শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
আজ ১ অক্টোবর। বাংলাদেশের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গত তিনমাস যারা নির্দলীয় সরকারের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা ওয়াদা করেছেন, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। ফলে ভোট কেন্দ্রে গোলমাল-টোলমাল হবে বলে মনে হয় না। সকালে অখিল পোদ্দার বের হয়ে যাবার সময় বললেন, ‘নিয়তির মা, সকাল সকাল ভিড় কম থাকতে ভোট দিয়ে আসো। পরের দিকে ঝামেলা হয়।’
আল্পনা স্নান সারলেন। লাল পাড়ের শাড়িটা পড়লেন। আয়নার সামনে বসে যতœ করে মাথায় সিঁদুর দিলেন। কপালে সিঁদুরের টিপ নিলেন। ভাবলেন, যাক, নিয়তির বাবা ভোট নিয়ে কোনো কিছু বলেন নাই। বাঁচা গেছে!
নিয়তিও খুব মজা পাচ্ছে। সে ভোটার না। কিন্তু মায়ের সাথে ভোট কেন্দ্রে যাবে। সেও তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছে। একটা উৎসব বলে মনে হচ্ছে।
আল্পনা নিয়তির হাত ধরে ভোট কেন্দ্রের দিকে রওয়ানা হলেন। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। তিনি ঘর তালা দিয়ে যাচ্ছেন।
সব মানুষ ভোট কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছে। চারদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব। কারো কারো চোখে-মুখে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ। তিনি দ্রুত পা ফেললেন।
ভোটকেন্দ্রের কাছাকাছি এসে লক্ষ্য করলেন অনেক লোকই তার দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে। কোত্থেকে দৌড়ে আসলো একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা। আল্পনার ঠিক সামনে ছেলেটি এসে নৌকাহ্ নৌকাহ্ বলে লাফ দিল। আশপাশের মানুষ উচ্চৈস্বরে হেসে উঠল। আল্পনা অবাক হয়ে গেলেন। একটু লজ্জাও পেলেন। ছেলেটির মনের ভাব তিনি বুঝতে পারলেন না।
স্কুলের শ্রেণিকক্ষগুলো ভোট কেন্দ্র। তিনি মাঠের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। অনেকবার তিনি ভোট দিয়েছেন। এই কেন্দ্রে হিন্দু ভোটারও ছিল বেশ। তারা সকাল সকালে ভোট দিতেন। সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়াতেন। এই অপেক্ষার সময় একে অপরের খোঁজ খবর করতেন।
এবার সামনে দেখা যাচ্ছে প্রচুর মানুষ হয়ে গেছে সকালবেলাই। মহিলাদের বুথের সামনে অনেক বড় লম্বা লাইন। প্রায় সবাই কালো বোরকা পরণে। আল্পনা তাকিয়ে দেখলেন ছাড়া ছাড়া দু-একজন হিন্দু মহিলা দেখা যাচ্ছে। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা। তাদের সবার মুখই মলিন। তিনটি লাইনে মহিলারা দাঁড়িয়েছে। তিনটি বুথে ভোট দিবেন। আল্পনা মাঝখানে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
তিনি বাড়ি থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন এবার ধানের শীষে ভোট দেবেন। কে কী ভাবলো তাতে কিছু করার নেই। শুধু নিয়তির বাবাকে কিছু বলা হয়নি। যা বলে বলুক। ভোট দিয়ে গিয়ে তাকে বলবেন ধানের শীষে ভোট দিয়েছি। তিনি হয়তো ঝামেলা করবেন। তবে তিনি উগ্র মানুষ না। ধানের শীষে ভোট দিয়েছে শুনলে হয়তো বলবেন, এইটা কী করলা? তিনি বলবেন, কী করব, রীনার মা খুব কইরা ধরল। অখিল বাবু বলবেন, ধরলেই দিতে অবে? রীনার মারে তুমি ধরলে সে কি নৌকায় ভোট দিত? যাক্ যা হওয়ার হইছে।
দুই পাশ থেকে বোরকা পড়া মহিলারা তাকে কী কী যেন বলছে। বাঁয়ের লাইনে একজন বোরকার নীচ থেকে তাকে দেখিয়ে বলল, ‘ঐ দেখ্ নৌকার গুলুই!’
আল্পনার ভীষণ খারাপ লাগছে। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, আমি নৌকায় ভোট দিতে আসি নাই, আমি ধানের শীষে ভোট দিতে আইছি! আমি আপনেগো মতোই ভোটার! এমুন করতেছেন কেন!
তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। মাথার ওপর রোদ আস্তে আস্তে কড়া হচ্ছে। গরম বাড়ছে। মানুষের চাপাচাপিতে এখন অসহ্য গরম শুরু হয়েছে। নিয়তিকে তিনি পেছনে একটি জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। তিনি পেছনে চেয়ে দেখলেন নিয়তি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় চোখ করে চারদিক দেখছে। একটু একটু করে লম্বা লাইন এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে তাঁর পেছনেও অনেক মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন থেকে মাঝে-মধ্যেই ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু সামনেও মেয়েলোক আছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এত বোকা পড়া মেয়েলোক আস কোথা থিকা? এই এলাকায় তো এমন ছিল না!
আল্পনা প্রায় বুথের কাছে চলে এসেছেন। এখন আর কয়েকজনের পরেই তার পালা। আল্পনার বুক ধুকপুক ধুকপুক করে কাঁপছে। তিনি এবার ভোট দিতে একা এসেছেন। আগে ভয় করেনি। যতীন জ্যাঠার ছেলের বৌ, মেয়েরা থাকত। জেঠিমাও আসতেন। মানুষ একা হলে বাগানের ফুলও তাকে উপহাস করে।
হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন ডানপাশের লাইনে কয়েকজন তাকে নিয়েই হাসাহাসি করছে। তার ভেতর থেকেই এক মেয়ে দৌড়ে এসে আল্পনার কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে জোরে বলল, ‘ও দিদি, নৌকায় চইড়া কি ভারত যাওয়া যাবে? পদ্মা যে শুকায় গ্যাছে! আপনেরা শুকায় ফেলাইছেন!’
লাইনে দাঁড়ানো নেকাব পড়া একজন মহিলা বলল,‘বাদ দে, এগো হুশ অবে না। এগো বলার চেয়ে কলাগাছেরে গিয়া বলা ভালো। তাতে কলাগাছ ফল দিত।’
আশপাশের কয়েকজন মেয়েলোক হা: হা: হি: হি: করে হেসে উঠল। আল্পনার মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিনি বুথে ঢুকলেন। বুক ফেটে কান্না আসছে। ব্যালট পেপার হাতে নিয়ে দ্রুত চট দিয়ে ঘেরা জায়গাটিতে ঢুকলেন। সিল তুলে নিলেন। হাত থরথর করে কাঁপছে। ব্যালট পেপারের দিকে বড় চোখ করে তাকালেন। তার গলা দিয়ে, গাল দিয়ে ঘাম ঝড়ছে। তিনি সিলটি নামিয়ে এনে নৌকা মার্কার উপর সজোরে চেপে ধরলেন! ব্যালটে আঁকা নৌকাটির উপর গাঢ় দাগ পড়ল। এখন নৌকাটিকেই চেনা যাচ্ছে না। তিনি ব্যালট ভাঁজ করে বাক্সে ফেলে দ্রুত পায়ে বের হয়ে আসলেন।
বাড়ির পথে ফেরার সময় দেখা হল রীনার মা আর রীনার সাথে। তারা ভোট কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছেন। রীনার মা হেসে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ‘কি বৌদি, ভোট দিছেন তো ঠিকঠাক মতো?’
আল্পনা কোন কথা বললেন না। রীনার মাকে দেখে কান্না আরো বেগে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। তিনি দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। নিয়তি পিছে পিছে ছুটছে।
রীনার মা অবাক হয়ে পেছন থেকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর রীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে হে হে রীনা, অত সোজা না। কইছিলাম! বেঈমানের জাত, ভোট দেয় নাই! হারে হিন্দু চিনি জন্মের থিকা। কাইটা দুই ভাগ করলেও ভিতরে ঢুকতে পারবি না!’