যারা মোটামুটি বই-পত্র পড়েন, নতুন প্রকাশিত বইয়ের খোঁজ-খবর রাখেন তাদের কাছেও শহীদুল জহিরের (জন্ম ১৯৫৩) নামটি খুব বেশি পরিচিত নয়। মফস্বল শহরের কথা বাদ দিলেও শুধু ঢাকা শহরেই লেখক শহীদুলের নাম শুনেছেন এবং তার লেখা পড়েছেন এমন পাঠক হাতে গোনা। যদিও মাত্র দু’টি উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ এবং ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ তাই তিনি রীতিমতো শক্তিশালী তার ভাষা শৈলী ও কাঠামো নির্মাণে, তীক্ষ্ণ ও গতিমান বর্ণনায়।
অনুমান যে এ দ্বিতীয় উপন্যাসটি দিয়ে তিনি অনেক বোদ্ধাজনকেও তার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করেছেন। এবঙ একথাও সত্যি বিতর্ক উঠেছে এই বলে যে, এ উপন্যাসের একটি চরিত্র মোল্লা নাসির উদ্দিন ও তার মাকে নিয়ে মোরগ খাসী করার দৃশ্যটির খুঁটিনাটি বর্ণনা না থাকলেও বাংলা সাহিত্যের কি এমন ক্ষতি হতো! রুচি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। যদিও সাহিত্যের বিষয় হওয়ার জন্যে রুচির ব্যাপারটি এ সময় পর্যন্ত আর গুরুত্বপূর্ণ নয় – বহু আলোচনার পর সাহিত্যের বিষয় বিচারের প্রশ্নটি গুড়িয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। তবে প্রশ্ন তো থাকেই ও-দৃশ্যের উপযোগিতা কতোখানি। যেমন কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যমুনার বুকে নৌকার উপর মৃত্যুপথযাত্রী মফিজউদ্দিনের সামনে তার হত্যা প্রয়াসী জোবেদ ও হালাকুর সঙ্গে কামসুত্রের চৌষট্টি কলা শেখানোর মরণ লড়াইয়ে গণিকা নয়নতারার অংশগ্রহণের দৃশ্য নিয়ে। নাকি – সেদৃশ্য সামগ্রিক উপন্যাসটিতে যাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আবিষ্কারের পথ ধরেই পার পেয়ে যায় কোপানলের। উপন্যাসের চিরাচরিত অবলম্বন গল্পকাঠামো যা ছাড়া যেনো আমরা সমালোচকেরা অন্ধের যষ্টিবিহীন হয়ে পড়ি সে বিষয়ে কিছু কথা শুরুতে বলে নেয়া দরকার।
প্রথমে আমরা ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ নিয়ে আলোচনা করব। দেশে থানার নতুন নাম হয়েছে উপজেলা। উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে এরকমই এক সময়ে সপরিবারে মারা যায় একাশি বছরের মফিজউদ্দিন মিয়া যার কি-না ১১১ বছর বাঁচার কথা ছিল বলে সে নিজে এবং গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করতো। এরও পর কোনো এক সময় মুদি দোকানি তোরাফ আলিকে ঘিরে গ্রামবাসীদের এক জটলায় উঠে আসে এ উপন্যাসটির প্রলম্বিত এক সময়ের কাহিনী। শুধুমাত্র আড্ডার সংলাপে বিবৃত ঘটনাই নয় গ্রামবাসীদের মনে পড়ার ঘটনারাজির অবলীলায় স্থান নেয় এতে, আর সেভাবেই চাঁদের প্রভাবের লোকজ বিশ্বাসাশ্রিত একটি কাহিনী নির্মিত হয় যেখানে পাঠক নিজেও যেনো পূর্ণিমার ঢল নামা আলোয় ভাসতে থাকেন। চন্দ্র প্রভাবিত করে যে ১৫৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি একবসায় শেষ করার জন্যে পাঠক নেশাগ্রস্তের মতো তার চতুর্পাশকে অস্বীকার করতে শুরু করেন।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মফিজউদ্দিন মিয়ার জীবনে দু’টি প্রধান ঘটনায় পূর্ণিমার উপস্থিতি নিয়ে গ্রামবাসীদের কথাবার্তা। শেষ ঘটনাটি অর্থাৎ তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পাঠক প্রথমে পান। সে ঘটনায় বিপুল জ্যোৎস্নার বিস্তার তোরাপ আলিসহ গ্রামবাসীদের সঙ্গে পাঠকও লক্ষ করেন। চাঁদের এ প্রভাবকে সূক্ষ্ম সূতো হিসেবে নিয়েই গ্রামবাসীরা চলে যায় মফিজউদ্দিনের জন্ম সময়ে যে-রাতের চাঁদ ছিল গ্রহণের। আর এভাবেই জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানের মফিজউদ্দিনের ব্যক্তিজীবন ও সমাজ জীবনে অসীম প্রতিষ্ঠা লাভের কাহিনী নির্মিত হয় ক্রমশ। যদিও সময়ানুক্রমিকভাবে অগ্রসর হয় না সে কাহিনী। কালানুক্রমতা যেনো কোনো বিবেচনার নয়, মূল বিবেচ্য বৈশিষ্ট্য। আর এভাবেই গরিব আকালূ ও করিযে পাওয়া বোবা মেয়ে-যাকে আকালূ প্রথমে কন্যা হিসেবে বড়ো করে তুললেও মেয়েটির সামাজি নিরাপত্তার প্রশ্নে তাকে বিবাহ করে – এদের দু’জনের সন্তান মফিজউদ্দিনের বয়োবৃদ্ধি, মিয়া বাড়ির আলি আকবর মিয়ার কন্যা চন্দ্রভানের সঙ্গে অনেক চড়াই উৎরাই এরপর বিবাহ, যমুনার উপর গণিকা নয়নতারার আমরণ কৌশলের কারণে মৃত্যুপথযাত্রী মফিজউদ্দিনের পুনর্জীবন লাভ, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়া, সন্তানের পিতা হয়ো, একাদশ সন্তান মোল্লা নাসিরউদ্দিন এবং গ্রাম্য মেয়ে দুলালীর সম্পর্ক, শিল্পীর ছেলে আবুবকর সিদ্দিককে আবর্তন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আলেকজানের সঙ্গে তার বিবাহ ইত্যাকার বহুবিধ ঘটনা একের পর এক নির্মাণ পায় এ উপন্যাসে।
যদিও প্রশ্ন ওঠে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে শহীদুল জহির আসলে কি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তাহলে উত্তরের অনেকখানি কাছাকাছি আমরা চলে যেতে পারবো যদি বলি গ্রামীণ লোকায়ত এক সমাজের চিত্র। ব্যক্তি মফিজউদ্দিনের দোর্দণ্ড পরিস্থিতির ভেতর সে নির্মাণ যথোপযোগী হওয়া সম্ভব কি-না? সম্ভব, কেনো না মফিজউদ্দিন যতোখানি না বাস্তব চরিত্র তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রামীণ চিন্তা ও চেতনার প্রতীকী রূপায়ণ। আর সে-নির্মাণের দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু শহুরে এবং শিক্ষিত লেখকের নয়, সরাসরি গ্রামীণ মানুষেরই, তাই সার্থকতাও অসে অনেকখানি। দুর্নিবার, অপরাজেয় ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি যেভাবে গ্রাম্য সমাজে এক সময় অপ্রতিরোধ্য ছিল তেমনি একটি চরিত্র মফিজউদ্দিনকে শহীদুল জহির সৃষ্টি করেছেন। তার এ-সৃষ্টিকে জমিদার বা অনুরূপ একটি পরিসর থেকে না এনে সম্পূর্ণ বিপরীত একটি প্রেক্ষিতে তৈরি করে গ্রামের মাতব্বরের আসনে বসাতে গিয়ে লোকজ বিশ্বাসের একটি আবহ সৃষ্টি করতে হয়েছে যা চরিত্রটিকে দান করেছে নতুন এক মাত্রা। যুক্তি শূন্যতার সে-পলিকে লেখক নিজস্ব বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতেও চান নি – আর সেজন্যেই সম্ভবত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, যার কথা গ্রন্থটির কোথাও উল্লেখ নেই, মফিজউদ্দিনের মৃত্যু ঘটে। দেশব্যাপী যোগাযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোকজ এসব চিন্তা-চেতনার ভাংচুর হয়েছে ক্রমাগত। সৃষ্টি হয়েছে নতুন ভাবনার, নতুন কর্মযোগের – যার ফলে আফজাল খাঁর ছেলে ইদ্রিস খাঁ হয়েছে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। ইদ্রিস খাঁর এ নতুন প্রকাশে বড়ো ভাই রংপুর ক্যান্টনমেন্টের বিগ্রেডিয়ার ইলিয়াস খাঁর উপস্থিহিতও অবশ্যই নজরে পড়ার মতো। সে ভাংচুরের আর এক উদাহরণ চন্দ্রভানের ‘লাইগেশন’ করানো। সর্বশেষ ছেলে আবুবকর সিদ্দিকের জন্মের ঊনিম বছর পর যখন চন্দ্রভান আর একটি সন্তান রফিকুল ইসলামের জন্ম দেয় তখন অন্য পুত্র ফরিদ হোসেনের স্ত্রী জরিনার কন্যা সন্তান প্রসবের খবরে তাকে সিরাজগঞ্জে দেখতে যাবার ওছিলায় চন্দ্রভান শহরে যায় এবং এ কাজটি করে। আর সবচেয়ে বড়ো বদলটি দৃশ্যমান হয় উপজেলা নির্বাচনের অল্প কিছু আগেই। ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিজউদ্দিন দীর্ঘদিন অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর (যদিও মাঝে একবার তার বন্ধু করিম খাঁর পুত্র আফজাল খাঁ দাঁড়াতে চাইলে তা নস্যাৎ করা হয়) অনুষ্ঠিতব্য জেলা নির্বাচনেও সে চেয়ারম্যান হতে চায়।কিন্তু ইতিমধ্যে আফজাল খাঁর ছেলে ইদ্রিস খাঁ চেয়ারম্যান হওয়ার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে। স্বভাবগতভাবেই মফিজউদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বীকে গ্রহণ করতে নারাজ। নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে সে। খাঁদের সঙ্গে বৈঠক করে সে প্রস্তাব দেয় সে নিজে উপজেলা চেয়ারম্যান হবেই, এমপি হবে ইদ্রিস খাঁ। কিন্তু নির্বাচনী মহড়ায় দেখা যায় সুরাহা কিছুই হয়নি। তখন ঝড় ওঠে মফিজউদ্দিন মিয়ার নিজের পরিবারে – দশম ছেলে চানাইকোনা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আব্দুল আজিজ যুক্তি তোলে মফিজউদ্দিন মিয়ার এখন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে যোগ্যতর কোনো সন্তানকে এগেয়ি দেয়া উচিত এবং অনেক আলোচনার পর মফিজ উদ্দিন তা মানতে বাধ্য হয়। তবে সে খাঁদের সঙ্গে আবার বৈঠক করে এবং নতুন ভাবনা প্রকাশ করে যে এমপি ইদ্রিস খাঁই হবে তবে উপজেলা চেয়ারম্যান হবে মফিজউদ্দিনের ছেলে আব্দুল আজিজ।
বাংলাদেশের অশিক্ষিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে মফিজউদ্দিনের মতো মহীরুহ নির্মাণে যেসব উপাদানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেগুলো নিয়ে এবার কথা বলবো। অশিক্ষিত অনুল্লেখযোগ্য কামলার ছেলে হওয়ায় মফিজউদ্দিন সাধারণ গ্রামবাসীর আলোচনার বাইরে। কিন্তু মিয়া বাড়ির মেয়ে চন্দ্রভানকে দেখে তাকে বিয়ে করার আকাঙ্খার কথা যখন সে তার বন্ধুদেরকে এবং সর্বোপরি প্রস্তাব হিসেবে চন্দ্রভানের বাবাকে দেয় তখন থেকেই তার ব্যাপারে তার প্রতিবেশীরা নতুন নতুন গল্প রচনা করতে শুরু করে। আর সেভাবেই সত্যি ঘটনা গল্প-সৃষ্টির ছোঁয়ায় নতুন নতুন সংযোজন লাভ করতে থাকে। কামলার ছেলে মফিজউদ্দিনকে ধমক দিয়ে বা অন্য সকল রকমে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে আলি আকবর মিয়া তাকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়। সিরাজগঞ্জ শহরে যেয়ে গয়লা গ্রামে যাওয়ার সময় যমুনার তীরে মফিজউদ্দিন জোবেদ ও হালাকুর খপ্পরে পরে। এক পর্যায়ে কিছু বুঝতে পারার আগেই সে কাবু হয়ে যায় ওদের কৌশলের কাছে। দড়ি দিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে ছৈ-এর নিচে তাকে ফেলে রাখে ওরা। পরে ওদের একজন এক গণিকা নিয়ে ফিরলে ওরা নৌকা ছেড়ে দেয়। নৌকার উপর জোবেদ ও হালাকুর সঙ্গে নয়নতারার সে রমনক্রিয়ার কে পর্যায়ে নয়নতারা আবিষ্কার করে মফিজদ্দিনের বিপদাপন্নতা উপস্থিতি। আসন্ন মৃত্যু থেকে মফিজউদ্দিনকে রক্ষা করার জন্যেই নয়নতারা বেছে নেয় নতুন কৌশল, সে কৌশলে জোবেদ, হালাকুসহ নয়নতারার মৃত্যু ঘটে। আর এ ঘটনা যেমনভাবে মফিজউদ্দিনের মধ্যে দীর্ঘ জীবন (নয়নতারা একসময় মফিজউদ্দিনের নিতম্বে ১১১ ছাপের এক চিহ্ন আবিষ্কার করেছিল এবং মফিজউদ্দিনকে আশাবাদী করেছিল এই বলে যে সে ১১১ বছর বাঁচবে) সম্পর্কে এক গভীর আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে। প্রচলিত গল্প যে মফিজউদ্দিনের জন্মের রাতে পূর্ণিমা থাকলেও তা ছিল গ্রহণের রাত। অন্যমানুষ বিহীন সে রাতে সদ্যজাত পুত্রকে মধু খাওয়াতে বৃদ্ধ আকালু যে দণ্ডকলসের গাছ এনেছিল তার মধ্যে একটি ভাঙগাছ ছিল বলে পরদিন সকালে একজন প্রতিবেশী চিহ্নিত করে। অতৃপ্তির কারণে মিয়া বাড়ির মেয়ে চন্দ্রভানের মধ্রে যে, মানসিক বৈকল্য দেখা দেয় তার উপসর্গ হিসেবেই সে রাতে বাড়ির পাশের রৌহার বিলে গোসলে নামতো। সামগ্রিক এ ঘটনাটি যেমনভাবে আলি আকবরকে দুর্বল করে ফেলে তেমনি মফিজউদ্দিনকে সুবিধে করে দেয়। আর এ সকল ঘটনার ফলে চন্দ্রভানের সঙ্গে মফিজউদ্দিনের বিয়ে হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। আর এ ঘটনাই কামলা মফিজউদ্দিনকে ‘মফিজউদ্দিন মিয়া’য় পরিণত করে। মফিজউদ্দিনের আকাশ কুসুম এ কল্পনার বাস্তবায়ন গ্রামবাসীদের মধ্যে নতুন নতুন রূপে ছড়াতে থাকে গল্পের বিস্তার।
গ্রামবাসীদের কথোপকথনকালে ঘটনারাজি এবং তাদের চিন্তারাশি ও পূর্বস্মৃতিসমূহ স্বাভাবিক কালানুক্রমকে মান্য করে কখনই আসে না। আর লেখক সে চেষ্টাও করেননি। অবিচ্ছিন্নভাবে গল্প নির্মাণ করে না গিয়ে উপন্যাসের প্রয়োজনে গল্পাংশকে নিয়ে আসার এ রীতিটি ব্যবহার করায় একটি বিশেষ লাভ হয়েছে পাঠকের – পাঠক আগামভাবে গল্পের আভাসকে চিন্তা করার সুযোগ পাননি। কল্পিত চরিত্রকে পেয়ে বা না পেয়ে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত তাকে হতে হয় না। তাছাড়া উপস্থাপনার এ ভঙ্গিটির কারণেই গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে গল্পের বর্ণনাকারিদের মানসিকতার সঙ্গে একটি সাযুজ্যও রক্ষিত হয়েছে বৈকি।
মফিজউদ্দিন মিয়া ও তার পরিবারকে ঘিরে নির্মিত এ উপন্যাসে অনেক ছোটো ছোটো অনুসঙ্গ যুক্ত হচ্ছে মূল ধারায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং অবলীলায় যেগুলো সাহায্য করে গেছে মূল নির্মাণকে। নাসিরউদ্দিনের নিকট দুলালীর প্রত্যাশা এবং সর্বশেষ দুলালীর মৃত্যুর পর তার আব্বা মোবারক আলীর আহাজারি এবং নাসিরউদ্দিন ঢাকা থেকে এসে মৃত দুলালীকে না দেখা পর্যন্ত তাকে কবর না দেয়ার সিদ্ধান্ত, আবুবকর সিদ্দিকের ঢাকায় যেয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দুই বন্ধু নিয়ে এসে গ্রামে ছবি আঁকা এবং সে সময় আলেকজানকে আবিষ্কার এমনকি পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালে আবুবকর সিদ্দিকের আঁকা আলেকজানের একটি পেন্সিল স্কেচের কারণে ওই পরিবারের ওপর াক মিলিটারির আচরণ, মুক্তিযুদ্ধে আবুবকর সিদ্দিক এবং আরো অনেকের সঙ্গে আলেকজানের স্বামী লুৎফর রহমানের অংশগ্রহণ, যুদ্ধে লুৎফর রহমানের মৃত্যু, যুদ্ধপরবর্তীকালে আবুবকর সিদ্দিকের ঢাকায় আর না ফেরা এবং স্কুলের মাস্টার হওয়া ইত্যাদি। বহুবিধ সকল জিনিসই মুল ঘটনাস্রোতকে সহায়তা করলেও নাসিরউদ্দিনের প্রসঙ্গে তার মোরগ খাসি করার ঘটনাটি কতোখানি প্রাসঙ্গিক সে প্রশ্ন আবশ্যক। এটা গ্রাম্য জীবনের একটি সাধারণ ঘটনা বেবেই কি আমরা এর প্রাসঙ্গিকতাকে মেনে নেব। নাসিরউদ্দিনকে কি আর কোন ঘটনার ভেতর দিয়ে দুলালীর কাছে নিয়ে আসা যেতো না। নাকি দুলালীকে নাসিরউদ্দিনের প্রত্যাখ্যানের পূর্ব ইঙ্গিত নাসিরউদ্দিনের মোরগ খাসিকরণ অর্থাৎ নির্বীজকরণ।
যমুনা তীরবর্তী সিরাজগঞ্জ পাবনার আঞ্চলিক ভাষায় উপন্যাসিক গ্রামীণ মানুষদের ভাবনাকে রূপ দিয়েছেন। আর গ্রামের মানুষদের ভাবনাকে তিনি যখন নিজ হাতে তুলে নেন তখন সেটি করেন স্বাভাবিক চলিত ভাষায় কিন্তু এর মধ্যেও লেখকের কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি তাঁর ভাষায় এক গতিময়তা সৃষ্টি করেন যা পাঠে পাঠক বাধ্য হন। কাহিনীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ তুচ্ছ হয়ে ঘোরলাগা এ বর্ণনায় পাঠক গা ভাসিয়ে চলেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আর সে সময়ের ভেতর দিয়ে পাঠক আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের চিরাচরিত একটি গ্রামকে – গ্রামের মানুষ, তাদের লোকজ বিশ্বাস ও চেতনাকে। কিছুই সেখানে যেমন আরোপিত নয় তেমনি লেখকের দৃষ্টিকোণও পৃথক কোনো ইঙ্গিত বহন করে না।
‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ প্রকাশের আরো সাত বছর আগে ১৩৯৪ বঙ্গাব্দে শহীদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ প্রকাশ পেয়েছিল। এবং সে উপন্যাসে জহির যথেষ্ট শক্তিমত্তার ছাপ রেখেছিলেন যদিও বইটি খুব বেশি পরিচিত পায়নি। অত্যন্ত সুখপাঠ্য সে বইটিতে ১৯৮৫-৮৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রেক্ষিতে আব্দুল মজিদ নামের একজন বিবাহিত যুবককে আমরা পাই যে কি-না ১৯৭১-এ ছিল এক কিশোর। এ যুবকের চিন্তা চেতনার সঙ্গে লেখক তার প্রতিবেশী পরিচিত জনদের চেতনাকেও প্রয়োজনানুযায়ী এনে সন্নিবিষ্ট করেন এবং নির্মাণ করেন ক্ষুদ্র এক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধকালীন, রাজাকার বাহিনীর এক চিত্র যার সঙ্গে স্থাপিত হয়েছে সাধারণ নগরবাসীর উদ্বেগ ও ভয়ের বিস্তার। যুদ্ধকালীন সারা বাংলাদেশের মানুষের হতাশা, চিন্তা, উদ্বেগ, পালিয়ে বেড়ানো এবং রাজাকার ও পাকবাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের দীর্ঘ এক ইতিহাস এর মধ্যে নিহিত এবং সফলভাবে উদ্ভাসিত। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ও আরো পরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির পারস্পারিক ঐক্যমত্য ও সেকারণে একই সুরে কথা বলার ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতার যে ন্যক্কারজনক চিত্র তার সবকিছুই বড়ো চেনাভাবে ফুঠে ওঠে মাত্র চল্লিশ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসটিতে।
ঢলের মতো করে লেখক বাক্যের পর বাক্য নির্মাণ করতে থাকে ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে। সেই একই নির্মাণভঙ্গি দ্বিতীয় উপন্যাসটিতেও বর্তমান। মানুষের অতীত স্মৃতি ও তার বর্তমান, তার বাহ্যিক কর্ম ও চেতনা যে অবিচ্ছিন্ন সে বোধ অনেক বেশি করে মূর্ত হয় ঔপন্যাসিকের বর্ণনাভঙ্গির এ বৈশিষ্ট্য। কোন বিষয়ের পূর্ণ নিরপেক্ষ চিত্রের জন্যে দরকার বহুমাত্রিকতায় তাকে দেকা। এটি সম্ভব সে বিষয়ে বহুকথনের বিবরণের মাধ্যমে – যাদের দৃষ্টি বিভিন্ন ভঙ্গিতে স্থিত। দু’টি উপন্যাসেই শহীদুল জহির এ কাজটি করেছেন। শুধুমাত্র প্রধান চরিত্র বা সামগ্রিক ঘটনাস্রোতের অন্তরালে লেখকের কণ্ঠস্বরকে আশ্রয় করে গল্পকে বাড়তে না দিয়ে তিনি প্রধান চরিত্রের চতুর্পার্শ্বের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও শ্রেণীর মানুষদের ভাবনা ও অভিমত পাশাপাশি রাখেন যা বিভিন্ন আলোকে একটি বিষয়কে যথাযথভাবে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে।
কথাসাহিত্যে যাদুবাস্তবতার যে ধারাটি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে ভীষণভাবে উপস্তিত তার ছায়া শহীদুল জহিরে রয়েছে – হ্যাঁ অনেকখানি এবং শুধু সে কারণেই শহীদুল জহিরের ভাগ্যে প্রশংসা কম জুটবে তা আমি মানতে নারাজ। উপস্থাপন অর্থাৎ উপন্যাসের ফর্মগত দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে তো চিরকালই বিদেশি নতুন নতুন ধারায় আত্মস্থ হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত সেখানে এ ব্যাপারটিতে উনিশ-বিশ ব্যতীত অন্য কিছু তো ঘটেনি। এবং শহীদুল জহির আমাদের সবার বাহবা পাবেন এজন্যই যে সম্পূর্ণ দেশীয় পরিপ্রেক্ষিতকে তিনি তাঁর নিজের ভাষায় উপন্যাসে গ্রন্থবদ্ধ করতে পেরেছেন। যাদুবাস্তবতা ধারার শৈলীগত বৈশিষ্ট্যের ছায়া তাঁর দুটো উপন্যাস থাকলেও তিনি সক্ষম পাঠককে তাঁর বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে, পাঠকের মননে নতুন আলো ফেলতে এবং চেতনাকে আরো বেশি চকচকে করতে। “…A novel examines not reality but existence, and existence is not what has occurred, existence is the realm of human possibilities, every thing that man can become, every thing he’s capable of. Novelists draw up the map of existence by discovering this or that human possibility.” এক সাক্ষাৎকারে মিলান কুন্ডেরা একথা বলেছেন যা প্রকাশিত হয়েতে তাঁর The Art of the Novel গ্রন্থে। লক্ষীবাজারের লোকদের মনে পড়ে ১৯৭১-এ বদু মওলানার কাক ওড়ানোর কথা। ‘এক থালা মাংস নিয়ে ছাতে উঠে যেতো বদু মওলানা আর তার ছেলেরা। মহল্লায় তখনো যারা ছিলো, তারা বলেছিলো বদু মওলানা প্রত্যেকদিন সে-মাংসের টুকরোগুলো আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতো সেগুলো ছিলো মানুষের মাংস।’ আর এভাবেই ১৯৭১-এ একজন রাজাকার বদু মওলানা এবং তার নিষ্ঠুর কার্যক্রমকে শহীদুল জহির ফুটিয়ে তোলেন ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে যার মধ্যে মিলান কুন্ডেরার উপর্যুক্ত বক্তব্যের পরিধি খোঁজা যায়।
চেতনা-প্রবাহ ধারায় এতোদিন আমরা পেয়েছি প্রত্যক্ষ বাস্তব আর করোটিস্থিত স্মৃতি – ভাবনা পাশাপাশি। সূক্ষ্ম সুতোয় তা থাকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একই রকমভাবে সরলপ্লট সময়ানুক্রমিকভাবে উপস্থাপন না করে শহীদুল জহির বিভিন্ন ব্যক্তির ভাবনাকে পাশাপাশি আনেন এবং সেগুলো এতো বেশি পরস্পরের জন্যে প্রয়োজনীয় বলে বোধ হয় যে এগুলোকে কোনোক্রমেই বিচ্ছিন্ন ভাবার সুযোগ থাকে না। যাদুবাস্তবতার ধারায় শহীদুল জহিরের উপন্যাসেও ভিন্ন ভিন্ন বিষয় বারবার বিভিন্নভাবে উঠে আসে এবং সন্দেহাতীত যে, সেগুলো ক্রমেক্রমে একটি পরিণতির দিকে যায়। এ ধারার চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই প্লট সম্মুখবর্তী না হয়ে বারবার পেছনে ফিরে আসে। ঘুরপাক খেতে থাকে একটা আবর্তের মধ্যে এবং তারই মধ্যে নির্মাণ পেয়ে যায় একটি পূর্ণ চিত্র। শহীদুল জহিরের কৃতিত্ব এখানেই যে তাঁর সৃষ্টি কাঠামোকে কখনো খণ্ডিত মনে হয় না, পুনরুল্লেখে বিরক্ত হন না পাঠক। যদিও সে রাতে পূর্ণিমা ছিল তে অল্প কিছু জায়গায় স্থবিরতা আক্রান্ত বলে মনে হয় এবং তারপরও উপন্যাসটি স্মর্তব্য সৃষ্টি আর তার সার্থক পূর্বসূরী হচ্ছে ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’।
রচনাকাল: ২০০২