শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
নিয়তির ইতিহাস পড়তে খুব ভালো লাগে। ইতিহাসের সব কথা তার কাছে গল্পের মতো লাগে। পড়তে বসলেই সে বাংলা, অঙ্ক রেখে ইতিহাস বই নিয়ে বসে। সে এখন ক্লাস এইটে পড়ে। উনিশজন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে নিয়তিই পট পট করে ইতিহাসের প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়। তাই মাঝে মধ্যেই ইতিহাসের শিক্ষক মোজাফফর স্যার দেখা হলে ঠাট্টা করে বলেন, ‘কী রে নিয়তি, সেরাজুদ্দৌলা কেমন আছে রে? সম্রাট আশোক কী খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে?’
দুপুরে খাবার শেষে মা বললেন, ‘একটু বই নিয়া বয়।’
নিয়তি ইতিহাস নিয়ে বসল। ইতিহাসের স্যার আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ওপর টিক চিহ্ন দিয়েছেন। স্যার বলেছেন, আওরঙ্গজেব থেকে একটি প্রশ্ন আসবেই।
কিন্তু আওরঙ্গজেবের কাহিনি পড়তে ওর ভাল লাগে না। সেদিন মকবুল দাদু বলেছিলেন, ‘কিছুদিন আগে আফগানরা যে বৌদ্ধ মূর্তি দুটো ভেঙে দিল, ও দুটো প্রথম ভাঙতে চেষ্টা করেছিল এই আওরঙ্গজেব হারামজাদা। মুঘল শাসকদের মধ্যে সেই ছিল সবচেয়ে ধার্মিক, খারাপ এবং নিষ্ঠুর। বাবাকে বন্দি করে বড় ভাইকে মাথা কেটে সেই মাথা একটি পাত্রে খাবারের মত করে সাজিয়ে বাবার কাছে পাঠিয়েছিল…।’
মকবুল দাদু বলেছেন, ‘আওরঙ্গজেব একটা পিশাচ ছিল…।’
মিছিল আসছে! নিয়তি পড়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ল। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখল বিরাট মিছিল। এত বড় মিছিল সে জীবনে দেখেনি! অনেক মানুষ।
বাবা ঘরে শুয়ে আছে। সে বাবাকে দৌড়ে গিয়ে খবর দিল, ‘বাবা দ্যাখ, কত্তো বড় মিছিল!’
বাবা শুয়ে রইলেন। উঠলেন না। সে দৌড়ে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখতে থাকল।
মিছিলের সামনে কয়েকজন হাতে হাত বেঁধে হাঁটছে। পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে একজন আরেকজনের সাথে ধাক্কাধাক্কি খাচ্ছে। তার পেছনে লোকগুলো পায়ে পায়ে হাঁটছে। কত মানুষ! এতবড় মিছিল যে মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা হয়ে হয়ে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। প্রথম ভাগে একজন বলছে, ভোট দিন ভোট দিন, আর সবাই সমস্বরে বলছে, ধানের শীষে ভোট দিন।
মিছিলের প্রথম অংশের পর সামান্য একটু ফাঁকা। তারপরের অংশে যুবক ধরনের ছেলেরা নেচে নেচে মিছিল করছে। ছন্দে ছন্দে একটি ছেলে নাচছে, আর বলছে, ‘হাসিনারে হাসিনা-’ একসাথে অনেক লোক বলছে, ‘তোর কথায় নাচিনা।’ ছেলেটি আবার বলছে, ‘তোর বাপের কথায় নাইচা’ সাথে সাথে অনেক লোক বলছে, ‘দ্যাশ গ্যাছে ভাইসসা।’
ছেলেটি আবার বলল, ‘হাসিনারে হাসিনা…’
অন্য লোকগুলো একসাথে বলল, ‘দ্যাশটা তো বাপের না…’
নিয়তি একবার মাকে একটু ঠেলা দিয়ে বলল,‘ও মা দ্যাশটা কার?’
আল্পনা বিড়বিড় করে বললেন, ‘জানি না, চুপ থাক!’
বিরাট মিছিল। ফুরায় না। মিছিলের এই অংশ পার হয়ে যেতে বেশ সময় নিল। এবার তৃতীয় অংশ চলে এসেছে। এই অংশেরও অধিকাংশ ছেলেই তরুণ-যুবক।
আল্পনা নিয়তিকে নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে মিছিল দেখা যায়, কিন্তু মিছিলের লোকগুলো তাদের দেখতে পাচ্ছে না। তবুও তার বুক দুরু দুরু কাঁপছে! মিছিল দেখার আনন্দ নেই। বরং কেমন ভয় ভয় করছে।
মিছিলের তৃতীয় অংশে একটি ছেলে বলছে, ‘একটা দুইটা মালু ধর।’
অন্য লোকগুলো বলছে, ‘সকাল বিকাল নাস্তা কর।’
আল্পনা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। ভয়ে, রাগে ঘৃণায় তার কান্না আসছে। তিনি সোজা গিয়ে অখিল বাবুর পাশে বসলেন।
নিয়তির কাছে মায়ের এই আচরণের কারণ স্পষ্ট না। সে পিছে পিছে এসে দেখল মা মুখে কাপড় ধরে বসে আছেন। তবুও সে জিজ্ঞেস করল, ‘ও মা মালু কী?’
মা উত্তর দিলেন না। অখিল পোদ্দার নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘মালু হইলাম আমরা রে মা। ’
বিকালে ভাল জাতের সমস্যায় পড়লেন আল্পনা। শাহজাহান পাটোয়ারীর স্ত্রী এসেছেন। সাথে তার মেয়ে রীনা। তার হাতে ধানের শীষের লিফলেট।
ইতিমধ্যে দুই পরিবারের ভেতরে কিছুটা যাতায়াত শুরু হয়েছে। মৌখিক সৌজন্যতায় কোনো কমতি নাই দুই পরিবারে।
‘বৌদি, আপনের কাছে আসলাম। কেমুন আছেন?’
‘আসেন আসেন দিদি।’
‘বৌদি কুনো অসুবিধা নাই তো?’
‘কীসের অসুবিধা?’
‘কেউ আপনেগো ডিসটাব করে নাতো?’
‘না দিদি। ভগবানের কৃপায় আছি, কুনো অসুবিধা নাই।’
‘কুনো অসুবিধা অইলে আমাগো জানাবেন বউদি। আমরা আচি কী করতে?’
আল্পনাভরসা পেলেন। বললেন, অবশ্যই জানাবো।’
‘বৌদি, একটা আবদার নিয়া আসছি। কোনদিন আপনের কাছে কোনো দাবী করি নাই, করছি?
‘না।’
‘আইজ একটা দাবী নিয়া আইছি। তিনি আল্পনার দুই হাত ধরে বললেন, বৌদি, কোনো সুময় কিছু চাব না, শুধু একটা অনুরোধ, ভুটটা আমাগো বাক্সে দিবেন। মাহবুব চৌধুরীর ধানের শীষে।’
আল্পনা জানেন সারা জীবন তারা নৌকার ভোটার। এবারো তাদের ভোট নৌকায়ই যাবে। কিন্তু ভোটের সময় অনেক প্রার্থীর লোক এসে ধরে, নানা ধরনের অনুরোধ করে, প্রলোভন দেখায়। ওতে ভোলার কোনো কারণ নাই।
এবারো অখিল পোদ্দার তাকে যথারীতি বলে দিয়েছেন, ‘শোন, ভোট চাইতে আসলে কারো না করবা না। আবার পুরাপুরি কথাও দিবা না। একমাত্র নৌকার লোক ছাড়া সবাইকে বলবা, অসুবিধা নাই, আপনাদের কথা আমাগো মাথায় আছে। বিবেচনা করতেছি। আসলে বিবেচনা করবা না। বিবেচনার কিছু নাই, কারণ অন্যগো ভোট দিলেও বিশ্বাস করবে না।’
আল্পনা বললেন, ‘অসুবিধা নাই, এইবার আমরা বিবেচনা করতেছি। আমাগো মাথায় আছে।’
শাহজাহানের স্ত্রী আরো শক্ত করে হাত ধরলেন। বললেন, ‘বৌদি কথা দেন ভোট দিবেন! অন্তত আমগো মুখের দিকে চাইয়া!’
আল্পনার মন গলে গেল। তিনি দ্রুত চিন্তা করলেন। কী আছে, একটা ভোটের ব্যাপারই তো। একটা ভোটে এমন কী। প্রতিবেশী মানুষ, সারা জীবন তাদের সঙ্গে উঠা-বসা করতে হবে। একটা ভোট দিতে সমস্যা কী? এদের ভোট দিলে তো মনে রাখবে। এত শক্ত হইলে চলে না।
তিনি বললেন, ‘কথা দিলাম। আমি ধানের শীষে ভোট দিব।’
উজ্জ্বল হয়ে উঠল পাটোয়ারির বৌয়ের মুখ, ‘আপনে ভোট দিবেন বৌদি! সত্যি আপনি ভোট দিবেন! আলহামদুলিল্লাহ্! আপনের ভোটটা পাইলাম বৌদি! আমার আর কোনো দাবি নাই।’
তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। এখনো সন্দেহের চোখে আল্পনার দিকে তাকাচ্ছেন, ভোট পাইলাম বৌদি?’
আল্পনা আবার বলল, ‘আমি কথা দিছি! আপনে নিশ্চিন্ত থাকেন। আমি ধানেই ভোট দিব!’
‘আইচ্ছা বৌদি, আহা! এরকম যদি সব হিন্দু হইতো, তাইলে আমাগো কোনো কষ্টই ছিল না। বৌদি কী আমাগো সঙ্গে যাবেন নাকি?’
‘কুথায়?’
‘আমরা ক্যাম্পেনে বাহির হইছি। বাড়ি বাড়ি গিয়া ভোট চাইতেছি। চলেন যাই। ভোটই যখন দিবেন আর আপত্তি কইরা লাভ কী ’
‘না দিদি, ওর বাবা এখনই আসবে।’
‘আইচ্ছা ঠিক আছে, ওই হিন্দুবাড়ি দুইটায় একটু চলেন। আপনের কাছে দাবী আছে দেইখাই কইতেছি। আপনের ভুট চাইতে অবে না। আপনি শুধু দাঁড়ায় থাকপেন, সাইনবোট।’
পরপর দুটি বাড়িতে যেতে হল আল্পনাকে। দুটোই হিন্দু বাড়ি। অনেকটা দড়ি গলায় নিয়ে গরু-ছাগল যেমন ইচ্ছা না-থাকা সত্ত্বেও এগোয়।
আল্পনা নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। পাটোয়ারির স্ত্রী জোর গলায় বলল, ‘এখন আর আগের মতো সময় নাই। আপনাগো সম্প্রদায় বুঝতে পারছে এক জায়গায় ভুট দিয়া লাভ নাই। কি পাইছে এই জীবনে? আইজ এই দ্যাখেন, বৌদিও বিষয়টা বুঝতে পারছে। সে কিন্তু ধানে ভুট দিবে। আপনেরাও একটু বিবেচনা করেন।’
বাড়ির মধ্যবয়সী গৃহিণী বললেন, ‘অসুবিধা নাই, আমরাও বিবেচনা করতেছি।’
‘তাইলে আইজ আসি। আরো কয়েক জায়গা যাইতে অবে।’
শাহজাহান পাটোয়ারির স্ত্রী আর মেয়ে সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে অন্য বাড়ির উদ্দেশে চলে গেল।
হিন্দু বাড়ির মধ্যবয়সী গৃহিণী আল্পনার সামনে এগিয়ে এলেন। তার মুখে পান। চোখের দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘অসুবিধা নাই, আমাগোও কথা দিতে অয়। পরশুদিন কয়েকটা লোক আইসা পিস্তল দেখাইয়া ভাতের মইধ্যে হাত রাখাইয়া কথা নিছে, ধানের শীষে ভোট দিব। আমিও ভাত, মাছ, জল সব ছুইয়া কসম কাটছি ভোট ধানের শীষরেই দিব!’
তিনি একটু থামলেন। তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু ভগবান নাইমা আইলেও না! ভগবানের কি সাথে চোউখ নাই! ভগবান হিসাব জানে না!’
আল্পনা ওই বাড়ি থেকে ফিরে আসলেন। হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন, দিদি যাই বলুক, আমি কথা দিছি। ভোট আমি ধানেই দিব। একটা ভোটের জন্য এতবড় মিথ্যা কাজ করতে পারব না।
শাহজাহানের স্ত্রী হাঁটতে হাঁটতে মেয়ে রীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে রীনা, তোর কি মনে অয়, ভোট দিবে?’
‘হে, মা। মনে হইতেছে ত দিবে। তুমারে কথা দিছে। তার চোখেমুখে কইতেছিল সে সত্যি কথাই বলতেছে। ক্যা হিন্দুরা ভোট দিতে পারে না?’
রীনার মা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললেন, ‘আমার তা মনে অয় না। মালাউন কা বাচ্চা কাভি নেহি আচ্ছা। যো ভি আচ্ছা ও শুয়োর কা বাচ্চা। পাকিস্তানিরা বইলা গেছে।’
তারপর গলা নিচু করে বলল, ‘নিয়তির মা আরো চালাক। চোখ মুখ দেখিস না? সিন্দুরের ফুটা দেইখা বুজিস না?’