ইমদাদুল হক মিলন (জন্ম ১৯৫৫) বাংলা উপন্যাসের কিংবদন্তিতুল্য লেখক। কারণ তিনি দীর্ঘদিন সৃজনশীলতার কঠিন পথে হাঁটছেন। তাঁর রয়েছে একাধিক শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস। জনপ্রিয় বলেই কখনো কখনো তিনি সিরিয়াস গ্রন্থের পাঠকদের কাছে উপেক্ষিত হয়েছেন; সমালোচকের কাছে থেকেছেন অনুচ্চার্য। অনেকদিন ধরে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় সবচেয়ে বেশি বিক্রিত গ্রন্থের তালিকায় রয়েছে তাঁর একাধিক গ্রন্থ। জনপ্রিয় এই কথাশিল্পীর শিল্পমানসম্পন্ন, ব্যতিক্রমী ও জীবনঘনিষ্ট গল্প-উপন্যাসের সূত্র ধরে তাঁর জনপ্রিয়তার স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভব।
খ্যাতনামা সমালোচক সুব্রত কুমার দাসের অভিমত অনুসারে, বাংলাদেশে আশির দশক থেকে লঘু-কথাসাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি সামনে আসে। একসময় উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। তবে জনপ্রিয় লঘু গল্প-উপন্যাসের পাশেই নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও শিল্পগুণসম্পন্ন সাহিত্যের বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। একসময় সৃজনশীল সাহিত্যের শিল্পগুণসমৃদ্ধ রচনাও জনপ্রিয় তকমা অর্জন করে। শিক্ষিত উচ্চবর্গের ড্রয়িং রুম থেকে কথাসাহিত্যকে বের করে এনে সাধারণ মধ্যবিত্তের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার প্রথম কৃতিত্ব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তবে রচনার শিল্পমান যুগোত্তীর্ণ হওয়ার পরও সতীনাথ ভাদুড়ীর মতো শক্তিমান কথাসাহিত্যিক জনপ্রিয় হননি। যেমন হয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন। সেজন্য উপন্যাসের উচ্চমানের নিক্তিতে জনপ্রিয়তা অভিধাটি সবসময় ধোপে টেকে না। ‘লঘু’ রচনার জনপ্রিয়তা অর্জনের মূল কারণ অগভীর জীবনবোধ, চটুল প্রেম ও হালকাচালে অবসর বিনোদনের জন্য লিখিত। উচ্চমার্গীয় ধ্রুপদী সাহিত্য বৈশিষ্ট্যের একেবারে বিপরীতমুখী তার প্রবণতা। পাঠকের লঘু বাসনাকে পরিতৃপ্ত করতে তা বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে বৃদ্ধিবৃত্তিক ও মননশীলতা জাগ্রত করে পাঠককে তৃপ্ত করতে পারে শিল্পমানসম্পন্ন রচনা। বর্তমান বিশ্বে হালকা ও চটুল রসের সাহিত্য যেমন বিক্রয় তালিকার শীর্ষে জায়গা পাচ্ছে তেমনি জীবনঘনিষ্ঠ প্রকৃত সাহিত্যও রচিত হচ্ছে এবং শীর্ষ তালিকায় স্থান পাচ্ছে। আবার অনেক রচনায় তাৎক্ষণিক আনন্দ দান মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও তাতে সমাজ জীবনের গভীর চিন্তার প্রতিফলন লক্ষণীয়।
পূর্বেই বলেছি শিল্পমানসম্পন্ন বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন ইমদাদুল হক মিলন। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার ও বিষয় বিন্যাসে তিনি সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবনকে রূপায়ণ করেছেন। লেখকের অভিনবত্ব আবিষ্কারের জন্য আমাদের অবশ্যই তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’ (২০১২) পাঠ করে তাঁর কথাসাহিত্যে প্রবেশ করতে হবে। কারণ এ রচনায় তিনি নিজের বেড়ে ওঠার কথা বলেছেন। তাঁর গ্রাম, প্রকৃতি, আড়িয়ালবিলের জীবন, মানুষ, ভাষা, হাটবাজার সবই উন্মোচিত হয়েছে। একইসঙ্গে আদি ঢাকার সঙ্গে বিক্রমপুরের যোগাযোগ, লেখকের নিজের এলাকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবন, দেশভাগ, দাঙ্গা প্রভৃতি রূপ লাভ করেছে। এই স্মৃতি অভিজ্ঞতার পথ ধরেই তাঁর বাল্য-কৈশোর-যৌবন উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি নিজের সৃজনশীলতার পথে অগ্রসর হয়েছেন। হয়তো একারণে প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ (১৯৭৬ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত) থেকে বিক্রমপুরের গ্রাম জীবনের কাহিনি রূপ লাভ করেছে। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে সংলাপ ও বর্ণনায় আঞ্চলিক শব্দ অবলীলায় উপস্থাপিত হয়েছে সেখানে। গ্রামীণ নিম্নবর্গের কথায় তিনি তাঁর মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। দেশভাগ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতার প্রকৃত চিত্র রয়েছে তাঁর একাধিক উপন্যাসে। চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে ইমদাদুল হক মিলন সহানুভূতিশীল, হৃদয়বান, ভাষা সচেতন ও অনুভূতিশীল আখ্যান নির্মাতা। অনেক রচনায় বর্ণনাভঙ্গিতে নিরীক্ষাপ্রবণতা লক্ষণীয়। সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনি বর্ণনা করতে করতে একসময় উমাচরণ চরিত্রের মধ্য দিয়ে উত্তমপুরুষ বর্ণনা পদ্ধতি সংযুক্ত হয়েছে প্রথম উপন্যাসেই। এভাবে মানবচরিত্রের অতলে ডুব দিয়েছেন তিনি। একদিকে গ্রামীণজীবন, মানুষ, প্রকৃতি অন্যদিকে আধুনিক নগর জীবন, প্রেম, যৌনতা তাঁর কথাসাহিত্যের মৌল উপজীব্য। আবার মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কথাসাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। সেখানে তাঁর দৃষ্টি ও ভাবনার জগত প্রসারিত; মুক্তিযুদ্ধোত্তর হতাশামগ্ন সমাজের চিত্র একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস অন্বেষায় তিনি নির্মোহ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গল্পগুলো তার স্বাক্ষ্য বহন করে। মূলত তিনি নিজ জীবনের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন। গ্রামীণ জীবনে নারীর অবস্থান চিত্রিত করেছেন দরদের সঙ্গে। প্রকৃতিময়তা ও দ্রোহ নারীর অবস্থান রূপায়ণে তাঁর অনন্যতার স্বাক্ষর রয়েছে ‘নূরজাহান’ উপন্যাসে; দ্রোহ চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে নূরজাহান। অন্যদিকে নারী ‘হাসু’র পুরুষ লিঙ্গান্তর আর ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসের বারিক-নয়নার সমকামিতা বাংলাদেশের উপন্যাসে নতুন চরিত্রের আস্বাদন এনে দিয়েছে। আরো আছে বিচিত্র পেশার মানুষের দারিদ্র্য ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের অভিব্যক্তি।
দুই.
ইমদাদুল হক মিলনের ছোটগল্পে জীবনকে দেখার পর্যবেক্ষণ তাৎপর্যবহ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি লিখেছেন একাধিক গল্প। তার মধ্যে ‘রাজার চিঠি’, ‘মানুষ কাঁদছে’ ও ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ উল্লেখযোগ্য। ছোটগল্প হিসেবে এগুলো বাহুল্যবর্জিত, ব্যঞ্জনাত্মক এবং অবিক্ষিপ্ত গঠন-প্রতীতির স্মারক। তবে সংক্ষিপ্ত পটভূমির গল্পগুলোর চরিত্র এবং চরিত্র-আশ্রিত সংলাপ ও ভাষা নিজস্ব ঢঙে অনবদ্য। ছোটগল্পের বুননে যে শিল্প-প্রকৌশল রৌদ্রছায়ার মতো সবেগে ছুটে চলে, তার নিদর্শন এগুলো। গ্রামের মানুষকে শারীরিক অবয়ব থেকে শুরু করে তার মুখের ভাষার হুবহু উচ্চারণ ইমদাদুল হক মিলনের নখদর্পণে। গ্রামীণ পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর কাহিনীকে নির্মাণ করার সক্ষমতা তাঁর গল্পে স্পষ্ট। তিনি ভাষা নিয়ে খেলতে গিয়ে যথোপযুক্ত ঘটনা বাছাই করেন, নির্বাচিত চরিত্রগুলো চকিত উদ্ভাসন-মুহূর্তে তুলে ধরেন, বর্ণনাকে বক্তব্যের সঙ্গে পরিমিত করে তোলেন। উপরন্তু গল্পের একমুখী গতিকে শীর্ষবিন্দুতে তুলে ধরে উপসংহারে পৌঁছে যান। বিষয় ও প্রতীতি অনুযায়ী ভাষার স্থানিক উদ্ভাস নিজস্ব মেজাজে ব্যক্ত হয় তাঁর গল্পে। যা ব্যাপ্তিতে ও গভীরতায় অন্যান্য গল্পকারের তুলনায় ভিন্ন কিন্তু তাঁর কাহিনীর জন্য অনিবার্য। বঙ্গবন্ধুকে গল্পের কাহিনীতে নির্মাণ করে গল্পকার যুদ্ধ-পরবর্তী মানুষের মূল্যবোধ ও চেতনা লুণ্ঠিত হওয়ার কার্যকারণ আবিষ্কার করেছেন। মুক্তিসেনাদের ভেতর থেকেই পুনরায় জেগে ওঠার শপথ ও প্রতিশোধ স্পৃহা তুলে ধরেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার তারিখের বিকেলে সূচনা হয়েছে ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পটির কাহিনী। এ গল্পের উপস্থাপনরীতি কৌতুককর হলেও বিষয়ের গভীরতা চমকে দেয় পাঠককে। বর্গাচাষী রতন গ্রাম থেকে এসেছে নেতাকে দেখার জন্য। তার বাসভবনের আশেপাশে ঘুরতে থাকলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে। পুলিশ অফিসার ও তার অধস্তন দুই সহকারী রতনের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিকে হাস্যকর করে তোলে এবং সন্দেহপরায়ণ রতনকে হাজতে আটকে রাখে। কাহিনিতে রঙ্গ-রসিক পরিস্থিতি পাল্টে যায় ভোরবেলা রতনকে ছেড়ে দিলে। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন এ সংবাদ জানার পর রতনের ভেতর অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে; আটকে রাখতে বলে তাকে। কারণ সে থানা থেকে বের হলে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবে। বাংলাদেশের ইতিহাসের মর্মান্তিক ঘটনাকে লঘু ঢংয়ে এবং ছোট পরিসরে অনিবার্য পরিণতির দিকে কাহিনীকে টেনে নেওয়ায় দক্ষতার পরিচয় আছে। বঙ্গবন্ধু যে রাতে নিহত হলেন সেই রাতের পটভূমিতে লেখা এ গল্প বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের ভালোবাসার কথায় স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে।
‘রাজার চিঠি’ আটাত্তরের শুরুর দিকে সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হয়। লেখক রূপকথার আঙ্গিকে প্রজাপ্রিয় মহান এক রাজার আদলে তৈরি করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। ইমদাদুল হক মিলন দেশের সাধারণ মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ববোধের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন এ গল্পে। শাসককে সাধারণ মানুষের কল্যাণে সতর্ক ও সংবেদনশীল হতে হবে – এই বক্তব্য আলোকিত হয়েছে কাহিনি বিন্যাসে ও চরিত্র নির্মাণে। ছদ্মবেশী রাজা মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থান ঘুরে মানুষের দুর্দশা দেখে তার রাজকর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা বুঝতে পারেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্যের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসার পর ‘রাত্রির মধ্যযামে’ হত্যাকা-ের শিকার হন রাজা মন্ত্রিপরিষদের হাতে। কারণ তিনি নিজেই দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে কেবল সুবিধাবাদী মন্ত্রীদের চাটুকারিতায় একদিন যে শাসক দেশজনতার সংবাদ ঠিকভাবে পাননি তিনি যখন বাস্তব অবস্থা জেনে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হলেন ও নির্দেশ দিলেন সে সময় ঘটল নিষ্ঠুর হত্যালীলা। এভাবে মন্ত্রীদের ক্ষমতার মোহ ও দেশবাসীর দুর্দশা তুলে ধরেছেন লেখক। একইসঙ্গে শাসকের সহজ-সরল জীবন-যাপন ও সচেতনতার অভাবে রাজ্যের করুণ অবস্থার বিবৃতি রয়েছে। শাসক সচেতন থাকলে এবং মানবদরদী হলে কুচক্রী মন্ত্রীদের হাত থেকে বাঁচতে পারতেন রাজা। কারণ তিনি নিজে সবই বুঝতে পারতেন- ‘মন্ত্রিপরিষদ আমার চারপাশ ঘিরে রেখেছে। প্রাসাদের বাইরে আমাকে কখনও নিয়ে যায়নি।’ অন্যত্র- ‘তিনি চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্যে কোনও দুঃখী প্রজা থাকবে না, অনাহারী প্রজা থাকবে না।’
‘মানুষ কাঁদছে’ সাতাত্তর সালের শেষদিকে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পের নামটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। লেখকের ভাষায়- ‘নামটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা। আজ যেমন, তখনো তেমন মানুষ বঙ্গবন্ধুর জন্য কাঁদছিল। তখনকার কান্নাটি ছিল গোপন কান্না। বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রকাশ্যে তখন কাঁদতেও পারছিল না মানুষ। এক যুবকের আত্মকথনের মধ্য দিয়ে, তার হাহাকার এবং হৃদয়ের গোপন রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য সাধারণ মানুষের কান্নার কথাটি আমি বলতে চেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর জন্য সাধারণ মানুষের ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছি।’ গল্পের সূচনা হয়েছে রহিম ও কালুর তাস খেলার বিবরণ দিয়ে। অন্যদিকে আশরাফ মিয়ার সাইকেল নিয়ে দুটি ঠেলা আনতে গিয়ে ট্রাকের নিচে পড়ে খুন হয় রহিম। তারপরই গল্পের কাহিনী মোচড় দিয়ে শুরু হয় উত্তমপুরুষের জবানি। শওকত কন্ট্রাকটরের ম্যানেজার আরিফ স্বগতোক্তি করে, সেখানে নিজের কথার সঙ্গে থাকে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ। রহিমের লাশ ধরে মেয়ে মানুষের কান্না দেখার পর তারও মনে হয় ‘মনে পড়ে আমি শেখ মুজিবের জন্য এখনও কাঁদিনি। আজ রাতে কাঁদব, মন ভরে কাঁদব। কাঁদলে অপরাধবোধ খানিকটা কমবে।’ গল্পটি শেষ হয় আরিফের কান্না দিয়ে। লেখক কৌশলে আরিফের বাস্তব জীবনের নানান রেখাপাত করে যান। আরিফ, আশরাফ মিয়া ও অন্য কন্ট্রাকটদের হিসেব-নিকেশের নানা খুঁটিনাটি উন্মোচিত হয়েছে গল্পে। আরিফের মতো কৃষকের সন্তান আর ম্যাট্রিক পাস করা ব্যক্তি চৈতন্যের গহীনে বঙ্গবন্ধু কিভাবে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তারই বর্ণনাত্মক উপস্থাপনা রয়েছে এ গল্পে।
তিন.
‘বাঁকা জল’, ‘ভূমিকা’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘কালোঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘রূপনগর’, ‘কালাকাল’, ‘টোপ’, ‘এক দেশে’, ‘বনমানুষ’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘পরাধীনতা’ ইমদাদুল হক মিলনের এই উপন্যাসগুলোর বিষয় বিচিত্র : মুক্তিযুদ্ধ, প্রবাসী শ্রমিক, কখনও গ্রামের ভেসে বেড়ানো অসহায় বালক অথবা পুরো একটা গ্রামই উপন্যাসের নায়ক। পাত্রপাত্রীর পেশা ও চরিত্র রূপায়ণেও বৈচিত্র্য রয়েছে। দিনমজুর বেলদার অথবা গ্রাম্য বাজারের ভাসমান নি¤œবর্গ, সার্কাসের জোকার, নদী ভাঙা মানুষ, পতিতাবৃত্তির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা কিশোরী পারুল যে শেষ পর্যন্ত জীবনের বিনিময়ে নিজেকে রক্ষা করে(‘টোপ’)- এরকম আরো অনেক চরিত্রের জীবন্ত উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মূলত ইমদাদুল হক মিলনের লেখক জীবনের বাছাই করা এ উপন্যাসগুলো নানাস্তরের গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপনের চিত্র হিসেবে বিশিষ্ট। জীবনের অনুভূতি ও উপলব্ধির ভাষা পাঠকের নিজস্ব সম্পদ করে তুলেছেন তিনি। কেন একজন লেখক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আমরা পেয়ে যাই ঔপন্যাসিকের পাঠকের প্রতি সহৃদয়সংবেদ্য সঞ্চারি ভূমিকা যা তিনি সহজ-সরল কথন বিশ্বে প্রসারিত করেন অজস্রতায়। মামুলি কথার আখ্যান থেকে তিনি নিজেকে প্রসারিত করেছেন সমাজ-রাজনীতির সংকটের গভীরে। ‘নূরজাহানে’র মতো বৃহৎ উপন্যাস লিখে লেখনি ক্ষমতা ও মেধার পরিচয় ব্যক্ত করেছেন।
জনপ্রিয়তার মোহ ইমদাদুল হক মিলনকে চটুল কাহিনি বর্ণনায় প্রাণিত করেনি বরং নি¤œবর্গের জীবন রূপায়ণে তিনি নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। ‘ভূমিপুত্রে’ আমরা দেখতে পাই, যে বেলদারদের আশ্রয়ে একসময় বেপারীরা দিনাতিপাত করত কালের বিবর্তনে তারাই উচ্চবর্গে আসীন হয়ে নিঃস্ব অসহায় বেলদারদের কৃপা করছে। ধান কাটার মৌসুমে ধানের ভাগাভাগি নিয়ে কুদ্দুস বেপারীর লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডাদের আঘাতে দিনমজুর কাদেরের মৃত্যু হলে সেই নিঃসহায়তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্রামীণ নিম্নবর্গের জীবন চিত্রণে ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন বিষয়ের সঙ্গে ভাষার ব্যঞ্জনা অভিদ্যোতিত করেছেন। আগেই বলা হয়েছে, বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার দক্ষ ব্যবহার তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একাধিক উপন্যাস রচনা করে তিনি চটুল আখ্যানের চেষ্টার অপবাদ থেকে মুক্ত হয়েছেন অনেক আগে থেকেই। ‘রাজাকারতন্ত্র’, ‘কালোঘোড়া’, ‘ঘেরাও’, ‘বালকের অভিমান’, ‘মহাযুদ্ধ’, ‘দ্বিতীয় পর্বের শুরু’, ‘একজনা’, ‘সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি’ তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এসব উপন্যাসে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, তাই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা করতে চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ভিন্ন অনুসন্ধানী আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে। যেমন, ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসে তিনি প্রথাগতভাবে কাহিনী বর্ণনা করেননি। এমনকি কোন নায়ক-নায়িকা সৃষ্টিতে মনোযোগী হননি। তিনি ছোট পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে মুক্তিযোদ্ধা কাদের, মুন্না, আলম, এবং খোকা ও তাদের সহযোগী হিসেবে রাজাকার সিরাজ চেয়ারম্যানের ছোটবিবি টুনটুনির মাধ্যমে দেশপ্রেমের মহিমা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। আবার স্বাধীনতাত্তোর প্রকৃত যোদ্ধাদের হতাশাকে চিত্রিত করেছেন। কারণ স্বাধীনতা এক মুক্ত দুর্বিনীত কালো ঘোড়া, যে থাকে কেবলই ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
প্রবাসী মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা ‘পরাধীনতা’র কাহিনিতে উন্মোচিত হয়েছে। উত্তমপুরুষের জবানিতে জার্মান প্রবাসী নায়কের চাকরি ও বাসস্থানের অভাব এবং দেশে ফেলে আসা পরিজনদের জন্য কাতরতা গভীর মমত্বে চিত্রিত হয়েছে। ‘জীবনপুর’ এক ব্যর্থ যুবকের কাহিনি। যাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য, বেঁচে থাকার জন্য সেখানে আশ্রয় নিতে হয়। ট্রাজেডির অনেক কিছুই বিন্যাস করেন তিনি। পরাজয়, গ্লানি, হতাশা তুলে ধরেন। তিন খণ্ডে রচিত ইমদাদুল হক মিলনের ‘নূরজাহান’ শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে পাঠক ও বিদগ্ধ সমালোচকের হৃদয় জয় করেছে। ‘নূরজাহান’-এর ১ম পর্ব ২৮৬ পৃষ্ঠা. ২য় পর্ব ৪৪৭ এবং শেষ পর্ব ৫৪২ মোট ১২৭৫ পৃষ্ঠায় তিনি মৌলবাদ, ফতোয়াবাজ এবং কাঠমোল্লাদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গ্রামীণ মানুষের জীবন ছবির মতো ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।
ইমদাদুল হক মিলনের কয়েকটি উপন্যাসের কাহিনি এক প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়েছে কিন্তু পরিণতিতে অন্য প্রসঙ্গ এসে জুড়ে বসেছে। ‘ঘেরাও’, ‘মহাযুদ্ধ’ প্রভৃতি উপন্যাসে সেই ত্রুটি স্পষ্ট। তবে তাঁর গল্প বলার অভিনবত্ব সর্বত্র দৃষ্টিগোচর হয়। সাদামাটা গল্পকথনের ক্লিষ্টতা থেকে পাঠককে নতুন জগতে প্রবেশ করিয়েছেন তিনি। বিশেষত একই কাহিনিতে সর্বজ্ঞ লেখকের বর্ণনা থেকে বের হয়ে উত্তমপুরষের ‘আমি’তে গল্প বলেছেন অনেকক্ষেত্রে। ভাষার সাবলীলতা, মানব জীবনের বিচিত্র সংকটের দরদি উপস্থাপন ও নানা চরিত্রের রূপায়ণে তিনি জনপ্রিয়। ইমদাদুল হক মিলনের মতে লেখকের দায়িত্ববোধ বিশ্বের সব মানুষের জন্য। তাঁকে ভাবতে হয় সমাজ, দেশ, জাতি নিয়ে। সর্বোপরি সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে তাঁকে লিখতে হয় মানুষ নিয়ে। আর এই লেখার বিষয়বস্তু কোনো একটি দেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না, হয় সর্বজনীন এবং বিশ্বের সব মানুষ নিয়ে। গ্রামীণ পটভূমিতে কথাসাহিত্যের বিষয় নির্মাণে তাঁর ভাষার ওপর অধিকারের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। তাঁর অনেক বর্ণনাই বাংলা গদ্যে নতুন সংযোজনা; প্রকাশভঙ্গিতে ভিন্ন স্বর সংযুক্ত। বিষয় ও প্রতীতি অনুযায়ী ভাষার স্থানিক উদ্ভাস নিজস্ব মেজাজে ব্যক্ত করেন তিনি; যা ব্যাপ্তিতে ও গভীরতায় অন্যান্য কথাসাহিত্যিকদের তুলনায় ভিন্ন কিন্তু ইমদাদুল হক মিলনের কাহিনির জন্য অনিবার্য।
(লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, writermiltonbiswas@gmail.com)