আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য গল্প কবিতা উপন্যাস; সেগুলোকে ঘিরে হয়েছে চলচ্চিত্রও। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগের ফলেই একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আমরা পেয়েছি। কবি ও কথাসাহিত্যিক মৌসুম মনজুর তাঁর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরেছেন বহুবার। যুদ্ধের নারকীয়তা, ভয়াবহতা তাঁর কবিতার ছত্রেছত্রে এলেও উপন্যাসের মতো বড়ো ক্যানভাসে সেসব নির্মমতার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ‘সৈয়দপুর একাত্তর ও একটি প্রতারক ট্রেন’-এর গল্প বিন্যাসের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দপুরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ, লোমহর্ষক ঘটনা বিবৃত হয়েছে উপন্যাসটিতে। এতে রয়েছে, বয়লারে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা মানুষের কথা। ঘটনাবহুল বর্ণনায় ঔপন্যাসিক বারবারই পাকিস্তানিদের পৈশাচিক নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন।
মৌসুম মনজুর ইংরেজি সাহিত্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে ঢাকার একটি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। ইতোমধ্যে তাঁর লেখা অর্ধ-ডজনেরও অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশি নভেলসের সাথে কথা বলেছেন তাঁর লেখা ‘সৈয়দপুর একাত্তর ও একটি প্রতারক ট্রেন’ নিয়ে। আলাপচারিতায় তাঁর সাথে ছিলেন বরুণ কুমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশি নভেলস : ‘সৈয়দপুর একাত্তর ও একটি প্রতারক ট্রেন’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমাদের বলুন।
মৌসুম মনজুর : ‘সৈয়দপুর একাত্তর ও একটি প্রতারক ট্রেন’ এর বিষয়বস্তু ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা। সৈয়দপুরে বিহারি ও পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গণহত্যা চালায় নিরীহ বাঙালি ও হিন্দু মারোয়ারীদের উপর। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বয়লারে প্রায় তিন শতাধিক বাঙালিকে জীবন্ত হত্যা করা হয়। সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট নির্মাণেও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক নারকীয়তার উদাহরণ চার শতাধিক মারোয়াড়ীকে নিশ্চিহ্ন করার ঘটনা। মাড়োয়ারিদের ট্রেনে করে ভারতের শিলিগুড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা বলে সৈয়দপুরের অদূরে গোলাহাটে হত্যা করা হয় এসব যাত্রীদের। তাদের কয়েকজন পালিয়ে বেঁচে যায় এবং তারা আজো সেই বিভৎস স্মৃতি নিয়ে সৈয়দপুর শহরে নিঃস্ব হয়ে বসবাস করছে। সৈয়দপুরে আটকা পড়া একটি অবরুদ্ধ বাঙালি পরিবার, যার কর্তা নিখোঁজ, দুটি যুবতী মেয়ে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়ার লোমহর্ষক ঘটনা এবং গ্রামে গিয়ে রাজাকারের লোলুপতার শিকার হয়ে মিলিটারির হাতে হস্তান্তর। ক্যাম্পে নেয়ার পথে ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। পাশাপাশি ট্রেনে অগ্নি সংযোগে ৪৫০ জনের নিধনসহ আশেপাশের এলাকার হত্যাযজ্ঞ, আগুন, পাকিস্তানিদের গণহত্যাকে উপজীব্য এই উপন্যাস।
বাংলাদেশি নভেলস : একাত্তরকে উপজীব্য করে উপন্যাস লেখার পেছনে আপনার ভেতরে কোন দর্শন কাজ করেছে?
মৌসুম মনজুর : ১৯৭১ সালে আমি ১১ বছরের কিশোর। ফাইভে পড়ি। সৈয়দপুর শহরে ৫/৬ জন ভাইবোন থাকি লেখাপড়ার জন্য। মা থাকেন গ্রামে, জমিজিরাত দেখাশুনা করেন। বাবা ডা. খোরশেদ আলী সরকার ডাক্তার, আওয়ামি লীগের উচ্চ সারির নেতা। ডিসপেনসারিতে যতটা না চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন তার চেয়ে বেশি জয় বাংলার সরগরম আর রাজনীতির ডামাডোল ছিলো । যতই দিন এগিয়ে আসে ততই উত্তেজনা বাড়তে থাকে সৈয়দপুর শহরে। বিহারী অর্ধুষিত এলাকা হওয়ায় বাবা তাদের টার্গেটে পরিণত হন। বাবা আমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে দেরী হয়ে যায়। তারপর আসে সেই ভয়াল রাত। আমাদের জীবনের অগ্নি পরীক্ষা। অনেক কৌশল করে, মৃত্যুকে সাথে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি গভীর রাতে। কুচকুচে অন্ধকার আর কড়া পাহারা ভেদ করে এগিয়ে চলে বয়স্ক দুইবোনকে সাথে করে আমাদের জীবন বাঁচানোর দুর্মর পদযাত্রা। আমাদের আশেপাশের ইদারাগুলো লুকিয়ে ভর্তি হতে দেখেছি। বাসায় আত্মগোপন অবস্হায় শুনেছি বাঙালি নিধনের আর্তচিৎকার। বাড়ি ঘরে লুটপাট শেষে অগ্নি সংযোগ, যুবতী মেয়েদের সম্ভ্রমহানির কাকুতিমিনতি, সব ছিলো কৈশোরে প্রত্যক্ষ করা এক রক্তাক্ত ইতিহাস। আমার বর্ষীয়ান জেঠাকে ধরে নিয়ে যায় সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট নির্মাণে। চলে তার উপর অকথ্য অত্যাচার। অনেকে গুম খুনের শিকার হন, সামান্য অবহেলায়। রেলওয়ে কারখানার বয়লারে তিন শতাধিক কর্মচারীকে জীবন্ত হত্যা, ট্রেনে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে গোলাহাটে ৪৫০ এর কাছাকাছি মারোয়াড়ীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ট্রেন থেকে তাদের সুন্দরী মেয়েদের করা হয় লুট, যাদের আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুরো সৈয়দপুর এক বধ্যভূমি। এই হত্যাযজ্ঞ, এই গণহত্যা এক দীর্ঘস্হায়ী মর্মবেদনার করুণ কাহিনি। সেই নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, অগ্নিসংযোগ, দলে দলে ভারতে পলায়নের সেই মানবেতর দৃশ্য আজো স্পষ্ট। সেই রক্তাক্ত দৃশ্যপট, জয় বাংলা ও স্বাধীনতার বুভুক্ষাই এই উপন্যাস লেখার মূল অনুঘটক।
বাংলাদেশি নভেলস : আপনার আর কোন কোন গ্রন্থে বা লেখায় মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছেন?
মৌসুম মনজুর : মুক্তিযুদ্ধের উপর আপাততঃ এটি আমার একমাত্র উপন্যাস। আরো একটি উপন্যাস চলমান আছে যা সামনের বইমেলায় প্রকাশিত হবে। যুদ্ধের পটভূমিকায় আমার কিছু ছোটগল্প আছে। কাঁঠাল পাতা, ট্রেন আসে ট্রেন যায়, যুদ্ধের বউ ইত্যাদি। বিশেষ করে যুদ্ধের বউ গল্পটি ভিন্নধর্মী। যুদ্ধ শেষ হলে সৈয়দপুরে আটকা পড়া অবাঙালিরা নিদারুণ অর্থকষ্টে পতিত হয়। এমনিতে তারা পরাজিত তার উপর বাঙালিদের চোট পাট কিল ঘুষিতে ওরা অস্থির । ওরা ঘরের জিনিসপত্র, গরু ছাগল, থালা বাসন সবকিছু বিক্রি করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। বাঙালিরা সস্তা দামে সেগুলো কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নানা জায়গায়। কোনো কোনো বাঙালি জিনিসপত্রের সাথে সুন্দরী বিহারী মেয়েদের বিয়ে করে নিয়ে যায়। তেমনি এক বিহারী মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায় আধা পাগল মিস্টার আলী। গ্রামে এ নিয়ে হুলুস্থুল। রৈ রৈ কাণ্ড। পুরো গ্রাম ভেঙ্গে পড়ে মিস্টার আলীর বাড়িতে। বউয়ের রূপ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে পড়ে! ওদিকে বাপের বাড়ি চিরতরে চলে যাওয়া মিস্টার আলীর আগের বউ ছুটে আসে হন্তদন্ত হয়ে। তারপর শুরু হয় চিরন্তন সেই চিত্রনাট্য। নাহ আগের বউ বোকা নয়। সে মেতে ওঠে নতুন খেলায়। গ্রামের নওজোয়ান ছেলেদের হাত করে। শুরু হয় নতুন এক যুদ্ধ!
বাংলাদেশি নভেলস : বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস বা গল্পগ্রন্থের কাজ যা হচ্ছে তা কি যথেষ্ট?
মৌসুম মনজুর : স্বাধীনতার আজ ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বায়ান্ন বছর একটি দীর্ঘ সময়। ব্যাপক সময়। যে স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণদান করেছেন, ২ লক্ষ জননীর সম্ভ্রম হানী ঘটেছে, সেই তীব্রতার প্রকাশ আরো ব্যাপক ও সমৃদ্ধশালী হওয়া যৌক্তিক ছিলো সাহিত্যে। যারা সে সময়ে প্রত্যক্ষ করেছেন এই নারকীয়তা, সেই তাণ্ডব দেখার রক্তচক্ষুধারী শব্দ সৈনিকেরা ক্রমান্বয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তাদের অনেকের সেই সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা ছিলো। অনেকেই সাহিত্যকর্মে পরীক্ষিত, উত্তীর্ণ। তাদের হাত দিয়ে যুদ্ধ ভিত্তিক প্রায় ৩০/৩৫ উপন্যাস আমরা পেয়েছি। তাদের কাছে প্রত্যাশাটা খুবই স্বাভাবিক, সঙ্গত। এই সংখ্যা বৃদ্ধি করা আমাদের স্বাধীনতার দায়বদ্ধতা। ইদানিং অনেকে ভালো লিখছেন কিন্তু চাক্ষুস অভিজ্ঞতা ভিন্ন একটি এডভান্টেজ যা কল্পনার কব্জিতে তেমন যুৎসই হয় না। কল্পনা ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণে একটি লেখা হয়ে ওঠে সোমত্ত, পাকাপোক্ত। সেই রণাঙ্গনের কারিগররা এখনো সজাগ, জীবিত। তাদের কলম সক্রিয় থাক শেষ দিন পর্যন্ত এটাই আমাদের কামনা।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca