প্রথমে দর্শনদারি পরে গুণবিচারী— প্রবাদটি নতুন বইয়ের ক্ষেত্রেও ভীষণ প্রাসঙ্গিক। একজন পাঠক একটি নতুন বইয়ের বিষয় বা কনটেন্ট সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ফ্ল্যাপ থেকে পেলেও তার মনের রসায়নে প্রচ্ছদ কিন্তু অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। লেখকের বিস্তৃত কিংবা সংক্ষিপ্ত ভাবনার প্রতিবিম্ব তৈরিতে একজন শিল্পী আয়নার ভূমিকা পালন করেন। যেখানে পাঠকের পক্ষে একজন লেখককে বেছে নেওয়া বা না নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। শিল্পীর রঙ, তুলি, পেন্সিল কিংবা কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সহযোগে একটা ভাবনা বা একটা গল্প পরিণত হয় একটা চিত্রকর্মে। যেখানে একজন শিল্পী তার মেধার পরিচয় রাখেন। শিল্পী আইয়ুব আল আমিন বর্তমান সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন প্রচ্ছদ নির্মাতা। বইমেলা ছাড়াও সারাবছরব্যাপী তিনি ব্যস্ত থাকেন শিল্পের এই মাধ্যম নিয়ে। নিঃসন্দেহে এটি খুব জটিল কর্ম। তাঁর শৈল্পিক মন ও বোধের সম্মিলনে প্রচ্ছদের এই প্রক্রিয়া হয়ে যায় নান্দনিক। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদে তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। ফলে একাডেমিক বিদ্যা এবং পেশাগত জীবনের চর্চার কারণে অহর্নিশ শিল্পের সাথেই তাঁর ঘরবসতি। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও রয়েছে ভীষণ সংযোগ। জীবনের গল্পকেই তিনি কলমে তুলে আনেন। শিল্পী আইয়ুব আল আমিন বাংলাদেশি নভেলসকে দিয়েছেন একান্ত সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছে বরুণ কুমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশি নভেলস : আপনি একজন শিল্পী। আবার আপনি একজন লেখকও। কোন সত্তায় নিজেকে আবিষ্ট করে রাখতে ভালো লাগে?
আইয়ুব আল আমিন : মানুষের সৃজনশীল সত্তা তো একটিই। এটি দিয়েই সে সমস্ত সৃজনশীল সৃষ্টি করে, কী ছবি আঁকা কী সাহিত্য রচনা কী সঙ্গীতের সাধনা। সে জন্য ছবি আঁকা আর লেখা দুটো দুই মাধ্যম হলেও একটা সত্তা থেকেই আসে। আমার যেহেতু ছবি আঁকাই পেশা সেহেতু না চাইলেও অনেক আঁকাআঁকি করতে হয়, আমি যেহেতু একটা জাতীয় দৈনিকে কাজ করি সেখানে প্রতিদিন বহু ধরনের বিষয়ের উপর কাজ করতে হয়। সেই কাজগুলোতে মনের সাথে যোগ ওইভাবে থাকে না। যদিও আমি সব কাজই মনোযোগ দিয়েই করার চেষ্টা করি। তারপরও কখনো কখনো একঘেয়েমি লাগে। তখন ফোনের প্যাডেই আঙুল চাঁপতে শুরু করি। যা মনে আসে তাই লিখি। সেখানে কোন চাপ থাকে না। কারো কথামত লিখতে হচ্ছে এমনও নয়। লেখাটি হয়ে গেলে কোথাও ছাপতে হবে এমন বাসনাও থাকে না। ফলে মনের একটা নির্মল ছাপ তাতে আপনা আপনি চলে আসে। পরে কোন সময় যখন ঐ লেখাটা পড়ি মনে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। আর আমার পেশার বাইরে আমি যখন নিজের জন্য ছবি আঁকি সেই মুহুর্তে আমার মাথাটা একদমই শূন্য হয়ে যায়, সেখানে দুনিয়ার কোন কিছুই আর থাকে না। এমনকি আমি খাবার খেতেও ভুলে যাই। একটা ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেলে যে অদ্ভুত শান্তিটা লাগে তা কোনো ভাষাতেই আমি লিখতে পারবো না এখানে।
বাংলাদেশি নভেলস : কামনা বাসনালয়’ ও ‘বুক ও পিঠের গল্প’ সম্পর্কে আমাদের যদি কিছু বলেন?
আইয়ুব আল আমিন : আমার ‘কামনা বাসনালয়’ ২০১৯ এর বই মেলায় প্রকাশিত হয়। এটি আমার প্রথম বই। তখন বই প্রকাশের খুঁটিনাটিও এতো বুঝতাম না। আমার সে সময়ের এলোমেলো লেখাগুলি চিত্রা প্রকাশনী অনেক যত্ন করে প্রকাশ করে। নাম গল্পটার উপর ভিত্তি করে প্রখ্যাত শিল্পী ধ্রুব এষ অনেক সুন্দর করে একটা প্রচ্ছদ করে দেন। আসলে ঐ গল্পটার নাম শুনে সবাই ভাবে যে কাম, যৌনতা বা শরীরবৃত্তীয় বিষয়-আসয় নিয়ে গল্পটা। কিন্তু মোটেও এমনটা নয়। কামনা বাসনালয়ের গল্পটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের। বাজারে একজনের হাড়িবাসনের দোকান ছিল। তার মেয়ের নাম ছিল কামনা। তার যেহেতু হাড়ি বাসনের দোকান তিনি দোকানের নাম দিলেন ‘কামনা বাসনালয়’। ছোট বড় এমন আরো ২১ টি লেখা নিয়ে বইটি। এরপর ২০২২ সালে করোনার পর প্রকাশ হয় বুক ও পিঠের গল্প। এখানে সবগুলো গল্পই মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না এবং আনন্দ বেদনা এবং ভালোবাসা ও অবেলার । বইটিতে ভালোবাসাকে আমি বুক ও অবহেলা বা ঘৃণাকে আমি পিঠের সাথে তুলনা করে বইটির নামকরণ করেছি। বুক ও পিঠের গল্প প্রকাশ করেছে কিংবদন্তি প্রকাশন। আর বইটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত প্রচ্ছদ শিল্পী আমার অতি প্রিয়জন সৌরীশ মিত্র।
বাংলাদেশি নভেলস : এ পর্যন্ত কতগুলো উপন্যাসের প্রচ্ছদ করেছেন? আর মিলিয়ে কতগুলো হতে পারে?
আইয়ুব আল আমিন : এখানে উপন্যাস তুলনামূলক কম প্রকাশিত হয় আপনি জানেন। এ পর্যন্ত কতগুলো উপন্যাসের প্রচ্ছদ করা হয়েছে ওইভাবে হিসেব করা হয়নি কখনো। তবে আমি ঢাকায় এসে পুরোদমে কাজ শুরু করেছি ২০১৭ সাল থেকে ৷ তখন থেকে এ যাবত বেশ কিছু উপন্যাসের প্রচ্ছদই করা হয়েছে দুই বাংলার। তবে সেই তুলনায় গল্প কবিতা ও প্রবন্ধের প্রচ্ছদ করা হয়েছে বেশি। এখনো সেরকমই হচ্ছে। সব মিলিয়ে কতগুলো বইয়ের প্রচ্ছদ করা হলো সেটাও কখনো গুনে দেখা হয়নি। তবে সব মিলিয়ে হাজার খানেকের মতো হতে পারে।
বাংলাদেশি নভেলস : শিল্পী হিসেবে ও লেখক হিসেবে কোন কোন শিল্পীর কাজ ও কোন কোন লেখকের লেখা আপনাকে বেশি আকর্ষণ করে?
আইয়ুব আল আমিন : আমি সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদ দেখে মুগ্ধ হই বরাবরই। তার ড্রয়িং নির্ভর প্রচ্ছদগুলো আমার কাছে এক কথায় অনন্য। এদেশে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। উনার আঁকা প্রচ্ছদে বিষয়বস্তুর সাথে হস্তাক্ষরের যে কম্পোজিশন তা আমি আর অন্য কারো কাজে পাইনা। উনার একেকটা বইয়ের প্রচ্ছদই একেকটা পরিপূর্ণ শিল্পকর্ম। আর আমরা ছোটবেলা থেকে বড়ই হয়েছি শিল্পী হাশেম খান-এর ছবি দেখে দেখে। এদেশের মাটি নদী ফুল পাখি আকাশ বাতাস চিনেছি উনার আঁকা ছবি দেখে দেখেই। এরপর ধ্রুবদার কথা আর কী বলবো। এদেশে প্রচ্ছদ শিল্পে তিনি এখন জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর অদ্ভূত অদ্ভুত সুন্দর সব প্রচ্ছদ আছে সেগুলো যত দেখি ততই মুগ্ধ না হয়ে পারি না। উনার পর যারা প্রচ্ছদ নিয়ে কাজ করছেন তাদের মধ্যে সব্যসাচী হাজরা দাদার কাজ আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। উনি মিনিমাল কাজ করেন যতটা কম রঙ, রেখা এবং কলেবরে। এটাই আমাকে মুগ্ধ করে সবচেয়ে বেশি। উনি এতোটাই পারফেকশনিস্ট যে উনার কাজে এক নজরেই সেটা ধরা পড়বে যে কারও কাছেই। এছাড়া নতুন আরো অনেকেই কাজ করছে। সবাই কম বেশি ভালো কাজ করছে বা করার চেষ্টা করছে।
আর এখন যারা লিখছে তাদের মধ্যে অনেকেই কবিতা লিখছে দুর্দান্ত । এখন অনেকের কবিতাতে আমি ভীষণ মুগ্ধ হই। সেই তুলনায় গল্প এবং উপন্যাসে অমাকে ততটা আকর্ষণ করে না। আমি এখনো সেই ক্লাসিক্যাল গল্প উপন্যাসেই আটকে আছি। সময় পেলেই আমি দেশের বা বিদেশের লেখকদের প্রিয় কোনো গল্প বা উপন্যাস পড়ে ফেলি। বিশেষভাবে একজন দুজনের নাম বলতে পারাটা আসলে মুশকিল। অনেকেই আমার ভীষণ প্রিয়।
বাংলাদেশি নভেলস : সাম্প্রতিককালে পেইন্টিংসে সময় দিতে পারছেন কি? আপনার পেইন্টিংস নিয়ে কোনো প্রদর্শনী বা এক্সিবিশন করার প্ল্যান আছে কি?
আইয়ুব আল আমিন : এটা একদমই কাজের কথা। বড় কোন পেইন্টিং ওভাবে আর করা হয় না। ছবি তো আঁকা হয়ই। প্রতিনিয়ত আঁকা হচ্ছেই। তবে এককভাবে নিজের জন্য যে ছবির কথা বলছেন তার জন্য সময় ওইভাবে দিতে পারছি না সত্যি। কারন আমি বসে বসে ছবি আঁকতেই পারি। কিন্তু আমি তো পরিজন নিয়ে এই শহরে বাস করতে পারবো না। আমার ছবি কে কিনবে? বিখ্যাত তো কেউ নই আমি। খুব শীঘ্রই গুছিয়ে একটা প্রদশর্নী করার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক।
বাংলাদেশি নভেলস : বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে আপনার বিশেষ কোনো মতামত বা অভিমত বা প্রত্যাশা আছে কি?
আইয়ুব আল আমিন : অসততা করে কোনোদিন মহৎ শিল্প হয় না। সাহিত্যও তাই। আমার সবচেয়ে কষ্টের কথাটা হলো এখন একজন শিল্পী বা সাহিত্যিক আরেকজন শিল্পী বা সাহিত্যিককে সহ্যই করতে পারছে না। একজন আরেকজনকে চোখ বন্ধ করে খারিজ করে দিচ্ছে। ভাবটা এমন নিজেরটা বাদ দিয়ে আর কারও কোনো কাজই হচ্ছে না। অন্যের দোষ বা ভুলটা না খুঁজে নিবিষ্টচিত্তে যার যার নিজের কাজটা করলেই কিন্ত সব সুন্দর হতে বাধ্য। ইন্টারনেট, সোস্যাল মিডিয়ার এই অস্থির সময়ে সবকিছু পাশ কাটিয়ে রেখে মহৎ শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার বিশ্বাস এসবের মাঝেও সুন্দর অনেককিছু সৃষ্টি হচ্ছে এবং হবে।
সৌজন্যে : www.suryalaw.ca