জিয়াউল হক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও কথাসাহিত্যিক। কলেজে পড়াকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতাত্তোরকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেন। পরবর্তীতে পাবনা আমিনউদ্দিন আইন কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৮৩ সালে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরিতে যোগ দেন। ২০১৬ সালে জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে অবসরে যান।
কবিতা, ভ্রমণকাহিনি, উপন্যাস ও গবেষণামূলক গ্রন্থ লেখার কাজে পুরোপুরি নিযুক্ত আছেন, তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা বারোটি। ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায় তাঁর লেখা ‘একাত্তরের পরি’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসভিত্তিক একটা উপন্যাস এসেছে। তাঁর এ উপন্যাসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখানে উঠে এসেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, সেই ঘটনাগুলোকেই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে ‘একাত্তরের পরি’ উপন্যাসটি লিখেছেন। বাংলাদেশি নভেলসকে তিনি দিয়েছেন একান্ত সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বরুণ কুমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশি নভেলস: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘একাত্তরের পরি’ সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন।
জিয়াউল হক : ‘একাত্তরের পরি’ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের আনন্দ, বেদনা, প্রেম, বিরহ ও নানা টানপোড়েনের কাহিনির পাশাপাশি তার সারা অন্তর জুড়ে থাকা ১১ মাসের কন্যা হারানোর দুঃসহ বেদনার কাহিনি মূর্ত হয়ে উঠেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকদের শাসনের নামে বাঙালিদের উপর শোষণ ও নির্যাতনের চিত্র, বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সকল আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি কসাই সেনাদের পৈশাচিক গণহত্যা, ত্রিশ লক্ষ শহিদের বুকের তাজা রক্ত, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের পাশাপাশি আজিম নামের একজন হতভাগ্য কৃষকের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের গৌরবময় কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। সে বাড়িতে যুবতী স্ত্রী ও ১১ মাসের কন্যা পরিকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে বাড়িতে ফিরে সে জানতে পারে তার আদরের কন্যা পরি কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। দুঃখের কাহিনির এখানেই শেষ না। মিলিটারির ভয়ে গ্রামের সব মানুষ পালিয়ে থাকায় তাকে দাফন করাও সম্ভব হয়নি। অভাগা মা এক টুকরা কাপড়ে জড়িয়ে তাকে বানের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। এ কথা শোনার পর আজিম পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কত সহযোদ্ধাই তো শহিদ হলো। আমি কেন শহিদ হলাম না। তাহলে আজ আমাকে এত দুঃসহ দুঃখ বেদনা ভোগ করতে হতো না।’
বাংলাদেশি নভেলস : একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনি কি মনে করেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরো আরো উপন্যাস হওয়া উচিত বা এখন যতটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য চর্চা হচ্ছে তা কি যথেষ্ট?
জিয়াউল হক : যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লক্ষ শহিদের বুকের এক সাগর রক্ত, দুই লক্ষ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি হানাদার সেনারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল রূপসী বাংলার শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ, কত বাবা-মা আজও তাদের সন্তান হারানোর দুঃখকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে বেঁচে আছেন, কত বোন তার প্রিয়তম স্বামী হারানোর বেদনার অশ্রু মুছে নিজেই জীবন যুদ্ধের সৈনিকের বেশে সংসারের সকল দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল, যুদ্ধ থেকে ফিরে না আসায় কত সন্তান একবারের জন্যও তার পিতার মুখ দেখা হয়ে ওঠেনি, কত ভাই বোন তার প্রিয় সহোদর হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে আজও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে; সেই দেশের মুক্তির সংগ্রামের কথা কতটুকুই বা আমাদের সাহিত্যে উঠে এসেছে? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ লেখালেখি হলেও আমার মতো একজন ক্ষুদ্র লেখকের কাছেও মনে হয় এখনও তেমন কোন কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়নি যা পড়ে আজকের প্রজন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দিনের সেই সব ভয়ঙ্কর ঘটনা জানতে পারবে, যা পড়ে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শিখবে। তাছাড়াও আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শিক্ষিত সমাজের পাশাপশি এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষও অংশগ্রহণ করেছিল। তাইতো আমার মনে হয় যুগের পর যুগ,শতাব্দীর পর শতাব্দী লিখে গেলেও তা শতভাগ পূর্ণতা পাবে না।
বাংলাদেশি নভেলস : আপনার লেখা অধিকাংশ বই-ই আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে, আমরা কি বলতে পারি এগুলো আপনার রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা?
জিয়াউল হক: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বলতে চাই আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের উপর আমার লেখা বইগুলো যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতার আলোকেই লেখা। তাছাড়া আমার মুক্তিযুদ্ধের লেখাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। (ক) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, (খ) মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সিরিজের ‘শত মুক্তিযোদ্ধার বিজয়গাথা-১’ থেকে ‘শত মুক্তিযোদ্ধার বিজয়গাথা-৬’ পর্যন্ত আমার ৬ খণ্ড বই আছে। এর প্রতিটা বইতে আমার নিজের যুদ্ধদিনের কাহিনিসহ ১০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ দিনের গৌরবময় কাহিনি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ‘রক্তে ভোজা শার্ট’ ও ‘একাত্তর্রে পরি’ নামের আমার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ২টি ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের সুখ, দুঃখ, বেদনা, হতাশাসহ জীবনের নানা টানপোড়েন নিয়ে লেখা কাহিনি। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় আমার প্রতিটি বই-ই রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা।
বাংলাদেশি নভেলস: যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকেন্দ্রিক লেখালেখি করেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কী?
জিয়াউল হক: অবশ্যই বলবো। আমার মতে দেশের ইতিহাসের আলোকেই ইতিহাসকেন্দ্রিক লেখালেখি এগিয়ে নিতে হবে। তাই একজন লেখককে যেমন প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে, তেমনি একটা বিশেষ বিষয়ের উপর তাদের মনোযোগী হতে হবে। আর তা হলো কোন যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় হঠাৎ করেই আমরা স্বাধীনতা লাভ করিনি। তার জন্য আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছিল দীর্ঘ সংগ্রামের পথ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকদের শোষণ ও নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে দিনে দিনে বাঙালিদের জাতিয়তাবাদ জাগ্রত হতে শুরু করে। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবীতে সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক প্রমুখ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে আমাদের স্বাধীনতার যে বীজ বপন করেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলেই মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তাইতো ইতিহাসকেন্দ্রিক কোন লেখা লিখতে হলে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রতিটা ধাপকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca