‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসের বাজিকর হয়তো জাত যাযাবর নয়, ‘বানজারানরা’ হলো জাত যাযাবর। তবুও পুরনো রক্তের স্মৃতি ও দোষে ঘরগেরস্থালি নিয়ে স্থায়ী বসবাসের স্বপ্ন অবচেতনে হলেও বাজিকরের আছে।। বহেরা গ্রামের পারগানা লক্ষণ সোরেনের কথায় বাজিকর সর্দার পীতেমের অবচেতনে জমিতে স্থিতির স্বপ্ন রোপিত হয়ে যায়। নক্ষত্রখোচিত খোলা আকাশের নিচে লক্ষণ সোরেন পীতেমকে জমি, স্থিতি, চাষাবাস, ফসলের আনন্দ ও সঙ্কট, অন্যায় ভাগিদারদের দৌরাত্মের কথা বলেও জমিতে ফসলের আনন্দের কথাটাই বড়ো অভিভূত স্বরে বলে,
‘তুমি জান জামিতে যখন ফসল ধরে তখন মানুষের মনের ভাব কেমন লাগে?’
পীতেম আকাশে চোখ রেখে সংক্ষেপে বলে, ‘জানি না।’
‘তোমার বউয়ের পেটে যখন বেটাবেটিরা এসেছে তখন তোমার মনের ভাব নিশ্চয় মনে আছে?’
‘আছে।’
‘তবেই বোঝ।’
তবুও, প্রকাশ্যে পীতেম জমি ফসল ও স্থিতির প্রতি কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করে না। হয়তো কোন এক পৌরাণিক স্মৃতি ও অভিশাপের চাপে সবকিছু চাপা থাকে। সোরেনের জোরালো দাবি ‘জমিতেই স্থিতি, জমিতেই স্থায়িত্ব. জমিতেই সুখ, জমি না থাকলে জীবনের কোনো অর্থই হয় না।’ রাতের আকাশে চোখ রেখে হেঁয়ালির সঙ্গে পীতেম উপেক্ষা করে যায়। তবুও কোথাও, গভীর অন্তরদেশে একটি দীর্ঘশ্বাস আকাঙ্ক্ষা ও আক্ষেপ মুচড়ে ওঠে। ড. নোমান আর ভাবতে পারছে না। তার মনটাও ভারি হয়ে উঠছে। সাহিত্যের ছাত্র নোমান উপন্যাসের সমাজ বাস্তবতাধর্মী গবেষণা করে ডিগ্রি অর্জন করেও সম্পূর্ণ একমত নয় যে সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় জীবনের সবটুকু, তার সমগ্রসত্য।
ড. আনোয়ার বিষয়টা দিখে ভিন্নভাবে।
সাহিত্য জীবনের দর্পণ এমন ভাষ্যে ড. নোমানের ষোলআনা আস্থা কখনো ছিল না। রাষ্ট্র-সমাজ-ব্যক্তির সম্ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতা, অতীত ও বর্তমানের ইতিহাস, দ্বন্দ্ব, বিক্ষোভ, মনোজগত, অবদানসহ সময় ও জীবনের ভিতর অদৃশ্য জীবনরেখ সবই সাহিত্যে দর্পণের মতো প্রতিফলিত হয়! হয়তো কোনোকালের সমগ্র সাহিত্য সম্ভারের ভিতর নানাভাবে এর রূপ ও স্বরূপের ছবি ছড়িয়ে থাকে। ড. নোমানের বন্ধু ও সহকর্মী ড. আনোয়ার মনে করে, সমগ্র সাহিত্যসম্ভার কেন কোনো একটি সফল উপন্যাসের ভিতরই সময় সমাজ রাষ্ট্র ও ব্যক্তির রূপ ও স্বরূপ তৈরি হতে পারে, পারে প্রতীক বা রূপক আকারে।
হয়তো! ড. নোমানের লম্বা শ্বাস পড়ে। অভিজিৎ সেনের ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ হয়তো সেরকম একটি উপন্যাস।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ‘সামাজিক উন্নয়নের গতিধারা’র বর্তমান একটি প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্ত দুই তরুণ গবেষকের ওপর দায়িত্ব পড়েছে অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও বিন্যাস সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এমন ২০টি সাহিত্যকর্মের ওপর বিস্তৃত গবেষণা হাজির করার। ছয় মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়কারী ও উন্নয়ন সংস্থার অন্যতম পরিচালক অধ্যাপক ইয়াজ চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার মিটিং করে ১৮টি উপন্যাসের তালিকা এবং বাংলা কবিতা ও নাটকের ওপর দুটি গবেষণাপত্রসহ ২০টি গবেষণা পত্রের কথা চূড়ান্ত করে নিয়েছে। নোমান এবং আনোয়ারের সঙ্গে ইয়াজ চৌধুরীর তেমন সমস্যা হয়নি। তিনি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন, সাহিত্য বিষয়ক কিছু প্রকাশনাও তাঁর আছে। ভালো খবর হলো সামপ্রতিক সময়ের সাহিত্যের ওপর তাঁর আগ্রহও বেশ। ড. আনোয়ার নিজে পছন্দ করে নিয়েছেন ‘তিস্তাপারের বিত্তান্ত’ উপন্যাসটি, ড. নোমান নিয়েছেন উপন্যাস ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ । দুজনেরই প্রিয় উপন্যাস ‘রহু চণ্ডালের হাড়’, বাকি উপন্যাস ও নাটক কবিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষকদের ভাগ করে দিয়েছেন। প্রকল্পের গাইডলাইন মতো তাঁরা সম্মতও হয়েছেন। সাড়ে সাত হাজার থেকে দশ হাজার শব্দের প্রবন্ধের জন্য প্রত্যেকে পাবেন দশ হাজার টাকা। নোমান ও আনোয়ার নিয়মিত বেতন ছাড়াও পাবেন ১০ হাজার করে।
উন্নয়ন সংস্থার ছোট লাইব্রেরি ঘরের শেষ টেবিলে বসে ড. নোমান ও আনোয়ার নিজস্ব পাঠ ও মূল্যায়ন বুঝে নিতে চান। দু’জনেই প্রবল আগ্রহ বোধ করছে রহু চণ্ডালকে নিয়ে। ঘন ঘন বিদ্যুতের যাওয়া-আসায় বাতি, এয়ারকন্ডিশনার বন্ধ হওয়া, আবার আই.পি.এস-এর মাধ্যমে চালু হওয়া এসব কোনো বাধাই হচ্ছে না তাঁদের। ফিল্টারের পানি ও কফি সরবরাহেও বিঘ্ন ঘটে না। অনেক দিন পর আবার এভাবে সাহিত্য পাঠে মশগুল হয়ে চাকরির ক্লেশের তুলনায় আনন্দই ভোগ করছেন। মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন। বাইরের প্রচণ্ড গরম, বৃষ্টি রোদ কিছুই জানালার কাচে আর মোটা পর্দা ভেদ করে মনোযোগ টলাতে পারছে না।
নোমান ও আনোয়ার দু’জনেই প্রায় সবক্ষেত্রে একমত। বিরোধের কিছু নেই, তবুও গুরুত্বহীন কিছু কিছু প্রস্তাবনায় অহেতুক বিতর্ক করে আড্ডা জমিয়ে তুলছে। ভাষা ও আঙ্গিকে তেমন কোনো নিরীক্ষা না করেও ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ (১৯৮৫) একদম নতুন একটি উপন্যাস। নোমেনের কথা ঠিক এভাবে মানতে রাজি নয় আনোয়ার, বলে, কী বলো নিরীক্ষা নেই, ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসে বিষয়ের মধ্যেই রয়েছে নিরীক্ষা। বাজিকরদের পাঁচ পুরুষব্যাপি দেড়শ’ বছর জুড়ে জীবন ইতিহাসের এমন ছবি বাংলা উপন্যাসে আর কখনো নির্মিত হয়নি।
অবশ্যই হয়েছে, তবে একইভাবে না হলেও হয়েছে, গোষ্ঠি নৃগোষ্ঠির জীবন সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে বহু উপন্যাস আছে। তাৎমা সমাজের জীবন যুদ্ধ নিয়ে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’, রাজবংশীদের নিয়ে তোমার ‘তিস্তাপারের বিত্তান্ত’, ‘তিস্তাপুরাণ’; ধীবর, তাঁতীদের জীবন নিয়েও হয়েছে।
আনোয়ার বলে, ওই উপন্যাসগুলি ওই উপন্যাসের শর্তে অসাধারণ ও খুব সফল। কিন্তু তুমি যদি প্রতি তুলনায় দেখো, দেখবে এই মহৎ সৃষ্টিগুলি একটি থেকে একটি কত স্বতন্ত্র।
নোমান আনোয়ারকে থামিয়ে বলে, সফল ও স্বতন্ত্র বলেই তো আমরা কথা বলছি, গবেষণা করছি। অভিজিৎ সেনের জীবন যাপন, অভিজ্ঞতা, সময় সমাজ রাষ্ট্র ও শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনার ধরন ও গড়ণ থেকেই তাঁর সৃষ্টিগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পেয়েছে। খেয়াল করো অভিজিৎ যখন ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ লিখতে শুরু করেন ৮০ দশকের প্রথম দিক থেকে তখন তাঁর বয়স চল্লিশের মতো। এমন একটি মহৎ উপন্যাস লিখবার মতো ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধ গড়ে ওঠার মতো সেরকম রয়স না হলেও কত সফল কাজ। ওঁর জন্ম ২৮ জানুয়রি ১৯৪৫। ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ ছাপার অক্ষরে প্রকাশ হয় ১৯৮৫ সালে। আনোয়ার বলে, জানো তো ওর জন্ম আমাদের বরিশাল জেলার কেওড়া গ্রামে। শৈশবও কেটেছে কেওড়া গ্রামে। তারপর পঞ্চাশ ষাট ও সত্তর দশকের বিভিন্ন সময়ে কলকাতা, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, আবার কলকাতা, চব্বিশ পরগণা, হুগলি বালুরঘাটসহ পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা ও ভারতের উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে বাস করে জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন।
নোমান যোগ করে, ইতিহাসে এম.এ. অভিজিৎ সেন মাকর্সিয় দর্শনও ভালো করে পড়েছেন। ফলে গ্রাম শহর মফস্বল জীবনের উপরিতল থেকে গভীরতল, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও আপাত সাধারণ জীবনকে রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে বুঝতে পেরেছেন। শুধু স্তরহীন সাদামাটা কাহিনীর বদলে জীবনের বহু রূপ তাঁর কথা সাহিত্যের উপজিব্য হয়ে ওঠে। লোককথা, লোকাচার, সংস্কার, পুরাণ, বিশ্বাস, সঙ্গে অফিসের রাজনীতি ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতি তার পর্যবেক্ষণ অনুধাবন থেকে বাদ পড়ে না। দেখো ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসটির কতরকম পাঠ সম্ভব।
নোমানের কথার মাঝখানে অধ্যাপক ইয়াজ চৌধুরী এসে দাঁড়ান। নোমানের কথা শেষ হলে বলেন, তোমাদের গবেষণায় চেষ্টা কোরো সম্ভব নিরাসক্ত নিরপেক্ষ থাকতে। আনোয়ার নোমানের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, স্যার কোনো প্রয়োজন আছে? আমরা আমাদের কাজ নিয়েই কথা বলছি। না না, কোনো কাজ নয়, তোমাদের কথা শুনতেই এলাম। তোমাদের একটা কথা বলি, তোমরা যেমন স্বাধীনভাবে কিছু ব্যতিক্রমী উপন্যাস নির্বাচন করেছ এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্যের কথা ভেবে, তেমনি আমাদের উদ্দেশ্য কর্মপদ্ধতিও কিন্তু ব্যতিক্রমী, আগে কখনো সরকারি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এভাবে কাজ করেনি। গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের মধ্যে নানা মাত্রায় মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা, ইতিহাস, সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বিন্যাস, অর্থনীতি এবং উন্নয়নের ছবি খুব সৎভাবেই চিত্রিত হয়। তোমাদের গবেষণার মাধ্যমে এই সব বিষয় যখন ষ্পষ্ট হয়ে উঠবে তার ভিত্তিতে আমরা উন্নয়নের প্রকল্পগুলো, কাঠামোগুলো যাচাই করব, এমনকি সরকারকেও আমরা পরামর্শ দিতে পারব। এধরনের উদ্যোগ এই প্রথম আমরাই নিয়েছি। ইয়াজ চৌধুরী কথা শেষ করেন। নোমান বা আনোয়ারের মুখে কোনো নতুন কথা আসে না। প্রায় একই রকম সুরে বলে, খুব ভালো উদ্যোগ। ইয়াজ চৌধুরী উঠে পড়েন, হ্যাঁ তোমরা কাজ কর, প্রয়োজন হলে আমার সঙ্গে আলোচনা করে নিবে।
বাইরের কোনো আলোই এই লাইব্রেরি ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। ঘড়ি দেখে বেলা বোঝে, এখনও দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। খাবারের জন্য কেউ তেমন তাড়া বোধ করে না। নোমান বলে, ভালোই হলো, তোমার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ ঠিক মতো নিজের কাছে পরিষ্কার করে নিতে পারলে লিখতে সময় লাগবে না।
আনোয়ার বলে, উপন্যাসে যে জীবনের সমগ্রতার কথা বলা হয় সে সমগ্রতা শুধু সময় ও জীবন ইতিহাসের খুঁটিনাটি বর্ণনার ক্যাটালগিং নয় – দ্বন্দ্বময় নাট্যরস, কাহিনীরস, কাব্যরস সহ জীবনের এমন সমগ্ররূপ ফোটে যেখানে সমাজের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক বিন্যাসটি গুরুত্বপূর্ণ। ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ শুধু কোনো ঔপন্যাসিক বৃত্তান্ত নয়, নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠির জীবন ইতিহাসের ক্যাটালগ নয় বরং বিকাশমান চলমান সমাজ সভ্যতার ও জীবনের, জীবনবোধেরও প্রতিনিধিত্বমূলক এক রূপকভাষ্য।
অবশ্যই, নোমান বলে, উত্তরবঙ্গের কোনো এক যাযাবর বাজিকর গোষ্ঠির জীবনযাপনের প্রামাণ্য ইতিহাস চিত্র নয়, বরং উন্মোচিত জীবন কাহিনীতে মানব সমাজ ও সভ্যতার রূপ রূপান্তরের রূপক কাহিনী হয়ে ওঠে। উপন্যাসে যেমন পাঁচ পুরুষ বা দেড়শো বছর জুড়ে বিস্তৃত সময়ে নিবাসহীন, ভূমিহীন, গৃহহীন, ধর্মহীন মানবগোষ্ঠির এক অশেষ যাত্রা, যাত্রার লক্ষ্য ঠিকানা খোঁজা, জীবন ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা। যাত্রায় আছে পরিশ্রম, কৌশল, লোকঠকানো, চুরি করা, মায় নিষ্ঠুর আচরণের সঙ্গে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার স্বীকার নিজেদের জীবন, আছে প্রেম, প্রেমে ব্যর্থতা, খুন, সরকার প্রশাসন, সামন্ত জোতদার লাঠিয়াল কৃষক কেরাণিসহ কত শ্রেণীর মানুষ। তো এসব শুধু বাজিকর গোষ্ঠির নিজস্ব জীবনধারণের বিশেষ কিছু নয়, এ-সবই আজকের আধুনিক মানুষ পর্যন্ত অপরিবর্তিত, এরকম জীবনযাত্রার শরিক; একই রকম অন্তঃস্থলে ঠিকানাহীন, ঠিকানার খোঁজে যাযাবর, জীবিকার খোঁজে পথে পথে, নিজ পরগণা, শহর দেশ ছেড়ে দেশান্তরে। ইতিহাসের কোথায় কবে কোন্ মানুষগোষ্ঠি হিমালয়ের মতো আমূলবিদ্ধ পাথুরে জমিনে আটকে আছে! আপাত যে মানুষ এক পুরুষে স্থির সেও মানসিকভাবে বিচরণশীল। এবং এই যাত্রায় জীবনযাপনের নিত্য ভঙ্গির সঙ্গে জীবনের দর্শনেরও বদল ঘটে।
দেবতাদের অভিশাপে বা কোন এক পুরাণ স্মৃতির সংক্রমণে ঘরহীন ঘরের খোঁজে যাযাবর বাজিকরদের মনে ধীরে ধীরে অভিশাপের নাগপাশ কাটিয়ে স্থির হয়ে বসবাসের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হতে থাকে। তারা হয়তো কৃষি ও গ্রাম ব্যবস্থার শৃঙ্খলে একরকম স্থির হয়ও, তবুও কি স্থির হলো? যাযাবরের প্রবৃত্তি মনকে অস্থির করে তোলে না! নোমানের দীর্ঘ কথার শেষে আনোয়ার তার পয়েন্টটি উল্লেখ করে, দেখো, অভিজিৎ অত্যন্ত সচেতন শিল্পী, সমাজবাদী চিন্তা ইতিহাস চেতনা থেকে সতর্কভাবেই অনেক প্রসঙ্গ তুলেছে, যেমন ধরো ওই পাঁচ পুরুষ বা দেড়শো বছরের উল্লেখ কেন! কারণ এতটা বিস্তৃত সময়ের মধ্যে অস্থিরতা, সামাজিক ভাবনার লক্ষ্যহীনতা ঘুচে একটি দার্শনিক প্রত্যয় তৈরি হয়ে উঠতে পারে। আমরা যাকে শাশ্বত কাল বলি এই সময়ের উল্লেখের সঙ্গে তার বিরোধ ঘটে না। যেমন দেড়শো বছরের বাজিকরদের এই জীবনের গল্প তাদের শাশ্বত জীবনের গল্পই হয়ে ওঠে। নোমান বলে, অভিজিৎ সেনের যে সমাজ ভাবনার কথা বললে, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখো উপন্যাস ভাবনাটি, ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ লিখবার অনেকটা পরে ১৯৯৭ সালে অনুরুদ্ধ হায় একটি ছোট গদ্যে তাঁর উপন্যাস ভাবনার কথা লেখেন –
“সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিন্যাসকে বুঝতে সাহিত্য যদি কিছু সাহায্য করে তাহলে লোকজীবন, লোককথা, মিথ, যন্ত্রযান ইত্যাদির সঙ্গে এখন পর্যন্ত ওতপ্রোতভাবে জড়িত মানুষকেই খুঁজতে হবে। আমাদের বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিকএবং উৎপাদনশীল জীবনেও এসবের প্রাধান্য ব্যাপক। আমি এসব বিষয় ও সেই বিষয় আশ্রিত যোগ্য আঙ্গিকটিকেই আমার কিছু গল্প উপন্যাসে খুঁজতে চেষ্টা করেছি।”
এর ঠিক একটু আগেই গল্প উপন্যাস লিখবার প্রচলিত কাহিনী, প্রথাগত আঙ্গিক ইত্যাদি থেকে বেরিয়ে আসবার প্রসঙ্গে বলেন, পুরনো ফর্মূলা থেকে বেরিয়ে আসার একটা চেষ্টা তো সব সচেতন লোকের মধ্যেই থাকে। সেখানে লোকজীবনের অবস্থান, লোককথা, লোকধর্ম, লোকবিশ্বাস, লৌকিক আচার, অবিচার সংস্কার ইত্যাদির অভিজ্ঞতার উপাদান যার অধিক থাকবে এবং এসবকে যথার্থ বুঝবার ও ব্যাখ্যা করার স্পর্ধা যার থাকবে সে আর অন্যত্র উপাদান অনুসন্ধানে যাবে কেন ?
অভিজিৎ সেনের এই ব্যাখ্যা করবার স্পর্ধা এবং বুঝবার ক্ষমতা আমরা তার অন্য উপন্যাসগুলোতেও দেখেছি। মজার কথা হলো এই ভাবনা লিখবার আগেই তাঁর ‘রহু চণ্ডালের হাড়’সহ ‘অন্ধকারের নদী’, ‘দেবাংশী’, ‘ছায়ার পাখি’, ‘আঁধার মহিষ’, ‘ঝড়’, ‘বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর,’ ‘হলুদ রঙের সূর্য’ প্রকাশ হয়ে গেছে। ফলে এই ভাবনার যথার্থতা তাঁর উপন্যাসগুলোতে তখন প্রমাণিত।
আনোয়ার যোগ করে, বড়গল্প ‘দেবাংশী’তে দেখো, লোকবিশ্বাস লোকাচার অলৌকিক উপাদানকে উপজিব্য করে সেন গ্রাম সমাজের স্বার্থান্বেষী রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে অসাধারণ একটি গল্প লেখেন। যাথারীতি এতসব অলৌকিকতা সত্ত্বেও তাঁর শ্রেণী আধারিত রাজনৈতিক বোধের অন্তর্বয়ন কাহিনীর অবয়বে বাক্সময় হয়ে থাকেই। দেবেশ রায় বলেছেন, ‘মার্কস্বাদের বিজ্ঞান আমাদের দৈবনেত্রের উন্মীলন ঘটায়।’
রাজনীতি বা শ্রেণীচেতনা প্রসঙ্গে নোমান ‘ছায়ার পাখি’, ‘অন্ধকারের নদী’, বা ‘আঁধার মহিষ, রচনাগুলির কথা তোলে, ‘অন্ধকারের নদী’র অশোক নিষ্ঠাবান সৎ প্রশাসক, রাষ্ট্রের বা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা টিঁকিয়ে রাখার প্রশিক্ষণ ও ব্রতও সে নিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কিছু নিয়ম পালনে অলিখিত নিয়েমের বাইরে মনোযোগী হলে কায়েমি স্বার্থান্বেষী পাণ্ডারা ঘটনা ঘটিয়ে আবার সমাধানও চায়। অশোক ওই মতলববাজদের শিকার হয়ে পড়ে। নোমানের কথায় আনোয়ার মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না, ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ওঠে, নোমানের কথার ভিতরই বলে ওঠে, যাই বলো, উপন্যাসিক অভিজিৎ সেন বড়ো প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠেন এই ক্ষুদ্র উপন্যাসটিতে। তাঁর রাজনৈতিক পক্ষপাত প্রকট হয়ে অন্ধকারের নান্দনিক নিরপেক্ষার ক্ষতি করে। ফলে, ‘অন্ধকারের নদী’তে খুব পরিষ্কার করেই অভিজিৎকে দেখা যায়, অশোকের বদলে লেখককেই চোখে পড়ে বেশি। রহু চণ্ডালের দেড়শো বছরের পর্যটনে দনু-পীতেম-বারি-জামির থেকে শারিক পর্যন্ত যে মহাকাব্যিক উদ্ভাসন ঘটে তাতে অভিজিৎ সেনের ধৈর্য কখনো বিচলিত হয় না। পীতেম, সালমা, সোরেন, জামির, শারিবাসহ কত চরিত্রের মধ্যে দিয়ে মানবিক সামাজিক রূপ রূপান্তরের গল্প দলিল হয়ে ওঠে, অভিজিৎকে এগিয়ে এসে ‘বক্তব্য’ ‘ব্যাখ্যা’ হাজির করতে হয় না। অন্ধকারের নদীতে তিনি কিছুটা উত্তেজনায় ভোগেন, তবে ‘ছায়ার পাখি’তে এসে তিনি শিল্প-প্রজ্ঞায় তাঁর বোধ প্রকাশ করতে সক্ষম হন। শিল্পের দ্ব্যার্থতা, দার্শনিক প্রত্যয়, লোক বা ভাবদর্শনের যুক্তিনিষ্ঠ বিনির্মাণসহ বহু চরিত্রের আয়োজনে ধীরে ধীরে এমন একটি অনুসন্ধানী সত্য প্রতিবেদন বেরিয়ে আসে যেখানে অভিজিৎ সেনের রাজনৈতিক বোধ ও উপন্যাস ভাবনা একরকম প্রতিষ্ঠা পায়। তুমি দেখো প্রতাপের যুক্তি শৃঙ্খলায় উপন্যাসের মূল ভাবনার কিছু প্রকাশ ঘটলেও ভবানীশঙ্কর, শিশির গোপালের আদর্শ, প্রত্যেকের নিজস্ব স্বর উপন্যাসটিতে সমন্বিত ও সুগ্রন্থিত কোন একটি চরিত্রকে অভ্যাসমতো মূল চরিত্র ভেবে নিলে ভুল হবে। প্রতাপের ভিতর কখনো অভিজিৎকে আবিষ্কার করেও আমি দ্বিধান্বিত হই, তাহলে গোপালের স্বপ্নভঙ্গ, হতাশা, চারদিকে ভাঙছে, আর যেন সম্ভব না হওয়ার যন্ত্রণা আর মনোকষ্টের ভিতর কি অভিজিৎ নেই? গোপালের কিছু কথা তোমাকে শোনাই, গোপাল তখন ভীষণ অসুস্থ –
‘যে আদর্শ নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল জীবনের, সেই আদর্শ তাকে এবং অন্যকে কোথায় নিয়ে এসেছে? এই প্রবল প্রশ্ন অনিবার্যভাবে কাল রাতে তার ভিতরে ঝড় তুলেছিল। ষাট এবং সত্তরের দশক আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। সেসব চিন্তা, কর্ম আদর্শ এবং স্বপ্নও আর ফিরে আসবে না। সব কিছু ভাঙছে নাকি, ভবানীশঙ্কর?’(‘ছায়ার পাখি’)
উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের সচেতন কয়েকজন রাজবংশী মানুষের স্বরে প্রশাসন শাসক রাষ্ট্রের চরিত্র উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে গভীর নৈরাশ্য সৃষ্টি হয়, আধুনিক সফল উপন্যাসের এ একটি উদাহরণ, প্রতীকময়তাও তৈরি হয় অনায়াসে। উপন্যাসের শুরুতে শুকিয়ে যাওয়া চিরি নদীর বর্ণনার ভিতর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে। দুর্বল চিরি নদির রূপক ব্যবহারে শিল্পী অভিজিৎ কোনো প্রগলভতার পরিচয় দেন না। কিন্তু তোমার বিশেষ করে ‘অন্ধকারের নদী’ বা ‘আধার মহিষে’ এই শৈল্পিক মিতাচার নেই। ‘রহু’র পর ‘ছায়ার পাখি’তে তিনি মহৎ ঔপন্যাসিকের পরিচয় দেন।
আনোয়ার লম্বা কথায় দীর্ঘ যতি দেয়, নোমান হাল্কা একটা শ্বাস ফেলে বলে, শিল্পসফল উপন্যাস বিষয়ে বাখতিন যেমন বলেছেন, অভিজিৎ সেনের উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হতেই পারে, বাখতিন বলেছিলেন, … in the novelist’s world generally nothing mearly thing-like no mean matter, no object – there are only subjects. Therefore, there is no word-judgment, no word about an object, no second hand referential word – there is only the word as address, the word dialogica – my contacting another word, a word about a word address to a word.
বাখতিনের এই word উচ্চারণ ও মর্মার্থ আমার কাছে মন্তাজের মতো মনে হয়। চলচ্চিত্রে মন্তাজ যেমন একটি দৃশ্যের সঙ্গে একটি দৃশ্যের জোড়া লাগিয়ে তৃতীয় অর্থ নির্দেশ করে যে অর্থ আসলে ছবির ফিংগার পয়েন্ট বা addressকে জোরালো করে, তেমনি word-এর সঙ্গে word যুক্ত হয়ে উপন্যাসের গন্তব্যকে আবিষ্কার করছে। ‘রহু চণ্ডালের হাড়’-এ এর উদাহরণ ব্যাপক, যাযাবর বাজিকর গোষ্ঠির মহাকাব্যিক পর্যটন যে মানব গোষ্ঠির শাশ্বত পরিভ্রমণ বা যাত্রার কথা বলছি তাকে অভিজিৎ বারবার বক্তব্য মন্তব্য দিয়ে নয় শব্দ দিয়েই সংযুক্ত করছেন, যেমন উপন্যাসের শুরুতেই আছে জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন হিসেবে অসংখ্য জানোয়ারদের কথা। বলছেন প্রবল ভূমিকম্পে যে সব ধ্বংসের কথা, বাঁচার জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন। মানব সমাজ সভ্যতার অতি প্রাথমিক সময়েও ছিল জানোয়ারের অবলম্বন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস এবং স্থান থেকে স্থানান্তরে সরে পড়া। পশু চুরি, দখল, যাদুটোনা, ভানুমতির খেল, শক্তিমানের অন্যায় শক্তি বলে ভোগদখল সবই মানব নৃগোষ্ঠির বিকাশেরই গল্প। ‘বাজিকর’ বিষয়টাও যথার্থ দ্ব্যর্থময়, প্রবল প্রতিকুলতার মধ্যে জীবন রক্ষা, আশা ও স্বপ্নের, ভবিষ্যতের পথে যাত্রার আকাক্সক্ষা একরকম বাজি ধরাই, জীবনকে বাজি রেখেই জীবনকে বয়ে চলা। অন্যদিকে এই বাঁচার প্রয়াসে দরকার তেমন কৌশল, মন ভোলানো চোখ ভোলানো যাদুকর ভেলকি। এবং ধীরে ধীরে স্থির হয়ে বাসের স্থিতিযোগ্য ব্যবস্থায় পথ অবলম্বন করা। জমি সংসার আর কৃষি আবাদে আপাত স্থিতিশীলতার খোঁজ পাওয়া। স্থিতিশীলতার খোঁজে কত জন প্রান্তর ঘুরে বেড়াল গোরখপুর থেকে ভূমিকম্পে উৎখাৎ হয়ে রাজমহল মণিহারিহাট, হরিশচন্দ্রপুর, সামামি হয়ে মালদা পূর্বপথে সূর্য ওঠার পথে রাজশাহী পাঁচবিবি আরও বহু স্থান থেকে স্থানান্তরে। স্বয়ং অভিজিৎও এই উপন্যাস লিখবার আগে কত পথ পরিভ্রমণ করেছে তা আমরা আগেই দেখেছি। আনোয়ারের ঠোঁটে হাসি, বলে, তোমার এই পাঠই আসলে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসের ‘address’। উপন্যাসের শেষে স্থায়ী বসবাসের ইঙ্গিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমুক্ত মানুষগুলির কোনো একটি বিশেষ ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন সবই শুধু বাজিকরদের গল্প নয়, সত্যিকার অর্থে দেড়শো বছর জুড়ে এমন করে বাজিকরদের, সব বাজিকরদের ইতিহাসও এভাবে গড়ে উঠেনি, বা উঠেছে যে তার তেমন ঐতিহাসিক দলিল নেই। যাযাবর বাজিকরদের আধার করে আবহমানের গল্পই তিনি লিখেছেন।
ঠিক বলেছ, নোমান প্রগলভ হয়ে আনোয়ারের কথা শেষ হতেই তার পাঠের পক্ষে যোগ করে, এই কারণে, উপন্যাসে বৃটিশ সম্রাজের কাল থেকে একেবারে দেশভাগ পার করে ষাট দশকে উপনিত হওয়া এই কাল পর্বের কথা যতটা সময়ের পরিধিকে চেনায় ততটা এই সময় পর্বের তুমুল রাজনৈতিক ঘঠনাবলির বিস্তার উপন্যাসে ঘটে না। ভারত, সিপি¬বি, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, ভারতভাগ. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তান সৃষ্টি, আন্দোলন উপন্যাসে গুরুত্ব পায় না। খোয়াবনামায় বা ছায়ার পাখিতে যেমন ইতিহাস ও রাজনৈতিক ভাবনা, তৎপরতা মুখ্য ভূমিকা রাখে।
মানুষের চলার প্রাথমিক ইতিহাস, ইতিহাসহীন বহু কাহিনী, পুরাণ, সংস্কার, বিশ্বাস জড়িয়ে স্বপ্ন মানব সংগঠনের আদল দিতে থাকে, গোষ্ঠি নেতা তৈরি হয়, নেতার পরম্পরা তৈরি হয়, এখানেও তেমন আছে দেবতার অভিশাপ, স্বপ্ন, স্বপ্ন নির্দেশ মানা, নিয়তির ওপর ভর আর আশার জগত। তাদের মতো করে একরকম নৈতিকতাও তৈরি হয়ে যায়। এই নৈতিকতা বিশ্বাসের নামান্তর। নৈতিকতা উপেক্ষা করলে অভিশাপ – দেবতার অভিশাপ। বলো এশুধু বাজিকরদের কথা। অভিজিৎ গভীর তন্ময় হয়ে একনিষ্ঠভাবে যেন বাজিকরদের কথা বলছে। তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর এই রূপকজীবনের আশ্রয় ব্যাখ্যা করতে বসেননি। নিরাবেগ নৈর্ব্যক্তিক শিল্পীর বুনুনে যাযাবর গোষ্ঠির খবর তৈরি করে যান, আর অনায়াসে এর বহুস্তরীয় অর্থময়তায় গভীর হয়ে ওঠে। অভিশাপটি লক্ষ্য কর, ওই অনৈতিক, সমাজ-অমান্য কর্মের জন্য অভিশাপ, অভিজিৎ সেন থেকে পাঠ শোনো –
হাজার বছর আগে যখন তারা কোনো এক বিশাল নদীর ধারে স্থায়ী বসবাস করত, সেই সময়কার পৌরাণিক স্মৃতি তাদের ভারাক্রান্ত করত। যখন তাদের কোনো প্রাচীন পুরুষ পুরা এক নতর্কীর প্রতি আসক্ত হয় এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর শুরু হয় সেই অন্তর্কলহ, যা তাদের স্থায়ী বসবাসকে ছিন্নভিন্ন করে। মানুষ তখন দুই দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পুরার বিরুদ্ধবাদীরা দাবি তুলেছিল, এ বিয়ে হতে পারে না, কেননা পালি নামের সেই নর্তকী নাকি তার বোন। সুতরাং, এ বিয়ে হবে অসামাজিক এবং অমঙ্গলময়।
পুরার সমর্থকরা বলেছিল, এ বিয়ে হবেই, কেননা পালি যে পুরার বোন এর কোনো প্রমাণ নেই।
তারপর পুরা ও পালির বিয়ে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দেবতার অভিশাপ নেমে আসে তাদের ওপর। অন্তর্কলহে সমস্ত মানুষ নষ্ট হয়। পুরা ও পালি দেশ-দেশান্তরে পালিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তাদের বিরুদ্ধবাদী ঘাতকেরা তাদের খুঁজে বেড়াতে থাকে। তারা কোথাও আশ্রয় পায় না এবং দেবতা তাদের অভিশাপ দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় করে দেয়। ‘ … তোমরা এক বৃক্ষের ফল দু’বার খেতে পারবে না, এক জলাশয়ের জল দু’বার পান করতে পারবে না, এক আচ্ছাদনের নিচে একাধিক রাত্রিবাস করতে পারবে না এবং সব থেকে ভয়ানক – এক মৃক্তিকায় দু’বার নৃত্য করা দূরে থাকুক, দু’বার পদঘাত পর্যন্ত করতে পারবে না। এই ছিল দেবতার অভিশাপ। সেই থেকে বাজিকর পথে প্রান্তরে ঘুরছে। সেই থেকে দেবতা থেকে বঞ্চিত।’ এই অভিশাপের গল্প অভিজিৎকে বলতে হয় পীতেম ও সালমার প্রেম ও ব্যর্থ পরিসমাপ্তির আখ্যানের জন্য। কেননা তাদের দুজনেরও ভাইবোন হবার সম্ভাবনা আছে। পীতেমের বাবা দলু যে সালমার মাকে গ্রহণ করেছিল বিবাহ সম্পর্কের বাইরেও। সালমার মা’র তো আরও পুরুষসঙ্গী ছিল দলুর অধিকার আসবার আগে! বাজিকরদের মনে, বিশেষ করে পীতেম ও সালমার মনে সেইসব প্রাচীন স্মৃতি, পাপবোধ বা নিতান্ত বিশ্বাস এখনো আতঙ্কিত করে। তো বলো, পালি পুরার গল্প যেমন শুধু বাজিকরদের জীবনেই ঘটে না, তেমন পীতেম সালমার গল্পও তাদের জীবনেই শুধু ঘটে না, অন্যদিকে দেবতার অভিশাপ কোন্ একটি নৃগোষ্ঠির জীবনে আতঙ্ক ও বিপর্যয় হয়ে ওঠে নি!
পীতেমের নানা এক সময় বলেছিল, ‘এ দেশের মানুষগুলোকে অবশ্যই দানোয় পেয়েছে, না হলে এমন হয় না, সুতরাং পালাও এখান থেকে।’ কারণ পৃথিবীর যাবতীয় ইন্দ্রজাল বা ভানুমতির খেলা থেকে বেশি উত্তেজক, বিষ্ময় উদ্রেককারী ভয়াবহ অত্যাচারের ঘটনা ঘটছিল। ‘তখন বাজিকর দেখেছে খাজনা না দিতে পারার জন্য গাছে ঝোলানো মানুষ, চুনের ঘরের মধ্যে বদ্ধ মানুষ, বিষ্ঠা ভক্ষণে বাধ্য মানুষ, বস্তাবন্দী জলমগ্ন মানুষ আরো অসংখ্য অশ্লীল কদাচার যার নাম শাস্তি, যার নাম প্রজাকে শায়েস্তা করা।’ ইংরেজ সরকারের প্রশ্রয় পাওয়া রেয়াড়া সাহেব, সাহেবদের আশকারা পাওয়া সামন্তপ্রভুদের এই নির্যাতনের প্রসঙ্গ ওঠে ওই উপন্যাসের সময়কালের জন্যই। তবে বাজিকর কেন আরও শ্রেণী পেশার মানুষ ভয় পেয়েছে, মরেছে, শেষে পালিয়েছে।
আনোয়ার দ্রুত পূর্বদেশের কথা তোলে, অভিজিৎ সেনের পর্যবেক্ষণ দেখ, তিনি সতর্ক সচেতন ভাবেই পীতেমের বাপের পূর্ব দিকে যাওয়ার স্বপ্নাদেশের মতো নির্দেশের কথা তোলেন।
পুব দেশে কি আছে বাপ ?
পুব দেশে জল আছে, ফল আছে, মানুষ আছে
জানোয়ার আছে।
তবে না নানা বলেছিল সেখানে দুর্ভিক্ষে আধা মানুষ মরে যায় ?
আধা মানুষ থাকে, তারা আবার মানুষ বানায়।
কৃষির সম্ভাবনাময় উর্বর অঞ্চলে জল হাওয়ায় মানুষের জন্মহার যেমন বাড়ে পূর্বের চিন-ভারত-ইন্দোনেশিয়ায়, তেমন এই পূর্বেই পশ্চিম প্রান্তের তুলনায় সাম্যের আহ্বান ও সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাগুলো ঘটে। পীতেমের বাবার মুখ দিয়ে অভিজিৎ নিজেই পূর্ব বিশ্বের এই সম্ভাবনার কথা জানালেন। ঔপন্যাসিকের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও পক্ষপাত সাম্য সমাজতন্ত্রের প্রতিই। তো এই ইঙ্গিতও সমাজ সভ্যতার রূপ রূপান্তরের ইতিহাসে নিহিত, বাজিকরদের ইতিহাসের কথামাত্র নয়। আর পূর্ব দিকেই প্রথম সূর্য ওঠে, সূর্য উদয়ের পথে যাত্রা! নোমান বলে, ঊপন্যাসের শুরু হয় শারিবার নানি লুবিনির গভীর সখ্যতায় বাজিকর গোষ্ঠির পথ যাত্রার কাহিনী বয়নের মধ্য দিয়ে। ভবিষ্যতের কাণ্ডারি শারিবা হয়তো তার শোনা গল্পেই নানির কাছে আবার শোনে, বারবারই সে দেখতে পায় এই নিবাসহীন উন্মূল গোষ্ঠির অন্তরে গোপনে হলেও স্থায়ী নিবাসের আকাক্সক্ষা ছিল। জমি ফসল নিয়ে সংসারের স্বপ্ন অবচেতনে চাপা পড়ে ছিল। আবার উপন্যাসের শেষে ওই শারিবার নেতৃত্বেই একরকম স্থায়ী হয়ে বাসের কথা আমরা পড়ি। পীতেম থেকে শারিবার মধ্যকার একশো বছরে বাজিকর স্থিতি পেয়েছে, গোষ্ঠির সবাই সংসার পেতেছে। সংসার পাতলেই সব শরিক, সব মানুষ স্থিতি পায়! নিশ্চিন্ত থাকতে পারে! মানব সভ্যতার ইতিহাসে নিশ্চিন্তে বসবাসের ইতিহাসের বড়ো অভাব। বিরোধের ইতিহাসই সত্য। বিরোধ এখানেও বাধে। শারিবা তবুও বিরোধ নিষ্পত্তির পথ খোঁজে বসতের স্থায়িত্বের আকাঙ্ক্ষা তার মনে। বিরোধ বাড়ছে দিগর এবং দিগরবহির্ভূত মানুষদের মধ্যে। … শারিবা কালই ইয়াসিনকে বলবে সেইসব মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে যারা ভায়রো, আজুরা ও অন্যান্য ভূস্বামীর হিসাব বহির্ভূত জমি দখলে চক্রান্ত করছে। এইভাবেই স্থায়িত্ব আসবে।’
তাহলে আনোয়ার আমাদের আলোচনায় বাজিকরদের পরিভ্রমণের গল্প আর মানব সমাজ সভ্যতার গড়ে ওঠা রূপান্তরের ভিতর যেমন একীভূত হয়ে যায়, তেমনি, অভিজিৎ সেনের ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাস সেই কাঙ্ক্ষিত উপন্যাসের নমুনা যেখানে জীবনের সমগ্রতা প্রতিফলিত হয় দর্পণে যেমন মানুষের মুখ ভেসে ওঠে আলো ছায়া দাগ গর্ত ও সৌন্দর্য নিয়ে।
এপ্রিল ২০১২