বিংশ শতাব্দীর আশির দশকটি কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্তের (জন্ম ১৯৪৭) জন্য ছিল উৎপাদী একটি কাল। শতাব্দীর শেষ দশকটিতে অতলান্তিক মহাসাগরের অপর পাড়ে অস্থায়ীভাবে স্থায়ী হয়ে গেল তাঁর বাস। নতুন শতাব্দী তাঁকে যখন ফিরিয়ে আনল নিজভূমিতে তাঁর হাত ভারাক্রান্ত সুদীর্ঘ অভিনব এক উপন্যাস ‘জন্ম জন্মান্তর’-এর পাণ্ডুলিপিতে। যুগান্তকারী সে উপন্যাসটির প্রকাশ শেষ করে (২০০০ সাল) আবার তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রচনাকর্মে ফিরে গেলেন। ২০০৩-এর বইমেলায় প্রকাশিত হল জীবন ঘনিষ্ঠ উপন্যাস ‘দ্রাবিড়’ গ্রাম। একবিংশ শতাব্দীর রচনাকর্মকে যদি হরিপদ দত্তের দ্বিতীয় পর্ব বলে চিহ্নিত করা যায় তবে সেই আশির দশকটি তাঁর প্রথম পর্ব যখন হরিপদ তাঁর অভিজ্ঞতা-নিঃসৃত গ্রামীণ বাস্তবতায় একের পর এক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস প্রকাশ করে চলেছেন। গ্রামীণ লোকজীবন তাঁর পরিপ্রেক্ষিত; কিন্তু সে প্রেক্ষিত রাজনৈতিক আলোকপাত তাঁর মজ্জাগত। ‘সূর্যের ঘ্রাণে ফেরা’ (১৯৮৫) এবং ‘জোয়াল ভাঙার পালা’ (১৯৮৫) গল্পগ্রন্থ দুটি দিয়ে মকসো করতে করতে তিনি ক্ষীণতনুর উপন্যাস ‘ঈশানে অগ্নিদাহ’ (১৯৮৬) রচনায় অগ্রসর হলেন যার স্বল্পপরটই প্রকাশ পেল একই ভঙ্গীমার আরও একটি উপন্যাস ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’ (১৯৮৭)। ইতোমধ্যে ‘রুদ্ধ দূয়ারে হাত’ (১৯৮৬) প্রকাশিত হলেও ক্রম অগ্রসরমান সে দশকটিতেই হরিপদ লিখলেন ‘অজগর’ যা বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হলো উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড। দীর্ঘ এ কাহিনীর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পায় ১৯৯১-এ এবং উল্লেখ্য ১৯৯৫-এ দুটি খণ্ডই দ্বিতীয় সংস্করণ পায়। ২০০২-এ অখণ্ড সংস্করণ হিসেবে উপন্যাসটির প্রকাশ বাংলা উপন্যাস পাঠকের রুচিকেই নির্দেশ করে। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা হরিপদ দত্তর প্রথম পর্বের উপন্যাস নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করবো।
‘ঈশানে অগ্নিদাহ’ শ্রেণী সংগ্রামের উপন্যাস। উপন্যাসটির ভেতর দিয়ে লেখক গ্রামীণ কৃষিজীবী সাধারণ মানুসের নির্যাতিত হওয়ার কাহিনীকেই তুলে ধরেছেন; কিন্তু সর্বোপরি তাঁর আরাধ্য আরও অগ্রবর্তী। ঔপন্যাসিক নির্যাতন, নিষ্পেষণের ভেতর দিয়ে সেই জনসাধারণের জেগে ওঠার কথা বলেছেন। আর হরিপদ দত্তের জন্য যা যা সহজাত তাহলো গ্রামীণ, অন্ত্যজ সমাজের ভাষা ও প্রেক্ষিতে তিনি সফলভাবে তাঁর স্বপ্নকে চরিতার্থ করেছেন উপন্যাসের ভেতর দিয়ে। আর তাই হয়তো ড. আহমদ শরীফ দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিলেন:
বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে আর্থসামাজিক শোষণ-বঞ্চণার একজন নতুন রূপকারকে, সমাজ পরিবর্তনের একজন সংগ্রামী নতুন কর্মীকে, গণমত সংগঠনের একজন উৎসাহী নতুন প্রচারককে, সর্বোপরি সমকালীন জীবনে ও জীবিকার একজন শিল্পচিত্রীকে ও একজন সফল শিল্পীকে প্রত্যক্ষ করলাম। 1
‘ঈশানে অগ্নিদাহ’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আবদুল্লা। বাবা জমির আলী ও মা ফুলবিবি। কৃষিকাজ করে তার সংসার চালানো দায়; তাই আবদুল্লা বেছে নিয়েছে ব্যাঙ ধরাকে সহ-পেশা হিসেবে। ‘ব্যাঙ খাওয়া হারাম’ এবং ‘ব্যাঙ ধরতে সাপের কামড়ের সম্ভাবনা’ দুটো বৈপরীত্যকে মাথায় নিয়েই আবদুল্লা বৃষ্টির রাতে ক্ষেতে যায় যেভাবে অনেক গ্রামীণ মানুষেরই পিঠ-ঠেকে যায় দেওয়ালে। যদিও তার ভালবাসা অনেক উঁচুতে – মোড়ল কন্যা সাবিহার সাথে।
কিন্তু ঐ মোড়ল রজব আলীই তো আবদুল্লাদের সকল অগ্রগতির অন্তরায়। বর্ষার পানি আসলে মোড়ল নিজের ক্ষেত বাঁচাতে সড়ক কেটে পানি সরাতে দ্বিধা করে নি। আর তাতেই আবদুল্লা-কুতুবউদ্দিনদের জমির ধান যায় ভেসে। তাছাড়াও মোড়ল কথা দেয় শীতের ইরি মরসুমে শ্যালোর পানির দাম নেবে অর্ধেক তাও ফসল তোলার পর।
ইতোমধ্যে সাবিহার বিয়ে ঠিক হয় হেলালের সাথে যে কিনা নেশাখোর আর বদ চরিত্রের লোক হিসেবেই পরিচিত। কথা হয় বিয়ের রাতে সাবিহা চলে আসবে বাঁশবাগানে, হাত ধরে পালাবে দুজনে। আবদুল্লা আসলেও সাবিহা আসে না। ভবিষ্যৎ ক্ষুধার চিন্তা তার চেতনাকে করে ছিন্নভিন্ন। এভাবেই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেন হরিপদ দত্ত যে প্রেক্ষি উজ্জ্বলতর হয় গ্রামীণ ছড়া, প্রবাদ এবং চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে।
আবদুল্লার বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি কিন্তু ক্রমাগতই তীব্রতর। প্রথমে জমির ফসল, তারপর প্রেমিকা, তারপর পানি; কেননা শীতে তার কাছে পানি চাইলে সাফ জবাব ‘ট্যাহা ফ্যালা, পরে পানির দাম নে’। ওরা সিদ্ধান্ত নেয় মোড়লের বিরুদ্ধে সালিশ বসাবে আর তার দায়িত্ব দেয় সবচেয়ে সাহসী জোয়ান ফতে আলী আর সোবাহানের হাত অথচ দুর্ভাগ্য এমনই ঐ দুইজনের ক্ষেত স্যালোর পানিতে টলটল, আর তাই সালিশ বসে না। ইতোমধ্যে বিনাদোষে মজিদের জেল হয়। বহুকষ্টে পুরান মেম্বার গেদু ভূঁইয়াকে দিয়ে তদ্বির করিয়ে মজিদকে বের করে আনলে তখন সে আগুনের ফুলকি, চাপ দেয় ওদের ‘গরীবের দল বানা, লড়াইয়ের দল।’ আর তারই শাস্তিস্বরূপ একরাতে কালা মাতব্বরের বাড়িতে ডাকাতির অভিযোগে মজিদের চোখ তুলে নেয় হেলাল মাতব্বরের লোকেরা। এভাবেই তো পিছন ফিরতে ফিরতে পিঠ দেয়ালে। ইতোমধ্যে মোড়লের জায়গা নেয়া শুরু করেছেন হেলাল নিজে। দখল করতে থাকে সাধারণ কৃষকের জমি। আবদুল্লাও ঠেকাতে পারে না নিজেরটুকু। ‘কিছুতেই সে এই ক্ষেতের চাল পেটে যেতে দিতে পারে না হেলালের’ এই প্রতিজ্ঞাতে রাত্রে দা নিয়ে বেরুলেও শেষমেষ ফিরে আসে হেলালের দরজা থেকে। মাথাটা উতলা করে দেয সাবিহার বাবনা। সবাইকে নিয়ে মোড়ল-চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করলেও তা যেন আর হয়ে উঠে না। কিন্তু হরিপদ দত্ত আশার বাণী দিয়েই তাঁর উপন্যাসের সমাপ্তি টেনেছেন। যেদিন রাতে হেলালের লোকজন এসে কুতুবকে খুন করে আর ওর স্ত্রীকে, বলাৎকার করে মেরে রেখে যায়। সকালে পুলিশ এসে হেলালের প্ররোচনাতেই সেই কেসের আসামী করা হয় আবদুল্লাকে। পুলিশ আবদুল্লাকে নিয়ে একপথে চলে যাচ্ছে আর অন্যদিকে আমরা দেখি ঝাঁক ঝাঁক মানুষ ঘিরে ফেলেছে মোড়লবাড়ি, হেলাল হয় সুড়কিবিদ্ধ, ওর গোলাঘরে লাগে আগুন।
হরিপদ দত্ত তাঁর উপন্যাসের নির্মাণ করেন খাঁটি গ্রামীণ সমাজের প্রেক্ষাপটে আর তাই গ্রামীণ ছড়া, প্রবাদ, আর চিত্রকল্পে সারা উপন্যাসটি ভাস্বর হয়ে থাকে। লোক উপাদানের এমন ব্যবহার হরিপদ দত্তের পরবর্তী উপন্যাস ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’-এ আরও বেশি প্রোজ্জ্বল। শুধু তাই না, পলাম-নরসিংদীর প্রেক্ষাপটে স্থাপিত এ উপন্যাসের কাহিনী ধারণ করেছে সে-অঞ্চলের আমজনতার ভাষাকেও। শুধু পাত্র-পাত্রীর মুখে নয় ঔপন্যাসিকের বর্ণনাতেও সে-ভাষা প্রযুক্ত। হরিপদ দত্ত তাঁর ভাষার এ খেলা ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’-এও বহাল রেখেছেন, যদিও ‘অজগর’-এ বিবরণকারীর ভাষাটি ভিন্ন হয়েছে, সে উপন্যাসটির প্রেক্ষাপটও একই অঞ্চল হওয়া সত্বেও। পরবর্তী উপন্যাস অন্ধকূপে জন্মোৎসবও একই গ্রামীণ জীবনকে আশ্রয় করে রচিত হলেও, এটি অভিনবত্বের নিরীখে তত উল্লেখযোগ্য নয়। ১৯৮৬-তে বাংলা একাডেমীর ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এ উপন্যাস কৃষিজীবী সমাজের একতাবদ্ধ হওয়ার কাহিনী, যে কাহিনীতে সুতো হিসেবে হরিপদ ব্যবহার করেছেন হাসান ও রুবীনার প্রেমকে এবং সে কাহিনী হরিপদ স্থাপন করেছেন হাজারো লোককাহিনী ও ছড়ার গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির প্রেক্ষাপট, যেখানে ব্যবহৃত শতশত প্রতীক ও চিত্রকল্পও হরিপদ গ্রহণ করেছেন গ্রামীণ-ঐ সমাজ থেকেই।
প্রথমেই উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাসের প্রতি আলোকপাত করা যেতে পারে। সন্ধ্যার পর হাসান নামের যুবক কৃষকটি অপেক্ষমান রুবীনার জন্য, যে রুবীনা একই গ্রামের আলীজানের মেয়ে এখন শহরে থাকে; গার্মেন্টসের চাকরি করে। ঢাকা থেকে ফেরা, প্রতি সপ্তাহেই রুবীনা গ্রামে ফেরে, তার গল্প, গল্পের বিষয় হাসানের মনকে ভেঙে চুরে দেয়। দিয়াশলাই তুলে আগুন জ্বালিয়ে হাসান চমকে ওঠে ‘লাল শাপলা থিকথিক করছে ঠোঁট জোড়ায়। ও কি মেয়ে মানুষের ঠোঁট? শাপলা হতে যাবে কেন? এক জোড়া পাকা লঙ্কা’। 2 হাসান বুঝতে পারে শহুরে সংস্কৃতি ও টাকার ধাক্কায় বদলে যাচ্ছে রুবীনা দ্রুত। আর তাই পরদিনই কসম খায় ‘ধান খাইয়া ছাড়বে মুরগিটাকে। ধান খাইলে মুরগি যাইব কৈ?’ আর তাই পরিকল্পনামাফিক ইচ্ছাপুরণ করলেও হাসান কিন্তু পারে না রুবীনাকে ধরে রাখতে। সেই রুবীনাকে অতসীপাড়ায় আমরা আবার দেখি যখন রুবীনাকে তার মা’রও অবিশ্বাস; কিন্তু তাদেরকেও তো মানতে হয় রুবীনাই তাদের পোলা, ক্ষেতও নাই তাদের আর তাই রুবীনাকেই আয় করতে হবে তার বাবা-মার জন্য এবং সে পরিচ্ছেদেই আমরা জেনেছি শহরে গার্মেন্টসের আপা তাকে শিখিয়েছে অনেক টাকা আয়ের যাদুর মন্ত্র। হাসানের কথা তার মনে হলেও সেই বড় আপাই তাকে ধিক্কার দিয়েছে ‘চাষার পোলার ভালবাসা?’ বলে। আর এভাবেই রুবীনর নামতে নামতে কোথায় যে নেমে গেছে! হাসান বুঝে গেছে ওদের দুজনেন বিয়ে বোধহয় হবার নয়। তবুও একদিন জোর করে ওর কাছে যখন মনের কথা জানতে চায় রুবীনা বলে: ‘হাসান ভাই, আমি বাসি হইয়া গেছি, আইটা হইয়া গেছি। নাপাক গতর লইয়া ক্যামনে ঘর করমু তুমার?’ 3 না উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি রুবীনা ফিরে এসেছে – এসেছে তার হাসানের কাছে। তার শেষ কথা ‘আর ঢাকা শহরে যামু না।’ 4 হাসান-রুবীনার কাহিনীর ভেতর দিয়ে ঔপন্যাসিক গ্রামীণ মানুষের নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা যেমন বলতে চেয়েছেন, তেমনি তাদের ভালবাসার ঐকান্তিকতাকেও উপস্থাপন করেছেন। অধিকন্তু তাদের এই ভালবাসার কাহিনীর ভেতর দিয়ে গ্রামীণ জনগণের জেগে ওঠার, বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কাহিনী শুনিয়েছেন হরিপদ নিপূণ হাতে।
যে কৃষক যূথবদ্ধ হয়, হয়ে বিদ্রোহী চৈতন্য অর্জন করে সে কৃষক দারিদ্রের চূড়ান্ত কশাঘাতে জর্জরিত। অভাব তার পুরোটা জুড়েই এবং আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শাসনযন্ত্রের দু’নম্বরী তার বুঝতে বাকি থাকে না। সেই কৃষকই তো হাসান; হাসানের সাতে আরও অনেকে। কী আছে ওদের? খাদ্যাভাবতো চিরকালীন। অর্থাভাবে হালচাষ বন্ধ হওয়ার উপায়। ঐ যে চেয়ারম্যান, মেম্বার, তারা তো সবসময়ই শকুনের মতো চোখ দিয়ে আছে ওদের সামান্য জমি আর বলদের দিকে। সামাজিক ঐ প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় ‘ঈশানে অগ্নিদাহ’-র সাথে ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’-এর সাযুজ্য পাওয়া যায়। কিন্তু কামলাদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে যে জোট তা সত্যিই দুর্লভ। কৃষকদের সে-যূথবদ্ধতায় নেতৃত্ব দেয় কৃষক-সন্তান শহরে কলেজ পড়–য়া ফরিদ আলী, হাসানের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। আর তাইতেই ‘শিবপুরে ডাকাতি করতে গিয়ে বলাৎকারী’র অভিযোগ গ্রাম রক্ষীদল হাসানকে ধরে আনে চেয়ারম্যানের অফিসে। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের যৌথ উদ্যোগে হাসান খায় অমানুষিক প্রহার। কামলার মজুরি বৃদ্ধির দাবি হাসান আর তুলবে না এই নাকে খত দিয়ে, সিগারেটের আগুনে ওর লিঙ্গ পুড়িয়ে তবে ওকে ছেড়ে দেয় ওরা। ছাড়তে না ছাড়তেই ওর পক্ষের জনা পঞ্চাশেক লোক হাজির। কিন্তু প্রতিআক্রমণে হাসান নারাজ। অভিমান ওর, সহযাত্রীর কেন যথাসময়ে আসেনি। দেরী হবার কারণ বুঝতে রাজী নয় সে। কিন্তু তাই বলে নিঃশেষ হয়ে যায় না ওদের সমিতি – ঢল-বষ্টির দিনে আবার মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলে ওরা। মেম্বারের শত অনুরোধেও ওরা তার জমির ফসল তুলতে রাজী নয় সে – যে ফসল বানের পানিতে ডুবে যাবে খানিক পরেই। মেম্বার তো বসে থাকে নি; পারুলিয়া থেকে কামলা নিয়ে আসে। আর তখন্ হাসানদের হুঙ্কার: ‘খবরদার। একটা কাঁচিও নামতে পারবে না ইরি ক্ষেতে। লৌয়ের দরিয়া অইব শালকো বিল।’ 5 পরে মেম্বার থানা থেকে পুলিশ নিয়ে আসে; কড়া পড়ে হাসানের হাতে। এবার কিন্তু তাতেও দমে না হাসানের দলের লোকজন। মেম্বারের এগারো বছরের ছেলেটাকে গায়েব করে ওরা। ওদের দাবি ‘থানা থাইক্যা আগে ছাড়াইয়া আনেন হাসানের। সাবধান পুলিশ আনলে জিন্দা পোলা লাশ হয়ে ফিরব।’ 6 শেষ পর্যন্ত হাসান ফিরে আসে, দেখে ডুবে যাচ্ছে বেবাক ইরি ক্ষেত, মেম্বারের গোলা ঘর।
গ্রামজ চিত্রকল্প এবং তুলনা-সৃষ্টি হরিপদের মজ্জাগত। ‘ঈশানে অগ্নিদাহ’ থেকেই তাঁর এ উপাদান উদ্ভাসিত, ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’-এ সেসব যেন আরও বেশি শিল্পরসোত্তীর্ণ। সে সাথে কত না লোককাহিনীর সমাহরি তিনি ঘটিয়েছেন। আছে গ্রাম্য ছাড়া আর প্রবাদ। বাংলা কথাসাহিত্যে আর কোন ঔপন্যাসিক লোকজ উপাদানের এমন সফল ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়েছেন কি না সন্দেহ। প্রথমে চিত্রকল্প ও তুলনা প্রসঙ্গ:
ময়াল সাপের খড়খড়ে খোলস। খাল তো নয়। (৯)
পৌষের দাঁতাল রাত। (১১)
ঠোঁটের ফাঁকে সে কি দাঁত। খলুইয়ে আটকা জ্যান্ত পুঁটি মাছের তাল-বেতাল লাফালাফি (১৪)
অন্ধকারে কাঁকড়া গর্তে বাসা বাঁধা শিং মাছের মত খল খলিয়ে ওঠে হাসানের গলা (”)
সূরুযহীন বিহানে ঝাঁপ ঠেলে বাইরে এলেই তাকে কপ্ কপ্ গিলে খায় দানব কুয়াশা। (১৬)
বৈশাকে হঠাৎ ঢল নামা এক হাঁটু পানির খালে আটকা পড়া কই মাছেরমত বেহুঁশ ইচ্ছেটা পানি ছেড়ে বৃষ্টি ভেজা মাঠে গড়াগড়ি খেয়েছিল অজানা জলাশয়ের খোঁজে। (১৭)
পূবের আমলকী গাছটার মাথায় রুবীনার কপালের লাল টিপের মত লটকে থাকে সূরুয। (ঐ)
পুরানো দিনগুলোতে অতটুকু খাঁচা খেলো তো কলাগাছের শরীরের কষের মত চোখ বেয়ে নামতো পানি। (১৮)
হাতের তালুর রঙ। তুলতুলে লাউফুল। (ঐ)
বনতুলসী পাতার মত ফ্যাকামে রুবীনার মুখ (১৯)
কাদার তলায় চাপা পড়া কুঁচে মাছটা মোড়ামুড়ি দেয় তার বুকের ভেতর… (৩০)
ছেলের হাতে লাঙ্গল তুলে দেয়ার আগে বুড়ো ফলার নিচে আটকে থাকা ঘাস-মাটির খুঁচিয়ে বের করে আনে দাঁতের ফাঁক থেকে পানের ময়লা বার করার মত। (৩৪)
বোধ করি নিজের ফুরিয়ে আসা জিন্দেগীর কথা দিলের ভেতর উঁকি দেয় বিলের পানিতে সাপের জিহ্বা বের করার মত। (৪২)
মা আম্বিয়া বিবির চোখ ভরতি সাপের তাড়া খাওয়া ব্যাঙের লাফালাফি। (৫১)
ওর নজর হাতে মেয়ের গতরে, উকুনেরা যেমনি চুপচাপ হাঁটে চুলের ফাঁকে ফাঁকে। (৫২)
রাত নামে আলীজানের চোখ ভরে। কুয়াশায় ডুবে যায় আম্বিয়া বিবির চোখ। (৫৩)
বিশাল এক সোনার অজগর হয়ে যায় সেই হার। (৫৬)
দুধরাজ সাপের ডিম রঙ জোছনায় বুড়োর চোখের ভেতর আসমান পোড়ে।… (১২৮)
বুড়ো কিয়ামত আলীর বুক ভরতি পাকা শিমুল ফুল। (১৪১)
ধূলের উপর দাগ ফেলে তাঁটা ‘ঘেন্টি সাপের’ মত মেম্বারের শুকনো ঠোঁটে হাঁটে কমরউদ্দিনের চোখ…। (১৪৪)
চিত্রকল্প ও তুলনাতে গ্রামজ উপাদানের এমন ব্যবহারের ফাঁকে ফাঁকে হরিপদ দত্ত মিশেল গিয়েছেন গ্রাম্য প্রবাদেরও। গ্রামীণ মানুষের মুখে মুখে যে প্রবাদ শালীনতা-অশালীনতার পার্থক্য থোতড়াই কেয়ার করে প্রকাশ পায় ঔপন্যাসিক তেমনভাবেই সেগুলোকে গ্রামীণ মানুষের ঠোঁটে উপস্থাপন করেছেন। এমন কিছু গ্রাম্য প্রবাদের উদাহরণ:
দুই দিনের মৌলবী না গামছারে কয় আচকান। (১৪)
কানা, খোড়া, ভেংগুড়, তিন শালার এক ল্যাংগুড়। (৫১)
জাতের জাত ঈমানের ঘোড়া, আপনা ঘরের জাউ থোড়া। (৫২)
যেমুন হউর বড়ি, তেমুন ওজু করি। (৭২)
হাগা নাই পুটকির বাঘা ডাক। (৯৪)
দশ ট্যাহায় সাউ কাতর এক ট্যাহায় শেখের চার বিরির ঘর। (১০৫)
এই বছর না সেই বছর যৌবন থাকে কয় বছর? (১০৭)
খাড়াইয়া মুতল মাগীর নাই লাজ, দ্যাখলমাগীর ঘোমটার সাজ। (১১০)
এই হাটে না ঐ হাটে, শরম বাঁচে কোন ঘাটে। (১১২)
পরের পুত, যম দূত। (১১৪)
বুড়ো আঙুল থুতু। (১১৬)।
বাড়ি জুইড়া ক্যাথা নাই পায়ের তলে তিন খাত। (ঐ)
কালকাল বসন্তকাল
ছাগলে চাটে বাঘের গাল। (১১৯)
হাতি যদি ফান্দে পড়ে চামচিকায় তার পুটকি মারে। (১২০)
নাচে পাছে দশ ভাই, যার ঝি তার জামাই। (১২২)
আপনা হাউড়ী সালাম না পায়, চাচী হাউড়ী ঠ্যাং বাড়ায়। (১৩৬)
অতি পণ্ডিতের ছিড়া কিতাব, অতি ছিনালের বড় নেকাব। (ঐ)
এমন কত যে প্রবাদ ছড়িয়ে আছে ১৫১ পৃষ্ঠার উপন্যাসটিতে। আরও আছে লোকছড়া। সামান্য লোকছড়ার সে সব উদাহরণ থেকে হরিপদ দত্তর গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতা মূর্ত হয়ে ওঠে। গ্রামীণ ছড়ার অল্প কয়েকটি আমরা এখানে উৎকলন করছি:
পানির আসন পানির বাসন
পানির সিংহাসন
বন্ধুর লাইগা পাইতা রাখছি
পরান ফুলের আসন। (১৯)
অথবা,
লাঙ্গল তাটিয়া করবি চাষ
ক্ষেতে ছড়াইবি গোবর ফাস
বৌ আনবি দুধাল মায়ের ঝি
ছাওয়ালের দুধের চিন্তা কি? (৩৫)
অথবা,
আগায় ধইরনা গো বাবা
আগায় করে থরথর।
গোড়ায় ধইরনা গো মা
গোড়ায় করে থরথর।
পিছনের শাড়ির লাইগা
সতিন-ঝি কি ছাড়ল ঘর? (৭৮)
হরিপদ দত্তর কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি তাঁর উপন্যাসের পরতে পরতে এমন সব গ্রামীণ ছড়ার সমাবেশ ঘটিয়েছেন গ্রামজীবন-কেন্দ্রিক তাঁর উপন্যাসের কাহিনীকে সজীব করে তুলেছেন। উপন্যাসে গ্রামীণ লোককাহিনীর ব্যবহার যে কোন উৎসুক পাঠককেই আকর্ষণ করে। ‘কৈবর্ত বৌ-এর কুমির হওয়ার কাহিনী’ (পৃ. ১০-১১), ‘ঢোঁড়া সাপের বিষহীন হওয়া’ (পৃ. ১১), ‘মেটেঘুঘুর কথা’ (২০), ‘কুটুম পাখির জন্মবৃত্তান্ত’ (পৃ. ২৩-৪), ‘পুতপুত পাখির জন্মকথা’ (পৃ. ৩৫), ‘সতিন ঝিকে খুন করে সৎ-মার ঘুঘু হওয়া’ (পৃ. ৭৭), ‘ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের পূর্ব বৃত্তান্ত’ (পৃ. ১১৫), ‘চৈতার বৌ-র পাখি হওয়া’ (পৃ. ৭৭), ‘চাতক পাখির পানি খেতে না পাওয়া’ (পৃ. ১৩৭) প্রভৃতি কাহিনীগুলো উপন্যাসের কাহিনীর মূল সুরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থাপিত হয়ে ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’ উপন্যাসটিকে একটি ভিন্ন মাত্রা দান করেছে সন্দেহ নেই।
তবে এসব কিছুকে ছাড়িয়ে ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’ উপন্যাসে যে মূল বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি হলো শ্রেণী সংগ্রামের লড়াইয়ে হাসানের জয়। মূল এই ভাবনাটি উপন্যাসের শিরোনামের সাথে সম্পর্কিত। চতুর্থ পরিচ্ছেদে লেখক সেই অন্ধকূপের সাথে পাঠকের পরিচিতি ঘটিয়েছেন। সে অন্ধকূপ অতসীপাড়ায় দোজকের কুয়ো বলে পরিচিত। বাপের মুকে শোনা সেই পাতাল ছুঁই ছুঁই কুয়োর কাহিনী এমন:
দেদার খোঁড়াখুঁড়ির বাদেও ওঠেনি পানি। এক রাতে জমিদার স্বপ্নাদিষ্ট হয় কোন এক মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তানকে কুয়োয় করতে হবে উৎসর্গ। তাই হলো। কোথা থেকে ধরে আনা হলো কাকবন্ধ্যা মায়ের পুত্র। তুলসী পাতা ধোয়া জলে স্নান করিয়ে নয়া কাপড় পরিয়ে ছেলেকে কুয়োর পাশে দাঁশ করাতেই পাতালে গমগম শব্দ তুলে বেরিয়ে আসে ঝকঝকে এক সোনার শেকল। সেই শেকল পেঁচিয়ে যায় ছেলেটার কোমরে। সড়সড় পাতাল নেমে যায় শেকল এবং সাথে সাথে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ। 7
সেই কুয়োকে ঘিরেই ঔপন্যাসিক নিজেও তাঁর কাহিনীর সমাপ্তি ঘটিছেন। উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে আমরা দেখি সারা ময়াল জুড়ে ছড়িয়েছে খবর: ‘অন্ধকূপ মানুষ চায়। জিন্দা মানুষ। সারা ময়ালে কথাটা তুফানের মত ছড়িয়ে পড়ে এক লহমায়। মানুষ চায়। মানুষের লৌ চায়। জোয়ান মরদের তাজা লৌ।’ 8 আর এমনি সময়ে অন্ধকূপের কাছে ফরিদ আলীকে মৃত আবিষ্কার করে হাসান, কমরউদ্দিনসহ অন্যান্যরা। ফরিদ আলী যে কিনা গ্রামের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে, দাবি আদায়ের আন্দোলনে শরিক করেছিল তার এই মৃত্যু মামুদ আলী মেম্বাররা জ্বিনের আছড় বলে চাপা দিতে চাইলেও দীর্ঘ অত্যাচারের শিকার হাসানের বুঝতে ভুল হয় না। আর তাই ‘আন্ধাইর কূয়া আর কত লৌ চায়’ হাসানের এ বাক্য অনুসরণ করে তার হাতে কোদাল যায় একটি শব্দে ‘মেম্বারের মাথাটা দুফালা তরমুজ’। আর সেই কোদালটা অন্ধকূপের পাড়ের ফণিমনসা গাছটার গোড়ায় ঢুকিয়ে মাটি টান দিতেই বেরিয়ে আসে একথোকা গোখরের ডিম যেগুলো ফেটে ফেটে বেরিয়ে পরে ছা। গ্রামের মানুষগুলোকে সেই সাপের ছায়ের মত দুশমন চেনার ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার আহ্বান দিয়েই শেষ হয অন্ধকূপে জন্মোৎসব। সন্দেহ নেই এটি একটি উৎকৃষ্ট উপন্যাস, কিন্তু যে ত্র“টি এ উপন্যাসটি অস্বীকার করতে পারে না তা হলো বক্তব্যগত প্রশ্নে এটিও এর পূর্ব উপন্যাস ঈশানে অগ্নিদাহ-এর সাজুয্য। তবে হরিপদ দত্ত তাঁর সকল পশ্চাঃপদতাকে অতিক্রম করে গিয়েছেন তাঁর পরবর্তী উপন্যাস ‘অজগর’-এ।
‘অজগর’ বঙ্গীয় এ অঞ্চলের মহাকাব্য। দীর্ঘ একটি কালকে কুশলী হরিপদ দত্ত তাঁর এ উপন্যাসে বিবৃত করেছেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শুরু হয়ে এ উপন্যাসের কাহিনী প্রবাহিত হয়েছে আশির দশক পর্যন্ত। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে সমকালীন এতদীর্ঘ একটি সময়কে বোধকরি আর কোন উপন্যাস ধারণ করে নি। তুলনীয় উপন্যাসের মধ্যে রয়েচে ‘সংশপ্তক’ (১৯৬৫), ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ (১৯৪৭) এবং ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (১৯৯৪-৬)। শহীদুল্লা কায়সার (১৯৩৬-১৯৭১) তৃতীয় থেকে পঞ্চম দশক পর্যন্ত, আবুজাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৮) দ্বিতীয় দশক থেকে ভারত বিভাগ, এবং সেলিনা হোসেন (জন্ম ১৯৪৭) ভারত বিভাগ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চিহ্নিত করেছিলেন সেগুলোর সবকটি থেকেই ‘অজগর’ সময-চিহ্নায়নের প্রসঙ্গে অগ্রবর্তী। সৈয়দ শামসুল হকের (জন্ম ১৯৩৫) ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ (১৯৯৮) দীর্ঘতর একটি সময়কে অবলম্বন করলেও তা লোককথা আশ্রিত বলে সে উপন্যাসটিকে আমরা বর্তমান আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করছি না।
অখণ্ড ‘অজগর’ উপন্যাসটির ভিতরের ফ্লাপে মুদ্রিত বাক্য ‘উপন্যাসটির বহির্বলয় রাজনীতি হলেও অন্তর্বলয় সামাজিক’ পাঠ করলে যে যে দুটি জিনিস সুস্পষ্ট হয়ে উঠে তাহলো উপন্যাসটিতে রাজনীতি ও সমাজ উভয়ই উপস্থিত, যদিও সরলরৈখিকভাবে বলয় ভাগের ব্যাপারটি অজগর এর প্রেক্ষাপটে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া এই দুটি বলয়ের ভেতর দিয়ে হরিপদ দত্ত যে মূল কাজটি করেছেন তা হলো এ অঞ্চলের মানুষের – তার চেতনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার বিকাশ ও অগ্রসরণ দেখিয়েছেন। দীর্ঘ আশি বছরের এক কালপরিক্রমায় ঔপন্যাসিক রাজনীতিকে ব্যবহার করেছেন মালার সুতোর মতো করে। সে সুতোতে ক্রমে ক্রমে তিনি গেঁথে গেছেন বাঙালি সমাজ ও তাঁ মানুষদের কথা যে কথা শেষ হয়েছে আশা-নিরাশার এক দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে। উপন্যাসের শুরুরকালে সামন্তবাদ-পুঁজিবাদের যে অজগরের খোলসমাত্র দৃশ্যমান, উপন্যাসের শেষেরকালে সে অজগর জয়নালের ব্রিফকেসের ভেতর। উপন্যাসের শুরুর সময়ে সে অজগরের অস্তিত্ব এমন:
বট গাছটার ধারে যেতেই বাপ-বেটাদের সমস্বরে চিৎকার। সামনে সটান পড়ে আছে বিরাট এক খোলস। অজগরের টাটকা খোলস। এই গজারি বনে যে অজগরের বাস একথা কেউ শোনেনি কোনদিন। অথচ এলো কি করে খোলসটা? গেল কার্তিকে গ্রামবাসীরা রাতের বেলা গজারী বনে শেয়ালের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল আচমকা। শেয়ালটা আর্তনাদ করে শেষে গোঙাতে গোঙাতে নীরব। কান পেতে শুনেছিল সবাই, সাহস হয়নি এগোতে। 9
ভয়ানক এ অজগরের অস্তিত্ব সারা উপন্যাস জুড়েই। সর্পিল গতিতে গা-হিম করা ভয়ানক এ সরীর্সপ সমাজ-রাজনীতি-জীবনধারা পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করেছে, আর আতঙ্কিত করেছে মানুষকে। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে প্রধান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত চরিত্র জয়নাল যে কিনা গণআন্দোলনের কাল থেকে বাংলা সমাজ বদলের পালার রাজনীতি সম্পৃক্ত, মুক্তিযোদ্ধা হয়েও যে কিনা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে হতাশ ও বিপর্যস্ত এবঙ সবশেষে জিয়াউর রহমানের শাসনকালে ক্ষুধা-পরিবার ও সমাজের আঘাতে ‘লাইসেন্স-পারমিটের’ কাছে নতজানু সে শহীদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ব্রিফকেস নিয়ে ফেলার পথে সে বাক্সটিতে আবিষ্কার করে সেই অজগর। গজারী বন ছেড়ে সে-অজগর এখন জীবনের সাথে ওতপ্রোত। ঔপন্যাসিকের বর্ণনায়:
ব্রিফকেসটা হাতে জয়নাল হাঁটে।… শূন্য ব্রিফকেসটা হঠাৎ তার কাছে মনে হয় কী ভীষণ ভারি। ডান হাতটা বুঝি ব্রিফকেসের ভারে ছিঁড়ে পড়ছে। তবে কি অজগরটা এই ব্রিফকেসের ভেতর? অন্ধকার পথে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ে সে। আর তখনই দু’ফাঁক হয়ে যায় ব্রিফকেসটা। রাতের অন্ধকারের চেয়েও কৃষ্ণবর্ণ বিশাল এক অজগর ব্রিফকেসটা থেকে বের হয়ে হা করে কামড়ে ধরে জয়নালের ডান হাতটা। 10
এবং এভাবেই প্রতীয়মান হয় হরিপদ দত্ত সরল সাদামাঠা গল্পের ভেতর দিয়ে তাঁর উপন্যাসের বিকাশ ঘটান নি। প্রতীকী এক আবহ বিচিত্রভাবে পুরোটুকু জুড়েই বর্তমান। আর সে বর্তমানবতার এক বিরাট অনুষঙ্গ রাজনীতি।
মোটা দাগে যদি এমন একটি মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়া যায় যে অজগর একটি রাজনৈতিক উপন্যাস তবে তাকে সর্বৈবভাবে সত্যকথন বলে ঐক্যমত্য পোষণ করতে কোন আলোচক দ্বিধা করবেন না। তবে একই সাথে এটি যে একটি সামাজিক উপন্যাস হিসেবেও সমান প্রকৃষ্ট সে আলোচনায় আমরা পরে আসছি। শুধু কি তাই! লৌকিক ঐতিহ্যের শব্দরূপ হিসেবেও কি অজগর সমান মনোযোগ দাবি করে না? কিন্তু এই যে সামাজিক বা লৌকিক অভিধাগুলো, তারা কি রাজনীতি বিবর্জিত? রাজনীতির ছায়া ও ছাপ কি শতাব্দীর পর শতাব্দী কাল ধরে আমাদের নিয়ন্তা নয়? কথাকার হরিপদ দত্ত তো দলের রাজনীতির কথা বলেন নি -তিনি বলেছেন দৈশিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক রূপরেখার কথা। ঔপন্যাসিক তো কোন বিশেষ রাজনীতির ভালোমন্দের কথা বলেন নি – বরং তাঁর অনুধ্যান বঙ্গীয় অঞ্চলে চলমান সামগ্রিক রাজনৈতিক বলয় ও সমাজজীবনে তার অভিঘাতের ফল। অথচ সে সবের পরও অজগর শুরু হয় আদম আলীকে দিয়ে যার আঙ্গুল ‘নাড়ার মত খরখরে’, যার অস্ত্র কোদাল আর আশ্রয় মাটি। অর্থাৎ হরিপদ মাটির মানুষ যে কৃষক, যে কৃষক বাংলার মাটিজাত তাকেই প্রধান করে তুলেছেন তার উপন্যাসে। তাছাড়া রাজনীতি ছাড়া কি সমাজ ও সময়ের উপন্যাস হয়? সংশপ্তক, পদ্মা মেঘনা যমুনা, গায়ত্রী সন্ধ্যা এদের কোনটাই কি রাজনীতি শূন্য উপন্যাস?
ঐ যে কৃষক আদম আলী তাঁর দৌলতেই জমিদার ও কাছারিবাড়ি – আদম যে কর্তাবাবুর জমি পত্তন নিয়েছে। আদম আলী বাপ-বেটারা মিলে যে খোলস প্রথম দেখেছিল তার উৎস ধরেই টোলের পণ্ডিত নিবারণ চক্রবর্তীর বিড়বিড় উচ্চারণ ‘অনার্য দেবী মা মনসার আবির্ভাব, পুজো হবে, দেবালয় হবে, নইলে রক্ষা নেই’। সে কৃষক আদম আলীতো সৈয়দ শের আলীরও শিকার কেননা তার ‘ডাককে হেলাফেলা করে কোন মুসলমান’। জমিদারের পেয়াদার ঢোলে খাজনার সাথে চার পয়সা বাজনার ঘোষণা ‘মা-মনসারে তুষ্টি না করলে কোপ-নজর পড়ব না বেবাক ময়ালে!’ যে শের আলী ঘোষণা দিয়েছিল ‘জমিদারের মনসা পুজোর বাঁদা দেয়া মুসলমানের জন্য নাজায়েজ কুফরী কাজ শেরকী গোনাহ’ সেই শের আলী মুহূর্তেই বদলে হয় নতুন মানুষ কেননা তার পরিবার অর গোষ্ঠীর জন্য অনার্য দেবালয়ের বাড়তি খাজনা মাফ। অথচ মাফ পায় না আকাইলা। আকালের বছর (১৮৯৬) জন্মে যে এই নাম ধারণ করেছে সে বৌ-ছেলেমেয়ের জন্য চুরি করেছে আদম আলীর বাড়ি ভাতের হাড়ি। হতভাগা সেই ভাত খেতে বা খাওয়াতেও পারে নি কাউকে কেননা ‘দৌড়ে পালিয়ে নিজের বাড়ির সীমানায় পৌঁছতে টাল সামলাতে না পেরে হাড়ি পড়ে ভেঙে ভাত ছড়িয়েছে উঠোনে। সেই ভাত চুরির শাস্তি জমিদার দীপেন চাটুয্যের ঘোষণা দশ বেত আর গলায় রশি লাগিয়ে সেই ভাতের পোড়া হাড়ি বেঁধে গ্রাম ধরে প্রদক্ষিণ। শাসিতের এ অবস্থা তো গ্রাম বাংলার শতাব্দীর চিত্র। যে শাসিত একসময় আকাইলা বা আদম আলী, সেই তো সাতচল্লিশের আগে পরের খালেক মিয়া আর একাত্তরের আগে পরের খালেক মিয়ার ছেলে জয়নাল। সে শাসিত তো সার্বক্ষণিকভাবেই রাজনীতির বলয়ে।
‘অজগর’-এ রাজনীতির এ অনুষঙ্গ ক্রমশ প্রকাশমান। সময়ের অগ্রসরণের সাথে সাথে তা তো একসময পুরো সমাজকেই গিলে খায়; আর তাই সময় যত অগ্রবর্তী রাজনৈতিক বোধ ও তার ব্যাপকতা তত বেশি বহুগ্রাসী। এবং সে জন্যেই মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, খেলাফত আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, স্বরাজ, কম্যুনিস্ট পার্টি, কৃষক সভা, জমিদার প্রথা বাতিল, ভোটাভুটি প্রভৃতি ব্যাপারগুলো ক্রমশ বেশি করে স্পষ্ট উপন্যাসটিতে। সেই দ্বিতীয় দশকে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস তো গ্রামের সাধারণ মানুসের কাছে ধরাছোঁয়ার বাইরের জিনিস; খেলাফত-স্বরাজ একটু বেশি যেন নড়াচড়া তুলেছিল; তবে স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের কর্মকাণ্ড জনমানসে আন্দোলন তুলেছিল অনেক বেশি করে যে জন্যে ক্ষুদিরাম গ্রামের মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত একটি নাম হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে কৃষক সভা, কম্যুনিস্ট পার্টির বিকাশ – বিপুল সংখ্যক দেশপ্রেমী মানুষ যারা একসময় স্বদেশী আন্দোলন করেছে, জেল খেটেচে তারাই তো যুক্ত হয়ে গেল সুদূর রাশিয়ার মতানুসারী ঐ দলটির কর্মকাণ্ডের সাথে। কম্যুনিস্ট পার্টির প্রথম দিককার এই ব্যাপারগুলো অনেক বেশি করে স্পষ্ট হয়েছে গুণময় মান্নার (জন্ম ১৯২৫) ‘লখিন্দর দিগার’ (১৯৫০) উপন্যাসে হরিপদ দত্ত যা সামান্য ছুঁয়ে এগিয়ে গেছেন তাঁর গন্তব্যের দিকে। সুলেখা সান্যালের (১৯২৮-১৯৬২) ‘নবাঙ্কুর’ (১৯৫৬)-এ যেমন অধীর কাকার স্বদেশী কর্মকাণ্ড করার কারণে জেল ফেরত হওয়ার পর কম্যুনিস্ট পার্টির ঐ রাজনৈতিক আদর্শের অনুগামিতা আছে তেমনি হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক আনন্দ বাগচীও। আনন্দ বাগচীদের রাজনৈতিক ওতপ্রোততাই হয়তো বাঙালি সমাজে গণমানুষের জন্য প্রথম রাজনীতি সম্পৃক্ততা – সেকথা ইতিহাস স্বীকৃত। এর আগে তো কংগ্রেসে শুধুমাত্র জমিদারবাবা, – তার নায়েব, নিবারণ চক্রবর্তী, হেডমাস্টার হরিশ মুখুজ্জে পর্যন্ত আর মুসলিম লীগ সৈয়দ শের আলী, আব্দুল কুদ্দুস আর মফিজউদ্দিন চৌধুরী পর্যন্ত বিস্তার পেয়েছিল। আর গণমানুসের ঐ রাজনীতিই তো চিরকালীন শত্র“ কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের – সেজন্যেই তো স্বদেশীদের ডাকাতির ঘটনার পর নির্বিবাদে গ্রেফতার হলো আনন্দ বাগচী আর তার সাতে গণ্ডায় গণ্ডায় চাষা, জোলা, কামার, কুমার, মালো আর মুসলমান। 11 শাসিতের উপর এই যে রাষ্ট্রের আঘাত তা কিন্তু কোন কালেই হ্রাস পায় নি। ভোট আদায়ের প্রয়োজনে কখনও মিষ্টি কথা বিনিময় হয়েছে মাত্র, তার বেশি নয়। কম্যুনিস্ট রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসে সার্বক্ষণিক বদনামের একটি ছিল ‘কাফের’ অভিধা, সে অভিধা তার জন্মকাল থেকেই। ‘কংগ্রেস না, লীগ না, এইডা আবার কেমুন পাট্টি?’ আদম আলীর এ প্রশ্নের শের আলীর জবাব:
পয়গম্বরদের জামানায় আরব দেশে এমনি বহু যাদুকর ছিল, তারা তাজ্জব করা কাণ্ড দেখাইয়া মানুষজনের ঈমান ভুলাইয়া কুফরী পথে নিত টাইনা। আনন্দ মাস্টারও গরীবের সুখ-শান্তির কথা বলছে। আদতে কম্যুনিস্টরা আল্লা-রাসুলে বিশ্বাসী নয়, ওরা কাফের। 12
হরিপদ দত্ত অনেক কিছুরই এমন গোড়া ধরে টান দিয়েছেন – সমাজ ও রাজনীতির শেকড় টেনে টেনে তাঁর পাঠককে সেসবের গুরুত্ব বা গুরুত্বহীনতা বুঝিয়েছেন। এর মধ্যে চলে এলো ভোট – সামনে এসে দাঁড়াল কৃষক প্রজা পার্টি ও তার নেতা হক সাহেব। নির্বাচনপূর্ব ঘোষণা ‘লাঙ্গল যার মাটি তার’ ‘জমিদারের বদলে জমিনে স্বত্ব পাবে প্রজা’ প্রভৃতি স্বপ্নপ্রায় প্রত্যাশাগুলো ছাড়খাড় করে দেয় আনন্দ বাগচীর কৃষক সভাকে। সে ‘ধরে রাখতে পারে না দলের মানুষগুলোকে। ওরা ভোট চায়, বোট। অথচ ভোট থেকে দূরে সরে থাকা আনন্দ বাগচীর পার্টির সমর্থক হিন্দু-মুসলমান সবাই প্রায় লটকে যায় তিন বাঁদরের তিন লেজে। হিন্দুগুলো কংগ্রেস আর মুসলমানগুলো লীগ – কৃষক-প্রজা পার্টির।’ 13 তারপর বিপুল ভোটে কংগ্রেস আর লীগের প্রার্থীদের হারিয়ে এসেম্বলী মেম্বার হয়ে যান কৃষক-প্রজা পার্টির রিয়াজ উদ্দিন মাস্টার। অথচ নির্বাচনোত্তরকালে আদম আলীদের পৌনঃপুনিক প্রশ্ন ‘ভোটের সময় যে ওয়াদা করলেন হক সাহেব সেই মতে কাম-কাজ করতাছেন না কেন?’ 14 আর তাই সেই ওয়াদার পূরণ দাবি করে স্লোগান ভরে দেয় আনন্দ বাগচী ময়ালের চাষাদের মুখে।
‘অজগর’ বাংলার রাজনীতির প্রত্যক্ষ বুননে নির্মিত; আর তারই স্রোত ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। সে যুদ্ধের দামামা বঙ্গীয় এ অঞ্চলে কম জোরে শ্রুত হয় নি। চট্টগ্রামে জাপানিরা বোমা ফেলার পর কাচারি বাড়িতে বৈঠক বসেছে কংগ্রেস, লীগ আর কৃষক পার্টির নেতাদের – ইংরেজ সরকারের তহবিলে জমা দিতে হবে যুদ্ধের খরচ; ইংরেজ রক্ষা পেল তবেই না দেশে আসবে আজাদী। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে আনন্দ বাগচীর দল রাজী নয় এক পয়সা চাঁদা দিতে – ফল যা হবার – আবার পুলিশের ঘরে।
এরই মধ্যে জমে উঠেছে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের স্লোগান। আগে মিঠে কথায় ভুলে ‘তালাতালি’ করেছিল ওরা হক সাহেবের জন্য অথচ শেষথক বেনিয়া গোকুল সাহা শুকুর আলীর কানে ঢেলেছিল যে কথা তা হলো: ‘কিরে শুকুইরা, যে পাতে খাইলি সে পাতেই বুঝি হাগতে চাইলি?… দেখলি এখন হক সাহেব তোর মানুষ না আমার মানুষ।’ 15 পাকিস্তানে ধোঁয়া সৈয়দ শের আলী আবার মিষ্টি কথা তোলো: মুসলমানের দ্যাশে জমিদার থাকবো মুসলমান। আজকে যদি থাকতো মুসলমান জমিদার তবে তাদের কোন দুঃক থাকতোরে?’ 16 রাজনীতির এ মালার সুতো অজগরে ক্রমঅগ্রসমান। সুভাষ বসুর অন্তর্ধান, মওদুদীর জামাতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে মাওলানা ইমতাজ উদ্দিনের বক্তব্য প্রভৃতির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি। জোরদার স্বাধীনতার আন্দোলন। জমিদার-জোতদারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে নেমে পড়ে আনন্দ বাগচীরা, সাথে পেয়েচে ম্যাট্রিক পাস শিক্ষিত মুসলমান আলতাফ হোসেনকে। তেভাগার উচ্চারণ হয় তীব্র; অজগরের বনে লাঠি আর সুড়কি চালানোর প্রশিক্ষণ চলতে থাকলে রব ওঠে নীরবে:
কোথায় সে অজগর। কোন ফোঁকরে তার বাস! আয় বেরিয়ে আয় দেখি। কয়টা তোর শিং, কয়টা পা? দেখবি লড়াই, দেখবি যুদ্ধ? ঐ তো ঘনিয়ে আসছে দিন, সামনে লড়াই কিয়ামত হবে না দুনিয়াটা? 17
এবং সত্যি সত্যিই সে অজগর বেরুতে সাহস পায় নি। সে অজগর কিন্তু আরও একবার ভয় পেয়েছিল – মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন জয়নালসহ মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি আশ্রয় নিয়েছিল ঐ গজারী বনেই। অথচ সে সাপ মানুষের ঘরের ভেতরেও দৃশ্যমান হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার আগের বছরগুলোতে বাংলাভাষী অঞ্চলে দুটি ঘটনা সবচেয়ে বেশি জনমন স্পর্শ করেছিল – তেভাগা আন্দোলন এবং হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। তেভাগা আন্দোলনে যারা নেতৃত্বে ছিল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা প্রতিরোধে তারাই আগুয়ান এটাই ঐতিহাসিক সত্য। অজগর-এও সে সত্য সামান্য আঁচড়ে হলে পরিস্ফুটিত। তেভাগা আন্দোলনের ডাকে আনন্দ বাগচী যেমন প্রধান কর্মী এবং সাথে আলতাফ হোসেন; হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটিতেও তাই। এসবেরই ভেতর তেভাগারা যখন সাফল্যের চূড়ান্তে, তখনই বাধলো সংঘর্ষ পুলিশে আর তেভাগার কৃষকে। বন্দুক হাতে এ্যাসেম্বলী মেম্বার সৈয়দ মোহাম্মদ আলীও সে যুদ্ধে অবতীর্ণ। ফল?
নেতাদের ঘরে ঘরে চললো তল্লাস।… শতশত গ্রেফতার।… ধীরেন বসুকে বাড়িতে তল্লাস করেও না পেয়ে তার বুড়ো পিতাকে পিটিয়ে আধা মরা করে ফেলে রেকে বিধবা বোনকে পালা করে ধর্ষণ করে দু’জন পুলিশ। … সারা তল্লাট পইপই খুঁজেও পুলিশ নাগাল পায় না আলতাফ হোসেনের। ক্রুদ্ধ পুলিশ আগুন ধুরিয়ে দেয তার বাড়িতে। তার পোয়াতী স্ত্রীকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে লীগ সরকারের বীর রোস্তম পুলিশ বাহিনী। ধানক্ষেতের ফাঁকা আলে শুইয়ে পর্যায়ক্রমে চার-পাঁচজন পুলিশ ধর্ষণে অসহায় রমণীর আর্তচিৎকারে খোদার আরশ কাঁপলেও টলে না এতটুকু বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের সিংহাসন। 18
তেভাগার কালের কথা আরও যেসব বাংলা উপন্যাসে আমরা পেয়েছি তাদের মধ্যে সাবিত্রী রায়ের (১৯১৮-১৯৮৫) ‘স্বরলিপি’ (১৯৫২) ও ‘পাকা ধানের গান’ (১৯৫৬-১৯৫৮) এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের (১৯৪৩-১৯৯৭) ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬) অন্যতম। তবে সে সময়কার পুলিশের অত্যাচারের কথা বিশেষ করে নারী ধর্ষণের মত ঘটনা খুব বেশি উপন্যাসে স্থান পায় নি। এসবের ভেতর দিয়েই ‘আজাদী আসলরে ভাই। বালা মসিবদ কিছু নাই’। রাজনীতির এই খেলাটা বিংশশতাব্দীর দীর্ঘ সময় জুড়েই বাংলাতে জমজমাট যা হরিপদ দত্ত ধরার চেষ্টা করেছেন তার উপন্যাসে ‘অজগর’-এ।
রাজনীতির এ ডামাডোলটা ’৪৭-এর আগে ছিল, পরেও ছিল। শাসক চরিত্র তো অপরিবর্তনীয়। তাই স্বাধীনতা নামে আসলেও তা যে যথেষ্ট ফলদায়ী নয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় হাতে হাতে। ক’দিন পরই তো খবর আসে এদেশে বাংলা ভাষা অচল, সব মানুষের বোল হবে উর্দু। আর তার পরপরই কম্যুনিস্ট পার্টি হিন্দুদের দল, সে দল নিষিদ্ধ। তাই পাকিস্তান হয়ে যে সাধারণ্যের কোন লাভ হয় নাই তা বুঝতে বাকি থাকে পানু ব্যাপারীরও। ব্রজবাসীর ‘হিন্দুস্তানে যামু কই?’ প্রশ্নের উত্তরে পানু জানায়: ‘কই যাবি ক জন্ম-মাটি ছাইড়া? এইটা তো তোগর দেশ। পাকিস্তান হইয়া আমার কোন লাভ হইল? হিন্দুস্তান হইয়া তর লাভ হইল? গরিবের আবার পাকিস্তান কি আর হিন্দুস্তান কি?’ 19 সাধারণ মানুষের এ ভাবনাইতো একাত্তরের সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল? ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত সময়কেও রাজনৈতিক আঁচড়ে আঁচড়ে হরিপদ দত্ত চিত্রিত করেছেন এবং তার এ সূক্ষ্ম চিত্রায়ণ যেমন তাঁর দক্ষতার পরিচায়ক তেমনি রসদায়ীও বটে। আর এভাবেই পঁয়ষট্টির পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ক্রমঅগ্রসরমান যেখানে ভাসানী ও প্রফেসর মুজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টিতে ভাঙন এবঙ তার ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান ও ছয় দফা। প্রথম খণ্ড শেস হচ্ছে যখন ভাসানীর মিটিং-এ যোগদানের মিছিলে চেয়ারম্যান সিকেন্দার আলীর লাঠিয়াল বাহিনীর হাতে আহত রক্তাক্ত খালেকের ছেলে কিশোর জয়নাল। যে কিশোর মুক্তিযুদ্ধের আগের দিনগুলো থেকে শুরু করে পঁচাত্তর-পরবর্তী কাল পর্যন্ত নিজেকে উপন্যাসটিতে প্রধান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে চলেছে।
দ্বিতীয় খণ্ডে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই আমরা পাই জামায়াত নেতা মওলানা ইমাম হোসেন সুলতানপুরীকে যে কিনা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ইসলাম বিরোধী কাফেরদের ষড়যন্ত্র বলে চিহ্নিত করে। এটতো গেল পাকিস্তানের দালালদের কথা। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনও কিন্তু এ পর্যায়ে তীব্র এবং বিস্তৃত, যদিও সে আন্দোলনের বিরোধী চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের কথাও উপন্যাসে স্থাপিত। আলতাফ হোসেনের কম্যুনিস্ট পার্টি অর্থাৎ মস্কোপন্থীরা শেখ মুজিবের ছয় দফাকে সমর্থন করলেও চীনপন্থীদের বিরোধিতা প্রকারান্তরের সরকারের তাবেদারী হিসেবেও চিহ্নিত হয় যদিও শেস পর্যন্ত আমরা দেখি চীনপন্থীর লড়াই করছে দু’জনের বিরুদ্ধে – এক. আওয়ামী লীগ ও দুই. পাকিস্তানী বাহিনী। কিন্তু এত সব দলমত ছাপিয়ে গণআন্দোলনেরও আগে থেকে বাংলার আপামর মানুষের হৃদয় জয় করতে শুরু করেছিল মুজিবুর ও তাঁর দল। বাম রাজনৈতিক আবহে লালিত পালিত কৃষক খালেক মিয়ার সন্তান জয়নালও সে আন্দোলনে অংশীদারী। আর তাই বাবাকে সে শোনায় ‘তুমরা কম্যুনিস্টরা যা পার নাই আব্বা, শেখ মুজিব তা পারবে, দেইখা নিও’ 20 কিন্তু তার মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বও কম নয় – কোন দলের পথ সঠিক সে প্রশ্ন তার মধ্যে নিরন্তর। কম্যুনিস্ট রাজনীতির আন্দোলন এবং স্বাধীনতার আন্দোলনের সাথে পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে পারে না জয়নাল। আবার আওয়ামী লীগের স্বাধীনতার আন্দোলন গরিব মানুষের কোন মুক্তি আনবে কিনা এ বিষয়ে তার সংশয় তীব্র। আর হরিপদ দত্তের সার্থকতা এই যে জয়নালের এ সংশয়ের ভেতরে তিনি এ জাতিগোষ্ঠীর বিরাট সংখ্যক মানুষের সংশয়কেই চিহ্নিত করেছেন। জয়নাল অথবা তার বাবা খালেক মিয়া পৃথক পৃথক চরিত্র হিসেবে বিকশিত হলেও তারা প্রকৃতপক্ষে রূপ পায় বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা-দ্বিধা-দ্বন্দ্বের প্রতিভূ হিসেবেই। আর সেজন্যেই আমরা জয়নালের কণ্ঠে শুনি ‘জানস মা, আমি কি হব? শেখ মুজিব আর লেলিন হব আমি।’ 21 জয়নালকে দেখি আমরা এই ভীষণ টানাপোড়েনের শিকার হত্ যেমন তার ভেতরে আলোড়ন তোলে ‘চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান। তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি নকশাল বাড়ি, নকশাল বাড়ি। চারু মজুমদারের অপর নাম সশস্ত্র সংগ্রাম’ 22 তেমনি তার চৈতন্যে যে বিশ্বাস স্থিত হয় তা হলো ‘সব এক। দল নয়, দলাদরি নয়, সব এক।’ 23 আর এভাবেই ‘কোথায় যে তলিয়ে যায় সর্বহারা। ডিম না মুরগি আগে? জয় বাংলা জয় সর্বহারা? আগে জয় বাংলা, আগে বাঙালি, পরে সর্বহারা।’ 24 বিপুল উত্তেজনায় কালিগঞ্জ-ঘোড়াশাল-নরসিংদীর ছেলে চলে এলো ঢাকাতে অবরোধে অংশ নিতে। আর এভাবেই হরিপদ জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলেন জয়নালকে। যে রাজনীতির অন্যান্য সংবাদগুলো হলো সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যাকাণ্ড, রাজশাহীতে অধ্যাপক জোহার মৃত্যু। আর এসবের ভেতর দিয়েই একসময় নির্বাচন ও সবশেষে সেই ভাষণ ‘আর যদি একটা গুলি চলে…’। তারপর ২৫ মার্চ রাতের ঘটনা যার পরিক্রমায় গ্রামের রাস্তা জুড়ে ঢাকা থেকে আগত শত শত মানুষের কাফেলা। এভাবেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, যে যুদ্ধে জয়নালরা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে সহজেই। হরিপদ দত্ত তাঁর উপন্যাস আরও বিস্তৃত করেছেন – মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ততার ভিতর দিয়ে জয়নালরা অতিক্রম করেছে বহু অভিজ্ঞতা যার অনেকগুলোই দেশপ্রেম বা সততার সাথে টাল খায় না। এবং বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার পর জয়নাল যে মুক্তিযুদ্ধ অতিক্রম করলো তা কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে পড়ে একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর ব্যাপার। দেশের আপামর মানুষ যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের সাধারণ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। ইন্টারভিউ ভালো হলেও চাকরি হয় না জয়নালের, আর এভাবেই দেশের শিক্ষিত যুবগোষ্ঠী হতাশা ও বিমর্ষতায় জর্জরিত। শেষে অসে রক্ষীবাহিনী – যার পরিণতিতে জয়নাল ঘরছাড়া – তারও পর ব
েতার কেন্দ্রের সংবাদ ‘শেখ মুজিব নিহত।’ হ্যাঁ প্রেসিডেন্ট জিয়া পর্যন্ত টেনেছেন হরিপদ যখন ‘দেশটার শরীরে আবার পাকিস্তান পাকিস্তান খুশবু’ 25 আর জয়নালরা শেষ পর্যন্ত শহীদ মাস্টারের দেয়া ব্রিফকেস গ্রহণ করে নিঃশঙ্ক চিত্তে।
রাজনৈতিক এই দীর্ঘ বলয় হরিপদ নির্মাণ করেছেন ব্যক্তি মানুষ ও সমাজ দিয়ে। অধিকাংশ ব্যক্তি মানুষই উপন্যাসে পূর্ণ চরিত্র না হয়ে বরং একটি শ্রেণী, গোত্র, পেশা, ভাবনার প্রতিভূ হয়েছে। জমিদার দীপেন চাট্যুজ্য, সৈয়দ শের আলী, আদম আলী, ননী গোপাল সাহা, আনন্দ বাগচী, মফিজউদ্দিন চৌধুরী, আলতাফ হোসেন, রিয়াজউদ্দিন চৌধুরী, জামায়াত নেতা ইমাম হোসেন সুলতানপুরী, শহীদ মাস্টার, তসলিম মাস্টার, আসাদ, পেয়ারা, দীপক সাহা প্রমুখ। এত দীর্ঘ উপন্যাসে এসব প্রতীকী চরিত্রের বাইরে যারা ব্যক্তি চরিত্রও হিসেবে প্রকাশিত ও সার্থক তাদের মধ্যে জয়নাল, তার বাবা খালেক মিয়া, জয়নালের মা আয়াতুন্নেছা অন্যতম। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয় হরিপদ তাঁর উপন্যাসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চরিত্রগুলোকেও অত্যন্ত জীবন্ত উপস্থাপনায় হাজির করেছেন যে কারণে পূর্ণ উপন্যাসটি জুড়েই বিপুল সংখ্যক মানুষের স্পন্দন পাঠক অনুভব করেন এবং দৃপ্ত হন।
হরিপদ দত্ত তাঁর ‘অজগর’-এ গ্রামীণ জীবনের রূপরেখা এঁকেছেন। গ্রামের নমশূদ্র, মুসলমান, কায়েত ব্রাহ্মণ সবাই মিলে তাঁর উপন্যাসের জগত। উপন্যাসে বড়লোক জমিদার দীপেন চাটুজ্যে, সৈয়দ শের আলীর মত ব্যক্তিরা উপস্থিত হলেও তাদের জীবনপ্রণালী হরিপদের আরাধ্য নয় এবং মাটির সাথে লেগে থাকা যে কৃষক ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ তারাই ঔপন্যাসিকের মূল্য প্রতিপাদ্য। তবে সেসবের ভেতর দিয়ে তিনি ভূমিকা রেখেছেন তা প্রধানত উচ্চবিত্তের নীতিবিবর্জিত, শ্রেণী বৈষম্যমূলক আচরণের বিশ্লেষণী প্রকাশের ভেতর দিয়ে। সেই উচ্চাবিত্ত কখনও শাকক জমিদার, কখন শাসক ধর্ম, কখনও দেশ শাসকও বটে। অন্ত্যজকে ঘৃণা করার মানসিকতায় সে উচ্চবিত্ত উচ্চনাক। তির্যক একটি ভাষা নির্মাণ করে হরিপদ দত্ত উঁচুতলার মানুষদের ঐ দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মোচন করেচেন। দীপেন চাটুজ্যে অর্থাৎ জমিদার বাবুর মালো পাড়া থেকে ফেরার পথে প্রস্রাবের বেগ পেলে যে দৃশ্যের অবতারণা ঘটে সেটি উপন্যাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এক উদাহরণ। হাতির পিঠ থেকে নামার পর জমিদার বাবুর প্রস্রাবের উপযুক্ত জায়গা বের করতে নায়েব বাবু তাকে নিয়ে যায় মালোদের দেবালয়ের দিকে যেখানে একটা পুরনো নিম গাছের গোড়ায় উঁচু বেদী, মাটি দিয়ে নিকানো।
‘এখানে নিত্যক্রিয়া সমাধান করুন ছোটবাবু’ নায়েব বাবু ইতি উতি করে জায়গাটা দেখে নিচ্ছিলেন, ‘মন্দ নয় স্থানটা কিন্তু।’
‘এটা কি?’জানতে চান জমিদার বাবু।
‘ও কিছু না, মালোদের প্রেত পূজার স্তান’ উত্তর দেন নায়েব বাবু।
‘নিশ্চয়ই কোন অনার্য দেবতার পিঠস্থান?’ মৃদু হাসেন জমিদার বাবা।
জমিদার দীপেন চাটুজ্যের মূত্রধারায় ভেসে যায় মালোদের দেবতার বেদী। আর্য কুলোদ্ভব জমিদারের পবিত্র বারি বর্ষণে ধন্য হয়ে যায় অনার্য দেবালয়। 26
এমন সংখ্যক উপাদান সারা উপন্যাস জুড়েই বর্তমান। উপন্যাসের শুরুর অংশে এ দ্বন্দ্ব জমিদার-প্রজা, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে কেটে খাওয়া তেভাগা চাষী ও পাকিস্তানের তাবেদার, কখনও সে দ্বন্দ্ব হিন্দু-মুসলমানেরও বটে। ষাটের দশকে কম্যুনিস্ট স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও মিথ্যে দেশপ্রেমিক দ্বন্দ্বও যথেষ্ট উজ্জ্বল উপন্যাসে।
‘অজগর’ উপন্যাসে হরিপদ দত্ত অনেক কিচুর সাথে অন্ত্যজ হিন্দুদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন। পরগনার একমাত্র ইংরেজ স্কুলে প্রথমবারের মত সরস্বতী পূজো হলেও সেকানে ফুলবেলপাতা দিয়ে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দেয়ার অনুমতি পায় না নামাপাড়ার ছেলেগুলো 27 কিন্তু মুরগি পোষা আর লুঙ্গী পড়ার অপরাধে ব্রাহ্মণ ঠাকুর যখন ‘সপ্তমন গরুর বিষ্ঠা ভক্ষণ আর সপ্ততীর্থ ভ্রমণ’ 28 শাস্তি জারি করে তখন নমোরা কিন্তু তা মানে নি, বিদ্রোহ করেছে সামনাসামনি। শুধু কি তাই ‘আমরা কি মায়ের সন্তান না?’ 29 নরেশ মণ্ডলের এ প্রশ্নে চন্দ্রকান্ত দত্ত বাধ্য হয় নমোদেরকে পুজোর মণ্ডপে ঢুকতে দিতে যে মণ্ডপে ‘এতোদিন উঁচু বর্ণের ব্রাহ্মণেরাই মন্ত্র পড়েছে পুজোর’। নাপিত, ধোপা, মালি, নমোরা চন্দ্রকান্ত দত্তের মেয়ের বিয়েরে কাজে হাত দিতে রাজি হয় এক শর্তে যে ওদেরকেও খেতে দিতে হবে কায়েতদের সাথে। হিন্দুসমাজের এই বিবর্তন অজগর-এ সাবলীলতায় মূর্ত।
ঔপন্যাসিক তাঁর কাহিনীকালের সাথে সাযুস্য রেখে যেমন রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরেচেন তেমনি সে সমতলে সমাজ বিবর্তনও তাঁর নজর এড়ায় নি। বাঙালির লুঙ্গি পড়া শুরুর কথা, নতুন খাবার গম আসারকথা, চাকরিতে প্যান্ট পরার রেওয়াজ শুরুর কথা এমনই কয়েকটি। পাকিস্তান আমলে মিলিটারি শাসন চালু হলে গ্রাম-সমাজে সে মিলিটারির উপস্থিতি কেমন প্রভাব ফেলেছিল তারও বিবরণ উপন্যাসটিতে অন্তর্ভুক্ত।
তবে তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাসে হরিপদ দত্ত প্রলেটারিয়েত জনগণের যে বিজয় চিহ্নিত করেছিলেন তেমন একটি উদাহরণ ‘অজগর’-এর শেষে মেলে নি। দীর্ঘ সামাজিক অন্যায়-অবিচারের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সৎ ও সুস্থ মানুষের জীবন যাপন যে অসম্ভব তাই বোধকরি শেষ পর্যন্ত হরিপদ দত্তের করোটিস্থিত ভাবনা। আর তাই সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা জয়নালকে বিজয়ীর বেশে উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে দেখতে পাই না। বরং সেও সামাজিক দুর্নীতি আর অন্যায়ের স্রোতে নিজেকে একীভূত করতে যেন বাধ্য।
প্রবন্ধটি সমাপ্ত করার আগে হরিপদ দত্ত সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফের উক্তিটি আবার স্মরণ করতে চাই:
হরিপদ দত্তের দেখবার চোখ, জানবার মন, বুঝবার শক্তি, অনুভব করবার হৃদয় যেমন আছে, তেমনি প্রতিবেশে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে বর্ণনা করবার লাঞ্ছিত শক্তি এবং বর্ণিত মানুষের আর্থ সমাজ ও মনুষ্য মনকে বিশ্লেষণে এবং রূপায়ণে। স্বনির্মিত ভাষা ও ভঙ্গিতে হরিপদ সে প্রকাশের চূড়ান্ত বোধকরি জন্ম জন্মান্তর যার আলোচনা একটি ভিন্ন প্রবন্ধের দাবিদার।
টীকা:
- শেষ প্রচ্ছদ, ‘ঈশানে অগ্নিদাহ’, হরিপদ দত্ত, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৮৬ ↩
- ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’, হরিপদ দত্ত, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ. ১৫ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৯ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৪ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮ ↩
- ‘অজগর’, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৪০২ (প্রথম প্রকাশ ১৩৯৫), মুক্তধারা, ঢাকা, পৃ. ১২ ↩
- ‘অজগর’, অখণ্ড সংস্করণ, ২০০২, বর্ণায়ন, ঢাকা, পৃ. ৩৫০ ↩
- ‘অজগর’, প্রথম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৪ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮-১০৯ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২ ↩
- ‘অজগর’, অখণ্ড সংস্করণ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৬ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৮ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৮ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৯ ↩
- ঐ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৬ ↩
- ‘অজগর’, প্রথম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৫ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৬ ↩