বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭৩) দিয়ে আহমেদ ছফার (১৯৪৩-২০০১) সরব উপস্থিতি বাংলাদেশে ঘোষিত হয়েছিল এমনটি বললে বিশেষ ভুল বলা হবে না। যদিও তার আগেই জাগ্রত বাংলাদেশ (১৯৭১) তাঁর শক্তিমানতার পরিচয় দিয়েছিল যথেষ্টই। ১৯৭৫-এ যখন পাঠক-দ্বারে পৌঁছাল ওঙ্কার, তখন আহমদ ছফার পরিচয়টই যেন বদলে যেতে চাইল। কেননা ততোদিনে তিনি একই সাথে চিন্তাবিদ এবং ঔপন্যাসিক – যা বাংলা উপন্যাসজগতে তুলনায় বিরল। গ্যোতের ফাউস্ট (প্রথম খণ্ড)-এর অনুবাদ অনেক দ্বন্দ্ব-বিবাদ করে ১৯৮৬ সালে মুক্তধারা থেকে যখন তিনি প্রকাশ করতে বাধ্য হন তখন বাঙালি পাঠক নতুন বিস্ময়ে দেখতে থাকেন আহমদ ছফাকে যিনি বারবারই তাঁর ক্ষেত্র বদলান এবং নবক্ষেত্রেও পারমঙ্গতা দেখাতে পারেন যথেষ্ট; বিশেষভাবে উল্লেখ্য এই যে, একটি বিশেষ ক্ষেত্রে থাকলেও শিল্পনিরীক্ষা তাঁর রচনার কখনই অচল নয়।
যদি চিন্তাশীল প্রবন্ধের কথাই ধরি, তবে দেখা যাবে তালিকায় একে একে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অন্যান্য অনেকগুলোর সাথে বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৭৯) এবং শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৯৭)। দুটিতেই গবেষণালব্ধ সত্য উপস্থিত; কিন্তু আহমদ ছফার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি সে-সত্যকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেন সরল ভঙ্গীমায়। আর সে কারণেই নতুন চিন্তায় পুষ্ট হয়েও তাঁর রচনা অনেক সময় বিরাট সংখ্যক পাঠকের প্রিয় হয়ে পড়ে সহজেই। শতবর্ষের ফেরারীতে ‘তাঁর (বঙ্কিমচন্দ্রের) রচিত সাহিত্যের একটি বিরাট অংশে আবেগ, অনুভূতি, ত্রুটি-বিচ্যুতিসহ মানুষকে তাঁর পূর্ণ পরিচয় দেখাতে চেষ্টা করেছেন এবং সে রচনাগুলো সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ লেশ বর্জিত। কিন্তু বঙ্কিম যেখানে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন সেখানেও তিনি ঘোরতর হিন্দু’ (পৃ. ২৬) বা ‘প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য ছিলেন সেই আশ্বর্য পুরুষ, আপন হাতে একটি বাক্যও রচনা না করে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব তিনি সম্পন্ন করেছিলেন’ (পৃ. ২৯) বা ‘যুদ্ধ বিগ্রহের বিষয়টা শ্রীকৃষ্ণ যে দৃষ্টিতে বিচার করতেন, তার সঙ্গে হযরত মুহম্মদের মতামতের আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়’ (পৃ. ৩৩) প্রভৃতি ভাবনা আহমদ ছফার পাঠ-পরিধি ও বিশ্লেষক পাঠের নমুনাই বহন করে।
এবার আসা যাক তাঁর উপন্যাস প্রসঙ্গে। ১৯৬৪-৬৫ সালে রচিত প্রথম উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী প্রকাশ পায় ১৯৬৭-তে। হয়তো সমালোচকের দৃষ্টিতে এর কিছু কিছু জিনিস কাঁচা মনে হবে, কিন্তু তারপরও উপন্যাসটি একটি বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ। ধর্মীয় সংস্কারচ্ছন্ন একটি সমাজের চিত্র বহন করলেও উপন্যাসটি সেই সংস্কারকে ভেঙে ফেলারও চিত্র বটে। হাসিম মুসলমান, কেননা তার বাবা মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে মানবিক সম্পর্কতো ছিন্ন হবার নয়। তার তাই হাসিমের স্ত্রীর মৃত্যুতে এগিয়ে আসে পোদ্দার গিন্নী অর্থাৎ হাসিমের দাদী। হাসিমের শিশুকে আশ্রয় দিতে পোদ্দার গিন্নীর জন্য ধর্ম কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। ছোট্ট, ২৩ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় উপন্যাস ওঙ্কার-এ আহমদ ছফা খোঁজেন বাঙালির দীর্ঘ পরাধীনতার শ্বাশত কণ্ঠ – যে কণ্ঠ বিদ্রোহের, প্রতিরোধের এবং প্রকাশের। তৃতীয় উপন্যাস অলাতচক্র (রচনা ১৯৮৪, প্রকাশ ১৯৯৪) গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতপ্রবাসী বাঙালিদেরকে নিয়ে। সে কাহিনীকে প্রেমের সুতো দিয়ে বাঁধা হলেও তা সর্বোপরি প্রকাশ করেছে উদ্বাস্তু বাঙালিদের দৈন্য। ১৯৮৮ সালে আহমদ ছফা রচনা করেন দুটি উপন্যাস আলি কেনান এবং মরণ বিলাস। আইয়ুব খান থেকে শেখ মুজিব পর্যন্ত রাজনৈতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে গ্রন্থিত আলি কেনান-এর কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে অস্তিত্ব রক্ষায় আপ্রাণ এক মানুষ। অন্যদিকে মরণ বিলাস হলো এক মুমূর্ষ রাজনীতিকের স্বীকারোক্তি যা উন্মোচন করে ঐ রাজনীতিকের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার কাহিনী। রাত ১২ টা ১৩ মিনিটে শুরু করে ভোর পর্যন্ত সাগরেদ মওলা বক্সের কাছে মন্ত্রী মহোদয়ের করুণ আর্তি প্রকাশিত হয় এতে।
এরপর উপন্যাস রচনায় আহমদ ছফার ক্ষান্তি চলে কয়েকবছর। ১৯৯৫ এ প্রকাশিত হয় গাভী বিত্তান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যঙ্গ করে এমন উপন্যাস বাংলা ভাষায় পূর্বে আর রচিত হয়নি তা নির্দ্বিধচিত্তে বলা যায়। ১৯৯৬-এ প্রকাশিত অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরীও বাংলা ভাষায় রচিত একটি অতুল্য উপন্যাস; কেননা আত্মজৈবনিক প্রেম ও অন্যান্য প্রসঙ্গে নিয়ে রচিত এমন জীবন্ত উপন্যাসের আর উদাহরণ কই! এ উপন্যাসে ছফা বেশী ভিন্নতার দাবিদার এ কারণে যে তাঁর সেই প্রেমিকাসহ অন্যান্য মানুষেরাও আমাদের সমাজের চেনা মুখ, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। ১৯৯৬ সালেই প্রকাশ পায় আহমদ ছফার আর একটি উপন্যাস যেটি অনন্যতার প্রশ্নে কম যায় না। তাহলো পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ।
১৯৯৫ সালের একুশে মেলাতে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর স্যাটায়ারধর্মী উপন্যাস গাভী বিত্তান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে দেশের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষকদেরকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে রচিত হয়েছে এ উপন্যাসটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু জুনায়েদ এ উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ। কোন রকম পূর্ব সম্ভাবনাহীন অধ্যাপক আবু জুনায়েদের উপাচার্যের সিংহাসনে আরোহণের ঘটনা দিয়েই গ্রন্থটি শুরু। নিরীহ ও সৎ প্রকৃতির আবু জুনায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে অবস্থিত হওয়ার পর চারপাশের প্রতিবেশে পরিণত হন ক্রীড়নকে, তার পরিবার অবতীর্ন হয় আধুনিকতা ও জৌলুসের প্রতিযোগিতায়। প্রথম দিকে তার স্ত্রী নিজের কপালের জোরেই আবু জুনায়েদের বর্তমান উন্নতিকে সরবে প্রচারে তৃপ্ত থাকতেন। কিন্তু এক সময় তিনিও অনুভব করেন তার স্বামী তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে; পূর্বের মতো তার স্বামী আর তার নাকে-দড়ি-দেয়া গরু নয়। ইতোমধ্যে উপাচার্য পরিবারটির নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয় শেখ তবারক আলীর সাথে যিনি নিজেকে নুরুন্নাহার বানুর অর্থাৎ আবু জুনায়েদের স্ত্রীর মৃত আব্বার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। শেখ তবারক আলীর কাছ থেকেই উপহার হিসেবে ওই পরিবারটি লাভ করে একটি গরু – শুধুই গরুই নয় গরুর বাসস্থান হিসেবে তবারক আলীর নির্দেশেই তার জামাতা আমেরিকাপ্রবাসী আবেদ হোসেনের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় একটি গোয়ালঘর; আসে গরুটিকে পরিচর্যার জন্য একটি লোক। গরুটি এক পর্যায়ে আবু জুনায়েদের চিন্তাচেতনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় যা নুরুন্নাহার বানুর মধ্যে সৃষ্টি করে প্রতিহিংসা। ভালোবাসার গরুই দখল করে নেয় আবু জুনায়েদের অবসর। উপাচার্যের একটি নতুন অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে ওই গোয়ালঘরটি। সেটিই সাক্ষাৎ প্রদান ও ছোটখাট কাজের জন্য উপাচার্য সাহেবের উপযুক্ত স্থান বিবেচিত হয়। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের গরু নিয়ে বিরোধীপক্ষের লোকজন তুলকালাম শুরু করেন। সেসব লঙ্কাকাণ্ডের যথোচিত উত্তরও দেয়ার ব্যবস্থা হয় উপাচার্যের দলের লোকজন দিয়ে। সামগ্রিক পরিস্থিতি এতো বেশি গরুটিকে কেন্দ্র করে যে বানুর পক্ষে তা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি বিরাট অংকের টাকা খরচ করে গরুটিকে ইঁদুর মারা বিষ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন।
গাভী বিত্তান্ত একটি উপন্যাস। ঘটনার পারম্পর্য রক্ষা করেই লেখক এতে শুরু থেকে শেষ অবধি পৌঁছান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অধ্যাপক ও কর্মকর্তার ছবি গ্রন্থটি পড়ার সময় আমাদের চোখে ভাসলেও এরা চরিত্র হিসেবেও নিজেদেরকে গ্রন্থটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মানবচরিত্রের পরিবর্ধন, বিশ্লেষণ গ্রন্থটিতে বর্তমান। কিন্তু সেসব কিছুকে ছাপিয়ে এতে মূর্তমান হয়ে ওঠে এর ব্যঙ্গচিত্রটি। দেশের প্রাচীনতম ও শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাসের চরিত্রায়ণ-ঘটনাবিন্যাস কখনও প্রতীকীভাবে, কখনও সরাসরি লেখকের স্যাটায়ার রচনার মূল পরিকল্পনায় ভূমিকা রাখে। আর তাই উপন্যাস পাঠের উপলব্ধি ছাপিয়ে এর কৌতুকপ্রবণ ঢং এবং গভীরে নিহিত ব্যঙ্গ পাঠকের কাছে বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন পরতে হাত দিয়ে আহমদ ছফা তুলে এনেছেন তার ভেতরকার ব্যর্থতা, অর্থহীনতা, মূর্খতাকে। উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে শাসক দলের সাথে উপাচার্যের সম্পর্ক, সরকারের প্রতি তার বদান্যতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সুবিধে আদায়ের প্রক্রিয়া হিসেবে চামচামি, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের সাহিত্যবিচার, ঠিকাদারের কাছ থেকে লাখ টাকার সুবিধে গ্রহণ করেও সেগুলোকে ব্যক্তিসম্পর্কের ফলস্বরূপ বিবেচনা করে উপাচার্যের আত্মতুষ্টি লাভের চেষ্টা এবং সর্বোপরি সকল কাজের চেয়ে গরুটি উপাচার্যের কাছে বেশি গুরুত্ব পাওয়া ইত্যাকার সবকিছুতেই আহমদ ছফার তীক্ষè দৃষ্টি বর্তমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাগত অনুষঙ্গের বাইরেও লেখক হাত দিয়েছেন। আবু জুনায়েদকে তার পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটে রেখে তার স্ত্রীর আচরণ, মেয়ের আধুনিক হওয়ার চেষ্টায় শারিরীক সম্পর্ক নির্মাণে বাছবিচার না থাকা প্রভৃতি ব্যাপারও গাভী বিত্তান্ত-তে উঠে এসেছে। সামগ্রিক সামাজিক অবস্থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডীতে আবদ্ধ করে আহমদ ছফা দেখিয়েছেন অকর্মণ্যরাই কেমন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, কেমন করে কূপমণ্ডুকতা আমাদের পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। একথা সত্য, উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ভেতর মাঝেমাঝেই ঝিলিক মেরে ওঠে আমাদের অনেক চেনা কোনো কোনো অধ্যাপক। ফলে, তাদেরকে নিয়ে সৃষ্ট ব্যঙ্গ অনেক সময়ই পাঠকের প্রচলিত ভাবনাতে আঘাত হানে।
১৯৯৬ সালের প্রকাশিত ভিন্নধর্মী উপন্যাস অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই একটি উদ্ধৃতি দিয়ে :
আমার কোন ধন-সম্পদ নাই। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্র পরিবার আমার কিছু নেই। যে সজীব বন্ধন একজন মানুষকে নানা কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত করে রাখে, আমার ভাগ্য এমন ফর্সা যে সব কিছুই আমার জোটে নি। অতীত দিনের অর্জন বলতে আমার জীবনের যেসব নারী এসেছিলো, যারা আমাকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, দাগা দিয়েছে, যারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, সেই দুঃখ-সুখের স্মৃতি চক্রটুকুই শুধু আমার একমাত্র অর্জন (পৃ. ১১)।
আর সে অর্জনের শব্দরূপই আহমদ ছফার উপন্যাস অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী। আমরা জানি, সাহিত্য মানেই জীবনের উপলব্ধির প্রকাশ। লেখকের পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং অনুভব সাহিত্যের প্রধান আধেয়। আর তাই যে কোনো সাহিত্যকর্মকেই আত্মজৈবনিক আখ্যা দেয়া চলে। যদিও সেগুলোর কোনো কোনোটিতে অনেক বেশি করে ব্যক্তি-লেখককে মূর্ত দেখা যায়। রুশ ঔপন্যাসকি লিয়েফ তলস্তোয়ের রিজারেকশান-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র নিখলাইদভ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরার গোরা লেখক-চরিত্রের চরিত্রায়ণ কি না অথবা জেমস জয়েসের পোট্রেট অব অ্যান আর্টিস্ট আজ এ ইয়াং ম্যান-এ ব্যক্তি জয়েস কতখানি উদ্ভাবিত সে প্রশ্নতো উঠতেই পারে। তবে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে বোধ হয় লেখকের ব্যক্তিগত ‘হয়ে ওঠা’র গুরুত্ব অনেক বেশি। সে প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত বা ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড-এর কথা পাঠকের মনে আসবে নিশ্চয়ই। অথচ লেখকের শুধুমাত্র প্রেমজ-সত্তার বিকাশ ও বিবর্তন দিয়ে আহমদ ছফার এ নির্মাণ। লেখক-পরিকল্পনায় দু’খণ্ডে সমাপ্তব্য এ উপন্যাসের প্রথম খণ্ড ছিল এটি; যাতে উঠে এসেছে উপন্যাসের বক্তা জাহিদ হাসান যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক-ছাত্র ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিজীবনে দু’জন ভিন্ন চরিত্রের নারীর অবস্থিতি বিষয়ক ঘটনাবলী। দুরদানা ও শামারোখ ছাড়াও উপন্যাসের আরও একজন শক্তিমান নারী চরিত্র উপস্থিতি যার নাম সোহীনি, যে কাহিনী সম্পর্কে জাহিদের বক্তব্য ‘তুমি আমার কাছে অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা। অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ, অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী।’ সেই সোহিনীর কাছে জাহিদ ব্যক্তিজীবনে সে সব নারীদের সম্পর্কে লিখে জানাচ্ছে যারা তার মনের মধ্যে প্রেমের উপলব্ধি ঘটিয়েছে, তাঁকে অমতৃলোকের যাত্রী করেছে।
উপন্যাসের শুরুর প্রথম সাত পৃষ্ঠা মত সেই সোহিনীকে নিয়ে লেখা; যদিও অনুমান করা গিয়েছিল উপন্যাসটির দ্বিতীয় খণ্ডে নিশ্চয়ই আমরা জাহিদ-সোহিনী কাহিনীর বয়ান পাব। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী বলে জাহিদ শুধুমাত্র সোহিনীকে সম্ভাষণ জানালেও আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না জাহিদের জীবনের সেসব রমণীদের সকলেই তাঁর কাছে অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী মিলে যেন একটা পূর্ণরূপ।
জাহিদের গল্পের প্রথম সে-নারীর নাম দুরদানা। একাত্তর সালে কোলকাতায় স্মৃতিকণা চৌধুরীর কাছ থেকে জাহিদ তার সম্পর্কে জানতে পারেন। শার্ট-প্যান্ট পরিহিতা, ধূমপায়ী, সাইকেল চালক দুরদানার সাথে জাহিদের পরিচয় ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে যেখানে জাহিদ থাকতেন সেখানে দুরদানার প্রথম আগমনেই বাঁধে গোলমাল। মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ থাকায় দারোয়ান হাফিজ তাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। পরে দুরদানা ছুরি দেখিয়ে ঝট্কা টানে দারোয়ানকে ফেলে দিয়ে হলে ঢোকে। প্রথমত নারী তারপর এরকম দুর্দান্ত স্বভাবের কোনো নারীর সাথে মেলামেশার ব্যাপারটি জাহিদের অনেক প্রিয় শ্রদ্ধাস্পদ শিক্ষকই শুধু নন তার বন্ধু-বান্ধবরাও মেনে নিতে পারেননি। অথচ যতই দিন যাচ্ছিল জাহিদ তত বেশি করেই দুরদানার ‘প্রাণশক্তির সব অঙ্কুরণ’ দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। কোনো উষ্মাই জাহিদকে দুরদানার সঙ্গ থেকে সরে নিতে পারেনি। দুরদানার জন্য জাহিদকে এমনকি শারীরিক নিরাপত্তাগত সমস্যাও পরতে হয়েছে। তাছাড়া আরও একটা সমস্যা ছিল। দুরদানার ভাই ইউনুস জোয়ারদার চরমপন্থী রাজনীতি করতেন। সেই সুবাদেও অনেকেই জাহিদকে ইউনুসের দলের সাথে সম্পৃক্ত বলে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করে। সরকারি দলের খড়গ মাথায় ছিল ইউনুসসের সেই খড়গের খানিকটা ইউনুসের বোনের সাথে সম্পর্ক রাখার জাহিদেরও প্রাপ্য হয়ে ওঠে। পাগলা জগলুল, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, দুরদানার বন্ধু কল্পপা আখতার লুলু প্রমুখ বহুজনের রোষের মধ্যেও জাহিদ দুরদানাকে ত্যাগ করেননি। দুরদানার সাইকেলের পেছনে চড়ার জন্যে দুষ্ট যুবকরা তাকে পিটিয়েছে, রাস্তায় উলঙ্গ করেছে। খানেখানানের বাড়িতে দাওয়াত খেতে তাকে আক্রমণের শিকার পর্যন্ত হতে হয়েছে; যদিও সেদিন সুকৌশলে তারা পেছন দিককার দরজা খুলে পালিয়ে এলাকার মাস্তানদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
আর সেদিনকারও ঘটনার ফলেই অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী উপন্যাসের পাঠক সবচেয়ে মোহনীয়, প্রীতিকর দৃশ্যটি পাওয়ার সুযোগ লাভ করেন। মাত্র এক পৃষ্ঠার এ বর্ণনাতে বৃষ্টির সে রাতে দুরদানাকে নিয়ে জাহিদ রওনা দেয়। নির্জন পারিপার্শ্বের এ সময়ে এ দু’জন মানুষ শারীরিকভাবে অনেকখানি কাছাকাছি চলে আসেন। তারা পরস্পরকে চুম্বন করেন। জাহিদ হাত রাখেন দুরদানার স্তনে। এ ঘটনার কাব্যিক বর্ণনাটি নিঃসন্দেহে যে কোনো পাঠকের দীর্ঘদিন মনে থাকবে। যদিও সে সময়ে আরও একটি ঘটনা ঘটে যা জাহিদ ও দুরদানাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। রিকশাতে দুরদানা জানায় তার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। এতে জাহিদের ভাবনা হয়, ‘মেয়ে মানুষ দুরদানা এতোদিনে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। তাঁর মেয়েমানুষী পরিচয় বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভেতর ভেতরে একরকম শংকিত হয়ে উঠলাম একে নিয়ে আমি কী করবো? একে তো কোনোদিন ভালবাসাতে পারবো না’ (পৃ. ৮) তারপর রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনাদির কারণে এক সময় দুরদান আত্মগোপন করে। জাহিদের ভাষায়, ‘মহাকালের খাঁড়ার আঘাতে আমরা পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম।’
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরীর জাহিদের জীবনে দ্বিতীয় রমণী শামারোখ। দুরদানার কাহিনী – চল্লিশ পৃষ্ঠা, যদিও বরং ছত্রিশ পৃষ্ঠাই আসলে – তুলনায় শামারোখের কাহিনী বিস্তার অনেক – একশ’ পৃষ্ঠা ছড়িয়েছে। শামারোখ কাহিনীর নাড়ীনক্ষেত্র আগাপাশতলা এতে ঢুকেছে বলেই এর আপাত পরিধি এতো বেড়েছে। কেননা, দুরদানাও তো জাহিদের জীবনে কম নয়। হয়তো বেশিই – কেননা, শামারোখে সম্পর্ক এত সুউচ্চ অভিমত জাহিদ সরাসরি ব্যক্ত না করলেও দুরদানা প্রসঙ্গে সোহিনীকে লেখা জাহিদের বক্তব্য থেকে আমরা পাই, ‘… দুরদানার কাছে আমার ঋণের পরিমাণ সামান্য নয়। তার স্পর্শেই আমি ইতিহাসের মধ্যে জেগে উঠতে পেরেছি। … এই যে আমি তোমার অভিমুখে যাচ্ছি দুরদানা হচ্ছে তার প্রথম মাইলফলক।’ আর শামারোখ? জাহিদের ভাষায়: ‘… নীতিবাগীশেরা শামারোখের জীবনের অতীত বৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করে নানান দাগে দাগী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করবে, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমি যখন তাকে প্রথম দেখি, আমার মনে হয়েছিলো, সৃষ্টির প্রথম নারীর সান্নিধ্যে দণ্ডায়মান হয়েছি। এই অপূর্ব সৌন্দর্যময়ী আমাকে দিয়ে যা-ইচ্ছে-তাই করিয়ে নিতে পারে। তার একটি কটাক্ষে আমি মানবসমাজের বিধিবিধান লংঘন করতে পারি। তার নির্দেশে সমস্ত নিষেধ অগ্রাহ্য করে হাসিমুখে ঈশ্বরের অভিশাপ মস্তকে ধারণ করতে পারি’ (পৃ. ৪৩)। আর এভাবেই শামারোখের কাহিনীর ভেতর পাঠকের অগ্রসরণ শুরু হয়।
জাহিদ শামারোখক চিনতো না; কিন্তু শামারোখের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ; শুধুমাত্র সে সুন্দরী বলেই, একটা অবিচার করতে যাচ্ছে এটা সে বুঝতে পরে এবং দৃঢ়সংকল্প হয় তা প্রতিরোধের। স্কলারশিপের টাকা যার জীবননির্বাহের একমাত্র উপায় সেই জাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা অধ্যাপকের ক্ষেপানোর পরিণতি জেনেও পিছপা হননি তার কাজ থেকে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সে কাজে তিনি সফলও হন। কিন্তু ততদিনে ব্যক্তিগত এক সম্পর্ক নির্মাণ হয়ে গেছে শামারোখ এবং জাহিদের মধ্যে। জাহিদের দার্ঢ্যতায় শামারোখ হয়ে পড়েছে তার প্রতি আকৃষ্ট, আর শামারোখের কাব্যপ্রতিভা, তার অপার সৌন্দর্য জাহিদকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে নিবিড় নীলিমায়। অথচ সেই শামারোখের শেষ দিককার আচরণ কত কুট, কত অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত ছিল যা জাহিদের সৌন্দর্যবোধকে, ভালবাসার স্মৃতিকে করেছে ক্ষত-বিক্ষত। তবে একটা জিনিস মানতেই হয় অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী উপন্যাসের শুরুটা তত ভাল লাগে না। মনে হয় কপট একটা প্লট নির্মাণের চেষ্টা চলেছে। সোহিনীর নাম নিয়ে এত কথার যৌক্তিকতাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া কথক-জাহিদের সাথে কি সোহিনীর বর্তমান গভীর প্রেম সম্পর্কে বিরাজমান? তা স্পষ্ট না হওয়ার খুঁতখুঁতে ভাবটি পাঠকের কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। তৃতীয় পরিচ্ছদে দুরদানা বিষয়ক কাহিনীর শুরু পঞ্চম লাইনে বলা হলো ‘আজ থেকে তিরিত্র বছর আগে’ তাহলে তো ঘটনার সময়কাল ১৯৬৫ সালের কাছাকাছি হয়। দুরদানার বয়স তখন কি ‘উনিশ’ ছিল নাকি মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে যখন জাহিদের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে তখন! তাছাড়া দুরদানা কাহিনীর শেষে এসে একচল্লিশে এসে ঢুকে পড়েছে।
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী-র কথক লেখক আহমদ ছফার মতই পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ-এর কথকও লেখক নিজেই। উপন্যাসটির শুরুতে আহমদ ছফা নতুন বাসার উঠার পর তার পালক পুত্র সুশীল ছাদ পরিষ্কার করার সময় আবিষ্কার করলো তুলসি গাছের এক চারা। কয়েকদিন পর নীলক্ষেতের দোকান থেকে কিনে আনলো একটা ঝুঁটি শালিক। আসলে সুশীল বা নতুন বাসা এগুলো সব সূত্র মাত্র। মূল কথা ওই তুলসি চারা আর ঝুঁটি শালিক যেগুলো দিয়ে পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ শুরু এবং সেগুলোকে অবলম্বন করে ক্রমশই আহমদ দফার গভীর সত্তায় পৌঁছানো যেখানে বৃক্ষের জন্য পাখির জন্য ছিল তাঁর অদ্ভুত ভালবাসাময় এক অতীত। অতীতের সেসব আসলে বৃক্ষ, ফুল বা পাখি নিয়ে নয়; বরং তাদের প্রতি আহমদ ছফার অন্তঃস্থ পিতৃস্নেহেরই রূপায়ণ।
সাহিত্যে প্রকৃতি সবসময়ই বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত। প্রেক্ষাপট নির্মাণ এবং মনুষ্য ভাব ও অবস্থার প্রতীকী রূপায়ণেও প্রকৃতি বহুল ব্যবহৃত। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কও কম আলোচিত নয়। ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ মনুষ্য মনে প্রকৃতির প্রভাবকে নির্দেশ করেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে। অন্যদিকে মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট প্রকৃতিতে মনুস্য সত্তার সাজুয্য খুঁজেছেন। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের প্রকৃতিপ্রেম এবং জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ‘প্রকৃতি’র রূপ আবার ভিন্ন ভিন্ন। আহমদ ছফার প্রকৃতি যদিও চারপাশের সামগ্রিক প্রকৃতি নয়। বরং তাঁর আঙিনার ভেতর প্রকৃতির যে উপাদান অর্থাৎ ফুল, পাখি, গাছের অবস্থান সেগুলোই বিষয়। সে সব ফুল, পাখি গাছের সাথে তাঁর পিতা-সন্তানের সম্পর্কের মমত্বপূর্ণ রূপটিই পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ-এর মুল আলোচ্য। সাথেও আরও আছে – তারা শিশু। কিন্তু উপন্যাসের শিরোনামে তারা উল্লিখিত নয় কেননা ওই শিশুরা তো ফুল, পাখি বা গাছের মতই বা ওই ফুল, পাখি বা বৃক্ষরাইতো শিশু। কেননা এরা সবাই তো একই অবস্থানে ঔপন্যাসিকের কাছে উপস্থিত। তিনি পিতা, আর বাকিরা তাঁর সন্তানতুল্য। তিনি তাদেরকে পিতৃস্নেহে লালন করছেন, তাদেরকে বড়ো করে তুলেছেন, তাদের কষ্টে ব্যথিত হচ্ছেন।
পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ-এ আহমদ ছফা নিকট অতীত থেকে ক্রমশ দূর অতীতের দিকে অগ্রসর হয়েছেন এবং তাঁর যাত্রা এত দীর্ঘ যে এক সময়ে আমরা তাঁর শিশুকালেও পৌঁছে যাই। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে আবার যাত্রা শুরু হয় বর্তমান দিকে।
উনিশ শ’ তিরানব্বই সালের আগস্ট মাসে বক্তা-লেখক তাঁর নতুন বাসা চারতলার চিলেকোঠায় থাকতে আসলেন। ভালো জামা-প্যান্ট পরে ও বাসাতে এসে খাটে শুয়ে পড়তেই তিনি ঘুমিয়ে গেলেন। সকালে উঠে দরজা খুলতেই দেখলেন লম্বা এক ফালি ছাদ। ছাদ ঘেঁষে নারিকেল গাছ। তাঁর চিত্ত আনন্দিত হয়ে উঠল। বিকেলে এলো তাঁর পালক ছেলে সুশীল। ঝাড়-মোছে ওস্তাদ সুশীল চারা পরিষ্কার করতে করতে পেয়ে গেলো তিন ইঞ্চি লম্বা তুলসি গাছের একটা চারা। আরো পেলো তিনটি ক্ষুদ্র নয়নতারা গাছ। সুশীলের যত্নে শুরু হলো ওই সব বৃক্ষ শিশুর নতুন জন্ম। ঝুঁটি শালিকটিও সুশীলই আনলো এবং আমরা ক্রমান্বয়ে বৃক্ষ ও পাখি সম্পর্কিত তাঁর যে অতীত সেখানে অবগাহন করতে শুরু করলাম।
প্রথম পাওয়া গেলো লেখকের আগের বাসায় থাকাকালীন সময়ের এক ঘটনা। অভ্যসমত সে বাড়িতেও তিনি গাছপালা লাগিয়েছিলেন। একদিন নিয়ে এলেন এক আপেল চারা। লাগালেন আঙ্গিনাতে। সব সেবার ভার নিলেন নিজের হাতে। আপেল চারা হয়ে দাঁড়ালো ‘বৃক্ষ শিশু’ ‘আপেল শিশু’। মানুষের প্রতি মানুষের যেমন অনুরাগ জন্মায় সে আপেল শিশুর প্রতি তাঁর মনে সে রকম স্থায়ী অনুরাগ জন্ম নিল। এক সন্ধ্যাবেলা নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদে বিষণœ লেখক বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে বসেছেন গাছটির কাছে। অভাবিতভাবে আপেল শাখা তাঁর শরীর স্পর্শ করলো। বিস্মিত হলেন তিনি। বদলে বসলেন জায়গা। দেখলেন শিশু আপেল গাছ হেলতে হেলতে আবার নত হয়ে তাঁর বুক স্পর্শ করছে। আর এভাবেই বৃক্ষ ও মানুষের ভালবাসার ছবিতে ভরা এ গ্রন্থের চুড়ান্ত রূপ অবলোকন করেন পাঠক। পুষ্প-বৃক্ষের আত্মা লেখকের আত্মাকে স্পর্শ করার আরও অন্যান্য ঘটনা লেখক একের পর এক বিবৃত করে মুগ্ধ করেন পাঠককে। নতুন বাসার নতনতারা, তুলসি চারার প্রসঙ্গে নিয়ে কথা বলতে বলতে ফ্লাশব্যাকে লেখক আমাদেরকে শুনিয়েছেন তাঁর অতীত দিনের বৃক্ষ সম্পর্কিত এ রকম ঘটনাসমূহ। একই রকমভাবে ষোল পৃষ্ঠায় যে ঝুঁটি শালিকের খবর আমরা পেয়েছিলাম হঠাৎ করেই তা পুরো বিষয়সহ পুনরায় হাজির হয় একষট্টি পৃষ্ঠায়। নীলক্ষেত থেকে আনা ঝুঁটি শালিকের কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গে আসে আরো অনেক পাখির কথা – অতীতের, বর্তমানের। শৈশবে পোষমানা শালিক মারা গেলে তা ছিল তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ‘এই পাখিটিকে আমি মরা মানুষকে যেমন কবর দেয়া হয়, তেমন কবর দিয়েছিলাম। অনেক দিন একা একা পাখিটির কবরের পাশে বসে থাকতাম। পাখিটির মৃত্যুই হলো আমার শিশু বয়সের প্রথম শোক’ – লেখকের এ অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সমব্যথী করে। শালিকের গল্পের ফাঁকেই এক সময় হাজির হয় রাজঘুঘু, কবুতর, কাক, বুলবুলি, দোয়েল, গাঙ, শালিক, চড়ইরা। সাধারণ পাখি হিসেবে নয় বরং অনুভূতিসম্পন্ন প্রাণী হিসেবে লেখকের চারপাশে এদের ঘোরাঘুরি। লেখকের সত্তার অংশীদার এরা।
বৃক্ষ ও বিহঙ্গের পুরাণের মাঝখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে শিশু পুরাণ। ‘মানুষ মানেই অমৃতের পুত্র’ এ অনুভব থেকে লেখক এক সময় হৃদয়ের গভীরে অনুভব করেন ‘আমাদের চারপাশে এতো শিশু। এতো অযত্ন, এতো অবহেলার মধ্যে তাদের জীবন কাটাতে হচ্ছে।’ এভাবেই লেখকের হৃদয়ে নাড়া দেয়, পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গের সাথে সাথে মনুষ্য শিশুরাও। সমচিন্তক নাজিমউদ্দিন মোস্তানের সাথে এ সময় লেখকের যোগাযোগ ঘটে। উভয়ের যৌথ উদ্যোগে শুরু হয় বস্তিবাসী শিশুদের জন্য এক স্কুল। শিশুদেরকে আশ্রয় করে রচিত এ আখ্যান যেমন রয়েছে শিশুদের জন্য লেখকের আপ্রাণ চেষ্টা ও গভীর অনুরাগের কথা, তেমনি পরিবেশের কারণে শিশুদের কলুষিত দিকটিও চিত্রিত হয়েছে মমত্বের সাথে। বাচ্চাদের বাপ-মায়ের পরিচয় প্রসঙ্গে যখন পাশের জনের সম্পর্কে একজন বলে ‘বড়ো ভাই, হের নাম মরিয়ম, হের মা ঘরে নাঙ ঢুকায়’, বা অন্য এক শিশুর সাথে মারামারি এক পর্যায়ে বাবুল নামের শিশুটি যখন কাঁদতে কাঁদতে আঘাত দেওয়া শিশুটির মা, খালা, নানি, দাদি, বোন, ফুফু, সাত প্রজন্মের যতো নারী আত্মীয় আছে মুখ দিয়ে সকলের সঙ্গে কুকর্ম করতে থাকে তখন বেদনার নীল আমাদের সবাইকে আবৃত করে। দুষ্ট শিশু আলমগীরকে বশে আনতে লেখক তাঁর থাকা খাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা নিলে শুরু হয় অন্য শিশুদের মধ্যে হাসাহাসি। উৎসুক লেখক এর কারণ জানতে পারেন বাবুল নামের শিশুটির কাছ থেকে। বাবুল লেখককে বলে, ‘আলমগীর বলেছে আপনে তারে ফাকাইবেন। হের লাইগা সব দিতাছেন’ – ইত্যাদি অনুসঙ্গগুলো আমাদেরকে ক্রমাগত দগ্ধ করে, নতুন অভিজ্ঞতায় সিঞ্চন করে।
একথা বলতেই হয় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ-এ পুষ্প অংশ পুরাণ-এ রূপ নেয় নি। সমগ্রের একটি অংশ, অথচ পূর্ণতায় ভরা এমন বৈশিষ্ট্য শুধু বৃক্ষ ও বিহঙ্গ অংশেই বর্তমান। তবে শিশু অংশটি ক্ষুদ্র হলেও ব্যাপক অর্থবাহী। আর তাই কি বলা চলে উপন্যাসটির নাম বরং ‘বৃক্ষ শিশু ও বিহঙ্গ পুরাণ’ হলেও ভালো হতো? এছাড়াও উপন্যাসের শুরুতে কয়েকবার ‘আমার লোকেরা’ ব্যবহার লেখকের প্রকৃত সত্তার বিপরীত পরিচয় দেয়। তবে এ সমস্ত ত্রুটি ধুয়েমুছে যায় যখন সমাপ্তিতে লেখক বলেন ‘… আমার প্রাণে পুষ্পের আগ্রাণ লেগেছে, জীবনের একেবারে মধ্যবিন্দুতে বৃক্ষ-জীবনের চলা অচলার ছন্দদোলা গভীরভাবে বেজেছে, বিহঙ্গ জীবনের গতিমাত্র স্পন্দন বারংবার আমার চিন্তাচেতনা অসীমের মূলে ধাবমান করেছে। এই পুষ্প এই বৃক্ষ, এই তরুলতা, এই বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে আমার মধ্যে কোন একাকীত্ব, কোন বিচ্ছিন্নতা আমি অনুভব করতে পারিনে। সকলে আমার মধ্যে আছে আমি সকলের মধ্যে রয়েছি।’ প্রকৃতির এসব অনুসঙ্গের সাথে বিস্মৃত অথবা প্রায় বিস্মৃত প্রত্যেক মানুষের জীবনের উপলব্ধি যেন প্রাণ পায় এ উপন্যাসে। গভীরে গিয়ে আমরা সবাই উপলব্ধি করতে থাকি ‘আমার পাখি পুত্রটি আমাকে যা শিখিয়েছে কোন মহৎ গ্রন্থ, কোন তত্ত্ব কথা, কোন গুরুবাণী আমাকে সে শিক্ষা দিতে পারেনি।’ ঔপন্যাসিকের উপলব্ধির সাথে পাঠককে এভাবে মিলিয়ে দেয়াই তো সত্যিকারের একটি উপন্যাসের কাজ।
হয়তো কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ-এর ঔপন্যাসিক অভিধা নিয়ে। কেননা, উপন্যাসের যে প্রচলিত গল্প-রীতি তা এতে নেই। বরং ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা বিবরণই এর গল্প। আর প্লট তো আছেই, যেহেতু ঔপন্যাসিক কার্য-কারণ সম্পর্ক ধরেই অনুভূতি থেকে অনুভূতিতে বিচরণ করেছেন। হয়তো কেউ কেউ আহমদ ছফার অন্য উপন্যাস যেমন ওঙ্কার বা অলাতচক্র-এর নাম বলতে চাইবেন তাঁর রচিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে। কিন্তু তারপরও এমন মন্তব্য করতে দ্বিধা নেই পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ-ই আহমদ ছফার প্রধান উপন্যাস। সকল প্রচলকে উপেক্ষা করে মানবিক অনুভূতির চূড়ান্ত শৈল্পিক প্রকাশ ঘটৈছে তাঁর এই উপন্যাসে। এটিই তাঁর প্রধান উপন্যাস। বাংলা ভাষায় রচিত মহৎ উপন্যাসের তালিকায় আহমদ ছফা সংযোজিত অভিনব একটি শিরোনাম।
পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে; জাপানি ভাষায় অনুবাদও হয়েছে উপন্যাসটি। লেখক নিজেই উপন্যাসটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, যদিও সেটি গ্রন্থাকারে এতোদিনেও প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতির সাথে মানুষকে এভাবে আমরা পূর্বে কোন উপন্যাসে পাইনি। মাত্র বাহাত্তর পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে চিত্রিত করেছে। আর সেকারণেই পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ নব্বইয়ের দশকের বাংলা উপন্যাসে একটি অন্যতম প্রয়াস।
প্রবন্ধটির প্রথম খসড়া ২০০১ সালে প্রকাশিত।