কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক ফয়জুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে একজন বিপুল প্রতিভাধরের নাম। তিনি সাহিত্য ও ভাষা বিষয়ক প্রাবন্ধিক হিসেবে সমাদৃত। তাঁর জন্ম ২৪ নভেম্বর, ১৯৬৩, সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকাতে। তাঁর লেখা গল্প ও প্রবন্ধ নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’। সাতটি গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- নক্ষত্রের ঘোড়া, খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক, আয়না, নীলক্ষেতে কেন যাই, বখতিয়ার খানের সাইকেল, ঘুমতৃষ্ণা এবং জমিন। ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’ গল্পগ্রন্থের জন্যে প্রথম আলো বর্ষসেরা বই : ১৪২২-এর সৃজনশীল শাখাতে পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুসেটসের উইলিয়ামস কলেজে অর্থনীতি ও উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সামাজিক সুরক্ষা সংস্কার সংক্রান্ত প্রকল্পের প্রকল্প-পরিচালক, জেনেভাস্থ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সচিবালয়ে টেক্সটাইল উইংয়ে ইকোনোমিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালীন ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ভীষণ আগ্রহ তাঁর। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও তিনি সাহিত্যেকে ভালোবেসেছেন, ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। আজ তিনি বাংলাদেশি নভেলসের সাথে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন, তাঁর সাথে আলাপ করেছেন বরুণ কুমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশি নভেলস : কোন ভাবনা থেকে ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’ উপন্যাসটি লিখেছেন? উপন্যাসটি প্রথম কত সালে প্রকাশিত? (২০০ শব্দ)
ফয়জুল ইসলাম : আমার পয়লা ও একমাত্র উপন্যাস ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’ বের হয় ২০১৮-র বইমেলাতে, বের করে পার্ল পাবলিকেশন্স।
‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’ লিখবার পেছনে প্রথা ভাঙবার দ্রোহ জড়িত। আশির দশকে সাহিত্য করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লেখকদের লড়বার উদাহরণ আমরা দেখেছি। সেই প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রেখেছেন অনেকই; তারা এখনও প্রতিষ্ঠানের মাঝে বিলীন হয়ে যাননি। এই একই উদ্দীপনা আমরা ব্যান্ড মিউজিকের সদস্যদের মাঝে দেখি− তারা প্রথাগত গান ফেলে নিজেরা গান লিখেন; দর্শকের সামনে তা পরিবেশন করেন; দর্শক বা পরিবেশক প্রতিষ্ঠান তা পছন্দ না করলেও তারা মিউজিকে নতুন ট্রেন্ড তৈরি করবার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হন না কখনোই; তার জন্য সংগ্রাম করেন নিরন্তর− নতুন কিছু করবার জন্য। এসব করতে গিয়ে কোনও না কোনও জীবিকা নিয়ে টিকে থাকবার চেষ্টা করেন তারা। এটাই বিশ্বজুড়ে মিউজিক ব্যান্ডের দ্রোহের জায়গা। মিউজিক ব্যান্ডের দ্রোহের জায়গাটাকেই আমি ধরতে চেয়েছি ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’ উপন্যাসে।
সালমান রুশদি ঠিকই বলেছেন, মিউজিক মানুষকে বিকল্প সমাজ-ব্যবস্থা প্রবর্তনের ভাবনা জোগায়। যেমন, আমরা পিংক ফ্লয়েডের বিখ্যাত গান− ‘উই ডোন্ট নিড নো এজুকেশন’-এর কথা স্মরণ করি যা আমাদের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থাকে আক্রমণ করে। ব্যান্ড মিউজিকের দলগুলোর প্রথা ভাঙবার এই অভিযানকে কূপমণ্ডুক সমাজ স্বাভাবিকভাবেই পছন্দ করে না। আমরা জানি, ব্যান্ড মিউজিকের সদস্যদেরকে সামাজিকভাবে নিগ্রহণেরও শিকার হতে হয়, তাদেরকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে− প্রাণ দিয়েছেন জন লেনন, সেলেনা, গুলশান কুমার−এমন অনেকেই। এসব নিয়ে সালমান রুশদির একটা উপন্যাস রয়েছে− ‘দ্যা গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট’ (১৯৯৯)। তিনিই সবার আগে ব্যান্ড মিউজিকের প্রথা ভাঙবার রোমান্টিসিজম, প্রণোদনা ও আন্দোলনের ব্যাপারটা সাহিত্যে তুলে ধরেছেন। রুশদির একটা কোট একদা আমাকে মুগ্ধ করছিল− দ্যা মিউজিক অফ ফ্রিডাম ফ্রাইটেনস পিপল…।
বাংলাদেশি নভেলস : ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’ উপন্যাসে দেখা যায় যে, শিপলু নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গান গাইতে গাইতে একসময়ে আর নিজের গান বাঁধতে পারে না, এই বিষয়টি কি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজে শিল্পীসত্তাকে যে পেশার প্রয়োজনে ক্রমবিনাশের পথে হাঁটতে হাঁটতে একসময় হারিয়ে যেতে হয় তারই ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপন?
ফয়জুল ইসলাম : খেয়াল করলে দেখবেন, কেবল আমাদের দেশেই নয়− বিশ্বজুড়ে দু’ধরনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে মিউজিক করতে আসছে তরুণ-তরুণীরা− এক হলো অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তানেরা এবং দুই হলো নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা। অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তানেরা যারা মিউজিক ব্যান্ডের সদস্য তারা মিউজিক নিয়ে নানান এক্সপেরিমেন্ট করে থাকে, তাদেরকে ভাবতে হয় না যে তাদের সংসার কীভাবে চলবে, তাকে ভাবতে হয় না যে রিকশাভাড়া বা চা-বিড়ির পয়সা আসবে কোথা থেকে, নয়া একটা গিটার কেনবার টাকাই বা দেবে কে! মিউজিক শো করে তারা যে অর্থ পায় হয়ত তা তারা ফুর্তিতেই উড়িয়ে দেয়।
‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’ উপন্যাসের মূল চরিত্র শিপলু কিন্তু নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান যার বাবা রিটায়ার করেছে, যাদের পরিবারের তেমন কোনও সম্পত্তি নেই, নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরোয়! ছাত্রদেরকে গিটার শিখিয়ে সে যা অর্থ পাচ্ছিল, বাবা অবসরে যাবার পরে সে অবদানে পরিবারের চলতে কষ্টই হচ্ছিল! কাজেই শিপলুর জন্য ভাল বেতনের একটা চাকরি চাই। ভাল চাকরি মিলে যাওয়া তো কম সুযোগের একটা দেশে চাট্টিখানি কথা নয়! সে মতিঝিলের একটা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ছোট একটা চাকরি পায় বটে, কিন্তু চাকরি আঁটোসাটো পরিবেশে সে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। তাই সে ছেড়ে দেয় চাকরিটা। তারপর আবার গিটার শিখিয়ে দিন চালাবার চেষ্টা!
নিজের পছন্দের ও ক্ষুন্নিবৃত্তি মেটাবার জন্য সঠিক পেশার নিশ্চয়তা কেউ দেয় না বটে, তবে সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য সামাজিক সুযোগ ও সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকাটা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এর অভাবে মিউজিক ব্যান্ডের সদস্যরা হতোদ্যম হয়ে পড়ে, তাদের দল ভেঙে যায়, কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় তারা, আবার নতুন নতুন মিউজিক দল আসে বাজারে। এ জন্যই শিপলুরা নিজেদের পছন্দে গান গাইবার স্বাধীনতার জন্য লড়তে থাকে।
বাংলাদেশি নভেলস: বাংলাদেশের সমকালীন উপন্যাসের ধারা বা গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ফয়জুল ইসলাম : বাংলদেশের উপন্যাস এখনও পুরোপুরিভাবে বিকশিত হয়নি, মানে, তা সব সময়ে দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করছে না। আমরা দেখি, অল্প কিছু ধনী, আর খানিকটা বড় আকারের মধ্যবিত্ত জনসাধারণ বাদে গরিব, তোস্য গরিবেরাই এ দেশের জনগণ। তাদের কথা কে বলছেন? মধ্যবিত্তের রোমান্টিসিজম নিয়ে ভরে গেল এখানকার উপন্যাসের জগত! তাই বারবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, ওয়াসি আহমেদের কথাই মনে আসে যারা আশ্চর্য মমতাতে আমাদের দেশের গরিবগুর্বদেরকে নিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক উপন্যাস রচনা করেছেন; গল্প লিখেছেন! এটাই আমাদের দেশের স্থানিক বৈশিষ্ট্য! তাকে অস্বীকার করবার জো আছে?
এখন কোনও লেখক যদি মনে করেন, আমার যা ইচ্ছে তাইই লিখব আমি− তা তিনি করতেই পারেন! তবে কথা থাকে, যে বাস্তবতাকে আমরা তুলে ধরছি− যা মূলতই মধ্যবিত্তিক রোমান্টিক উপস্থাপন− তারও বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপন করা প্রয়োজন। মধ্যবিত্তিক ক্রাইসিসগুলো কী কী? তার বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপন করবার চেষ্টা করাটাই সঙ্গত। সামাজিক বিজ্ঞান আমাদেরকে এমনতরো বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনেরই সূত্রই দিয়ে থাকে। মধ্যবিত্তিক রোমান্টিক কাহিনি তো মেলাই হলো! এবার উপন্যাসের বাক বদল চাই− বাংলাদেশের গল্প চাই। তার জন্য চাই মমতাময় লেখক− মেলা মাৎ করে দেবার মতো বাজিগর নয়, ডুগডুগি বাজিয়ে বান্দরখেলা দেখানেওয়ালা নয়।
বাংলাদেশি নভেলস: আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের উপন্যাস বিশ্ব সাহিত্যের সাথে সমানতালে চলার ক্ষেত্রে সেগুলোর যথাযথ ইংরেজি অনুবাদ হওয়া উচিৎ?
ফয়জুল ইসলাম : ভারতবর্ষের একটি আঞ্চলিক ভাষার বাংলাতে লেখা উপন্যাসের অনুবাদ হলে তো ভাল কথা! কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখছি, যারা বাংলা থেকে ইংলিশে অনুবাদ করছেন তারা কেবল সুপার জনপ্রিয় কাজগুলো ধরছেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য পাঠে তাদের খামতি আছে বলে আমরা মনে করি। তাদেরকেই ভাল কাজ খুঁজে বের করতে হবে। সব লেখকের যে সামাজিক নেটওয়ার্কিং দুর্দান্ত হবে− এটা মনে করবার কোনও কারণ নেই, এসব কাজে তার ঠ্যাকাও নেই।
এরপর আমরা সাবধানী হই অনুবাদকের পারঙ্গমতা নিয়ে। এ নিয়ে প্রশ্ন আছে জন্যই এখানকার অনেক লেখক নিজেরাই নিজেদের কাজ অনুবাদ করে ফেলেন। এ কাজটা নিশ্চয় ক্ষতিকর কেননা সেই লেখক যদি কেজো অনুবাদক পেতেন তবে নিজের কাজ অনুবাদ করবার বদলে তিনি একখানা মৌলিক উপন্যাসই রচনা করতেন তখন! তাইই নয় কি?
এবার ভেবে দেখি, বাংলাদেশের উপন্যাসের বৈশ্বিক অবস্থানটা আসলে কোন জায়গাতে− অনুদিত উপন্যাস ক’জন বিদেশি পাঠ করছেন? এটাকে আমরা বলছি চাহিদার দিক। তো জোগান তো তার ওপরেই নির্ভর করবে! সখের অনুবাদ বা তা সখেই তা গ্রন্থিত করবার পরে দেখা গেল যে আন্তর্জাতিক বাজারে তা আর বিক্রি হচ্ছে না! হতেই পারে। প্রকাশকেরা চাহিদা ও সরবরাহ বিষয়ক ড্যাটা দিতে পারলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হতো।
তাই বলি− অনুবাদ যদি সৌখিন কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে, তা চালানো যেতেই পারে। তবে তা’তে করে সেই অনুবাদ বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নে খুব একটা কাজে আসবে না, মানে, বৈশ্বিক চাহিদার বাস্তবতাতে তা বাংলাদেশের উপন্যাসকে আর এগিয়ে নাও নিতে পারে! আমরা মনে করি, বাংলাদেশের উপন্যাসের অনুবাদ হোক বিভিন্ন ভাষাতে, বাজারভিত্তিতেই। তবেই কিনা অনুদিত বই আন্তর্জাতিক পাঠকের হাতে পৌঁছুবে, নইলে নয়।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca