ড. গৌরাঙ্গ মোহান্ত একজন কবি, গবেষক ও অনুবাদক। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘Robert Frost: A Critical Study in Major Images and Symbols’. কবিতা, প্রবন্ধ ও অনুবাদকর্মে সিদ্ধহস্ত এ লেখক ১৯৬২ সালের ৭ জানুয়ারি লালমনিরহাট জেলার দেউতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করেন। তিনি ভারতের দার্জিলিং-এর নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০১ সালে ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
তাঁর লেখা কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে – ‘আধিপ্রান্তরজুড়ে ছায়াশরীর, ‘শূন্যতা ও পালক প্রবাহ, ‘ট্রোগনের গান, ‘জলময়ূরের শতপালক’। তাঁর অনূদিত গ্রন্থ ‘ঝলকে ওঠা স্বপ্নডাঙা’ মূলত চীনা ট্যাং যুগের কবিতার অনুবাদ; নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ “A Green Dove in Silence” নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়। সম্পাদিতগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে – ‘বেগম রোকেয়া স্মারকগ্রন্থ’ (যৌথ) ও ‘পুথি রহিব নিশানী: হেয়াত মামুদ’ (যৌথ)।
কীর্তিমান এই কবি, গবেষক ও অনুবাদক বাংলাদেশি নভেলসের সাথে কথা বলেছেন অনুবাদ, বর্তমান কবিতা চর্চা ও প্রাসঙ্গিক নানান বিষয়ে। তাঁর সাথে আলাপচারিতায় ছিলেন বরুণ কুমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশি নভেলস : আপনি কবিতার মানুষ। নিজে কবিতা লেখেন। আপনার কবিতা অনেক পাঠকই দুর্বোধ্য বলে বিবেচনা করে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
ড. গৌরাঙ্গ মোহান্ত : কবিতার দুর্বোধ্যতা অনতিক্রম্য বিষয় নয়। কঠিন শব্দ ও অজানা পুরাণের ব্যবহার কবিতাকে আপাত দুর্বোধ্য করে তুলতে পারে। তবে কবিতার দুরূহতার প্রধানতম কারণ হলো চিত্রকল্প ও প্রতীকের ব্যবহার। পরিচিত শব্দাবলির সাথে যখন কল্পনার সংশ্লেষ ঘটে তখন নির্মিত চিত্রকল্পের অর্থ প্রধানত প্রতীকী চারিত্র্য ধারণ করে। আবার সুজ্ঞাত কোনো শব্দ যখন তার আভিধানিক অর্থকে অস্বীকার করে তখনও কবিতায় প্রতীকতার ব্যবহার ভাস্বর হয়ে ওঠে। কবিতার বিষয়ে এ কথাগুলো নতুন কিছু নয়। একজন পাঠক নিবিষ্টতার সাথে যদি চিত্রকল্প ও প্রতীকের রহস্য উন্মোচন করেন তাহলে আমার কেনো পৃথিবীর কোনো কবিতাই আর দুর্বোধ্য থাকে না। আমি গদ্যকবিতা লিখি; এ জাতীয় কবিতার ভেতর প্রবন্ধের দৃঢ়তা, ন্যারেটিভের চলিষ্ণুতা বিদ্যমান থাকায় আমার মনে হয় একনিষ্ঠ পাঠকের কাছে আমার কবিতার গূঢ়ার্থ অনুধাবন করা অসাধ্য নয়।
বাংলাদেশি নভেলস : কবিতা অনুবাদের দিকে ঝুঁকলেন কেন? ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ হলেও আমরা খেয়াল করছি আপনার অনুবাদ অন্য ভাষা থেকে হচ্ছে। সেটির ব্যাখ্যা জানতে চাই।
ড. গৌরাঙ্গ মোহান্ত : ইংরেজি সাহিত্য পড়বার ফলে একটি বিষয় জীবনের প্রথম দিকেই বুঝে ফেলেছি যে অনুবাদের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। রবার্ট ফ্রস্ট ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে লিখেছেন, ভাষার প্রতিবন্ধকতা বাহ্যত মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলেও শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা ও অনুবাদের ভেতর দিয়ে সে সংকটের উৎসারণ সম্ভব। আমরা ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ নিতে গিয়ে Homer, Sophocles, Aeschylus (Greece) Lev Nikolayevich Tolstoy (Russia), Gustave Flaubert (France), Bertolt Brecht (Germany) Henrik Ibsen (Norway), Joseph Conrad (Poland), Robert Frost, Herman Melville, Ernest Hemingway (America) প্রমুখ অনেক দেশের কবি-সাহিত্যিকের সৃষ্টিকর্মে নিমগ্ন থেকেছি। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের জন্য আমার অনুরাগ স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হয়েছে। আটের দশকের প্রথম দিকে আমার একজন ফিনিশ (Finnish) শিক্ষয়িত্রী জানান যে চীনের কবিতা তাঁর বেশ প্রিয়। আমি চীনের কবিতার স্বাদ গ্রহণের জন্য উৎসুক হয়ে উঠি। চীনের কবিতা পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি প্রাচীন বাংলা কাব্যের অনেক আগে থেকেই চীনে অসাধারণ কবিতা রচিত হয়েছে। আমি চীনের থাং বা ট্যাং যুগের কবিতা পড়ে দারুণ মুগ্ধ হয়ে পড়ি। ট্যাং কবিতায় লক্ষণীয় যে দারিদ্র্য পীড়িত মানুষ চালের অভাবে ওক ফলের বীজ সেদ্ধ করে দিনাতিপাত করেছে। চর্যাপদেও দারিদ্র্যের চরম অবস্থার কথা বর্ণিত রয়েছে। ভাতের অভাবে মানুষ যে উপোস থেকেছে সে তথ্য চর্যাপদে বিদ্যমান। আমাদের প্রাচীন কাব্যের সাথে ট্যাং কবিতার এ জাতীয় সাদৃশ্য আমাকে থাং/ট্যাং কবিতা অনুবাদে উদ্দীপ্ত করেছে। আমার ‘কর্ডোফোনের প্রতিধ্বনি’ গ্রন্থে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ফিলিস্তিন, উত্তর আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডা, গ্রিস প্রভৃতি দেশের কবিদের ভাষান্তরিত কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। একই সাথে আমি বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদও করে চলেছি। উল্লেখ্য যে ২০১৮, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে আমরা Dhaka Translation Festival (DTF) এর আয়োজন করি। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশের সাহিত্যিকগণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। আমাদের লক্ষ্য ‘Unite through Translation’ স্থিরীকৃত হয়। ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা অনুবাদের ফ্লাডগেইটস উন্মুক্তকরণে প্রথম প্রয়াস গ্রহণ করি। বাংলাদেশে নিশ্চিতভাবে উন্নতমানের সাহিত্য রচিত হয়েছে কিন্তু যথাযথ অনুবাদের অভাবে বিশ্বে ব্যাপকভাবে বাংলা সাহিত্য আদৃত হয়নি। আমাদের সীমিত সাধ্যের ভেতরে আমরা বাংলা সাহিত্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ইংরেজি, ফরাসি ও হিন্দি ভাষায় প্রকাশের সার্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করি। বর্তমানে লন্ডন থেকে প্রকাশিত Poetry Out Loud পত্রিকার সাথে যুক্ত রয়েছি। এ পত্রিকায় নিয়মিত বাংলা গদ্যকবিতা ও গল্পের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশি নভেলস : আমরা জেনেছি এবছর আপনার দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। এই দুটি গ্রন্থের বিষয় নিয়ে যদি কিছু বলেন।
ড. গৌরাঙ্গ মোহান্ত : জাগতিক প্রকাশন থেকে দুটি বই প্রকাশিত হবে। ‘ঝলকে ওঠা স্বপ্নডাঙা: চীনের ট্যাং কবিতা’-র দ্বিতীয় সংস্করণে রয়েছে ৮০টি কবিতার অনুবাদ। বইটি ৬৩টি কবিতার অনুবাদ নিয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে বাংলা ভাষায় এ জাতীয় বইয়ের অস্তিত্ব আমার চোখে পড়েনি। চীনা সমাজের গভীরে কবিতা ছড়িয়ে রেখেছে বিস্ময়কর শেকড়। চীনে কবিতাকে উচ্চতর শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হত। কনফুসিয়াসের দর্শন ও মূল্যবোধ চীনা সমাজকে যেমন প্রভাবিত করেছে তেমনি সাহিত্যের আশ্চর্য রূপায়ণের ক্ষেত্রও করেছে প্রস্তুত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে ‘শি জিং’ বা কবিতার বই রচিত হলেও থাং বা ট্যাং যুগে অর্থাৎ ৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ কালপরিসরে সংসিদ্ধ হয় চীনা কাব্যাদর্শের রেনেসাঁস। ট্যাং যুগে ২২০০ জন কবি উপহার দেন প্রায় ৫০ হাজার কবিতা যেগুলো চিত্রকল্প ও প্রতীকের ব্যঞ্জনায় অনবদ্য।
‘করোটিমঞ্চে খেমটাওয়ালি’ নামে আমার যে কাব্যটি প্রকাশিত হতে চলেছে তা প্রকৃতি, প্রেম, ঐতিহ্য ও মৃত্যুর চিত্রকল্পে পল্লবিত। এখানে মহেঞ্জোদাড়ো-নর্তকীর নির্মিত ত্রিভুজের ভেতর আঘ্রাত হয় পদ্মসৌরভ, জলপুষ্পের ত্রিভুজভূমির ভেতর তরঙ্গধ্বনি শ্রুত হয়, নির্জন জলদৃশ্যের ভেতর জেগে ওঠে কার্পাস-আচ্ছাদিত পদ্মদল যা কখনো স্বপ্নের ভেতর করতলে আঁকে সাইজমিক ঊর্মিকা; নারকেল বনের এসরাজ আর নিভৃত মাঠ সুষুম্নার ভেতর পার্থিব গান্ধার রচনা করে, কখনো নীল পপির গানে কেঁপে ওঠে মাঠ; সৈকতচারিণীর সেরিব্রামে কাঙ্ক্ষা ও শ্রান্তির দ্বৈরথ দৃশ্যমান হয়, গুলাচি প্রভাবিত সৈকতে জলশব্দে খুলে যেতে থাকে সীমান্তের সকল দরজা; আর নীল বরফের নিচে নিস্পন্দ শরীরে শ্রুত হয় মাইক্রোবের গুঞ্জন।
বাংলাদেশি নভেলস : আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. গৌরাঙ্গ মোহান্ত : আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ জানাই।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca