বাংলাদেশি নভেলস প্রতিবেদন : শুরুর দিন থেকেই নতুন নতুন বই মেলায় আসতে শুরু করেছে। হরেকরকম বইয়ের ভীড়ে উপন্যাস পাঠকের মন খুঁজে বেড়ায় তাদের কাঙ্খিত বইটি। মেলায় ঘুরে ঘুরে ভালো উপন্যাস পেলেই তারা তা উল্টেপাল্টে দেখে, পছন্দ হলেই থলেতে ভরে নেন। যাদের পক্ষে মেলায় গিয়ে উপন্যাসের খোঁজ নেয়া সম্ভব হয় না, এমন উপন্যাস সন্ধানী পাঠকের জন্যে আজকেই এই তিন উপন্যাসের বৃত্তান্ত।
উপেক্ষিতা সীতা
বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় হরিশংকর জলদাস একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের নাম। অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে এসে তাঁর নতুন উপন্যাস ‘উপেক্ষিতা সীতা’। ফ্ল্যাপ থেকে আসুন জানি উপন্যাসটির বৃত্তান্ত,
“শাস্ত্রে, পুরাণে এবং মানুষের কাছে সীতার অবস্থান অতি উচ্ছে। প্রায় দেবীর পর্যায়ে। তারপরও সীতার জীবন বিপন্ন-বিধস্ত। জন্মের পরপরেই জঙ্গুলে নির্জন এক ভূমিতে বিসর্জিত হয়েছে সীতা। করা তার পিতা-মাতা? সে কি পিত-মাতার সামাজিক সন্তান নয় ?
পতিব্রতা, সর্বংসহা, সন্তান-অনুরাগী সীতাকে কেন রামচন্দ্র মর্যাদার আসন থেকে ধুলায় টেনে নামাল? হাতের নাগালে শতসহস্র রুপসি রমণী থাকা সত্ত্বেও রাবণ কেন সীতাকে অপহরণ করল? রাম কি বিশ্বাস করে বসেছিল, রাবণ কর্তৃক সীতা ধর্ষিতা? কোন কারণে সীতার অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করল রামচন্দ্র? গর্ভবতী সীতাকে অরণ্যে বিসর্জন দিল কেন রাম?
রামচন্দ্র কি শুধু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মতো উঁচুবর্ণের মানুষদের রাজা ছিল? শূদ্রদের কী চোখে দেখতো রাম? কেন রামচন্দ্র শূদ্রতপস্বী শম্বুককে হত্যা করল? রাম শেষ পর্যন্ত সীতাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিল না কেন? সীতার আত্মহত্যার জন্যে কে দায়ী? রামচন্দ্র, না তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যসমাজব্যবস্থা?
এতদিন ‘মহাভারত’ নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন হরিশংকর জলদাস, এবারই প্রথম ‘রামায়ণ’ নিয়ে লিখলেন। তাঁর পৌরাণিক উপন্যাসগুলো শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, তৎকালীন সমাজকে ফালা ফালা করে উপস্থাপনও। নতুন কথা শোনানোর জন্য হরিশংকর উপন্যাস লিখেন। উপেক্ষিতা সীতা’ও তার ব্যতিক্রম নয়। “
উপেক্ষিতা সীতা উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ।
লেনিন
বইমেলায় এসেছে ঔপন্যাসিক আশানুর রহমানের প্রথম উপন্যাস ‘লেনিন’। আসুন পরে দেখি এ উপন্যাসের ফ্ল্যাপ,
“বালক ভ্লাদিমিরের লেনিন হয়ে ওঠার গল্প যেন একদিকে রুশ ইতিহাসের আলোড়ন, অন্যদিকে উলিয়ানভ পরিবারের একটানা বিয়োগান্তক কাহিনি। ইতিহাসের কামারশালার আগুনে আর পারিবারিক শোকগাঁথায় গড়ে ওঠে লেনিনের মন। জারের হাতে বিপ্লবী বড় ভাই সাশা-র মৃত্যু কিশোর লেনিনকে দেখিয়ে দেয় জীবনের দিশা। সেই জীবনে প্রেম আসে নাদিয়া ও ইনেসার আকর্ষণ নিয়ে। ভালবাসার আহ্বান ছিল ইয়াসনেভা ও এলিজাবেতের কাছ থেকেও। কিন্তু লেনিন যেন কাছে থেকেও দূরে, দূরে থেকেও অন্তর্গত রক্তের ভেতরে। শুধু প্রেমে নয়, বন্ধুত্বেও লেনিন যেন অধরা থেকে যায় ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের কাছে। শ্রমিকের সঙ্গে তিনি শ্রমিক, অরণ্যে শিকারি, প্যারিসের আড্ডায় তুখোড় বুদ্ধিজীবী আর ব্রিটিশ মিউজিয়মের নির্জনতায় এক আচ্ছন্ন পাঠক।
ইউরোপের ভূগোল জুড়ে লেনিনের চলাচল। সাইবেরিয়ার বরফজীবনের নির্বাসন থেকে সুইজারল্যান্ড, লন্ডন, প্যারিস, ব্রাসেলস আর পুরো রাশিয়াজুড়ে ছড়ানো তার কক্ষপথ। কখনো মনে হয় তিনি নিষ্ঠুর, কখনো বিষাদময় ও নিঃসঙ্গ। ইনেসাকে কবরে শুইয়ে কাঁদছেন লেনিন। এই লেনিনই তো পিটার্সবার্গের ক্ষমতা দখলের আগে ও পরে শান্ত—যেন বিপ্লবের রেলগাড়িটার বিজ্ঞ চালক। ইতিহাসের শীতল বরফে মোড়ানো লেনিনের কঠিন ব্যক্তিত্বের তলায় যে উষ্ণ জীবনস্রোত–এই উপন্যাস তারই নিবিড় বয়ান।
লেনিনের মৃত্যুর পরে ম্যাক্সিম গোর্কি আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘লেনিনের মনোজগৎ নিয়ে কেউ যদি একটা ফিকশন লিখতে পারত। তাঁকে নিয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক আল্যান ব্রায়েন লেনিন : দ্য নভেল নাম উপন্যাস লিখলেও বাংলা ভাষায় এই প্রথম। আশানুর রহমান সেই শূন্যস্থান পূরণের পাশাপিশি গোর্কির প্রত্যাশাও মেটালেন।”
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ।
জলতৃষ্ণা
বইমেলায় এসেছে কথাসাহিত্যিক শাহমুব জুয়েলের চতুর্য উপন্যাস ‘জলতৃষ্ণা’।
উপন্যাসটির ফ্ল্যাপ পড়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করি, যেটি লিখেছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার-
“গ্রাম শহরের কাছে না গেলেও শহর এখন ঢুকে পরে গ্রামের মধ্যে। মুক্তবাজার পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মানেই ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদর অবাধ লুটের লাইসেন্স দেওয়া। প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহের জন্য অবাধ লুন্ঠন পুঁজিবাদ নির্মাণের শর্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ইউরোপ এই পুঁজি সংগ্রহ করেছিল এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে লুন্ঠনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সেই ক্ষমতা নেই। তাই তারা লুঠ করে দেশের সম্পদ, জঙ্গল, নদী, পাহাড়, খনি, আর শ্রমজীবী মানুষের শ্রম। সেই লুন্ঠনের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন আমাদের দেশে অনুপস্থিত। স্থানীয়ভাবে কিছু দেশপ্রেমিক মেরুদণ্ডসম্পন্ন তরুণ রুখে দাঁড়ায়। অবধারিতভাবেই তারা পরাজিত হয় অসম যুদ্ধে। কিন্তু আমাদের জাতির হাজার বছরের ইতিহাস বলে যে, পরাজয় শেষ কথা নয়। প্রতিবাদ এবং বারবার রুখে দাঁড়ানোই সত্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।
শাহমুব জুয়েলের জলতৃষ্ণা আপাতদৃষ্টিতে পরাজয়ের পাশাপাশি সেই অবিনাশী প্রতিরোধের সংকল্পটিকেই সামনে এনেছে। উপন্যাসটি এই কারণেই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রচেষ্টা হিসেবে পরিগণিত। লেখকের ভাষা এবং আখ্যান-বয়নে পরিশ্রমের চাপ রয়েছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, শাহমুব জুয়েল উপন্যাস ‘জলতৃষ্ণা’ নতুন প্রজন্ম লেখকদের প্রতি আশাবাদী চিন্তার ফসল।”
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে তাম্রলিপি প্রকাশনী।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca