সাহিত্যিক ও রাজনীতিক সুলেখা সান্যাল (১৯২৮-১৯৬২) আজ বিস্মৃতপ্রায় একটি নাম। অথচ চল্লিশের দশকের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল মানুষদের মুখে মুখে প্রচারিত। ফরিদপুর জেলার বর্ধিষ্ণু এক গ্রাম কোড়কদীর মেয়ে এই সুমহান লেখিকা। মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর সাহিত্য প্রচেষ্টা উপেক্ষণীয় নয়। কোড়কদী গ্রামে অবস্থান করে কৈশোরকালেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন যেমনভাবে পরবর্তীতে কোলকাতাতে চলে যাওয়ার পরও তার সে কার্যক্রম হ্রাস পায় নি। সুলেখা সান্যালের উপন্যাস ‘নবাঙ্কুর’ (১৩৬২ বঙ্গাব্দ)-এ তৎকালীন বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও তাতে বেড়ে ওঠা এক মেয়ের কাহিনী মর্মস্পর্শীভাবে বর্ণিত। আত্মজৈবনিক ‘নবাঙ্কুর’ ছাড়াও ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দেওয়াল পদ্ম’। পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘নবাঙ্কুর’ (২য় খণ্ড), ‘হৃদয়ের রং’ এবং ‘মুকুরের মুখ’। 1 তাঁর রচিত ত্রিশটি গল্পের সবগুলোই বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের ফসল যেগুলোতে চরিত্রেরাও সুলেখার নিজের ব্যথা-বেদনায় অংশীদারী। তাঁর নাম বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাস ও সমালোচনার গ্রন্থগুলোতে অনুপস্থিত থাকা হয়ত আমাদের মননের দারিদ্র্যকেই প্রকাশ করে।
১৯২৮ সালের ১৫ জুন সুলেখার জন্ম হয়। চট্টগ্রামের মাসির বাড়িতে কেটেছিল তাঁর শৈশব। সাত বছর বয়সে লেখাপড়া শুরু করলেও ১৯৪২ সালে চট্টগ্রামে বোমা বিস্ফোরণের পর নিজ গ্রামে ফিরে আসেন এবং ১৯৪৪-এ প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই এ পাস করে কোলকাতায় গিয়ে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউট-এ ভর্তি হন বিএ পড়ার জন্য। ১৯৪৮ সালে সুলেখা তাঁর পছন্দের এক রাজনৈতিক সহকর্মীকে বিয়ে করেন। তাঁদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে তরুণ সান্যাল লিখেছেন:
অবন্তী সান্যাল মহাশয়রা তিন ভাই, দুই বোন। অবন্তী সান্যাল সব থেকে বড়, তার পরে অজিত সান্যাল যিনি এক সময় বুলবুল চৌধুরীর নৃত্য সংস্থায় যুক্ত হয়ে বিদেশ ঘুরে এসেছেন এবং ছোট সুজিত সান্যাল বর্ধমান রাজ কলেজে আমার সহপাঠী ছিলেন। আর দুই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন সুলেখা সান্যাল এবং ছোট বোন সুজাতা। এই সুজাতা পরবর্তীকালে আমার সহপাঠী শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহিত হয়। 2
একটি বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে গ্রেফতার বরণের কারণে যথাসময়ে বিএ পরীক্ষা দিতে পারেন নি। জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি পরে বিএ পাস করেন। ১৯৫৭ সালে তাঁর শরীরে লিউকেমিয়া ধরা পরলে চিকিৎসার জন্য মস্কো পর্যন্তও গিয়েছিলেন। ফিরে আসেন হতাশ হয়ে। এবং তারপর থেকে সুলেখার নিয়ত প্রচেষ্টা সাহিত্য – সাহিত্যের ভেতরে নিজের মন্থিত যন্ত্রণার লিপি দিয়ে তিনি একটি অবলম্বন পেতে চেয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ৪ ডিসেম্বর সুলেখা সান্যাল মারা যান।
উপন্যাসের মত ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও সুলেখা সান্যাল সমান মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৩৬৩ বঙ্গাব্দে তাঁর একমাত্র ছোটগল্প সংকলন ‘সিঁদুরে মেঘ’ প্রকাশিত হয়। এ সংকলনটিতে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলোর মধ্যে শিরোনামের গল্পটি ছাড়াও রয়েছে ‘জীবনায়ন’, ‘জন্মাষ্টমী’, ‘ফল্লু’, ‘গাজন সন্ন্যাসী’, ‘ছোটমাসি’, ‘খেলনা’। এগুলো ব্যতিরেকেও তাঁর আরও তেইশটি গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৪০৭ বঙ্গাব্দে তাঁর কনিষ্ঠা ভগিনী সুজাতা সান্যাল (চট্টোপাধ্যায়) সুলেখা রচিত ১৮টি গল্পের একটি সংকলন ‘সুলেখা সান্যালের গল্পসংগ্রহ’ নামে প্রকাশ করেন।
‘নবাঙ্কুর’ সুলেখা সান্যালের ছাব্বিশ বছর বয়সের ফসল। পরবর্তীকালে উপন্যাসটির দু’টি সংস্করণও বাজারে এসেছিল এবং সুলেখা সান্যালের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক দুভার্গ্যরে মতই বাংলা উপন্যাসের পাঠকের দুর্ভাগ্য এই যে উপন্যাসটির উল্লেখ এতদ্সংক্রান্ত কোন আলোচনা-ইতিহাস গ্রন্থে স্থান পায় নি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘পরিকথা’ লিটল ম্যাগাজিনের (সম্পাদনা: দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়) মে ২০০০ সংখ্যা ‘বিংশ শতাব্দির সমাজ বিবর্তন: বাংলা উপন্যাস’ বিষয়ে যে বত্রিশটি উপন্যাসের আলোচনা হয়েছে তাতে ‘নবাঙ্কুর’-এর অন্তর্ভুক্তির কারণেই অনেক সমালোচক নড়েচড়ে বসেন। ফেব্রুয়ারি ২০০১-এ শ্যামলী গুপ্তের সম্পাদনায় ‘শতবর্ষের কৃতী বঙ্গনারী’তে সুলেখা সান্যালের নাম অন্তর্ভুক্তি আর একটি অগ্রসরণ তবে একই বছরে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ Nabankur : The Seedling’s Tale এবং সে ইংরেজি সংস্করণের উপর আলোচনা আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে নারীবাদী উপন্যাস হিসাবে গ্রন্থটির অবস্থান কোথায়।
‘নবাঙ্কুর’ একজন নারীর হয়ে ওঠার কথা। একজন কেন্দ্রিয় চরিত্রের হয়ে ওঠার যে কাহিনী ইংরেজি সাহিত্যে The Way of All Flesh (Samuel Butler : ১৯০২), Sons and Lovers (D.H. Lawrence : ১৯১৩) ev A Portrait of the Artist as a Young Man (James Joyce : ১৯১৬) প্রভৃতি কালজয়ী উপন্যাসে ধৃত যা ‘Bildungsroman’ বলে প্রচলিত; যে ধারা বাংলাভাষায় বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৪-১৯৫০) ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) এবং ‘অপরাজিত’ (১৯৩১) ছাড়া একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হুমায়ুন আজাদের (১৯৪৮-২০০৪) ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ (১৯৯৫) এবং উপর্যুক্ত সবকটি উপন্যাসই যা একজন পুরুষের হয়ে ওঠা। সে সবেরই বিপরীত নবাঙ্কুর একজন নারীর হয়ে ওঠা – যে ধারার সাম্প্রতিক সংযোজন তসলিমা নাসরিনের (জন্ম ১৯৬২) ‘আমার মেয়েবেলা’ (১৯৯৯)।
ভারতের ‘দি হিন্দু’ পত্রিকা উপন্যাসটির ইংরেজি সংস্করণের আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছে:
Cast in the mould of a feminist bildungsroman, Sanyal traces the tale of Chhobi (literally, “Picture”), a gusty and hardy little girl who grows up to defy the conventions of a patriarchal family order in Bengal during the last, frantic decades of India’s anti-colonial struggle. Born and educated in Bangladesh in her early life, Sanyal herself received her political education from her brother and his friends who were involved in revolutionary terrorist activities against the British, and her sympathies are clearly identified in Chhobi’s tomboyish enthusiasm for the undercover work the young men around her risk their lives for in their patriotic fervor. Sanyal had been a member of the Communist Party in her college days in Calcutta (where she came after partition), and this, her first novel, is imbued with her fledgling political views about freedom, space and choice. Somewhere along the way – perhaps almost unconsciously for the author, and certainly not consciously for her protagonist, these ideas that hung like dewdrops in the nationalist air outside entered Chhobi’s very being, condensed into dreams of personal freedom, and crystallised into rebellion, of the sort that we would label today as feminist. As with all causes Chhobi in the single-minded pursuit of hers, struggles and bleeds, of course, but emerges hopeful. She is a significant signifier in an arid landscape of female oppression as she finally boards the train that will take her from her village to Calcutta, a sequence in which one may identify all the landmark tropes for modernity, advancement, and the quest for personal freedom denied to young rural women of her time. This “picture” – the final freeze, as it were – blushes with hope and promise, both romantic and political, aspiring toward emancipation at multiple levels of living and being, espying fulfillment. 3
‘নবাঙ্কুর’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ছবি – ছবির কৈশোরের প্রারম্ভিক সময় থেকে যৌবনের দ্বারে পৌঁছানোর সময়কাল উপন্যাসটিতে বিধৃত। ছবির পূর্বপুরুষ নীলকুঠির মালিক আর বর্তমান পুরুষ সেই লুপ্ত ঐতিহ্যের ধারক নিুমধ্যবিত্ত একটি পরিবার। স্বদেশী আন্দোলনের কালে যখন ছবি আট-নয় বছরের মেয়ে তখনই তার বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ – ঠাকুরদাদার কথা প্রত্যাখান কেননা ঠাকুরদাদা অন্যায়ভাবে এক গরীব জেলেকে চটি দিয়ে প্রহার করেছে। পাঠশালার ছবির তখনকারই স্বপ্ন অনেক লেখাপড়া করবে আর সাহসী হবে যখন কিনা তার সমবয়সী পাঠশালার মেয়েরা বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়। অন্য মেয়েরা যখন নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছবি তখন বাড়ির ছেলেদের মত করেই সব কিছু পেতে চায়। ছবির এই যে পড়াশোনার আগ্রহ, অধিকারগত চেতনা সেখানে কি কারো প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল? অপ্রকাশিতভাবে তার মা মমতার চৈতন্য ছবিতে প্রবাহিত এটি অনস্বীকার্য।
এরপর গ্রামের ছবি চলে গেল শহরে বড় পিসিমা সুকুমারীর সাথে। মা-মেয়ে পরস্পরকে ছেড়ে থাকার বেদনা স্বীকার করে নেয় শুধুমাত্র একটি কারণেই তা হলো পিসিমার ওখানে সে স্কুলে পড়বে, পাস করবে, কলেজে পড়বে আর বড় হবে অধীরকাকার হতো। শৈশবে স্বদেশী অধীরকাকা ছিল ছবির স্বপ্নের মানুষ, আরও বড় হয়ে তিনিই ছবির দীক্ষাগুরু – অনুপ্রেরক। শহরে যাওয়ার আগেই কিন্তু ছবি বুঝে গিয়েছিল সমাজে নারীর অবস্থান – কালো বিচ্ছিরি বিন্তিপিসির বিয়ে না হওয়ার যন্ত্রণা, রায়বাড়ির বাঁধা পুরোহিত ভট্টাচার্য্যি ঠাকুরের ভাগ্নি পিতা-মাতাহীন মায়াদির কষ্ট, অধীরকাকার বোন শ্বশুরবাড়ি ফেরত লতু পিসিমা শ্বশুরবাড়ি ফেরত সব কিছু মিলেমিশে ছবিকে এসব কিছুর বাইরে যাওয়ারই চেতনায় পৌঁছেছে। ছবির লৈঙ্গিক এই বিদ্রোহের মাটিতে পলি জমিয়েছে শহরে অবস্থানকালে তার রাজনৈতিক বোধ। ইংরেজ তাড়াতে সারা বাংলা জুড়ে যে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ততদিনে তাতে তো অংশীদার ছবিদের দিদিমনি সুধাদিও। সে আলোতে ছবিও ক্রমাগত উদ্ভাসিত। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ভিন্ন কত অনুষঙ্গ যা ক্রমাগতই ছবিকে আরও বেশি অভিজ্ঞ করে তোলে। গরিব নিলু-পিলুদের দুঃসহ জীবনযাত্রা, খ্রিস্টান অসীম-মিনুর মায়ের উৎকণ্ঠা, ঘুটে কুড়ানী মেয়ে মুসলমান পরীবানুর ক্লাসে ফাস্ট হওয়া সত্ত্বে না করা ইত্যাকার সব ব্যাপারগুলো ক্রমশ নতুন নতুন মানস-চেতনায় ছবিকে নিয়ে যেতে থাকে। তারপরও ছবির জীবন ‘রূপকথার গল্প নয়, সত্যি সত্যি গল্প’ যে প্রেক্ষাপটেই ছবির একদিন আবিষ্কার ‘সে বড় হয়েছে’; তার কৈশোর আচ্ছন্ন করে রেখেছে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ।
এরই মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল – বোমা পড়ার আতঙ্কে শহরবাসী সবাই শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করলো, যারা পালালো না তারা মিলিটারী এসে মেয়ে ধরে নিয়ে যাবে এই ভয়ে পালাতে বাধ্য হলো। তেমনি এক সময়ে যখন মাত্র দু’বছর পর ছবির ম্যাট্টিকুলেশন পরীক্ষা। ছবিও ফিরতে বাধ্য হলো তার নিজ গ্রামে। যেয়ে দেখল তার স্বপ্নের অধিরকাকা স্বদেশী করার দায়ে পাঁচ বছর জেল খাটার পর কৃষক সমিতি করতে গিয়ে যক্ষ্মায় আক্রান্ত। সেই প্রিয় মানুষটিই তো ছবিকে বলে, ‘মরবার আগে অন্তত একটা মেয়েকে দেখে যেতে পারি, যে ভয় পায় না, মুখ থুবড়ে পড়ে না যন্ত্রণায়’। হ্যাঁ ছবিই সেই মেয়েই হয়েছে যে ভয় পায় নি, মুখ থুবড়েও পড়ে নি। আর তাই আমার ছবির পড়াশোনা শুরু স্কুল শিক্ষক সুখদাকাকার কাছে। কিন্তু ইতিমধ্যে গ্রামবাংলার ঘরে হানা দিচ্ছে দুর্ভিক্ষ: সানুনাসিক স্বরে চতুর্দিকে চিৎকার ‘চাড্ডি দেও গো, ফেন দেও মা’। সে সবের মোকাবেলায় অন্যসব ছেলেদের সাতে ‘কখন দিশেহারার মতো বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছে ছবি’। পরিবার ও সমাজ থেকে দু’টি ব্যপারেই এসেছে প্রবল বিরোধ, পড়াশোনা আর সমাজ-কল্যাণ দু’টোই তো শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য। কেননা ‘জ্ঞান হবার পর থেকে সে শুনেছে সে ছেলে নয়, মানুষও নয় – সে মেয়ে। মেয়েদের জোরে কথা বলতে নেই, হাসতে নেই, পড়তে নেই। আশা নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই।’ ইন্টানেটে ‘Women on Women’ শিরোনামের এক লেখায় তাই বলা হয়েছে:
The novel notes a number of points in her life when Chobi worries her mother because, even as a young girl, Chobi refused sexual difference, asking for the same share of food the boys get, refusing to cry when beaten for such aduacity, expecting not to be inferior to anyone. Sanyal makes sure we don’t see Chobi as a female man by marking her share of “maternal” traits (she is, for example, her little brother Prodip’s great comforter). Sanyal also keeps the women of the house (grandmother, aunt, mother) ambivalent about Chobi, sometimes responding almost viciously to her failure to practice compliance and deference, sometimes more proud of her than of the sons sometimes tenderly agonizes over the possible dire consequences of her unconventionality, sometimes defensive or protective of her. Chobi’s sister Sefu weeps enough over having to replace Chobi in the proposed marriage, but lacks the strength to turn her tears into Chobi’s refusal. I take this balancing act by Sanyal as a way of posing Chobi and her family’s women on the very edge of a tidal shift that was beginning to bring more and more Indian women some unfamiliar alternatives – India gages – to the prison-like gender roles one often finds in fiction. 4
ছবি কিন্তু মেয়ে হয়ে থাকে নি, এমনকি ছেলেও হয় নি বরং বলা যায় মানুষ হয়েছে। মানুষের স্বাধীন চিত্ততার জয়গান গেয়েছে সকল প্রতিরোধের মুখেও। আর তাই পাত্রপক্ষ দেখতে এল তীব্র প্রতিবাদে সে – আয়োজন নস্যাৎ করে সে। বেত্রাঘাত খেয়ে, গৃহবন্দী থেকেও সে একনিষ্ঠ থেকেছে তার ভালবাসার কাছে। ‘ভালবাসাই আসল। সেখানে জাত নেই, ধর্ম নেই, কুমারী-বিধবার প্রশ্ন নেই’ – অধীরকাকার এ বাণী ছবির প্রধান পাথেয়।
ঔপন্যাসিক সুলেখা সান্যালের কৃতিত্ব বর্ধিত হয় যখন পাঠক আবিষ্কার করেন ছবির এই মানুষ হয়ে ওঠার কাহিনী লেখিকা স্থাপন করেছেন একটি রাজনৈতিক ঐতিহাসিক চেতনা সমৃদ্ধ সময়ে। স্বদেশী আন্দোলনে সময় থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং তেভাগা আন্দোলনের মতো ঘটনাসমূহ নবাঙ্কুর এ ঝিলিক দিয়ে ওঠে বারবার এবং পাঠক-চৈতন্যে লেখিকার রাজনৈতিকবোধ ক্রমাগত আছড়ে পড়তে থাকে। ‘নবাঙ্কুর’-এর আলোচনা করতে গিয়ে বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য বলেছেন:
উপন্যাসের আর একটি বৈশিষ্ট্যও পাঠকের চোখে পড়ে। নায়িকা ছবির বয়সের বিভিন্ন পর্বে ক্রমাগত তার দেখার চোখ পাল্টায়। সুচনা পর্বে যখন সে বেশ ছোট, তখন সে কল্পনার জগতে, রূপকথার জগতে বাস করে। সব কিছুতেই বিশ্বাস করতে তার ইচ্ছে হয়। … এই সব সরলতা ছবিকে প্রথম থেকেই স্বাভাবিক করে রাখে। পাশাপাশি তার চোখ-কান সব সময়ই খোলা। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বয়স তখনও তার হয় নি, কিন্তু সেই বয়সেই অনেক ব্যাপারে তার মনে খটকা লাগে। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রধান লক্ষণ হল নারীদের পরস্পরের প্রতি মমতা এবং সহানুভূতি। ছবির ক্ষেত্রে তার সূচনা নিজের মাকে দিয়ে। শহরের শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে গ্রামীণ জমিদারদের কঠোর রক্ষণশীল অন্তঃপুরে এসে সমস্ত নিজস্বতা হারিয়েছেন। অনেক বলা-কওয়ার পর মেয়েকে তিনি মাঝে মাঝে কবিতা শোনানোর সাহস দেখাতেন, কিন্তু গান জানা সত্ত্বেও গাইবার সাহস দেখাতে পারেননি। ছবির তখনই জানা হয়ে যায়, বউদের নাকি গান গাইতে নেই। 5
বঙ্গীয় অঞ্চলে নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়াও (১৮৮০-১৯৩২) ছিলেন ঔপন্যাসিক। বিদ্রোহী অনেক কর্মকাণ্ডের সাথে, নারীবাদী প্রবন্ধ-নিবন্ধের সাথে তাঁর উপন্যাস প্রচেষ্টা ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৪) স্মরণীয়। মধ্যবর্তীকালে আমরা আরও যেসব সাহিত্যিক পেয়েছি তাঁদের মধ্যে শৈলবালা ঘোষজায়া (১৮৯৪-১৯৭৪) বিশেষ মনোযোগ এজন্য দাবী করতে পারেন যে তাঁর উপন্যাসে নারীর বিদ্রোহ না থাকলেও অন্তত নারী নির্যাতন সুচিহ্নিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তাঁর উপন্যাসে জন্ম-অপরাধী উল্লেখযোগ্য। তবে মানুষ হওয়ার চেতনায় নারীর বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ বোধ করি সুলেখা সান্যালের ‘নবাঙ্কুর’ উপন্যাসেই লক্ষিত হয়। তসলিমা নাসরিনের আমার মেয়েবেলা বা আকিমুন রহমানের ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’তে (১৯৯৯) নারী তার ব্যক্তিগত যৌন অভিজ্ঞতায়ও চিত্রিত, অর্ধশতাব্দী পূর্বে রচিত ‘নবাঙ্কুর’-এর সুলেখা সান্যাল সে চিত্রণ এড়িয়ে গেলেও তাঁর ছবির বিদ্রোহ একালের যে কোন বাঙালিকে উৎসুক করবে সন্দেহ নেই।
বিষয়গত প্রশ্নে ‘নবাঙ্কুর’-এর অনস্বীকার্য যদিও সংহতি বিবেচনায় ‘দেওয়াল পদ্ম’ অনেকের কাছেই বেশি মর্যাদার দাবিদার। ‘দেওয়াল পদ্ম’ অসীমা-সঞ্জয়ের কথা। শুরুতে প্রায় শত্রুভাবাপন্ন এমন দুজন মানুষকে সুলেখা সান্যাল তাঁর উপন্যাসে কাছাকাছি এনেছেন সুকৌশলে, পাঠকের মনে কোন দ্বিধা-সংকোচ সৃষ্টি না করে। না হলে মননের প্রশ্নে এ দুজন মানুষের নৈকট্য এমন অবশ্যম্ভাবী হবেই বা কেন! অথচ বিস্ময়ের যে সঞ্জয় হল অসীমার মৃত ছোট বোন অণিমার স্বামী।
শুরুতে গোয়েন্দা কাহিনীর ছাপ যেন। মধ্যপ্রদেশে হাসপাতালের ডাক্তার অসীমা তার মার পত্রে অনুরোধ পেল বাড়ি ফেরার পথে মৃত অণিমার শিশু সন্তান দুটিকে দেখে যাওয়ার। অণিমার বাবা-মা-দাদারা সবাই এমন বিশ্বাসে স্থির যে অণিমার শ্বশুর বাড়ির মানুষেরা তাকে হত্যা করেছে বা তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। তাদের ভাবনা দৃঢ়তর হয়েছে কেননা দাদারা ওদের বাড়িতে গেলে যথেষ্ট সমাদর পায় নি। এ সব প্রেক্ষিতেই অসীমাকে বৃদ্ধা মাতার অনুরোধ: পারলে যে সে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে যায়, না নিতে পারলে অসীমার কাছ থেকে তো ওদের সম্পর্কে কিছু জানা-শোনা যাবে।
এমন একটি আবর্তের ভেতর দেওয়াল পদ্ম-র কাহিনী শুরু। এবং অসীমার সে বাড়িতে পৌঁছানো পর্যন্ত অণিমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের রূঢ়তাই বেশি স্পষ্ট। যদিও ক্রমে পর্দা সরতে থাকলে বোঝা যায় সে-পরিবারটি আসলে মাটি-ঘেঁষা-মাটির সাথে জীবন-যাপনই তাদের নিমিত্ত যা পরিবারটি সবকটি মানুষকে যুগপৎ সরলতা এবং ঔদার্য দিয়েছে। পারিবারিক এ পরিচয়টি সঞ্জয়ের মা-বাবা-ছোটভাই বিজয় সবার ভেতর দিয়েই ক্রমশ প্রকাশিত। এবং সামগ্রিক এ প্রতিবেশ অসীমার নিজের দুয়ারটি খুলতে ভূমিকা রাখে ভীষণ – উন্মোচিত হয় অশোকের সাথে তার ব্যর্থতার কথা যার পরিণতিতে পঁয়ত্রিশ বছরেও সিঁদুরবিহীন অসীমা।
অসীমা-অশোক ডাক্তারী পড়ার কাল থেকে বন্ধু। পড়া শেষ হতেই অশোককে ওর বাবা পাঠিয়ে দিল বিলেত – অসীমা রয়ে গেল দেশে। বছর পার হতেই ও নিজে জাহাজে চাপল। বিলেতে নেমে আবিষ্কার করল অন্যমস্ক এক অশোককে। ফ্লাটে যেয়ে পেল ওর গার্লফেন্ড লরাকে। আর এভাবেই শেষ হয়ে গেল অসীমা-অশোক সম্পর্ক। কষ্ট করে ফিরে যখন এল, অসীমা ততদিনে বিয়ে হেয়ে গেছে। অসীমার এ গল্পের ভেতর সুলেখা সান্যালের আত্মজৈবনিক উপাদান হয়তো কেউ কেউ খুঁজবেন, তবে উপন্যাসটিতে এ আখ্যানের গুরুত্ব অনেক। অসীমার এ কাহিনী তার ব্যক্তিগত মর্যাদাবোধকে যেমন সমুন্নত করেছে, তেমনি সঞ্জয়-অণিমার কাহিনী উন্মোচনেও সহায়ক ভূমিকা পালক করেছে।
অসীমার বোন অণিমা ছিল ভারি সুন্দর। কম লেখাপড়া জানা, একটু অহঙ্কারী, একটু একটু ঝগড়াটে আর স্বার্থপর। ‘অণিমা তার রূপের দাম পেয়েছিল’। সঞ্জয়ের বাবা তাকে দেখেই পছন্দ করে, তারপর সঞ্জয়ের সাথে বিয়ে হয় ওর। ভালাবাসা হল, দুটি সন্তানও হল, কিন্তু যা হল না তা হল সঞ্জয়দের মানসিকতার সাথে একাত্মতা। তার ধারণা ওরা অণিমাকে ঠকিয়েছে – পাঁচশো বিঘে জমির ফার্মে ডায়নামো বসিয়ে ইলেকট্রিসিটি আনবে, ট্রাকটর চালাবে ইত্যাদি বলে। আর এবাবেই ক্রমশঃ অণিমার মন ভাঙতে থাকত দ্রুত। তেমনি এক সময় পূর্ব্ববঙ্গের কলেজ বন্ধু সমীর ওদের বাড়ি। সমীর এখন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ করছে। এত বেশি ঘনিষ্ঠ হল সে যে আসাটা ঘটল বার কয়েক। তারপর সবশেষে একবার অণিমা-সঞ্জয় দুজনে মিলে সমীরকে সাথে নিয়ে বেড়াতে গেল শহরে। একদিন সমীর অণিমা বাইরে যেয়ে আর ফিরে এল না। উদভ্রান্ত সঞ্জয় নিজ সন্তান টুকু-সোনার প্রিয় বাবা হয়ে নিজেকে যোগ্যতর করে তুলল সঞ্জয়। মানুষ জানল ও বাড়ির বৌ অণিমা আত্মহত্যা করেছে।
উপন্যাস শেষ হয়েছে প্রতীকী এক ব্যঞ্জনা দিয়ে। প্রথম দিন বিকেলেই সঞ্জয় অসীমাকে নিয়ে গিয়েছিল গ্রামের প্রাচীন মন্দিরটিতে যার গায়ে হয়েছে দেওয়াল পদ্ম। বিদায়কালে দেখা গেল সঞ্জয় অসীমার জন্য নিয়ে এসেছে ঐ পদ্মের এক শিকড়-সুতো। যদিও লোকে বলে এ পদ্ম নাকি যেখানে সেখানে হয় না তবু সঞ্জয়ের ইচ্ছা অণিমা চেষ্টা করে দেখুক। কিন্তু বাসটা ছাড়লে দেখা গেল শেকড়টা হারিয়ে গেছে, আলগা একটু মাটি মাত্র রয়ে গেছে অসীমার হাতে। যে শিকড় অণিমা হারিয়ে গেছে, সেই শেকড়ের মাটি সঞ্জয় বা তার পরিবারকে আঁকড়ে থাকার যে কোন অর্থই হয় না লেখিকা হয়তো তেমনটিই বোঝাতে চেয়েছেন। ‘দেওয়াল-পদ্ম’-র প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিয়ে পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন:
সঞ্জয় সেই যে শেকড়, দেওয়াল পদ্মের শেকড় হাতে দেয় অসীমার – ঝড়ের অন্ধকারে সঞ্জয় আর নটবর নিয়ে এসেছে। সব জায়গায় এ ফুল হয় না – দেখাই যাক না পরীক্ষা করে। অসীমা কান্নাকে সামলায়। কিন্তু শেকড়টাই কই – আসনে কেবল তলার মাটিটুকু। মাটিটা বোধ হয় শেকড়ের সঙ্গেই মেশেনি। মাটিটা অসীমা হাতে তুলে নিল, তারপর বাইরে ফেলে দিল – ও ফুল তো যেখানে-সেখানে ফোটে না। আঙুলের মাটির দাগটা লেগেই রইল, তারপর সেটাও মিলিয়ে গেল। আমাদের তো ঐ মাটিকে শেকড়ের সঙ্গে লাগাতেই হবে – নচেৎ মরবে গ্রাম, বাঁচবে না শহরতলী, শহর। অসীমা বাসের চলন্ত গতিতে ফিরছে – এ কি আগেকার অসীমা! 6
‘দেওয়াল পদ্ম’ নিয়ে আলোচনা শেষ করার আগে উপন্যাসটির আত্মজৈবনিক উপাদান বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। অসীমা-অশোক উপাখ্যানের সাথে সুলেখা সান্যালের ব্যক্তিজীবনের এক অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ১৯৪৮ সালে বিশ বছর বয়সে সুলেখা বিয়ে করেছিলেন রাজনৈতিক সহকর্মী, বড়দার বন্ধু চিত্ত বিশ্বাসকে। কলকাতায় সংসার গড়েছিলেন তাঁরা, সন্তানও হয়েছিল; যদিও ভুমিষ্ট হয়েছিল মৃত সন্তান। অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণেই তাঁরা তাঁদের বাসার বাইরের অংশটা ভাড়া দিয়েছিলেন পরিচয় পত্রিকার অফিসের জন্য। তখন পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন বাংলা সাহিত্যের আর একজন শক্তিমান কিন্তু বিস্মৃত কথাকার ননী ভৌমিক (১৯২১-১৯৯৬)।
চিত্তবাবুর সাথে জীবন মেলাতে সুলেখা বোধ হয় বিপন্ন বোধ করছিলেন যা একসময় বৌদ্ধিকভাবে কাছাকাছি ননী ভৌমিকের দিকে সুলেখাকে ঠেলে দেয়। গল্পগ্রন্থ ‘ধানকানা’ (১৯৫৬) এবং উপন্যাস ‘ধুলোমাটি’ (১৯৫৬) খ্যাত ননী ভৌমিক মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের চাকরি নিয়ে চলে যান ১৯৫৫ সালে। একই বছর চিত্ত বাবুর সাথে সুলেখা সান্যালের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৫৭ তে তাঁর শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়লে ১৯৫৮-র জুনে সুলেখা মস্কো যান চিকিৎসার জন্য। সেখানে ননী ভৌমিক তাঁকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যান এবং পরে ননী ভৌমিকের ফ্লাটে রূপবতী কারমেলার সাক্ষাৎ ঘটে। এ সবের পরিণতিতেই আহত সুলেখা দেশে ফিরে আসেন ১৯৫৯-র মার্চে।
মাত্র দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন অকাল প্রয়াত এই লেখিকা। অথচ দুটিতেই তাঁর দার্ঢ্য সুস্পষ্ট। ব্যক্তিজীবনের উপাদানকে উপন্যাসের প্লট করতে সংকোচ করেন নি তিনি। রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণেই সুলেখা সান্যালের কথাসাহিত্য গভীর জীবনবোধের শিল্পিত পরিচায়ক হতে পেরেছে। পূর্বসূরি বা সমসাময়িক অধিকাংশ মহিলা কথাকারের মত তাঁর রচনা ঘরকন্যার বিবরণে পরিণত হয় নি।
এবার আসছি সুলেখা সান্যালের ছোটগল্প প্রসঙ্গে। একমাত্র সংকলন ‘সিঁদুরে মেঘ’-এ অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলো ছাড়াও তার যে সব গল্পের সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলো হলো: ‘অন্তরায়’, ‘কীট’, ‘সংঘাত’, ‘বিবর্তন’, ‘ছেলেটা’, ‘একটি মামুলি গল্প’, ‘উলুখড়’,‘কিশোরী’, ‘পরস্পর’, ‘খোলাচিঠি’, ‘শকথেরাপী’। এছাড়া পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা তাঁর অন্যান্য গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘পঙ্কতিলক’, ‘মামণি’, ‘পাষণ্ড’, ‘প্রতীক’, ‘যে গল্পের শেষ নেই’, ‘শেষ সন্ধ্যা’, ‘ঘেন্না’, ‘লজ্জাহর’,‘ফাটল’, ‘রূপ’, ‘ভাঙাঘরের কাব্য’ ইত্যাদি। ১৯৬৪ সালে তাঁর ‘সিঁদুরে মেঘ’ গল্পটির চলচ্চিত্রায়ণ হয়। তাঁর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য বাস্তব ঘনিষ্ঠতা। প্রতিটি গল্পেই জীবনের সন্বিষ্ট চিত্রকে সুলেখা ভাসা দিতে চেয়েছেন। চল্লিশ-পঞ্চাশের যে ঝঞ্চাক্ষুব্ধ সময় তা সুলেখার গল্পাবলীতে মূর্ত। সুজাতা সান্যালের ভাবনা:
সুলেখা সান্যালের ছোটগল্পগুলিকে আমরা তিনটি পর্বে ভাগ করতে পারি। প্রথম পর্ব ‘সিঁদুরে মেঘ’ এবং অন্যান্য গল্প – যেগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে দাঙ্গা, দেশভাগ ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত সৃষ্টি। দ্বিতীয় পর্বে আমরা রাখতে পারি তাঁর ব্যক্তিগতজীবনের একান্ত যন্ত্রণাদগ্ধ কাহিনীর প্রতিচ্ছবির গল্পগুলি। তৃতীয় পর্বে একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্র, যা লেখিকার বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা প্রকাশ করে। 7
তাঁর অনেক গল্পের মূল প্রতিপাদ্য দেশবিভাগ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ধর্ম ভিত্তিতে যে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের জন্ম হয়েছিল তার ফলশ্র“তিতে কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এমন লাখ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী চলে যান ভারতে। রাজনীতির কারণে হঠাৎ করে এমন নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষ বারবারই কঠিন বাস্তবতায় সুলেখার গল্পে উপস্থিত। নিজের ব্যক্তি জীবনে আরও বহু জনের মত সুলেখা সান্যাল নিজেও যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তা তাঁর এক বিরাট সংখ্যক গল্পের প্রধান উপজীব্য।
‘ফল্গু’, ‘জন্মাষ্টমী’, ‘গাজন-সন্ন্যাসী’ গল্পগুলো দেশ বিভাগ নিয়ে রচিত সুলেখার প্রধান রচনা। ‘অন্তরায়’ ও ‘বিবর্তন’ যার বিষয়বস্তুও একই – নির্মম দেশবিভাগ ও উদ্বাস্তু জীবন। মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা বাঙালির জীবনে এ ঘটনার অভিঘাত ছিল সুদূর প্রসারী। ‘ফল্গু’তে তাই দেখা যায় মহেশ্বরীকে যে কিনা অবিনাশের পিসিমা। কোলকাতা থেকে বেড়াতে আসা অবিনাশের স্ত্রী বরুণা যখন মহেশ্বরীর কাছে কোলকাতা চলে যাওয়ার প্রসঙ্গ তোলে তখন তার এক কথা ‘ন’ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় গিয়েছিলাম – আর চৌদ্দ বছরে মেয়ে কোলে বিধবা হয়ে ফিরে এসেছিলাম এ বাড়িতে – এই আমার জীবনের জাগয়া বদল। কোথায় যাব! এখানকার মাটি আঁকড়ে থাকবো শেষ দিন পর্যন্ত।’ অসহায় বৃদ্ধার মর্মবিদায়ক ও গভীর অভিপ্রায় ‘ফল্গু’কে সজীবতা দিয়েছে। অথচ এ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে হিন্দু-মুসলমান নৈকট্যের ব্যাপারটিও লেখিকার দৃষ্টি এড়ায় নি। মতি যে মুসলমান তাই ও চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশযোগ্য নয়। সে-মতিকে অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে আসে বরুনা। বরুনা সকল জাতের মানুষ নিয়ে পিকনিক করে, গল্প করে, একসাথে খায়। বরুনার সকল কর্মকাণ্ড বুড়ির কাছে উপস্থিত ‘জাত বিচার না – হিন্দু মুসলমান না, দেশ ভাগাভাগি না’ এই গভীর সত্য নিয়ে। ‘জন্মাষ্টমী’ এবং ‘গাজন-সন্ন্যাসী’র পশুপতি তো তেভাগার বিক্ষত সৈনিক। ফরিদপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এ গল্পের পশুপতি যখন জেলে যায় তখন তার বাবা কাশীনাথই পুত্রবধু ও নাতিকে নিয়ে হয়েছিল দেশান্তরী। দেশছাড়া ঘরছাড়া এ মানুষগুলো সম্পর্কে কাশীনাথের বিবরণ ‘সাতজন মরিছে আমাশায়। জমি যেতি দেশে গরমেন্ট যে, সে তো জমি না পাথর। জল নাই এ দেশে, ফসল তুমি ফলাবা কেমন করে। একখান করে মাটির খুপরি, তারে দুই ভাগ করে দু’টো পরিবার থাকতি হবি।’ এই যে নির্মমতা তাতেই এক সময় এসে হাজির হয় পশুপতি। সে আবার মানুষ খ্যাপারে এমন আশঙ্কা তার স্ত্রী মানদা প্রকাশ করলে পশুপতির ক্ষুব্ধ ও মর্মন্তুত উত্তর ‘আদালত আমাগারে ছাড়েৎ দেছে কোন প্রমাণ না পায়ে, নিজের দ্যাশের থে শত্রুতা করে বার করে দেশে। তুইও কি তাড়ায়ে দিতি চাস আমারে’!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিধ্বস্ত কোলকাতার চিত্রও প্রাণস্পর্শীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সুলেখা সান্যালের কয়েকটি গল্পে। ‘সিঁদুরে মেঘ’ এ বিষয়ে রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রধান গল্পগুলোর অন্যতম। অনন্ত এবং মালতীর দাম্পত্য জীবনকে নিয়ে গড়া এ গল্পে সে সময় কালের সর্বস্বশূন্য কোলকাতাবাসীর চিত্রই ফুটে উঠেছে। অনন্ত বা মালতী কেউই একটি সুখী দাম্পত্যে পৌঁছতে পারে না তাদের অ-প্রকাশিত অতীতের জন্য – যদিও তারা জানে না তাদের পরস্পরের এ অতীত। দুঃসময়ের কালে মালতীকেও যে এক সাহেবের অফিসে চাকরি নিতে হয়েছিল তা নিয়ে মালতীর অনুশোচনার শেষ নেই। পেটের দাবির কাছে নিরুপায় মালতীকে সে সময় আরও অনেক মধ্যবিত্ত মেয়ের মতই ত্যাগ করতে হয়েছে সকল সম্ভ্রম, অন্যদিকে অনন্তও তো বোঝে নি নিজের স্ত্রীকেই তুলে দিতে হবে সাহেবদের হাতে যার পরিণতিতেই স্ত্রী ললিতা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। ওরা দুজনেই তো এমন সময়ের সন্তান যখন হাসপাতাল উঠে গিয়ে মিলিটারী ব্যারাক হয়েছে আর সৈন্যদের সাথে ঘুরে বেড়ানো মেয়েরা ছেঁড়া জুতোর মত পরিত্যক্ত। আর তাই তো শেষে স্বামীর ভাবনা ‘আমরা দুজনেই ঘরপোড়া গোরু, তাই তো সিঁদুরে মেঘ দেখে মুখ শুকোয়’।
দুঃসহ অর্থনীতির এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুলেখার অন্যান্য গল্পগুলো হলো: ‘জীবনায়ন’,‘খেলনা’, ‘বিবর্তন’ প্রভৃতি। মধ্যবিত্তের সামাজিক অবস্থার এ করুণ চিত্র সুলেখা সান্যালের এক জীবন্ত সৃষ্টি। সে এক এমন সময় যখন সীমা-আনন্দ তাদের সম্ভাব্য সন্তানের আগমনের সংবাদে কি খেয়ে বাঁচবে এই চিন্তাতে এম আর পর্যন্ত ভেবে ফেলে (জীবনায়ন), অথবা সামান্য অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নেই বলে নমিতা আর প্রবীর পরস্পরকে ভালবাসার পাও দাম্পত্যে পৌঁছাতে পারল না (খেলনা), অথবা অভয় তার অসুস্থ স্ত্রী কনিকার জন্য আলো-বাতাস ভরা একটা বাসা ভাড়া নেয় যার ভাড়া তার নিজ আয়ের সমান এবং সেখানে খাওয়ার জন্য আর কোন টাকা উদ্বৃত্ত নেই (বিবর্তন)।
সুলেখা সান্যালে গল্প নিয়ে বর্তমান আলোচনাটি শেষ করতে চাই তাঁর ‘উলুখড়’ দিয়ে। ১৯৬৭ তে পত্রিকায় প্রকাশিত এ গল্পটি এ পর্যন্ত তাঁর সকল গল্পের মধ্যে দীর্ঘতম – সাধারণ বইয়ের পৃষ্ঠায় সাইত্রিশ পৃষ্ঠা। কথক ব্রজেন এ গল্পের প্রধান চরিত্র না হলেও তারও রয়েছে এক বিশেষ গুরুত্ব। প্রধান যারা চরিত্র তারা হলো দেবাশিষ আর অনুপমা। শশাঙ্কর স্ত্রী অনুপমা আর দেবাশিষ কলেজ পড়াকালে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো দেবাশিষ বিলেত থেকে ফিরতেই অনুপমার সাথে তার বিয়ে হবে। আর সেই আশ্বাসমতই শশাঙ্কের সংসার ছেড়ে স্বপ্নের জগতে পা ফেললো অনুপমা। তার এই কাজের জন্য তার পরিবার তাকে করলো ত্যাগ। অনুপমা হয়ে পড়লো একাকী, নিঃসঙ্গ। চাকরিও গেল তার। হতাশ ক্লান্ত অনুপমা আক্রান্ত হলো জটিল রোগে। কিন্তু প্রত্যাশা পুরণ ঘটে নি। কেননা দেবাশিস তো ইতোমধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অন্য এক মেম মেয়েকে নিয়ে। রোগ শোকের চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুপমা অন্ধ হয়ে যায় পুরোপুরি। কিন্তু তার মৃত্যুর পূর্বে দেবাশিস্ আসার ব্যাপারে তার প্রত্যাশার মিথ্যা পুরণ ব্রজেন ঘটিয়েছেন। বিদেশ ফেরত একজনকে দেবাশিস্ হিসাবে উপস্থাপন করেছিল অনুপমার সামনে। ‘উলুখড়’ মানুষের মিথ্যে ও সত্যি ভালবাসার গল্প। সুলেখা সান্যালের ব্যক্তিগত জীবনে স্পর্শও ‘উলুখড়’ গল্পে দুর্লক্ষ্য নয়।
সবশেষে সুলেখা সান্যালের শেষ জীবন নিয়ে তাঁর অনুজা সুজাতা সান্যালের (চট্টোপাধ্যায়) বক্তব্য উদ্ধার করছি। তিনি লিখেছেন:
১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি যেন জীবনকে ছেনে ছেনে নতুন নতুন মূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। জীবনের কাছ থেকে পাওয়া তিক্ততা বিশ্বাসহীনতা, নিঃসঙ্গতা তাঁকে ঠেলে দিয়েছে অদ্ভুত এক নৈর্ব্যক্তিক শূন্যতাবোধের মধ্যে। এই সময় আমরা তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলি পাই। নারীজীবনে ব্যর্থতা, সবকিছু পাবার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও না পাবার যন্ত্রণা, অবসিত যৌবনের হতাশা, রোগের দুঃসহ ক্লেশ – সবকিছু রেখে গেছেন তাঁর এই সময়ের লেখার মধ্যে। 8
গভীর পাঠে স্পষ্ট হয় নারী কথাসাহিত্যিক হিসেবে সুলেখা বেছে নিয়েছিলেন একটি ভিন্ন জগত। সমসাময়িক পুরুষ কথাকারদের তুলনাতেও তাঁর কলম অগ্রণী ছিল এমনটি বললে ভুল বলা হয় না।
প্রবন্ধটির প্রথম খসড়া ‘বিস্মৃত নারীবাদী উপন্যাস নবাঙ্কুর’ প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক সংবাদ’ সাময়িকীতে ১৫ জুন ২০০৪ তারিখে।
টীকা:
- সুজাতা সান্যাল (চট্টোপাধ্যায়) রচিত ‘বড়দিদি সুলেখা সান্যালের জীবনী’, ‘সুলেখা সান্যালের গল্পসংগ্রহ’, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ। ↩
- তরুণ সান্যাল, ‘জীবনের চেয়ে বড় যে জীবন’, ‘কথারূপ’, সম্পা. গৌতম অধিকারী, কলকাতা, ডিসেম্বর ২০০২, পৃ. ১০। ↩
- www.hinduonnet.com/thehindu/1r/2002/06/02 ↩
- www.2.cddc.vt.edu/mtm/sis.htm ↩
- বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য, ‘নবাঙ্কুর: নিজের হয়ে ওঠার উপন্যাস’, ‘কথারূপ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০-২১ ↩
- পার্থপ্রতীম বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘দেওয়াল-পদ্ম: দ্বিমাত্রিক সংলাপ’, ‘কথারূপ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭ ↩
- সুজাতা সান্যাল (চট্টোপাধ্যায়), ‘বিষাদিত আনন্দ’, ‘কথারূপ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭-৭৮ ↩
- সুজাতা সান্যাল (চট্টোপাধ্যায়) রচিত ‘বড়দিদি সুলেখা সান্যালের জীবনী’, প্রাগুক্ত ↩