শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
বেনাপোলের কাছাকাছি সীমান্ত এলাকা। দালালরা জনপ্রতি দু’ শ’ টাকা নিচ্ছে। তাদের আজ পোয়া বারো। বলা যায় সিজন পড়েছে। গতকাল থেকে ভারতে লোক যাওয়া শুরু হয়েছে। কে কী জন্য যাচ্ছে দালালদের জানা নেই। ভোলা, উজিরপুর, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর থেকে বেশ অনেক লোক এসেছে পার হতে। তবে সমস্যা হল সীমান্তের অবস্থা ভালো না। তাই লোকজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যায় পার করা হবে। ইতোমধ্যে কয়েক জনকে বিডিআর ধরেছে। দালালদের একজন সাইকেল স্ট্যান্ড করতে করতে একা একাই বলল, ‘শালার বিডিআর হইল দুমুখো সাপ। সব দিকে থাকে।’
অখিল পোদ্দার হেমেন কাকা, নিয়তি আর আল্পনাকে নিয়ে সীমান্ত এলাকার একটি বাড়ির উঠানে অপেক্ষা করছেন। উঠানে অপেক্ষা করতেও ভাড়া দিতে হয়। পেটে প্রচ- ক্ষুধা। কিন্তু কারো খাবার রুচি নেই। সময় যেন ফুরাতে চায় না। বোধকরি কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। হেমেন গাঙ্গুলী অখিল পোদ্দারের দিকে তাকালেন। অখিল যেন এ দু’দিনেই তার মতো বুড়িয়ে গেছে।
এক সময় আরেক দালাল এসে ডাক দিতেই তাঁরা পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলেন। দালালের পিছনে আরো একটি পরিবার। চেনাশোনা কেউ না। আলাপ পরিচয়ের সময়ও এখন না। যত তাড়াতাড়ি এই দেশ থেকে কাঁটাতার পার হওয়া যায়। নিয়তির অবস্থা ভীষণ খারাপ। হেঁটে হেঁটে একটি ফসলের মাঠ পার হতে হল। নো ম্যান্স ল্যান্ড আর দূরে নেই। ওই তো সামনে। হঠাৎ দুই তিনটা টর্চ জ্বলে উঠল। দালাল বলল, ‘নিচু হন! সবাই নিচু হন!’
অপরিচিত পরিবারের লোকটি বলল, ‘ধরা পড়লে অসুবিধা হবে?’
দালাল বলল, ‘কন্টাক্ট করা আছে। কিন্তু বলা তো যায় না। দুই পারের শালারাই মাঝেমাঝে বেঈমানি করে।’
সবাই কাঁটাতারের কাছাকাছি চলে এল। পাশ দিয়ে দালাল দ্রুত সবাইকে রেখে পার হয়ে এগিয়ে গেল পথ ক্লিয়ার কি না দেখতে। হেমেন গাঙ্গুলী দেখলেন কাঁটাতার যে অংশে নেই তার কাছেই একটি গাছ। গাছের দুটি ডালে পাতা নেই। চাঁদের বিপরীতে আলো-আঁধারে মনে হচ্ছে একটি অনেক উঁচু মানুষ দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ডাল দুটোকে মনে হচ্ছে নোমানের কাটা হাত যেন ওপরে তুলে আছে। যেতে বাধা দিচ্ছে। নোমান বলছে, ‘কাকা কই যান?’
হেমেন গাঙ্গুলীর চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিনি বিড়বিড় করে অতি নিচু স্বরে বললেন, ‘যাই বাবা, পারলাম না।’
ঠিক বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে পার হওয়ার সময় অখিল দু পা পিছিয়ে এল। পেছন ফিরে থু-থু করে দু’বার থু ফেলল।
হেমেন কাকা চোখে প্রশ্ন নিয়ে অখিলের দিকে তাকালেন। অখিল পোদ্দার তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ কাকা, থুতু ফেললাম! আপনেও ফেলেন। আপনেও ফেলেন কাকা!’
একটি ফাঁকা জায়গায় এসে হেমেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশের দিকে ফিরে তাকালেন। তারের বেড়া কালো দেখা যাচ্ছে। দূরে ইমিগ্রেশনের আলো। বাংলাদেশের দিক থেকে হালকা একটি বাতাস এসে তার চোখে মুখে লাগল। গভীর চোখে তাকিয়ে দেখলেন। চোখের সামনে ভেসে উঠল মকবুলের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির মুখটি।
তিনি অশ্রুসজল চোখে বিড়বিড় করে বললেন, ‘বাই।’