লোকনাথ ভট্রাচার্য ২০০১ সালের ২৫ মার্চ কায়রোতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এ সংবাদটি বাংলাদেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ক্ষুদ্রতম কলেবরে হলেও ছাপা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যু বড় সংবাদ হিসাবে গ্রাহ্য না হলেও বিশেষ দোষের হতো না, যেহেতু বাংলা সাহিত্যের যে সকল লেখকের মোটেই পাঠক জোটেনি, তাঁদের মধ্যে লোকনাথ ভট্রাচার্য অন্যতম। কমলকুমার মজুমদার প্রমুখ তাঁদের জটিল ভাষারীতির কারণে পাঠকপ্রিয়তা না পেলেও কিছু পাঠকের কাছে তাঁদের নাম বেশ পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু লোকনাথ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে তাও ঘটে নি। যদিও ভাষারীতির এ জটিলতা লোকনাথে নেই। যা তাঁর পাঠে প্রতিবন্ধকতা, তা হলো উপস্থাপনা রীতির অভিনবত্ব যা অধিকাংশ বাংলাভাষী পাঠকের কাছে অদৃষ্টপূর্ব। এ ছাড়াও হয়ত নিজের লেখার প্রকাশনা নিয়ে তাঁর খানিকটা সংকোচ ছিল, তদুপরি প্রকাশিত মূল্যায়নে বলা যায় কোন মহলই বিশেষ আগ্রহ প্রদর্শন করে নি। ১৯৭৬ থেকে শুরু করে ফরাসি ভাষায় তাঁর প্রায় বিশটি গ্রন্থ অনূদিত হলেও এবং সব মিলিয়ে প্রায় পঁচিশটি গ্রন্থের প্রণেতা হয়েও তিনি আদৃত হন নি বাংলাভাষী পাঠকের কাছে। যদিও ফরাসিভাষী কর্তৃক ‘অফিসার দেন আর্টস এ্যাট দেম লেটার্স’ সম্মানে ভূষিত হওয়া ছাড়াও মৃত্যু পূর্বকালীন কায়রো ভ্রমণ প্রসঙ্গেটিও একটি অবশ্য উল্লেখ্য বিষয়। সেখানে তিনি গিয়েছিলেন ফরাসি সরকার কর্তৃক এক কবি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েই, যা তাঁর লেখক সত্তারই স্বীকৃতি বৈকি।
লোকনাথ ভট্টাচার্য একাধারে কবি, গল্পকার, নাটক্যকার এবং অনুবাদক। ঔপন্যাসিক অভিধাটি আলাদা করে উল্লেখ করতে চাই এ জন্য যে, এক্ষেত্রেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অভিনবত্ব ও শিল্প-সাফল্য তিনি প্রদর্শন করেছিলেন। যদিও র্যাবো, মলিয়ের, দেকার্ত, আঁরি মিশো বা সার্ত্রের অনুবাদক হিসাবেও তাঁর কৃতিত্ব বিশেষ মনোযোগের।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে লোকনাথ ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার এক রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে। ১৯৪৫ সালে আইএ পাশ করে ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে। ১৯৫০ থেকে ফরাসি ভাষা শিক্ষা শুরু করে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে পেয়ে যান ফরাসি সরকারের বৃত্তি। গবেষণার মূল বিষয় ছিল ভাঙ্গা সংস্কৃতে লিখিত ও প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত এক বৌদ্ধ ডাকিনী তন্ত্রের পুঁথির ফরাসি অনুবাদ ও ব্যাখ্যাসমেত উপস্থাপন। সাথে আরও একটি যে গৌণ বিষয় ছিল, তা হলো র্যাবো ও পল এলুয়ারের কাব্যে ‘আমি’র রূপ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা। মূল বিষয়টিতে তাঁর নাকি খুব আগ্রহ ছিল না। বরং ঝোঁক ছিল অতিরিক্ত আনুষঙ্গিক গবেষণার। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পান ডক্টরেট ডিগ্রি। ইতোমধ্যে সমসাময়িকদের মতো মার্কসবাদী দর্শনেও প্রভাবিত হন। এ সময়ই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ফরাসি নাগরিক ফ্রাঁস মতেরুর সঙ্গে। ততদিনে র্যাঁবোর অনুবাদ প্রকাশিত হয়ে গেছে ১৯৬৫-তে। ১৯৬৬ সালে প্রকাশ করেন প্রথম উপন্যাস ‘ভোর’, যদিও রচনাকলের বিচারে সেটি তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। একই বছরে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘যত দ্বার তত অরণ্য’। ১৯৬৭ তে প্রকাশিত হয় ‘দুয়েকটি ঘর দুয়েকটি স্বর’ যেটি প্রকৃতপক্ষে তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস। পরবর্তীকালে প্রকাশিত উপন্যাসগুলো হলো: ‘বাবুঘাটের কুমারী মাছ’ (১৯৭২), ‘থিয়েটার আরম্ভ সাড়ে সাতটায়’ (১৯৮৩), ‘অশ্বমেধ’ (১৯৯৭) এবং ‘গঙ্গাবতরণ’ (১৯৯৮)। সাতের দশকের শেষ দিকে ‘তিমির তরাই-এ পক্ষাঘাত’ নামে যে উপন্যাসটি তিনি লিখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পত্রিকা ‘চতুরঙ্গ’-তে সেটিরই বীজ পরিবর্তিত কাঠামোর উপস্থাপনা হলো ‘গঙ্গাবতরণ’। একই সঙ্গে উল্লেখের প্রয়োজনে যে, শেষ দু’টি উপন্যাস বাংলায় প্রকাশের অনেক আগেই ফরাসি ভাষায় ফ্রাঁস মতেরু (ভট্টাচার্য) কর্তৃক অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়ে প্রকাশিত ও প্রশংসিত হয়েছিল। ১৯৯১-এর লেখা ‘গঙ্গাবতরণ’ ১৯৯৩ সালে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হলে প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘ইনডিকেশন্স’ পত্রিকায় এর সপ্রশংসা আলোচনা করা হয়। এ ছাড়াও লোকনাথ ভট্টাচার্যের আরও একটি উপন্যাস রয়েছে। ১৯৯৯-এর কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘এবং মুশায়েরা’ পত্রিকার (সম্পাদক: সুবল সামন্ত) লোকনাথ ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর ক্ষুদ্র একটি উপন্যাস ‘করেছ একি সন্ন্যাসী’। ১৯৮৬’র মে-জুন মাসে রচিত মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসটিও তাঁর একটি অনন্য সৃষ্টি বলে সমালোচকরা মনে করেন।
লোকনাথ ভট্টাচার্যের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করার আগে উপন্যাস বিষয়ে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা উদ্ধার করতে চাই। সেটি হলো: “বাস্তবধর্মিতায় আমার আগ্রহ কম, বিশ্বাস কম বিশেষত বাঙালি মধ্যবিত্ত সংসারের চিত্রাঙ্কন আমার ক্ষমতার বাইরে, আগ্রহের সম্পূর্ণ বাইরে। আমার আছে পথ, আমার আছে রাত্রি এবং সেই পথ ধরে সারা রাত বেয়ে চলা, ভোরে কোথাও পৌঁছানো, হয়ত কোনখানেই পৌঁছানো নয় – মাঝখানে আকাশ ও অতিক্রম করে চলা বনের ফিসফাস, সত্তার দুঃসহ দুঃখ, যন্ত্রণা, স্বপ্ন, অভিশাপ এবং মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যু।” একটি রাত ধরে ভোরের উদ্দেশ্য পথ চলার কাহিনী হিসাবে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন তাঁর ‘ভোর’, ‘থিয়েটার আরম্ভ সাড়ে সাতটায়’, ‘গঙ্গাবরণ’ উপন্যাসে।
লোকনাথ ভট্টাচার্যের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যে প্রসঙ্গটি বার বার উচ্চারিত হয় তা হলো ফরাসী উপন্যাস-জগতের ‘নোভা রোমান’ বা নব উপন্যাস আন্দোলন। ১৯৫০-এর দিকে উপন্যাসের কাঠামোগত অভিনবত্বের প্রত্যাশায় ফ্রান্সে গড়ে ওঠা এ আন্দোলনের পুরোভাগ ছিলেন ক্লোদ সিঁম ও নাতালি সারৎ। প্রথানুযায়ী কোন আখ্যান না থাকাই এ ধরনের উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাথে সাথে অন্য আরও যে চারিত্র্যবৈশিষ্ট ‘নোভা রোমান’ ধারণ করেছিল তা হলো শিল্প শুধুমাত্র দেখাবে, ব্যাখ্যা করবে না। লোকনাথ নিজেই ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে এ সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ ‘বস্তুপ্রেমিক ফরাসি নব উপন্যাস’ রচনা করেন। সে প্রবন্ধে আরও যে তিনটি বৈশিষ্ট্যকে তিনি বিশেষ গুরুত্বের বলে মত দিয়েছেন, সেগুলো হলো (১) নব উপন্যাসের নায়ক ও অন্যান্য চরিত্র নামহীন, আসলে তাদের চরিত্রের অস্তিত্ব নেই, (২) চরিত্রদের অবিচ্ছিন্ন গতিভঙ্গি এবং (৩) আত্মজিজ্ঞাসা ও বস্তুজগতের আত্মোপলব্ধির জন্য রহস্যের ভিতর দিয়ে অগ্রসরণ।
‘লোকনাথ ভট্টাচার্যের উপন্যাস’ প্রবন্ধে বিশিষ্ট সমালোচক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় লোকনাথের নিজের উপন্যাসের এসব বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতিকে বিশ্লেষণ করেছেন সুন্দরভাবে। আলোচনার এক পর্যায়ে তাই তিনি বলেছিলেন, ‘বাস্তবতা নির্ভর কাহিনীতে তাঁর আগ্রহ নেই… সককালীনতা ও বাস্তবতা দুটোকে তিনি বর্জন করেছেন…। তাঁর উপন্যাসে বাস্তব চরিত্রের কোন অস্তিত্ব নেই। … ঝোঁক বরং সর্বনামের প্রতি – ‘আমি’, ‘সে’, ‘তারা’, ‘ওরা’ ফিরে ফিরে আসে।
লোকনাথ নিজে সমালোচকের এ ভাবনার বিপ্রতীপে অবস্থান নিলেও (বীতশোক ভট্টাচার্যকে দেয়া সাক্ষাতকার, ‘এবং মুশায়েরা’, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০-১৯২) বিস্তৃত বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয় ফরাসি ও সাহিত্যে পণ্ডিত এ মানুষটির উপন্যাসগুলোতেও ফরাসি নব উপন্যাসের আন্দোলনের প্রভাব পরোক্ষ হলেও প্রোথিত। যদি শুধুমাত্র শেষ দু’টি উপন্যাস ‘অশ্বমেধ’ ও ‘গঙ্গাবতরণ’-এর আলোকেও বিবেচনা করা যায় তা হলেও উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা অসম্ভব নয়। দুটিই পরিভ্রমণের কথা – বাহিরীক নয়, যেন মনুষ্যমনের গভীরতম জগতে পরিভ্রমণ। উপরি কাঠামোতে যদিও সেখানে ভ্রমণ শেষে এক গন্তব্যের কথা বলা আছে। প্রায় শূন্য-কাহিনী কাঠামোয় সে ভ্রমণ পরিব্যাপ্ত। ‘ভোর’ বা ‘থিয়েটার আরম্ভ সাড়ে সাতটায়’-তেও তেমন ভ্রমণেরই চিত্রণ পাওয় যায়, যদিও শেষে রচিত উপন্যাস দু’টিতে তা অধিকতর নুতন মাত্রা গ্রহণ করেছে। সে যাত্রায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা কারা? ‘অশ্বমেধ’ শুরু হয়েছে ‘তুমি যা খুশি বল, বলবে?’ – দিয়ে এবং তৃতীয় বাক্যটিতে রয়েছে ‘আমায় শুধু অধিকার দাও চুপটি মেরে তোমার পাশে পড়ে থাকার, তোমাকে দেখাব।’ এভাবেই সর্বনামগুলো চরিত্রগুলো নিজ নামেও উপস্থিত। ‘আমাদের পরিচয় দেয়া দরকার, জানি। এখুনি সেটা দিচ্ছি, হাতে অবশ্য সময় বেশি নেই। সময় কারুরই নেই, না আমাদের, না আপনাদের, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদেরই শুধু নয়, আমাকেও বিশ্বাস করুন… বলে যে কাহিনী শুরু সেটাতে একটু পরেই ‘অমি’ লোকটির পরিচয় হলো ‘আমি হলাম লোকনাথ, পদবি ভট্টাচার্য। ‘আমি’ বাদে অন্য সর্বনামগুলো আস্তে আস্তে যেসব নামে আবির্ভূত হয় সেগুলো হলো বৃন্দাবন, সমীরণ, সুনন্দা, ধ্রুব প্রভৃতি এবং ‘গঙ্গাবতরণ’ আরও বিশিষ্ট এ জন্য যে, এতে উক্ত চরিত্রগুলো (প্রশ্ন যদিও থেকেই যায় যে তারা প্রচলিত অর্থে চরিত্র কি না) দীর্ঘ আলাপের ভেতর দিয়ে উপন্যাসটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যেখানে দূর লক্ষ্য হিসাবে প্রতীয়মান অস্তিত্বের সঙ্কট বা জীবন জিজ্ঞাসা। সেই সাথেই ‘অশ্বমেধ’ এবং ‘গঙ্গাবতরণ’-এ লোকনাথের ভারত-ঐতিহ্য বিশেষভাবে প্রকটিত যা তাঁর পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলোর তুলনায় এ দু’টিকে বিশিষ্টতাও দান করেছে।
ফরাসি নব উপন্যাসের ছাপ লোকনাথ ভট্টাচার্যের উপন্যাসে লক্ষিত হলেও এ কথা আমাদেরকে স্বীকার করতেই হয়, তিনি দেশীয় প্রেক্ষাপটে দেশীয় দর্শনেই তাঁর উপন্যাসকে নির্মাণ করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাভাষী সমসাময়িক সৎ লেখকদের অন্যতম, যেহেতু তিনি জনপ্রিয়তার বা অন্য কোন মোহ দ্বারা তাড়িত নন। তাঁর ছিল একটিই অনুপ্রেরণা, আর তা হলো শিল্প-নির্মাণ।
দৈনিক জনকণ্ঠ সাময়িকীতে ১৩ জুলাই ২০০১-এ প্রকাশিত।