উপন্যাস কবিতা গল্পগ্রন্থ কিংবা প্রবন্ধ যে ধারারই বই হোক না কেন, পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগে তার গায়ের জামাটি বানান বা নির্মাণ করেন একজন শিল্পী। লেখকের ভাবনার সাথে একজন শিল্পীর মনন যখন একটা সরলরৈখিক সাযুজ্য তৈরি করে বা একটি বিন্দুতে এসে মিলিত হয় তখনই সেই গ্রন্থটির প্রচ্ছদ হয়ে ওঠে নান্দনিক। প্রথম দেখাতেই একজন পাঠক বইটি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা লাভ করে। কিন্তু প্রচ্ছদ আঁকা বা নির্মাণের এই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিশ্রম সাধ্যও বটে। এমন শিল্পমণ্ডিত কাজ বাংলাদেশের যে কয়জন শিল্পী করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে মোস্তাফিজ কারিগর একটি উজ্জ্বল নাম। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ তথা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে যারা লেখালেখি করেন কিংবা প্রকাশনা সংস্থার সাথে যুক্ত তাদের কাছে তিনি তুমুল প্রিয়। চিত্রকলায় রয়েছে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। রঙতুলি, ক্যানভাস কিংবা ডিজিটাল মাধ্যম আঁকাআঁকির বাইরেও তিনি নিবিষ্টচিত্তে লেখালেখি করেন। পেয়েছেন সাহিত্যে পুরস্কার। তাঁর আঁকা ছবি দিয়ে হয়েছে প্রদর্শনীও। শিল্পী ও লেখক মোস্তাফিজ কারিগরের সাথে তাঁর শিল্পের সাথে অন্তরঙ্গতা নিয়ে আলাপচারিতা করেছেন বরুণ কুমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশি নভেলস : প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলায় ও সারাবছরব্যাপী অসংখ্য নতুন বই প্রকাশিত হয়, তারমধ্যে অসংখ্য উপন্যাসের প্রচ্ছদের সৃষ্টি হয় আপনার হাত দিয়ে। কীভাবে আপনি একটা বড় উপন্যাসের গল্পকে নিয়ে আসেন একটা ক্যানভাসে?
মোস্তাফিজ কারিগর : একটা বড় উপন্যাস মানে একটা বড় ক্যানভাস। সেখানে নানা ঘটনা, সময়কাল, বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটে। একটা বইয়ের প্রচ্ছদের আয়তন তো সেই অর্থে খুব বেশি নয়, সামান্যই। স্বল্প আয়তনের সেই ক্ষেত্রে একটা উপন্যাসের এতো বিস্তৃত পরিসরকে পরিস্ফুটিত করা একজন শিল্পীর জন্যে খুব চ্যালেঞ্জের। সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশের বেশির ভাগ উপন্যাসই প্রকাশিত হয় বইমেলার সময়টাকে ঘিরে, তখন তো খুব কাজের চাপ থাকে, তাই পুরো উপন্যাসটা পড়ার সুযোগ ঘটে না। বইয়ের সারামর্ম পড়ে পুরো বিষয়বস্তুকে প্রতিনিধিত্ব করে, এমন একটি বিষয় আমি প্রচ্ছদে আঁকার চেষ্টা করি। যাতে পাঠক বইটি হাতে নিয়ে প্রাথমিক ভাবে বইটির সাথে একটা যোগাযোগ তৈরি করতে পারেন। তবে বইয়ের বিষয়ের সাথে হুবুহু সামঞ্জস্য ঘটিয়েই যে প্রতিটি উপন্যাসের প্রচ্ছদ হতে হবে বা উপন্যাসের পুরো বিষয়কে প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তুলতে হবে- সম্ভবত সে বিষয়টা তেমন সঠিক নয়। একজন লেখক উপন্যাসটি লিখছেন তার সৃষ্টিশীলতা দিয়ে, আর একজন শিল্পী তার সৃষ্টিশীলতা দিয়ে প্রচ্ছদ আঁকছেন, দুটি ভিন্ন মাধ্যম। তাতে তারতম্য ঘটা স্বাভাবিক। অনেক তারতম্য ঘটার পরেও দুটি শিল্প মাধ্যমের একটা যোগাযোগ ঘটে যায়, সেটা খুব গভীর শিল্পান্বেষী না হলে ধরা যায় না। আমাদের এখানে লেখকদের মধ্যে একটা প্রবণতা খুব লক্ষ্য করি- তারা তাদের বইয়ের, ধরা যাক একটা উপন্যাসের সমস্ত বিষয়কে প্রচ্ছদে দেখতে চান। এখানে চিত্রশিল্পীর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বা চিত্রশিল্পীর মননের সাথে লেখকের যোগাযোগের অভাব রয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়।
বাংলাদেশি নভেলস : আপনি একজন শিল্পী ও লেখক। দুই ক্ষেত্রেই আপনার সাফল্য ঈর্ষণীয়। শিল্পী নাকি লেখক কোন সত্তাকে বেশি উপভোগ করতে ভালো লাগে?
মোস্তাফিজ কারিগর : আমার কাছে লেখক ও শিল্পী, দুটো আলাদা সত্তা মনে হয় না কখনো। দুটো একই সত্তা। প্রকাশের মাধ্যমটা ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কখনো লেখায় নিজেকে খুঁজছি, কখনো রঙ-রেখায়। আমার সমস্ত সৃষ্টিশীলতা তার গতিপথ অনুযায়ী কখনো লেখায় কখনো আঁকায় আনন্দ খুঁজে নেয়। আর একটা বিষয়, আপনি যে সাফল্যের কথা বলছেন, তাতে আমার খুব আস্থা নেই। এই মিডিয়াতাড়িত সময়ে সকল সাফল্যই কেমন সন্দেহ লাগে আমার। কাজ করে যাওয়াটাই আমার কাছে সাফল্য। তবে আমার ভাবের প্রকাশ ঘটাতে এই দুটো মাধ্যম নিয়ে মাঝে মাঝে খুব বিপদে পড়ে যাই । যখন কবিতা বা ছোটগল্প আসছে মাথায়, তখন একই সাথে প্রচুর চিত্রকল্প আসে বলে, ছবি আঁকার জন্যেও মন ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়। তখন একটা যন্ত্রণাও হয়।
বাংলাদেশি নভেলস : যদিও এটি একটি কঠিন প্রশ্ন, এ পর্যন্ত কতগুলো উপন্যাসের প্রচ্ছদ করেছেন? কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে কতগুলো প্রচ্ছদ করেছেন?
মোস্তাফিজ কারিগর : এটা সত্যিই, সঠিক বলা কঠিন; কতগুলো উপন্যাসের প্রচ্ছদ করেছি, বলা যাবে না সেভাবে। সেই ২০১০/১১ সাল থেকে প্রচ্ছদ করছি, এতোদিনে ৫ থেকে ৬ হাজার বইয়ের প্রচ্ছদ করা হয়ে গেছে। তবে এর মধ্যে কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদই বেশি। বাংলা ভাষায় সম্ভবত কবিতার বইয়ের সংখ্যাই বেশি হবে।
বাংলাদেশি নভেলস : একটু ভিন্ন প্রশ্ন করি, বাংলাদেশের একটা বড় অংশের মানুষ রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক চিন্তা করেন, আর আপনি ঢাকা ছেড়ে চলে এসেছেন কুষ্টিয়ায়। এই যে, অবস্থানগত পরিবর্তন এটা কি আপনার কাজকে প্রভাবিত করছে? আর কোন ভাবনা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন?
মোস্তাফিজ কারিগর : আমি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীর চাকরির কারণে হয়ে উঠছিলো না। কুষ্টিয়াতে তার বদলিটা যখন হয়ে গেলো, আমি আর দেরি করিনি, চলে এসেছি ঢাকা ছেড়ে। কেন না ঢাকার জীবনটা খুব বিশ্রী লাগতো; আলোহীন, বৃষ্টিহীন, জ্যোৎস্নাহীন, নদীহীন। পুঁজির পৃথিবীতে মানুষ সবাই ঊনমানুষে পরিণত হয়ে গেছে। ঢাকার মতো কসমোপলিটান শহরে জীবনও জীবিকার জন্যে দৌড়ানো সব মানুষকে কাফকার মেটামরফসিসের তেলাপোকার মতো লাগতো। হাঁপ ধরে যেতো। আমার মনে হয়েছে টাকা আর খ্যাতি অর্জন কখনোই একজন সৃষ্টিশীল মানুষের লক্ষ্য নয়, অন্তত আমার নয়। তাই ঢাকার সমস্ত কিছুকে ছেড়ে আমার চলে আসতে কোনো পিছুটান ছিলো না। কুষ্টিয়াতে এসে অন্তত প্রকৃতির সাথে দেখা হয়, এখানে আমি বাতাসকে দেখতে পায়। আমার লেখা ও আঁকাতে তার নানা প্রভাব পড়ছে পজিটিভলি।
বাংলাদেশি নভেলস : আপনার সাম্প্রতিককালের পেইন্টিংস নিয়ে প্রদর্শনী বা এক্সিবিশন করার প্ল্যান আছে কি?
মোস্তাফিজ কারিগর : আছে। চেষ্টা করছি। বইয়ের প্রচ্ছদ করার পেছনে বছরের একটা বড় সময় আমার খরচ হয়ে যায়। তাই নানাভাবে পিছিয়ে পড়ছি…। প্রদর্শনীর জন্য কাজ প্রস্তুত করে রেখেছি। নানা গ্যালারিতে চেষ্টা করছি স্লট পাবার জন্যে। দেখা যাক কী হয়। যেখানেই হোক এবছর একটা প্রদর্শনী করবো বলে স্থির করেছি।
বাংলাদেশি নভেলস : শালঘর মধুয়া ছাড়াও আর কোন কোন বই নিয়ে কাজ করেছেন, সামনে কোন বিষয় নিয়ে লিখছেন?
মোস্তাফিজ কারিগর : ‘শালঘর মধুয়া’ র পরে আমার বেশ ক’টি বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ তে উপন্যাস ‘বস্তুবর্গ’ জেমকন সাহিত্য পুরস্কার পায় এবং ২০১৬ এর বইমেলাতে কাগজ প্রকাশনী সেটা প্রকাশ করে। সে বছরই অগ্রদূত প্রকাশনী থেকে ‘স্বয়মাগতা’ নামে কবিতার বই প্রকাশিত হয়। তারপর কবি প্রকাশনী থেকে ২০১৯ এ ছোটগল্পের বই ‘কেরু এন্ড কোং’ প্রকাশিত হয়, ২০২১ শে কৌম থেকে প্রকাশিত হয় কবিতার বই ‘অকারে হলুদ বর্ণ’। ২০২৩ এ কলকাতার ছোঁয়া প্রকাশনী থেকে কবিতার বই ‘ বিভোর আলেক বন’ প্রকাশিত হয়। ২০২৩-এই কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স থেকে ‘বস্তুবর্গ’ উপন্যাসটির ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। আর কবিতা গল্প লিখছি। উপন্যাসের লেখার চেষ্টাও করছি।
বাংলাদেশি নভেলস : আপনি প্রচুর কবি, লেখক, প্রকাশকদের সাথে কাজ করেন, কাজের এই জার্নিতে কোন কোন বিষয় আপনার ভালো লাগে, আর কোন কোন বিষয়ে বিব্রতবোধ করেন?
মোস্তাফিজ কারিগর : ভালো লাগার বিষয় তো প্রচুর। দেশের কত কত কবি-লেখকদের বইয়ের প্রচ্ছদ করছি, তাদের বইয়ের মোড়কে আমার আঁকা জড়িয়ে থাকে। কত কত পাঠকের হাতে বইটা যায়। দুই বাংলার প্রথিতযশা লেখকদের বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি, সেটা তো আমার জন্যে খুব শ্লাঘার। কত কবি-লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি, কতজনকে দৃশ্যত চিনি না, দেখা হয়নি কখনো। এমন কারো কারো সাথে হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে গেলে খুব আনন্দ লাগে।
এতোদিন প্রচ্ছদ করতে করতে কত বিচিত্র বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছি। রাতদিন খেটে খেটে প্রচ্ছদ করার পরেও সম্মানী পাইনি। একই প্রচ্ছদ বার বার করেছি। লেখকরা ফেরত দিয়েছেন। খুব কষ্ট হতো। লেখকরা তাদের নানা চিন্তা, আইডিয়া দিয়ে প্রচ্ছদ করিয়ে নিতে চান, তাতে আমার শিল্পীসত্তার সাথে সংঘর্ষ ঘটে। সহ্য করে আবার কাজ করি। সবচেয়ে কষ্ট ও মানসিক যন্ত্রণার বিষয় প্রতি বছর বইমেলাকে ঘিরে বইমেলার আগের একটা মাসে প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ করতে হয়। প্রকাশক বা লেখক রাতে বইয়ের নাম দিয়ে, সকালেই প্রচ্ছদ চান। এটা কোনো কাজের সুষ্ঠু প্রক্রিয়া হতে পারে না। এটা আমাকে খুব বিব্রত করে।
বাংলাদেশি নভেলস : বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে আপনার বিশেষ কোনো মতামত বা অভিমত বা প্রত্যাশা আছে কি?
মোস্তাফিজ কারিগর : এতো বড় বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের আমি এতো সামান্য এক কণা যে শিল্প ও সাহিত্যের মতো এতো মহৎ ও বিস্তৃত বিষয় নিয়ে অভিমত প্রকাশের যে নূন্যতম যোগ্যতা অর্জন করা দরকার, তা আমি করে উঠতে পারিনি। সর্বোপরি শিল্প ও সাহিত্য তো এখন মিডিয়া ও সমাজের নানা ক্ষমতাবানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যের সত্যিকার স্বরূপ খুঁজে পাওয়া এখন খুব কঠিন কাজ। আমার একটা জিনিস খুব মনে হয় চারপাশটা দেখে- মানুষের মধ্যেকার মগ্নতাটা হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আমরা খুব প্রচার কাঙাল, খ্যাতির কাঙাল হয়ে উঠেছি। আমাদের ভেতরে একটা বিশ্বাস সত্যি হয়ে উঠছে, মৃত্যুর পরে আখেরি কিছু নেই। তাই যা সুনাম-খ্যাতির দরকার জীবিত অবস্থায় তা হাসিল করে যেতে হবে এবং এই বিশ্বাসও আমাদের শক্ত হচ্ছে দিন দিন; আমাদের দেহ গত হওয়ার পরে মহাকাল আমাদের মনে রাখবে না কিছুতেই…তাই নিজের ঢোলটা নিজে পিটিয়ে ফাটিয়ে দিয়ে যাবো যেভাবেই হোক। পৃথিবীতে এতো বড় শিল্পী-সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে যে, তাদের কাছে আমাদের ক্ষুদ্রতা আমরা খুব স্পষ্ট বুঝি। সেই হতাশা থেকেই আমরা হয়তো এতো প্রচারকাঙাল, প্রতিযোগী হয়ে উঠেছি পরস্পর।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca