কালকেউটের সুখ
স্বকৃত নোমান
এক.
এইখানে, চুনকুড়ি নদীর পশ্চিম পারে এসে দেখা যাবে গরানপুরের সীমানা শেষ। মনে হতে পারে, না, কেবল গরানপুরেরই নয়, বুঝি-বা দুনিয়ারও সীমানা শেষ। ওপারে দুনিয়া আছে বটে, তবে সে আরেক দুনিয়া। আকাশ আছে, ডাঙা আছে। চাঁদ সুরুজ খাল নদী গাছগাছালি বাঘ সাপ কামোট কুমির কীটপতঙ্গ সবই আছে – কেবল মানুষ নেই। আর নেই সীমানা, আর নেই দিক। সীমানা হয়ত আছে। উত্তরে গাবুরা, দক্ষিণে ডিঙিমারী বা চাঁদবাড়িয়ার সীমানা হয়ত চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু দিক? বাদাবনে যাদের সাত পুরুষের কারবার – সেই নিবারণ সাধক, মাজেদ গাইন, আজিবর বাওয়ালি বা মহব্বত সাজুনিও কি বনের ভেতরে গিয়ে দিক খুঁজে পায়?
নিশিরাতে দিকচিহ্নহীন বাদাবন সিথানে রেখে গরানপুরের মানুষেরা যখন ঘুমায়, বনের ভয়াল নৈঃশব্দ হামাগুড়ি দিতে দিতে পশ্চিমে বাংলা-ভারতের সীমানা কালিন্দী পর্যন্ত গড়ায়। তখন এই দুনিয়ারও আর সীমানা থাকে না, দিকচিহ্ন থাকে না। সীমানাহীন-দিকচিহ্নহীন দুই দুনিয়া গলাগলি ধরে ভোর পর্যন্ত গড়াগড়ি খায়।
সেদিন মাঝরাতে, দুই দুনিয়ার সঙ্গমকালে, হঠাৎ নিখোঁজ হন কেশব ওরফে কিশোয়ার মাস্টার। তার নিখোঁজ সংবাদে গোটা জনপদ নড়েচড়ে ওঠে। এই বাঘ সাপ কামোট কুমির আর দস্যু ডাকাতের দেশে জলজ্যান্ত মানুষ সবার অজান্তে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। মানুষ গুম হয়ে যেতে পারে, হাওয়া হয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে পারে, মাটি হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে; মানুষ খুন হয়ে যেতে পারে অথবা বাঘ-কুমিরের পেটেও চলে যেতে পারে। অতীতে এমন ঘটনা কত ঘটেছে, বর্তমানেও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। এসব ঘটনা মানুষকে এখন আর তেমন আলোড়িত করে না। এসব শুনতে শুনতে কানে সয়ে গেছে, দেখতে দেখতে চোখে সয়ে গেছে, সইতে সইতে চামড়াটা ঘড়িয়ালের মতো হয়ে গেছে, আঘাতে আঘাতে অন্তরটাও পাথর হয়ে গেছে। কিন্তু কেশব মাস্টার অন্য মানুষ। চুনকুড়ি-মাদার ও কালিন্দী পারের জনপদে তার নাম সবার মুখে মুখে। নামটা শুনলে মানুষের মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগে। তার এমন দুঃসংবাদে জনপদটা নড়েচড়ে তো ওঠারই কথা।
তার প্রতি মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধার কিছু কারণও আছে। মানুষ হিসেবে তিনি কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের। এই কাহিনির পটে যেসব মানুষ দেখা যাবে তাদের চেয়ে আলাদা, অথবা তারা তার চেয়ে আলাদা। দূর গ্রামের একটা মানুষ, যে কোনোদিন তাকে দেখেনি, লোকমুখে কেবল তার নাম শুনেছে, সেও তাকে আলাদা করে চিনে নিতে পারবে।
মণ্ডল তার বংশগত উপাধি। কবে তার কোন পূর্বপুরুষ গ্রামের মোড়ল ছিলেন, সেই ধারাবাহিকতায় তার বাবা মণ্ডল, দাদা মণ্ডল, দাদার দাদাও মণ্ডল। এককালে তিনিও কেশব মণ্ডল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা শুরু করার পর উপাধি পেলেন ডাক্তার। বাড়িতে স্কুল চালু করার পর ডাক্তারের পাশাপাশি মাস্টার উপাধিটাও জুটল। আর ধর্ম বদলের পর স্বাভাবিকভাবেই তার নামেরও বদল ঘটল। কারো কাছে তিনি কিশোয়ার মাস্টার, কারো কাছে কিশোর, কেশর বা কেশু ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি পেলেন। পরবর্তীকালে বাদাবনের চোকার নিচে চাপাপড়া শূলোর মতো সব নাম-উপাধি চাপা পড়ে থাকল কেবল কেশব মাস্টার।
কেশব মাস্টারের পূর্বপুরুষের পেশা ছিল চিকিৎসা। বাবা অনন্ত মণ্ডল ছিল নামকরা কবিরাজ। কলকাতায় আয়ুর্বেদশাস্ত্রে পড়ালেখা করা। হরিনগর বাজারে তার দোকান ছিল – শ্রী বনেশ্বরী চিকিৎসালয়। লোকে তাকে অনন্ত কবিরাজ বলে ডাকত। তার বাবাও ছিল কবিরাজ, যদিও ছেলের মতো অত যশখ্যাতি ছিল না তার। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পড়ালেখাও ছিল না। তবে বারাসতের বিখ্যাত কবিরাজ শ্রী অক্ষয়চন্দ্র রায় ছিলেন তার গুরু। গুরুর কাছ থেকেই ‘শুশ্রুত সমহিতা’ ও ‘চরক সমহিতা’র শিক্ষা নিয়েছিল। হেন রোগ নেই যার চিকিৎসা তার কাছে ছিল না। বিশেষ করে যৌনরোগে তার দাওয়াই ছিল ওস্তাদি। ঘন ঘন স্বপ্নদোষ? বীর্যের দ্রুত স্খলন? মিলনে অনীহা? তবে যাও নরেন কবিরাজের কাছে। ছেলে-সন্তান হচ্ছে না? তবে নরেন কবিরাজের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে থাক। কানের কাছে মুখটা নিয়ে প্রথমে সে এই শ্লোকটা শোনাবে, ‘সে পুরুষ অধম, যে দেখেনি কখন, রমণে রমণী বীর্যের হয়েছে স্খলন।’
তারপর যে দাওয়াইটা দেবে, তুমি তো তুমি, তোমার বাপ-দাদায়ও দেখেনি। খেয়ে তোমার ঔরস থেকে সন্তান বাপ বাপ করে তোমার বউয়ের গর্ভে গিয়ে পড়বে। নরেন মণ্ডলের আমলেই সুন্দরবনঘেঁষা নোনাজলে ধোয়া চুনকুড়ি নদীর তীরে হিন্দু অধ্যুষিত এই নিরালা-নির্জন পাড়াটির নাম হয় মোল্লেপাড়া।
তার বাবা, অর্থাৎ কেশব মাস্টারের বড়বাবা ছিল নামকরা গুনিন। বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়ের সঙ্গে স্বপ্নযোগে তার দেখা হয়েছিল। আর শাজঙ্গলী একবার ঈশ্বরীপুরের যশোরেশ্বরী মন্দিরের প্রয়াত ঠাকুর মতিনন্দী চক্রবর্তীর রূপ ধরে তার কানে কানে কী এক মন্ত্র দিয়ে গেলেন। মৌয়াল-বাওয়ালিদের সঙ্গে বনে ঢুকে মাটিতে হাত রেখে শাজঙ্গলীর দেয়া মন্ত্র পড়ে যখন সে বাঘচালান দিয়ে বাঘের মুখ খিলান করত, যত দুর্ধর্ষই হোক, হেতালঝোপে ঢুকে বাঘ বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ত। বন কেটে সাফ করো, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দাও – মৌয়াল-বাওয়ালিদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘুমটা আর ভাঙত না। তুকতাকেও ছিল পাকা ওস্তাদ। সুন্দরবনের সোয়া শ প্রজাতির গাছগাছড়ার নাম ছিল তার মুখস্থ। সাপেকাটা রোগির বিষ নামানো, হাতে-পায়ে শূলোর ঘা সারানোয় তার দাওয়াই ছিল অব্যর্থ।
বাপ-দাদার কবিরাজি চিকিৎসায় আস্থা ছিল না কেশব মাস্টারের। স্বপ্ন ছিল অ্যালোপ্যাথির বড় ডাক্তার হবেন, বিলেতে গিয়ে এমবিবিএস ডিগ্রি নেবেন। কিন্তু ডাক্তার কি আর চাইলেই হওয়া যায়? বিলেত তো শ্যামনগর নয় যে সকালে হাঁটা ধরো আর বিকেলে গিয়ে পৌঁছ। ডাক্তারি পড়তে হলে কাড়ি কাড়ি টাকার দরকার। এত টাকা তিনি পাবেন কোথায়? বাবার সব জমিজিরাত বেচেও তো জোগাড় হতো না। গরানপুরে তখন কত আর জমির দাম, বিঘাপ্রতি বড়জোর পাঁচশ-এক হাজার। সাত বিঘা জমি বেচলে কত আর হতো!
স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল তার। বাবার কথামতো ম্যাট্র্রিক পাস করে কলকাতায় গিয়ে হোমিওপ্যাথির ওপর এক বছর পড়ালেখা করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালেন। কলকাতা থেকে ফিরে গরানপুর বাজারে একটা ছাওড়া তুলে ডাক্তারি শুরু করার কথা ভাবলেন, কিন্তু যুদ্ধ লাগায় পরিকল্পনাটা ভেস্তে গেল। মানুষ পালাচ্ছে। খুলনা থেকে, বাগেরহাট থেকে, বরিশাল থেকে নদীপথে সুন্দরবন পাড়ি দিয়ে গরানপুর হয়ে কালিন্দী নদী পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় পালাচ্ছে মানুষ। কোলে শিশু, মাথায় বোঁচকা আর পেটে খিদা নিয়ে দলে দলে মানুষ দেশ ছাড়ছে। সীমান্তপথগুলো একে একে বন্ধ করতে থাকে পাকবাহিনী, তবু মানুষ পালায়। দিনে গা-ঢাকা দিয়ে, রাতে নৌকা ছুটিয়ে প্রাণের ভয়ে মানুষ পালাতে থাকে। কেশব মাস্টারের তো তখন পূর্ণ যৌবন। তাকেও পালাতে হয়। সন্দেশখালী দিদির বাড়িতে বউ-বাচ্চা রেখে বারাসতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি যুদ্ধে যোগ দিলেন।
দেশ স্বাধীনের পর মানুষ আবার ফিরতে শুরু করল। মাথায় গুলির দাগ নিয়ে কেশব মাস্টারও ফিরলেন। মণ্ডলবাড়ি তো তখন বিরান, শক্তপোক্ত চৌচালা টিনের ঘরটার নিশানাও নেই। পোড়া ভিটায় তিনি আবার ঘর তুললেন। হরিনগর বাজারে বাবার ‘শ্রী বনেশ্বরী চিকিৎসালয়’ এত দিন তালা দেয়া ছিল, ঝাড়-মোছ দিয়ে তিনি আয়ুর্বেদির বদলে হোমিওপ্যাথির চেম্বার খুলে বসলেন। সকালবেলায় চাষাবাদ আর বিকেলবেলায় ডাক্তারি – পাশাপাশি দুটোই চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
মাথায় হঠাৎ ঝোঁক চাপল গরানপুরের ছেলেমেয়েদের তিনি লেখাপড়া শেখাবেন। এই জল-জঙ্গলের দেশের মানুষ জন্ম-মৃত্যু বোঝে, বিয়ে-থা বোঝে। ঘরসংসার বউ-বাচ্চা হাগা-মোতা বোঝে; ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বাঘ সাপ কামোট কুমিরের সঙ্গে লড়াইও বোঝে – বোঝে না কেবল পড়ালেখা। বুঝে কী হবে? যতই পড়ালেখা করো কারবার তো ওই জল-জঙ্গলেই। ডাঙার বাঘ বলো কি জলের কুমির, তারা কি পড়ালেখার মর্ম বোঝে? যত বড় পণ্ডিতই হও, তুমি তো আর মোবারক গাজীর মতো বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে না। শাজঙ্গলীর মতো বাঘ তো তোমাকে দেখে মাথা নুইয়ে লেজ গুটিয়ে হেতালঝোপের আড়াল হবে না। কুমির তো তোমাকে বড়পীরের মতো গিলে আবার উগরে দেবে না। কেশব মাস্টারের বড়বাবার কি লেখাপড়া ছিল? গাবুরার মেহের গাজী বলো বা তার বেটা পচাব্দী গাজী, জীবনে তো কোনোদিন তারা স্কুল-কলেজের ধারেকাছেও গেল না। তাই বলে তাদের বোধ-বুদ্ধি কি কম ছিল? তারা কি এই বাদাবন দাপিয়ে বেড়ায়নি?
পড়ালেখার জন্য হরিনগরে স্কুল একটা আছে বটে – হরিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু সে তো মেলা দূর। শীতের মৌসুমে না হয় প্রান্তরের পথ ধরে কোণাকোণি হাঁটা ধরলে অল্প সময়ে পৌঁছা যায়। কিন্তু শীত তো সারা বছর থাকে না, প্রান্তরটাও সারা বছর শুকনো থাকে না। তখন যেতে-আসতে দেড়-দুই ঘণ্টা লেগে যায়। কার এত গরজ লেখাপড়ার জন্য ছেলেমেয়ে অত দূরে পাঠাবে? দূরে না হয় পাঠাল, কিন্তু স্কুলে তো আর মুফতে পড়ালেখা হয় না। বই-খাতা দরকার, দোয়াত-কলম দরকার, মাসে মাসে বেতন দরকার, বছরে তিনবার পরীক্ষার ফি দরকার। গরানপুরের জেলে মৌলে বাউলে কিশেনরা দিনে এনে দিনে খায়, ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করানোর বাড়তি টাকা তারা পাবে কোথায়? এর চেয়ে বরং জেলে হয়ে গাঙে যাক, মৌলে-বাউলে হয়ে বনে যাক, অথবা লাঙল-বলদ নিয়ে মাঠে যাক। তাতে দু-পয়সা রুজি হবে। রুজিটাই বড় কথা। রুজির জন্য বাঘের পেটে যেতেও আপত্তি নেই। বছর বছর আট-দশটা মানুষ বনে গিয়ে হাপিস হয়ে যায়। সকালে জলজ্যান্ত মানুষ বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বনে গেল, অথচ রাতে ফিরল কিনা লাশ হয়ে! লাশেরও কি হদিস থাকে? ঘাড় মটকে আদমখোর বাঘ রক্ত আর নাড়িভুঁড়ি খেয়ে ছেঁড়াখোড়া পিঞ্জরটা কোথায় কোন খালের ধারে ফেলে রাখে, জোয়ার এলে স্রোতে ভাসতে ভাসতে বেওয়ারিশ লাশটা কোথায় নিপাত্তা হয়ে যায়, দিনের পর দিন খুঁজেও তো পাত্তা মেলে না।
তবু কী এক জাদু বনবিবির, কী এক সর্বনাশা টান বাদাবনের, বাঁচা-মরার তোয়াক্কা করে না মানুষ। জীবনটা তাদের কাছে হালছাড়া নৌকার মতো, স্রোতে যেদিকে খুশি নিয়ে যাক। জীবনের হালটাকে ছেড়ে দিয়ে রোজ ভোরে তারা বনে ছোটে, আজরাইলের চোখ ফাঁকি দিয়ে জীবন-মরণের সাঁকোয় দাঁড়িয়ে জীবিকার সংস্থান করে। বনই তাদের বাঁচা-মরা, বন ছেড়ে তারা কোথায় যাবে?
বনবিবির জাদুজালে আটকাপড়া এই বনজীবী মানুষদের নতুন কথা শোনালেন কেশব মাস্টার, ‘শোনো ভাই, যাবার আরো জাগা আচে। জগতডা অনেক বড়। গরানপুরের বাইরিও জগত আচে। সেখানে বাঁচা-মরার এমন সর্বনাশা লড়াই নি, মরণের এমন বিভীষিকা নি। সেখানে আরাম আচে, আয়েশ আচে, রোজগারের নানা পথ আচে। বাঘ-কুমিরের সঙ্গে লড়াই আর কত কাল? মশা-মাছির হুল খাতি খাতি, শুলোর ঘা খাতি খাতি শরীরটারে কত আর বিষ বানাবা? জন্তু-জানোয়ারের মতো বনেবাদাড়ে আর কত কাল ঘুরে বেড়াবা?’
কেউ তার কথা বোঝার চেষ্টা করে, কেউ ঠাট্টা-তামাশা ভেবে উড়িয়ে দেয়। কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন মাস্টার, বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেখাপড়ার প্রতি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন, ‘বুঝলে ভাই, জ্ঞানই হচ্চে আসল কথা। জগতডা হলো একটা যুদ্ধের মাঠ। এই যুদ্ধে তোমারে সাহায্য করার মতো কেউ নি। তোমারে আসতি হইচে একা, লড়াই কত্তিও হবে একা। একাকী লড়াই কত্তি কত্তি তুমি যদি জিতে যাও তবেই তুমি জয় কত্তি পারবা মিত্যুকে। তবেই তোমারে হাতজোড় কইরে পোনাম করবে পিথিবী। আর যদি হাইরে যাও, তাইলে পরে পিথিবীর ধুলোয় কুকুর-বিড়ালের মতোন ধুলো হইয়ে মিশে যাবা। কেউ তোমারে মনে রাইখবে না। সুতরাং লড়াইর জন্যি রেডি হও। কিন্তু কী দে লড়বা? অস্ত্র পাইবে কনে? অস্ত্র হইলো জ্ঞান। যত বেশি জ্ঞান অর্জন করবা ততই তুমি হইয়ে ওঠবা পাকা লড়াকু। জ্ঞান এমন এক অস্ত্র, এই অস্ত্র যার হাতে থাকে শত্রু তারে সহজে হারাতি পারে না।’
কিন্তু কে বোঝে তার এসব তত্ত্বকথা! লোকজন হাসাহাসি করে, ‘বেশি লেখাপড়া কুরে মোড়লের ছাবালের মাথাটা বিগড়ে গেচে। নালি কি মানুষ এইরাম আবোল-তাবোল বকে!’ আবার কেউ কেউ যে বোঝে না, তাও নয়। বোঝে। কিন্তু বুঝে কী হবে? গরিব মানুষ, ঠিকমতো দুবেলা খেতে পায় না, ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে পণ্ডিত বানানোর মতো টাকা-পয়সা কোথায়?
কেশব মাস্টার বলেন, ‘টাকা-পয়সা লাইগবে ক্যানো? সব ব্যবস্তা আমি কইরে দ্যাবো। শুদু তোমার ছাওয়ালডারে আমার বাড়িতি পাঠিই দ্যাও। আমার যা সাদ্য শেকাবো, তারপর ঘরের ছাওয়াল ঘরে ফিরে যাবে। মৌলে বাউলে কামলা কিশেন যা বানাও সে তোমার ব্যাপার।’
দশ-বারোটা ছেলেমেয়ে জোগাড় করে বাড়ির উঠোনে ছোট একটা স্কুল চালু করে দিলেন কেশব মাস্টার। মুন্সিগঞ্জ থেকে বাল্যশিক্ষা ও ধারাপাত কিনে আনলেন। ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই-খাতা দেখে যারা স্কুলে আসতে রাজি হয়নি পড়ালেখার প্রতি তাদেরও আগ্রহ তৈরি হলো, নতুন বই পেতে ধীরে ধীরে তারাও স্কুলে আসা ধরল। মাদুর পেতে উঠোনে বসিয়ে দেন মাস্টার, হাতে হাতে বই-খাতা তুলে দেন। লেখাপড়ার প্রতি ছেলেমেয়েদের আগ্রহ দেখে বাবা-মায়েরা নীরবে সাঁয় দেয়। বিনা বেতনে দু-কলম লেখাপড়া করতে পারলে ক্ষতি কি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, জগৎ-সংসারও ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে, এখন কি আর আগের মতো টিপসই থাকবে? জজ-ব্যারিস্টার না হোক, অন্তত দস্তখতটা তো শিখুক।
যত দিন যায় তত ছাত্রছাত্রী বাড়ে, আর বাড়ে মাস্টারের আনন্দ। সংসারের কোনো কিছুতেই তিনি এতটা আনন্দ খুঁজে পান না, যতটা পান ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর সময়। ঝুটঝামেলাও আবার কম বাড়ে না। ঝড়বৃষ্টির দিনে স্কুলটা চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি লাগলে তো আর থামতেই চায় না। ঝরছে তো ঝরছেই। তখন তো ছাত্রছাত্রীদের বসার মতো একটা জায়গা লাগে।
বছর ঘুরলে তারও একটা ব্যবস্থা তিনি করে ফেললেন। গাঁটের কড়ি ভেঙে একটা ছাওড়া তুললেন পুবের ভিটায়। কাঠের খুঁটির ওপর গোলপাতার ছানি। চারদিক খোলা। উত্তর মাথায় খুঁটির সঙ্গে একটা ব্ল্যাকবোর্ড টাঙানো। বোর্ডের সামনে একটা হাতলচেয়ারে তিনি বসেন, আর ছাত্রছাত্রীরা সারি বেঁধে বসে তার সামনে। অল্প দিনেই বেশ জমজমাট হয়ে উঠল তার স্বাধের স্কুল। কেশব ডাক্তারের বদলে সবাই তাকে কেশব মাস্টার বলে ডাকতে শুরু করল।
কিন্তু ওই যে বাদাবনের টান, তন্ত্রমন্ত্রের নেশাধরা রহস্যময় জগতের মায়া! মাইছাড়া হতে না হতেই বাপের আঙুল ধরে যে একবার ওই মায়ার জগতে গেছে, মায়া তো আবার তাকে টানবেই। মায়া মানেই তো টান। এত সহজে কি বনবিবির, যে কিনা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে আঠারো ভাটি শাসন করেন, হাতছানি উপেক্ষা করা যায়? নাকের সিকনি ঝরা বন্ধ হওয়ার আগেই বনের আতিপাতি চিনে নাও। একানী মরানী দেয়ানী ভারানীতে গিয়ে মাছ ধরো, বনের গহীনে গিয়ে গোলপাতা কাটো, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাঠ কাটো, ছাটা কাটতে কাটতে আতিপাতি খুঁজে চাক ভেঙে মধু জোগাড় করো। পদ্মমধু, খলসে মধু পৃথিবীর কোথায় আছে এই সুন্দরবন ছাড়া?
আর বনে যাদের কারবার নেই তাদের তো হালের বলদ আছে, লাঙল জোয়াল আছে। একজনের রুজিতে কত আর কুলায়। ছেলেমেয়ে ফুটফরমাশ খাটলে সংসারের রোজগারটা বাড়ে। রোজগারই বড় কথা। জমিনে গিয়ে হাল দাও, রোয়া লাগাও, ধান কাটো, মাড়াই দাও। ধানের মরশুম শেষ হলে গরুর জন্য ঘাস কাটো, গরু-মোষের পাল নিয়ে মাঠে যাও। নেহাত কোনো কাজ না থাকলে বসে বসে মুরলি বাজাও, তাস মারো, লুডু খেল। কাজের কি শেষ আছে! এত কাজের মধ্যে পড়ালেখার সময় কোথায়?
একদিন দেখা গেল কেশব মাস্টারের জমজমাট স্কুলটা ফাঁকা। ছাত্রছাত্রীরা কেউ আর স্কুলের ধারেকাছে ঘেঁষে না। কী করেন মাস্টার? হাল ছেড়ে দেবেন? না, হাল তিনি ছাড়লেন না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আবার তাদের স্কুলমুখী করলেন। কেউ নিয়মিত আসে, কেউ ফাঁকিঝুকি দেয়। ফাঁকিবাজদের একটা তালিকা তৈরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি আবার তাদের স্কুলে হাজির করেন।
তার এই তৎপরতায় গ্রামের মানুষ বিরক্ত হয়, কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলার সাহস পায় না। বলবেই বা কী, খারাপ তো কিছু করছেন না তিনি। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মানুষ সমাজে কটা আছে? এমন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে কথা বলেই-বা কেমন করে!
কথা যে বলে না তা নয়, বলে। তবে সামনে নয়, পেছনে। মোল্লেপাড়ার নিবারণ সাধক, পাঁচ মেয়ের মধ্যে একটা মাত্র ছেলে তার। মেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের তো আর বাদায় নেয়া যায় না। বাঘসাধনার কাজ মেয়েদের দিয়ে হয়ও না। তল্লাটের সে নামকরা গুনিন। টেংরাখালী, মরাগাঙ, দাঁতিনাখালী এমনকি গাবুরা থেকেও তার ডাক আসে। সে যখন বাদায় পা রাখে দক্ষিণরায় তখন বাঘের পালকে তাড়িয়ে দক্ষিণের জঙ্গলে জড়ো করেন। গুনিন হিসেবে তার বাবারও খ্যাতি ছিল। বাঘের থাবায় বেচারা অকালে প্রাণ হারায়। তাই বলে ছেলে তার সাধনা ছাড়েনি। বাবার সাধনায় হয়ত ঘাটতি ছিল বলে বাঘ তার বশে আসেনি। ছেলের সাধনায় ঘাটতি নেই, তন্ত্রমন্ত্রের জোরে সে বশে এনেছে বনের বাঘ। মৌয়াল-বাওয়ালিদের ওপর ছড়ি ঘোরায় বাঘ, আর বাঘের ওপর ছড়ি ঘোরায় নিবারণ। শুধু বাঘ কেন, বাদার জিন-পরি দেও-দানোরাও তার হুকুমের গোলাম। মৌয়াল বলো কি বাওয়ালি, বনে গেলে তো তাদের দলে একজন গুনিন লাগে। তারা ব্যস্ত থাকে ছাটা কাটা, চাক ভাঙা, কাঠ কাটার মতো কঠিন সব কাজে। আর গুনিন ব্যস্ত থাকে বাঘের থাবা থেকে তাদের রেহাই দেয়ার কাজে। কাজটা তো আর অত সহজ নয়, বলতে গেলে চাক ভাঙা বা কাঠ কাটার চেয়েও কঠিন। রাতদিন সে মৌয়াল-বাওয়ালিদের চারদিকে চক্রাকারে ঘুরে বেড়ায়, ধূপ-ধুনো জ্বালায়, ধোঁয়া দেয়, মন্ত্র পড়ে এ-গাছে ফুঁ দেয় তো ও-গাছের পাতা নাড়ে, গাছে গাছে মন্ত্রপড়া জল ছিটায়। মাঝেমধ্যে গরানের আশাটা উঁচু করে অদৃশ্য বাঘকে ভয় দেখায়। দু-তিন মাইলের মধ্যেও হয়ত বাঘ থাকে না। থাকার কথাও তো নয়। বাঘের পালকে তো তখন দক্ষিণরায় তাড়িয়ে নিচ্ছেন দক্ষিণের জঙ্গলে, অথচ বাঘ তাড়ানোর জন্য নিবারণের এতসব কাণ্ডে মৌয়াল-বাওয়ালিরা মনোবল পায়। মনে বাঘের ভয় থাকে না বলে কাজ করতে পারে নিশ্চিন্তে।
কত স্বপ্ন নিবারণের, ছেলেকে বাঘসাধনার দীক্ষা দিয়ে তার মতো জাঁদরেল গুনিন বানাবে। অথচ কেশব মাস্টার কিনা তাকে নিয়ে গেলেন স্কুলে! সামনে কিছু বলতেও পারে না নিবারণ, পেছনে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে, ‘শালা অকম্মার ঢেঁকি, কী বালের নেকাপড়া শেকাবে, এ্যাঁ? আরে মোড়লের ছাবাল মোড়ল, এ্যাতো শক হলি গণ্ডায় গণ্ডায় ছাইলেপিলে জন্ম দে তোমার ইস্কুলি ভত্তি করাচ্চ না ক্যানো? পরের ছাইলেপিলে নে এ্যাতো টানাহেঁচড়া ক্যানো? ছাবাল জন্ম দিচি আমি। জজ-ব্যারেস্টার বানাবো, না ডোঙাড়ে কোদালে বানাবো সে আমার ব্যাপার। তোমার এত মাতা ব্যথার কারণডা কী?’
নিবারণের মনের কথা বোঝেন না মাস্টার, তা নয়। বোঝেন। মুচকি হেসে বলেন, ‘ছেলেটারেও তন্ত্রমন্ত্র শেখাবা নাকি নিবারণ? মানুষ কত্তি হবে না?’
চেপে রাখা রাগটা খাই খাই করে ওঠে নিবারণের। মুখ ফসকে বলেই ফেলে, ‘আমার ছাবালকে তোমার কি গরু-ছাগল মনে হয় মাস্টারমশাই?’
মাস্টারমশাই এবার হা হা করে হাসেন, ‘ফারাক কনে নিবারণ? গরুও খায়, তোমার ছাবালও খায়। গরুও নাদে, তোমার ছাবালও হাগে। ফারাক শুধু এটুকু, গরু চার পায়ে হাঁটে, তোমার ছাবাল হাঁটে দু-পায়ে। ছাবালরে মানুষ কত্তি চালি এট্টু লেখাপড়া তো দরকার নাকি?’
কথা আর বাড়ায় না নিবারণ, চুপ মেরে যায়। তা ছাড়া আর উপায় কী। যতই মন্ত্রটন্ত্র আওড়াক, নিজে একটা অকাট মূর্খ, সে তা ভালো করেই জানে। পণ্ডিতের সঙ্গে মূর্খের কি তর্ক সাজে?
একই কারণে কেশব মাস্টার তার ছাত্রছাত্রীদের গায়ে মাঝেমধ্যে বেত চালালেও কেউ প্রতিবাদ করে না। প্রতিবাদের কী আছে, বেতের বাড়ি না খেলে তো বলদও হাল টানে না। কেউ কেউ ছেলেকে হালের বলদের মতো ধরেবেঁধে মাস্টারের হাতে তুলে দেয়, ‘এই দে গেলাম। চোক দুটো বাদ দে যা পারো মাইরো, শুদু ছাবালডারে এট্টু মানুষ কুরে দ্যাও মাস্টারবাবু।’
হাতে একটা ‘বর্ণমালা পরিচয়’ আর একটা ‘ধারাপাত’ ধরিয়ে দিয়ে মাস্টারমশাই ছেলেকে মানুষ করতে লেগে যান। তাই বলে আবার পরের ছেলের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেন না। আদর-সোহাগের কমতি রাখেন না, কিন্তু লেখাপড়ায় গাফলতি দেখলে অল্পবিস্তর শায়েস্তা করতেও ছাড়েন না। পাকা জালিবেতটা তো হামেশা তার হাতেই থাকে, কখন কার পিঠে সওয়ার হয় কে বলতে পারে! মাঝেমধ্যে এমনও দেখা যায় স্কুলঘরের খুঁটির সঙ্গে অথবা আঙিনার পেয়ারাগাছটার সঙ্গে গরুর দড়িতে কারো হাত পিচমোড়া বাঁধা। অপরাধ, সে দুদিন স্কুল কামাই দিয়েছে। আবার কখনো কেউ কান ধরে সূর্যমুখী একপায়ে খাড়া। অপরাধ, এক মাসেও সে তিনের নামতাটা মুখস্থ করতে পারেনি।
বাপ ডেকে, মা ডেকে, বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে আদর-সোহাগ করে ছাত্রছাত্রীদের বাল্যশিক্ষা আর ধারাপাতটা মুখস্থ করাতে পারলেই খুশি মাস্টার। এরই মধ্যে কেউ চলে যায়, কেউ আরো পড়ালেখার জন্য থেকে যায়। থেকে যাওয়াদের তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ দেন। ছড়া, কবিতা, গরুর রচনা আর ‘পিতার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র’ লেখা শেখান।
দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ শেষ হলে মাস্টার নিজেই চান ছাত্রছাত্রীরা এবার স্কুল ছাড়–ক। মানুষ তো তিনি একা, এত ছাত্রছাত্রী সামলাবেন কেমন করে! কিন্তু চলে যেতে বললেই কি তারা যায়? বনের নেশা কাটতে কাটতে ততদিনে তাদের লেখাপড়ার নেশায় পেয়ে যায়, আরো ওপরের ক্লাসে উঠে তারা মাস্টার-ফরেস্টারের মতো বড় মানুষ হতে চায়। মাস্টার বলেন, ‘ওপরে তো আর ক্লাস নি বাবারা। আরো পড়তি চালি হরিনগর স্কুলি গে ভর্তি হও।’
হরিনগর? সে তো বাবা মেলা দূর। কে যাবে অত দূরে ভর্তি হতে! ভর্তি হলেও দু-চার দিন হয়ত ঠিকমতো আসবে-যাবে, তারপর আবার বনের নেশায় পেয়ে বসবে। তখন আগে যা শিখেছিল তাও ভুলেটুলে যাবে।
অগত্যা হরিনগর থেকে বাড়তি দুজন মাস্টার এনে ক্লাস থ্রি চালু করে দিলেন তিনি। দুই মাস্টারের বেতন পঞ্চাশ করে এক শ। এই বেতন দিয়ে মাস্টার রাখা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব, তাই জনপ্রতি ছাত্রছাত্রীর ওপর এক টাকা বেতন ধার্য করে দিলেন। বেতনের কথা শুনে প্রথম দফায় কিছু ছাত্রছাত্রী কমে গেল। যারা থাকল তাদের কেউ বেতন দেয়, কেউ আজ দেবে কাল দেবে করে শেষ পর্যন্ত দেয় না। মাস শেষে ষাট-সত্তুর টাকার মতো আদায় হয়, বাকি টাকা গোলার ধান বেচে জোগাড় করতে হয় মাস্টারকে। কী আর করবেন, জোগাড় তো করতেই হবে। বলদের জোয়াল যখন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বইতে তো হবেই।