পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় তাঁর ‘বিবিধ আখ্যান ও টেকনোলজি’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেছেন, ‘… লেখককে শুধু একবার মাত্র মৌলিক হবার সুযোগ দেয়া হবে। শুধু একবার। সে মৌলিকতায় যদি সে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে, তাহলে তাকে তার ঐ মৌলিকতাতেই শেষ দিন পর্যন্ত লিখে যেতে হবে, অবিশ্যি যতোদিন তাকে লিখতে দেয়া হয়, যতদিন আর একজন লেখক জনপ্রিয়তার মৌলিকতা নিয়ে কাগজে এসে না পড়েন।’ (‘উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে’, প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন্স, কলকাতা, ১৯৯৪ পৃ. ২৩)। উপর্যুক্ত ভাবনাটি নাসরীন জাহানের (জন্ম ১৯৬৪) দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপন্যাসের বেলাতেই মিথ্যা প্রতিপন্ন হলেও ক্রমশ তা সম্য-মিথ্যার লুকোচুরিতে পরিণত। প্রথম উপন্যাস যা তাঁকে পুরস্কার, জনপ্রিয়তাসহ পরিচিতির চূড়ান্তে নিয়ে গিয়েছিল সেই ‘উড়ুক্কু’তে ব্যবহৃত উপস্থাপনা ও ভাষাশৈলী থেকে নাসরীন সম্পূর্ণতই সরে যান একটি নবতর কলাকৌশলে। ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’য় ব্যবহৃত নতুন সে কারিকুরী সফল পরিণতি পায় ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’-এ এবং এরপর প্রকাশিত তাঁর দুটি উপন্যাস ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’ এবং ‘সোনালী মুখোশ’-এ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উড়ুক্কু’-র উপস্থাপনা কৌশল পুনঃস্থাপিত। বিষয়গত বৈশিষ্ট্যেও সাযুজ্য যথেষ্ট স্পস্ট। ‘উড়ুক্কু’, ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’ এবং ‘সোনালী মুখোশ’–এ তিনি প্রত্যক্ষ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তাঁর প্লটকে নির্মাণ করেন। সে নির্মাণ ‘বৈদেহী’ (১৯৯৭)-তে অসাধারণ মানবিক উপস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যক্ষ বাস্তবতার সে ধারাটি পরবর্তীকালে ‘শঙ্খনর্তকী’ (২০০৩) পর্যন্ত বিবর্ধিত; যদিও মাঝখানে ‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’তে ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’ এবং ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’-এর মত তিনি পরিক্রমণরত এক স্বপ্নেরজগতে – যে জগতে পার্থিব স্বাভাবিক বাস্তবতা সর্বদাই পরোক্ষ, সর্বদাই প্রতীকী।
কৈশোর থেকে লেখালেখি শুরুর পর পাঁচটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ পায় নাসরীনের এবঙ তারপর ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘উড়ুক্কু’। এর এক বছর পরই প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’ – যা তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত পেয়েছিল। ১৯৯৫-এর বই মেলাতে প্রকাশিত হয় আরও দুটি উপন্যাস ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ এবং ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’। আর সবশেষে ১৯৯৬-এর বই মেলাতে প্রকাশিত হয়েছে তার দীর্ঘতর উপন্যাস ‘সোনালী মুখোশ’। বাস্তবকে অবলোকন এবং তা উপস্থাপনে নাসরীন যেমন সহজাত তেমনি শৈলীতেও সর্বদাই নিরীক্ষাধর্মী। কিন্তু, ক্লেদময় চারপাশের সমাজের চিত্রকে অবলম্বন করে নির্মিত ‘উড়ুক্কু’ থেকে সম্পূর্ণতই স্বপ্নে জগতের ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ তার কলমের বিস্তারকেই নির্দেশ করে। সাধারণ জনপ্রিয়তার মোহে তিনি ভোতা না হয়ে বরং চ্যালেঞ্জকেই আশ্রয় করেন – বিষয় ও প্রকরণগতভাবে পূর্বের উপন্যাসের তুলনায় সম্পূর্ণ বিপরীত একটি অবস্থানে ডিঙা ভেড়াতে তিনি পশ্চাৎপদ হন নি।
ক্লান্তিকর চারপাশের বিরূপ ও ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মেয়ে নীনাকে নিয়ে ‘উড়ুক্কু’ যেমনভাবে নীনার ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পাই আমরা উপন্যাসটিতে, তেমনি নীনার প্রতিবেশও যথেষ্ট পুঙ্খানুপুঙ্খতায় এতে বর্ণিত। আর এভাবেই ক্লেদময় আমাদের চারপাশ এবং সে চারপাশের ভেতরে স্থিত নীনার চিন্তা-চেতনা একাদিক্রমে হাজির। অত্যন্ত জীবন্ত সে চিত্র। প্রেম-যৌনতা, হতাশা-ব্যর্থতা, ভালবাসা-বন্ধুত্ব, রাজনীতি-সংঘাত কোনটিই সেখানে অনুপস্থিত নয়।
ঢাকা শহরে বেসরকারি অফিসে কেরানির চাকরি করে নীনা। সামান্য বেতন দিয়ে কোনক্রমে দিন কাটায় সে। থাকে সাবলেটে শানু ও তার স্বামী কামালের সাথে। প্রেম করে রেজাউলের সাথে বিয়ে হয়েছিল নীনার। কিন্তু ক্রমেই রেজাউল থেকে অনেক দূরে। নীনার সন্তান যদিও বেঁচে থাকে না। আর এভাবেই স্বামী-ছাড়া নীনাকে নিয়ে ‘উড়ুক্কু’ শুরু। ইরাকের কুয়েত আক্রমণের সময়ে বর্তমান নীনা স্থাপিত। দুঃখ-দুর্দশা-যন্ত্রণার মধ্যে নীনার অগ্রসরণের সাথে সাথে বিভিন্ন অনুষঙ্গে এসে উপস্থিত হয়েছে তার অতীতও। মফস্বলের গরিব বাবার সন্তান হিসেবে ভাই-বোন-মা-এর দারিদ্র-জর্জরিত সংসার থেকে শুরু করে বোন রানুর মজুমদার নামে বিভ্রান্তকারী মোহসৃষ্টিকারী এক শয়তানের খপ্পরে পড়া ইত্যাদি অনেক কিছু চলে আসে। দুর্গোৎসবের দিনে নিখোঁজ রানুকে খুঁজতে গেলে অজয় তাকে চুমু খেতে হাতে পয়সা দিয়েছিল সে প্রসঙ্গটিও অবলীলায় এসে হাজির হয় উপন্যাসে। শিল্পী হিমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। রেজাউলের সাথে বিবাহপূর্ব ও বিবাহকালীন সময়ের বর্ণনাও কখনও পাত্র-পাত্রীদের আলাপের ভেতর দিয়ে কখনও নীনার চেতনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়। নীনার ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠরত আরেফিন, বন্ধু সত্যজিৎ, শিল্পী বন্ধু সালাহদীন, বন্ধু রঞ্জু প্রভৃতি সবাইকে চারপাশে রেখেই নীনাকে। সবশেষে মায়ের বিবাহপূর্ব, প্রেমিক ইরফান চাচার সাথে, যিনি শিল্পের এক অত্যন্ত প্রাণপূর্ণ সমালোচক এবং সংগ্রাহক, তার সাথে নীনার পরিচয় নীনাকে আশার আলোতে আনতে প্রধান ভূমিকা রাখে। ছাড়াছাড়ি অবস্থাতে যখন রেজাউল আবার নীনার সাথে সম্পর্ক স্থাপন আগ্রহী, অফিসে-বাসায় নিজে, বন্ধু দিয়ে নীনার মনকে ভেজাতে চেষ্টা সবসময়ই – এক বৃষ্টিভরা সন্ধ্যায় নীনার সাথে রেজাউলের শারীরিক সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয। যার পরিণতিতে নীনারসাথে রেজাউলের শারীরিক গ্রহণের ব্যাপারে তার অমত থাকলেও প্রিয় বন্ধুদের পরামর্শেও গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করতে রাজি হয় না সে। ওমরের সত্য-বন্ধুত্ব এবং আশ্বাস এবং সে সাথে ইরফান সাহেবের প্রাণদায়ী ঔদার্য নীনাকে লড়াই করে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রত্যয়ী করে, চারপাশের সকল রোষদৃষ্টির সামনে সামাজিকভাবে অবৈধ সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে আগ্রহী করে।
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’তেই নাসরীনের একটি ভিন্নজগৎ পরিদৃষ্ট হয় পাঠকের কাছে।জ্যান্ত বাস্তবকে চেতন-অবচেতনের ছবি দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারঙ্গম যে-নাসরীনকে ‘উড়ুক্কু’তে আমরা দেখলাম তার কাছে স্বপ্নলোক এখন প্রধান অবলম্বন। রূপকথার ঢঙে কাহিনী নির্মাণে তিনি অগ্রবতী হন। সেখানে বাস্তব আসলেও তা পাঠকের কাছে ঝিলিক দিতে না দিতেই পাঠক আবার ডুবে যান স্বপ্নলোকে ভ্রমণ পরিক্রমায়। সে পরিক্রমণে আমরা পাই অমৃতা ও এক যুবকের গল্প। সে গল্পের লেখকও পাশাপাশি অধ্যায়ে উপস্থিত। মোট বিশটি অধ্যায়ের দশটিতে আমরা পাই লেখককে – যে কি না ঢাকার নাগরিক জীবনে বেকারত্বের যন্ত্রণা ও হতাশায় ক্লিষ্ট। আপসকাম ও আপসকামহীনতার এক আবর্তে প্রতিদিন জর্জরিত সে লেখক। এবং সকলের মধ্যেই স্বপ্নলোকের এক কাহিনী সে নির্মাণ করে যার দুটি চরিত্র – একজন অমৃতা অর্থাৎ কি না চন্দ্রের প্রথম কলা আর অন্যজন টানটান পেশীর শানিত, চৌকস এক যুবক। বিভিন্ন আবর্তের ভেতর দিয়ে অমৃতা ও যুবদের মিলন ঘটে পুনরায় আর তা নির্মাতা লেখক অজেয় আশাবাদের ভাস্বর। ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’তে অলীক রূপকথার যে ট্লট নির্মিতি পায় তার পাশাপামি প্রবহমান থাকে আরও একটি ঘটনাস্রোত যার কেন্দ্রতে থাকেন এক লেখক এবং তার পাশিপার্শ্ব এবং তা জীবন্ত বাস্তবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেই স্থাপিত। রূপকথার ফর্মে উপখ্যান নির্মাণে নাসরীন তাঁর চূড়ান্ত সাফল্যে পৌঁছান ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’-এ যেখানে স্বাভাবিক জীবনচিত্র কোনক্রমেই রূপকথার রাজ্য তেকে বিচ্ছিন্নযোগ্য নয়। অলৌকিক এক গল্প কাঠামোয় বাক্য বা বাক্যাংশ দিয়ে, কখনও বা ক্ষুদ্র আখ্যান দিয়ে পার্থব বাস্তবকে একাকার করে দেয়া হয় কল্পলোকের সম্ভাব্যতার সাথে।
মোট আটষট্টি পৃষ্ঠার ছোট উপন্যাস ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’-এর প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখিকা প্রধান চরিত্র চন্দ্রলেখা সম্পর্কে অবহিত করেন পাঠককে। বোঝা যায় তিনি চন্দ্রলেখাকে নিয়ে একটি গল্প বলতে যাচ্ছেন প্রথম পুরুষের ভাষ্যে এবং সে গল্পটি রূপকথার গল্পের এক আবহ দিয়ে শুরু হচ্ছে। রূকথার এ ধাঁচটি সমগ্র উপন্যাস জুড়েই বর্তমান, কোথাও কোথাও তার তীব্রতা অত্যন্ত তুঙ্গ। সেখান থেকে মাঝে মাজে চকিতের জন্য বাংলাদেশে এরশাদ পরবর্তী সময়ে ফিরে আসেন লেখিকা। সে সময়ের একজন সাংবাদিক মিস্টার এম আলীকে নিয়ে বর্তমানের সাথে সংযুক্তির চেষ্টা চলে রূকথার গল্পটির। নতুন নতুন প্রতীকী অর্থ লাভ করে উপন্যাসের চরিত্র এবং ঘটনার খণ্ডচিত্রগুলো। সম্মোহনী জাদুবিস্তারী রমণী চন্দ্রলেকার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে ক্ষুদ্রকায় এ উপন্যাসের।
সারা উপন্যাস জুড়ে ঘটনাংশগুলো এমনভাবে সংঘবদ্ধ যে একটি নির্দিষ্ট ছকে ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’-এর সরল রৈখিক ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা অযৌক্তিক। হালকা তুলির এক আঁচড় সেগুলোকে পরস্পরের সাথে সংযুক্তি ঘটালেও সেগুলো নিজ নিজ প্রেক্ষিতে নতুন নতুন অর্থবহতায় উজ্জ্বল। সময়ের ব্যাপক ভাঙা-চোরার ভেতর দিয়েও ঘটনাপ্রবাহ যে গতিতে চলে সেটিকে আমরা এখন বলার চেষ্টা করব।
তার প্রাসাদটি কাঠের তৈরি। স্রোতস্বী নদীর জলে এ প্রাসাদের অর্ধেক ডুবে থাকে। দারুণ রূপসী সে। গলায় শাদা তসবির দানা, চামড়ায় দুধ ও রক্তের বিচিত্র মিশ্রণ। তাকে দেশে মনে হয় না সে এ রাজ্যের নারী, তার ধবল দাঁতের স্কুরিত আভায় যখন চতুর্পাশ ঝলসে ওঠে, যখন তার স্থির দৃষ্টির সম্মুখে সার সার নতজানু মানুষ পবনের বেগে তার কণ্ঠ কাঁপাতে থাকে তখনই তার কাজের বিস্তার। তার মূল শক্তি অদ্ভুত সম্মোহন ক্ষমতা। এ দিয়ে তার উত্থান’।
গ্রন্থের ক্ষুদ্র এ প্রথম অনুচ্ছেদটি দিয়েই পাঠক প্রবেশ করেন চন্দ্রলেখার আখ্যানে। এর ঠিক পরের বাক্যেই ঘোষিতহয় তার নাম চন্দ্রলেখা।
চন্দ্রলেখার দূর রাজ্যের রানী। যুদ্ধকালীন এক দুর্ঘটনায় ধর্ষিতা হয় সে। তারপর বিভিন্ন পরিক্রমার ভেতর দিয়ে সে গ্রহণ করে এক রাজ্যের রাজভার। রানী হিসেবে তার আশ্রয় হয় উদ্ভট কিছু আচরণ। রূপকথার এ আবহের ভেতর নাসরীন আঁচড়ে আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন আমাদের দেশের সামগ্রিক রাজনৈতক সমাজ ব্যবস্থাকে, সরকারি ব্যবস্থাকে। যাদুবাস্তবতার যে ধারাটি ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’ এবং ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’-এ বর্তমান। তবে শেষেরটিতে এ ভঙ্গিমা ব্যবহারে নাসরীন অনেক বেশি সফল। ভাষাগত দিক থেকে রূপকথার কাঠামো উপযোগী একটি পর্যায়ে অতনি যেমন উন্নীত হতে পেরেছেন তেমনি উপস্থাপনাগতভাবেও তিনি লাভ করেছেন চূড়ান্ত সাফল্য। বাস্তবতাকে অলৌকিকের আবরণে পরিবেশেনের ব্যাপারে তিনি ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’ থেকে ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’-এ অনেক বেশি পারদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন। এবং অত্যন্ত আনন্দের যে তিনি আবারও তাঁর পথ পরিবর্তন করেন তাঁর পরবর্তী উপন্যাসে। ‘উড়ুক্কু’র ছোপছাপ নতুন করে তাঁর আশ্রয় হয় ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’ এবং ‘সোনালী মুখোশ’-এ।
চতুর্থ উপন্যাস ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’-এ নাসরীন জাহান নতুন বিষয়কে গ্রহণ করলেও ফর্ম বা আঙ্গিকগত দিক থেকে সে উপন্যাসে ‘উড়ুক্কু’র আঙ্গিকের ঢংটি পরিলক্ষিত হয় – যে-ঢং সোনালী মুখোশ পর্যন্ত ব্যাপৃত। ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’ আবর্তিত হয় সরযুকে নিয়ে। যদিও পাশাপাশি অন্য একটি চরিত্র নকিবও এ উপন্যাসের প্রধান চরিত অভিদার দাবিদার। ক্ষীণতম সংযোগে এ দুজন প্রধান চরিত্র পরস্পরের সাথে সম্পর্কিতও বটে। তবে চারপাশে বাতি নেভার প্রেক্ষিতে বলা যায় নকিবের বাতি অনেক কম নিভেছে। তুলনায় সরযুর জীবনের চারপাশের আর কোন বাতি নেই।
মুক্তিযুদ্ধকালে কিশোরী সরযুর পরিবার যখন আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয় এরকম এক সময়েই কান্তিমান এক পাকসেনার মোহনীয় রূপে আকৃষ্ট হয় সে। সামান্য পরিচয়ের সে সূত্রেই অজানিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে ফেলে সরযু। সারা গ্রামে আক্রমণ হয় পাকসেনাদের। বেঁধে নিয়ে যাওয়ার পর পিতার সামনেই ধর্ষিতা হয় সরযু। নিষ্ঠুর সে ঘটনার স্মৃতি সারাজীবনেও সরযুকে ছেড়ে যায় না। যুদ্ধোত্তরকালে এ ঘটনার কারণেই পিতার সাথে কন্যার স্বাভাবিক সম্পর্ক হয়ে পড়ে অসম্ভব। এ রকমই এক সময়ে পিতার বিপত্নীক বন্ধু শফিউল আলম আসেন ওদের বাড়িতে। সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে দয়াপরবশ হয়ে তিনি বিবাহ করেন সরযুকে, যদিও বিয়ের আগেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয় তাকে। এক পর্যায়ে এসে স্বামী ও তার অতীত নিয়ে হয়ে পড়ে সংকুচিত। পাকসেনা কর্তৃক সরযু ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনা স্মরণে সে হতে থাকে নির্জীব। স্বামীর ছেলে বিদেশ ফেরত রাহুলের সাথে বন্ধুত্ব হয় সরযুর। হঠাৎ করেএকদিন স্বামী মারা গেলে স্বামীর আত্মীয়জনেরা ঝেটিয়ে বের করে দেয় তাকে। প্রকাণ্ড ঢাকা শহরের াগরিক জীবনে সরযু হয়ে পড়ে একা, নিঃসহায়, নিরবলম্ব। জন্ম হয় সন্তান মিতুলের। স্বামীর বন্ধু হুমায়ুন রেজার রক্ষিতায় পরিণত হয় সে ক্রমশ অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে। একদিন খুন হয় মিতুল। মানসিক বৈকল্য আঁকড়ে ধরে সরযুকে।
এত বেশি হারানোর যন্ত্রণা যে-সরযুরে তার পথে নকিবের উপস্থিতি চারপাশ খুব বেশি দাগকাটার নিশ্চয়ই নয়। নীনা উত্তমপুরুষে ‘উড়ুক্কু’র কাহিনী শুরু করলেও সরযু তা করে না। এখানে বক্তা লেখিকা এবং তিনি নকিবকে দিয়েই উপন্যাসের কাহিনীর উন্মোচন করান এবং তারপরও নকিব নয় সরযুই এ উপন্যাসের প্রধান লক্ষ্য। নির্মম বাস্তব, তার কশাঘাত, হতাশ পরিণতি এসব কিছুই ‘উড়ুক্কু’র মত ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’তেও সমানভাবে উপস্থিত এবং সে ব্যাপারটি একই রকমভাবে বিদ্যমান ‘সোনালী মুখোশ’ এর কল্পনার জগৎটা মাঝে মাঝেই বড় বেশি খুলে গেছে, একাকার হয়ে গেছে বাস্তবের ধারালো সর্পিল চিত্রের সাথে।
‘সোনালী মুখোশ’-এ পাশাপাশি দুটি গল্পের বিস্তার ঘটানো হয়েছে সে গল্পদ্বয়ের অন্যান্য চরিত্ররা খুব বেশি করে পরস্পরের সাথে পরিচিত না হলেও মূল দুই চরিত্র অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্ররা একে অপরের ঘনিষ্ঠ-তারা এক সময় প্রেম সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। পরবর্তী জীবনে একজন অর্থাৎ পুরুষটির যার নাম কিনা জাহিদ সে বেকার এবং অন্য আরেকজন যার নাম নিশি সে স্বামী সবকিছুই ক্রমান্বয়ে আলুথালু হয়ে এসে জড়ো হয় পাঠকের সামনে। দূরতরভাবে সম্পর্কিত দুটি গল্পধারার এমন সমন্বয় প্রচেষ্টা যদিও নাসরীনের এ উপন্যাসেই প্রথম নয়, তার পূর্ববর্তী উপন্যাস ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’তেও এমন প্রয়াস লক্ষণীয়। শৈলীটির মধ্যে অভিনবত্ব যে খুব বেশি নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না এবং তারপরও ‘সোনালী মুখোশ’ সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে – এতে ধৃত মনুষ্য মনের বিচিত্র জগতের ছবির জন্য। যদিও অধিকাংশ প্রকৃতি সাহিত্য বিচিত্র মনোজগৎকেই উপহার দেয় কিন্তু তারপরও নাসরীন এ ব্যাপারে বিশেষত্বের অধিকারী। ‘সোনালী মুখোশ’-এ তিনি তাঁর প্রিয় এবঙ অত্যন্ত আদলের গড়া চরিত্রগুলোর মুখোশ বারেবারে খুলতে থাকেন যা পাঠককে যেমন অভিনবত্বের আলোয় উদ্ভাসিত করে তেমনি বিলোল অনুভূতি ঘটায় আবিষ্কারের আলোয়। বহুস্তরা মনুষ্য মনের যে শেষ স্তর বলে কিছু নেই তাই যেন ধৃত হতে থাকে সারা উপন্যাস ধরে। প্রধান চরিত্রগুলোর মনোরাজ্যের এ সন্ধানকার্য লেখিকা ক্রমান্বয়ে করতে থাকেন তাঁর বিশেস বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভাষা দিয়ে – সে ভাষায় শব্দের নতুন নির্মিতির ঝলক পাঠককে হিল্লোলিত করে, উপস্থাপনায় সে-ভাষা স্বাবলম্বী।
নিশি তার স্বামী আফজালের সংসারে বদ্ধ। টুটিটাকি দুর্লভ ভাল লাগার চেয়ে ভাল না লাগার ঢেউ সেকানে অনেক বেশি। একদিকে সন্তান কামনা, সে কামনা পুরণে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা, অন্যদিকে স্বামীর সাথে নিয়তই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি। বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের অস্তিত্বকে ঊর্ধ্বমুখী করবে সে সাহসও নেই। এ রকমই এক নিশিকে কেন্দ্র করে ‘সোনালী মুখোশ’-এর দুটি গল্প ধারার একটি নির্মাণ। এতে সংযোজিত নিশির চলমান বর্তমান এবং স্মৃতিস্থিত অতীতও। জাহিদের সাথে নিশির প্রে, সাজিদুলের সাথে তার দীর্ঘ দু’বছরের অবিবাহিত অথচ স্বামী-স্ত্রীতে সম্ভব শারীরিক সম্পর্ক ইত্যাদি সব কিছু যেমন নিশির করোটি থেকে পাঠকের সামনে চিত্রিত, তেমনি বর্তমানের নিশির অসুস্থ সাজিদুলকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া, তা থেকে সৃষ্ট দাম্পত্য সমস্যা ইত্যাকার সবকিছুরও সম্মিলন ঘটে। ‘সোনালী মুখোশ’-এর দ্বিতীয় যে ধারাটি সমান তালে যথেষ্ট গুরুত্বে এ উপন্যাসে স্থাপিত তার কেন্দ্রে রয়েছে নিশির পূর্ব-প্রেমিক জাহিদ। সে-ধারাতে নিশিকে নিয়ে জাহিদের অতীত, জাহিদের বাবা-বিষয়ক ঘটনা ইত্যাদির সাথে বাবার কাছে আশ্রিতা এক নারী – যার গর্ভে বাবার সন্তান ছিল তাকে খুঁজতে যেয়ে অচিন্ত্যপুর গ্রাম জাহিদের সকর ঘটনাদির বিবরণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি এ দুটির সমন্বয়ে একটি নতুন নির্মিতি ঘটেছে এবং তারই শিল্পরূপ ‘সোনালী মুখোশ’।
মানুষের সামগ্রিক অস্তিত্ব তার চেতনাস্থিত অতীত এবং বর্তমানের চতুর্পাশের সমন্বয়। ভালোমন্দে সাধারণ হিসেবে সেখানে শর্ত হিসেবে খুবই নগণ্য। ‘সোনালী মুখোশ’-এর নিশি একজন সাধারণ মানুষ যার চেতনা ও কর্মবিস্তার পুঙ্খানুপুঙ্খতায় এ উপন্যাসে নির্মাণ করা হয়েছে। নিশির সাথে জাহিদুলের প্রেম ছিল। অবস্থান পরিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সে প্রেম বাস্তবে রূপ পায়নি। পরে তার সাথে সম্পর্ক হয় সাজিদুলের। সাজিদুল সে সময় থাকত মমতাদি’র বাসায়। গোপনে বিয়ে করেছে এ ছুতোয় দাম্পত্য জীবনের কে প্রতিচিত্র চলে সেখানে। দীর্ঘ দু’বছর সে সম্পর্ক টিকে ছিল। সাজিদুলের দিক থেকে নিশির জন্র ছিল সৌন্দর্য ও মমত্ববোধ। ইতিমধ্যে অফিসের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আসে সাজিদুলের বিরুদ্ধে। কোর্টে সাজিদুল স্বীকার করে তার দোষ। জেল হয় সাজিদুলের। কিন্তু এক বছর না পেরোতেই সাতদিনের পরিচিত আফজালকে নিশি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে বিয়ের সাত বছর পর আমাদের গল্পের শুরু।
‘…যে আমার কেউ ছিল না, যাকে আমি চিনতাম না, তার সঙ্গে একটা জীবন কাটাচ্ছি, তাকে জীবনের সব করেছি, অথচ ঘুম থেকে একটু জাগানো, এই চিন্তা করতেই তার ভয়ে কেঁপে উঠছি’, (পৃ. ৩৫)। ঘুমন্ত স্বামীকে জাগানোর ব্যাপারে নিশির এ চিন্তা থেকে ক্ষণভঙ্গুর তার দাম্পত্য সম্পর্কটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে সাজিদুল ও নিশির লোমহর্ষক ঘটনার পূর্ব সে সম্পর্কে শুধুই টানাপোড়েন, শুধুই নির্মাণ প্রচেষ্টা এবং ব্যর্থ হওয়া।
শিক্ষিকা রোজলিনকে জাহিদ ভালবাসতো, তার তখন কৈশোর বয়স। যে ভালবাসায় নিশিতে পাওয়া মানুষের মত জাহিদ কবর খুঁড়ে মৃতার হাত থেকে আংটি আনতে বিক্রম দেখায়। অথচ ঐ ঘটনার পর থেকেই রোজলিনকে আর ঐ শহরে দেখা যায় নি। তারপর জাহিদের সাথে নিশির প্রেম। উপন্যাসের বর্তমান সময়ে এসে জাহিদ যখন পূর্ণ যুবক তখনও ‘জীবনে তার নারী সঙ্গমের অভিজ্ঞতা নেই’ (পৃ. ১৪৫)। অথচ সেই কি না নিশির জন্মদাগ দেখার জন্য াগল প্রায় হয়ে যেত। জাহিদের বাবা আশেক আলী মীরের জীবনে আছে এক অনুন্মোচিত অধ্রায়। একরাতে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। দিশেহারা হয়ে এক বাড়ির দরজায় ধাক্কা দেয় সে। সে বাড়িতে তার সাথে পরিচয় ঘটে অত্যাচারে অতীষ্ঠ এক রমণীর। তার অনুরোধে তাকে বাঁচাতে নিয়ে আসে ঢাকায়। কি এক গভীর টানে সেই মহিলার সাথেই হয়ে পড়ে শারীরিক সম্পর্ক। সন্তান আসে তার।
‘আমি পলায়া আসি’ জাহিদের বাবার উক্তি। হারপর সেই মহিলার মেয়ে হয়। অন্যের রক্ষিত হয়। শিকার হয় সামাজিক অবিচারের। দুর্ঘটনায় মারাত্মক আঘাতের পর বাবার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পূর্বে জাহিদকে বলা তর অনুরোধ রাখতে জাহিদ যেয়ে পৌঁছে অচিন্ত্যপুর গ্রামে। বাবার সেই মহিলার বাছে বাবার দশ হাজার টাকা পৌঁছে দিতে। ‘সোনালী মুখোশ’-এর জাহিদ-আখ্যান এভাবেই শুরু। সে গ্রামে এক বৃদ্ধা ও তার কন্যা হীরার সংসারে জাহিদ আশ্রয় নেয়। দু’মাসের অধিককাল সে গ্রামে জাহিদের অবস্থানকালে যেসব ঘটনা ঘটে সেগুলো ছাড়াও সেখান তেকে শহরে ফিরে আসার পর বেকারগ্রস্ত জাহিদের পারিপার্শ্বও এতে বর্ণিত হয়েছে।
‘সোনালী মুখোশ’-এ প্রধান চরিত্র নিশি ও জাহিদ ছাড়াও যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে নিশির স্বামী আফজাল ও নিশির অন্য সেই প্রেমিক সাজিদুল। আছে নিশি-আফজালের বন্ধু রেজা-স্বাতী দম্পতি। নিশির বোন রিনি জেলখানায় সাজিদুলের সাথে যে যুবকের পরিচয়ের পর সাজিদুল তাকে অনুসরণ করে পালাতে চেয়েছিল সেই ওসমান। আচে মুস্তাফা যার সাথে শেষদিকে এসে নিশির পরিচয় ঘটে যখন নিশি আফজালের সংসারে নেই। বিরাট জাগয়া নিয়ে আছেন মমতাদি। সন্তান থাকার পরও যিনি নিঃসন্তানের মত, যার কাচে সাজিদুল থাকে পরিবারের একজন মানুষের মত।
এ প্রজন্মের পূর্ববর্তী প্রজন্মটিও ‘সোনালী মুখোশ’-এর বেশ গুরুত্বের সাথে এসেছে। সেক্ষেত্রে জাহিদের বাবা-মা সবছেয়ে বেশি আলোচনার যোগ্য। এরকম আরও রয়েছে আফজালের মা-বাবা, নিশির মা-বাবা। উভয় প্রজন্মের এতগুলো চরিত্রকে পাশাপাশি নির্মাণ করে শহর ও গ্রাম উভয় প্রেক্ষাপটে পিতা-মাতা ও সন্তান পরস্পরকে অবলোকনের কাজটি চলতে থাকে।
মানুষের দাম্পত্য জীবনের অস্থিরতার এক নিপুণ শব্দ-রূপ ‘সোনালী মুখোশ’। প্রকৃত সত্য, প্রকৃত বাস্তবকে অপ্রকাশিত রেখে দাম্পত্য সম্পর্কের বিমূঢ় চিত্রটি এ উপন্যাসে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমাদের। মিথ্যা আচরণ, মিথ্যা ভাষণ সে সম্পর্কের অস্তিত্বকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কী ভীষণ ক্রিয়াশীল। কম্পাস ভাঙার পর বাবার শাস্তি এড়াতে উপায় উদ্ভাবন প্রশ্নে নিশি সম্পর্কে লেখিকা বলেন, ‘তাকে বরাবরই রক্ষা করেছে মিথ্যাকেই মিথ্যার চর্চা করতে তার বুদ্দির সূক্ষ্ম দরজাগুলো খুলে যাচ্ছিলো’ (পৃ. ৬৫)। আর এ মিথ্যার বেসাতির মধ্যে স্বামী আফজালের সম্পর্কে নিশির ভাবনা, ‘আমাদের দু’জনকে হয়তো এ জীবনে পাশাপাশি চলতে হবে, যেহেতু মাঝখানে সন্তান নেই, এভাবেই কেউ কাউকে গভীরভাবে অনুভব না করেই সংসার ভাঙার মতো বিপর্যয়ের বিষয়ে আমাদের দু’জরেনই যেহেতু সমান ভয়, সেহেতু কিছুটা মায়া, কিছুটা মিথ্যা, কিছুটা অভিনয়, এভাবেই …’ (পৃ. ৬৮)। গভীরে প্রোথিত এসব মিথ্যা ও অভিনয়ের ব্যাপ্তি রয়েছে রেজা-স্বামী দম্পতির ভেতরেও। আছে নিশির মা-বাবা, আফজালের মা-বাবা, জাহিদের মা-বাবার মধ্যে। সাজিদুলের মা-বাবা? ‘মার মৃত্যুর পর ওর বাবা আবার বিয়ে করে। এক সময় দ্বিতীয় মার প্ররোচনায় বাবা তাকে [জাহিদকে] ঘর থেকে বের করে দেয়।’
নাসরীন জাহান তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপন্যাস ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’ এবং ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’-এর রূপকথার আদলে তাঁর উপন্যাস রচনার যে প্রয়াস চালিয়েছেন তা থেকে পরবর্তীতে জিনিস আবার নতুন জায়গায় স্থিত হয়েছেন। চিন্তা এবং পারিপার্শ্বিক প্রকৃত বাস্তব নতুন করে আবারও তার উপন্যাসে গুরুত্ব পেয়েছে যেমনটি ঘটেছিল তার প্রথম উপন্যাস উড়–ক্কুতে। সেখানে নতুনভাবে মাত্রা যোগ হচ্ছে বইকি। ভাষাশৈলীতেও যেমন তিনি অর্জন করে চলেছেন অধিকতর পূর্ণতা। স্বোপার্জিত শব্দ ভাঙার এবং রূপক-প্রতীক নির্মাণ তাঁর রচনাকে ক্রমশই করে তুলেছে অধিকতর সুখপাঠ্য, প্রাণস্পর্শী। শব্দ নির্মাণ এবঙ তা ব্যবহারের এ নিরীক্ষা যদিও ‘উড়ুক্কু’ থেকেই লক্ষণীয় কিন্তু ‘সোনালী মুখোশ’-এ এসে তার মেধা ও চাতুর্য অনেক বেশি প্রীতিকর।
প্রথম উপন্যাস ‘উড়ুক্কু’র গল্পের কাঠামোটি একটি মাত্র থামের উপর দাঁড়িয়ে। অত্যন্ত গাঢ় কিছু ভিন্ন আখ্যানের সেখানে মিশেল থাকলেও তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করে তার গুরুত্ব বা ভূমিকা বিশ্লেষণের দরকার হয় না। কিন্তু ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’তে উপন্যাসের প্লটটি দু’টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র থামের উপর দাঁড়িয়ে – যার একটি প্রধান চরিত্র মর্মস্পর্শী হৃদয় কাঁপানো সরযুর এবং অন্যটি নকিবের, যাকে সরযুর বর্তমানে প্রধান চরিত্রে অভিধা দেয়া যায় না বলেই আমরা দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র বলতে চাই। এ নির্মাণ শৈলীর সুবিধা কি? যে সমাজে সরযুর অবস্থান তার সবকিছু সরযুর চারপাশ দিযে স্পষ্ট হয় না – কেননা সরযু তো অধিকাংশতই অতীতসর্বস্ব, মনোবৈকল্যের শিকার। সে চারপাশ পূর্ণতা পায় নকিবের চতুর্পাশ দিয়ে। ‘সোনালী মুখোশ’-এর ক্ষেত্রেও কারিকুরিগত এ সাযুজ্য বিদ্যমান। নিশিকে নিয়ে গড়ে ওঠা অন্যান্যদের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব ও সফলতার নির্মাণ পায় জাহিদের আখ্যান। এতে করে স্মৃতি থেকে আসা ওদের দুজনের পরস্পরের প্রতি অনুভূতি এবং ভাবনাকে যেমন আমরা অনুপুঙ্খে দেখার সুযোগ পাই, সাথে সাথে আরও লাভবান হই এ কারণে যে জাহিদ বিষয়ক আখ্যানটির বিরাট একটি অংশ গ্রামের পরিবেশে আশ্রিত হওয়ায় গ্রামের মানুষের সংস্কার, চেতনা, ভাবনা, বেদনা, হতাশাকেও আমরা পেতে থাকি যা শহুরে পরিবেশে স্থাপিত নিশির আখ্যানটির সাথে সাথে একটি প্রাতঃকাল উপহার দেয়।
‘বৈদেহী’তে যে কোন গভীর মনস্ক পাঠকও খুঁজে পাবেন শিল্পবোধ। যেমন গল্প-উপস্থাপনা তেমনি বিষয়-প্রসঙ্গেও উপন্যাসটি পাঠকের মনোযোগ দাবি করে সহজেই। উপন্যাসটির কথক দুজন; দুজনেই উত্তমপুরুষের বক্তা: একজন নীরা আর একজন হাসান। প্রত্যেক বক্তা একটি একটি অধ্যায়ে তাদের নিজেদের কথা বলে। তাদের বিবরণে যেমন অতীত উপস্থাপিত হয় তেমনি বর্তমানেরও সংশ্লেষ ঘটে।
‘বৈদেহী’ কি নাসরীন জাহানের সবচেয়ে মননস্পর্শী উপন্যাস। তাঁর উপন্যাসের যে কোন পাঠকই সম্ভবত এমন একটি প্রশ্নের ইতিবাচক সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। নীরার কাহিনীর বিভিন্ন অনুষঙ্গ ক্রমান্বয়ে পাঠককে আলোড়িত করতে থাকে। নীরা তার পঙ্গু স্বামীকে ঢাকাতে রেখে চিকিৎসার ব্যয়বার বহন করতে করতেই পঙ্গু। নিজের দেহ বিক্রি করে আয় করা ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ খোলা থাকে না। নীরার এই জাল-দীর্ণ অবস্থা পাঠকের মর্মমূলকে নাড়া দিতে থাকে ভীষণভাবে। এসবেরই ভেতর দিয়ে একসময় হাসান-নীরা স্থিত হয় একটি অনাবিল ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়।
‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’তে নাসরীন কিন্তু আবার অনুসন্ধানী একটি রহস্যময় জগতে এবং এমনটিও হয়তো বলা চলে যে যাদুবাস্তবতার প্রধান যে উপাদান অর্থাৎ অভিঘাতমূলক উপাদান তা বোধহয় এ উপন্যাসটিতেই সবচেয়ে বেশি করে উপস্থিত। ওসমানের অস্তিত্বগত এ অনুসন্ধান বাইরে থেকে ক্রমে ক্রমে ভেতরের দিকে।
ওসমানের জন্মের সময় থেকেই সে-সব রহস্যের শুরু। তারপর তিরিশ বছর আগে নয়নপুর গ্রাম থেকে ওসমানের বিদায় যখন শত্রুর হাতে নিহত হয় ওর মা-বাবা। দীর্ঘ তিনটি ধমক শেষে ওসমান আবার ঐ গ্রামেরই মুখোমুখি। না, বিচার চায় নি সে; শুধু চেয়েছিল একটু আশ্রয় নিজ জন্মস্থানে। কিন্তু ভাগ্যের পরিণতি এমনই যে ওসমানের তাও জোটে না। উপন্যাসের মেষে তার মৃত্যুই আমরা প্রত্যক্ষ করি এবং সেটা ফজলুর হাতে – যে ফজলু কিনা শৈশব থেকেই ওসমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
২০০৩-এ প্রকাশিত ঔপন্যাসিকের দীর্ঘতম উপন্যাস ‘শঙ্খনর্তকী’ আকারগত প্রশ্নে দীর্ঘ হলেও শিল্পপ্রশ্নে ততটা সফল নয় বলেই মনে হয়। ‘বৈদেহী’তে গল্প-কাঠামোর যে নান্দনিকতায় নাসরীন পৌঁছতে পারেন বা ‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’তে ওসমানের কাহিনী-নির্মাণে ঔপন্যাসিকের যে দক্ষতার পরিচয় পাঠক লাভ করেন, ‘শঙ্খনর্তকী’তে কথাশিল্পী তেমন একটি মাত্রায় নিজেতে সমর্পণ করতে পারেন বলে মনে হয় না। প্রধান দুই চরিত্র অঞ্জন এবং মিলির কাহিনীর অনেক কিছুই পাঠকের কাছে আরোপিত হিসেবে উপাস্থিত হয়। মনেহয় কাহিনীর দৈর্ঘ্য-বৃদ্ধিই যেন একমাত্র কাজ পাঠকের। তাই-পূর্ববর্তী দুই উপন্যাস ‘বৈদেহী’ এবং ‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’তে ঔপন্যাসিক সাফল্যের যে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হন, শঙ্খনর্তকী সে-উত্তরণে কোন সংযোজন নয়।
সমাপ্তিতে শুরুতে উদ্ধৃত দেবেশ রায়ের ভাবনাকে আবার স্মরণ করতে চাই। একবার মাত্র মৌলিক হওয়ার সুযোগ লেখক পাবেন এটা ঠিক কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায় – লেখক নিজেই সচেষ্ট থাকবেন নিজের মৌলিকতার মধ্যেই নিজের সৃষ্টিকে শানিতকরতে, না হলে তো লেখকের মৃত্যুই ঘটে বলে অনেকে মনে করেন।
1 Comments
Samina
খুব যত্ন করে লিখা। অনেক ভাল লাগলো।