সাবিত্রী রায় (১৯১৮-১৯৮৫) শরিয়তপুরের লেখিকা। আটটি উপন্যাস লিখেছিলেন: যার মধ্যে প্রথম দু’টিকে বাদ দিলে বাকি সব ক’টিকে সহজেই শিল্পমান উত্তীর্ণ বলবেন যে কোন কড়া সমালোচকও। দুটি উপন্যাস পাকা ধানের গান (১ম পর্ব ১৯৫৬, ২য় পর্ব ১৯৫৭, ৩য় পর্ব ১৯৫৮) এবং মেঘনা-পদ্মা (১ম পর্ব ১৯৫৬, ২য় পর্ব ১৯৬৪, ৩য় পর্ব ১৯৬৫) আয়তনের বিশালতা ছাড়াও অন্তত এদের প্রথমটি মহাকাব্যিক উপন্যাস অভিধাও পেয়েছিল সমকালীন খ্যাতিমান লেখকদের কাছ থেকেও। তৃতীয় উপন্যাস স্বরলিপিও (১৯৫২) আলোড়ন তুলেছিল বিবিধ কারণেই। কিন্তু বাংলাভাষী পাঠকের দুর্ভাগ্য এই, বাংলা উপন্যাসের কোন ইতিহাস বা সমালোচনার গ্রন্থে সাবিত্রী রায় নামটি কোনভাবেই উল্লিখিত হয় নি। পূর্বসূরি এবং সমকালীন অন্য অধিকাংশ নারী কথাশিল্পী যখন পারিবারিক উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত তখন এ লেখিকা জীবনকে দেখেছেন অনেক বেশি বাস্তবতার নিরিখে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী এবং অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি এবং উপন্যাসের কাঠামোয় সেগুলো প্রকাশের ক্ষমতায় তিনি সমকালীন পুরুষ কথাসাহিত্যিকদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন – এমন অভিমত দিলে অতিরঞ্জন হবে না। সমকালীন বাংলার যে চিত্র – যাতে রাজনীতির প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য – তাই হয়েছে সাবিত্রী রায়ের অধিকাংশ উপন্যাসের উপজীব্য। পারিবারিক ও সামাজিক চিত্রপটে, বাঙালির চিরকালীন মনস্কতার আধারে সাবিত্রী রায় এঁকেছেন রাজনৈতিক বাঙালিকে – যে বাঙালি নারী বা পুরুষ নয়, যে বাঙালি অধিকারের প্রতিষ্ঠায় আপ্রাণ। লেখিকার প্রধান দু’টি উপন্যাস স্বরলিপি এবং পাকা ধানের গান-এর প্রেক্ষিতে বর্তমান প্রবন্ধে এসকল বিবেচনাকে বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা হবে।
সাবিত্রী রায় রাজনৈতিক পরিবারের মানুষ। বাবা নলিনীরঞ্জন সেন এবং মা সরযূবালা দু’জনেরই উত্তরাধিকার ছিল গর্ব করার মত। তাছাড়াও বাল্যেই সাবিত্রী সান্নিধ্য পেয়েছিলেন পিসিমা অম্বিকা দেবীর – সামাজিক এবং শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে যাঁরা ছিল সার্বক্ষণিক তদারকি। তাছাড়া পরিবারটির সাথে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশ আন্দোলনের কর্মীদের ছিল আন্তরিক যোগাযোগ। সাবিত্রী প্রথম থেকেই ছিলেন রাজনীতি-সচেতন। শৈশবে সাহিত্যচর্চা বলতে ছিল কবিতা লেখার প্রচেষ্টা; সেগুলোতে স্বাদেশিকতার সে মনোভাব ছিল স্পষ্ট। প্রচলিত বিশ্বাস ও নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে সাবিত্রী রায়ের অবস্থান ছিল সর্বদাই দৃঢ়। এসবেরই চূড়ান্ত হিসাবে ১৯৪১ সালে সাবিত্রী রায় কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হন।
সাবিত্রী রায়ের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় অনুবাদকর্মের মাধ্যমে। তার আগে কবিতা লেখার ছোট্ট একটি ইতিহাস আছে। ১৯৩১ সালে বড়ভাই দেবপ্রসাদ সেনের জন্য পুলিশ বাড়ি তল্লাস করার সময় তাঁর কবিতার খাতাটি নিয়ে যায়; যা আর কখনো তিনি ফেরত পাননি। প্রথম অনুবাদ গল্প ‘চোখের জল ফেলো না মারিয়ানা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অরণি পত্রিকায়। সাংস্কৃতিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে স্বীকৃত সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৯১-১৯৫৪) সম্পাদিত এ পত্রিকাতেই কিছুদিন পর ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪-এ প্রকাশিত হয় সাবিত্রী রায়ের প্রথম মৌলিক গল্প ‘ধারাবাহিক’। একই বছরে অরণিতে তাঁর আরো যেসকল গল্প প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে ‘মাটির মানুষ’ ‘নূতন কিছু নয়’, ‘সাময়িকী’ ‘ওরা সব পারে’ ইত্যাদি। উপর্যুক্ত গল্পগুলোর সঙ্গে অন্যান্য আরো গল্প যেমন ‘রাধারাণী’ (১৯৪৫), ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ (১৯৫৬), ‘সমঝদার’ (১৩৫৭), ‘হাসিনা’ (১৯৪৭), ‘প্যারামবুলেটার’ (১৯৪৮), ‘অন্তঃসলিলা’ (১৯৪৯) নিয়ে ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় সাবিত্রী রায়ের একমাত্র গল্পসংকলন নতুন কিছু নয়। ‘১৯৪৩-এর আকালে যারা প্রাণ হারালো তাঁদের স্মরণে’ উৎসর্গীকৃত এ গল্পগ্রন্থটি ছাড়াও উপন্যাস-বহির্ভূত তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে শিশুপাঠ্য লেখার খেলা (১৯৫৫?), কিশোরপাঠ্য হলদে ঝোরা (১৩৭৯) এবং নীলচিঠির ঝাঁপি (১৯৮০)।
১৯৩৮ সালে বিএ ও পরে বিটি পাশ করার পর ১৯৪০ সালে অধ্যাপক শান্তিময় রায়ের সাথে অসবর্ণ বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে স্বামী জেলে যাওয়ার এবং সন্তানের লালন-পালনের সমস্যা হওয়ার সাবিত্রী রায় তাঁর পেশা শিক্ষকতা থেকে সরে আসলেও তাঁর মন যে শিশুশিক্ষা ও শিশু লালন-পালনের ব্যাপার নিয়ে প্রশ্নিল ছিল তার প্রমাণ উপরে উল্লিখিত শেষোক্ত তিনটি গ্রন্থ। এসময় পেশা হিসেবে লেখাকে গ্রহণ করার প্রসঙ্গে তাঁর কন্যা গার্গী রায় (চক্রবর্তী) জানান,
একসময় মার মনে দ্বিধা আসে, – লিখে তো রোজগারের পথ নেই। সে হল পঞ্চাশ দশকের কথা। মুসৌরিতে মার আলাপ হয় বিশিষ্ট হিন্দী কথাসাহিত্যিক উপেন্দ্রনাথ আসখের সঙ্গে। লেখাকে পেশা করবার জন্য তিনিই মাকে উৎসাহিত করেন। উনি মার লেখিকা-সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। চাকরি করতে না পারার কুণ্ঠা এরপর অনেকাংশে কেটে গেল। তবে লেখিকা সত্তার সঙ্গে গৃহিণী-সত্তা মাতৃ-সত্তার দ্বন্দ্ব মাকে লাগাতার পীড়িত করেছে। সাংসারিক কাজের অফুরন্ত দায়িত্বের ফাঁকে ফাঁকে মা সময় বার করে নিতেন লেখার জন্য। মেঝেতে মাদুর পেতে বা তক্তপোষের উপর জলচৌকি ধরনের ছোট ডেক্সের ওপর ওর অধিকাংশ লেখা। লেখার জন্য মানসিক পরিবেশ তৈরি করতে টেপরেকর্ডে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চালিয়ে মা কাগজ নিয়ে বসতেন। 1
অরণিতে ছোটগল্প প্রকাশের কালেই সাবিত্রী রায় উপন্যাস রচনায় হাত দেন। প্রথম উপন্যাস সৃজন প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে (শ্রাবণ ১৩৫১)। ২৮০ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি সাবিত্রী উৎসর্গ করেছিলে পিসীমা, মা ও বাবা-কে; অর্থাৎ লেখিকার জীবনে পিসীমা যে কতখানি প্রভাব ফেলেছিলেন তার স্বীকৃতি মেলে লেখিকার এ উৎসর্গ থেকে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বিশ্বজিৎ। দীর্ঘ রাজনীতির সাক্ষী সে। উপন্যাসের সময়কালে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীরা সহিংস আন্দোলন ছেড়ে সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকছে। দরিদ্র ঘরের সন্তান দুখু দত্তক পুত্র হয়ে বড়লোকের বাড়িতে এসে হয়েছিল বিশ্বজিৎ। কিন্তু আপন চেহারায় সে বিকশিত হল যখন সন্ত্রাসবাদী স্বদেশীর সংস্পর্শে সে আসে। আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কারাগার থেকে যখন সে মুক্তি পায় তখন সে অন্য মানুষ – নতুন দীক্ষায় আলোকিত। প্রথম উপন্যাস সৃজন-এই লেখিকার একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্ট। ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন তাঁর উপন্যাসের একটি প্রধান অনুষঙ্গ, কিন্তু আন্দোলনের ভেতরের দ্বন্দ্বগুলো নিয়েও তিনি ছিলেন সচেতন। নিজের রচনায় সে-সচেতনতার প্রকাশও তিনি ঘটিয়েছিলেন। সচেতন সে মানসিকতার কারণে তৃতীয় ও চতুর্থ উপন্যাসদ্বয় স্বরলিপি ও পাকা ধানের গান প্রকাশের পর কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল; যে নির্দেশকে অমান্য করায় তাঁর উপন্যাসদ্বয় নিষিদ্ধ করে পার্টি এবং দৃঢ়চেতা সাবিত্রী নিজেই পার্টির সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেন। সাবিত্রী রায় বিস্মৃত হবার পেছনে এসকল কার্যকারণও ক্রিয়াশীল ছিল মনে করতে খুব বেশি বিভ্রান্তি হবার কথা নয়।
সহিংস সন্ত্রাসবাদ থেকে সাম্যবাদে দীক্ষাগ্রহণের এমন আরও একটি উপন্যাসের সন্ধান আমরা পরবর্তীকালে পেয়েছি। ননী ভৌমিক (১৯২১-১৯৯৬) রচিত ধুলোমাটি (১৯৫৬) নামের সে উপন্যাসটি তুলনামূলকভাবে বেশি সংহত হলে সৃজনকেও লেখিকার প্রথম প্রয়াস হিসেবে শ্রমসাধ্য বলতে দ্বিধা করা উচিত নয়। তাছাড়া ধুলোমাটি সৃজন-এর দশ বছর পরের রচনা – সে বিষয়টিকেও বিবেচনায় রাখতে হয়। সৃজন সম্পর্কে আনন্দবাজার লিখেছিল:
‘বিদেশীর কারাগৃহে আবদ্ধ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহের ঘৃণ্য দলাদলি ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ, দাদাদের দল রাখার আপ্রাণ প্রয়াস ও দলগত কুৎসা-প্রচার যা কারান্তরালে ও বিদ্বেষের বহ্নিশিখা জ্বালিয়া সমস্ত আবহাওয়াকে বিষাক্ত করিয়া আনিয়াছিল, সে সব দুঃখের কাহিনী গ্রন্থকর্তী সুনিপুণ বিশ্লেষণে লোকলোচনের সমক্ষে ধরিয়াছেন।’
ঔপন্যাসিক সময়কালীন যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তাঁকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সৃজনসহ তাঁর অন্যান্য সকল উপন্যাসেই চিত্রিত করেছেন। অধ্যাপক ভোলানাথ ঘোষ অশনি পত্রিকায় সৃজন নিয়ে যে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন তার অংশবিশেষ এমন:
গোড়াতে একটা কথা স্বীকার করতে বাধ্য যে বাস্তব জীবনের পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে লেখিকা অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। একটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ধারাবাহিক ইতিহাস গল্পের সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। … লেখিকার প্রত্যক্ষ অনুভূতি প্রবল। … সমগ্র উপন্যাসটি পড়লে মনে হয় একটি সত্য কাহিনীকে যেন লেখিকা উপন্যাসে রূপান্তরিত করেছেন। … কেউ কেউ করবেন যে প্রায় সব চরিত্রগুলি মধ্যবিত্তের চরিত্র মাত্র। এমনকি মজুরেরাও তাঁর উপন্যাসে মধ্যবিত্ত মনোবৃত্তি নিয়ে চলাফেরা করছে। … মোটের উপর প্রথম রচিত হিসাবে আধুনিক ও আধুনিক লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে লেখিকাও আসন দাবী করতে পারেন।
সৃজন-এর দুর্বলতাকে ভোলানাথ ঘোষ যেমন চিহ্নিত করেছেন তেমনি অসহিষ্ণু সমালোচকের সম্ভাব্য সমালোচনায় উত্তরও তিনি আগে থেকেই প্রস্তুত করেছেন। অভ্যুদয় পত্রিকায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ও উৎসাহসূচক মন্তব্য করে বলেছিলেন ‘ভাষার এই স্বাভাবিকতায় লেখিকার বৈশিষ্ট্য, হয়তো মনে হবে বাংলা উপন্যাসে নৈর্ব্যক্তিকতার সার্থক সূচনা এই বইয়েতে পাওয়া যায়’। সাবিত্রী রায়ের উপন্যাসকে ক্রম অনুযায়ী পাঠ করলে বোঝা যায় চেনা সমাজ ও চেনা মানুষের ছবি সৃজন ও দ্বিতীয় উপন্যাস ত্রিসোতাকে যে সহজতায় তিনি এঁকেছেন স্বরলিপি হয়ে পাকা ধানের গান পর্যন্ত তার রূপ অপরিবর্তিত থাকেনি। ক্রমান্বয়ে তিনি শিল্পসচেতন হয়ে উঠেছেন, এবং তাঁর লেখিকা সত্তায় সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী চেতনা দার্ঢ্য লাভ করেছে। ত্রিসোতা প্রকাশ পায় ১৯৫০ সালে। এর দ্বিতীয় সংস্করণটি এসেছে ১৯৫৪-তে। দ্বিতীয় সংস্করণে ‘প্রকাশকের কথা’ অংশটি ১৯৬১-তে প্রকাশিত দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ থেকে বাদ দেয়া হয়। ঔপন্যাসিক হিসেবে সাবিত্রী রায়ের কৃতিত্ব ত্রিসোতা পর্যন্ত প্রশ্নাতীত না হলেও প্রগতি সাহিত্যের একজন কলাকার হিসাবে তাঁর সাহিত্যপ্রচেষ্টা যে যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল তা ‘প্রকাশকের কথা’ অংশে স্পষ্ট। এতে আছে:
নির্জিত শ্রেণীবিভক্তসমাজে প্রগতিসাহিত্যের ভূমিকা হল প্রতিবাদের। তাকে হতে হবে বিপ্লবের হাতিয়ার। তার দৃষ্টিভঙ্গী হবে জনগণের। এখানে লেখকবাহিনীর কাজ হবে ধনিক সমাজের ক্রূর, নিষ্ঠুর অত্যাচার ও ছলনার কথা পরিষ্কার করে সবাইকে বুঝিয়ে দেয়া – যেন জনসাধারণ সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রেরণা পেতে পারে তা থেকে। জনগণের সংগ্রামের অকুণ্ঠ প্রশংসাই থাকবে এতে।…
রাজনীতির বিচারে যে সব সাহিত্যিক নিজেদের শ্রেণীচ্যূত, জাতিভ্রষ্ট মনে করে শ্রমিকশ্রেণীরই দর্শনকে জীবনাদর্শ বলে গ্রহণ করেছেন – তাঁদের গভীর প্রয়াস লক্ষ করা যায় নতুন শ্রেণী-সাহিত্য সৃষ্টির জন্য। লেখিকার বর্তমান উপন্যাসটিকেও এই পর্যায়ে ফেলা চলে অকুণ্ঠ চিত্তে। এমনি একজন মধ্যবিত্তের চোখ দিয়ে দেখা সমগ্র জাতির জীবনচাঞ্চল্য! গ্রাম্য পরিবেশ থেকে শহরের জনারণ্যে সর্বত্রই আশ্রয়চ্যুত মধ্যবিত্ত মনের ছোঁয়াচ। এ মধ্যবিত্ত মন নিজের খোলস ছড়িয়ে বের হয়েছে অনন্ত যাত্রার পথে। উদ্বেগ, বিভ্রান্তি আর সমস্যা-সংশয় জড়িত সে পথ। আর তার পাশেই চলেছে দিগ¦লয় রেখায় কাতার দিয়ে বলিষ্ঠ মানুষের দল – শোষিত সর্বহারার মিছিল – উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যগ্র ব্যাকুল। দুঃখে আসে তাদের জীবনে – কিন্তু মুহ্যমান করে বিবশ করে দিতে পারে না সে দুঃখ। কর্ম প্রেরণায় এগিয়ে যায় তারা। তাঁদেরই দলে যে মিশতে হবে তাকেও।
সেই অবিনাশী প্রাণশক্তির শিকড়ের সন্ধান যে লেখিকা খুঁজে পেয়েছেন তা নিঃসন্দেহ। আর কিছু না হোক, গণসাহিত্য সৃষ্টির সযত্ন প্রচেষ্টা এর প্রতিছত্রে সুপরিস্ফুট। 2
দীর্ঘ এ উদ্বৃতির অপ্রত্যক্ষ কারণ হল এটি সুষ্পষ্ট করা যে সাবিত্রী রায় ততদিনে গণসাহিত্যের লেখক হয়েছেন। অথচ মর্মান্তিক এই যে সেই জনগণের প্রাণ যে পার্টি তাই তাঁর স্বাধীনতা হরণ করতে মরিয়া হয়ে গিয়েছিল। ত্রিসোতাতে 3 সাবিত্রী রায়ের আত্মজৈবনিক উপাদানের উপস্থিতি খুব বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য। উপন্যাসের রূপসী গ্রামকে ব্যক্তি সাবিত্রীর বাল্যজীবনের উপসী গ্রাম হিসেবে সনাক্ত করতে সচেতন পাঠকের অসুবিধা হবার কথা নয়। এমনকি সেখানে রয়েছে রথীন্দ্র মাস্টার (প্রয়াত সাহিত্যসেবক রবীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী) এবং আরও অনেক চেনা মুখ যাঁদেরকে ব্যক্তি সাবিত্রী রায়ের জীবনের চারপাশে আমরা দেখি। উপন্যাসের অন্য চরিত্র কুসুমলতাকে সাবিত্রী রায়ের পিসিমা অম্বিকা দেবী হিসেবে চিনে নিতে কষ্ট হয় না।
ত্রিসোতা শুরু হয়েছে চরকা কাটার সময়। সাথে সাথে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যুবকদের ঘনিষ্ঠতা লক্ষ করা যায়। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মত গ্রামীণ জীবনের অনুপুঙ্খ বিবরণ ত্রিসোতা-রও বিশাল জায়গা দখল করে আছে। আর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পদ্মার সাথে লেখিকার সাজুয্যও দুর্লক্ষ নয়। নিজ পরিবার এবং সমাজকে প্রেক্ষাপট বানিয়ে লেখিকা তাঁর এ উপন্যাসের নির্মিতি দিয়েছেন। পদ্মা শুধু উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র নয়, বিদ্রোহী চরিত্রও বটে। ঘটনার ক্রমপ্রসারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত এ উপন্যাসে তীব্রভাবে অনুভূত। দুর্ভিক্ষের তীব্র ছোবলে রক্তাক্ত বাঙালি সমাজের কমবেশি চিত্র এ উপন্যাসে পাওয়া যায়। বাঙালি সাধারণ নারীর যৌন নিরাপত্তাহীন সে সময় বড় ক্রুর। নারীর সম্ভ্রমের মূল্যহীনতার এমন মর্মন্তুদ চিত্র বুঝি শুধুমাত্র সুলেখা স্যানালের (১৯১৮-১৯৬২) ‘সিদূরে মেঘ’ 4 (১৩৫৯) গল্পেই পাওয়া যায়। ‘সিদূরে মেঘ’ গল্পের অনন্ত আর মালতী দুজনেই তো ঘরে পোড়া গরু। বাংলার সর্বকালের বিধ্বংসী দুর্ভিক্ষে মালতী যেমন তার সম্ভ্রমকে রক্ষা করতে পারেনি, তেমিন অনন্তও প্ররোচিত হয়েছিল তার মৃত স্ত্রী ললিতার শরীরকে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে। ত্রিসোতার মদনতো বিলাতী সাহেবের মন গলিয়ে দু’পয়সা বেশি কামাই করতে যে কারও গৃহস্থ বধূর যৌবনকে কালিমাময় করতে রাজী। আর ক্ষুধা! সে তো নিত্যসঙ্গী সে কালেও বাঙালি সাধারণ মানুষের। ধারণা করা যায় সাবিত্রী রায়ের উপন্যাসসকলের মধ্যে ত্রিসোতাতেই দুর্ভিক্ষের চিত্র সবচেয়ে বেশি মাত্রায় উপস্থিত:
মুসলমান পাড়ার মেয়েরা আসিয়া শাক তুলিয়া লইয়া যায় আশ্রমের ভিটা হইতে। কানে আসে শিশুদের আর্তনাদ। চাউল আনছে তোর বাজানে?
– চাউল নাই আউজকা কয়দিন না? কচু সিদ্ধ চলছে দুই সন্ধ্যা। এক সন্ধ্যা গেছে মিষ্টি আলু-পোড়া দিয়া। আউজকা একমুঠা চাউল আনছে বাবুগো বাড়ির থন – জিভটা জুড়াইয়া আসে। আউস ধানের ফ্যানা ভাতের স্বপ্ন ক্ষুধায় স্তিমিত চোখগুলোতে।
ছোট ছোট একপাল ছেলেমেয়ে পিতলের বাটি রাখিয়া যায় রান্না ঘরের সামনে ফ্যানের প্রত্যাশায়। তারাসুন্দরী একজনের মত চাইল বেশি লয় রোজই। কিছু কিছু ভাত ও ফ্যান একসঙ্গে ঢালিয়া দেয় ঐ পিতলের ঘটিগুলিতে। কোন কোন দিন নিজের ভাতটুকুও দিয়া দেয়। বুকটা যেন স্তদ্ধ হইয়া গিয়াছে – কি ভীষণ দুর্দিন। ঘরে ঘরে অনাহারে মৃত্যু আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। এই হাড়গিলা শিশুগুলি টিকিয়া থাকিবে কি এই ফ্যানটুকুর জোরে। ঘটিতে ফ্যান ঢালিতে ঢালিতে ভাবে তারাসুন্দরী। 5
দুর্ভিক্ষের এ চিত্রের মতই তৎকালীন বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিক্রমায় ত্রিসোতার অগ্রসরণ। সেখানে দৃপ্ত পদক্ষেপে কর্মব্যস্ত কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মীবাহিনী, কিন্তু সাথে আছে ফরোয়ার্ড ব্লক ও সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের আগমনবার্তা। এসবের ভেতর দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি, ভারতের স্বাধীনতা লাভ। কিন্তু সে স্বাধীনতা যে সাধারণ মানুষের স্বাধীন হওয়ার ইঙ্গিত নয় তা-ও স্পষ্ট। কিন্তু তারপরও মানবজীবনতো আশারই প্রত্যাশায় স্থাপিত। আর সেজন্যেই হয়তো পদ্মা সকলকে হারিয়েও যখন মেয়েকে কোলে তুলে নেয় তখন ‘একফালি রোদ আসিয়া পড়িয়াছে রোয়াকে’। উপন্যাসটির আলোচনাশেষে একথা স্বীকার করতেই হয় ত্রিসোতা পর্যন্ত সাবিত্রী রায় বড় বেশি ঘটনার বিবরণকারী। সামগ্রিক সময়কাল ও সমাজজীবনকে ধারণ করতে তিনি মাঝে মাঝেই অপ্রত্যাশিত ও দৃষ্টিকটুভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেন যা উপন্যাসের সামগ্রিক সৌকর্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে পরবর্তী উপন্যাস স্বরলিপিতেই তিনি সে-দার্ঢ্য অনেকখানি অর্জন করেছিলেন কোন সন্দেহ নেই।
স্বরলিপির ‘লেখিকার কথা’য় সাবিত্রী রায় যে বলেছিলেন ‘এ উপন্যাসেরও আমার পূর্ববতী উপন্যাস দুইটির মতই, কোন চরিত্র মিথ্যা নয় – বাস্তবেরই ছায়া, আবার কোনও চরিত্রই সত্য নয় – কল্পনারই প্রতিছায়া মাত্র’ যাকে ঔপন্যাসিকের সাহিত্যাদর্শ হিসাবে ধরে নেয় চলে সহজেই। তাঁর উপন্যাস সকলের কাহিনী বুনন করেন তা তো অন্য যে কোন লেখকের মতই স্বতঃসিদ্ধ। স্বরলিপির কালসীমা ১৯৪৬-১৯৫১। অর্থাৎ বলা চলে ত্রিসোতার প্রায় শেষ দিকে এসে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরবতী তিন/চার বছর কাল পর্যন্ত এ উপন্যাস বিস্তৃত। প্রায় একই সময়কাল নিয়ে সাম্প্রতিককালেও আরও যে একটি কালজয়ী উপন্যাস আমরা পেয়েছি তা হলো খোয়াবনামা (১৯৯৬)। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) রচিত সে উপন্যাসও বাংলা অঞ্চলের সে সময়কার সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাত – যেমন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তেভাগা আন্দোলন, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদিকে যেমন আত্তীকরণ করেছে, সাবিত্রী রায়ও তা করেছেন তাঁর স্বরলিপিতে। ইলিয়াস পঞ্চাশ বছর পর, আর সাবিত্রী পঞ্চাশ বছর আগে। সাবিত্রী যে কাজটি করেছেন চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার আলোকে, ইলিয়াসকে তা করতে হয়েছে ইতিহাসের পঠনের ভেতর দিয়ে। আর সে কারণেই হয়তো ইলিয়াসের অনেক বিবরণ ইঙ্গিতবাহী, স্বপ্নমিশ্রিত, যেটি সাবিত্রীর ক্ষেত্রে সাদামাটা বিবরণেই ব্যক্ত। তবে ইলিয়াস ও সাবিত্রীর রচনাদ্বয়ের একটি চূড়ান্ত পার্থক্য এভাবে হয়তো চিহ্নিত করা চলে যে সাবিত্রীর সামগ্রিক প্রকাশ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাস্নাত, যেমনটি ইলিয়াসের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে ঘটে নি।
স্বরলিপির প্রকাশক লিখেছিলেন:
রাজনীতিকে প্রধান উপজীব্য করেও অনাবিল জীবনালেখ্য রচনা যে সম্ভব তারই জ্বলন্ত প্রমাণ পূর্বগামী সাহিত্যিক প্রচেষ্টা সৃজন ও ত্রিসোতা। বিপ্লবী বাস্তবতায় পরিপ্লুত ‘স্বরলিপি’ হল মুক্তিকামী, শান্তিপিপাসু ভারতীয় আত্মায় সংগ্রামী সাধনার অনুলেখ। জীবনকে বাদ দিয়ে সংগ্রাম নয় – তাই বৃহত্তর সংগ্রামের সাথে দেখি মিলিয়ে গেছে ব্যক্তিগত জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সংঘাত, দোলাচল চিত্ততা, প্রেম ও প্রয়োজনের শত সহস্র খুঁটিনাটি। ‘ত্রিস্রোতা’ ছিল বাংলা সাহিত্যেও এক অকর্ষিত পথের প্রথম পদ্রক্ষপ। ‘স্বরলিপি’ হল সেই পথের বলিষ্ঠ অভিযান। 6
স্বরলিপি শুরুই হয়েছে এক সমাবেশ দিয়ে। যেখানে মুহুর্মুহু স্লোগান ‘তেলেঙ্গনার পথ আমাদের পথ’। আর সামান্য পরেই সেখানে উপস্থিত দর্শকের মানসিক অভিব্যক্তি: ‘প্রতিহিংসাই। শুধু সাম্রারাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে নয়, এতদিনের ভুল পথ ধরা আপোসী সংস্কারবাদীদের বিরুদ্ধেও’ 7 এবং শেষ বক্তার কথা ‘এতকাল আমরা যা বলেছি, তা সবই ভুল। আজ থেকে যা বলছি, তাই একমাত্র ঠিক’ 8 থেকে বোঝা যায় সম্পূর্ণতই রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সাবিত্রী রায়ের অন্বিষ্ট। সাধারণভাবে রাজনৈতিক না বলে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল অর্থাৎ তৎকালীন ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির লোকজন এবং কর্মকাণ্ডকে ঘিরে স্বরলিপির আবর্তন। পার্টির কঠোর অনুশাসনের সেই চুড়ান্ত আদর্শকে লালন করে, সার্বক্ষণিক কম্যুনিস্ট পার্টিকর্মী সাবিত্রী রায়, সার্বক্ষণিক পার্টিকর্মী শান্তিময় রায়ের স্ত্রী সাবিত্রী রায় তাঁর দেখা অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। পার্টির ভেতরের লোকজনের ভাবনায় পার্টির কর্মকাণ্ডের সমালোচনাও বিপুল। আর সেকারণে পার্টির পক্ষ থেকে সাবিত্রী রায়কে মুখোমুখি করা হয় এক অগ্নিপরীক্ষার। এ প্রসঙ্গে সুজিৎ ঘোষের ভাষ্য হল:
কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির বিচ্যুতিগুলোকে তাত্ত্বিকরূপে না রেখে জীবন্ত প্রতীকে চিত্রিত করায়, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের মতো পার্টির কর্ণদারদেরও তিনি বিরাগভাজন হয়েছেন। ‘স্বরলিপি’ প্রকাশের পরে, পার্টির তরফে থেকে এই বই প্রত্যাহার প্রত্যক্ষ নির্দেশ তার প্রতি আসে। তিনি সে প্রস্তাবে সম্মত হন নি। ফলে বইটি পার্টি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তার অনমনীয়তায় পার্টির সদস্যপদ শেষ পর্যন্ত তিনি ত্যাগ করেন। ‘সৃজন’র ‘বিশ্বজিৎ’ এর মতোই আদর্শে আত্মনিবেদিত অথচ উদাসী লেখিকার স্বামীও পার্টি এবং লেখিকার মধ্যে এই সংঘাতে থেকেছেন উদাসীন, কিছুটা ইচ্ছাকৃত নিরপেক্ষ। হয়তো লেখিকার মনে সেকারণে ছিল অভিমান, কিন্তু পরবর্তীকালে তার যেন একলব্যের সাধনা – পাটির স্বীকৃতি বা সভ্য পদ প্রভৃতির প্রতি না তাকিয়েই তিনি একটা নিজের লক্ষ্যভেদের সাধনায় নিমগ্ন থেকেছেন। লিখে গেছেন পরবর্তী উপন্যাসগুলি একের পর এক। সে উপন্যাসগুলিতেও তিনি শ্রমজীবি-শোষিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, শোষণের বিপক্ষে এক শোষণ-নিপীড়নহীন মুনষত্ব্যের, সাম্যসমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। 9
কিন্তু স্বরলিপির বিশেষত্ব এই যে এ উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্র রাজনৈতিক মানুষ হলেও সর্বোপরি তারা মানবিক বোধে সিঞ্চিত। উপন্যাসের পৃথ্বী, রথী, শীতা, সুমিত্রা, মেনকা, সাগরী, ফল্গু, কুরী, আক্রাম খাঁ এরা সবাই জীবন্ত। অর্থাৎ সাবিত্রী রায় তাদের সর্বোপরি মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। রাজনীতি বা আদর্শের পুতুল হিসেবে নয়। এমনকি প্রয়োজনহীন বিবেচনা করে লেখিকা উপন্যাসের অনেক স্থানেই একটি রেখাতেই একটি চরিত্রকে মূল ঘটনাক্রমে প্রবিষ্ট করিয়ে দিয়েছেন। নমিতার স্কুলের বোর্ডিঙে সিপ্রা ও চন্দনার অনুপ্রবেশ 10 এমনই এক উদাহরণ।
উপন্যাসের মূল বিষয় রাজনীতি হওয়ার কারণে এমন কুড়ি কুড়ি চরিত্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছে খুব সহজেই। শিবশম্ভুবাবু, মহিমদা, স্বরাজ, সুন্দরপ্রকাশ, কুমারী, উর্মি, শুক্লা, মায়া, ছায়া, দেবজ্যোতি, মেনকা, বিনু, সুদর্শন, শীতাংশু, অরুণাংশু প্রমুখ চরিত্রের আবির্ভাব উপন্যাস শুরুর প্রথম থেকেই। উপন্যাসের শেষে গিয়ে বোঝা যায় চরিত্রের একটি দীর্ঘ তালিকা নিয়ে সাবিত্রী তাঁর গল্প বুনেছিলেন। এবং এদের অধিকাংশ পাত্র-পাত্রীই, অথবা তাদের সকলেই প্রকৃতপক্ষে একটি সামগ্রিক ও বৃহত্তর পরিম-ল নির্মাণে অংশগ্রহণকারী – কোন একটি বা একাধিক বিশেষ চরিত্রকে বিশেষভাবে রূপায়নে সাবিত্রী রায় মোটেই আগ্রহী নন।
স্বরলিপির মূল পরিক্রমা ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী তিন/চার বছরের সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক এবং বিশেষভাবে কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনীতি। স্পষ্ট কোন সময়কাল দিয়ে উপন্যাস শুরু না হলেও উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর আচরণ ও বক্তব্য দিয়ে বোঝা যায় সাবিত্রী সেকালটাকেই ধরতে চান যখন বাংলার মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা এমনকি পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী। পার্টি নেতৃত্বে তখন ধরে ঘুণ। উত্তাল সে সময়ে কম্যুনিস্ট পার্টির বিপ্লব অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতাই ছিল পার্টি নেতৃত্বের আমলা মানসিকতা ও দুর্নীতি পরায়ণতা। এবং ইতিহাস সচেতন সকলেই জানেন পার্টির অভ্যন্তরের ঐ কলুষের কারণেই পার্টির জন্য ভাল ফল বয়ে আনে নি। এবং বিশেষ মনোযোগের যে, সাবিত্রী রায় একজন নারীকর্মী হয়েও পার্টির ভেতরের এ ব্যর্থতাকে চিনতে এবং তার সাহিত্যিক রূপায়ণে ভুল করেননি।
উপন্যাসের প্রধান যারা পার্টিকর্মী তাদের মধ্যে পৃথ্বী অন্যতম। সাথে আছে রথী, সাগরী, শীতাংশু, অরুণাংশু, ফল্গু। এদের প্রত্যেকেই পার্টি-অন্ত-প্রাণ। আবার এরা সকলেই পার্টির নেতৃত্বের ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড ও আচরণ সম্পর্কেও সচেতন। পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরও 11 এরা প্রত্যেকে নিজ-নিজ কাজে আরও যেন বেশি করে নিমগ্ন। সহ্য করছে অমানুষিক পুলিশি যন্ত্রনা। অথচ নেতৃত্বে যারা সেই নন্দলাল বা তার বিশ্বস্ত সাগরেদ ব্যোমকেশ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত – শুধু তাই নয়, তাদের সে বিলাস পার্টির টাকায় – যে টাকা পার্টি ফান্ডে আসে কৃষক-মজুরদের এক টাকা/দু টাকা চান্দা থেকে। নন্দলালের মত একটি চরিত্রকে উপন্যাসে সমকালেই উপস্থাপন করা সাবিত্রী রায়ের জন্য ছিল এক দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ। পার্টিকর্মী রথীর স্ত্রী সাগরীকে নিজে বিয়ে করার জন্য নন্দলাল যেসব ফাঁদ পেতেছে, অথবা আরেক পার্টি কর্মী চিত্রকর অরুণাংশুকে দিয়ে পিয়নের কাজ করিয়ে নন্দলাল যে আচরণ করেছে তার চিত্রণ এ উপন্যাসে প্রীতিকর। এমনকি পার্টির ফান্ডের টাকা নিয়ে ব্যোমকেশের ক্রিয়াকলাপও যথেষ্ট মনোযোগ দাবী করে। অথচ যারাই এসব অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে তারাই হয়েছে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত। কুমার শংকরের মত একজন সৎ কর্মীকেও পার্টি অন্যায় দোষারোপ করতে দ্বিধা করে নি। যেমনটি ঘটেছে পৃথ্বীর ক্ষেত্রেও। শুধু কি বহিষ্কৃত! সাহিত্যিক পৃথ্বী হয়েছে একঘরে। অন্যসকল কর্মীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে পৃথ্বীর সাথে কোনরকম যোগাযোগ না রাখার জন্য। আর সে পরিক্রমাতেই বহিষ্কৃত হয়েছে রথী। আর নন্দলালের কূটচালে রথীর স্ত্রী পার্টিকর্মী সাগরীকে বলা হয়েছে রথীকে ত্যাগ করতে। ব্যক্তিগত সকল মানবিক বোধকে অস্বীকার করে পার্টি কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া অন্যায়গুলো নিরলস, সৎ, একনিষ্ঠ বহু পার্টিকর্মীকে একসময় হতাশ ও ব্যর্থ মনোবল করেছিল এমনটি বুঝতে বাকি থাকে না। আর তাই সাগরী, অরুণাংশু উভয়েই চলে যায় কৃষক এলাকায়। ফল্গুর উপরও এসেছে অন্যায় ফরমান। অথচ পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি কৃষকদের মধ্যে আন্দোলনকালে, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় এর ব্যাপকতা রোধে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া উদ্বাস্তুদের অধিকার আদায়ে পার্টির এই বহিষ্কৃত কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি আন্তরিক।
স্বরলিপির এসব চরিত্ররা কিন্তু শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গেরই বাসিন্দা নয়। তাদের বিরাট অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেরও নাগরিক। পদ্মা-মেঘনা বিধৌত বাংলার এ অঞ্চলও উপন্যাসটিতে যথেষ্ট পূর্ণাঙ্গতায় উপস্থাপিত। কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেও উভয় বাংলাই প্রাসঙ্গিক হয়েছে। হাজং বিদ্রোহের সংবাদ তো এ উপন্যাসে রীতিমত উদ্দীপক তথ্য। হাজং বিদ্রোহের অনেক দূরে অবস্থান করেও উপন্যাসের চরিত্রদের সাবিত্রী রায় এ ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করেন সহজেই। শীতার বাসায় মিঠুর ছোটমাদের ফেলে যাওয়া কাগজেই তো আমরা প্রথম পড়ি:
গুলি চলেছে চাষী কন্যার বুকে। দুধের শিশু ঢলে পড়েছে হাজং বধূর কোলে। বুকের দুধটুকু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো, জন্মের মত শেষ হল তার স্তন্য খাওয়া। স্তন্যপায়ী শিশুর বুকে গুলি ছুড়তে দ্বিধা করে নি সাম্রাজ্যবাদের অনুচরেরা। 12
মিঠুর ছোট মা-ই তো পার্বর্তী এবং মনিকাকা হল কমরেড নিখিলেশ। দুজনেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্মী। এই পার্বতীই তো ইতিহাসখ্যাত কর্মী ইলা মিত্র; যার বিবরণ আমরা পাই:
সারাদিন ঘুরছে পৃথ্বী মামুদপুর মামলার আসামীদের জন্য টাকা সংগ্রহ করতে। দশ হাজার টাকা তুলে দিতে হবে তিন দিনের মধ্যে। পাকিস্তান থেকে আত্মগোপন করে পালিয়ে এসেছে নিখিলেশ এ টাকা সংগ্রহ করতে। একটা ডিফেন্স কমিটিও গঠন করতে হবে।
পার্বতীসহ সতের জন কৃষকের বিরুদ্ধে মামুদপুর থানার দারোগা হত্যার মামলা চলছে। …
সমস্ত কাজের ভিতরে পৃথ্বীর মাথায় ঘুরছে পার্বতীর জবানবন্দী। আজই পত্রিকায় বেরিয়েছে তার উপর অকথ্য অত্যাচারের বিবরণ। গলিত অগ্নিস্রোতের মত প্রতিহিংসার লাভাস্রোত ধাবিত হচ্ছে পৃথ্বীর অস্তিত্বের শিরা উপশিরায়।
শীতের রাতে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে লোহার পেরেক ঢুকিয়েছে সর্বাঙ্গে।…
জীবনে ভুলতে পারবে না মানুষ সর্পদংশনের মত এ লাইনগুলি – Then they pushed hot eggs one after into my …’ 13
আর এভাবেই সাবিত্রী রায় রূপ দিয়ে চলেন স্বকালের বাংলার সামগ্রিক এক রূপকে। এরই প্রসঙ্গে গ্রন্থে এসে উপস্থিত হয় আরও দুটি প্রসঙ্গ – উদ্ধান্তু সমস্যা এবং হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। সমকালের প্রেক্ষাপটেই নয় শুধু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এ দুটির গুরুত্ব অপরিসীম। সন্দেহ নেই উদ্ধান্ত বিষয়ে সাবিত্রী রায়ের উপস্থাপনা অপূর্ণ। স্বরলিপিতে বিবৃত হয়েছে পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিমবাংলায় উদ্ধান্ত হিন্দু গৃহহীনদের কথা, পশ্চিমবাংলা থেকে পূর্ববাংলায় আগত মুসলমান উদ্ধান্তদের কথা আসেনি। এ প্রসঙ্গে আমরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামার কথা স্মরণ করতে পারি। সে উপন্যাসের পশ্চিমবাংলা বা ভারত থেকে আগত মুসলমান উদ্ধাস্তুদের কথা এসেছে। সাবিত্রী রায় যেহেতু উভয় বাংলাকেই তাঁর প্রেক্ষাপট করেছেন, তাই উভয় ক্ষেত্রেই উদ্ধাস্তু প্রসঙ্গটি তাঁর উপন্যাসে প্রত্যাশিত ছিল যেমনটি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ক্ষেত্রে তিনি করেছেন। পশ্চিমবাংলায় যাওয়া সেসকল উদ্ধাস্তুদের নিয়ে স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহলের যে কূটচক্র তা-ও এ উপন্যাসে বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গীতে উপস্থিত।
ঘটনার ক্রমঅগ্রসরণে এক পর্যায়ে উপস্থিত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। উপন্যাসের সময়কাল ১৯৪৬ এর পর হওয়ার সে দাঙ্গার চিত্র স্বরলিপিতে লিখিত হয় নি, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ত্যাগের উত্তরকাল তো এ উপন্যাসের গল্প অতিক্রম করছে। আর তাই অতর্কিত এক সংবাদ ‘পাকিস্তানে আবার গোলমাল শুরু হয়েছে’। 14 ছেচল্লিশের যে দাঙ্গা কলকাতায় শুরু হয়ে আস্তে আস্তে সারা বাংলায় ছড়ালো – এ দাঙ্গা শুরু হলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সে গোলমাল প্রথমে দেখানো হয়েছে হয়েছে কলকাতা থেকে। হাজার হাজার মানুষ দাঙ্গায় আত্মীয় পরিজন, ধনসম্পদ হারিয়ে পশ্চিমবাংলায় যেতে তাদের যে অভিব্যক্তি, মানুষজন যে চিঠিপত্রাদি লিখছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে, পত্রিকায় যে সকল সংবাদ ছাপা হচ্ছে – এসবের ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে দাঙ্গার পূর্ণ চিত্র। উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শীতা তখন পূর্ব পাকিস্তানে। এবং সাবিত্রী রায় দেখাতে ভোলেন নি যে শীতাকে যারা রক্ষা করেছে তারা মুসলমান; যেমনভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার কারণে যখন পশ্চিমবাংলায় ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাই’ 15 শ্লোগান ও পোস্টারে যখন কলকাতার পথঘাট উচ্চকিত তখন মানবিক বোধসম্পন্ন কিছু মানুষই একত্রিত করে সুস্থ বোধসম্পন্ন সকলকে এবং অসৎ সকল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের বিরুদ্ধে। পৃথ্বীরা সবাই কলাকাতার দাঙ্গা রোধে সামনের কাতারে। কিন্তু তারপরও রক্ষা হয় না। মধু মুখার্জীর ইন্ধনে কালু গুণ্ডা ও তার লোকজন হাঁশিয়াকে তুলে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণের পর বিবস্ত্র অবস্থায় ফেলে যায়।
ঔপন্যাসিক সাবিত্রী রায়ের জীবনে এটি একটি পরিহাস যে স্বরলিপির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র লেখক ও রাজনৈতিক পৃথ্বী পার্টির সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য যেমন বহিষ্কৃত হয় স্বরলিপি প্রকাশের পর সাবিত্রী রায়ের ভাগ্যেও বহিষ্কারপ্রাপ্তি ঘটে। বহিষ্কৃত হয়ে পৃথ্বীর যেমন মনে হয়েছিল ‘কি নিয়ে চলতে পারে সে জীবনে। সাহিত্য? কিন্তু কি লিখবে সে?’ 16 সেই মনে হওয়া দৃঢ়তর হয় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পর। নিজেকে সম্বোধন করে পৃথ্বীর বক্তব্য ‘লেখক তোমার কলম তুলে ধর। কলমে, তুলিতে আর গানে – নতুন সুর বাঁধা স্বরলিপিতে রচনা করো কল্যানী মানুষের মুক্তির আহ্বান। জানাও দিকে দিকে অনন্ত শান্তির ডাক।’ 17 সাবিত্রী রায়ের লেখিকা সত্তাও পৃথ্বীর মত – সাহিত্য রচনার ভেতর দিয়ে পুরোপুরি ডুবে যাওয়া। আর তারই ফলশ্রুতি পরবর্তী দুটি বিশাল উপন্যাস পাকা ধানের গান এবং মেঘনা পদ্মা।
কম্যুনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ এসকল দ্বন্দ্বের প্রকাশই কি সাবিত্রী রায়কে বিস্মৃত হবার প্রধান কারণ? পূর্বসূরি এবং সমকালীন অধিকাংশ অন্য লেখিকারা যখন ঘরোয়া বিষয়-আশয় নিয়ে লিখতে ব্যস্ত তখন সাবিত্রী ঝুঁকেছেন রাজনীতিকে তার উপন্যাসের বিষয় করতে। স্বীয় লব্ধ অভিজ্ঞতাই তাঁর পুজি। মনন এবং বিশ্লেষণ তার অনুষঙ্গ। যেখানে উত্তাল এই সময়ের বিপুল টানাপোড়েন, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথাচিত্র একজন পুরুষ ঔপন্যাসিকও রচনায় সাহস করেননি, সেখানে সাবিত্রী রায়ের রচনা রীতিমত প্রথাবিরোধী। সুজিৎ ঘোষ বলেছেন ‘প্রকৃতপক্ষে প্রথম উপন্যাসটি থেকেই লেখিকা এক প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ফলে তাঁর উপন্যাসের গুণাগুণ আলোচিত হয়নি, বরং আলোচনা ও প্রচারের অভাবজনিত এক নৈঃশব্দের বাতাবরণ ক্রমশই তাঁর রচনাগুলির ওপর পরিব্যপ্ত হয়েছে।’ 18 প্রতিষ্ঠানবিরোধী এ অবস্থানের সাথে যুক্ত হয়েছিল উপন্যাসে বিধৃত পার্টির কিছু কাজ সম্পর্কে কোনো কোনো কর্মীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী, যা তাঁকে পার্টির পরিমণ্ডল থেকে দূরে ঠেলে দেয়। স্বরলিপি নিষিদ্ধ ঘোষণাকালীন এক প্রবীণ পাঠকের স্মৃতিসমৃদ্ধ আলোচনা রয়েছে যা রীতিমত উদ্দীপক। সাবিত্রী রায়ের স্বামী শান্তিময় রায়ের ছাত্র সৌরীন ভট্টাচার্য এ আলোচনায় জানিয়েছেন:
ইতিমধ্যে বাহান্ন সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। … তা ‘স্বরলিপি’ পড়া শেষ হতে না হতেই আর এক দুঃসংবাদ। ঠিক যে কোনো সংবাদ পাওয়া গেল তা নয়, কীরকম যেন এক ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে এদিক-ওদিক। বাড়ির বড়রাও যে বেশি কিছু বলতেন তা নয়। সুন্দর দেখতে ঐ স্বরলিপি বইটা আমাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল … শোনা গেল বা জানা গেল বা বোঝা গেল, যাই হোক, বইটি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওই রকমই ভাসা ভাসা জানা গেল বইটি পার্টি বিরোধী বলে চিহ্নিত হয়েছে, তাই এ-বইয়ের প্রচার নিষিদ্ধ।
… ওই সময়ে পার্টির ভেতরের কথায় খানিকটা আলগোছে প্রচার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, লিখিত কোনো সার্কুলার কিংবা ফতোয়া পার্টি সদস্যদের জানা ছিল কিনা তা জোর দিয়ে বলতে পারছি না। সম্ভবত ছিল। অন্তরালের চাপাচাপি কতটা ছিল, সে ব্যাপারে নিজের অবস্থান কী ছিল, তাঁর সম্ভাব্য আপত্তি কত তীব্র ছিল এসব কথা আজ হলফ করে বলা শক্ত। 19
আর এভাবেই সাবিত্রী রায় চলে গেলেন বিস্মৃতির গভীর তলে। অথচ পঞ্চাশ বছর আগে সাবিত্রী রায়ের ভাবনা পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী কম্যুনিস্ট পার্টির ব্যাপারে সত্য বলে স্বীকৃত। পার্টির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কর্মীমহলে সকল প্রকার আলোচনাকে নিষিদ্ধ রাখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। সেজন্যই তিনি যেমন স্বরলিপির স্বরকে সমুন্নত রাখতে পার্টির সদস্যপদ ছাড়তে পিছপা হন নি, তেমন পরবর্তীকালেও নিরত হন নি তাঁর জীবনদর্শনকে প্রকাশ করতে। সাহিত্যিক সত্যই ছিল তাঁর একমাত্র আদর্শ। সাহিত্যিক সে-চেতনায় যুক্ত ছিল সাম্যবাদ আকাঙ্ক্ষা। পার্টির আদর্শকে তিনি সে আকাঙ্ক্ষার উর্ধ্বে স্থান দেন নি। আর সেজন্যই তাঁর উপন্যাসের মানবিক বোধ পাঠকের কাছে সমাদৃত। দলীয় সংকীর্ণতার উপরে উঠে তাঁর চরিত্রগুলো মানবিক স্পর্শ পেয়েছিল বলেই সাবিত্রী রায়ের উপন্যাস এখন নতুন করে বিশ্লেষণের দাবী রাখে। স্বরলিপির এক আলোচনায় সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেন:
সাবিত্রী রায়ের রচনায় একটি গভীর মানবিক আদর্শবাদের ফল্গুধারা প্রবাহিত। এ শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাস নয়, সমাজ মানসে স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনচারী মানুষের, স্বাধীনতাচারিনী মানবীর যে চলাফেরা তিনি চিত্রিত করেছেন অত্যন্ত সহজে, কোন ঢাক ঢোল না বাজিয়ে, কোন দীর্ঘ যুদ্ধং দেহি গোছের বক্তৃতার প্রবর্তন না করেই, সেটাতে সত্যিকার বিস্ময় জাগায়। এটা বিশেষ করে লক্ষণীয় তাঁর নারীচরিত্রে। এরা কেউ প্রেমে সফল, কেউ বা ব্যর্থ, কিন্তু প্রত্যেকেরই হৃদয়বত্তার দুটি সমাজ প্রকাশ, একটি তার আদর্শের ক্ষেত্রে, অন্যটি তার মানবিক সম্পর্কগুলির পরিবেশে। 20
সাবিত্রী রায়ের উপন্যাসের মানবিক বোধের অনুসন্ধানে সাফল্যের কারণেই তাঁর পরবর্তী মহাকাব্যিক উপন্যাস পাকা ধানের গান ১৯৮৬ সালে অখণ্ড সংস্করণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আংশিক অর্থানুকূল্যে প্রকাশ পেয়েছিল?
স্বরলিপি বা সাবিত্রী রায়ের অন্যান্য উপন্যাসের মতই পাকা ধানের গানও বাংলার উভয় অংশকেই এর ক্ষেত্র করেছে। স্বরলিপিতে এসেছিল কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক পরিক্রমা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, উদ্ধান্ত সমস্যা ইত্যাদি। অন্যদিকে পাকা ধানের গান বাংলা অঞ্চলের সংঘটিত তেভাগা আন্দোলনের মর্মস্পর্শী চিত্র। কৃষকদের সে-আন্দোলনের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর সম্পৃক্ততাসহ পুরো চিত্রটি সাবিত্রী রায় বিধৃত করেছেন যা শেষ হয়েছে ১৯৪৬-৪৭-এর হাজং বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে। এ উপন্যাসে তিনি আবার স্বরলিপির মত সংক্ষিপ্ত একটি সময়ের রূপায়ণ না করে ধারণ করেছেন একটি দীর্ঘ কালকে যা বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ যুগের শেষ কাল থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী তেভাগা আন্দোলনের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত: যার প্রথম দিককার কিছু কিছু অনুষঙ্গ ত্রিসোতাতে পাওয়া যেতে পারে। যদিও অবশ্য উল্লেখ্য যে লেখিকা সেসবের নির্মিতিতে সুস্পষ্ট ভিন্নতা দিয়েছেন। পৌনঃপুনিকতা তাঁর রচনাগুলোকে দুষ্ট করতে পারে নি।
ত্রিশ-চল্লিশের দশকের বাংলাভাষী অঞ্চলে যে বিপুল প্রস্ফূরণ তা নিয়ে উপন্যাস রচনার কি শেষ থাকতে পারে! স্বদেশী যুগের অগ্নিগর্ভ সময় অতিক্রান্ত হয়ে বীর্যবান সেসকল তরুণরা তখন নতুন বিশ্ববীক্ষার দিকে। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা – যার কাঁপনে বঙ্গবাসীও উদ্বেগাকুল। তারই মধ্যে এলো বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন। বছর না পেরুতেই সাম্রাবাদী সরকারের সাথে মজুতদার ও জোতদারের যোগসাজশে ছারখার হয়ে গেল বাংলার সাধারণ বিত্তের জীবনযাপন। পঞ্চাশের (১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ) যে মন্বন্তরে সরকারি হিসেবেই মারা গিয়েছিল ১৫ লাখের বেশি মানুষ, বেসরকারি হিসেবে যে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৫ থেকে ৪০ লাখ 21 – তারই মধ্যে শুরু হলো তেভাগা আন্দোলন – কৃষকের ন্যায্য দাবী প্রতিষ্ঠার আমৃত্যু প্রচষ্টা। বাংলা অঞ্চলের অধিকাংশ জেলার মানুষ সাড়া দিল সে আহবানে। একই কাতারে দাঁড়িয়ে সাহস যোগালো শিক্ষিত প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক-বুদ্ধিজীবী। বাঙালি জীবনের ঘটনাবহুল সে-সময়ের সামগ্রিক চিত্র বাংলাভাষায় রচিত উপন্যাসে দুর্লক্ষ্য না হলেও তার সংখ্যাকে কি প্রতুল বলা চলে? বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলনকে একমাত্র উপাত্ত করে রচিত উপন্যাসটি সতীনাথ ভাদুড়ীর (১৯০৬-১৯৬৫) জাগরী ছাড়া কোন ভাল উদাহরণ কি আমাদের আছে? পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়েও তো মাত্র গোটাকয়েক: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৪-১৯৫০) অশনিসংকেত (১৯৪৪), তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৯-১৯৭১) মন্বন্তর (১৯৪৪) এবং গোপাল হালদারের (১৯০২-১৯৯৩) ত্রয়ী উপন্যাস পঞ্চাশের পথ (১৯৪৪), ঊনপঞ্চাশী (১৯৪৬) এবং তেরশ পঞ্চাশ 22 (১৯৪৫)। এছাড়া সরোজকুমার রায় চৌধুরীর (১৯০৩-১৯৭২) কালোঘোড়া (১৯৫৩), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) চিন্তামণি (১৯৪৬), সুবোধ ঘোষের (১৯০৮-১৯৮০) তিলাঞ্জলি (১৯৪৪), আবু ইসহাকের (জন্ম. ১৯২৬) সূর্য দীঘল বাড়ী (১৯৫৫), অমলেন্দু চক্রবর্তীর (জন্ম. ১৯৩৪) আকালের সন্ধানে 23 (১৯৮২) উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। পঞ্চাশের মন্বন্তর প্রাসঙ্গিক হিসেবে প্রবিষ্ট হয়েছিল এমন অন্য কয়েকটি উপন্যাস হলো সুমথনাথ ঘোষের (১৯১০-১৯৮৪) সর্বংসহা (১৯৪৪) ভবানী ভট্টাচার্যের 24 (১৯০৬-?) ইংরেজি উপন্যাস So Many Hungers (১৯৪৮) এবং দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৯-১৯৯০) একমাত্র উপন্যাস মাটি ও মানুষ (১৩৬৮), আলাউদ্দিন আল আজাদের (জন্ম, ১৯৩২) ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪) প্রভৃতির নাম করা যায়। বাঙালির দুর্ভাগ্য এই যে মন্বন্তর নিয়ে কিছু উপন্যাস রচিত হলেও তেজোদীপ্ত বাঙালির দুর্মর সংগ্রাম তেভাগা আন্দোলন নিয়ে বিশেষ কোন উপন্যাস রচিত হয় নি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামায় তেভাগার প্রসঙ্গ অনেকখানি আসলেও দুর্ভিক্ষের দূরতম ইঙ্গিত রয়েছে মাত্র। যদিও দাঙ্গা প্রসঙ্গ খোয়াবনামায় এসেছে পরিপূর্ণ বিস্তৃতিতে। ব্যাপক দাঙ্গার পরিচয় যেসব উপন্যাসে রয়েছে তার মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বাধীনতার স্বাদ (১৯৫১), নারায়ণ চৌধুরীর (১৯১৮-১৯৭০) লালমাটি (১৯৫১
) অন্যতম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গটি অন্যান্য যেসকল উপন্যাসের ঘটনাস্রোতে স্থান পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সত্যেন সেনের (১৯০৭-১৯৮১) উত্তরণ (১৯৭০), আবু জাফর শামসুদ্দীনের (১৯১১-১৯৮৯) পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৭৪), শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) জননী (১৯৫৮), শহীদুল্লা কায়সারের (১৯২৭-১৯৭১) সংশপ্তক (১৯৬৫), অসীম রায়ের (১৯২৭-১৯৮৬) একালের কথা (১৯৫৩) প্রভৃতি। হয়তো কৃষণ চন্দরের গাদ্দার, খুশবন্ত সিং-এর ট্রেন টু পাকিস্তান বা অতি সম্প্রতি রচিত শশি ঠারুরের রায়ট-এর মত সম্পূর্ণতই দাঙ্গা বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস বাংলাভাষার হয়ত দূর্লভ। দাঙ্গা নিয়ে উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও যতটুকু ঘটেছিল তেমনটি তেভাগার উপন্যাস না থাকা নিয়ে প্রার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন: ‘দুঃখের বিষয় তেভাগা আন্দোলনকে নিয়ে এই ধরণের উপন্যাস প্রচেষ্টা আমাদের প্রধান ঔপন্যাসিকেরা কেউ করেন নি।’ 25 খোয়াবনামার চল্লিশ বছর আগে পাকা ধানের গান-এ তেভাগার বিপুল উপস্থিতি আমাদের স্মরণে আসে না যেহেতু এর লেখিকা হারিয়ে গেছেন বিস্তৃতির অতলে।
পাকা ধানের গান-এর পর্ব তিনটি আলাদা আলাদাভাবে প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। অখণ্ড সংস্করণটি প্রকাশ পায় ১৯৮৬ তে যার দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছে ১৯৯০-এ। অখণ্ড সংস্করণে কোন পর্ব-উল্লেখ নেই। অখণ্ড সংস্করণকে সংক্ষেপিত বলা হয়েছে। 26 পাকা ধানের গান হিন্দী, মালায়ালাম ও চেক ভাষার অনূদিত হয় এবং সমাদর লাভ করে। এস. উপাধ্যায় হিন্দী ভাষায়, দুর্বান জবাভিতেল চেক ভাষার এবং এম. এন. সত্যার্থী মালায়ালাম ভাষায় গ্র্রন্থটি অনুবাদ করেন। অখণ্ড সংস্করণে সাড়ে ছয় শতাধিক পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি বাঙলাভাষা অঞ্চলের সর্ব-অগ্রণী রাজনৈতিক উপন্যাস। নারী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে আর শ্রেণী-সচেতন রাজনৈতিক কথাসাহিত্যিক হিসেবে সাবিত্রী রায় সর্বাগ্রে উল্লেখ্য এবং সফল এক কথাশিল্পী; যার উত্তরসূরী হিসেবে মহাশ্বেতা দেবীকে (জন্ম ১৯২৬) চিহ্নিত করা চলে। বাংলা কথাসাহিত্যে একই রূপ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছিলেন আর যে একজন নারী কথাকার তিনি হলে সুলেখা সান্যাল।
পাকা ধানের গান উপন্যাসে ত্রিশ ও চল্লিশ দশকের বাংলাদেশের যে উত্তুঙ্গ রাজনৈতিক সময়কে চিত্রায়িত করা তার প্রধান চরিত্রটি হল পার্থ। একুশ বছর বয়সী পার্থকে পাওয়া যায় উপন্যাসের প্রথম লাইন থেকেই। এরপর পার্থর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। এক পর্যায়ে হাজং এলাকা। চূড়ান্ত বিদ্রোহের এক সময় পত্রিকা অফিসে টেলিপ্রিন্টার শিটে নিউজ: ‘হাজং অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন তোরজোর চলছে। খুব লড়াই করছে চাষীরা। … মেশিনগান দিয়ে গুলি চালাচ্ছে হাজংদের ওপর। সতের জন আহত হয়েছে। … একজন কৃষক নেতা পার্থ দাস গুলিতে নিহত। 27 হাজংদের এই যে রণসাজ তার চূড়ান্ত বর্ণনা সাবিত্রী যেভাবে দেন:
ঘরের বাইরের সে কফিন স্তব্ধতা ভেদ করে হঠাৎ বনের ভেতর থেকে শিঙা বেজে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে চলে সে সাংকেতিক শিঙার বেতার বার্তা।
সমস্ত রক্তকণিকা দিয়ে শোনে পার্থ অরণ্য-প্রান্তের সে শিঙার প্রতিধ্বনি। সিগ্ধ একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে অধর প্রান্তে। সঙ্গে সঙ্গে আরও খানিকটা রক্ত বেরিয়ে আসে ক্ষত দিয়ে।
সন্ধ্যা হতে না হতেই হাজার হাজার হাজং সারি বেঁধে টিলার ঢালু বেয়ে নিচে নেমে আসে। নেমে আসে হাজার হাজার ডালু, কোচ, গারো বানাই – প্রত্যেকের হাতে তীর ধনুক, লাঠি-সড়কি, বর্শা। দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনীর মতো অন্ধকারে শালবনের ভেতরে দিয়ে ছুটে আসে মশালের পর মশাল। মাদলের গুরু গুরু আওয়াজ আর মশালের গণনাতীত সংখ্যা দেখে ভয় পেয়ে যায় মিলিটারী সশস্ত্র বাহিনী। সৈন্যের ঘাঁটি তুলে নিয়ে যাবার হুকুম আসে ওপরওয়ালার। 28
সংগঠিত হাজংদের বিদ্রোহী কার্যক্রমের এই যে বর্ণনা তা থেকে ধারণা করা যায় সমকালীন রাজনীতির কর্মকাণ্ড নিয়ে সাবিত্রী রায়ের ধারণা কত প্রত্যক্ষ। বিপ্লবী দলের ছেলে হিসেবে পার্থর প্রথম উপস্থিতি থেকে সংগ্রামী নেতা হিসেবে পার্থর ক্রমঅগ্রসরণ। জেল খাটার পর পার্থরা ক্রমশ ঝুঁকছে সমাজতন্ত্রের দিকে। ব্রিটিশ-বিরোধিতার সাথে তখন যুক্ত হয়েছে অত্যাচারী ধনিক জমিদার-বিরোধিতাও। তবে ব্রিটিশ-বিরোধী বা জমিদার-বিরোধী যাই হোক না কেন এ দলভুক্ত মানুষদের ওপর সরকারি নির্যাতন কোনদিনই কমে নি।
পাকা ধানের গান-এর জন্য সাবিত্রী রায় যে প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেন তার বিশালতা যেকোন উপন্যাস পাঠককেই বিস্মিত করবে। দিঘির পাড়, তালপুকুর, মনসাডাঙ্গা, শ্যামগঞ্জ নদীবিধৌত বাংলার এসকল গ্রামের পটে সাবিত্রী রায় হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-শুদ্র, জেলে-কৃষক সকল ধর্ম শ্রেণী ও পেশার একটি সমাজকে উপস্থাপন করেছেন যার বাসিন্দা উপন্যাসের কলাকুশলীরাও। তাদের কেউই অনন্য নয়, তারাও যেন উপন্যাসে অনুল্লেখিত অন্য মানুষদের মত সাধারণ। উপন্যাসের কাহিনী আবার ঐ সকল গ্রামের কোন বিশেষ পরিবারে গণ্ডিবদ্ধ নয়, বিস্তৃত হয়েছে অনেকগুলো পরিবারে, সম্পৃক্ত হয়েছে অনেক মানুষ। আর তাই পার্থকে দিয়ে উপন্যাস শুরুর পর ক্রমে ক্রমে সেখানে সমবেত হয়েছে দীনবন্ধু মাস্টার, দেবকী, সুবালা, সুখদা, কেতকী, কুন্তী, সাথী, মফির মা, আমিনুদ্দিন, আমিন জগাই বাঁড়ুজ্যে, আলি, পার্থর বাবা সুদাম, লক্ষ্মণ, অমূল্য, কুণ্ড মাঝি, আল্লাবক্স, মঙ্গলা, অর্জুন, লক্ষ্মী, দাসুর মা, মেঘীসহ আরও অনেকে। নিকটবর্তী ঐ সকল গ্রামপুঞ্জ থেকে কাহিনী ছড়িয়েছে কাঞ্চনপুরে ; যেখানে দেবকী স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানে পাওয়া যায় ঈশানী দেবী, সুন্দর ঠাকরুণ ও লতার মত চরিত্র। আবার দেবকীর শ্বশুরবাড়ি একই গ্রামে যখন হলো তখন আরও অনেকগুলো চরিত্র এসে যুক্ত হলো এদের সাথে। দেবকীর মামী শাশুড়ি, ননদত্রয় পুসি-টুসি-হাসি, বিধবা জা আন্না, স্বামী রাজেন। আর বিপ্লবী সুলক্ষণ সরকারও ঐ বাড়িরই ছেলে।
প্রথম পর্বের মাঝামাঝি জায়গায় 29 আমরা পেলাম নতুন আরও একটি স্থান পাহাড়পুর – দক্ষিণবঙ্গের আগের গ্রামগুলো থেকে অনেক দূরে। কারাবাসের দিনশেষে পার্থর অন্তরীণ হয়েছে ঐ এলাকায়। দক্ষিণের সে গ্রামগুলো পার্থকে দিয়েছিল চেতনা যা চূড়ান্ত বিপ্লব কার্যে উত্তরের ঐ পাহাড়পুর এলাকায় স্মরিত। পাহাড়পুরের নতুন মানুষদের মধ্যে সারথী, সরস্বতী, শঙ্খমান, বাসুমনি, আলাপী, কার্ত্তিক চৌকিদার। পনের ষোল পৃষ্ঠার এই অংশ শেষে আমরা দেখি পার্থর অন্তরীণ কাল শেষ। এই অংশটি পাকা ধানের গান উপন্যাসের মূল উপপাদ্য হাজং বিদ্রোহী প্রেক্ষাপট নির্মাণে প্রধান নিয়ামক। এই অংশে হাজংদেরকে যে সপ্রতিভ চরিত্রে দেখানো হয়েছে তা দ্বিতীয় বার যখন আমরা পাহাড়পুরে উপস্থিত হই 30 তখন বিদ্রোহী চেতনায় পরিবর্তিত। সেখানে বিপ্লবী গণেশ দাসের সশরীর উপস্থিতি। কিছুদিন পর সেখানে সুলক্ষণ ও তার স্ত্রী লতা উপস্থিত। আর এখানে পাহাড়পুরের হাজং বিদ্রোহের লেখ্যরূপ দেওয়ার জন্য সাবিত্রী রায় স্বাবলম্বী একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করে ফেলেন।
ইতোমধ্যে প্রথম পর্বে দুই-তৃতীয়াংশ শেষে 31 পার্থর অবস্থান হয় কলকাতায়। সেখানে ভদ্রার সাথে পার্থর পরিচয়; যে কিনা আর একটি প্রধান নারী চরিত্র হিসেবে উপন্যাসে পরিস্ফুটিত। ভদ্রাসূত্রে আর যারা উপস্থিত হয় – তারা হলো আনন্দবাবু, নিউ লাইট পত্রিকার ফটোসাংবাদিক অবাঙালি কুনাল কুরূপ প্রমুখ। আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ভদ্রার সূত্রে আরও পাওয়া যায় সত্যদর্শন, টিয়া ও টিপুর মত ছোট ছোট চরিত্রগুলো। মৃত স্বামীর বাড়িতে (শহরটি যশোর বলে অনুমান 32) অবস্থানকালে তার সাথে যোগাযোগ ঘটে আইরিশ সৈনিক অ্যানড্রু ওদোনেল বা ও-নীলের। আর এভাবেই দক্ষিণবঙ্গ থেকে উপন্যাসের প্রেক্ষাপট উত্তরবঙ্গ হয়ে বাংলাই শুধু পার হয় নি, হয়েছে ভারতবর্ষের সীমানাও। পরিচয় পত্রিকায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন:
প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড পড়তে পড়তেই আশঙ্কাই জাগে, ভয় হয় এতগুলি বিচ্ছিন্ন বিভিন্নমুখী চরিত্রের সামঞ্জস্য কি সম্ভব হবে? সুলক্ষণ ও লতার কাহিনী, সারথি ও সরস্বতীর প্রেম, দেবীর সংক্ষুব্ধ জীবনেতিহাস, আলি ও মেঘীর কাহিনী, ফোটোগ্রাফার কুনালের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, চোরাকারবারী দুলাল দত্তের সংসার, আনন্দবাবু ও ভদ্রার জীবনবৃত্ত – এদের সকলকে একটি সমগ্রতার মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণ ঐক্য পরিণতি কি দিতে পারবেন লেখিকা? কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডের শেষাংশ থেকেই বোঝা যায় এতগুলি চরিত্র ও ঘটনার ভিন্নমুখী গতিকে নিয়ন্ত্রিত করবার শক্তি তাঁর আছে ; তৃতীয় খণ্ডে এসে অতি স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত ধারাগুলি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একটি ধারায় মিলে গেছে।
অন্যদিকে কলকাতায় দেবকীর অবস্থান নেয়ার সূত্রে গড়ে উঠেছে আরও একটি চরিত্র জগত। হেনামামী, দুলালমামা, সুখনলালের মত অর্থগৃধ্নু চরিত্রগুলোকে আমরা এখানেই পেয়েছি। সর্বরকম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবকী যখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তখন তার উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ অন্নপিসি – দেবকীরই মত আর এক অসহায় কিন্তু সংগ্রামী নারী। দেবকী পরে যখন যক্ষা হাসপাতালে চাকরি নেয় তখন আরও যারা ভীড় করে দাঁড়ায় তাদের মধ্যে রয়েশে আশাদি, মিহিরবাবু, রাখিদি, অসীম। আর এভাবেই কয়েকশত চরিত্র উপন্যাসের কালের ভেতরে দিয়ে গ্রন্থের ঘটনাসমুহকে কোন-না-কোন-ভাবে স্পর্শ করেছে। এ সকল চরিত্রের মধ্যে পার্থ, দেবকী, ভদ্রা প্রধান ঘটনাসমূহের নিয়ন্ত্রক হলেও সুলক্ষণ, আলি, মেঘী, সারথি, সরস্বতী, কুনার প্রভৃতি চরিত্রও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর সেজন্যেই বোধহয় একজন সমালোচক পাকা ধানের গান উপন্যাসের আলোচনায় বলেছেন:
‘নায়ক-নায়িকা সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণার কোন আকর্ষণই সাবিত্রী রায়ের নেই। কেবলমাত্র ঐক্যবদ্ধ বীরত্বের শক্তি এবং সম্ভাবনার প্রকাশ এ গ্রামটি ও এর বিপ্লবী সরল অধিবাসীরা’। 33
পাকা ধানের গান হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক অনুপম চিত্র। উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষজন যেমন এ উপন্যাসে মিলেমিশে আছে তেমনি চেতানগতভাবেও তাদের অবস্থান খুবই কাছাকাছি। লক্ষ্মণ যে আমিনুদ্দির বাড়িতে যায় গাজির গান শুনতে অথবা গরুগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় মঙ্গলার যে বিশ্বাস পীরের পূজো দিলে গরুর মঙ্গল হবে, তীব্র ঝড়ের দিনে আমিনুদ্দির বাড়িতে যখন হরি ও আল্লাহ উভয়ের নামই ধ্বনিত হয় তখন ধর্মীয় পার্থক্য সত্ত্বেও এই দুই সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত ও চেতনাগত নৈকট্য উপলব্ধি করা যায়। আর সচেতনভাবে সাবিত্রী রায় যে কাজটি করেছেন তা হলো আলির সাথে ব্রাহ্মণের বিধবা মেয়ে মেঘীর প্রেম ও বিয়ে। আলি ও মেঘীর এই বৈপ্লবিক কাজটি কিন্তু উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে সামাজিক অনুশাসনের পরিপ্রেক্ষিতেই। মেঘীর জন্মকালেই বাপ মারা যায়। বিয়ের পরপরই স্বামীকেও হারায়। এমন অভাগী মেয়ের জায়গা কোথায়! পৈতে বিক্রি করেই চলে মা-বেটির সংসার। সেখানে আলির উপস্থিতি মেঘীর ভেতরে জায়গায় স্বপ্ন দেখার সাহস। ‘ঐ মুসলমান ছেলেই একমাত্র ব্যথার ব্যথী তার।’ 34 কিন্তু সে স্বপ্ন কি পূরণ হবার জন্য জেগেছে? জগাই বাড়ুজ্জ্যে, যে কিনা মেঘীর শরীর চেয়ে পায় নি, থাকে ওৎ পেতে। তারপর ওদের ভালবাসাবাসি ফাঁস হয়ে গেলে মাথা মুড়িয়ে মেঘীর গালে পোড়া ছ্যাকা দিয়ে দেয়। কিন্তু পার্থর দৃঢ়তার কারণেই শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয় সবকিছু। রেজিষ্ট্রি করে বিয়ের জন্য ওদেরকে ট্রেনে তুলে দেয় পার্থরা। আর এভাবেই আলি-মেঘীর নতুন এক জীবন শুরু হয়; যা হিন্দু-মুসলমান সমাজের জন্য এক নতুন ইঙ্গিতের সূচনা বৈকি। আলি-মেঘী চলে গেলে পার্থর বাবা সুদাম এবং মা মঙ্গলার নিচের ভাবনা দিয়ে এ অধ্যায় আপাতত শেষ হয়:
সুদামও নিশ্চয় হ’য়ে বসে থাকে ঘরে। কাজটা একবার সায় দেয়, একবার দেয় না মনে, বামুনের মেয়ে মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে – ঘর সংসার চলবে কি ভাবে কে জানে? নামাজ পড়বে, কলমা পড়বে মেঘী? আবার ভাবে, নামাজকি আলিই পড়তো কোনোদিন? এরা সব আলাদা জাত। আলাদা যুগের আলাদা মানুষ। পার্থ, আলি, লক্ষ্মণ – এরা কলিকালের চেলে সব, এছাড়া এ বিয়ে না দিলেও মেয়েটার দুর্দশার অন্ত থাকবে না।
মঙ্গলা মেঘীদের রওয়ানা করে দিয়ে এসে বলে ‘গালের উপর টিকে আগুন দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়েছে মেয়েটার। এরা কি মানুষ নয়?’ 35
জমিদারী অত্যাচারের এক জীবন্ত দলিলের মতো পাকা ধানের গান। সে অত্যাচার কখনও একজন ব্যক্তির ওপর আবার কখনো একটি সামাজিক দলগোষ্ঠীর ওপর নেমেচে। সে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের উঠে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা এতে রয়েছে। আর সেজন্যেই তো এতদ্অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামাজিক আন্দোলন তেভাগা-হাজং বিদ্রোহ সম্ভব হয়েছিল। মফির মা’র জমি যেমন করে নাকি দু’হাজার টাকা কর্জ নিয়েছিল সে অজুহাতে জমিদারের আমিন জগাই বাড়ুজ্যে দখল করে, আমার পথকর না দিলে চলাচল নিষেধ তেমনি একটি শমন আসতেও খুব বেশি দেরী হয় না। জমিদারের ছত্রছায়ায় থাকা এসব অত্যাচারী মানুষগুলোই নীচুতার চূড়ান্ত প্রমাণ করে। এদের বিরুদ্ধে আলির অবস্থান বলে তার ওপর নির্যাতন বেশি। তাদের এমন অত্যাচার তো পাহাড়পুর এলাকায় তীব্রতর। পার্থরা যাদের সংগঠিত করছে তাদের বেশিরভাগই হদি। ক্ষত্রিয়জ মর্যাদার দাবিদার এই হদিরা হলো রাজা হৈহয়ের বংশধর। তাদের হাতের পদ্মফুল না হলে মায়ের পূজো হয় না, অথচ তাদেরকে পূজায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয় না। এভাবে ধর্মীয় অত্যাচার যেমন আছে, আছে সামাজিক অত্যাচার। কিন্তু প্রকৃতিগত বিদ্রোহী চেতনার অধিকারী মানুষ মেনে নেয় নি এসব। আন্দোলন হয়েছে। হদিরা প্রতিমা কাঁধে নিতে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনই হয় নি। শেষ পর্যন্ত বাবুরা রাজি হয়েছে পূজাকে সর্বজনীন করতে। এই বিদ্রোহী চেতনারই অঙ্গ হিসেবে এক সময় আসে টংক আন্দোলন। জমির ধান কৃষকেরা জমিদারের গোলায় তুলতে রাজি হয় না; যার পরিণতিতে হাতি আর লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে হাজংদের ঘর-বাড়ি ভেঙে দেয়া হয়েছে। শঙ্খমানকে ধরে নিয়ে জমিদারের পাইকরা দিনরাত শারীরিকভাবে অত্যাচার করেছে। কিন্তু মাথানত করে নি হাজংরা। ব্যাপকভাবে সংগঠিত হাজংদের ওপর শেষ পর্যন্ত ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে যার চূড়ান্ত ঘটেছে মেশিনগানের গুলিতে পার্থর মৃত্যুতে।
বিট্রিশ বিরোধিতা ও জমিদারী বিরোধিতার পাশাপাশি সাবিত্রী রায়ের উপন্যাস নারীর বিদ্রোহী চেতনারও প্রতিরূপ। নারীকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে উপস্থাপনে সাবিত্রী রায় দৃঢ়চেতা। নিজের জীবনে যেমন নারীত্ব তাঁর কোন বাধা হয়ে দাড়ায় নি তেমনি তাঁর নারী চরিত্রকে তিনি সততা ও ন্যায়ের পথে – আদর্শ ও দেশপ্রেমের পথে নিতে কোন প্রতিবন্ধকতা রাখেন না। তাঁর প্রথম উপন্যাস থেকেই এ প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। স্বরলিপি ও পাকা ধানের গান-এ তা হয়েছে বিস্ময়করভাবেই স্বচ্ছ। ত্রিসোতা-র পদ্মার বিদ্রোহী চেতনা অনেক বেশি সংহতরূপে প্রকাশ পায় স্বরলিপি-র সাগরী ও শীতার ভেতর দিয়ে। এরা দুজনেই সাধারণ ঘরের মেয়ে, কিন্তু দুজনেই আবার অসাধারণ তাদের ভাবনা ও আদর্শবোধে। পার্টির নির্দেশকে মাথা পেতে নিতে সাগরী তার স্বামী রথীকে ত্যাগ করলেও তার ভালবাসাকে কলুষিত করে নি। যখনই বুঝেছে পার্টিনেতৃত্ব তার ব্যক্তিজীবনকে ক্ষতি করতেই উপায় খুঁজছে সে প্রতিবাদ করেছে, কলঙ্কের কালি কপালে মেখে চলে গেছে কৃষক এলাকায় আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে। আর এভাবেই একসময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে মৃত্যু ঘটে সাগরীর। শীতাও কি কম! ভালবাসলেও তার বিয়ে হয় নি পৃথ্বীর সাথে। বিয়ে হয়েছিল যে দেবজ্যোতির সাথে তার মৃত্যুতে বিধবা শীতার একমাত্র আশ্রয় হয় শিশুসন্তান মিঠু। কিন্তু পরে বোঝা যায় সেও এক ছাইচাপা আগুন। তাই শাশুড়ির মৃত্যুকালে সে শ্বশুরের ভিটাতে গিয়েও সেখানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে পলাতক কমরেডদের। তারই আশ্রিয় ছিল নিখিলেশ পার্বতীর স্বামী যে কিনা হাজং বিদ্রোহের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়। শুধু কি তাই! নিজেও তো চেষ্টার ক্রুটি করে নি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এড়াতে। পাকা ধানের গান-এর দেবকীর মত একটি বিদ্রোহী চরিত্র সমকালীন বাংলা উপন্যাসে হয়তো দুর্লভ। হয়তো পারিপার্শ্বিকতার চাপে দেবকী নুইয়ে পড়তে চায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর বিদ্রোহীসত্তা অপরাজেয়। দেবকী তো অত্যাচারী স্বামীর পদবী পর্যন্ত নিজের নামের সাথে লাগাতে নারাজ। মেঘীর ভেতরেও কি ধর্ম ও সমাজের প্রচলিত প্রথাবিরোধী একজন নারীর শক্তিশালী অস্তিত্বকে আমরা অনুভব করি না? এমনকি ঈশানী দেবী এবং লতাও তো সমাজ পরিবর্তনে কম অগ্রণী নয়! স্বকালের বিদ্রোহী নারীসমাজের কর্মকাণ্ডে সাবিত্রী রায়ের ছিল অচ্ছেদ্য সম্পৃক্ততা। আর সেজন্যেই তো স্বরলিপি-র উৎসর্গে ২৭ এপ্রিল ১৯৪৯ এর যে পাঁচজন শহীদের নাম উৎকীর্ণ তাঁদের মধ্যে চারজনই নারী। 36
পাকা ধানের গান সন্দেহাতীতভাবেই একটি সফল রাজনৈতিক উপন্যাস। জীবন-ঘনিষ্টতায় সফল সামাজিক চিত্রণ এ উপন্যাসের মূল প্রতিবাদ্য। এবং সাবিত্রী রায়ের সাফল্য অথবা কৌশল এই যে তিনি উপন্যসটিকে সম্পূর্ণতই একটি রাজনীতির পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না রেখে এবং ঘটনাক্রমের মূল ভিত হিসেবে রেখেছেন বাঙালির দৈনন্দিন সামাজিক ও পারিবারিক জীবন। পাকা ধানের গান-এর আরও একটি বিশিষ্টতা এই যে, লৌকিক জীবনাচরণ সারা উপন্যাসটি জুড়ে বর্তমান যা উপন্যাসটির মূল গল্প-কাহিনীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে উপন্যাসটিতে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সেকালের বাঙালি জীবনের লৌকিক বিবিধ অনুষঙ্গ উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে পুঁথির গল্প আর গান নিয়ে লাউল 37 সাজানোর গল্প, হলুদ বাটার গান 38, নীল সাজা 39, আহলাদী পুতুল বানানো 40, গাজীর পট দেখানো 41, কালী নাচ 42, মনসার পাচালী পাঠ 43, মাঘমঙ্গলের ব্রত 44 তোষলা ব্রত 45 এমনই কিছু উদাহরণ। লোককাহিনী লোকপুরাণের কতকত গল্পও এসে মিশে আছে পাকা ধানের গান-এর মূল গল্পের ভেতর। এবং নির্দ্বিধচিত্তে বলা চলে যে পাকা ধানের গান লৌকিক সংস্কৃতির যে কোন গবেষকের জন্য একটি মূল্যবান দলিল হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা চলে যে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গেও সাবিত্রীর উপন্যাসের এক অবিচেছদ্য অনুষঙ্গ। স্বরলিপি ও পাকা ধানের গান উভয় গ্রন্থেই বহু বহু রবীন্দ্র গান ও কবিতার উদ্ধৃতি লেখকের মনন ও পাঠগত চিত্রকে পরিস্ফুটিত করে।
সাবিত্রী রায়ের পরবর্তী দীর্ঘ উপন্যাস মেঘনা-পদ্মা 46 -এর দুটি খণ্ড প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে। সাত শতাধিক পৃষ্ঠায় এ উপন্যাসটির শেষাংশ সমুদ্রের টেউ আলাদাভাবে প্রকাশিত হয় ১৯৬৮-তে। সাবিত্রী রায়ের শেষ দুটি উপন্যাস হল ঘাসফুল (১৯৭১) ও বদ্বীপ (১৯৭২)। ঘাসফুল উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল সময়কে ঘিরে। উত্তাল রাজনীতির সেসব যুবকের বাংলাদেশের এক মফস্বল শহর যশোরেও কর্মব্যস্ত। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অধ্যাপক সুগত সাথে যোগাযোগ ঘটেছে ব্রিটিশ প্লেনচালক পিটারের। সাম্যবাদের বিশ্বনন্দিত মতবাদের পিটারও সুগতদের সাথে একই কাতারে উপস্থিত। পারিবারিক নৈকট্যে পিটার চলে আসে সুগতর পরিবারে নেমে তমস এক স্তদ্ধতা।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শুরু থেকে পঞ্চাশ দশকের প্রথম বছরগুলো পর্যন্ত বাংলা অঞ্চল অতিক্রম করেছে কঠিন এক সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় হাঁসফাস বাঙালি জীবন যার সাথে যুক্ত রয়েছে ধুরন্ধর রাজনীতি। সর্বশেষে মন্বন্তর-দাঙ্গা-দেশভাগ এবং উদ্ধাস্ত সমস্যায় কন্টকিত এমন একটি কঠিন সময় হয়তো বাঙালি আর কোনদিনই অতিক্রম করে নি। এবং উল্লেখ্য যে এসবের ভেতরের দেশের প্রগতিশীল সিংহাভাগ মানুষ সেকালে যুক্ত হয়েছিল তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের আন্দোলনে। এ আন্দোলন স্বদেশী পার হয়ে সাম্যবাদরে পথে তেভাগ্য ও হাজং বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই সমকালের এই উত্তুঙ্গতা সামগ্রিকরূপে বাংলা কথাসিহিত্যে প্রয়োজনানুযায়ী উপস্থাপিত হয় নি। সে সময়ের সাথে সমকালীন লেখকদের সম্পৃক্ততা কম থাকায় বা পরবর্তীকালে সে সময়কে ইতিহাস পাঠের ভেতর দিয়ে আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমাদের উপন্যাস বঞ্চিত হয়েছে। সামান্য যে কয়েকটি প্রচেষ্টা হয়েছিল তার মধ্যে সাবিত্রী রায়ের অন্ততপক্ষে পাকা ধানের গান উপন্যাসটির নাম অন্যতম হিসেবে গণ্য হতে পারে। অথচ রাজনীতির নিমর্ম দৃষ্টির বাইরে। বাংলার সামাজিক-ধর্মীয় লৌকিক সমাজকে রাজনীতির বিশ্লেষণে স্পষ্ট করে সাবিত্রী রায় তাঁর উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। নারী হয়েও ঘরে বন্দী থাকেন নি। তাঁর প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা বিপুল বিস্তার লাভ করেছিল। সন্দেহ নেই সাবিত্রী রায়ের সাহিত্য নতুন মূল্যায়নের দাবী রাখে।
অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. শতবর্ষের কৃতী বঙ্গনারী, শামলী গুপ্ত (সম্পা), কলকাতা, ২০০১।
২. প্রগতির পথিকেরা, ১৯৩৬-১৯৫০, দেবাশীষ সেনগুপ্ত (সম্পা.), কলকাতা, (প্রকাশকাল অনুল্লেখিত)।
৩. বাংলা কথাসাহিত্যের একাল, ১৯৪৫-১৯৯৮, বীরেন্দ্র দত্ত, কলকাতা, ১৯৯৮।
৪. পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার উপন্যাস (১৯৪৬-১৯৭১), শাহীদা আখতার, ঢাকা, ১৯৯২।
৫. বাংলা উপন্যাস ও তার আধুনিকতা, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, কলকাতা, ২০০০।
টীকা:
- সাবিত্রী রায়ের নির্বাচিত রচনা সংকলন (কলকাতা, ১৯৯৯) এর শুরুতে ব্যক্তিমানুষ সাবিত্রী রায়, পৃ. ১৫, শিরোনামে কন্যা গার্গী চক্রবর্তী একথা লেখেন। ↩
- প্রাগুক্ত, দ্রষ্টব্য, ‘সাবিত্রী রায়ের গ্রন্থপঞ্জি অংশ’ পৃ. ১৩১-১৩২। ↩
- ত্রিসোতা, সাবিত্রী রায়, কলকাতা দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংষ্করণ, ১৯৬১, পৃ. ৮১ তে এমন স্পষ্ট প্রতুল। ↩
- স্বল্পায়ু সুলেখা সান্যালের জন্ম ফরিদপুর জেলার কোঁড়কদি গ্রামে। প্রথম ছোটগল্প ‘পঙ্কতিলক’ ১৯৪৪ সালে অরণি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সে অর্থে বিবেচনা করা যায়, সাবিত্রী রায় থেকে দশ বছর বয়ঃকনিষ্ঠ হয়েও সুলেখা সান্যাল সাহিত্যচর্চা শুরু করেন একই সময়ে। প্রথম উপন্যাস নবাঙ্কুর ও ছোটগল্প সংকলন সিঁদুরে মেঘ যথাক্রমে ১৩৬২ ও ১৩৬৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশ পায়। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত এ ধীমতী লেখিকা ১৯৫৯ সালে মস্কো যান চিকিৎসার জন্য। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস দেওয়াল পদ্ম (১৯৬৪)। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০। ↩
- সাবিত্রী রায়ের নির্বাচিত রচনা সংকলন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩ দ্রষ্টব্য। ↩
- স্বরলিপি, সাবিত্রী রায়, কলকাতা রত্না প্রকাশণ সংস্করণ, ১৯৯২, পৃ. ০২। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ০৩। ↩
- সুজিৎ সোম, ‘ভূমিকা’, ‘স্বরলিপি’, প্রাগুক্ত, পৃ. iii। ↩
- স্বরলিপি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫। ↩
- প্রাগুক্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪। ↩
- প্রাগুক্ত, ২৩-২৪। ↩
- প্রাগুক্ত, ২৩৭-২৩৮। ↩
- প্রাগুক্ত, ২৯৩। ↩
- প্রাগুক্ত, ২৯৯। ↩
- প্রাগুক্ত, ১৩৪। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১০-৩১১। ↩
- সুজিৎ সোম, প্রাগুক্ত, পৃ. ii। ↩
- সৌরীন ভট্টাচার্য, স্বরলিপি: স্বগত কথন, পরিকথা (সম্পা. দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়), দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা (পশ্চিমবঙ্গ), মে, ২০০০ পৃ. ১৫৬-১৫৭। ↩
- সুকুমারী ভট্টাচার্য, সাবিত্রী রায়ের উপন্যাস, চতুরঙ্গ, (সম্পা. নীরা রহমান), কলকাতা, বর্ষ ৫৩, সংখ্যা ০৮ (ডিসেম্বর ১৯৯২), পৃ. ১৫৫। ↩
- দ্রষ্টব্য ৫, বিনতা রায় চৌধুরী, পঞ্চাশের মন্বন্তর ও বাংলা সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ০৫। ↩
- মুদ্রণ বিভ্রাটের কারণে মধ্যপর্ব প্রকাশে বিলম্ব ঘটেছিল বলে জানা যায়। ↩
- এ উপন্যাসটি অবলম্বনেই পরবর্তীকালে খ্যাতিমান চিত্রনির্মাতা মৃণাল সেন একটি ছবি তৈরি করেন। ↩
- বাঙালি ঔপন্যাসিক ভবানী ভট্টাচার্যের জন্ম বিহারে। লিখেছেন ইংরেজিতে। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলো হল: So Many Hungers! (১৯৪৮), Music for Mohini (১৯৫২), He Who Rides a Tiger (১৯৫৪), A Goddess Named Gold (১৯৬০), Shadow from Ladakh (১৯৬৬) ইত্যাদি (দ্র. Who’s Who of Indian Writers: : 1983, Shahitya Akademi, New Delhi, ১৯৮৩, পৃ. ৭৫ এবং Larousse Dictionary of Writers, New York, ১৯৯৪, পৃ. ৯৩। ভবানী ভট্টাচার্যের So Many Hungers! সুভাষ মুখোপাধ্যাযের অনুবাদে কতক্ষুধা নামে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। (দ্র. বিনতা রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৫)। ↩
- পার্থপ্রতিম বন্দোপাধ্যায়, ‘তেভাগার উপন্যাস: দু-একটি মন্তব্য’, দিবারাত্রির কাব্য (সম্পা. আফিফ ফুয়াদ), কলকাতা, ৬ষ্ঠ বর্ষ ২য় সংখ্যা (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৯৮), পৃ. ৫৭। ↩
- সাবিত্রী রায়ের নির্বাচিত রচনা সংকলন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৪। যদিও অখণ্ড সংস্করণে সংযোজনের কোন ব্যাপার ঘটেছে বলে বর্তমান আলোচকদের মনে হয় না। কেননা গ্রন্থটির দ্বিতীয় পর্বের (আলাদা আলাদা গ্রন্থে পর্বে সম্ভবত ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত। গ্রন্থটিতে কোন সাল উল্লেখ নেই। তাছাড়া আলাদা আলাদাভাবে মুদ্রিত পর্বগুলির নতুন মুদ্রণের কোন সংবাদও জানা যায় না) সাথে অখণ্ড সংস্করণের কোন সংকোচন দৃষ্টিগোচর হয় নি। ↩
- সাবিত্রী রায়, পাকা ধানের গান (অখণ্ড), কলকাতা, প্রথম সংস্করণ, ১৯৮৬, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯০, পৃ. ৬৪৮। ↩
- সাবিত্রী রায়, পাকা ধানের গান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪৭। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৭। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৯। ↩
- এ অনুমানের ভিত্তি অমলেন্দু সেনগুপ্তের উত্তাল চল্লিশ: অসমাপ্ত বিপ্লব (কলিকাতা, ১৯৮৯), গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে (পৃ.২৯) সাবিত্রী রায়ের স্বামী শান্তিময় রায়ের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় কম্যুনিস্ট পার্টি একসময় শান্তিময় রায়কে যশোরে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেয়। সেখানে ক্লাইভ ব্রাইসনসহ আরও অনেক বিদেশী সৈনিকই সেসময় ভারতবর্ষের ফ্যাসীবিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন পরে এদের দুজন মারা যান; যাদেরকে যশোরে কবরস্থ করা হয়। ↩
- ১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারী তারিখের নিউ এজ পত্রিকা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন প্রভাত মুখোপাধ্যায়। ↩
- পাকা ধানের গান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩ ↩
- প্রাগক্ত, পৃ.১২১-১২২। ↩
- ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির ডাকে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বিনা বিচারে বন্দী মুক্তির দাবি নিয়ে যে মিছিলটি বেরিয়েছিল তাতে পুলিশের হামলা হলে বন্দুকের গুলিতে যে চারজন মহিলা কর্মী মৃত্যুবরণ করেন তাঁরা হলেন: লতিকা সেন (জন্ম ১৯১৩), প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায় (জন্ম ১৯১৭), অমিয়া দত্ত (জন্ম ১৯১৮) এবং গীতা সরকার (জন্ম ১৯২২)। ↩
- ত্রিসোতা, প্রাগুক্ত, এর প্রকাশক পরিচিতি পৃষ্ঠায় ‘লেখিকার অন্যন্য গ্রন্থ’ তালিকায় যন্ত্রস্থ এ গ্রন্থটির নাম দেয়া হয়েছিল পদ্মা-মেঘনা। ↩
- পাকা ধানের গান, প্রাগুক্ত, পৃ.৩২। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ.৫০। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ.৫২-৫৬। নীল সন্ন্যাসীদের একটি গান এমন:
সত্য ত্রেতা ছাপরেতে
ছিল না মা পাশ।
মা-মা-মাগো।
নন্দীরে কয় যাও কৈলাসে
নীল হবে না বিনা পাশে রেখো মা তোর চরণ তলে
তোমার অনন্ত নীলে। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ.৫৮। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫। মাঘমণ্ডলের ব্রততে আছে –
উঠ উঠ সূর্য ঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া
না উঠিতে পারি আমি ইয়লের লাগিয়া
ইয়লের পঞ্চাশটি শয়রে থুইয়া
উঠিবেন সূর্য কোনখান দিয়া
উঠিবেন সূর্য গোয়ালবাড়ির ঘাট দিয়া। ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ.১৬৩। তোষলা ব্রতের একটি ছড়া হল –
কোদাল কাটা ধান পাব
গোয়াল আলো গরু পাব
দরকার আলো বেটা পাব
সঙা আলো জামাই পাব
সেজ আলো ঝি পাব
আড়িমাথা সিঁদূর পাব
ঘর করব নগরে
মরবো গিয়ে সাগরে
তোমার কাছে মাগি বর
স্বামীপুত্র নিয়ে যেন সুখে করি ঘর ↩
1 Comments
এণাক্ষী মজুমদার
ভালো লেখা। কেউ যদি সাবিত্রী রায়ের সাহিত্যকৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে চায় এ লেখা পড়া তার পক্ষে অনিবার্য হবে। এটা দুর্ভাগ্য যে এঁর কথা বাঙালি পাঠক জানে না, জানার চেষ্টাও নেই।