ঔপন্যাসিক হিসেবে মাহমুদুল হকের (জন্ম ১৯৪০) পরিচয় এখন আর কোনও প্রশ্ন নয় বলেই অনুমান। যদিও জনপ্রিয়তার ব্যাপারটি তাঁর অভিধায় কখনও মানানসই হবে না এটা নিশ্চিত। তাছাড়া বোদ্ধাজনের পাঠকপ্রিয়তা লাভের মতো যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনায় তিনি এখনও গৃহীত হন নি সেভাবে। কিন্তু তারপরও মাহমুদুল হক স্বল্পপ্রজদের তালিকা উৎরে এসেছেন এতদিনে। সত্য, এমন একটি তালিকায় সূচিবদ্ধ হয়েও অনেকেই যথেষ্ট আলোচিত হয়ে পড়েন কেননা মোট সাতটি উপন্যাস একেবারে হেলাফেলার নয়। এবং মাহমুদুল হকের ক্ষেত্র যেটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হল প্রত্যেকটিতেই এ ঔপন্যাসিক ভাষা, বর্ণনা ও গল্প সকলেতেই নির্মাণ করেন এমন চরিত্রসমূহ যা থেকে পূর্ববর্তী উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যকে খুঁজে বের করা বাতুলতা হয়ে দাঁড়ায়। তবে একটি ব্যাপারে সাজুয্য আবশ্যিকভাবে দৃষ্ট তা হল ঐহিত্য-চেতনা-স্বদেশিকতায় তাঁর গভীর মমত্বের স্পর্শ।
গল্পকার মাহমুদুল হকের পরিচয় ষাটের দশকেই মূল্যায়িত। এরপর প্রথম উপন্যাস ‘অনুর পাঠশালা’ রচিত হয়েছিল ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে। ‘যেখানে খঞ্জনা পাখি’ নামে প্রথম এ উপন্যাসটি গ্রন্থরূপ প্রকাশ পায় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপন্যাস যথাক্রমে ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ (১৮৭৪) ও ‘জীবন আমার বোন’ (১৯৭৬)-এর প্রকাশ পরপরই। ১৯৮৮-তে ‘খেলাঘর’ (রচনাকাল ১৯৭৮), ১৯৯২-এ প্রকাশিত ‘কালো বরফ’ (রচনাকাল ১৯৭৭) এবং ১৯৯৬-এর ‘মাটির জাহাজ’ (রচনাকাল ১৯৭৭)-এর গ্রন্থরূপ প্রকাশে দীর্ঘ বিরতি থাকলেও রচনাকালের ধারাবাহিকতা স্পষ্ট। এরপর ২০০৪ সালে বেড়িয়েছে ‘অশরীরী’। অন্য গ্রন্থ? না তেমন কিছুই তো নয় শুধু একটি গল্পগ্রন্থ ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ এবং শিশুতোষ গ্রন্থ ‘চিক্কোর কাবুক ছাড়া’।
উপর্যুক্ত পরিমাণগত হিসেবটির সাথে আর একটি হিসেব অসংগত হবে না সেটা হল মাহমুদুল হকের সাতটি উপন্যাসের দৈর্ঘ্য। না জোশেফ কনরাডের ‘দ্যা হার্ট অফ ডার্কনেস’, আরনেস্ট হেমিংয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি’, আলবেয়ার কামুর ‘দি আউটসাইডার’ বা জেমস কয়েসের ‘দ্যা পোট্রেট অফ এন আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং মান’ কে না ভুলেই আমরা বর্তমান বিবেচনায় যেতে চাই। গ্রন্থাকারে যথাক্রমে ৮২ (অনুর পাঠশালা), ১৩৩ (নিরাপদ তন্দ্র), ১৭৭ (জীবন আমার বোন), ১২২ (কালো বরফ), ৬৪ (মাটির জাহাজ), ৭২ (খেলাঘর) এবং ৭২ (অশরীরী) পৃষ্ঠাতেই মাহমুদুল হক নিরীক্ষায় সফল, নিজস্বতা নির্মাণে দ্রোহী, নগর চেতনার গ্রামজ, অনুভবে পুঙ্খানুপুঙ্খ। আধুনিক মনস্কতায় পাঠক হৃদয়ে ছাপ ফেলে তাঁর প্রতিটি প্রচেষ্টা।
মাত্র ৮২ পৃষ্ঠার ‘অনুর পাঠশালা’য় মাহমুদুল হক কেমন যেন আলোড়িত করে ফেলেন আমাদের সকল চৈতন্যকে। দুপুরে সে অনু একা থাকতে পারে না, ভেবে পায় না কি করবে, কোথায় যাবে, এমন একটি কিশোর কত গভীরভাবে পাঠক সত্তাকে আন্দোলিত করতে পারে তা বোধ হয় নাগরিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উপন্যাসে পূর্বে আমরা দেখি নি। আর সেজন্যই হয়তো এটি একটি কিশোর-উপন্যাস না হয়ে বড়দের উপন্যাস হয়ে পড়ে গভীরতর অর্থেই। যদিও ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে দেখা নির্জন দুপুরে জলেশ্বর মালী ও মালী বৌ’র জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকতে দেখার বর্ণনায় খুব নিরাসক্তভাবেই সে বলে ‘মালী বৌয়ের বুক শাদা ধবধেবে’। কিন্তু যখনই জানি ‘অনু আব্বাকে সহ্য করতে পারে না। শয়তান মনে করে। ঘৃণা করে’, (পৃ. ১৪) অথবা ইংরেজি শেখাতে স্যার আসায় ‘দুপুর হলেই তার [মার] সঙ্গে যেন নিদারুণ শত্র“তার এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়’ (পৃ. ১৮) আর অবশিষ্ট থাকে না অনুর গভীরতর চেতনায় ঔপন্যাসিক এক সুলুকসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। বাদবাকি যে ব্রিং খেলা, রং বেরংরের মার্বেল, লামাদের বাগান, এসব তো উপলক্ষ মাত্র। একটি লীলাক্ষেত্র যেখানে কিশোর অনুর পঞ্চইন্দ্রিয় ব্যস্ত, নির্মিতিতে অভিনবত্ব নতুন অভিযোজন যেন সে গল্পে। যখন অনুর ‘বুকের মাঝখানে কাচের পিরিচ ভেঙে খান-খান হয়ে যায়’ (পৃ. ১৮) তখনই তো ফকির, টোকানি, গেনদু, লাটু, ফালানি, মিয়াচাঁন এবং আরও অনেকের সাথে অনুর মেলামেশা – ঘেরা দেয়াল ছেড়ে সে জগতে আঞ্চলিক ও অশ্লীল ভাষা ও ব্যবহার আপাতভাবে বড় বেশি মনে হয়। আর সে সময়েই সরুদাসীর আকস্মিক আবির্ভাব। জগতের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো যখন অনুকে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন সরদাসী যেন অন্য কোন ডাক। মাত্র সতেরটি পৃষ্ঠা! একটি প্রহর মাত্র অথচ তাতেই হৈহৈ রৈরৈ পড়ে যায় অনুর কিশোর প্রাণে। ‘তুই খুব সুন্দর রে’ (পৃ. ৩৯), ‘মা উঠতে বসতে কম গুতান গুতায় নাকি। চামারনীটা মরেও না, মরলে আমার হাড়ে বাতাস লাগতো।’ (পৃ. ঐ); ‘চারমানবাবুর ছোট মেয়েটার না, বিয়ে না হতেই পেট হয়েছে’ (পৃ. ৪১), ‘আজকাল ধুমসী ধুমসী পোয়াতীরা গ্যাঁট গ্যাঁট করে সোজা হাসপাতালে চলে যায় পয়সা বাঁচাবার জন্য। মদ্দা ডাক্তারের হাতে খালাস করায়। ঘেন্নায় আর বাচিনে বাপু।’ (পৃ. ৪২); ‘তুই কি অসভ্য, হাঁ করে আমার পাছা দেখছিলি বুঝি এতোক্ষণ’ (পৃ. ৪৫ [ছুটতে গিয়ে সরুদাসীর কাপড় পেছনের দিকে ফেঁসে গেলে সে ছেঁড়া জায়গায় হাত রেখে দৌড়াতে থাকে]); ‘তুই আর আমি – স্বামী-স্ত্রী হতুম তাহলে কিন্তু তোকে একথা বললে আমার পাপ হতো’ (পৃ. ৪৬ [প্রেক্ষিত পূর্বোক্ত]); ‘বাবুদের বাগানে-তোতে আমাতে মাগ-ভাতার খেলা খেলবো।…খেয়ে দেয়ে দু’জনে পাশাপাশি শোবো।… তাড়ি খেয়ে…আমাকে রানডি মাগি ছেনাল মাগি বলে যাচ্ছ তাই গাল পাড়বি’ (পৃ. ৪৮)… হ্যাঁরে মনসাপাতা, আমাকে তোর কেমন লাগে সত্যি করে বলনা…’ ‘তুই আমাকে বিয়ে করবি’? (পৃ. ৫২); ‘…তোর গলা ছড়িয়ে চৌকিতে শুয়ে থাকবো। চলনারে, তোতে আমাতে শুয়ে থাকি’! (পৃ. ৫৩); এমন অনেকগুলোর প্রধান কয়েকটি মাত্র। যদিও ভুলে যাওয়া উচিত নয় একটি শুধু সাক্ষাত অথচ তার ছাপ অনুতে অনপনেয় আর তার ফলে সেখানে ভাঙন আসে আরও জোড়ে। ‘…আমি কি ননীর পুতুল? কুত্তা কোথাকার!… কতো না তোর মুরোদ শুয়োর…গায়ের খেকো, খ্যাংরা মারি তোর মুখে।’ – চৌকিতে গলা ধরাধরি করে শুয়ে থাকার সরুদাসীর প্রস্তাবে অনুর ‘তোমার গায়ে কেমন আঁশটে গন্ধ’। (পৃ. ৫৪)-এর ক্রমোত্তর এগুলো।
পরবর্তী সময়ে ‘সরুদাসী এক নির্জন কষ্টের নাম’ হওয়ায় অনু আবার পারিবারিক জীবনে স্থিত। সেখানে ‘সারা পৃথিবীর মানুষ [মা] দরোজা বন্ধ করে এখন ইংরেজি শিখতে গিয়েছে? সেখানে বানীখালা, মন্টু, মঞ্জু, ট্যামবল, গোর্কি। অন্যকে বোকা বানিয়ে বা চমকে দিয়ে আনন্দ লোটার জন্য সে জগৎ ব্যস্ত। বাইরের দমবন্ধ গুমোটে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। স্বার্থপরায়ণতার বীভৎস এক রূপ হলদে দাঁত দেখায় অনুকে। ‘আমি সকলের সামনে তোমার মুখোশ খুলে দেবো…নীচ ছোট লোক’ …[মার উক্তি] ‘মুখ সামলে কথা বলো… [বাবার উক্তি] ‘…তুমি একটা কুকুর….[মার উক্তি] ‘আর তুমি একটা পাগলা কুকুর, তোমাকে গুলি করে মারা দরকার…’ [বাবার উক্তি] এসব হল দৈনন্দিন চিত্র। ক্রিস্টলের ভারি শিশি ছুঁড়ে মারে অনু বাবাকে লক্ষ করে এবং আমরা উপলব্ধি করি রহস্যময় এ দম্পতির প্রতিচিত্রই যেন ঘটেছিল অনু…সরুদাসীর শেষ সংলাপগুলোতে। আর সেজন্যেই অনুর মনে হয় ‘সরুদাসীকে তার খুঁজে বের করতেই হবে’ (পৃ. ৮৪)। এবং ঋষিপাড়ার সরুদাসী নামী মানবীর আখ্যান এক রহস্যময়তার আবরণে মোড়া যেমনটি আমরা নিরাপদ তন্দ্রা শেষ পরিচ্ছেদে অবলোকন করি। প্রতীকী কোনও অর্থ নয় অন্ধকারে অবচেতনের আপাত অসংলগ্ন ভাবনা সেখানে সকল বাস্তবতা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে।
‘অনুর পাঠশালা’র মতো ‘নিরাপদ তন্দ্রা’তেও মাহমুদুল হক বিচরণ করেন মানুষের রহস্যময় আচরণের জগতে। যে অন্ত্যজ মানুষ ‘অনুর পাঠশালা’তে ঝিলিক দিয়েছিল পাঠশালার অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ভেতর দিয়ে তারা হারিয়ে যায় না কখনই মাহমুদুল হকের উপন্যাস জগৎ থেকে। ভিন্নতর বয়স ও অভিজ্ঞতার মানুষ হলেও তাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট অভিন্ন। সভ্যতার আচরণ, অনুচ্চার্য শব্দের প্রাচুর্য সে-জগৎকে উপস্থাপন করে পাঠককে দেয় খিন্ন মানব সত্তার সত্যিকারের পরিচয়।
অন্ত্যজ সে জগতের কেন্দ্রে রয়েছে হিরণ। হিরণকে ঘিরে আবর্তিত বহুধাগতিমুখী এ কাহিনীর কথক যে ‘অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তেমনি প্রয়োজন ন্যূনতম একটি বিলাসিতা’ হিসেবে গ্রহণ করেছে বই পড়াকে। অকর্মণ্য এ যুবক হিরণের গল্পটি বলার জন্যই বেছে নেয় একটি প্লট। তাতে যদিও সুবিধেই হয় – পাওয়া যায় তার চারিত্রিক পরিচয় এবং সাথে সাথে বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষায় গল্পটি পার পেয়ে যায় সহজেই। পেশা ও বাসা বদলাতে অতিরিক্ত অভ্যস্ত এ যুবক আগে কম্পোজিটরের কাজ করত। সে সূত্রেই ইদ্রিস কম্পোজিটরের সাথে তার পরিচয় এবং সবশেষে করাতিটোলায় বস্তিতে একসাথে বাস। ইতিপূর্বের ডেকোরেটরের পেশায় ফাৎনা মিস্ত্রির সাথে চতুরতা করে থাকিন কামিয়ে সে এখন কর্মহীন দিন কাটায় ইদ্রিসের ঘরে যেখানে চতুর্পার্শ্বস্থ সব বাজে উপসর্গকে সে নস্যি করে উড়িয়ে দেয়। তক্তপোশ যার পায়াতে লেখা ‘আমার সোনা মানিক দালহাপ্পু দালহাপ্পু বলে কাঁদে’ এতে একসময় আশ্রয় হয় তার ক্রমে দরজা খোলে গল্পের। গল্পের দায়িত্ব বর্তায় ইদ্রিসের উপর। ইদ্রিস গল্প বলে তক্তপোশটার যার সাথে জড়িয়ে আছে হিরণের চোখের জলের কথা। এবং মাহমুদুল হকের বৈশিষ্ট্য হল সে ‘জল’ ভাবালুতায় ভরা নয়। পাঠক ক্রমশ এমন এবং জীবনের অভিজ্ঞতার ওপর দিয়ে নিজেকে টেনে নিয়ে চলেন যেখানে সৌন্দর্য তুচ্ছ, সভ্যতা বালাইহীন। হিরণের দীর্ঘ ঘটনাবহুল এ জীবনের সূত্রপাত যে কেরামত ম্যানেজারকে দিয়ে সে তো হিরণকে গ্রাম থেকে শহরে এনেই ক্ষমতাহীন রূপুরুষ। তারপরই তো মনুষ্য চরিত্রের খেলা – হিরণ ভালোবাসা আর দেহ এ দুই কণ্টকে ক্রমশ রক্তাক্ত। কোবাত আলী, মরিয়ম, জলির বুকি, ফকিরচাঁদ সর্দার, দেঁতো আকদ্দস, কাঞ্চন, ফালু, কাশেম সবাইকে নিয়ে হিরণের ভালোবাসার সোনায় সোহাগা হয়তো তা ছল তবুও হরিণের যৌবন তো ঢলঢল, জীবনের এফোঁড় ওফোঁড় রূপ। লিবিডোর তাড়ণাই কি এসবের নিয়ামক! আর এসবের স্রষ্টা ইদ্রিস। ক্লেদাক্ত বিপন্ন এ জীবনকে সে-ই সর্বস্রষ্টা হয়ে অকর্মণ্য যুবককে বলে যে কি না ইদ্রিসকে শোনায়, ‘…পিঁপড়েদের ভেতরে বর্ণাশ্রম থাকলেও ভাবি একতাবদ্ধ জাত ওরা। পুলিশ বা দারোগা পিঁপড়ে শ্রমিক পিঁপড়ের কলজেয় পা দিয়ে চটকায় না, অথবা রাজা পিঁপড়ে সুযোগ পেলেই ক্ষুদ্র পিঁপড়ের পাজরায় রোঁদা ডলে না। ঠিক তেমনি কেউ চিড়েচ্যাপ্টা হলে অন্যেরা হাপুশ নয়নে ডুকরে ওঠে না। অর্থাৎ কারো জন্যে কেউ হাসে না। কারো জন্যে কেউ কাঁদে না’। (পৃ. ৩০)
‘পুনরায় নিজের কথায় ফিরে আসি’ বলে সে যখন ফিরছে বলে মনে করছে তখন হিরণ তার সত্তাতে আসীন। অবচতনে হিরণের আবির্ভাব তাকে দাঁড় করায় কেরামত আলীর জায়গায়। এক ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে ঝড়ের দাপপাদাপি আর দৃষ্টির কলরোলে এক আবছা নারীমূর্তি অপচ্ছায়ার মতো তার শয্যাপার্শ্বে এসে হাত ধরে তার এবং ক্রমাগত বলে চলে সে। কি বলে সে? পুরো পাঁচ পৃষ্ঠা সাড়ে পাঁচ লাইন তার বিরামহীন এ কথা কি বিলাপ! আপাত পারস্পর্যহীন হলেও গভীর অর্থবহতার মাধুর্য যেন ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। যে গল্পের বয়ানে একসময় ইদ্রিসকে ছাড়িয়ে জলিল বুকি অংশীদারী হয়েছিল তাকে যে সে নিজেই এমন করে নিজ অস্তিত্বে ধারণ করে ফেলবে তা ছিল অজ্ঞাত। মানব-মনের জটিল অবচেতনেরই রূপায়ণ এটি। হিরণের জন্য ইদ্রিসের ভালোবাসা যেমন কোনও অজান্তে নির্মীয়মান তেমনি ভিন্ন আর এক নির্মিতিতে প্রথম কথক যুবকটি নিজেই নিজেকে স্থাপন করে। বিশাল এ ধরণীতে গ্রামীণ সরল এক রমণীর শুধুই স্থানাভাব। বেঁচে থাকবার, নিজেকেস ধারণ করবার সামান্য আধারের অভাব তাকে বারবার নিক্ষেপ করে ভিন্নভিন্ন পুরুষের ক্রোড়ে, চূড়ান্ত মানবেতর স্থানেও যেন তার পরিত্রাণ নেই।
জীবনের স্পষ্ট দৃশ্যমান অধ্যায়কে এড়িয়ে এভাবেই মাহমুদুল হক বারবার ছিটকে চলে যান তাঁর বিষয় সন্ধানে। জনপ্রিয়তার হাতছানি, চর্বণে চর্বিত বিষয়াদি, ক্লিশে শিল্পশৈলীকে ঝটকে ফেলে অভিনব নির্মাণে জীবনকে দেখার প্রচেষ্টা উত্তরোত্তর তাঁর উপন্যাসকে অভিনবত্বে স্থাপন করে চলে। বাখতিনের ‘কণ্ঠস্বরের বহুত্ব’ ধারণাটি মাহমুদুল হকের প্রথম এই দুটি উপন্যাস সম্পর্কে প্রযোজ্য। ‘চরিত্রেরা লেখকের অধীন নয়, তারা জীবনের মূল সূত্রের দ্বারা আবর্তিত। চরিত্রগুলি লেখকের হাতের পুতুল নয়, তারা স্বয়ম্ভর এবং তাদের পারস্পারিক দ্বন্দ্বের বুননে উপন্যাস গড়ে ওঠে।’ – দস্তয়েভস্কির সৃষ্ট চরিত্র সম্পর্কে বাখতিনের এই তত্ত্ব অনুর পাঠশালাতে স্পষ্ট। এত সোজা লেখক-নিরপেক্ষ চরিত্রনির্মাণ, প্রেক্ষাপটের আবহ বাংলাদেশের উপন্যাসে ১৯৬৯ সালে! একটি বিশিষ্ট্য ঘটনা বৈকি।
তবে উপন্যাস সম্পর্কে স্বতঃসিদ্ধ যে বক্তব্য ‘The novel tells a story’ অদৃশ্য কারণে মাহমুদুল হককে সেখানে ফিরে আসতে হয়েছে পরবর্তী সময়ে। উপর্যুক্ত দুটিতে তার ক্রমবৃদ্ধি জীবন আমার বোন এ ‘highest factor’ হয়েছে। যদিও মাহমুদুল হক জীবন আমার বোন-এর লেখক হিসেবই বহুল পরিচিতক কিন্তু ‘অনুর পাঠশালা’তে শৈলীর যে বাঙ্গময়তা যা আধুনিকতার পরাকাষ্ঠা নির্মাণ করে পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে যেন এক পশ্চাদপসরণ। গল্পের প্রাধান্য কালো বরফ পর্যন্ত এক দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসক।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর নিকট-অতীতের এক সময়কাল স্থাপিত খোকার গল্প বোন রঞ্জু, নীলাভাবি, অনেক ক’জন বন্ধু যেমন মুরাদ প্রমুখ, লালু চৌধুরী, সেজখালার ত্যাদড় মেয়ে বেলী সকলকে নিয়ে একটি দৃশ্যমান আবেশ তৈরি করে যা ঐ সময়ের চিত্র দেয়া এবং নাম গ্রহণ করে জীবন আমার বোন। ‘নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন যন্ত্রণারই শব্দরূপ’ (‘বাংলাদেশের উপন্যাস’, বিশ্বজিৎ ঘোষ, সাহিত্য পত্রিকা অষ্টাবিংশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এ উপন্যাস সমসাময়িক জীবনের সামগ্রিক চিত্রকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে প্রকাশ করে। বাঙালির জ্বলে ওঠারও যে বাস্তবতা সেখানে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র খোকার অংশগ্রহণে ব্যর্থতা থাকলেও ঐ বাস্তবতা কিন্তু উপন্যাসে অনুপস্থিত নয়। মাতৃহীন একমাত্র বোন যাদের পিতা কর্মোপলক্ষে বাইরে এমন একটি পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিতে খোকার যে অস্তিত্ব সেখানে দ্বন্দ্বের উপস্থিতি তো রোমান্টিক বিলাসিতার করণে নয়, বরং যৌক্তিকতার ঝালাইমাড়াইয়ের কারণেই। একাত্তরের মাঠে উত্তাল যে বাঙালি যেখানে চারদিকে শুধু মিছিল, স্লোগানের প্রকম্পন, যেখানে উদ্বেগ ও ব্যাকুলতাই নাগরিক জীবনের আবশ্যিক উপাদান হলেও ঐতিহাসিক এক আলোকবর্তিকার প্রত্যাশা দীপ্ত তেমন এক আবহে মুরাদ, ইয়াসিন, মওলা, নুরুদ্দিন, রহমান যখন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে চেতনাগতভাবে সেখানে খোকার শুধুই প্রশ্ন যা পিছুটানেরই সামিল বললেও অন্যায় হয় না। তবে এসবের মধ্যে ‘মুক্তির একমাত্র পথই হ’ল সশস্ত্র বিপ্লব’ (পৃ. ১৭২) ধ্বনিও উঠেছে যা রাজনৈতিক অঙ্গনের বহুধাকে নির্দেশ করে; তেমনি বাঙালি মধ্যবিত্তের সে চেতনাও স্পষ্ট যেখানে শিল্প-কারখানার মালিকানায় দখলদারিত্ব প্রধান হয়ে ওঠে। লিবিডো তো জীবনের অনস্বীকার্য এক উপাদান। তাই এমনতর রাজনৈতিক সময় নিয়ে তৈরি ‘জীবন আমার বোন’ – এ নীলা ভাবিকে অনুপস্থিত রাখেন না মাহমুদুল হক। ভাষার যে রহস্যময়তা ‘অনুর পাঠশালা’তে দিয়েছে নতুনতর মাত্রা তা ভিন্ন রূপে ‘নিরাপদ তন্দ্রা’তে বিরাজমান। ‘জীবন আমার বোন’-এ লেখকের এ শক্তি অনেক বেশি বাস্তব সম্পর্কিত। সরাসরি বক্তব্যের এ বৈশিষ্ট্য আরও বেশি করে ‘কালো বরফ’-এ উপস্থিত। কিন্তু বিশেষ শব্দের ব্যবহারে অভ্যস্ততা এবং বাক্য নির্মাণে সমরূপ চাতুর্য ছাড়া ঐন্দ্রজালিক আবহ যা সম্পূর্ণই ভাষাকেন্দ্রিক তাকে আর এ পর্যায়ে আবিষ্কার করা যায় না।
বর্ণনায় যে ভঙ্গিটি ‘অনুর পাঠশালা’তে সার্থকভাবে ব্যবহৃত তৃতীয় পুরুষের সে বর্ণনা ‘নিরাপদ তন্দ্রা’তে মাহমুদুল হক আর গ্রহণ করেন না। উত্তম পুরুষের এমন একটি চরিত্র এ কাহিনী শুরু ক’রে যার সাথে ঔপন্যাসিককে মেলানো চলে না। যদিও কথকের হাত বদল সেখানে পুনঃপুনঃ ঘটেছে এবং উত্তম পুরুষের কথন শৈলীকে বজায় রেখেই। ‘জীবন আমার বোন’-এ তৃতীয় পুরুষে লেখক ফিরে যান আবার এবং আমরা উপলব্ধি করি বর্ণিত বিষয়াদির সাথে লেখকের প্রতিবেশের সাজুয্য। যেরকম একটি সহধর্মিতা ‘কালো বরফ’-এও স্পষ্ট। এ উপন্যাসে উত্তম পুরুষে প্রথম অধ্যায়টির কথক পোকা। ছোট বেলার পোকা সম্পর্কে বিবরণ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে কথক তৃতীয় পুরুষের যে কি না আব্দুল খালেক ও তার স্ত্রী রেখার দাম্পত্য জীবনকে দেখছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শৈশবের পোকাই মফস্বল কলেজের অধ্যাপক আবদুল খালেক। দ্বিতীয় অধ্যায়ের আবদুল খালেক প্রথম অধ্যায়ের ডায়েরিতে লিখেছে এমন অনুমান করাও অস্বাভাবিক নয় কেননা তাকে রেখা শুরুতেই বলে ‘…হঠাৎ আবার তোমার ডায়েরি লেখার শখ চাপল কেন’ (পৃ. ১৬)। অষ্টম অধ্যায় পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে এ দুই বিবরণ একের পর এক আসছে। নবম অধ্যায়ে অর্থাৎ শেষ এবং দীর্ঘতম অধ্যায়টি সংযোজিত হয়েছে আবার নতুন একটি শিরোনাম নিয়ে ‘আলোছায়ায় যুগলবন্দী’।
অধ্যাপক খালেকের জীবনে এখন এক দুঃসময় উপস্থিত যদিও এত সহজেই সে সময়কে সংজ্ঞা দেয়া চলে না। তবে এটুকু স্পষ্ট সে সময় দাম্পত্য অনীহা, হতাশ জীবন চেতনা ক্লিষ্ট। আর সেজন্যই সুদূরগামী শৈশবস্মৃতি হানা দেয়, দেয় আনন্দ বেদনা। শিশুকালের খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে সেখানে পরিবার, পরিবারের বন্ধুজনেরা সবাই আশ্রিত। প্রিয় মনি ভাইজান, দেশভাগের সময় পশ্চিমবাংলা থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা সব একাকার হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেখানে। সে-অতীতকে মর্মস্পর্শী করে উপস্থাপনের জন্য যেন বর্তমানের অবতারণা সে গল্পে। বর্তমানের বিষাদসিন্ধুতে পুরানোকে রাঙিয়ে রাঙিয়ে দেখা। গল্পের এই হোমনীয়তা ‘কালো বরফ’ পর্যন্ত দাপট ছড়িয়ে আবার যেন নিস্তেজ ‘মাটির জাহাজ’-এ। শুধু এ গল্পটি নয় আরও অন্য যে কিছু মুখ্য হয়ে হয়ে দাবড়িয়ে চলে কোমলতার পরশ নিয়ে।
চৌষট্টি পৃষ্ঠার মাটির জাহাজ বাহাত্তর পৃষ্ঠার ‘খেলাঘর’-এর মতোই একটি নিটোল গল্পকে ধারণ করতে অনীহা। সূক্ষ্ম এক পারস্পর্যকে মাত্র আশ্রয় করেই এর অগ্রসরণ। কেয়াপাতার নৌকা, আদিনাতের ভিটে, বকুল ফুলের শুকনো মালা, টুনুর চিঠি, হিজলবনের নখের কাছে, ঘাটের কথা, জললিপি (যদিও এটি জলপিপির মুদ্রণ প্রমাদ মনে হয, কেননা এ অংশে জলপিপি পাখির সাক্ষাৎ ঘটেছে বারবার), তেঁতুল গাছের গোড়ায়, আন্না, ছৈ-তোলা নৌকা, ম্যাজিক মুকুল উপশিরোনামের মোট এগারোটি অধ্যায়ের সামগ্রিক রূপ এটি। উত্তম পুরুষে শুরু হয়ে এটি নতুন মাত্রা গ্রহণ করেছে ‘প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা’ শব্দবন্ধ দুবার (পৃ. ৬০ ও ৬৩) ব্যবহারের মাধ্যমে। গ্রন্থশুরুতে রেহানা আবরণ নিয়েছিল এক সহজ সরল চটুল যুবতীর যে গ্রন্থশেষে হঠাৎ আসা বেদনার এক ঝড় হয়ে প্রকাশিত হয় ইয়াকুবের কাছে, পাঠকের কাছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সময়ে পাক মিলিটারি অথবা মিলিশিয়ারা তুলে নিয়ে গিওয় যে কলঙ্ক লেপন করে রেখেছে তারই উৎস এই দমবন্ধ দুঃখের। তেষট্টি পৃষ্ঠা ধরে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক মনোরম আবেশ লেখক তৈরি করেন রেহানা ওরফে ঝুমি ওরফে আন্না ওরফে গাব্বু ওরফে ঢেঁপি ওরফে লতার সাতে ইয়াকুবের। পরবর্তী সাত পৃষ্ঠাতেই যা আত্মস্থ করে নতুন এক প্রজ্ঞা যেখানে ‘সারা বারান্দায় আন্নার পায়ের ছাপ’-এর উপর গাল পেতে শুয়ে থাকে ইয়াকুব।
‘খেলাঘর’-এর পাতায় পাতায় ছড়িযে আছে বাঙলার লোকজ এমন একটি প্রকৃতি ও আবহ যা মাহমুদুল হকের চারিত্রিক-বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ পেতে পারে সহজেই। গ্রামজ ভাষা – যেখানে শ্লীলতার প্রশ্নটি অনেক সময়ই আরোপিত – তা সহজেই স্থান পায় তাঁর অনেক উপন্যাসে। অনুর পাঠশালা থেকে শুরু করে তা ‘কালো বরফ’, ‘মাটির জাহাজ’ এবং ‘খেলাঘর’ পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘জীবন আমার বোন’ এবং ‘নিরাপদ তন্দ্রা’তে বৈশিষ্ট্যটি রূপ বদলালেও অনুপস্থিত নয়। নগর জীবনের প্রেক্ষাপট ঐ দুটি উপন্যাসের ভাষার এ বিশেষত্ব পরিবর্তন করে শহরে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় ভাষা চলন আর বলনে পাঠক খটকা খেলেও এর বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন না কোনভাবেই।
২০০৪-এর বইমেলায় প্রকাশিত ‘অশরীরী’ হয়ত-বা নিভৃতচারী এ কথাকারের নতুন প্রকাশ, যা বাংলাদেশের উপন্যাসের যে কোনো মননশীল পাঠকের জন্যই একটি সুখবর; যদি স্বেচ্ছানির্বাসিত এ-ঔপন্যাসিকের এটি নতুন রচনা হয়, তবে তা হবে সকলের জন্য অশেষ আনন্দের এক সংবাদ যে মাহমুদুল হক আবার কথাশিল্পে ফিরে এসেছেন।
‘অশরীরী’ শুরু হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনাপুঞ্জ দিয়ে; যদিও সে-ভাবনার জনক কে তা খুব বেশি স্পষ্ট হয় না সহজে। ‘পাখির শিষ, না ট্যাপ তেকে পানি ঝরছে ওভাবে, পাখি হয়ে থাকলে দোয়েল; ভোরের আলো ফুটতে দেখে দোয়েলই ওরকম প্যাটর-প্যাটর জুড়ে দেয় বরাবর, তখন আর তার কোনো তাল থাকে না, বকে চলেছে তো চলেছেই’ – এভাবে অনির্দেশক বাক্যরাশি চলতে শুরু করে যা প্রায় দেড় পৃষ্ঠা পর কেমন এক আকৃতির পর্যায় লাভ করতে চায়, যখন বোঝা যায় ওইসব শব্দের ভেতর আসলে কথা আছে – ‘কথাগুলো নিরীহ; না ভালো, না মন্দ। কেমন আছো? ভালো? ভালো নয়? বুঝতে পারছি, বুঝতে পারছি! এ-রকমই, বুঝলে, এই রকমই। আর কি! কি আর করবো! হ্যাঁ, ভাই। কারো জন্য কারো কিছু করার নেই! বুঝলে আম্বিয়া?’
এইভাবেই ‘অশরীরী’তে আম্বিয়ার অনুপ্রবেশ। তবে খুব সহজেই যে আম্বিয়া চরিত্রটিতে পাঠকের প্রবেশ ঘটছে তা নয়; আম্বিয়া নামের মানুষটির ভেতরের ভাবনাস্রোতের দূর-সম্পর্কিত কিছু কিছু অভিজ্ঞানে পাঠক ক্রমশ স্নাত হতে শুরু করেন। যেমন, যেদিন প্রথম সে তাহেরার হাত নিজের মুঠোয় ভরেছিল, সেদিন চোখ বুজে এসেছিল তাহেরার; অথবা বুটের ছ্যাঁচা খেয়ে-খেয়ে ডান পায়ের পাতায় দগদগে ঘা হয়ে গেছে, উষ্ণ পেচ্ছাবের ধারা গড়ালে বেশ আরাম লাগে। সেই আরামের পেচ্ছাব-বিষয়ক ভাবনাটি মুহূর্তেই বাষা নেয়: “তাছাড়া পেচ্ছাব জিনিসটা অ্যান্টিসেপটিকও বটে, মেসে থাকতে সে সেই রকমই শুনেছে ওদুদের অভ্যেস ছিল নিয়মিত পাড়ায় যাওয়ার। ওদুদ বলত, ‘একবার কেন, দশবার পাড়ায় যাও, কিচ্ছু হবে না, কেবল কামকাজ সেরে নিজের মুত যন্ত্রটাকে ধুয়ে ফেলতে হবে, রোগবালাই ধারে কাচে আসবে না।’ মনুষ্য মনের এই যে ক্ষিপ্র ও পরিবর্তনশীল গতিবিধি তার চিত্রায়ণ হতে হতে সূক্ষ্ম যে আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ হতে থাকে তাতে ক্রমশ প্রতীয়মান হয় উপন্যাসের প্রধান এই চরিত্র আম্বিয়ার সাথে মুক্তিযুদ্ধের সংযোগ।
চেতনাস্তরের গভীরে থাকে যে-ভাবনারাশি তার ভাষ্যরূপ কিন্তু মাহমুদুল হকের উপন্যাসের নতুন কোনো অনুযজ্ঞ নয়; ‘অনুর পাঠশালা’ তো সেই গভীর চেতনাস্তরকেই আশ্রয় করেছে। নিরাপদ তন্দ্রাও কম যায় না এতদপ্রসঙ্গে। ‘মাটির জাহাজ’ যে-অনুষঙ্গের পরিপূর্ণ পরিচর্যা। তবে অবশ্য-উল্লেখ্য যে, ঔপন্যাসিক তাঁর এ-নির্মাণে ভাষাশৈলী এবং বিষয়বোধে কখনো পৌনঃপুনিক হন নি। অভিনবত্বের হাতছানি তাঁর প্রতিটি উপন্যাসকেই নতুনতর মাত্রা দান করে।
‘অশরীরী’তে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি যেভাবে এসেছে তাতেও নিরীক্ষার অনুসন্ধান করা যেতে পারে। তাঁর পূর্ববর্তী উপন্যাস ‘জীবন আমার বোন’ এবং ‘খেলাঘর’-এও মাহমুদুল হক মুক্তিযুদ্ধ-প্রসঙ্গকে আশ্রয় করেছেন। ‘জীবন আমার বোন’-এ মুখ্য চরিত্র খোকার সাথে মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্তি বাহিরীক অবস্থান থেকে মূল্যায়িত। অন্যদিকে খেলাঘর ইয়াকুবের কোমল অনুভবরাশির উচ্চারণ। রেহানা-ইয়াকুবের উচ্ছ্বল কথোপকথন দিয়ে শুরু এ উপন্যাসটিতে ঝড়ের উথাল-পাতাল শুরু হয যখন পাঠক জানতে পারেন যুদ্ধ শুরুর দিনগুলোতে রেহানাকে মিলিশিয়ারা ধরে নিয়ে গিয়েছে। উপন্যাসটি শেষ হয় ইয়াকুবের এমন ভাবনারামি দিয়ে: ‘সারা বারান্দায় আন্নার (রেহানা) পায়ের ছাপ। ইচ্ছে হয় ওর ওপর গাল পেতে শুয়ে থাকি। … ছলছলে পানির কোন ঘেঁষে ওই তো ঘুমশাক, আন্না আমাকে চিনিয়েছিল। ভাই ঘুমমাক, আন্নাকে তুমি মনে রেখো। ওই তো আমরুল, থানকুনি পাতা মনে আচে তো ভাই, মনে আছে। তো ভাই, মনে আছে।’ ইয়াকুবের দুঃখবোধের এমন যে শ্বাসরোধকারী বর্ণনা তা বোধ হয় মাহমুদুল হকের স্বজাতর। দার্শনিকতা-বিবর্জিত অনুভূতির এমন প্রকাশে অশরীরীতেও প্রতুল। আবার উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবনাও কি নেই! আব্বাস উদ্দিনের ওই গানটা শুনলেই মনে হয়: ‘তা মোমিন মুসলমান দেকা হলো, ওটাই বাকি ছিল, মালগুলো কি! দেশটাকে একেবারে ছারখার করে দিলো শুয়োরের বাচ্চারা! আমার শারা প্রাণ ভরে গাল দিতে ইচ্ছে করে, চেঁচিয়ে গাল দিতে ইচ্ছে করে।’ অথবা ‘আহাম্মকের দল! স্রেফ ভাঁওতাবাজি দেশটাকে করে তুলেছে একটা সারগাছা, আঁস্তাকুড়; এক এক শালা আসবে আর দেশটাকে তাঁর বাপদাদার জমিদারি বলে মনে করবে, শালাদের বস্তাপচা ফতোয়া শুনতে শুনতে কানমাথা জালাপালা হযে গেছে মানুষজনের।’
অবসাদগ্রস্ত আচ্ছন্ন ভাবনাস্রোতের ভেতরেই একসময়ে জানা যায় মিলিটারি ক্যাম্পে বর্তমানে আটক আম্বিয়া মে মাসের ন’ তারিখে গজারিয়ায় প্রথমবার ধরা পড়েছিল এবঙ মজার বষিয়হলো যখন আম্বিয়া সামগ্রিক বর্তান অবস্থাটি স্পষ্টতর রূপ নিল এমন একটি বাকে, ঠিক তখনই লেখক সজোড়ে আবার পাঠককে সরিয়ে নিয়ে যান ‘এর আগে অনেক কথা আছে’ বলে। সে-কথায় প্রথমেই আসে স্ত্রী তাহেরা প্রসঙ্গ, সন্তান পুপুর প্রসঙ্গও সমসাময়িক। নিকট অতীত থেকে সেসব প্রসঙ্গ ক্রমশ দূর অতীতে সম্প্রসারমাণ। দূরতর অতীতে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন তাহরো তার বড় মামা গিলগরিনর সংসারে আশ্রিত এবং খবরের কাগজের সাহিত্রপাতার দায়িত্বে নিয়োজিত আম্বিয়া তাহেরার গৃহশিক্ষক। মিলিটারি সেলে আটক আম্বিয়ার অতীত উপস্থাপনে ঔপন্যাসিক কুশলী – ঘটনা পরম্পরাকে ভেঙে নষ্যাৎ করে ফেলেন তিনি; মনের ভেতর লাফ দিয়ে ওঠা বিবিধ প্রসঙ্গ গদ্দাগাদির ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠে মাথা উঁচিয়ে।
তাহেরা চরিত্রটি ‘অশরীরী’ উপন্যাসের নিয়ামক। মামা দিলগনির বাসায় আশ্রিত থাকা অবস্থাতেই মামির শয়তানির শিকার হয সে। ইচ্ছে করেই মামি লেলিয়ে দেয় নিজের ভাই মোস্তাফিজকে। গর্ভবতী হয় তাহেরা। নিজের এই পরিণতির জন্য দায়ী ব্যক্তিটির নাম লুকিয়ে রেখে সে আশ্রয় খোঁজে আম্বিয়ার কাছে। এক পর্যায়ে আম্বিয়া-তাহেরার বিয়ে সম্পাদ্য হলে শুরু হয় নতুন সংকট। আম্বিয়ার সন্নিকটবর্তী যে-কোনো নারীর ব্যাপারেই তাহেরা বোধ করতে থাকে ক্রুরতা। কাজের মেয়ে মনোরমা বা আপন বোন আন্তদুমও তার অপমানকর আচরণ থেকে রক্ষা পায় নি। কুৎসিত ইঙ্গিতে অতিষ্ট করে তুলেছে নিজেদের জীবন।
‘অশরীরী’-র আম্বিয়া কায়াহীন। নির্মম নির্যাতন শরীরবোধের স্বাভাবিকতা থেকে আম্বিয়াকে নিক্ষেপ করেছে শরীরহীনতাবোধে। দীর্ঘ এবং প্রত্যক্ষ নির্যাতন তার মধ্যে যে-অনুভূতির জন্ম দিয়েছে তা হলো: ‘আচ্ছন্নতা কি মনোরম মনে তোলপাড় করে একথা। আচ্ছন্নতা কী মধুর! সারা শরীর উৎকর্ণ হয়ে বলে – আমাকে আচ্ছন্নতা দাও, আমাকে আচ্ছন্নতা দাও’ – যার বারিরীক প্রকাশে আমরা আম্বিয়াকে জোড় হাত অবস্থায় ‘আমাকে গুরি করে মারুন-’ বলতে দেখি। শরীর-নিরপেক্ষ এ-অস্তিত্ব আম্বিয়ার অন্য কিন্তু তাৎক্ষণিক কিছু নয়। পঁচিশে মার্চের রাতে ঢাকায় ক্রাকডাউন হলে শত শত লাশ সরানোর কাজে জড়িযে গিয়েছিল আম্বিয়াও। মিলিটারির হাতে পড়ে পচা-বীভৎস লাশ সরানোর কাজে সাঁড়াশি হাতে নিযুক্তি পেয়েছিল সে। তারও আগে ছাত্র বয়সেও একবার তাকে লাশ সরানোর কাজ করতে হয়েছিল: হাজার হাজার নিরন্ন মানুষের মিছিলে যখন গুলি চালিয়েছিল পুলিশ, তখন।
সন্দেহ নেই ‘অশরীরী’ একটি অনুপম সৃষ্টি। কল্পনাশক্তির বিস্তারণ এ-উপন্যাসের উপজীব্য যেমনভাবে উপস্থাপনার কারুকলা উপন্যাসটিতে সঞ্চার করেছে গভীর সংকটবোধ – ব্যক্তিমানুষের সে-সংকটের সঙ্গে কথাশিল্পী সম্পৃক্ততা ঘটিয়েচেন জাতীয় সংকটের। এভাবেই তাঁর সাহিত্য প্রয়াসে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে এবং ‘অশরীরী’-র প্রকাশ হয়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
প্রকাশকাল যাই হোক না কেন রচনাকালের দিকে দৃষ্টি ফেরালে বোঝা যায় মাহমুদুল হকের ঔপন্যাসিক জীবন সর্বমোট দশ বছর- ‘অশরীরী’কে বাদ দিয়ে। তার ব্যক্তি জীবনকালের সাতাশ বছর থেকে শুরু করে তিনি ষাট ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে। মাত্র দশ বছরের ঔপন্যাসিক জীবনে মোট সাতটি উপন্যাস – কালের পরিক্রমায় কতগুলো টিকবে সে প্রশ্ন ভিন্ন হলেও প্রতিটিতেই ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন তা অনস্বীকার্য। ভাষা ও রচনাশৈলী, আঞ্চলিক ভাষার দক্ষ ব্যবহারের সাথে বহুর প্রচলিত গ্রামীণ শব্দ ও ভানবাসমূহের সহজাত প্রকাশ তার কথাসাহিত্যকে করে তোলে অনেক বেশি মনোগ্রাহী। প্রকাশিত উপন্যাসগুলি একের পর এক ঘোষণা করেছে বাংলা উপন্যাস জগতে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, শক্তিমান এক ঔপন্যাসিকের আবির্ভাবের পূর্বাভাসকে। তারপরও পাঠক মনে আকাঙ্ক্ষা একটি বৃহত্তর উপন্যাসের যার বিষয়গত ব্যাপ্তি অধিকতর প্রসারিত। আমাদের সে প্রত্যাশার প্রাপ্তি কবে সন্নিকট হবে!