যে সকল পাঠক ইংরেজি ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের (১৮১২-১৮৭০), ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ (১৮৪৯) পড়েছেন তাঁদের জানা আছে উপন্যাসটি ঐ ভিক্টোরিয়ান ঔপন্যাসিকের আত্মজীবনীর ছায়া। খুবই বিস্ময়ের এবং সম্ভবত পৃথিবীর সাহিত্যের এমন নজির বেশ ভার যে ডিকেন্স এগার বছর পর আবার একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস প্রকাশ করেন যার নাম ‘গ্রেট এক্সপেকটেশান্স’ (১৮৬০)। ঔপন্যাসিক সার্থক কারণ তিনি উপন্যাসদ্বয়ে পৌনঃপুনিকতাকে এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘মানুষের বেড়ে ওঠা’র কাহিনী নিয়ে ডিকেন্স যদিও তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরুতেই রচনা করেছিলেন ‘অলিভার টুইস্ট’ (১৮৩৭)। শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করে একটি চরিত্রের বিকাশ জার্মান ভাষায় যা ‘বিলগানস্রোমান’ বলে পরিচিত বিশ্ব উপন্যাসে তা একটি শক্তিশালী ধারা। বাংলা ভাষাতেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), সুলেখা সান্যাল (১৯২৮-১৯৬২), হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪), আকিমুন রহমান (জন্ম ১৯৫৯) এবং অতি সাম্প্রতিক শেখ আলমামুনের (জন্ম ১৯৭৩) অপু, ছবি, মাহবুব, পারভীন বা নূহুলের মতই কিশোরও এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতে পারে বাংলা সাহিত্যে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা রচিত দুটি উপন্যাসেই কিশোর এক আকর্ষণ যার আরও সুসংগঠিত রূপের প্রত্যাশায় অনেক বাংলাভাষী পাঠকের মত বর্তমান আলোচকও।
অলিভার টুইস্ট, ডেভিড কপারফিল্ড বা পিপ ডিকেন্সের উপন্যাসগুলোতে লেখকের ছায়া নিয়ে উপস্থিত। সে ছায়ার কায়া লেখকের কলম নির্ভর। সমালোচক তন্নতন্নতে প্রয়াসী আর তাই ডেভিড কপারফিল্ডের আদ্যাক্ষর ডিসি আসলে ঔপন্যাসিকের নামের আদ্যাক্ষর অর্থাৎ সিডির স্বেচ্ছা প্রণোদিত ভ্রংশ বলেও দাবী করেন। অলিভারের কতখানি ডিকেন্স বা ডেভিড নিজেই পুরোটা ডিকেন্স কিনা, কিংবা ফিলিপ পিরিপ অর্থাৎ পিপ কত বেশি লেখকের সাজুয্যে বিচার্য সে বিতর্কে না যেয়ে বরং আমরা ঐ আপ্ত বাক্যকেই মেনে নিতে চাই যে উপন্যাস মাত্রেই আত্মজৈবনিক – তা যে বিচারেই হোক না কেন। লেখকের সাথে লিখনের চরিত্র, ঘটনা বা ভাবনার সমান্তরালতা অপ্রতিরোধ্য। তবে যুগের অগ্রসরতার সাথে সাথে লেখকের প্রকাশভঙ্গী এবং প্রকাশ্যতব্য বিষয়েও ভিন্নতা স্বাভাবিক। অপুকে যে নির্মলতায় পাঠকে পান, সন্দীহান সমালোচক তেমন পান না। অপুর জীবনে তেমন ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে যেমনটি মাহবুবের জীবনে আমরা পাই। বিভূতিভূষণের কাল শরীর মোচনের এ অনুভূতি সাহিত্যে স্বীকৃতি দেয় নি; হুমায়ুন আজাদ সাহস দেখিয়েছেন, যদিও সমালোচনার তীর তিনিও এড়াতে পারেন নি। বুঝতে পারি ছবি ফরিদপুরের কোড়কদিতে যেভাবে উপস্থিত তার জীবনেও ছিল পারভীনের মতো রজঃস্বলাসময়ের দীর্ণতা যা বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের বাঙালি লেখিকার কলমে আশ্রয় পায় নি। নারী ঔপন্যাসিকের গ্রন্থে সে বিষয় যখন পূর্ণাঙ্গ বিস্তৃতিতে পরিস্ফুটিত, তখন পঞ্জিকায় শতাব্দীর পাতা উল্টে যায় যায়। কাব্যপ্রাণ মুহম্মদ নূরুল হুদা সে পাতা উল্টে যাওয়ার আগেই লিখেছিলেন ‘জন্মজাতি’ (১৯৯৪) এবং ‘মৈনপাহাড়’ (১৯৯৫)। দুটি উপন্যাসেই কিশোর উপস্থিত – দ্বিতীয়টিতে প্রধান চরিত্র হিসেবে আর প্রথমটিতে অন্য অনেকের মতই; তবে উল্লেখ্য প্রথমটিতে আসলে হয়তো প্রধান কোন চরিত্রই নেই। কিশোর দেখেছে তার মা ফিরোজা বিবির সাথে তার দু নম্বরের খসম মন্নু মাঝির শারিরীক ক্রিয়াদি, থম্ভুর শরীর কিশোরে যে আগুন জ্বালায় তার নির্বাপন ছলুতে যা কিনা পায়ুঃক্রিয়া নামে পরিচিত। কিশোরের অভিজ্ঞতায় রয়েছে মানুষের পশুগমণের দৃশ্য দেখার। আর কিশোরের এমন সব অভিজ্ঞতা বাঙালি সমালোচকের সহনশীলতার সীমা ছাড়া বলেই হয়তো পাঠক সমাজে মুহম্মদ নূরুল হুদা কম আলোকিত ঔপন্যাসিক ।
‘জন্মজাতি’র শুরুর বয়ান কিন্তু কিশোরের নয়। কথক সেখানে অনু। নাকি অতনু? লুসাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনু যার শুরু হয় ‘যখন শেষ হলো’ অর্থাৎ স্কুলের ছুটির ঘন্টা পড়লে। এই যে দশ-এগার বছর বয়সী বক্তা তার শুরুতে কিন্তু রয়েছে সব লোককথা, লোক কাহিনীÑ স্কুলের দপ্তরী রমণীদাসের অতীত, সুন্দরী বুড়ি খুবসুরত বিবির উপাখ্যান, সোনাবিবি-মৌলবিসাহেব অধ্যায় ইত্যাদি। কিন্তু সেসবের সাথে জড়াজড়ি করে আছে ফুলেশ্বরী নদী বা মৈনপাহাড় যা শিশুতোষ ঐ মানুষগুলোতে নির্মিতি দেয়। সে নির্মাণে সোনাবিবির সাথে মৌলবির ক্রিয়াটি দর্শনস্পর্শিত। সে দর্শন লেখকের, যৌনাক্রীড়ার দার্শনিক উপস্থাপন। উপস্থাপক কবি হওয়ায় তা কাব্যগন্ধীও বটে।
কিন্তু কিশোর কি দেখেছিল? ‘না, ঠিক মনে করতে পারে না। মনে করতে চায়ও না। তবে যা দেখেছে সবই ভাসা ভাসা’ (পৃ ৬৬)। না চাইলেও কিশোর কি পারে নিজেকে ঠেকাতে? দুর্বার আকর্ষণ তাকে যা দেখায় তাতেই বদলে যায় তার জীবনধারা। জীবিকা পাল্টে স্থলজীবন থেকে জলজীবনে প্রবেশ করে কিশোর। অদ্ভুত এক যৌন জীবনেও বটে। বাপ-মা’র পরিচয়হীন রমণীকাকার মতোই কিশোরও জীবনের রুদ্ধ দুয়ারে মাথা খোটে যেন। মৈথুনে হাতের ব্যবহার ঘেন্না জাগায় নিজের উপর, মনের একাকীত্ব যাই হোক শরীরী নৈঃসঙ্গ কাটাতে সাহায্যকারী খোঁজে সে। কিন্তু তার চূড়ান্ত দেখতে আমাদের যেতে হবে লেখকের পরবর্তী উপন্যাস ‘মৈনপাহাড়’-এ।
ঘটনার এ পারম্পর্যতা থেকে কি সহজেই বলা যায় ‘মৈনপাহাড়’ ‘জন্মজাতি’-র দ্বিতীয় খণ্ড? নাকি কথাকার তাঁর দ্বিতীয় প্রচেষ্টাতে কিশোরের কাহিনীকে আরও পরিস্ফুট করতে প্রয়াসী? বাঁকখালী নদী, মৈশখালি প্রণালী আর বঙ্গোপসাগরের প্রেক্ষাপটে লিখিত বাংলা ভাষার সম্ভবত প্রথম উপন্যাসটিতে লেখক শুরু থেকেই কিশোরকে তার পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপনে মনোযোগী। আর তাই কাহিনি সামান্য এগোতেই পূর্ববর্তী উপন্যাসের সেই উপাদান ভর করে লেখকে। ছইয়ের ভেতর উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে থাকা ছলুর উপর উপগত হয় কিশোর। কিন্তু সাপকে পোষ মানাতে না মানাতেই কিশোর দার্শনিক। সে বোঝে ‘সব মায়া। মাইয়া মানুষ মানেই মায়া। পুরুষ দিয়েও হয়, সব হয়। থম্ভু গেলে যে কষ্টের রেশ, ছলুকে পেলে সে কষ্টের শেষ’ (পৃ ২১)। দার্শনিক এই বোধন কিশোরের, নাকি অনুর, নাকি লেখকের নিজেরই। লেখক-করোটির এমন দর্শনজাত বোধ তাঁর উপন্যাসের মানুষেরা বহন করবে তেমনটাই তো স্বাভাবিক।
দুটি উপন্যাস জুড়েই রয়েছে কাব্যকথার ছড়াছড়ি। উপন্যাসের নির্মাণকারী নিজেই কবি উপাধিকারী বলেই কি পাতায় পাতায় এমন কাব্যগন্ধ? অথবা লোকপদের ভীড়? কিশোর নিজেও কিন্তু মিল দেওয়া কথার ভক্ত – যা আমরা জেনেছি ‘মৈনপাহাড়’-এ। জানতে জানতেই আরও অগ্রসরণ। ‘সিনার ভিতরে সিনা চাকা চাকা / সিনার ভিতরে মধুপোকার বাসা’ – অন্তমিলযুক্ত পঙতিদ্বয় কিশোরকে বিলোড়িত করে। পৃথিবীকে বড় আনন্দময় মনে হয় তার। অর্থাৎ ক্রমে ক্রমে জীবনাভিজ্ঞতায় কিশোর কবি-দার্শনিক। ‘মৈনপাহাড়’-এ সুসংহত বলেই উপকাহিনিগুলো ছিটকে পড়ে না মূল স্রোত থেকে। বরং লেখকের সব দেখা – তাঁর সমুদ্রতীরবর্তী পাহাড় ও নদী ঘেরা প্রকৃতি, তাঁর সমাজ, সে সমাজের অতীত সব কথা এসে ভীড় জমায় কিশোরের গন্তব্য পথে। পথ-পরিক্রমায় কিশোরের অবলোকন ছাগলের ওপর চড়ে বসা এক মানুষ – যেমন করে ভাসমান মোষের উপর বসে থাকে মোষের রাখাল। আর সে ঘটনাতে নিজেকে চিন্তাগতভাবে সম্পৃক্ত করে কিশোর – নিজেকেও জ্ঞাতিগোত্রভাবে মানুষ হওয়ার কারণেই। ‘না, আমিও কি ধোয়া তুলসীপাতা … ভাবে কিশোর তারপর তাকায় ছলুর দিকে। ছলুর দিকে তাকাতেই তার শরীরটা শিরশির করে। পরক্ষণেই মনে পড়ে মগপল্লীর কথা। থম্ভুর কথা। লুঙ্গির ভিতরে ফুঁসে ওঠে একটা সাপ। যাকে সহজে পোষ মানানো যায় না। মানুষ পোষ মানে তো পশু মানে না। পশু মানে তো মানুষ মানে না। কিশোর খুব সহজেই বুঝে নেয়, তার ভিতরেও বসত করে আপসহীন এই পশু মানুষ বা মানুষ পশু’ (পৃ ৩৭)।
দুটি উপন্যাসেই আর এক রহস্যময় চরিত্র সোনাবিবি। অনুরা তাকে সোনাফুফু বলে ডাকে। সোনাবিবিকে নিয়ে কত যে কথা প্রচারিত! তারপরও সে অনুদের কাছে জ্ঞানীর জ্ঞানী; গুরুর গুরু। সোনাবিবি যেন অতীত সম্ভার। মৈনপাহাড়ে দুই ডাকাতের হাতে কিশোর প্রহৃত হলে সোনাবিবির কাছে যায় সে – রহস্যউদ্ধারে। যেয়ে বরং জড়িয়ে পড়ে সোনাবিবির শারিরীক রহস্যে।
দুটি উপন্যাস মিলে কিশোরের উপলব্ধি বিস্তৃত। নির্মাণকালের যেসব উপাদান মনু-পুত্রকে তাড়িত করে, বিশ্লিষ্ট করে পৌঁছে দেয় চূড়ান্ত এক মানবসত্তায়, কিশোর সেসবের সবকটিতেই স্পর্শিত। ঈশ্বর এবং যৌনতা মানববিশ্বের এ দুটি উপাদান কিশোরকে নির্মাণ করে – আর সে নির্মাণের স্রষ্টা কবি হওয়ায় কিশোরের চেতনায় কাব্যপ্রভাব সুস্পষ্ট।
হয়তো কোন কোন উচ্চনাসার সমালোচক মুহম্মদ নূরুল হুদার উপন্যাসকে স্খলিত বলবেন – প্লটের শৈথিল্যের কারণে অথবা কাব্যময়তাকে দোষ বিবেচনা করে। বর্তমান আলোচনার শুরুর প্রসঙ্গ ধরে বলি অপু, ছবি, মাহবুব, পারভীন বা নূহুল কেউই প্রাপ্তবয়স্কে কবি হয় নি বলেই হয়তো তাদের হয়ে ওঠার রচনাতে কাব্যস্পর্শ অনুপস্থিত। কিন্তু কিশোর কবি। কবির সত্তা তো গদ্যকারের মত জাগে না – জাগে নতুন মাত্রিকতায়, নতুন বোধন নিয়ে। আর প্লটের শৈথিল্য? সন্দেহ নেই বিষয়গতভাবে মুহম্মদ নূরুল হুদার দুটি উপন্যাসই শক্তিশালী উপাদানের আধার, তবে ‘মৈনপাহাড়’ অনেক বেশি সুসংহত। হয়তো অনুরূপ বিষয় নিয়ে কবির ভবিষ্যত উপন্যাসটি কাঠামোগতভাবে আরো বেশি সুদৃঢ় হবে, আমরা একজন কিশোরকে পাবো যে কবি, যার বড় হয়ে ওঠা একজন কবির বর্ধনের মতই। যেমনটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে একমাত্র মুহম্মদ নূরুল হুদার কলমেই সম্ভব হয়েছে।