শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
সন্ধ্যায় দোকান থেকে ফিরে এসে অখিল পোদ্দার দেখলেন ঘর-দোর খোলা। কেউ নেই! ঘরের টিভি, শোকেস ভাঙা, কাঠের সিন্দুক ভাঙা! সারা ঘর জিনিসপত্রে ছড়াছড়ি! অখিল পোদ্দারের মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি লাফ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। দৌড়ে গেলেন পাটোয়ারির বাড়িতে। ঢুকে পড়লেন পাঠখড়ির বেড়া দেওয়া উঠানে। চিৎকার করে বললেন, ‘ও দিদি! আমার বাড়িতে কী হইছে দিদি!’
দরজা খুলে বের হয়ে এল পাটোয়ারি, বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘কই আমরা তো কিছু জানি না? তয় যাই ঘটুক, বেগানা পুরুষ ছেলে হইয়া আপনে আমার বাড়ির ভেতর ঢুকে পারেন না!’
অখির পোদ্দার কেঁদে দিয়ে বললেন, ‘মাফ করেন আমারে দাদা! আমার মাথা ঠিক নাই। আমার স্ত্রী আর মেয়ে নাই, ঘরের সব জিনিসপত্র ভাঙা!’
পাটোয়ারি এবার পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারল। অখিল পোদ্দারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সর্বনাশ!’
অখিল পোদ্দার আরো দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
পাটোয়ারি বলল, ‘শিগগির থানায় যান। এ ছাড়া আর কী করবেন?’
দিশেহারা অখিল পোদ্দার থানার দিকে ছুটতে থাকলেন। মুখে ডাকতে থাকলেন, ‘আল্পনা! ও নিয়তি! কী হইল রে!’
ডিউটি অফিসারের নির্লিপ্তভাবে বসে আছেন। বিরক্ত হয়ে ডিউটি অফিসার বলল, ‘আরে ভাই এত বড় দুনিয়া, কুথায় খুঁজবো আপনের বৌ আর মে’?’
‘দারোগা সাহেব! আপনের পায়ে পড়ি, কিছু একটা করেন?’
দারোগা হাতের সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিল। তার চেয়ার ছেড়ে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। বলল, ‘করতে তো চাই, পারি কোথায়? জিডি করেন, জিডি করেন। আর মুন্সিরে কয়টা পয়সা দিয়া যান। খরচাপাতি আছে!’
অখিল পোদ্দার এই শোকের মধ্যেও মুহূর্তের জন্য থ’ বনে গেলেন। তারপর বের হয়ে দৌড় দিলেন। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে অখিল পোদ্দার উপস্থিত হলেন মাহবুব চৌধুরীর বাড়ির সামনে। তখনও বেশ লোকজন তার বাড়িতে।
বাড়ির চত্বরে ঢুকে তিনি দেখলেন মাহবুব সাহেব কথা বলছেন আর সবাই শুনছে।
তিনি বললেন, ‘ম্যাডামের প্রোগ্রাম একটু আগে জানতে পারলাম। তিনি সর্বপ্রথম যাবেন ওমরা পালন করতে সৌদি আরব। সেখান থেকে চার দিন পর দেশে ফিরবেন।’
তাকে ঘিরে থাকা লোকদের মধ্যে দু-তিন জন বলে উঠল, ‘শুক্র্ আল হামদুলিল্লাহ্!’
অখিল পোদ্দার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সবাই তার দিকে ঘুরে তাকাল।
অখিল পোদ্দার হাত জোর করে বললেন, ‘হুজুর বাঁচান!’
মাহবুব সাহেব ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছেন। বললেন, ‘আপনি কে? কী হয়েছে?’
‘আমার মে’ আর বৌরে ধইরা নিয়া গ্যাছে! আমারে বাঁচান হুজুর।’
‘কে ধরে নিয়ে গেছে? চেনা চেনা লাগছে, আপনার নাম কী?’
অখিল পোদ্দার কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘হুজুর, আমি সেই ফুটবলার অখিল পোদ্দার! মনে আছে হুজুর?’
মাহবুব সাহেব তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘কে ধরে নিয়ে গেছে?’
‘কে নিছে কইতে পারবো না। আপনে সাহায্য করলে ফিরা পাব হুজুর!’
‘আমি কি সাহায্য করতে পারি? থানায় যান! ক্ষমতায় তো আমরা না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। তারাই দেখবে।’
তিনি অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এইখানে আমার কিছু করার আছে?’
কয়েকজন বলে উঠল, ‘জ্বি না স্যার, আপনি কী করবেন।’
কে যেন বলে উঠলো, ‘এইগুলা স্যার বানোয়াট কাহিনি। আমাগো দোষ দেওয়ার ফন্দি! কুথায় লুকায় রাখছে তাই দ্যাহেন। বিদেশের কাছে বদনাম করার চেষ্টা।’
কোনো আশাই নাই। অখিল পোদ্দার বের হয়ে আসছেন। পেছন থেকে আরো কে একজন বলল, ‘ভোটের বেলায় নৌকা আর বাঁচানোর বেলায় আমরা! মানুষ এখন আর অমন বোকা নাই!’
তিন-চার জন তাকে সমস্বরে সমর্থন করে উঠল। অখিল পোদ্দার দরজার কাছে থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। মাহবুব সাহেবের পায়ে পড়বে কি না বিবেচনা করছেন। মাহবুব সাহেব বললেন, ‘থাক, যেতে দাও!’
মাহবুব সাহেব অন্য লোকদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘স্ত্রী কন্যা তো আমাদেরও আছে। তাদের তো কেউ কিছু বলে না! দেশবাসী হিন্দুদের কোলে নিয়ে বসে থাকার জন্য আমাকে ভোট দেয় নাই।’
কেউ কেউ উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘জি ভাই, খাটি কথা।’ কেউ বলল, ‘মাশাআল্লাহ, সোবহানআল্লাহ।’
অখিল পোদ্দার দ্রুত বের হয়ে এলেন। কেউ নেই। কোনো আশা নেই। রাত তিনটার সময়ে তিনি চিৎকার দিয়ে সদর রাস্তার মাঝে বসে পড়লেন।
শেষ পর্যন্ত ভোরবেলা নিয়তি আর তার মাকে খুঁজে পাওয়া গেল। ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত অবস্থায় যেন আদিম দুই নারী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ছেঁড়া জামাকাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা যাচ্ছে না। শেষ রাতে একজন চলে যাওয়ার সময় একজন খানিকটা ফিরে এসে নিয়তির জামা আর পাজামা তুলে নিয়ে গেছে। পাশে পড়ে থাকা আল্পনার পেটিকোট আর ব্লাউজই শুধু রয়ে গেছে।