কথাসাহিত্যিক মোখলেস মুকুল একজন শেকড় সন্ধানী লেখক। তাঁর লেখায় মানুষের যাপিত জীবনের নানান সংকট, অসঙ্গতি, সমাজের অবহেলিত শ্রেণির মানুষের নিরন্তর টিকে থাকার সংগ্রাম, প্রকৃতির বিরূপ খেলায় নিঃস্ব মানুষের আর্তনাদ, প্রেম এমনকি নিয়তি ভীষণভাবে উঠে আসে।
কথাসাহিত্যিক মোখলেস মুকুলের জন্ম ১৯৬৪ সালে, পাবনা শহরে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক, মেডিসিন ও এজমা বিষয়ে স্নাতকোত্তর। কবিতা, গল্প ও উপন্যাস এই তিনধারাতেই তিনি লেখেন। তবে উপন্যাস লিখতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাঁর লেখা গল্পগ্রন্থের মধ্যে চাকা, কাঁকড়াকাল, কবিতার মধ্যে শূন্য, উপন্যাসের মধ্যে মন্ময়বৃক্ষ, বঙ্গালী ভইলী, অতঃপর করোনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ উপলক্ষে ‘বাইশ শ বাইশ’ শিরোনামে তাঁর লেখা একটি নতুন উপন্যাস প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। উপন্যাসটির বিষয়, বিস্তার, সময়কাল ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশি নভেলসকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
বাংলাদেশি নভেলস : ‘বাইশ শ বাইশ’ উপন্যাসের উপজীব্য ও এর নামকরণ প্রসঙ্গে আমাদেরকে যদি কিছু বলেন।
মোখলেস মুকুল : উপন্যাসটি মূলত মানুষের ও প্রকৃতির অস্তিত্ব সংকটকে নিয়ে লেখা। আপনারা জানেন, সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকায় যে ‘জোলা’ শ্রেণির মানুষের বসবাস, যারা হাতচালিত তাঁতে লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা মূলত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। নদী ভাঙ্গনে এদের ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল বিলীন হয়ে যায়। জীবনের প্রয়োজনে তারা আবার নতুন করে ঘরবাঁধে, কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ আচরণের মাধ্যমে তারা আবার সব হারায়। নদীভাঙ্গন, ভূমিকম্প, খাদ্যসংকট মোকাবেলা মানুষকে টিকে থাকতে হয়। মানুষের জীবনে সংকটের পাশাপাশি প্রেমও আসে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই প্রেম হারিয়ে যায়।
ভাগ্যবিড়ম্বিত, বাস্তুহীন মানুষেরা একখণ্ড মাটিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু অর্থের প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভুঁইয়ে পাড়ি জমাতে চায়। অবৈধ পথে দালালদের মাধ্যমে অবৈধপথে বিদেশে যাওয়ার পথে নানান ধরণের অত্যাচার এমনকি হত্যার শিকার হয়। তারপরেও কেউ কেউ দেশান্তরিত হয়। নানান উপায়ে অর্থ উপার্জন করে বিত্তশালী হয়। ঘটনাক্রমে তরুণ বয়সের ভালোলাগার মানুষটিকে একান্ত নিজের করে পেতে তার জীবনসঙ্গীকে পরিকল্পিতভাবে খুন করে। আবার প্রকৃতিতেও একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর দুর্যোগ আসে। যেমন ২০২০ সালে এসেছিলো করোনা, ১৯২০ সালে এসেছিলো স্প্যানিশ ফ্লু । আবার পূর্বপুরুষের ডায়েরি পরে, নিজভূমিতে ফিরে আসলে সন্ধান করতে থাকে তার বাস্তুভিটার। ভবিষ্যতে দেশের আয়তন কমে যাবে, জনসংখ্যা বেড়ে যাবে। সেসময়ে প্রচণ্ড মাত্রার ভূমিকম্পে সমস্ত শহর বিদ্ধস্ত হয়ে যাবে। রেসকিউ করার মতো যন্ত্রপাতিও থাকে না। একদিকে অতীত, অন্যদিকে ভবিষ্যতের মানুষের ও প্রাকৃতিক সংকট নিয়েই এ উপন্যাস।
বাংলাদেশি নভেলস : এ উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র ও তাদের সম্পর্কের সাযুজ্য বা বৈপরীত্য সম্পর্কে বলুন ।
মোখলেস মুকুল : প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশান্তরী হওয়া হতভাগ্য এক কিশোর মাসুদ রহমান। চাকরির মোহে কিশোরী প্রেমিকা মালতিকে ফেলে ঢাকায় চলে যায় । ঢাকার কালশি এলাকায় গিয়ে আরো আরো হতদরিদ্র বস্তিবাসীদের সে দেখে । বজলু মাসুদের বন্ধু। বজলু ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমায় । তার সাথের বাকি যাত্রীরা মারা যায় । এক পর্যায়ে মাসুদ অর্থ আত্মসাৎ করে পাড়ি জমায় ব্রাজিলে। সেখানে মারিয়ামার প্রেমে পড়ে। মারিয়ামা ও বজলুসহ একসঙ্গে ছয় বন্ধু ব্রাজিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে । পথিমধ্য আমেরিকার দশটি দেশ অতিক্রম করতে গিয়ে পাঁচজনই মৃত্যুবরণ করে। একমাত্র মাসুদ বেঁচে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রে পোঁছায়। ভাগ্যক্রমে দেখা হয় কিশোরকালের প্রেমিকা মালতির সাথে। তখন মাসুদের অনেক টাকা, মাসুদ মালতিকে নিজের করে পেতে মালতির স্বামীকে খুন করে ।
কালক্রমে যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষমতা হারায়। মানুষ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যেতে থাকে। ঘটনাক্রমে মাসুদ রহমানের দৌহিত্র মাসুদ জুনিয়র বাংলাদেশে ফিরে আসে । এক অতিরিক্ত জনসংখ্যার বাংলাদেশকে দেখতে পায়। মালতি নামের এক সুন্দরী গাইডের সাথে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে আকস্মিক ভূমিকম্পে তাদের মৃত্যু হয়। তাদের অতৃপ্ত আত্মার প্রশ্ন জাগে, প্রতি এক শ বছর পরপর পৃথিবীতে যে ডিজাস্টার নেমে আসে এবং এভাবে চলতে থাকলে বাইশ শ বাইশ সালে পৃথিবীর কী হবে? সার্বিকভাবে বিষয় বৈচিত্র ও একটু বড় পরিসরের ভেতর দিয়েই উপন্যাসের চরিত্রগুলো সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশি নভেলস : সাম্রতিককালে ‘বঙ্গালী ভইলী’ শিরোনামে একটা উপন্যাস লিখেছেন, খুব ছোট করে যদি এটার সম্পর্কে বলেন।
মোখলেস মুকুল : ‘বঙ্গালী ভইলী’ একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। বাংলা ভাষার প্রাচীনযুগের লেখ্যভাষা ছিল সংস্কৃত। তখন অন্তজশ্রেণির সংস্কৃত পাঠ ছিলো নিষিদ্ধ। তৎকালীন নিম্নবর্ণের মানুষেরা চরম অত্যাচার সহ্য করে প্রাকৃত ভাষার প্রথম লেখ্য রূপ দেন। সৃষ্টি করে চর্যাপদ। আর্যব্রাহ্মণরা তাদের ছিলো প্রতিপক্ষ। সেই সময়ের কয়েকজন নরনারীকে কেন্দ্র করেই এই উপন্যাস লেখা। হালিক, জালিক, সামন্তশুভ, উরুবিল্বে, কুক্কুরীপা, শবরপা, লুইপা, দারিকপা, গঙ্গাধর, ইন্দ্রভূতি প্রমুখ প্রাকৃত ভাষার সাথে সংশ্লিষ্ট চরিত্রের সমন্বয়ে এই উপন্যাসের শরীর নির্মিত হয়েছে।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca