শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
হেমেন গাঙ্গুলীর মাথার শাদা চুলগুলো উসকো খুসকো হয়ে আছে। পাথরের মত বসে আছেন। বিমর্ষ আরেক বৃদ্ধ মকবুল সাহেব বসে আছেন হেমেন গাঙ্গুলীর সামনে। তাঁর হাতে একটি খুতি। অনেকক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর মকবুল সাহেব বললেন, ‘বিয়ের সময় আমার বৌকে তুই একটা কানের দুল বানিয়ে দিয়েছিলি। জিনিসটা তোর ভাবীর খুব পছন্দের ছিল। তাঁর মৃত্যুর দু-তিনদিন আগে হাসপাতালে বিছানায় বসে হাসতে হাসতে বলছিল, আমি যদি মরে যাই, হেমেনদা যে কানের দুলটা দিয়েছিল, সেটা তুমি সবচেয়ে পছন্দের মানুষকে দিয়ো। আমি বহু ভেবে দেখেছি, এ জগতে আমার সবচেয়ে আপন মানুষ তুই।’
হেমেন গঙ্গোপাধ্যায় চোখ তুলে তাকালেন।
মকবুল সাহেব বললেন, ‘এর মধ্যে ভরি দশেক সোনা আছে। আর বড় ছেলেটা আমেরিকা থেকে আমাকে এক হাজার ডলার পাঠিয়েছিল। ভাঙানো হয়নি। এগুলো নে।’
হেমেন গঙ্গোপাধ্যায় চোখ তুলে তাকিয়ে শক্ত করে বললেন, ‘এগুলো দিয়ে আমি কী করব?’
‘ওপার গিয়ে কী মানুষের কাছে হাত পাতবি, ভিক্ষা করবি? হিন্দুদের অনেকে মনে করে, ওপারে গেলেই স্বর্গ অপেক্ষা করছে। কিন্তু তুই আমি তো জানি, কত কঠিন জীবন সেখানকার বাস্তবতা।’
হেমেন বাবু বললেন, ‘যত কঠিনই হোক, এগুলো আমি নেব না। এর দাবিদার তোর সন্তানরা।’
‘আমার ছেলে মেয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ওটাই ছিল আমার কর্তব্য। তা ছাড়া দাবী একটি আপেক্ষিক বিষয়। আইন দিয়ে দাবী নির্ধারণ হওয়া উচিত নয়। শেষ বয়সে আমাকে আঘাত দিস না। নে, ধর।’
মকবুল সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে হেমেন গাঙ্গুলী হাতে না নেওয়ার সাহস পেলেন না।
তিনি হাতে নিতেই মকবুল সাহেব ঘুরে হাঁটতে শুরু করলেন। দুই পকেটে হাত রেখে পেছনে না তাকিয়ে বললেন, ‘বাই।’