেদিন সে রাস্তায় বেরোতো দু-একটা লাশ তো পড়তই। এই নৃশংসতার জন্য তার নাম ফাটল ডেয়ারিং ছবু।
খানসেনারা শ্যামনগর থেকে পালাতে শুরু করলে জিয়ারত আলীর মতো ডেয়ারিং ছবুও মুর্শিদাবাদ কি মালদহ পালিয়ে গেল। হরিনগর বাজারের মুদি দোকানি চৈতনদাশের নেতৃত্বে ডেয়ারিং ছবুর তিন সাগরেদকে গাছের ডালে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখল, দুজনকে খুন করে চুনকুড়ির জোয়ারে ভাসিয়ে দিল। বেগতিক বুঝে বাকিরা কোথায় কোথায় গা ঢাকা দিল। পাঁচ বছর পর ডেয়ারিং ছবু বাড়ি ফিরলে তারাও হঠাৎ চিলা থেকে বেরিয়ে হাটবাজারে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা শুরু করল।
তারপর হঠাৎ একদিন চৈতনদাস খুন। তার ছেঁড়াখোঁড়া লাশ পাওয়া গেল চুনকুড়ির চরে। পুলিশ এসে ভক্তদাসের হাতে হাতকড়া পরাল। যুদ্ধের সময় মাইন বিস্ফোরণে বেচারার ডান পা-টা উড়ে গিয়েছিল। ক্রাচে ভর দিয়ে হাত দুটো জোড় করে সে কত মিনতি করল, ‘খুন আমি করিনি ছার। ভগবান সাক্ষী, আমি খুন করিনি। আমারে ছাইড়ে দেন ছার।’
দারোগা খুব মেজাজি মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, খুনখারাবি মোটেই বরদাস্ত করতে পারেন না। লম্বা গোঁফে তা দিয়ে চোখ রাঙিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘অস্ত্র জমা দিছিস শালা? খুন তুই করেছিস বাইন্চোত্।’
এই ঘটনার মাসখানেক পর হরিনগরের তিন গিরি হিন্দু এক রাতে হঠাৎ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হিঙ্গলগঞ্জ চলে গেল। কেন গেল কেউ কিছু জানল না। কদিন পর গরানপুরের দাসবাড়ি আগুনে পুড়ল। পোড়া ভিটায় গোলপাতার ঝুপড়ি তুলে মাসখানেক গরু-ছাগলের মতো কোনো রকম মাথা গুঁজে থাকল পাঁচ গিরি হিন্দু। তারপর এক রাতে সবার অগোচরে তারাও হিঙ্গলগঞ্জ চলে গেল। বছর দুই তাদের পোড়া ভিটা বিরান পড়ে থাকল। হঠাৎ একদিন আলাউদ্দিন বেড়া দিয়ে বেগুন-মরিচের ক্ষেত শুরু করল। গ্রামে রটাল, কেনাসূত্রে সে এই ভিটার মালিক। কিনেছে হরিনগরের ছবেদালির কাছ থেকে। ছবেদালি কার কাছ থেকে কিনেছে সেই খবর আর কেউ নেয়নি। কে জানে, এমনও তো হতে পারে, ছবেদালি হিঙ্গলগঞ্জ গিয়ে ভিটার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা-পয়সা দিয়ে ভিটাটা কিনেছে। না কিনলেই-বা কী? কে যাবে ছবেদালির সঙ্গে ঝামেলায় জড়াতে! আগের মতো তার ক্ষমতা বাড়ছে দিন দিন। থানা-পুলিশের সঙ্গে তার দোস্তালি। কেউ কিছু বলতে গেলে চৌদ্দ শিকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলে কার কী করার থাকবে!
ফন্দি-ফিকির করে আলাউদ্দিন এখন প্রায় পনেরো-ষোল বিঘা জমির মালিক। যেই না শুনল প্রসূন মাইতির ছাড়াভিটায় স্কুল হবে, অমনি তার কুনজর পড়ল ভিটাটার ওপর। কিন্তু গ্রামবাসীর একতার কারণে এবার সুবিধা করতে পারল না। গ্রামের মানি-গুণীদের নিয়ে কেশব মাস্টার তাকে বাধা দিলেন, ‘এই ভিটেয় স্কুল হবে আলাউদ্দিন। যতই তুমি দলিল দ্যাখাও কেউ মানবে না।’
হেঁসো হাতে মাস্টারের মুখোমুখি দাঁড়াল আলাউদ্দিন। চোখ দুটো গাঁজুড়ির মতো লাল। পেছনে জাবেদ খানের দিকে তাকাল একবার, তারপর চোখ নামিয়ে একগাল হেসে বলল, ‘ঠিক আচে, ইস্কুল হবে ভালো কতা। আমি তো ভিটে দখল কত্তি আসিনি মাস্টারবাবু। বাড়িতি রান্নার কাট নি, তাই দুটো ডাল কাটতি আইচি। গেরামের ভালোর জন্যি যা মনে হয় করো।’
দেরি করলেন না কেশব মাস্টার, পরদিন তার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রসূন মাইতির ভিটার জঙ্গল পরিষ্কারে লেগে গেলেন। হাত লাগাল গ্রামের ছেলে-বুড়োরাও। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুদিনেই জঙ্গল সাফ। ভিটা প্রস্তুত, ঘর তোলার দেরি শুধু, হঠাৎ শুরু হলো ঘোর বর্ষা। জৈষ্ঠ্যের বাতাস সাগরের সব জল তাড়িয়ে এনে জড়ো করল আকাশে। একে তো বর্ষা, তার ওপর জোগার গোন। লোনাজলে মাঠ-ঘাট সব থৈথৈ। মুকনোলির প্রান্তরে হাঁটুজল। অবিরাম বর্ষা জীবনযাত্রা থামিয়ে দিল, স্কুলের কাজ না থামিয়ে উপায় কী!