কাজী রাফি বাংলা কথাসাহিত্যে এক বিস্ময়ের নাম। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক যাকে ‘জিনিয়াস ঔপন্যাসিক’ হিসেবে অখ্যায়িত করেছেন। কাজী রাফি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ দিয়ে বাজিমাত করেছেন; সাহিত্যবোদ্ধা ও বিদগ্ধপাঠক মহলে নতুন অনুরনণের সৃষ্টি করেছেন। তারপর একে একে লিখেছেন বিশের অধিক বই। এ লেখকের ভিন্নমাত্রার লিখনশৈলী, বয়ানকৌশল একদিকে যেমন পাঠপিপাসাকে ক্রমশ বাড়িয়ে তোলে, অন্যদিকে পাঠক যদি কাজী রাফির সাহিত্য পাঠে নিমগ্ন হতে না পারেন তবে তিনি গল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ বেড়ে যায়; যেমনটা পাহাড়ি পথে একজন আরোহীকে সাবধান থাকতে হয়, শতর্ক থাকতে হয়, যদি ছিটকে পড়ে যায়, এই ভয়ে।
মানুষের আর্তনাদের তরঙ্গ, ইতিহাসের বহমানতা, রাজনীতির এপিঠ-ওপিঠ, জীবনের বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপট, বাংলা সাহিত্যে বৈশ্বিক গল্পের আস্বাদ এসবের সম্মিলন ঘটে তাঁর লেখায়। পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতাকে গল্পের বুননের ভেতর দিয়ে পাঠকের সামনে পরিবেশন করার বা ডাইভারসিফিকেশন করার অসামান্য কৌশলে সিদ্ধহস্ত কাজী রাফি। ফলে একদিকে অনুভবের বুদ্বুদ, অন্যদিকে অভিজ্ঞতার সঞ্চয়নকে মানবিক ক্যানভাসে শব্দশিল্পের নির্যাসের নামান্তর করে তিনি বরাবরই মানুষের গল্প বলেন, লেখেন।
এবারের অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ উপলক্ষে তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত। গ্রন্থটি ‘আবির রাঙা এক প্রজাপতি’ শিরোনামে মোট ৭টি গল্পের সংকলন হিসেবে প্রকাশ করেছে ‘বিদ্যা প্রকাশ’। গল্পগুলো হলো- অঙ্কুর, দিকচিহ্ন রেখে যায় যে ধ্রুবতারা, অবগুণ্ঠন, রুহির অ্যালার্ম ঘড়ি, আবির রাঙা এক প্রজাপতি,ধনুকের মতো সেই নারী, নিঃসঙ্গতার ঘ্রাণ।
কীর্তিমান লেখক কাজী রাফির সাথে কথা হয়েছে বাংলাদেশি নভেলসের। তাঁর নতুন এই গল্পগ্রন্থ ‘আবির রাঙা এক প্রজাপতি’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বরুণ কুমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশি নভেলস : আবির রাঙা এক প্রজাপতি সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলেন
কাজী রাফি : ‘আবির রাঙা এক প্রজাপতি’ আমার একটা গল্পগ্রন্থ। বইটিতে বেশ কয়েকটি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। আমি চেষ্টা করেছি আমাদের যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরতে এবং তার জন্য বর্তমান জীবনের যে পরিস্থিতি তার বাইরে থেকে পত্রপত্রিকা যেসব প্রতিবেদন করে লেখা সে প্রতিবেদন করে না। লেখা করে কী মিথ্যা একটা জগৎকে বেছে নেয়। মিথ্যা কূট চরিত্র, মিথ্যা ক্যারেক্টার, মিথ্যা সব নেয়, নিয়ে গল্প করে কী সত্যিকারের সত্যিটাকে এঁকে দেয়। আমি সেটাই করেছি। আমার চরিত্রগুলো কাল্পনিক, কিন্তু সমাজের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, মানুষের আর্তিগুলো তো ঠিক; আমার গল্পে এই বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। মানুষের অনুভব, মানুষের হাহাকার, মানুষের অপ্রাপ্তি, মানুষের বিচ্ছিন্নতা; আমরা খুব বেশি মানুষের জড়িত আবার খুব বেশি, আবার অনেক বেশি বন্ধুবান্ধব আমাদের ফেসবুকে কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা যেন খুব বেশি একা হয়ে যাচ্ছি, খুব বেশি বিচ্ছিন্ন যাচ্ছি। এই গল্পগুলো লিখতে আমার এই ধরণের অনুভব কাজ করেছে। গল্পগুলো দুইবছর সময় ধরে বিভিন্ন সময় লেখা। একেক সময় একেক গল্পের বীজ এসেছে। সেই গল্পের বীজ ধরেই আমি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছি।
এখানে একটা গল্প আছে, দিকচিহ্ন রেখে যায় যে ধ্রুবতারা শিরোনামে, এখানে মূলত তিনটা কিশোরী মেয়ের গল্প আছে। একটা বাড়ির কথা আছে, বাড়িটা বাতিঘর হিসেবে শহরের সবাই চেনে। এই গল্পটা রহস্যময়। বাড়িটাকে দুটো মেয়ের কাছে চেনা চেনা মনে হয়, আসলে তারাই এ ঘরের বাসিন্দা। মিউনিসিপ্যালিটি কর্পোরেশনে কাজ করে যে মহিলা, তাকে মা বলে জানে। শুধু তাদের মেধার কারণে একটা দামি স্কুলে বাচ্চা দুটো ভর্তি হয়েছে। যে মেয়েটা তাদের আপন ভাবছে, সেই মেয়েটি ওই বাসায় থাকে। একটা সময়ে তার বাবাই এই বাসায় হিসেবে ঢুকেছিলো। আর ওই দুই মেয়েই ছিল ওই বাসার সত্যিকারের বাসিন্দা। তাদের পূর্ব পুরুষ এখানেই ছিল। তাহলে কী এই গল্পের সূত্র? গল্পকার কী এনেছে? গল্পকার সেখানে রোমান মূর্তি আনে, একটা মূর্তির নাম আলমামেটার। সালেহা যখন একেবারে শেষ দৃশ্যে এই দুই বোনকে নিয়ে যায় , তখন মেয়েটা বলছে আমাদের এই বাতিঘর নামের বাড়ির বাতিটি না জ্বলে না। কবে থেকে জ্বলে না, কীভাবে জ্বলে না, সে কিছুই জানে না। অথচ সে জানে, এই বাতিটা একসময় জ্বলতো। পেছনের দরোজা দিয়ে ঘুরিয়ে যখন বাগান দেখাচ্ছে, ছোট বাচ্চাটার মনে হয় অনেক অনেক বছর সে এখানে ছিলো। কিন্তু কীভাবে? সে জানে না। ব্যস্ত তার কাছে ধাঁধার মতো করে ফিরে আসে। ওই বাড়ির বাসিন্দারা যখন গার্ডকে মেয়ে দুটোকে তাড়িয়ে দিতে বলে, তখন সালেহার খুব মন খারাপ হয়। মেয়ে দুটো মাথা হেট করে চুপচাপ বসে থাকে। একটা নির্জন রাস্তা, সেখানে একটা সাঁকোর উপর তারা দুই বোন বসে থাকে। তাদের যে মা, সেও আসলে একসময় তাদের এই বাড়িতে কাজ করতো। সেকারণে তারা তাকে মা বলে জানে। শেষ দৃশ্যে ছোট বোন বলে বাতিঘরের বাতিটা আর জ্বলে না। বড়ো বোন বলে, আমি জানি তার বোতামটা কোথায় ! এখানে স্মৃতিঘোর কাজ করে। গল্পটা খুবই রূপক । সরাসরি গল্প না বলে, একটা অরৈখিক গল্প বলেছি। যাতে সমাজের চিত্রটা ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশি নভেলস : বাকি গল্পগুলো সম্পর্কেও যদি কিছু বলেন।
কাজী রাফি : অঙ্কুরসহ আরো যেসব গল্প আছে সেসবেও একইভাবে চেষ্টা করেছি। একটা গল্প আছে, যেখানে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, সেই মেয়েটি পুত্রের বান্ধবী বয়সী। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্ক দৈহিক সম্পর্কের দিকে ধাবিত হয়। কেন গড়াচ্ছে, কীভাবে গড়াচ্ছে সে বিষয়গুলোকে এখানে আমি দৈহিক সম্পর্কের চেয়েও মনোদৈহিক বিষয়ের নিরিখে দেখিয়েছি। যেটি সমাজের প্রভাব থেকে এসেছে। এরকম বেশ কিছু গল্প আছে, আশাকরি পাঠকের ভালো লাগবে।
বাংলাদেশি নভেলস : আপনার লেখায় সবসময়ই ইতিহাসচেতনা, সমাজচেতনা, প্রেমচেতনা, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় চিত্রিত হয় সেসব বিষয়ে আমাদের যদি বলেন।
কাজী রাফি : রাজনীতি সচেতনতা, সমাজচেতনা এসব ছাড়া গল্প হবে না। আমরা যেভাবে গল্পটা লিখি তা যদি শুধুই প্রেমের কথা বলে, সেখানে যদি দর্শন না থাকে, সেখানে যদি মাত্র রাজনীতির খোলসটা মাত্র থাকে, দগদগে ঘা তা যদি স্পষ্ট করতে না পারে, তবে সে গল্প হবে না। শুধু মানবমানবীর প্রেমের গল্পে যদি অনুভব না থাকে, তবে সেই গল্প লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। গল্প লেখার ক্ষেত্রে কয়েকটা উদ্দেশ্য থাকার দরকার। মানুষের মননে যেন তা প্রভাব ফেলে। সেটা ভাষার প্রক্ষেপণ থেকে হবে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হবে। তার দেখা সমাজটাকে কতটা গভীর থেকে তুলে আনতে পারছেন সেটা মূল্যবান। আমার ভেতরে কোনো গল্পের বীজ যখন আসে, তখন আমি সেইসব চরিত্রের সাথে কথা বলি, তাদেরকে আপন করে ফেলি। এর বীজতলা আস্তে আস্তে বড়ো হতে থাকে। এদের পাতা গজায়, ডাল মেলে। এরা বাতাস দিতে থাকে, এরা আমার জীবনের অংশ হয়ে যায়। তাদেরকে আমি ভালোবেসে ফেলি, তাদেরকে আমি সমাজের বিভিন্ন জায়গায় ফেলে ফেলে দেখতে চাই। তাদেরকে বুঝতে চাই, তাদের হাহাকারটা কোথায়? তাদের প্রেমটা কেমন? যখন এই বীজতলা কথা বলা শুরু করে তখন লিখে ফেলি। সেটা হতে পারে প্রেমের গল্প, হতে সমাজ বাস্তবতার গল্প। রাজনৌতিক সচেতনতা, মননশীল একটা অভিযাত্রা হতে পারে। সবকিছুর সংমিশ্রণে একটা গল্প হতে পারে। একটা উপন্যাস হতে পারে। ইতিহাসচেতনা খুব জরুরি না হলেও যদি তা তৈরি করা যায় সেটিই ভালো। ব্রিটিশদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, অতীতের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। আমাদের লেখার ভেতরে আমরা যদি আমাদের জাতিগোষ্ঠীকে তুলে না আনি, আমাদের সংস্কৃতি কী তা যদি তুলে না আনতে পারি তাহলে আমাদের ভেতরে সমাজচেতনা তৈরি হবে না। ইতিহাসচেতনা না থাকলে দেশপ্রেম আসবে না, তার সংস্কৃতির প্রতি একটা জাগরুক দৃষ্টি তৈরি হয় না। আমি প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন এলাকার সন্তান, সেখানে বিরাট ইতিহাস ছিল। আমি সেই ভূমির সন্তান। এই ভূমিপুত্র হিসেবে আমারও তো তার প্রতি দায় আছে।
বাংলাদেশি নভেলস : বর্তমান সময়ের লেখকদের দিয়ে কিছুই হচ্ছে না, একটি একটি গুঞ্জন আমরা প্রায়ই শুনি, এ বিষয়ে কী বলবেন।
কাজী রাফি : আসলে যারা বলেন, তারা পড়ছেন না। যারা এমন বলছেন তাদের থেকে হয়তো ভালো কাজ হচ্ছে। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারছেন না। গল্পের মাধ্যমে মস্তিষ্কে কোর্টিসেল তৈরি হয়। কেউ কেউ লেখার সময় ডেভিলসটনিক সৃষ্টি করছে। পাঠকরা না বোঝার কারণে, তারা এই ডেভিলসটনিকে আক্রান্ত হচ্ছে। তারা তথ্য উপাত্ত খুঁজছে, তারা ভাষার ব্যাপারটা ভুলে যাচ্ছে। অদ্ভুদভাবে পাঠক ওইটার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। এসব হচ্ছে, ভালো গল্পও হচ্ছে। এই জঙ্গম সময়ে পাঠকের জন্যে যেটা কঠিন, তাহলো একটা ভালো গল্প খুঁজে বের করা। পাঠককেও ট্যালেন্টেড হতে হবে। ট্যালেন্টেড রাইটারকে বুঝতে হবে। আমি পড়ার সময় যদি বুঝে ফেলি লেখক কী বলতে যাচ্ছেন, তাহলে ওই পড়ার কোনো দরকার নেই।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca