শেকড়ের দাগ
মহসীন হাবিব
এ যেন এক হৈ হৈ আর রৈ রৈ ব্যাপার। যেন উৎসব লেগেছে। প্রতিহিংসার উৎসব। উপজেলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার মুখে মুখে শুধু ইলেকশন। কে হবেন এবার এমপি। রোকনুজ্জামান নাকি মাহবুব চৌধুরী। আওয়ামী লীগ না বিএনপি?
রাস্তায় রাস্তায় কর্মীদের মিছিল। মিছিলে অল্পবয়সী আর ভারীবয়সী বলে কথা নেই। আগে দেখা যেত মিছিলে শুধু যুবকরাই। এখন মিছিলের সামনের দিকে, মাঝখানে চুল-দাড়ি পাকা মানুষও দেখা যায়। একের পর এক রাস্তা দিয়ে মিছিল চলে যাচ্ছে। সরগরম উপজেলা। এই একদল নৌকা, নৌকা করতে করতে চলে গেল। এক-দুই মিনিট পরেই দেখা যায় ধানের শীষ, ধানের শীষ করতে করতে আরেক দল চলে এসেছে।
গোটা উপজেলায় যেন দুই দলের পোস্টার ব্যানার দিয়ে সেজেছে। কোথাও একটু দেয়াল পর্যন্ত ফাঁকা নেই। এখন যদি একটি ফাঁকা জায়গা খুঁজে পেয়ে সেখানে লেখা হয়, একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচান। রক্তের গ্রুপ ….পরক্ষণে দেখা যাবে সেই লেখার ওপর পোস্টার চেপে বসেছেÑ লেখা আছে, দেশ ও জনগণের নেতা অমুক ভাইকে ভোট দিন! এখন দেশবাসীর রোগী বাঁচানোর সময় না। এখন ভোটের সময়।
রোকনুজ্জামানের পোস্টারের ছবিতে পুরু গোঁফ। গোঁফের রং হয়েছে নীল। তার গায়ে মুজিব কোট। বাঘের মতো বদমেজাজী চেহারা হলেও মুখে একটা হাসি হাসি ভাব দেখা যাচ্ছে। পোস্টারের ওপরে লেখা জয় বাংলা, একটু ফাঁক করে লেখা বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম। ডানপাশে লেখা জয় বঙ্গবন্ধু।
পোস্টারে আরো দু’টি ছবি দেওয়া হয়েছে। একটি শেখ হাসিনার অন্যটি বঙ্গবন্ধুর। উপজেলাবাসীকে আহ্বান জানানো হয়েছে পুনরায় ভোট দিয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে অংশ নিতে। পোস্টারের নীচে ছোট করে লেখা – প্রচারে: উপজেলাবাসী।
মাহবুব চৌধুরীর পোস্টারে লেখা – বাংলাদেশ, মাঝখানে বিসমিল্লাহির রহমানের রহিম, তারপর জিন্দাবাদ।
ঠিক তার নীচেই জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার দু’টি ছবি। এরপর বড় ছবিটি মাহবুব চৌধুরীর। চোখে চশমা। রাশভারী চেহারা। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। দেখলেই বোঝা যায় অভিজাত পরিবারের লোক। তিনিও মিটি মিটি হাসছেন। এই হাসিটা তার নিজের না। ছবি তোলা শেষ হতেই হয়তো তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হাসির খোসাটি লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন।
এই পোস্টারটিরও নীচে লেখা – প্রচারে : উপজেলাবাসী।
রোকনুজ্জামান সাহেবের বাসায় অনেক লোকের ভিড়। আগামীকাল শেষ মিছিল। কাল মধ্যরাতের পর মিছিল-মিটিং ও প্রচারণায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে। কাল বিশাল মিছিলের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা জানেন, মিছিলের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। মিছিলের লোকের সংখ্যা দেখেও অনেকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। উপজেলায় মোট ১৭টি ইউনিয়ন। সব ইউনিয়নে সকাল থেকেই মিটিং শেষে মিছিল বের করতে হবে। মিছিল উপজেলা প্রদক্ষিণ করে চলে যাবে সোনা ঘাট। এজন্য মোট ১৫টি ট্রাক লাগানো হবে সকাল থেকেই। সব ব্যবস্থা করা আছে।
রোকনুজ্জামান সাহেব একটু চিন্তিত। ১৭টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের মধ্যে ১৩টি এবার আওয়ামী লীগের সাথে বেঈমানী করেছে। তিনি রাতের খাবার খাচ্ছেন। মানিক সরদার খাবে না। ক্ষিদে নেই। সে রোকন সাহেবের পাশে বসে আছে। রোকন সাহেবকে তাগিদ দিল, ‘ভাই আরেকটা মাছ নেন।’
‘না, আর লাগবে না।’
‘খাওয়া দাওয়াটা ঠিক রাখা দরকার ভাই। তা না হলে শরীর খারাপ করবে। এমনিই আপনার শরীর ভাল যাচ্ছে না। এর মধ্যে খাটাখাটনি করতে অবে।’
‘তুই খেয়ে নে।’
‘আমি ঠিক আছি ভাই, কোনো অসুবিধা নাই। আমরা এখন যাবো ময়েনুদ্দিনের বাড়ি। সেইখানে মিটিং কইরা যাবো কারিকর পাড়ায়।’
রোকনুজ্জামান বললেন, ‘কারিকর পাড়া ঠিক আছে না?’
মানিক জোর গলায় বলল, ‘সব ঠিক আছে।’
তারপর নিচু গলায় বলল, ‘কয়েকটা ঘরে একটু ঝামেলা আছে। কিছু পয়সা ছাড়তে অবে। ওইটা আপনি চিন্তা কইরেন না, আমি দেখপ।’
‘হারে মানিক, এই চেয়ারমেনগুলো, বেঈমানগুলো ঝামেলা করায় আমাদের একটু মুশকিল হল না?’
‘আরে ভাই রাখেন তো! মানুষ আইজকাল চেয়ারম্যানের কথায় ভোট দেয় নাকি? আপনে নিজে ফিল্ডে নাইম্যা দ্যাখতেছেন না?’
পাশে আরো কয়েকজন কর্মী ডাইনিং ঘিরে বসে আছে। তারা প্রায় সমস্বরে বললÑ ‘মানিক ভাই ঠিকই কইছে ভাই।’
মানিক সরদার বলল, ‘ভাই যেইখানে গেছি, জিগান এগো কাছে, সবখানে একটা আলাদা ফুর্তি আছে।’
‘হাজার হাজার লোকের আমার সাথে সাক্ষাত অইছে। সবাই হাইসা দিয়া কয়, ভাই, আমরা দরকার হইলে সামনের উপর, সবাইর সামনে সিল মারব।’
রোকন সাহেব শুনে ভরসা পেলেন।
মানিক সরদারের মনে সত্যিই আনন্দ। সে নিশ্চিত যে নৌকা মোট এক লাখ তেতাল্লিশ হাজার ভোটের মধ্যে কমছে কম আশি হাজার ভোট পাবে। তার গতবারের একটা কাহিনি মনে পড়ল। মজার ঘটনা। মানিক সরদার মাঝে-মধ্যে মজার ঘটনা খুব ভালবাসে।
‘বুঝলেন ভাই, গতবারের কথা। আমি দাঁড়াইয়া আছি মুন্সিবাড়ী সেন্টারে। দেখি ছেলে পেলেরা এক থুরতুরা বুড়িরে ধইরা নিয়া আইছে ভোট দিতে। বুড়িরে যত্ন কইরা ধরছে। তার মধ্যে এই জাফরও ছিল, ছিলি না?’
‘হ, বাই, আমিও ছিলাম।’
‘সে কি এইখানকার বুড়ি! সেই নোটাডাঙ্গা বাড়ি! ওরা তারে পর্থমে ডিঙ্গিতে আইনা তারপর ভ্যানে কইরা স্কুল পর্যন্ত আনছে। বুড়ি এখন মরি তখন মরি অবস্থা, নারে?
জাফর বলল, ‘হ বাই। এতদিনে মরছে সিওর।’
মানিক বলল,‘বুড়িরে জিগাইলাম, “দাদি, মার্কা ঠিক আছে তো? বুড়ি কইল, হ, ঠিক আছে।” আমি কইলাম, “কী মার্কা, কও দেহি?” সে কইল, “নাও।” খুশি হইয়া দশ টাকার একটা নোট হাতে দিয়া কইলাম, “যাও সুন্দর কইরা ভোট দিয়া আস।”
মানিক সরদার এই গল্পটা বলে খুব মজা পাচ্ছে। সে হাসতে হাসতে বলছে। ‘বুড়ি ভোট দিয়া বাহির অইয়া আসলো। আমি জিগাইলাম, “ও দাদি দিছ তো ঠিকভাবে?” বুড়ি কইল, “হ দিছি।” আমার ক্যা জানি সন্দেহ অইল। জিগাইলাম, “নাও মার্কায় ঠিক মত দিছ তো?” বুড়ি কী কয় জানেন?’
রোকনুজ্জামান মুচকি হেসে বললেন, ‘কী বলে?’
‘বুড়ি কয়, “চৌক্ষে ভাল দেহি না। নাওতো আমি দ্যাখলাম না। চিনবার পারলাম ধান, তাইতে দিয়া আইছি।”’
মানিক সরদার এবার হাসি থামিয়ে কৃত্রিম রাগের ভাব করে বলল, ‘ভাই, এমন রাগ অইছিল, মনে অয় বুড়িরে খুন করি। দেখি হাতের মধ্যে দশ টাকার নোটটা শক্ত কইরা ধইরা রইছে। আমি একটা ছোঁ মাইরা টাকা নিয়া গেলাম। জাফররা তখন কোনদিকে যেন গেছে। বুড়ি দাঁড়ায় দাঁড়ায় কইতে থাকল, “ও বাবারা আমারে বাড়ি দিয়া আয়, কই গেলি, আমারে বাড়ি দিয়া আসার কতা কইয়া আনলি?”
‘আমি কইলাম, বুড়ি তুমারে নদীর মধ্যে ফেলাব। তুমারে কোলে কইরা বাড়ি দিয়া আসপে মাহবুব চৌধুরী।’
‘বুড়ি একটু থাইমা কয়, মাহববু চৌধুরি কিডা?’
জাফর স্মৃতি হাতড়িয়ে বলল, ‘ছাত্তার ভাইও তহন আমাগো সাথে ছিল।’
প্রায় সাথে সাথে মানিক সরদারের চেহারা পাল্টে গেল। সে বলল, ‘ঐ কুত্তার বাচ্চার নাম আমার সামনে নিবি না! ইলেকশনটা যাক্। আমি ওরে এইবার খাইয়া ফেলাবো! আল্লাহ-আল্লাহ্ কইরা ক্ষমতায় আসতে দে! খালি কোনো রকমের হাসিনা আফা সরকারডা গঠন করুক! আমি ছাত্তারের কিরিচ ছাত্তারের পাছায় যদি না ভরছি, তাইলে মানিক না!’
রোকানুজ্জামান এত কথা জানেন না। তিনি বললেন, ‘কী করেছে ও?’
‘ভাই, না করছে কী! গিরামের এক দল পুলা নিয়া হেমেন ঠাকুরের বাড়ির ওই মেয়েটারে কে ধর্ষণ করছে?’
‘কে?’
‘এই ছাত্তার। ওর সঙ্গে ছিল বিএনপির কিছু পুলাপাইন।’
‘বলিস কী?’
‘শুধু তাই না, মোয়াজ্জেম সাহেবের ইউনিভার্সিটি পাস পোলাডারে খামোখা কোপাইছে এই ছাত্তার আর ওর সঙ্গের সন্ত্রাসীরা। সাংঘাতিক বিদ্যান পোলা। দুই টাকার ছাত্তার আর ওর সাথেরগুলা একটাও নাম সই করতে পারে না। অথচ কত বড় বিদ্যান পোলাটার লাইফ নষ্ট কইরা দিল। আহা! মোয়াজ্জেম সাহেবের মত পরহেজগার মানুষটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।’
‘ও নাকি তোর আস্কারাতেই যত বাড়াবাড়ি করেছে? দু-এক জন আমাকে কানে কানে বলেছে।’
‘সেই জন্যেই তো ওরে এইবার দেইখা নিব!’
‘সে সুযোগ কি পাবি মানিক?’
‘অবশ্যই পাবো!’
‘তুই যত কথাই বলিস, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে না। বাড়াবাড়ি করিস না। এদিক ওদিক কিছু হয়ে গেলে ওরা কিন্তু তোকে মার্ডার কেসে ফেলবে। বিএনপি কতটা প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে তা তোর জানা নেই। তারচেয়ে বড় কথা এবার যদি আল্লাহ না করুক ক্ষমতা ওদের হাতে যায়, তাহলে দেশ কিন্তু চালাবে খালেদ জিয়া না।’
মানিক অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,‘তাইলে কে?’
‘খালেদা জিয়ার দুই পুত্র। বিশেষ করে তারেক রহমান। ক্ষমতার চোটে দিশেহারা হয়ে যাবে। বিকৃত হয়ে উঠবে।’
রোকনুজ্জামান একটু থামলেন। তারপর চিন্তিত মুখে বললেন, ‘বাপ একটি দেশের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় যে কিশোরদের পড়ালেখা হয় না, স্কুল থেকে বের করে দেয়, তাদের মানসিক গঠন কোন পর্যায়ের ভাবা যায় না।’
রোকনুজ্জামানের অভিজ্ঞতা কম নয়। তিনি কেমন যেন গতিহীন হয়ে পড়েছেন। বললেন, ‘আমরা তো এখান থেকেই শেকড়ের রাজনীতি করে বড় হয়েছি। প্রতিটি ঘরের, প্রতিটি তল্লাটের খবর আমাদের কাছে থাকতো। ওই যে ছাত্তারের কথা বললি, ও এমন বিকৃত স্বভাবের হয়েছে কেন জানিস?’
‘জ্বি না।’
‘সাত্তারের বাবার নাম ছিল নুতা মোল্লা। বাড়ি বাড়ি পরেতের কাজ করতো। অসম্ভব ভাল একজন মানুষ ছিল। শিক্ষাদীক্ষা ছাড়া একটা মানুষ যতটা মহান হতে পারে নুতা মোল্লা তা-ই ছিল। মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। নুতা মোল্লার ঘরে অভাব ছিল, কিন্তু তা নিয়ে বেচারার কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু ছাত্তারের মা ছিল অত্যন্ত লোভি এবং উচ্ছৃঙ্খল। এসব খুবই নোংরা আলোচনা। কিন্তু তবুও আজ বলছি। নুতা মোল্লা কাজে চলে যাওয়ার পরই ছাত্তারের মা ঘরে লোক ঢুকাতো। কখনো কখনো এসব কাজ সে ছাত্তারকে কোলে নিয়েই চালাতো। দেখে দেখে ছাত্তারের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মনে রাখবি, কারো মা দুশ্চরিত্র হলে সন্তান যদি তা বুঝতে পারে, তাহলে সেই সন্তানের মধ্যে কোনো নৈতিকতা তৈরি হয় না, কারো প্রতি মায়া বোধ করে না, কোথাও তার প্রতিশ্রুতি তৈরি হয় না। সে হয়ে ওঠে মানুষরূপী একটি পিশাচ।’
মানিক অত্যন্ত শঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাই, আপনার কেন মনে অইতেছে যে আওয়ামী লীগ এইবার ক্ষমতায় আসপে না?’
‘এদেশের মানুষ একদলকে বারবার ভোট দেয় না। ক্ষমতার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চায়। নির্বাচনের আগ দিয়ে তাদের একটি নেশার মত তৈরি হয়। মনে হয়, সরকার পরিবর্তন হলেই নতুন সরকার এসে তাদের ঘরের বাজারটাও করে দেবে।’
তিনি উঠে পড়লেন। এবার একটু গলা উঁচু করে বললেন, ‘মানুষ যথেষ্ট সরলও আছে। রাজনীতিবিদরা যা বলে ওরা তাই বিশ্বাস করে। আমরা মুলত সেই সুযোগটাই নিয়ে থাকি।’