এক
অমিয়ভূষণ মজুমদার (১৯১৮-২০০১) পশ্চিমবাংলার লেখক। খোদ কলকাতা নয়, কোচবিহারের বাসিন্দা তিনি। যদিও এসব প্রসঙ্গ অমিয়ভূষণ মজুমদার সম্পর্কে খুব বেশি জরুরি নয়। খোঁজাখুঁজি করলে তাঁর বই বাংলাদেশের বইপাড়ায় দু’এক কপি মেলে, যার বেশি কলকাতা শহরেও মেলে না বলেই শোনা যায়। যদিও বর্তমানে বাংলা কথাসাহিত্যের এমন মননশীল পাঠক খুব নগণ্য যিনি তাঁর অন্তত দু’চারটি উপন্যাস পড়েননি। অর্থাৎ সিরিয়াস পাঠকের দ্বারে তিনি সব বাধা পেরিয়ে গেলেও জনপ্রিয়তা অভিধানটি তাঁর কপালে জুটবে না কখনই বলে মনে হয়। কিন্তু তারপরও বোদ্ধাজনের সামগ্রিক বিচার হলো অমিয়ভূষণ মজুমদারের নামটি সময়সাময়িক কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম উচ্চার্য।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর বাংলা কথাসাহিত্যে শক্তিমান নক্ষত্রদের মধ্যে সতীনাথ ভাদুড়ী, জগদীশ গুপ্ত, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, কমলকুমার মজুমদার, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অসীম রায় এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ অন্যতম। আবু ইসহাক, দেবেশ রায়, মাহমুদুল হকের পর সার্বক্ষণিক সিরিয়াস সাহিত্যের সৃজনে যাঁরা সূচিবিদ্ধ হন তাঁদের মধ্যে অভিজিৎ সেন, নবারুন ভট্টাচার্য, ভগীরথী মিশ্র, হুমায়ুন আজাদ, শহীদুল জহির প্রমুখের নাম প্রাথমিকভাবে মনে আসে। অন্নদাশংকর রায়, মহাশ্বেতা দেবী, বিমল কর, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, আহমদ ছফা প্রমুখের কথাসাহিত্য জনপ্রিয়তা ও শিল্পমানের যুগল বিচারে এগোয়। উপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি না পেলেও দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গুণময় মান্না, আবুবকর সিদ্দিক উল্লেখ্যযোগ্য প্রচেষ্টাকারী। জীবন ও জগতকে দেখার সন্নিষ্ট চেষ্টার সাথে শৈলীগত নিরীক্ষা ও সার্থকতা সাহিত্যজগতে সর্বদাই কম। শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্য বা শুধুমাত্র উপন্যাস-এর ক্ষেত্রেই নয় ব্যাপারটির সত্যতা শিল্পসাহিত্যের সকল অঙ্গনেই লক্ষিত।
অমিয়ভূষণ মজুমদারের প্রথম প্রকাশিত রচনা হল একটি নাটক। দ্য গড অন মাউন্ট সিনাই নামের এ নাটকটি বেরিয়েছিল অধুনালুপ্ত মন্দিরা পত্রিকায়। (অমিয়ভূষণ মজুমদার পূর্ণাঙ্গ রচনাপঞ্জি, বিজ্ঞাপনপর্ব ১০, অক্টো ১৯৮২ – জানু ১৯৮৩, কলকাতা)। অন্যত্র তথ্যাদি এমন ১৯৪৩-এ মন্দিরা পত্রিকায় একটি একাঙ্ক প্রকাশিত হয়েছিল (অমিয়ভুষণ মজুমদার জীবনপঞ্জী, এবং মুশায়েরা, উপন্যাস বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা, কলকাতা)। দ্য গড অন মাউন্ট সিনাই-ইকি ঐ একাঙ্কটি? লিটল ম্যাগাজিনে রচনা প্রকাশ করার এ অভ্যাসটি সারাজীবন ধরেই অমিয়ভূষণে বর্তমান। লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়েছে। ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর কাছে কিছুতেই তিনি পরিচিত হয়ে উঠতে পারেন নি। যদিও আসল ব্যাপারটি হচ্ছে তিনি তা চানওনি। পরবর্তীতে হাত দেন গল্প রচনায়। ১৯৪৫-এ প্রথম গল্প রচিত হয় যার নাম ছিল ‘প্রমীলার বিয়ে’।
প্রথম উপন্যাস গড় শ্রীখণ্ড – ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা পত্রিকায় ১৩৬০ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা থেকে। পরে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস নয়নতারা – যদিও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এটিই তার প্রথম উপন্যাস – প্রথম সংস্কারণে নীলভূঁইয়া নামে প্রকাশিত হয়েছিল। চতুরঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশকালে যদিও এটির নাম ছিল নয়নতারা। আসল ব্যাপারটি হচ্ছে নীলভূঁইয়া নামে লেখক যে একটি ট্রিলজি লেখার পরিকল্পনা করেন তার প্রথম পার্ট ছিল নয়নতারা।
কিন্তু পরবর্তীতে ট্রিলজি লেখার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যাওয়ায় তিনি সেটিকে স্বতন্ত্র একটি উপন্যাস হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে নতুন সংস্করণে নাম দেন নয়নতারা। গ্রন্থাকারে নয়নতারা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৫৫ সালে। এরপর ক্রমান্বয়ে দুখিয়ার কুঠি (পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৫৭, গ্রন্থাকারে ১৯৫৯), নির্বাস (গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৫৯), মধু সাধুখাঁ (পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৬৮, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৮৮), ফ্রাইডে আইল্যান্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ এবং তাহার পর (পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৭০, গ্রন্থকারে প্রকাশ ১৯৮৮), রাজনগর (পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৭২-১৯৭৪, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৮৩), বিলাস বিনয় বন্দনা (পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৭৬, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৮১), মহিষকুড়ার উপকথা (পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৭৮, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৮১), বিবিক্তা (পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৭৮, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৮৯), চাঁদবেনে (গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৯৩), বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবী (পত্রিকায় প্রকাশ ১৯৮৪, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৯৭)।
দ্বিতীয় উপন্যাস নয়নতারা ১৯৫৩ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে রচিত – তথ্যটি সহজলভ্য। গড় শ্রীখণ্ড – প্রকাশকালের হিসেবে দ্বিতীয় হলেও রচনাকালে প্রথম সে তথ্যটি আগ্রহী পাঠক জানেন। শুধুমাত্র চাঁদবেনে-এর প্রথম প্রকাশকাল নিয়ে সমস্যা। বিজ্ঞাপনপর্ব-এর উল্লিখিত সংখ্যা এবং উত্তরাধিকার (অক্টো-ডিসে ১৯৯৪, উত্তর দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ) অমিয়ভূষণ মজুমদার সংখ্যা অথবা এবং মুশায়েরার উল্লিখিত সংখ্যার কোনটিই প্রথম প্রকাশের পত্রিকার নামটি দিতে পারলেও এর সময়কাল উল্লেখ করেনি। এ ছাড়া? উদ্বাস্তু নামের তাঁর একটি উপন্যাসের নাম জানা গেলেও সেটির প্রকাশকাল সহজলভ্য নয় যেমনভাবে গ্রন্থটি নিজেই রীতিমত দুর্লভ। এতো গেল গ্রন্থিত উপন্যাসের হিসেব। অগ্রন্থিতদের মধ্যে যেগুলো আছে সেগুলোর পত্রিকায় প্রকাশকাল এবার আমরা প্রথম বন্ধনীতে উল্লেখ করলাম। দোম আন্তনিও (১৯৭২), তাসিলার মেয়র (১৯৭৩-৭৫), নিউ ক্যালকাটা (১৯৭৩), মতিঘোষ পার্ক (১৯৭৪), উত্তর পুরুষ (১৯৮৭), মাকচক হরিণ (১৯৯১), ট্রাজিডির সন্ধানে (১৯৯৪)। এছাড়া রয়েছে বিন্দনী যার পত্রিকার প্রকাশকাল বর্তমান লেখকের অজানা। এই অরণ্য এই নদী এই দেশ গ্রন্থটি দু’টি বড় গল্পের সমন্বিত রূপ যার একটি ‘সোঁদাল’ ১৯৮৭’র পুজাসংখ্যায় প্রতিক্ষণ-এ উপন্যাস অভিধায় ছাপা হয়েছিল। এ তথ্য এ জন্যেই যে ‘সোঁদাল’ উপন্যাস কি না তা বিচারের প্রশ্ন থাকছে। তা ছাড়া থাকছে ‘বিপ্লবের মৃত্যু’ যা ১৯৬১ সালে পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এটি গ্রন্থকার ঢাকার ঘাস ফুল নদী প্রকাশনী থেকে ১৯৯৮ এ প্রকাশিত হয়েছে। এ উপন্যাসটি নিয়েও সমরূপ সমস্যা রয়েছে। কেননা, এবং মুশায়েরার উপর্যুক্ত সংখ্যাটি একে উপন্যাস তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। অন্যদিকে উত্তরাধিকার অমিয়ভূষণ মজুমদার সংযোজন সংখ্যাটি (অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৯৫) এটিকে অগ্রন্থিত গল্পতালিকায় সূচিবিন্ধ করেছে।
পাঠক মাত্রই বিরক্ত হচ্ছেন জেনেও রসকসহীন এ তালিকা নির্মাণটি বর্তমান রচনার জন্যে জরুরি। এ জন্যে যে, অমিয়ভূষণ মজুমদারের মোট রচনা পরিমাণে যথেষ্ট এবং তার মধ্যে উপন্যাস সিংহভাগ। কিন্তু প্রথম দু’টি ছাড়া বাকিগুলোর রচনাকালে স্পষ্ট হিসেব অনুপস্থিত। অনুমানে একটি লেখাক্রমে প্রথম দিকে ৫/৭/১০টি উপন্যাসের ক্ষেত্রে করা সম্ভব হলেও সকল উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা এখনো সম্ভব নয়। যদিও নিশ্চিত তা অতীব প্রয়োজন।
মোট উপন্যাস সংখ্যা বারো (গ্রন্থকার প্রকাশিত) + সাত (পত্রিকায় প্রকাশিত) + এক (উদ্বাস্তু) + দুই (সোঁদাল ও একটি বিপ্লবের মৃত্যু) = বাইশটি ধরলে অনেকের হঠাৎ করে মনে হবে ‘এতগুলো’। যদিও সময়ের হিসাবটি এ বিস্ময়কে নস্যাৎ করবে নিশ্চয়। ১৯৫৩ সালের পূর্ব হতে আমৃত্যু সর্বমোট আটত্রিশ বছরের অধিককাল ধরে অমিয়ভূষণ মজুমদার নিরলসভাবে উপন্যাস রচনা করেছেন।
এবার আসা যাক সাহিত্যের হিসেব-নিকেশ বিষয়ক গ্রন্থগুলোতে। সেগুলোতে অমিয়ভূষণ কেমনভাবে মূল্যায়িত। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা গ্রন্থে অমিয়ভূষণের শুধুমাত্র গড় শ্রীখণ্ড অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ গ্রন্থের রচনাকালের প্রেক্ষিতে এটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া যায়। গড় শ্রীখণ্ড, দখিয়ার কুঠি, মহিষকুড়ার উপকথা, মধু সাধুখাঁ, ফ্রাইডে আইল্যান্ড, রাজনগর প্রভৃতি উপন্যাস ‘বুড়ি ছোঁয়া’ স্পর্শ পেয়েছে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা উপন্যাসে কালান্তর গ্রন্থে। দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ গ্রন্থে নেই এটি সত্য, কিন্তু নীলভূইয়া কেন বাদ যায় সে প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয়। অশ্রুকুমার শিকদারের আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস গ্রন্থটিতে গড় শ্রীখণ্ড নিয়ে পনের পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ রয়েছে। ১৯৮৮ সালে অর্থাৎ এ গ্রন্থের প্রথম প্রকাশকালের মধ্যে অমিয়ভূষণ মজুমদারের মহিষকুড়ার উপকথা পর্যন্ত উপন্যাস প্রকাশিত। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত বাংলা উপন্যাসের শিল্পীরীতিতে হীরেণ চট্টোপাধ্যায় অমিয়ভূষণ মজুমদারের কোন উপন্যাসকে বিশ্লেষণের তালিকায় আনতে সক্ষম হন না যদিও শীর্ষেন্দু, শংকর, সঞ্জীব, সুনীলের উপন্যাস অন্তর্ভুক্ত হয়। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর একটি গ্রন্থ বাংলা উপন্যাস : দ্বান্দ্বিক দর্পণ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩) বইতে মধু সাধুখাঁ নিয়ে কথা থাকলেও ফ্রাইডে আইল্যান্ড প্রাসঙ্গিক হয়নি।
লেখার সন তারিখ নিয়ে এতসব বকবকানি কেন? এ জন্য যে একজন মহৎ সাহিত্যিকের সকল রচনার ক্রমহিসাব থাকাটি অতীব প্রয়োজন – বিষয়ক নির্বাচন সংক্রান্ত প্রশ্নে যেমন, তেমনি ভাষা ও প্রকরণের প্রশ্নেও বটে। পাঠকের কাছে লেখকের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নেও এটি প্রাসঙ্গিক বলে সকলে বিবেচনা করেন।
দুই
বিংশ শতাব্দীর অর্ধেক পুরোটা জুড়েই অমিয়ভূষণ মজুমদার ছিলেন বাংলা উপন্যাসের প্রধান পুরুষদের অন্যতম। ১৯৫৩-তে যখন তাঁর উপন্যাস গড় শ্রীখণ্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু হরে তখন বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র পরবর্তী সমকালীন প্রধান তিন ঔপন্যাসিকের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অস্তমিত; তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান উপন্যাসগুলো প্রকাশিত, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অস্তাচলগামী। এ তালিকার বাইরে কম জনপ্রিয় ধারায় আরও যে একজন শক্তিমান সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর প্রধান দুটি উপন্যাস জাগরী ও ঢোঁড়াই চরিতমানস ইত্যেমধ্যে প্রকাশিত। অ-চলিত ধারার ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ত্রয়ী উপন্যাস অন্তঃশীলা, আবর্ত এবং মোহনাও ততদিনে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে অদ্বৈত মল্লবর্মন তাঁর তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের গ্রন্থরূপ প্রকাশের আগেই প্রায়ত। এরকমই একটি সময়ে অমিয়ভূষণ মজুমদার শিল্পিত ও ঋজু নির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে বাংলা উপন্যাস জগতে প্রবেশ করেন। নিরলস এ উপন্যাসকর্মী তারঁ অন্বিষ্ট থেকে কখনও বিচ্যুত হননি বা কর্মহীন থাকেন নি। তিনি পঁচিশটির বেশি উপন্যাস লিখেছেন এবং এর প্রত্যেকটিতেই অনুসন্ধান করেছেন উপস্থাপনা ও ভাষার নতুন রীতি, সমাজ ও চরিত্রের নতুন দিগন্ত। ঠিক পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁর এমন প্রয়াস বাংলা উপন্যাসকে সর্বদা বিভাসিত করেছিল।
লক্ষ করা যেতে পারে, ঔপন্যাসিক হিসাবে অমিয়ভূষণ মজুমদারের দীক্ষাকালে বায়োজ্যেষ্ঠ কমলকুমার মজুমদারের প্রথম উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা প্রকাশিত হয় নি, সামান্য অগ্রজ শওকত ওসমানের জননী লিখিত হলেও প্রকাশ পায় নি। এ দুজনের মধ্যে কমলকুমার তাঁর ভাষার ক্রমজটিলতার কারণে পাঠক-দ্বারে পৌঁছতেই পারলেন না, আর শওকত ওসমানের ঔপন্যাসিক কৃতি কয়েকটি উপন্যাসে রচনার পর ঢালে নেমে গিয়েছিলেন তা অস্বীকারের কোন উপায় নেই। পরবর্তীতে আমরা আরও পেয়েছি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক এবং অসীম রায়কে। উপর্যুক্ত পাঁচজনের মধ্যেই ওয়ালীউল্লাহ অগ্রগামী। তাঁর লালসালুই প্রথম উপন্যাস হিসেবে এ পাঁচজনের মধ্যে প্রথম: ১৯৪৮। রচনার স্বল্পতা এবং শেষ দুটি উপন্যাসে জটিল উপস্থাপনা সত্ত্বেও তিনি অনাদৃত নন। আবু ইসহাক স্বল্পতর, যদিও সৃজন প্রশ্নে অসীম রায় পরিমাণে বেশি। মধ্যমপ্রজ হলেও অসীম পাঠকপ্রিয়তা পাননি রচনায় ভাবালুতার অভাবের কারণে। অসীমের জন্মের বছর ১৯২৭-এ আরও যে এক বাঙালি ঔপন্যাসিক জন্ম নিয়েছিলন এবং সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন তিনি লোকনাথ ভট্টাচার্য। অসীম রায়তো তবুও বোদ্ধা পাঠকের টেবিলে হলেও স্থান পেয়েছিলেন, লোকনাথ তা থেকেও বঞ্চিত। লোকনাথের মতই নিকট অতীতে আর একজন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হলেন শামসুদদীন আবুল কালাম। কাশবনের কন্যা দিয়ে তাঁর দৃপ্ত যাত্রা শুরু হলেও সম্ভবত দীর্ঘ প্রবাসকাল এবং উপন্যাসে গল্প বলার প্রচলিত প্রথা পরিত্যাগ করায় তিনি পাঠকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেলেন। তাঁর মৃত্যুরও একবছর পর ১৯৮৮-এ যখন মহাকাব্যিক কাঞ্চনগ্রাম প্রকাশ পেলো তখন বাঙালি পাঠক শুধু এটুকুই যেন অনুভব করলেন কী এক অমিত প্রতিভা পাঠ-তালিকার বাইরে রয়ে গেছে। বর্তমানে পঞ্চাশ-ষাটের কোঠায় বাংলা উপন্যাসে বিচরণ করছেন শিল্পীদীপ্ত বেশ কয়েকজন, যদিও দুর্ভাগ্যের যে তাঁদের মধ্যে র্কীতিমান যিনি সেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ইতিমধ্যেই কালের গ্রাসে পতিত।
অমিয়ভূষণের গড় শ্রীখণ্ড আবহমান বাংলার উপন্যাস। ভারত স্বাধীনতার আগে-পরের সময়কালে পদ্মাপাড়ে স্থাপিত এ উপন্যাসের কাহিনী। সমসাময়িক মধ্যবিত্ত সমাজ অমিয়ভূষণের উদ্দিষ্ট হলেও সমাজভূক্ত উচ্চ-নীচ কোন শ্রেণিই বাদ যায় না সে উপন্যাস থেকে। আর তাই সর্বোপরি এটি একটি বিশেষ শ্রেণির উপন্যাস না হয় পদ্ম-তীরবর্তী বাংলা জনপদের সকল মানুষের উপন্যাস হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয় পদ্মা নায়িকার আসনেই। “পৃথিবীতে অনেক দেশ থাকতে পারে – যে দেশে পদ্মা নেই, সেটা আমার দেশ নয়। এও বলি, পৃথিবীতে অনেক দেশ থাকতে পারে, তাকে আমি দেশ বলি না। যে দেশে পদ্মা প্রবাহিত, সেটিই আমার দেশ। … বাঙালির কথা বলব, পদ্মার কথা বলব না, এ কি হয়” – এমন ভাবনাতো অমিয়ভূষণ বারবারই ব্যক্ত করেছেন তাঁর বহু ভাষ্যে।
স্বকালের সমাজ ও মানবমনকে ধরতে অমিয়ভূষণ বিশাল কলেবরের যে গড় শ্রীখণ্ড রচনা করেন ঠিক পরবর্তীতে উপন্যাস নয়নতারা-তেই তিনি আর সে সমাজ ও কালে স্থিত থাকেন না। যদিও পদ্মা প্রসঙ্গটি অপসৃত হয় না এ উপন্যাসেও। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝির এক সময়কে নিয়ে গড়ে ওঠে দ্বিতীয় এ উপন্যাসটি যার ভাষ্যে রয়েছে ব্যাপক ভিন্নতা। লক্ষণীয় যে, ঔপন্যাসিক তাঁর এ গ্রন্থটিকেও ঐতিহাসিক করায় প্রয়াসী নন। নয়নতারার সময়কাল মোটামুটি ১৮৫৫ থেকে ১৯৫৭-৫৮। অন্যদিকে রাজনগর শুরু ১৮৫৯-এ। নয়নতারাতে ঔপন্যাসিক প্রথম দিকে যে প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেন তাতে জমিদারপুত্র রাজচন্দ্র ও তাকে কেন্দ্র করে ইংরেজ নেটিভ দ্বন্দ্বই প্রধান হয়ে উঠবে বলে মনে হয় পাঠকের। কিন্তু তৃতীয় অধ্যায়ে এসে লেখক ঘোষণা দেন ‘এমনি অবস্থায় নয়নতারার সঙ্গে রাজচন্দ্রের দেখা হয়েছিল।’ এভাবেই নয়নতারার প্রবেশ, প্রাধান্য বিস্তার এবং শিরোনাম হওয়া। যদিও উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে নয়নতারার অপ্রধান হয়ে পড়া চোখে লাগে। উপন্যাসটির গৌণ কিন্তু বিশেষ গুরুত্বের একটি চরিত্র হলো বুজরুক। উপন্যাসের কালের সাথে ভারতের স্বাধীনতার স্পৃহা ও সিপাহী বিপ্লবের যে সম্পৃক্তি তা ঐ বুজরুককে দিয়েই। আখ্যান-নির্মাণে অমিয়ভূষণের আগ্রহ নয়নতারায় সর্বপ্রথম প্রকটিত যা গড় শ্রীখণ্ডতে তুলনায় কম স্পষ্ট। গল্পপ্রধান, যদিও গল্পই প্রধান উপজীব্য এমনটি হয়নি অমিয়ভূষণের একটি উপন্যাসেও, এমন আর একটি উদাহরণ হলো রাজনগর। নয়নতারার রাজচন্দ্রই রাজনগর উপন্যাসের প্রধান। রাজনগর-এর কাহিনী শেষ ১৮৮৩-তে। নয়নতারাতে নয়নতারাও রাজচন্দ্রের মুহূর্তিক শারিরীক সম্পর্কের ফসল যুবক কুমারনারায়ণকে দিয়ে উপন্যাসটি শেষ করা হয়েছে। গল্পপ্রধান নয়, কিন্তু সংযত গল্পের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অমিয়ভূষণের এমন অন্যান্য উপন্যাসের নাম: দুখিয়ার কুঠি, নির্বাস এবং বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবী।
ইতিহাসের সময়ে উপন্যাস স্থাপনার এমন উদাহরণ অমিয়ভূষণে আরও রয়েছে: মধু সাধুখাঁ এবং চাঁদবেনে। প্রথমটিতে যে সময়কালকে ধারণ করা হয়েছে বাংলা উপন্যাসের তখন ক্রীতদাস প্রথা বর্তমান। বাঙালি ক্রীতদাস নিয়ে রচিত এমন আর একটি উপন্যাসের নাম এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা বোধ হয় অযৌক্তিক হবে না। অসীম রায় রচিত সে উপন্যাসটির নাম নবাববাঁদী (১৯৮১)। নবাববাদী সামাজিক মানুষের চিত্রণ হলেও মধু সাধুখাঁ সে কালের সামাজিক ব্যকরণ। অন্যদিকে সুবৃহৎ চাঁদবেনে শিরোনামের পৌরাণিক পুরুষকে ধারণ করলেও সূক্ষ পাঠে স্পষ্ট হয় সে-পুরাণের ইতিহাস ভূগোলে কোন গড়মিল নেই। আর কে নারায়াণের মালগুড়ির দিনগুলো গ্রন্থে মানচিত্র থাকলেও চাঁদবেনেতে তেমনটি নেই কেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে অমিয়ভূষণের দার্ঢ্য উত্তর মালগুড়ি তাঁকে কল্পনাতে সাজাতে হয়েছে। আর ভূগোলের দিক দিয়ে, বায়ু প্রবাহের দিক দিয়ে কোন স্টানডার্ড অ্যাটলাস (বিলেতে তৈরী অ্যাটলাস) সামনে খুলে নিও, পেয়ে যাবে – একটাও ভুল পাবে না।’
রহস্যময়তা এবং অপ্রথাগত সম্পর্কও তাঁর উপন্যাসের সহজাত কারুকাজ। নয়নতারায় রানী ও ফিরিঙ্গি পিয়েত্রোর সম্পর্ক নিয়ে যে রহস্যের সম্ভাবনা পাঠক পেয়েছিল রাজনগর-এ তা স্পষ্টতা পায়। পিয়োত্রাই হলো রানীর মামাতো ভাই এবং কৈশোরের ভালোলাগার মানুষ। চরিত্রটির পুরোটাই তো রহস্যে ঘেরা। রাজকুমার রাজচন্দ্রের সাথে তার শারিরীক সহবৎও এমন এক বিরাট উদাহরণ। বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবীর প্রধান যে দুটি চরিত্র পায়খানার গাড়ীর ড্রাইভার হারান ও তার মেয়ে তরু দুজনেই ঋদ্ধ পাঠকের করোটিতেও সহজ সমাধানে আসে না। চৌদ্দর তরুর বাপ তো হরিণ পোষে না, শুয়োর পোষে। ওর মা চলে গেছে সদ্যজাত ভাইকে রেখে। নিজের সংসার নিয়ে, স্কুল-পড়াশোনা নিয়ে তীক্ষ্ণ উচ্চারণ ‘আমি কি করতে পারি? আমি কি তোমাদের ছোট্ট মেয়ে নই? তার মধ্যে আবার মাথা ঘষার দিন তো আসছেই মাসে মাসে। আর এসবের ভেতরেই বাবাকে স্বাভাবিক রাখার প্রতিযোগিতায় ঘটে গেল ঘটনাটি। নিজের মেয়ের গর্ভে হারানের আর এক সন্তান বড় হতে থাকল। আর এভাবেই পৌরাণিক এক প্রতিতুলনায় স্থাপন করে কাহিনীর এক উদ্ধত সন্নিবেশ অমিয়ভূষণ করেন বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবীতে।
যৌনসংসর্গের ঘটনা অমিয়ভূষণে কম, কিন্তু টুকরো টুকরো ইঙ্গিত প্রয়োজনমত আসতেই থাকে। বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবীর যেমন হারান ও তরুর ঘটনাট অনালোকিত, নয়নতারায় রাজু-নয়নতারাও তাই। কিন্তু শুকরদের যৌনক্রিয়া, হারান-হরমতিয়া সম্পর্ক অনেক স্পষ্ট। বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবীতে আরও যে একটি ব্যাপার ঘটে তা হলো সমাজের এমন একটি স্তরকে চিত্রিত করা যেটি শিক্ষা ও সভ্যতার সাধারণ মাপকাঠির বাইরে। সে সকল অভিজ্ঞতায় প্রচলিত মূল্যবোধ পিষ্ট। রামী রজকিনীতেও এমনটি লক্ষ করা যায়। রামী রজক ডাকাত কর্তৃক অপহৃত। মধু ডাকাত যখন তার পা জোড়া বুকে ধরে প্রেমের কাব্য শোনায় তখন সে প্রেমে রামীকে ডুবতেই হয় – কেননা ঈশেন ডাকাতের ঔরস তখন তার পেটে বড় হচ্ছে। মধুকে দিয়েই ঈশেনকে ঢাকতে হবে।
অথচ চন্দ্রাবলী গ্রামের রামী কিন্তু মানবিক এক উচ্চমার্গের বোধে সিঞ্চিত। যৌনতার প্রশ্নে নিজের উপলদ্ধিকে রামী মা দূর্গার সাথে তুলনীয় করে তোলে। যেমন মহাদেব মা দূর্গার শরীরে আশ্রয় খোঁজে। নিকটস্থ পুরুষ তো রানীর শরীরেই খুঁজবে তেমন আশ্রয়। তরুও কি কম এ বোধে? সমাজের অবহেলিত এক সম্প্রদায় তথাকথিত সভ্যতার আলোর বাইরে যাদের অবস্থান – তরু তাদেরই একজন। অথচ বাবার সাথে যৌনসংসর্গের পরও সে অনুতাপে ভোগে নি। কিশোরী তরু বরং তার পেটের ভেতর শিশুর নড়াচড়া উপভোগ করে। হারান গর্ভস্থ নষ্ট করার প্রস্তাব দিলে তরুর সোজাসাপটা উত্তর : ‘তোমার এক ছেলের মা আমি, তার তিনমাস থেকে, অন্য আর একের হতে দোষে কি?’
অমিয়ভূষণ মজুমদারের সাহিত্য প্রসঙ্গে একটি বহুলশ্রুত বিষয় হলো ভাষাজটিলতা। অমিয়ভূষণ নিজেরও যেমন তার বিভিন্ন সাক্ষাতকারে বলেছেন, তেমনি পাঠকও উপলব্ধি করেন যে ভাষা লেখকের প্রয়োজনকেই বাস্তবায়িত করে। অন্যদিকে উপস্থাপনা প্রয়োজনও ভাষার উপর প্রভাব ফেলতে পারে বৈকি? ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো ভাষাগত প্রশ্নে জটিল না হলেও উপস্থাপনাগত প্রশ্নে অনেক পাঠকেরই আয়ত্তের বাইরে। কমলকুমার মজুমদার কি শুধুই ভাষাজটিলতা? তাঁর দেখাটা অপ্রচলিত হয়ে পড়াও কি একটি অন্যতম কারণ নয় তাঁর ভাষা জটিলতার পেছনে? তাছাড়া ভাষার সাথে পাঠকের পরিচয়ের প্রশ্নটিও বিশেষ শুরুত্বের। যেমন কমলকুমারের কথাসাহিত্যের রচনাক্রমের হিসাবে পড়তে থাকলে তাতে পাঠকের বোধ্যতা বৃদ্ধি পেয়ে পরবর্তী পাঠকটিকে তুলনায় সহজ করে তোলে।
ভুলে যাওয়া উচিত নয় সাহিত্যের ভাষা ও প্রকরণ একজন ঋদ্ধ পাঠকের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই উত্তর আধুনিক সময়ে কথাসাহিত্যের একজন পাঠক শুধুমাত্র গল্প প্রত্যাশা করেন না তার লেখকের কাছে। বিষয় হয়তো প্রত্যাশা করেন, কিন্তু বেশি প্রত্যাশা করেন তার সমন্বিত উপস্থাপন। এসব দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা অমিয়ভূষণ মজুমদারের উপন্যাস সকলের কালানুক্রমিকের মূল্যায়নে যাব, তবে প্রসঙ্গিক কমলকুমার মজুমদারের উল্লেখ আমাদের দরকার হবে, যেহেতু অন্বিষ্ট প্রশ্নে দু’জনেই আপসহীন।
কমলকুমার মজুমদার সাধারণভাবে জটিল ভাষায় রচিত কথাসাহিত্যের স্রষ্টা হিসাবে পরিচিত। এত সরলীকৃত করে এত প্রতিভাধর একজন সাহিত্যিককে বিশ্লেষণ করা বাংলাভাষী পাঠকদের জন্যে সত্যিই লজ্জার। জটিল যে তার ভাষা তার রূপটা কেমন, জটিলতার উৎসটা কোথায়, কতখানি জটিল, সর্বত্র কি একই ধরণের জটিল – এ জিজ্ঞাসাগুলো আমাদেরকে নাড়া দেয়ার আগেই উপর্যুক্ত সরলীকৃত মন্তব্য আমাদের মস্তিস্কে কমলকুমার সম্পর্কে একটা ধারণা স্থাপন করে এবং তাঁকে পাঠ করা থেকে রিবত রাখে। যদিও প্রকৃত চিত্রটিতে খানিকটা হলেও ভিন্নতা লক্ষণীয়। কমলাকুমার মজুমদারের কথাসাহিত্যের কালানুক্রমটি যদি বিবেচনায় রেখে পড়া যায় তা হলে সরলতা থেকে জটিলতার একটি ঊর্ধ্বগতি বেশ নজরে পড়ে। ‘লালজুতো’ (১৯৩৭) থেকে ক্রমান্বয়ে ‘মধু’, প্রিনসেস, ‘প্রেম, ‘জাসটিস, ‘বাবু’ পর্যন্ত জটিলতার প্রশ্ন নেই। বরং ‘লালজুতো’ সমসাময়িক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্য মহারথীদের ভাষাকে অতিক্রম করে অধিক প্রাঞ্জল। এটি চলিত ভাষায় রচিত, যদিও অন্যরা তখনো সাধু ভাষাতে লিখছেন। শুধুমাত্র এই একটি গল্পই কি কম তাঁর সম্পর্কে সরলকৃত বক্তব্যটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে। ১৯৪৫-৫১ সময়ে আরো ৩টি গল্প ‘জল’ ‘তেইশ’ ‘মল্লিকা বাহার’-এ এসেছে সামান্য কয়েকটি করে বাক্য যেখানে প্রচলিত রচনারীতি লেখক মানছেন না। ভিন্ন রচনারীতি এ ব্যাপারটি ক্রমশ তীব্রতর হয় – শুধুমাত্র সাধু ভাষাতেই তিনি স্থিত হন না, নির্মাণ করে চলেন একটি আবহ এবং পাঠক উপলব্ধি করেন লেখক হিসেবে কমলকুমার মজুমদার নতুন দৃষ্টিও লাভ করেছেন। তাঁর দেখাটাই তা হলে সে-দর্শন প্রচলিত ভাষায় বর্ণনা কীভাবে সম্ভব! অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৫৯), গোলাপ সুন্দরী (১৯৬২) পর্যন্ত তবুও সে-ধৈর্যশীল পাঠক এগুতে পারেন কিন্তু পিঞ্জরে বসিয়া শুক (১৯৬৯) সে তো বোধগম্যতার বাইরে এবং উল্লেখ্য এরপর ১০ বছর তিনি এমন রচনায় নিমগ্ন ছিলেন যেখানে জটিলতার কোথায় গিয়ে তিনি পৌঁছেন তা সহজেই অনুমেয়।
এবার ফিরে আসি অমিয়ভূষণের ভাষা প্রশ্নে। সুবিমল মিশ্রের সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি জানান, রাজশেখর বাবু নাকি আমার গড় শ্রীখণ্ড উপন্যাস সম্বন্ধে বলেছিলেন ‘কি ভাষা! পড়া যায় না।’ অমিয়ভূষণের প্রথম উপন্যাস গড় শ্রীখণ্ড সম্বন্ধে এ মন্তব্য বর্তমান সময়ের পাঠকের জন্যে হাস্যকার। বরং বলা চলে ভিন্নতর উপস্থাপনার একটি ভাষা নির্মাণের যে ব্যাপার সেটি তার পরবর্তী উপন্যাস নয়নতারা, দুখিয়ার কুঠি, নির্বাস পর্যন্ত ক্রিয়াশীল নয়। মধু সাধুখাঁতে তাঁর এ প্রচেষ্টার একটি সার্থক রূপায়ণ স্পষ্ট হয় যা পরবর্তী উপন্যাস ফ্রাইডে আইল্যান্ড-এ বেশ অপ্রবেশ্য হয়ে পড়ে। এ উপন্যাসের শুরুর লাইনগুলো এমন – “সে বিষয়ে নানা মত যে প্রচলিত আছে সে স্বীকার করি এবং যা যাহা খুশি প্রামাণ্য মনে করায় ক্ষতিবৃদ্ধি দেখি না। কেহ বলে দ্বীপের, যাহা দ্বীপ তাহা দেশ, ট্যুরিষ্ট ব্যুরোর প্রচার, কেহ বলে বেনিফিকো ক্যাস্টিগোলিনোর ক্যারিবকাব্য আন্দোলন, বলে ইহা সবই জন জোয়াকিম ফ্রেডা এবং সেই মাত্র।” জটিলতার প্রশ্নে যদি তুলনা করা চলে তবে ফ্রাইডে আইল্যান্ড হয়তো কমলকুমার মজুমদারের গোলাপ সুন্দরী পর্যন্ত হতে পারে। না, তুলনায় প্রশ্নটি ভাষা নিরীক্ষার সাজুয্যের প্রশ্নে নয় এবং উল্লেখ্য অমিয়ভূষণের পরবর্তী আর কোন উপন্যাস এ ধারায় রচিত হয় নি। পরবর্তীকালে শুধুমাত্র চাঁদবেনেতে তৎসম শব্দের প্রাচুর্যমণ্ডিত যে ভাষাটি তিনি তৈরি করেন সেটি হাজার বছর আগের সমাজচিত্রকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনে। যেমনটি আমরা লক্ষ করেছিলাম শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন (১৯৮৪) উপন্যাসে। লক্ষণ সেনের যে বাংলাদেশ তার পটভূমিতে এ কাহিনী নির্মাণ করতে গিয়ে শওকত আলীকে তৎসমবহুল একটি ভাষা ব্যবহার করতে হয়েছে। ভাষা প্রশ্নে অমিয়ভূষণ অন্য আরও যে কারণে উল্লেখ পান তা হলো আঞ্চলিকতা। গড় শ্রীখণ্ড থেকেই চরিত্রদের মুখের ভাষায় আঞ্চলিক রূপ দিতে তিনি দ্বিধা করেন নি, যদিও গড় শ্রীখণ্ড-তে সেটি পুরোপুরি প্রযুক্ত হয় নি। যে কোন বাংলাভাষী পাঠকের বোধ্যতার সীমানা মনে রেখেই তিনি সেখানে আঞ্চলিক ভাষা দিয়েছেন। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে তাঁর এ বিবেচনা যদিও রামী রজনিকীতে গৃহিত হয় না। সে-উপন্যাসে চরিত্রের মুখের ভাষার প্রতি তিনি অধিকতর সন্বিষ্ট।
অমিয়ভূষণের উপন্যাস নিয়ে মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আর একটি কথা হলো মহাকাব্যিক গড় শ্রীখণ্ড প্রকাশের পরও তিনি সমাদৃত হন নি। সময় লেগেছে। ১৯৭০ এর দশকেও তাঁকে নিয়ে আলোচনা খুব বেশি নজরে পড়ে না। তবে পরের দুই দশকে তাঁকে নিয়ে, তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে কম আলোচনা হয় নি। মানবমন ও সমাজের বিচিত্র অনালোকিত জগতই তাঁর আরোধ্য। বিশ্বসাহিত্যে সিরিয়াস ধারার একজন বুভুক্ষু পাঠক অমিয়ভূষণ মজুদার তাঁর মনন ও শৈলী দিয়ে সে সকল জগতকেই চিত্রায়িত করেছেন। গত পঞ্চাশ বছরের বাংলা উপন্যাসে তাঁর অমোঘ উপস্থিতি আমাদেরকে নিরন্তর প্রাগ্রসর করেছে।
২০০২ সালে প্রকাশিত লেখকের বই বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য-তে (ঐতিহ্য, ঢাকা) অন্তর্ভুক্ত।