হাসনাত আবদুল হাই-এর ঔপন্যাসিক প্রতিভা সম্পর্কে পাঠক দীর্ঘদিন ধরেই জ্ঞাত। সম্প্রতি সেখানে আর একটি মাত্রার সংযোজন পাঠককে বিমোহিত করছে। সেটা হলো জীবনীমূলক উপন্যাসে হাসনাতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। জীবনীমূলক নাটকে বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থাকলেও জীবনীমূলক উপন্যাস রচনার ইতিহাস এত সমৃদ্ধ নয়। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৮৫-১৯৩০) ‘শশাঙ্ক’ (১৯১৫) বা ‘ধর্মপাল’ই (১৯১৬) হাতে গোনা উদাহরণগুলোর অন্যতম। এছাড়া খ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রমথনাথ বিশীর (১৯০২-১৯৮৫) ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’। তাই সাম্প্রতিক সমাজের জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, বিদ্রোহী ও অমিত প্রতিভা চেতনাকে নতুন আঙ্গিকে, নুতন উপস্থাপনায় উপন্যাসে চিত্রণের কাজে হাসনাত আবদুল হাই প্রধানত ও একমাত্র। সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয়, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে গৃহীত তথ্য ও গল্প নিয়ে প্রতিবেদন প্রধান এরকম উপন্যাস হাসনাতের তিনটি ‘সুলতান’, ‘একজন আরজ আলী’ ও ‘নভেরা’।
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বিচিত্রা’ ঈদ সংখ্যায় ‘সুলতান’ প্রকাশিত হলেই (’৯১-এ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত) হাসনাত হয়ে ওঠেন পাঠকের সাহিত্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। উল্লেখ্য, এর আগেও তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাস রয়েছে। যেমন- ‘তিমি’, ‘আমার আততায়ী’ (১৯৮০), ‘প্রভু’ (১৯৮৪), ‘যুবরাজ’ (১৯৮৫)। সুলতান বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল কারণ এটি রচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে। অমিত প্রতিভাধারী সুলতান প্রবাস জীবন ত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তাঁর সম্পর্কে অজ্ঞাত বাঙালি সমাজ ধীরে ধীরে তাকে আবিষ্কার কররতে শুরু করে। এ সময়ে উপন্যাসাকারে ‘সুলতান’-এর প্রকাশ উৎসুক পাঠককে করে তোলে আরও বেশি আলোড়িত। পাঠকের এ আলোড়নের পেছনে আরও যে একটি প্রধান কারণ রয়েছে সেটি হচ্ছে ‘সুলতান’-এ ব্যবহৃত বর্ণনা কৌশল। যদিও উল্লেখ্য, যে কৌশলের উদ্বোধন হিসেবে হাসনাত আগেই রচনা করেছিলেন ‘মহাপুরুষ’ (১৯৮৫-র ‘বিচিত্রা’ ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত। গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ করে ১৯৮৬ সালে)। সুলতানের পথ ধরে হাসনাত রচনা করেন ‘একজন আরজ আলী’ (‘বিচিত্রা’ ঈদ সংখ্যা ১৯৯৩-এ প্রকাশিত। পরবর্তীতে এটি গ্রন্থরূপ লাভ করেছে)। ১৯৯৪-এ একই পত্রিকার ঈদ সংখ্যাতে তার ‘নভেরা’ উপন্যাসটির প্রকাশ রীতিত বিস্ময় ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ উপন্যাসটি শিল্প-সাহিত্য পিপাসুদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে প্রায়-বিস্মৃত ৫০ ও ৬০ এর দশকের অনন্য শিল্পপ্রতিভা নভেরা সম্পর্কে এবং তাদেরকে বিস্মিত করেছে একজন হারিয়ে যাওয়া শিল্পীর জীবনীভিত্তিক এ উপন্যাস রচনায় হাসনাতের ব্যবহৃত কৌশল এবং ইতিহাসের উপাদান নভেরা বিষয়ক তথ্যকে গ্রহণীয়ভাবে উপস্থাপনে হাসনাতের সার্থকতায়। জীবনীভিত্তিক উপন্যাস রচনায় হাসনাতের অগ্রসরণটি বেশ লক্ষণীয়। মহাপুরুষ অনৈতিহাসিক এক চরিত্রকে অবলম্বন করে হলেও এ ধারায় পরবর্তী তিনটি উপন্যাসই নিকট অতীতের বা বর্তমানেও জীবিত চরিত্রদের নিয়ে যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। এবং উল্লেখ্য চারটি উপন্যাসেই হাসনাত একই কৌশল অবলম্বন করেন – বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলিকে প্রয়োজনানুযায়ী সাজিয়ে, দরকারে ঐসব ব্যক্তিদেরকে সরাসরি উপন্যাসের চরিত্র করে তাদের মুখ দিয়েই তথ্য বা গল্প আকারে তিনি সেগুলো বের করেন-এবং লক্ষণীয় হাসনাত এ কৌশলে ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছেন অধিক শক্তিশালী, অধিক সার্থক। এ ধারায় যত তিনি সামনের দিকে এগিয়েছেন তার উপন্যাসের নাম-চরিত্রটি হয়ে উঠেছে তত বেশি বিমূর্ত, নৈর্ব্যক্তিক ও শিল্পসার্থক।
‘মহাপুরুষ’ উপন্যাসটি কেন্দ্রিভূত হয়েছে সৈয়দ বেলাল নামের একজন ব্যক্তিকে ঘিরে। উচ্চপদস্থ আমলা সৈয়দ বেলাল সাইক্লোন পর্যুদস্ত এলাকায় রিলিফ সংক্রান্ত ব্যাপারে দায়িত্ব পাওয়ার পর আবিষ্কার করেন প্রচলিত রিলিফ প্রদান পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ এবং এতে সত্যি সত্যি ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি নিজস্ব ভাবনায় নতুন এক উপায় বের করেন যা প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয় তাড়াতাড়িই। এক পর্যায়ে সৈয়দ বেলাল সিদ্ধান্ত নেন তিনি চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণতই স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন ঘটে যায়। দেশহিতৈষী সৈয়দ বেলালের কার্যক্রমে আসতে থাকে বাধা। যেসব স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি প্রথম থেকেই তার বিরোধিতা করেছিল সুযোগ বুঝে তারা হয়ে ওঠে মারমুখো। পারিবারিক জীবনেও সৈয়দ বেলাল হতে থাকেন বিপর্যয়ের শিকার। তিনি আখ্যায়িত হতে শুরু করেন ‘পাগল’ অভিধায়। হতাশ সৈয়দ বেলাল এক বিকেলে তার নিজ গ্রাম কাজলপুরে ফেরার সময় দ্রুত পথ অতিক্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন এক অরণ্যের মধ্য দিয়ে সেখানে তার মৃৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে সৃষ্টি হয় চাঞ্চল্য। তার সৃষ্ট ‘গ্রামসভা’ দ্বারা উপস্থিত লোকজন তার শোকে হয় বিহ্বল। কিন্তু ক্ষত-দুষ্ট সমাজের স্বার্থান্বেয়ী যারা জীবিত অবস্থায় তার কাজকে পলে পলে বাধা দিয়েছে তারাই তার কবর ঘিরে সৃষ্টি করে মাজার। বাৎসরিক উৎসব শুরু হয় এ মাজারকে উপলক্ষ করে। প্রচলিত সামাজিক রীতিতেই মাজার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় সেই লোকটি যে সৈয়দ বেলালের জীবিতাবস্থায় কাজলপুরে তাকে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিল।
উল্লেখ করা দরকার সমস্ত উপন্যাসটি হাসনাত আসলে শুধুমাত্র সৈয়দ বেলালের জীবনীকেই আঁকতে চেষ্টা করেছেন। আর সে জীবনীকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই এসেছে বিভিন্ন চরিত্র, বিভিন্ন অনুযঙ্গ। প্রচলিত ধারার একজন আমরা কি করে দেশ সেবার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং তার ভাবনাচিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন সেটাই মহাপুরুষ এর মূল প্রতিপাদ্য। যেমনভাবে ‘সুলতান’-এ তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একজন রাজমিস্ত্রীর লালু নামের ছেলেটি শেখ মোহাম্মদ সুলতান হয় এবং তার বিপুল প্রতিভা ও সরলতা দিয়ে সারা পৃথিবীতে এস এম সুলতান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। প্রতিষ্ঠিত এস এম সুলতানের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিভার পেছনের সমস্ত কারণকেই প্রয়োজনানুযায়ী হাসনাত সাজিয়েছেন পাঠকের উদ্দেশ্যে। সুলতানের জীবনের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন উপাদানকে এক জায়গায় এনে হাসনাত তুলে ধরেছেন সদালাফী কোমলপ্রাণ সুলতানকে। দেখিয়েছেন বিদেশের মাটিতে বিপুলভাবে প্রশংসিত সুলতান কেমনভাবে অবহেলিত হন স্বীয়দেশে। এঁকেছেন সুলতানের শিল্পচিন্তা। শিল্পরচনাভঙ্গি। পাঠকের হাতে উপহার দিয়েছেন অমিত বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী মাদ্রাসায় ২য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা কৃষক আরজ আলী মাতব্বর কোন পরিবেশের মধ্য দিয়ে পরিণত হন একজন মহীরুহে ঔপন্যাসিক তারই বয়ান করেছেন। কত বেশি দৃঢ়চিত্ত ও পরিচ্ছন্ন চিন্তার অধিকারী হলে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে একজন মানুষ তার আহৃত জ্ঞানকে মনুষ্য সমাজের কল্যাণে প্রকাশ করতে পারে ‘একজন আরজ আলী’ও তারই দৃষ্টান্ত। সমাজ ও মানুষের কল্যাণে আরজ আলীর বিস্ময়কর পদক্ষেপ ও কর্মপ্রচেষ্টাকে উপন্যাসে অঙ্গীভূত করে হাসনাত পাঠককে অবহিত করেন একজন প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার মানুষের মননকেই। যেমনভাবে নভেরাতে বিকৃত হয়েছে বর্তমানে বিস্মৃত প্রায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের চারুশিল্পকলায় বিদ্রোহী, আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিভা নভেরার বড় হয়ে ওঠা। বাংলাদেশের সাধারণ একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা নভেরার শিল্পপ্রতিভা কেমন করে একটি ফুলের মত ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয় এবং সামাজিক অবজ্ঞার কারণে আবার ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় তাই ‘নভেরা’র বিষয়। ‘সুলতান’ ও ‘একজন আরজ আলী’র মত ‘নভেরা’তেও লেখক বিশিষ্ট প্রতিভাটির শুধুমাত্র প্রতিভা বিকাশ ব্যাপারেই আবদ্ধ থাকেন না, তিনি একাধারে রূপ দেন ব্যক্তি নভেরাকে। শিল্পী নভেরার সাথে শিল্পী হামিদুর রহমানের বন্ধুত্ব, তাদের গভীর প্রেম, সামাজিক বেড়াজাল ছিন্ন করেও তাদের প্রেমের প্রকাশ এবঙ সবমেষে বিবাহ না হওয়া সবই এ উপন্যাসে অঙ্গীভূত। যেমনভাবে হাসনাত এতে নভেরার সাথে তার অন্য কয়েকজন বন্ধুর রহস্যময় সম্পর্ককেও তুলে ধরেছেন পাঠকের উদ্দেশ্যে। গভীর দৃষ্টিতে দেকলে স্পষ্ট হয়ে যায় হাসনাত আবদুল হাই তার সৃষ্ট জীবনীমূলক উপন্যাসগুলোতে সে সকল জীবনীকেই অবলম্বন করেছেন যাদের প্রতিভা অবিস্মরণীয় এবং যাদের জীবন ধরন গতানুগতিক নয়। এসব প্রতিভার ‘হয়ে ওঠাকে’ স্পষ্ট করে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্যই হাসনাতের কলম ধারণ। এ ধারার উপন্যাস সৃষ্টি করতে গিয়ে হাসনাত ‘মহাপুরুষ’-এ একজন কাল্পনিক চরিত্রকে আনলেও পরবর্তী তিনটি চরিত্রই দেশের শিক্ষিত জনের কাছে পরিচিত। হাসনাতের এই অগ্রসরণে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে যত বেশি তিনি ভবিষ্যতের দিকে এগিয়েছেন তত বেশি করে তার চরিত্রগুলো বিমূর্ততার দিকে ধাবিত হয়েছেন। সৈয়দ বেলাল যত বেশি স্পষ্ট, অনুভবযোগ্য, সুলতান তা নন। সুলতানের চরিত্র বোধগম্য ও ছবির মত করার জন্য যত উপাদান দরকার তার সবগুলো এলেও কেমন যেন পাঠকের মনে সুলতান চরিত্রটি হয়ে উঠেছে একটা বিষ্ময়। সে বিস্ময়বোধ একজন আরজ আলীতে যেয়ে আরও বেড়ে যায় এবং নভেরাতে নভেরা চলে যায় আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
জীবনীমূলক এসকল উপন্যাসগুলোতে প্রধান চরিত্রে জীবনীটি উপস্থাপনায় হাসনাত সবসময়ই কৌশলী এবং আগ্রহও নতুনত্ব সৃষ্টিকারী। শেষ তিনটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপটটি এমন যে লেখক হাসনাত উপন্যাসের ঐ কেন্দ্রীয় চরিত্রটি নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন এবং সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য সাহায্য নিচ্ছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও পত্রিকা ইত্যাদি থেকে। মহাপুরুষ-এ ঐ একটি ব্যাপারে ভিন্নতা রয়ে গেছে খানিকটা। সেখানে উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি বহুলোক সমাগমের মাজার পরিদর্শনে এসেছেন একজন সাংবাদিক এবং তিনিই পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপের মধ্য দিয়ে পূর্ণরূপ দেন সৈয়দ বেলাল চরিত্রটিকে।
সংগৃহীত তথ্য ও চিত্রকে সুবিধানুযায়ী (সময়ানুগ নয়) সাজাতে গিয়ে লেখক কখনও প্রথম পুরুষ আবার কখনও তৃতীয় পুরুষের আশ্রয় নেন। কথক পরিবর্তনের এ ব্যাপারটি ‘মহাপুরুষ’ ও ‘সুলতান’-এ স্পষ্ট সীমারেখায় আবদ্ধ থাকলেও পরে সীমারেখাটি অস্পষ্ট হতে শুরু করে এবং ‘নভেরা’তে এসে সম্পূর্ণই অস্পষ্ট হয়ে যায়। কোন পুরুষে গল্পটি বলা হচ্ছে সেটি গৌণ হয়ে দাঁড়ায় পাঠকের কাছে- কেননা, অভিভূত পাঠক তখন রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন চরিত্রটিকে আবিষ্কারে জন্যে। তাই ‘নভেরা’তে দেখা যায় একটিমাত্র অনুচ্ছেদ পরেও লেখক বক্তা পরিবর্তন করে ফেলেন খুব সাবলীলভাবেই।
পার্শ্বচরিত্র চিত্রণের ব্যাপারে বলা যায় শুধুমাত্র ‘মহাপুরুষ’ এর প্রধান চরিত্রটি বাদে দু’একটি চরিত্র খানিকটা অবয়ব লাভ করে, যেমন- সৈয়দ বেলালের স্ত্রী। কিন্তু এটি বাদে বাকি উপন্যাস তিনটির অন্য কোন চরিত্রই পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে নি। পরবর্তী তিনটি উপন্যাসের পার্শ্চচরিত্রগুলোর প্রায় সবাই সমাজের প্রতিষ্ঠিত গুণী ব্যক্তি এবং আমরা তাদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষন করি বলেই হয়তো আমাদের পাঠের আগ্রহ এমন দৃঢ় হয়, কোনরকম শিথিলতা আসে না; কিন্তু যদি তারা আমাদের অপরিচিত হতেন তাহলে পাঠকের প্রতিক্রিয়া কি রকম হতো তা বলা মুশকিল। সুলতান-এ হাসনাত আবদুল হাই, আহমদ ছফা, জয়নুল আবেদীন, দেবদাস চক্রবর্তী, জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ, একজন আরজ আলীতে হাসনাত আবদুল হাই, আলী নূর, অধ্যাপক শামসুল হক প্রমুখ এবং নভেরাতে শামসুর রহমান, খান আতা, হাসনাত আবদুল হাই, আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, ফয়েজ আহমদ, এসএম আলী, সাঈদ আহমেদ প্রমুখ যদি পার্শ্চচরিত্র হিসেবে না আসতেন তাহলে পাঠকের আগ্রহে নিশ্চয়ই ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিত।
হাসনাতের লেখা জীবনী গোত্রীয় এ সকল উপন্যাসের আলোচনায় একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী যে, উপন্যাস চারটির চারজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বই এমনভাবে সৃষ্ট হয়েছে যে, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক সকল বাধা পেরিয়ে তাদের প্রতিভার যে স্ফুরণ সেটা পাঠকের মাথাকে তাদের উদ্দেশ্যে নমিত করায়। তাদের দ্রোহ, তাদের মেধা, তাদের গ্রহণযোগ্যতা পাঠককে বিস্মিত করে, অভিভূত করে। ‘মহাপুরুষ’ যেহেতু কাল্পনিক উপন্যাস তাই সেটিকে বাদ দিয়ে বাকি তিনটিতে এস এম সুলতান, আরজ আলী মাতুব্বর ও নভেরার মত তিন বিস্ময়কর প্রতিভাকে এভাবে হাসনাত পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। ঐ সকল চরিত্রের ব্যক্তিজীবন ও প্রতিভাস্ফুরণ সম্পর্কে পাঠকের ধারণা পূর্বে অস্পষ্ট থাকলেও উপন্যাস পাঠপর সে ধারণা একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। পাঠক হাসনাতের গল্প চোখ বুঁজে বিশ্বাস করেন কারণ সে সকল চরিত্রের বিভিন্ন দিক উন্মোচনের জন্য হাসনাত যেসব সূত্র বিশেষ করে ব্যক্তিকে উপন্যাসে নিয়ে আসেন তাঁরা সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। আর সে কারণেই পাঠক নির্দ্ধিধায় চরিত্রকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করে ফেলেন। আর তার ফলে এস এম সুলতান, আরজ আলী মাতুব্বর এবং নভেরা অর্জন করে পাঠকের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
জীবনীমূলক উপন্যাস লেখক যেমনভাবে সচেষ্ট থাকেন নাম-চরিত্রের মানুষটিকে রক্ত মাংসের অবয়ব দিতে তেমনিভাবে সেখানে আসে সমাজের ঐ-সময়কার একটি চিত্র। এতে একটি চরিত্রকে প্রধান হিসেবে গড়ে তোলাই লেখকের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে না সাথে সাথে চরিত্রটিকে পাঠকের কাছে বাস্তবোচিত ও গ্রহণীয় করে তুলে ধরার দায়িত্বও লেখক গ্রহণ করেন। হাসনাত আবদুল হাই এ কাজটিই করেছেন তাঁর ‘সুলতান’, ‘একজন আরজ আলী’ ও ‘নভেরা’ উপন্যাসে। বলা বাহুল্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবেই।