শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
আজ সন্ধ্যা বেলায়ই সমস্ত উপজেলা থমথম করছে। রাস্তা ঘাটে কোনো মানুষ নেই। উপজেলা অফিসের সামনে শুধু প্রচুর মানুষ। আর অধিকাংশ মানুষ ঘরে গিয়ে টেলিভিশনের সামনে বসেছে। সবাই উৎসুক। কী হয় ফলাফল।
সন্ধ্যায় যখন সুকুমার টিভির সামনে বসা তখনও সে ভরসা দিয়ে বলল, ‘দাদা, চিন্তা কইরো না তো। আরে না হইলেও আওয়ামী লীগ ১২০ আসন পাবে। তাইলেও দেইখো হাসিনা সরকার গঠন করবে। আওয়ামী লীগের বান্দা সীট কেউ নিতে পারবে না।’
কিন্তু রাত দশটার দিকে সুকুমার চুপ হয়ে গেল। যত খবর আসছে টিভিতে তাতে দেখা যাচ্ছে বিএনপি বা চারদলীয় জোট অনেক এগিয়ে! হিসাব পুরাপুরি কল্পনার বাইরে!
সবাই চুপ হয়ে আছে। অখিলবাবু বললেন, ‘সুকুমার, তুই একটু সইরা থাক। ভোরবেলাই একটু গা ঢাকা দে। বলা তো যায় না। কি দিয়া কি অয়।’
‘আর তুমরা?’
‘আমাগো আর কি অবে? আমরা তো বাড়িই আছি। তা ছাড়া আমরা তো আর পার্টি করি না। নির্বাচনের কাজেও নামি নাই। তোরে নিয়াই হইল সমস্যা।’
‘আমারে নিয়া কী সমস্যা? আমিও তো নির্বাচনের কামে নামি নাই?’
‘যে কোনো জায়গায় রাজনৈতিক সমস্যা হইলে প্রথম শিকার হয় যুবক-তরুণরা। শুনিস নাই ’৭১ সালের কথা। যুবক পাইলেই আর রক্ষা ছিল না!’
টেলিভিশন যখন বন্ধ করা হলো তখন রাত একটার মতো বাজে। সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। ঘুমাতে গিয়ে আল্পনার ঘুম আসছে না। বাইরে একটা কুকুর করুণ সুরে কাঁদছে! সেই কান্না মানুষের কান্নার মতো শোনায়।
আল্পনা বললো, ‘ঘুমাইছেন নাকি?’
অখিলবাবু বললেন, ‘না।’
‘বাইরে কুকুর কানতেছে!’
‘কানবেই তো। কুকুর কানবে না? কুকুরের কি সুখ-দুঃখ নাই?’
‘কুকুর কান্দা ভালো না। আমরা তখন ছোট। মার কাছে শুনছি একাত্তরের গোলমালের আগে খালি কুকুর কানত।’
অখিল পোদ্দার চোখ বুজে আছেন। তারও ভয় ভয় করছে। কুকুর কাঁদার কথাটা মিথ্যা না। তিনি তার বাবা, ঠাকুরদার কাছে শুনেছেন বাংলা পঞ্চাশের বড় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। হাজার হাজার, অগণিত মানুষ সেই দুর্ভিক্ষে মারা গেছিল। দুর্ভিক্ষের আগের দিনগুলোয় নাকি সারারাত কুকুর কাঁদত। তিনি নিজেও স্বাক্ষী। ’৭১ সালের মার্চ মাসের ২৩-২৪ তারিখ যত কুকুর ছিল আশেপাশে সব সুর করে কাঁদতে থাকল। আমরা কিছুই বুঝতে পানি নাই। শুধু আলোচনা করছি, কুত্তা এমুন পাগলের মত কান্দে ক্যান! আবার ফরিদপুরে পাকিস্তান আর্মি যেদিন ঢুকল, তার আগের রাত্রে কুকুরগুলো পাগল হইয়া উঠেছিল। তবুও তিনি স্ত্রীকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘আরে এইগুলা কিছু না! সব কুসংস্কার, তুমি ঘুমাওতো!’
আল্পনা বললেন, ‘আমাগো কোনো সমস্যা নাই তো?’
‘কী সমস্যা? একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বদল আইছে। একদল ঠকছে আরেক দল জিতছে। এতে দেশবাসীর সমস্যার কি আছে! সারা দুনিয়ায় এমুন পরিবর্তন হইতেছে।’
বাইরে আবার কাছেই দুটো কুকুর সুর করে কেঁদে উঠল। দূরে অন্য আরো একটি কুকুরের কান্না শোনা যাচ্ছে। অখিল বাবুর বুকের মধ্যে কেমন এক অজানা ভয় যেন বয়ে যেতে থাকল।
আল্পনা তাঁর একটা হাত অখিলবাবুর বুকের ওপর রাখলেন।