সঞ্জয় ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘সৃষ্টি’ বছর দশেক আগে ফুটপথে পেয়ে কেন যে অনাস্বাদিত এক আনন্দ অনুভব করেছিলাম তা আজ মনে নেই। অনুমান হয়, যে লেখককে কবি এবং সম্পাদক হিসেবে জেনে আসছিলাম ততদিন তাঁর এমন একটি সুদীর্ঘ (পৃষ্ঠা ৩৭৮) উপন্যাসের প্রথম সংস্করণ নিজের মালিকানায় থাকার মত করে হাতে পাওয়াটা বড় এক প্রাপ্তি বলে মনে হয়েছিল। দমবন্ধ আনন্দে উপন্যাসের শুরুর তৃতীয় বন্দনীতে ‘পাঠকের অবগতির জন্য’ পড়তে গিয়ে খানিকপর টের পেলাম এটি আসলে লেখক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ভূমিকা বয়ান নয়, বরং উপন্যাসের একটি অংশ, তখন শিহরিত হয়েছি এই ভেবে যে উপন্যাসের এমন কৌশল ১৯৫০ এর আগে? তাও বাংলা ভাষায়!
৪ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ এর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের জন্ম। ১৯৬১ সালের ঐ একই তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়। জন্ম-মৃত্যুর এমন তারিখ সাজুয্য নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ‘বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান’ (১৯৮৫) উল্টে দেখি তিনি অনাশ্রিত। অথচ বাংলাদেশের কুমিল্লাতে তো তাঁর জন্ম এবং পড়াশোনা! ‘পূর্বাশা’ নামে খ্যাত বাংলা ভাষার সাহিত্য পত্রিকার ইতিহাসে অসাধারণ সে সংযোজনটিও তো ঘটেছিল কুমিল্লায় থাকতেই। তাঁর সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ জুড়ে কুমিল্লার আভাস! ‘সৃষ্টি’ উপন্যাসেও কুমিল্লার ছায়া অনুভব করা যায় বৈকি! কতখানি অনাদৃত হলে এমন অনাশ্রয়ের ঘটনা ঘটতে পারে!
ঐ যে বলেছিলাম ‘পাঠকের অবগতির জন্য’র কথা – সেটির প্রকৃত লেখক অনিরুদ্ধ ঘোষাল, দীপায়নের বন্ধু। সে বলছে যে তার বন্ধু দীপায়ন চৌধুরী এবং অনিরুদ্ধ নিজে আসলে দীপায়নের কথা নিয়েই এ উপন্যাসটি লিখেছে যদিও সে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ‘দীপায়ন আমাদের বন্ধু বটে – কিন্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়’। এবং মজার বিষয় হলো অনিরুদ্ধ লিখছে যে যখন দীপায়ন জানল যে সে দীপায়নকে নিয়ে কাহিনি লিখতে শুরু করেছে, তখন টেবিলের উপর রেখে গেল একটি বাঁধানো খাতা। খাতাটা আসলে দীপায়নের ডায়েরি। ঐ ডায়েরিকে আশ্রয় করে এবং নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতি আর অভিজ্ঞতাকে সংযোগ করে অনিরুদ্ধ যে দীর্ঘ কাহিনিটি রচনা করে সেটিই ‘সৃষ্টি’।
‘সৃষ্টি’র লেখক যে পত্রিকাটির জন্য খ্যাত সেই ‘পূর্বাশা’ প্রকাশিত হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৯, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ এবং শেষে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯। সৃজনশীলতায় সফল সে সম্পাদকের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০, নিবন্ধ গ্রন্থ ৭, গল্পগ্রন্থ ৩, নাটক ৩, কিশোরপাঠ্য ৩ এবং উপন্যাসের সংখ্যা? ৩৩ অধিক। আর সে কারণেই বিষ্ময় ভর করে বর্তমান আলোচকের যে এত বিপুল এবং সার্থক রচনাবলী দিয়েও পাঠক সাফল্য কেন অর্জিত হয়নি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের! সে সৃজনকে সংরক্ষণে কেন এগিয়ে আসেনি কোন সাহিত্য-প্রাণ জন!
জীবনে নাকি কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি সঞ্জয় ভট্টাচার্য। অথচ সাহিত্যিক বা সম্পাদক হিসেবে সাধারণ যে সাফল্য তাঁর ধারে কাছে ঘেঁষতে না পারাই কি তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতিকর অন্যতম কারণ? ১৯৫৫ সালে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে তাঁর জীবন থেকেই তো হারিয়ে গিয়েছিল কয়েকটি মাস। তাঁর ঠিক উৎসটা যে কোথায় নিহিত ছিল! তাঁর মা-ও তো ছিলেন উন্মাদিনী। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র বড়দা বিজয় ভট্টাচার্যের পরের দাদা কৃতি সংগীতকার অজয় ভট্টাচার্যও গলায় ক্ষুর বসিয়ে আত্মহত্যা করতে বসেছিলেন একদিন। ১৯৫১ সালে এমন আত্মহত্যার চেষ্টা সঞ্জয় ভট্টাচার্য নিজেও একবার করেছিলেন বলে জানা যায়। আর ঠিক ঐ বছরের আগেই রচিত ‘সৃষ্টি’ ১৯৫০-১৯৫১ সালে ধারাবাহিকভাবে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাগর ও অন্যান্য কবিতা’ যখন প্রকাশ পায় তখন তাঁর বয়স ২৬। আর ‘পূর্বাশা’ সৃষ্টিরকালে তাঁর মাত্র ২৩ বছরের প্রথম যৌবন। প্রথম উপন্যাস কোনটি? ১৯৪২-এর সেপ্টেম্বরে বেরিয়েছিল ‘বৃত্ত’। লেখা যদিও আরও বছর দুয়েক আগেই। ১৯৪৩-এ প্রকাশিত ‘মরামাটি’ ১৯৪৮ তে দ্বিতীয় মুদ্রণ পাওয়ার পর ১৯৮২ তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকূল্যে পুনরায় প্রকাশ পায়। ‘কল্লোল’-এর প্রথম সংস্করণ হাতে নিয়ে দেখছি সেটার তারিখ ছিল ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট। কি বিস্ময়ের যেন। ভারতের স্বাধীনতার সন-তারিখেই। আরও পরে যে ‘দিনান্ত’ ছাড়াও রয়েছ আত্মজৈবনিক ‘মৌচাক’, ‘প্রবেশ ও প্রস্থান’ আরো কত। আছে ‘কস্মৈ দেবায়’, ‘রাত্রি’। মোট গ্রন্থ সংখ্যা ৫৯-এর ভীড়েও পাঠকের কাছে তাঁর উপস্থিতি শুধুই সম্পাদনার কৃতিত্বে যেখানে তিনি অন্য লেখকদের নিয়ে যুক্ত। তাহলে অন্য লেখক কেন তাঁর নিজস্ব সৃজনে সামিল নন? নাকি সমকালীন অন্যান্য লেখকের চেয়ে বেশি ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ হয়ে যাওয়ার কারণেই এমন নির্মম পরিণতি এমন ফলবান একজন লেখকের।
‘পাঠকের অবগতির জন্য’ ‘সৃষ্টি’ উপন্যাসের অংশ হলেও এর পরে শুরু হয়েছে ‘এক’। সেভাবে অধ্যায় শেষ হয়েছে ‘ত্রিশ’-এ। ‘এক’ এর শুরুতেই ইংরেজি তারিখ ২০.২.৪৩। বোঝা যায় এটা দীপায়নের ডায়েরির পাতা। সে পাতায় ভারত-স্বাধীনতার পূর্বকালের সময়কে যেমন ধরা, তেমনি ধরা হয়েছে দীপায়নের আট বছর বয়স থেকে। শৈশবের সেসব কথা, বাবার কথা, দাদার কথার সাথে মিশে গেছে ১৯৪৩-এর দীপায়নের সাথে, যার বয়স কিনা ৩৪ বছর। আছে তার রাজনীতির কথা, সাহিত্য-ভাবনার কথা। দীপায়নের বয়সের হিসেব কষলে সেটা হুবহু লেখক সঞ্জয়ের বয়সের সাথে মিলে যায়। ৩৪ বছরের দীপায়ন তো রাজনীতি সম্পৃক্ত – চেতনাগতভাবে এবং কর্মগতভাবে। আর তাই ডায়েরির এ পাতাতে উঠে আসে গান্ধীজির দশদিন অনশনের কথা, মার্ক্সবাদ নিয়ে স্বদেশী নেতাদের টানাপোড়েনের কথা। আর এভাবেই স্বকালের রাজনীতির একটা গভীর কিন্তু আপাত অস্পষ্ট চিত্র উঠে আসতে থাকে সঞ্জয়ের কলমে। আর মিশেল চলতে থাকে দীপায়নের শৈশবের।
৮ বছরের দীপায়ন তো আসলে পানু। পানুর গল্পটা শুরু হয়েছে ‘রুমাল-কাব্য’ দিয়ে। সে কাব্যেরও কাল ১৯১৮। আর মানুষটি শেফালি। পানুর মনে হয় ‘আমি বুড়ো হয়েছি। নইলে ছেলেবেলার কথা কেন মনে পড়বে?’ আরও মনে হয় ‘দীপায়নের কেউ নয়। তারা গাঁয়ের’। অদ্ভুত গ্রামীণতার ভেতর সে দুটির বাচ্চা ছেলেমেয়ে। ডুরে শাড়ি পড়ে দাঁতে আঁচল কাটছিল শেফালি। সেই শেফালির সাথে পানুর কথা – সাপ নিয়ে। সাপে শেফালি সহজ, আর পানু অনভ্যস্ত। আবার পড়াশোনায় পানু অভ্যস্ত, কিন্তু শেফালির কোন বালাই নেই। সেই শেফালিকে পানু রুমাল দিয়েছিল। সে দেওয়া সামান্য ছিল না; কিন্তু শেফালির মনে হয়েছিল ওটা ছিঁড়ে পুতুলের শাড়ি হবে। শৈশবের সে সারল্যের চিত্র সঞ্জয়ের কলমে এত সরল, তাজাতাজা, শান্তিময়। কোন পাঠক আছেন যিনি নিজের শৈশবে না ফিরে পারবেন! অথচ সরল শৈশবের ভেতরেই ঢুকে পড়ে দীর্ঘপরের কঠিন বাস্তব ‘তখনকার পানু আজকের দীপায়ন চৌধুরীকে চিনতে পারবে না – দীপায়নও পানুকে আপন বলে চিনতে পারে না আজ। তারা দুই পৃথিবীর মানুষ – দুই বাংলাদেশের। সে-পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে – কোথাও সে বাংলাদেশকে দীপায়ন খুঁজে পাবে না’। মূর্ত হয় ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগে বাংলা ভ্রষ্ট হওয়ার ব্যথায় কাতর দীপায়ন। একই কাতরতা তো ঐ আট বছর বয়সেও ছিল – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, গোরা সৈন্যদের চলাফেরা, মৃত্যু সংবাদ আরও কত কি? কুমিল্লর মানুষ হওয়ার কারণেই সঞ্জয়ের স্মৃতি এড়ায়নি সেসব। এই সব স্মৃতিবহুলতার ভেতর ঔপন্যাসিক সঞ্জয়, নাকি বক্তা দীপায়ন দেখতে পায় তার অস্তিত্বের অস্তিত্বহীনতা। সে বোধ করে ‘আমি নামহীন, গোত্রহীন, পরিচয়হীন।’ আধুনিক বোধে কষ্ট ক্লান্ত দীপায়নের অনুভব; ‘পৃথিবীর প্রথম মানুষ তাই আমি। আমি অপাপবিদ্ধ নই। আমার রক্ত শুধু আমারি রক্ত নয়, আমার মন শুধু আমার হাতেই তৈরী নয়।’ দীপায়নের এই উপক্রমনিকা কি শুধুই এই উপন্যাসের কাহিনির? সে উপক্রমনিকা কি একটি মানব অস্তিত্বের উৎসমূলকে অনুসন্ধানে কাঙ্ক্ষী নয়?
তেমন করে শুরুর পর বক্তার দায়িত্ব নেয় অনিরুদ্ধ ঘোষাল – যে কিনা পানুর বন্ধু, ছোটবেলাকার। ৫ ক্লাসে পড়াকালে দুজনের কথায় উঠে আসে স্বদেশী প্রসঙ্গ, চরকা কাটার মত প্রসঙ্গগুলো। আসে লুসাই পাহাড় আর চা-বাগানে ধর্মঘটের কথা। সঞ্জয়ের দাদার মত সৃষ্টিতেও কিন্তু পানুর দাদা আছে, নাম তার দেবু। আছে আলির কথা, যাদের বাড়িতে পানু আর অনি গিয়েছিল একসাথে, তিল ফুলে আদর করতে করতে। আর এভাবেই প্রকৃতি এবং কৈশোরের সুমিষ্টতার ভেতর দিয়ে পানুর জীবনের প্রথম অধ্যায়ের চলন শুরু।
তিন নম্বর অধ্যায়ে পানুর নায়কোচিত সমাদর তাকে অধিকতর উচ্চ মানুষ হিসেবে উপস্থিত করে। অনিরুদ্ধ ভাষ্যে ‘সবাই আমরা পানুকে নায়ক বলে মেনে নিয়েছি। নেতা নয়, নায়ক। নেতা হবার কোন রুচিই ছিল না ওর।’ এবং একটি চতুর্পাশ সৃষ্টি হয় উপন্যাসে যাতে পানুর সে বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বলতর হয়ে আসে। তার ফিনফিনে জামা, পাম্প-শ্যু, যথাযথ বোতামের উপস্থিতি তাকে প্রতুল, মানিক আর ভূপতির চেয়ে বড় করে তোলে, ওদের কাছে ঈর্ষণীয় করে তোলে। অনুরুদ্ধর বয়ানে এই সব কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ ঢুকে পড়ে দীপায়নের ডায়েরি যাতে আছে পানুর স্বীকারোক্তি। রয়েছে একজন দীপায়ন, যে কিনা দার্শনিক, যার কিনা বিশ্লেষণ ক্ষমতা অসাধারণ। আর তাই ঔপন্যাসিক কৌশলের নায়ক-নায়ক পানুর সমান্তরালে উপস্থাপন করেন: ‘পানু জানত না, সে একদিন দীপায়ন চৌধুরী হয়ে উঠবে। তবু কেউ জানত। পানুর ভেতরেই কেউ – কোন কোষতন্তু, কোন গ্রন্থিরস – যাকে আমরা নিয়তি বলি।’ অসাধারণ দর্শনাশ্রিত সে ভাবনার ক্রমঅগ্রসরণ: ‘তার [নিয়তি] ইতিহাস আছে, হয়ত জ্ঞানও আছে – সে জানে কোথায় তাকে যেতে হবে, কোন শিল্পে, কোন মূর্তিতে, কোন কলেবরে। শুধু সেই জানে। একদিন তার নাম থাকে পানু, তারপরে আরেকদিন সে দীপায়ন চৌধুরী হয়।’ কীভাবে মানুষের সে নিয়তি নির্মিতি পায়। সে নিয়তিতে এসে ঢোকে সাহিত্য, স্বদেশী আন্দোলন, আন্দামানে নির্বাসন, আর ক্রমে ক্রমে শেফালি থেকে বিচ্যুতি।
একথা সত্যি সৃষ্টি সরল গল্প দিয়ে এগোয় না। গল্পের চেয়ে আরও অনেক কিছু উপন্যাসে বড় হয়ে ওঠে। ধারণা হয় সঞ্জয়ের অধিকাংশ উপন্যাসেই সে ধারার উনিশ-বিশ। আর সে কারণেই কি ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ অভিধা দিয়ে তার কথাসাহিত্যকে দূরে ঠেলে দেওয়া! বাংলা উপন্যাসের ভাগ্যটাই এমন হওয়ায় ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬১) বা লোকনাথ ভট্টাচার্যের (১৯২৭-২০০১) মত সঞ্জয়ের অনুজ-অগ্রজ দর্শনস্নাত কথাশিল্পীরা কোন পাকা আসনই গড়তে পারেননি। ভাবতে বিস্ময় লাগে বাংলা সাহিত্যের সেই পাঠকরাই মার্সেল প্রুস্ত (১৮৭১-১৯২২), জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) বা ফ্রানজ কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪), আলবেয়ার কামুর (১৯১৩-১৯৬০) মতো লেখককে নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছেন, বাংলা ভাষায় অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) মত সাহিত্যিককেও অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘকাল সত্যিকারের পাঠকের জন্য। আর যত বছর সে পাঠকের জন্ম হয়নি, ওয়ালিউল্লাহ মূল্যায়িত হয়েছেন তাঁর প্রথম উপন্যাস দিয়ে, যাতে গল্পের টানটান উত্তেজনা উপস্থিত ।
যে দর্শনের উপস্থিতি দীপায়নে প্রকাশিত সেটা কি হেলাফেলার? অন্তর্গত অভিনব দর্শনের কারণেই তো সাহিত্যকর্মের জয়জয়কার হয়। অথচ দীপায়ন বা সঞ্জয়ের সে দর্শন বাঙালি গ্রহণ করেনি – সে ব্যর্থতা কি শতাব্দী পেরিয়ে সঞ্জয়ের মৃত্যুর অর্ধশতক পরেও ঘুচবে না?
কী অসাধারণ দক্ষতায় সঞ্জয় তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন ডায়েরি – তারিখের ক্রমকে ভেঙে চুড়ে। আর সাথে সাথে ঢুকে পড়েছে অনিরুদ্ধের ভাষ্য। বিস্ময় লাগে সে সব ভাষ্যের বেশ কিছু কিছু অংশ আবার তৃতীয় বন্ধনীতে আটকানো যেগুলো আসলে কাহিনির সম্প্রসারণ হয়, বরং কাহিনি সম্পৃক্ত বিষয়ের ব্যাখ্যা। এত অভিনব বয়ন কৌশলের ভেতর দিয়ে ঔপন্যাসিক তৈরি করেন দীপায়নকে। শেফালির নির্মল বোধের কাছে যার নায়ক রূপ তুচ্ছ, বীণাদির বুকের ভেতর যে দীপায়ন বাহুবদ্ধ। সেই দীপায়নই তো একদিন অনিরুদ্ধকে বলেছিল ‘মানুষ হয়ত য়ুরেনিয়মের নিয়মেই খানিকটা চলতে শুরু করে – আইনও নিয়ম হয়, রেডিয়ম্ হয়, শেষটায় সীসে। অনেক আলফা-বীটা-গামা রশ্মি ছেড়ে-ছেড়ে তবে এই রূপান্তর! আমি য়ুরেনিয়মেরই বংশধর …।’
‘সৃষ্টি’ এভাবেই হয়ে ওঠে দীপায়ন ওরফে পানু ওরফে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অন্তর্গত নির্মাণ। বাহিরিক নির্মাণকে তুচ্ছ করে ঔপন্যাসিকের যেসব বোধ ইউরোপিয় সাহিত্যকে নতুন মর্যাদায় পুষ্ট করেছিল, বাংলা ভাষায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য তেমনই এক কারিগড়। প্রেম আর সাহিত্য আর রাজনীতি নিয়ে দীপায়ন ক্রমে ক্রমে পৌঁছে এক সঞ্চরণশীল মানব অস্তিত্বে। আবার এসবের ভেতর যখন বাসব এসে ঢুকলো, অনিরুদ্ধের মন্তব্য ‘দীপায়ন চৌধুরীর অনেকটাই তো বাসব।’
‘সৃষ্টি’ পড়তে পড়তে বার বার মনে হয় উপন্যাসের কাঠামো নির্মাণে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অগ্রগামী ভাবনার উৎসমূল কোথায়? বাংলা ভাষায় রচিত উপন্যাস জগতে তাঁর সে নির্মাণ কৌশলের পূর্বসূরী কি কেউ ছিলেন। নাকি ইউরোপিয় সাহিত্যের বুভুক্ষু পাঠক অসাধারণ মেধাধিকারী সে-লেখক আয়ত্ত্ব করেছিলেন কৌশলের অচিন্তিতপূর্ব সে-দক্ষতা? উপস্থাপনার সে অভিনবত্বই কি সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে দূরে ঠেলেছিলেন সাধারণ পাঠক সমাজ থেকে? কিন্তু বাংলা উপন্যাসের ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ পাঠক যাঁরা কিনা প্রুস্ত-কাফকা-কামু নিয়ে বাগাড়ম্বর করেন, যারা উৎসাহিত মার্কেজ-সারামাগো য়োসার উপন্যাসে, তাঁরাও কেন নিজ ভাষা আর মাটির অনন্য প্রতিভা সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে খুঁজে পাঠ করার তাগিদ বোধ করেননি। আধুনিক মনন প্রকাশের আধুনিক কৌশলের বিবেচনায় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সৃষ্টির মাহাত্ম্য কোথায়! তাঁর নিজের ভাষায় ‘আমি উপন্যাস লিখবো ভাবিনি, কেননা আমার মনে হতো – উপন্যাস তো অনেকদিন ধরেই লেখা হচ্ছে, তাহলে আমি কেন লিখবো? তখন আমি এই একটা দেখলাম যে বাঙলা উপন্যাসে টেকনিক নিয়ে কাজ হয়নি। সেসব সরল রেখার ধরনে বা সময়ের পুরনো ধারণা থেকে লেখা: সময় একটা সরল রেখার মতো পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, আমি একটা প্রেমকাহিনী লিখবো বা আর-কিছু লিখবো, যা-ই লিখি, অন্তত টেকনিকটা নতুন করবো। উপন্যাসে আমি সময়ের নতুন ধারণা প্রয়োগ করলাম – সময় যেন একটা বৃত্তের মতো, উপন্যাসটার নামও ‘বৃত্ত’। ফর্মটা তৈরি হয়েছে আমার বিষয়বস্তু থেকে নয়; টেকনিক ভেবেছি, বিষয়বস্তু দিয়ে ভরতি করা হয়েছে।’ ‘বৃত্ত’ উপন্যাসের অন্তরালে সেই যে ভাবনা তাঁকে আশ্রয় করে ক্রমশ অধিকতর ইন্টেলেকচুয়াল হতে হতে এক পর্যায়ে সৃষ্টির স্রষ্টা উপন্যাসের নির্মাণ কৌশলে এমন উচ্চমার্গকে আত্মস্থ করলেন যার পাঠ বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের পাঠকের নিকট প্রতীত হয়েছিল দুষ্পাঠ্য বলে। পাঁচ দশক পরের বর্তমান প্রজন্মের পাঠকের নিকটও কি নিজের সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী সে মেধাবী লেখক বাঙালির পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন না কোনভাবেই?
রচনাকাল ২০১০