উপন্যাসতাত্ত্বিক ই এম ফরস্টার একবার কমলকুমারকে (১৯১৪-১৯৭৯) চিঠি লিখলে তিনি পাত্তা দেননি। মনে করা হয়, পশ্চিমা উপন্যাসতত্ত্বকে তিনি অপছন্দ করতেন। বাংলা সাহিত্যে ইংরেজি সাহিত্য প্রভাবিত যে আধুনিকতার সূচনা ও বিকাশ, কমলকুমার তার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভারতবর্ষে ইংরেজ আগমন, উৎপাদনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক নবজাগরণে বাঙালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবাদে তিনি গ্রহণ করেছেন রামপ্রসাদ, ঠাকুর রামকৃষ্ণের লোকায়ত জীবনচর্চা ও বঙ্কিমের ধর্মবোধকে।
‘মাধবায় নম’, ‘তারা ব্রহ্মময়ী’ বলে তাঁর অধিকাংশ রচনার সূচনা। রামকৃষ্ণ ও রামপ্রসাদ ভক্তি, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগরের ভাষা তথা কমা, সেমিকোলন পর্যন্ত ভালোলাগার বিষয়টিও এর কারণ। তারই ধারাবাহিকতায় কমলকুমার মজুমদার তাঁর উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থের ভাববিগ্রহ রামকৃষ্ণের, এর কাব্যবিগ্রহ রামপ্রসাদের। রামপ্রসাদ আমাদের শুদ্ধ মন আনিয়া দেন। কমলমানস ভারতবর্ষের শিকড়সন্ধানী, তার প্রমাণ তিনি আবারও দিলেন ‘সতীদাহ’কে উপন্যাসটির বিষয়বস্তু করে।
উপন্যাসের শুরুতে ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’ বলতে তিনি কি তবে বুঝিয়েছেন ভারতবর্ষের নবজাগরণকে? যদিও এই অমানবিক প্রথা বন্ধের পেছনে অবদান ছিল ব্রিটিশ শাসনেরই। তবুও শাসকের আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে যখন সতীদাহের সব পর্ব সারা, ঠিক তখনই কমলমানস এতে সায় না দিয়ে তরুণী যশোবতী ও মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ সীতারামকে পাঠাল ‘সলিল সমাধি’তে। বয়ানে ভারতীয় ভাব আর আখ্যানে ভারতীয় আচারের ভাবের কারণে এ উপন্যাসটি আমার পছন্দের। ভারতবর্ষের অমানবিক সংস্কারগুলোর অন্যতম সতীদাহ। এর মতো একটি আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বিষয়, যা বাঙালি হিন্দুর জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে প্রবহমান ছিল, সেই সংস্কারকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ‘থিম’ করে কমলকুমার লিখছেন জীবনাবসানের বৃত্তান্ত, যা হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়- অনবদ্য শৈলীর চিত্রায়ণ অন্তর্জলী যাত্রা। যার ভাষাও সাধু হয়তো নয়, চলিতও নয়, কমলীয় ভাষা।
সতীদাহের যাতনা বিশ শতকের সমাজজীবনে ততটা প্রভাববিস্তারী না হলেও কমলকুমারের উপন্যাসে তা চেতনায় চিড় ধরায়। ভাবি সতীর যন্ত্রণা ও অস্তিত্বের লড়াই আর গভীর স্তরশায়ী মনোবেদনাকে হাজির করে পাঠকের চোখে প্রগাঢ়তা দান করার জন্যই বুঝি লিখলেন কমলকুমার। সতীর যে বেদনা, অন্তর্দহন, মনজ্বালা, অস্তিত্বহীনতা, পরাধীনতা উনিশ শতকের সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রকাশমান হয়েও থেকে গেল ধরাছোঁয়ার বাইরে, কমলকুমার মূলত তারই সচেতন বৃত্তান্ত নিয়ে বিশ শতকের সমাজ ও সংস্কৃতিতে পুনঃপ্রবেশ করেছেন। উনিশ শতকের বাঙালি নারীর জলজ্যান্ত প্রতিমূর্তি যশোবতী। যশোবতী ধারণ করেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হাজারো নারীর গভীর স্বরূপটিকে। সেই প্রতিনিধি যশোবতীকে সার্তের অস্তিত্ববাদ দিয়ে পরখ করলে দেখা যায়, স্বাধীনতা কতটা খর্ব বাঙালি নারীর কাছে। উপন্যাসে কুল পুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ, সীতারামের দুই পুত্র বলরাম ও হরেরাম, জ্যোতিষী অনন্তহরি, যশোবতীর বাবা লক্ষ্মীনারায়ণ, এক গীতাপাঠক, কীর্তনিয়া দল এবং সর্বোপরি কুলীন ব্রাহ্মণ সীতারাম- সবাই যেন আসন্ন দাহের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছে যশোবতীকে। বৈজু একমাত্র সতীদাহ নিবারণ করতে আপ্রাণ সচেষ্ট। এই উপন্যাস যদি ‘ঈশ্বর দর্শনের গল্প’ হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বৈজুনাথই ঈশ্বর। এই মানুষরূপী ‘ঈশ্বর’ সতীদাহের বিরুদ্ধে কথা বলে যেন ঈশ্বরের পক্ষ থেকেই বাণী নাজিল করছেন। যশোবতীকেও বারবার সতীদাহের বিরুদ্ধে সে বোঝানোর চেষ্টা করেছে।
কিন্তু সংস্কারাচ্ছন্নের বিশ্বাস, যশোবতীর পিতৃকুলের স্বর্গবাস হবে। মূলত কমলকুমার দেখিয়েছেন, কিভাবে পুরোহিততন্ত্রের কাছে সামাজিক মানুষজন মাথা নোয়াতে অভ্যস্ত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সীতারাম দোসর নিল ঠিকই, পূর্ণিমায় চাঁদ যখন লাল, অতর্কিতে গুপ্তঘাতকের মতো কোটাল বান এসেছে। বাণবিদ্ধ পাখির মতো কর্কশ করুণ স্বরে সীতারামের ‘বউ’ ডাক শোনা গেল। বৈজুর হাত সজোরে ছাড়িয়ে যশোবতী ছুটল। ততক্ষণে সব শেষ। জলে তলিয়ে যাচ্ছে সব, সীতারাম। ‘কর্তা’ বলে জলে লাফ দিল যশোবতী। কাঁদতে কাঁদতে সন্তরণের বৃথা চেষ্টা। কিন্তু লাভ হলো না। কেননা চাঁদ এখন লাল। সীতারাম দোসর নিয়ে তীব্র জলস্রোতে ভেসে গেল। কোটাল বান প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মনুষ্য সৃষ্ট কোনো কারণে নয়। কিন্তু সতীদাহ মনুষ্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট পরিণাম। বৈজুর মতো বিবেক হয়তো কোটাল বানে নিজেকে অন্তত সান্ত্বনা দিতে পারে, অন্যদিকে সতীদাহ হলে পারত না। যশোবতী স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেল স্বেচ্ছায় না সমাজই থাকে জলে পাঠিয়েছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে জীবিত থাকলেও তার গন্তব্য বিধবা হিসেবে আরো ভয়াবহ হতো। ২০০ বছরের পুরনো পটভূমিকায় লেখা কাব্যব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধিশালী এই উপন্যাসের শরীরজুড়ে ভারতবর্ষের নিজস্ব গন্ধ।