শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট হয় তিনি দেশের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম; এবং জনপ্রিয়তার মোহ এমনই এক জিনিস যে সৃজনশীলতার কঠিন পথ সে কিছুতেই মাড়াতে নারাজ। অথন মোহাবিষ্ট সে লেখকের শিল্পোত্তীর্ণ রচনার সন্ধান সাধারণ প্রচলেই চলে যায় দৃষ্টির অগোচরে। ‘ফ্যান’ যারা তারা তো গতানুগতিকতারই পাঠক; আর পরিশ্রমী পাঠক তো ‘জনপ্রিয়’ অভিধাটির জন্যেই তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখেন। সমালোচকের কাছে তিনি অনুচ্চার্য একটি নাম। এভাবেই দুর্ভাগ্য ঘটে সাহিত্য পাঠকেরÑ কথাকারের ঘটে কিনা তিনি তা তাঁরাই জানেন কেননা সুচিক্কন বিশেষণগুলো তাঁকে হয়তো ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করেছে এই ‘দুর্ভাগ্য’কে উল্টো অর্থে গ্রহণ করতে যে কারণ তাঁকে বইমেলায় ‘সবচেয়ে বিক্রিত’ জাতীয় শব্দপুঞ্জে পুলকিত করে । তেমনই এক জনপ্রিয় কথাশিল্পীর কিছু শিল্পমানসম্পন্ন; পরিশ্রমী, প্রথাবহির্ভূত উপন্যাস নিয়ে আমরা আলোচনা করব।
ধরা যাক ভূমিপুত্র সে-ঔপন্যাসিকের একটি রচনা। এবং বর্তমান আলোচক সর্বৈবভাবে একমত যে লেখকের ‘ফ্যান’রা উপন্যাসটির নাম শোনেন নি, শুনলেও গ্রন্থটির প্রথম অনুচ্ছেদ-পাঠ শেষ করতে পারেন নি। কারণটি ব্যাখ্যা করার জন্য সে অনুচ্ছেদটির উৎকলন আবশ্যক। দৈর্ঘ্যরে বিষয় পাঠক আশা করি সহজভাবে নেবেন।
নাওয়ের পাছায় পা ছড়িয়ে বসেছিল বাদলা। খালি গা, পরনে তাঁতীবাড়ির ত্যানাত্যানা একখানা লূঙ্গি। লিকলেকে পা দুটো জিংলার ডালার মত পড়ে আছে। দু’পায়ের তলা হা করে তাকিয়েছিল কাদেরের দিকে। কী সাদা! জল-কাদায় পায়ের তলার চামড়া খুব খেয়েছে। আঙুলের ফাঁকগুলো থিকথিক করছে। মানুষের পাড়ায়-পাড়ায় কাদা শুকিয়ে যেমন দাদরা-খাদরা হয়ে তেমন দেখতে পায়ের তলা বাদলার। হ্যাজা। দেখে লগি মারা ভুলে খেঁকিয়ে ওঠে কাদের। ঐ ব্যাডা, তরে না কইছি পায়ে কেরাসিন তেল দিতে। দুইদিন দিলে হ্যাজা কইম্মা যাইবো। 1
না এমন একটি অনুচ্ছেদ পাঠ সাধারণ অভিনিবেশে সম্ভব নয়। শুধু কী ভাষার প্রশ্ন। বিষয়ের প্রশ্নেও তো গভীর মনোযোগ দাবি করে বসে সে উপন্যাস। কেননা সামান্য এগুতেই-
কথাগুলো ভেবে আনমনা হয়ে যায় কাদের। আতরীর কথা মনে পড়ে। আহারে বইনডা আমার। বেপারীগ পোলা নাইলে পেডে লইছিলি, জামাই নাইলে তালাক দিতো – হের লাইগা গলায় দড়ি দিবি! মরণের কাম আছিলো কি! বেলদারগ কুন বউ-বেডি বেপারীগ লগে না হুইছে! তয় তুই আছিলি বলদা। হের লাইগা ঐ পেড বাইজ্জা গেছিলো। 2
বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষাটি পাত্র-পাত্রীর কথোপকথন এবং চিন্তা ছাড়িয়ে বারবারই সর্বদর্শী লেখকের কলমের ভেতর ঢুকে পড়ে। সাথে সাথে জানান দিতে থাকে সমাজের অন্ত্যজ মানুষের সভ্যভব্যতার বাইরের আচরণেই যেন লেখক ধারণ করতে চেয়েছেন তাঁর এ গ্রন্থে। অনুলিখন অসম্ভব জেনেই আবারও তাই উদ্ধৃতির আশ্রয়:
দেইখা শুইনা বইচিরে বিয়া করছে কাদের। বইচির পেডের খান কাদেরেরঐ। তয় আতরীরডা, এই বাদলা হালায় বেপারীগ পোলা। বেলদার বাড়ির বেবাকতে জাইনা গেছিলো। 3
জন্ম এবং জীবন নিয়ে নির্বিকার সে লেখকের নাম ইমদাদুল হক মিলন (জন্ম ১৯৫৫)। অভিনবত্ব অনুসন্ধানী রুচীশীল যে পাঠক ‘জনপ্রিয়’-কারণে মিলনের উপন্যাস পড়েন নি, তাঁকে অনুরোধ ‘ভূমিপুত্র’ পড়ুন এবং বাংলাদেশের প্রধান উপন্যাসগুলোর তলে এটিকে একবার যাচাই করুন।
হ্যাঁ, মিলন প্রেমের উপন্যাস লেখেন, যৌবনে স্থিত নারী-পুরুষের ভাবনা-আচরণ তাঁর অন্বিষ্ট; যৌন উপাদানও তাঁর লেখায় প্রতুল – এমন কথাগুলো বর্তমান লেখকের মতো অনেকেরই জানা। কিন্তু ভিন্ন প্রয়োজন দেখা দিল মিলনকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার। সে প্রয়োজনের পথ ধরেই ‘উপন্যাসসমগ্র’-তে (অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৯) যাবজ্জীবন-এ প্রবেশ, বইয়ের ফ্ল্যাপই সে প্রবেশের অনুপ্রেরক যেখানে লেখা ছিল:
যাবজ্জীবন তাঁর প্রথম উপন্যাস। বিক্রমপুরের গ্রামজীবন নিয়ে লেখা। ১৯৭৬ সালের কবি রফিক আজাদ অতি যতেœ অতি মমতায় বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার ধারাবাহিকভাবে ছেপে ছিলেন। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে যাবজ্জীবনের পাত্রপাত্রীর সংলাপ তো রটেই এমনকি বর্ণনায়ও আঞ্চলিক শব্দ অবলীলাক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রামজীবনের প্রেক্ষাপটের রচনায় এই প্রবণতা প্রথম। 4
‘যাবজ্জীবন’-এ প্রবেশ বর্তমান আলোচককে উৎসুক করে অধিকতর প্রবেশে। আর সে গতিতেই ‘কালোঘোড়া’, ‘উপনায়ক’, ‘পরবাস’, ‘ঘেরাও’, ‘মহাযুদ্ধ’, ‘নিরাপত্তা হই’, ‘বালকের অভিমান’ এবং ‘ভূমিপুত্র’ পরিভ্রমণ। ‘যাবজ্জীবন’-এ যে নিরীক্ষাপ্রবণ এবং পরিশ্রমী লেখকের সাক্ষাৎ পাওয়া সেটি হয়তো দুর্লভ মিলনের রচনাসমগ্রে; ‘ভূমিপুত্র’-এর মতো উল্লেখযোগ্য দু’চারটি ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তারপরও আমাদের সীমাবদ্ধতা উপর্যুক্ত উপন্যাসগুলোর বৃত্তে। খোঁজার চেষ্টা মিলনের হঠাৎ হঠাৎ স্ফুরিত মেধাশিখা এবং আহবানের চেষ্টা সে শিখাকে অনির্বেয় করার।
ইমদাদুল হক মিলনের প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ পড়লে বোঝা যায় গল্প বলার অন্বিষ্ট নিয়ে তিনি তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু করেন নি। গ্রামীণ নিরন্ন মানুষের কথা প্রথম থেকেই তার উপজীব্য। বরং এমনটি হয়তো বলাচলে যে তিনি সেই মানুষকেই তাঁর উপন্যাসের আধার করেন যে কিনা উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী হওয়ার জন্যে যেন যথেষ্ট উপযুক্ত নয়। যাবজ্জীবন-এর সেই মানুষটি হলো রুহিতন – ঝোপঝাড়ে অন্ধকারে অদূরে ভাঙ্গা দরদালানে যার বাস, যার একমাত্র সাথে একটি কুকুর, যদিও পাশের বাজারটির অনেকেই রাতের বেলায় রুহিতনের খদ্দের। ওর ক্লেদপূর্ণ বসবাস, জীবন-যাপন, আচার-ভাষার ভেতর নতুন মাত্রা যুক্ত হয়ে যায় যখন এই কাজির পাগলায় আসে সার্কাস দল। সেই দলের জোকার যে কিনা ‘মহারাজা’ হিসেবে খ্যাত তার সাথে টান সৃষ্টি হয় রুহিতনের। দুটি দুঃখী মানুষের এই মিলন ঔপন্যাসিক বড় মমতায় আঁকেন:
আস্তে করে রুহিতনের বুকে মুখ গুঁজে দেয় মহারাজা। তবু ঘুম আসে না তার। রুহিতনের বুকে মুখ রাখলেই তার গায়ের গন্ধ মহারাজাকে সেই এক সুদূর জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কী যেন এক কথা মনে পড়ি পড়ি করে। এই রকম এদ গন্ধ, এই রকম এক রকম বুকে কবে যেন, এই জন্মে না গেল জন্মে কবে যেন অবচেতনে আবার সেই মাছ আস্তে আস্তে ভেসে ওঠে। উঠে একটা ঘাই দিয়ে আবার তলিয়ে যায়। 5
ঔপন্যাসিক তাঁর গ্রন্থে যেমন দিয়েছেন রুহিতনের অতীত, তেমনি মহারাজার অতীতও আমরা পাই এতে। আরও একজন যার অতীত গ্রন্থে পরম যত্নে গ্রথিত সে হল বাজারের পাগল মমিনা। ওরা যেন সবাই এক গোত্রের; তাই তো ওরা পরস্পরের সুখে-দুখে ভাগীদার। ওদের দলে অন্য আরও যে একজন সে হল নেড়ি কুত্তাটা। তাইতো মমিনার মৃত্যু হলে রুহিতন যখন ‘ভাইরে আমার’ বলে কাঁদে আর মমিনার বুকে মাথা ঘষে তখন, উপন্যাসের শেষে, কুত্তাটা স্থির হয়ে বসে থাকে। হয়তো প্রশ্ন করা চলে উমাচরণ ডাক্তারও কি ওদের গোত্রে? হ্যাঁ মিলন সংখ্যালঘু নিরাপত্তাহীন সে মানুষটিকেও দেখতে চেয়েছেন চেতনাস্তরের গভীর তলদেশ থেকে।
উপন্যাসের উপক্রমণিকাতে রুহিতন আর মহারাজাকে গোছগাছ করে উপস্থাপন শেষেই ঔপন্যাসিক যেন ছোটেন বাকিদের কাছে – প্রথমে উমাচরণ, বাজারের ডাক্তার এবং পরে মমিনা পাগলা। তারপর সব যেন মিলেমিশে একাকার। উমাচরণের উপাখ্যান যখন ঢুকতে থাকে উপন্যাসে পাঠক সবিস্ময়ে লক্ষ করেন বর্ণনাকারীও তার ভূমিকা বদলে ফেলেছে। সর্বজ্ঞ যে লেখক এতক্ষণ রুহিতন আর মহারাজার কথা শোনাচ্ছিলেন, তাঁর জায়গায় উমাচরণ েিজই বলতে শুরু করে তার নিজের কথা। দেশ ভাগ হওয়ার ষোল-সতের-বিশ বছর পরেকার সে কাহিনী। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কাজির পাগলার বিশাল জমিদার বাড়ির বাবুদের আশ্রয়েই তো মানুষ উমাচরণ – পুরুষানুক্রমে। সেই জমিদার পরিবারের সন্তান জলধর চক্রবর্তী কলকাতা থেকে ডাক্তারী পাশ করেও গ্রামে ফিরে আসলেন বাবার ইচ্ছাতেই। তারপর তার নিজের ছেলেরা কলকাতা থেকে বারবার চিঠি লিখলেও দেশ ছাড়েন নি ডাক্তার বাবু। তার এক কথা: ‘ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ কইরা দেশটারে নাইলে দুইভাগ করলোই, কিন্তু আমি যে এই মাটিতে জন্মাইলাম এইডা তো মিথ্যা কথা না! 6 কিন্তু তিনিও থাকতে পারলেন কই! দেশ একসময়ই ছাড়তেই হলো। উমাকেও নিতে চেয়েছিলেন, উমাই যায় নি। যাবে যাবে করেও যেন যাওয়া হয়ে উঠে না। যাবে কী করে- এই মাটিতেই তো তার একমাত্র মেয়ে পরির মত গৌরী। বাবুদের দিঘিতে গৌরী ডুবে মরতেই তার স্ত্রীও মেয়েকে অনুসরণ করলো। আর তাতেই কি রুহিতন উমাচরণের কোমলতা পায়!
দশ-এগার বছরের রুহিতন কোত্থেকে একদিন এসে জুটলো কাজির পাগলা বাজারে। মধ্যবয়সী উমাচরণ একদিন খুব সকালে ঘুম ভেঙে শুনতে পায় গোঙানী। বেড়িয়ে দেখে রুহিতন; শুনে বোঝে ধর্ষিতা হয়েছে সে তারপর আস্তে আস্তে রুহিতন বেশ্যা। কিন্তু –
উমাচরণের বড় মায়া পড়ে গেল মেয়েটির ওপর। সময়ে অসয়ে রুহিতন তারপর থেকে উমাচরণের কাছে আসে। বাবাজি বলে ডাকে। আর ঐ ডাকে কী যে মায়া, উমাচরণ মেয়েটিকে নিজের বাইরে ভাবতে পারে না। হোক না বেশ্যা, মানুষ তো! তার আর কমলের মেয়েটি বেঁচে থাকলে তো রুহিতনের বয়সীই হত! 7
বাজারের লোকজন দু’তিন বার রুহিতনকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। ওদেরকে হাতে পায়ে ধরে ঠেকিয়েছে উমাচরণ নিজেই। অথচ তার নিজের অবস্থান নিয়েই উমাচরণ দুশ্চিন্তিত। ঢাকায় রায়ট লেগেছে – এ সংবাদ বিভিন্ন মুখে বিভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হয় তার কাছে। ওদিকে আবার সাধুর বোন গলায় দড়ি দিল। গাওয়ালির কাজে সাধু গেল দূর কোন এলাকায়। সাধুর খোঁজ দেয়ার অজুহাত করে লাট মিয়া আর মনা ছুরি ঠেকায় সাধুর মার বুকে, ধর্ষণ করে ওর বোনকে; দুঃখে ধর্ষিতা হয় আত্মহন্তী। এসব চিন্তা যখন উমাচরণকে ক্ষয় করে চলেছে তখন তার সঞ্চিত ছয়শ’ তিরিশ টাকা আর কিছু পয়সার সন্ধান পেল নেতাই। সাধুর বোনের কথা ভেবে নিজের রাঁড়ি বোনটার কথা মনে পড়ে তার – আর তখনই উমাচরণের উঁইয়ে খাওয়া পাটাতন ওর আকাঙ্ক্ষাকে ত্বরান্বিত করে। রাতে অনেক কৌশলে পাটাতন দিয়ে ঢুকে বাক্সটা বের করে নেতাই প্রথম ঢোকে রুহিতনের ঘরে। বিশেষভাবে লক্ষ করার মত হলো মিলনের বৃত্ত রচনা। উমাচরণের টাকাটা লুণ্ঠিত হচ্ছে আর একজন হিন্দু কর্তৃক, যে কিনা সে টাকার খানিকটা হলেও ঢালছে এক বেশ্যার জন্যে যাকে উমাচরণ বিশেস স্নেহ করে। মানুষের লুণ্ঠনবৃত্তি যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ ইমদাদুল হক মিলন তাঁর কাহিনীর ভেতর দিয়ে তেমনটিই জানিয়েছেন। কিন্তু সকল কুকর্মের পরও মনুষ্যত্ব যে জাগরূক তা স্পষ্ট হয় নেতাই যখন রুহিতনের বাড়ি থেকে বেড়োয়। নেড়ি কুত্তাটার কাছে তার আকুল মিনতি:
নেড়ি, আমারে ক্ষমা করিচ। তারপর কেন যে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কেন যে এমন হয় বুঝতে পারে না নেতাই। উমাচরণের কথা মনে পড়ে নেতাইয়ের। মাটা, রাঁড়ি বোনটার কথা মনে পড়ে। পঙ্গু বাপটার কথা মনে পড়ে। সকালবেলায় জেনে যাবে সবাই নেতাই নেই। উমাচরণ বুক চাপড়ে কাঁদবে। তার সর্বনাশ করে গেল নেতাই। বাপটা, মাটা, রাঁড়ি বোনা সবাই কাঁদবে। নেতাই তাদের জলে ভাসিয়ে গেল। কিন্তু নেতাই করবে কী! মানুষের বগল চেঁচে জীবনা আর বরবাদ করে দিতে পারে না সে। খানিক পর কাজির পাগলার মাঠে নেমে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে নেতাই। চিন্তাভাবনা সব ঝেড়ে ফেলে। এখন লৌহজং যাবে নেতাই। সেখান থেকে ইষ্টিমার। ইষ্টিমারে গোলালন্দ ঘাট। সেখান থেকে কলকাতা। নেতাইকে আর পায় কে! 8
এসবের সাথে আরও যে একজন নীরব দর্শক সে হলো মমিনা পাগল। সারা বাজারের মানুষ যখন পাগলটাকে অবহেলা করে তখন তাকে যত্ন করে যে মেয়েমানুষটা খাওয়ায় সে তো রুহিতন। জাতবংশে মমিনারা হাজাম – মুসলমানি করানো ওদের আদি পেশা। কিন্তু সে পেশা ভাল লাগেনি মমিনার বাবা সংসার আলীর। বাদ্যযন্ত্রের প্রতি তার ছিল অদ্ভুত এক মোহ। আর তাই সকালে মমিনার ঘুম ভাঙতে বাঁশির শব্দে। সন্ধ্যার পর বাপের হাত ধরে যেত যাত্রার আসরে। সংসার আলী যেমন যারা বিক্রমপুর এলাকায় বাদ্যকর হিসেবে খ্যাতি পায়, মমিনাও তেমনি যেন ক্রমে ক্রমে হয়ে পড়ে বাঁশিতে একাগ্র। কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন বাঁশিতে ঠোঁট ছোঁয়াতেই মমিনা পরিণত হতে শুরু করে ভিন্ন এক মানুষে। মথার ভিতরে নিরেট এক শূন্যতা তার। আর এভাবেই একদিন মমিনা পাগল হয়ে গেল।
এভাবেই ঔপন্যাসিক উমাচরণ, রুহিতন, মহারাজা, মমিনা, নেতাইয়ের কাহিনীর মিশেল দিয়েছেন ‘যাবজ্জীবন’ উপন্যাসে। শেষ পরিচ্ছেদে মমিনার মৃত্যু ঘটে খৈয়াজাতের কামড়ে। এই খৈয়াজাতের সাপের উপস্থিতি কিন্তু উপন্যাসটিতে পৌনঃপুনিক। শুরু থেকেই এর ভীতিকর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। যদিও সহজেই প্রশ্ন উঠতে পারে সাপের কামড়ে মমিনার মৃত্যুর যৌক্তিকতা নিয়ে – এর মাধ্যমে ঔপন্যাসিক কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন? না, প্লটের সামূহিক এমন বিবেচনায় ‘যাবজ্জীবন’-কে একটি সফল উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা চলে না। তবে উপন্যাসটিতে যে কোন সচেতন পাঠক অনুভব করতে পারেন একজন হৃদয়বান, শব্দসচেতন ও অনুভূতিশীল গল্পকারকে এবং প্রত্যাশা করতে পারেন একটি ভাল উপন্যাস এমন একজন ঔপন্যাসিকের কাছ থেকে।
১৯৭৬ সালে রচিত ‘যাবজ্জীবন’ ১৯৯০-এ প্রকাশিত হলেও ১৯৭৭ ও ১৯৭৮-এ রচিত ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ এবং ‘দুঃখ-কষ্ট’ প্রকাশ পায় শ্রীঘ্রই ১৯৮২-তে। নিকটবর্তী সময় অর্থাৎ ১৯৭৯-তে রচিত ইমদাদুল হক মিলনের আরও একটি উপন্যাসের নাম ‘উপনায়ক’। ঢাকা মহানগরীর প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাসে ভিন্নতর এক অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সন্ধান পাওয়া যায়। তাছাড়া ঔপন্যাসিকের বর্ণনাভঙ্গীর নিরীক্ষা প্রবণতা এতে স্পষ্ট। ‘যাবজ্জীবন’-এ সর্বজ্ঞ লেখকের ভেতর উত্তম পুরুষের বক্তা উমাচরণের যে উপস্থিতি উপন্যাসটিতে যেমন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল; বিভিন্নভাবে সাপের উপস্থিতি যেমন প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করেছিল ভীতিকর উপাদানকে তেমনি ‘উপনায়ক’-এ আমি আর নদী দুজনেই বক্তা। তারা দুজনেই উত্তর পুরুষে বর্ণনা দিয়ে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তারা দুজনেই যেমন নিজের সম্পর্কে বলেছে, তেমনি পরস্পরের সম্পর্কেও বলেছে। এভাবেই উপনায়ক-এর কাহিনী নির্মিতি পেয়েছে যা বাংলা সাহিত্যে হয়তো অভিনব নয় কিন্তু একজন ব্যক্তি-লেখকের নিরীক্ষার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য উপাদান।
উপন্যাসটিতে ‘আমি’-র নাম উল্লেখ করা হয় নি। ‘আমি’ কথা বলেছে তিনবার অন্যদিকে নদী বলেছে দুবার। আমি নদীকে ভালবাসে, নদীও আমিকে; যদিও অমুর সাথে নদীর সম্পর্কটা সবার জানা। আর এখানেই ইমদাদুল হক মিলন সুযোগটা পান। মানব-চরিত্রের অতলে ডুব দিয়ে দিয়ে তিনি দেখাতে থাকেন সেখানকার ভাবনারাশি। হয়তো প্রশ্ন তোলার আগেই মন্তব্য করা চলে যে উপনায়ক কো মহৎ উপন্যাস নয়; কিন্তু নগরবাসী যুবক-যুবতীর জীবন-যাপন ও ভাবনাচিত্রের অসাধারণ রূপায়ণ যে এতে ঘটেছে তাতে ভিন্নমত থাকার কোন কারণ নেই। ‘আমি’ আর নদীর উপাখ্যানের ভেতর লিলি আর রায়হানের প্রসঙ্গ যেন মানবমনের আর একটি ভিন্নতর স্তরকেই উন্মোচন করেছে। উপনায়ক আর কিছুর পরিচায়ক না হোক নগর জীবন এবং আধুনিক মানবমনের উপর্যুক্ত দুটি উপন্যাস পাঠে যে কোন পাঠকই একটি সরল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন যে মিলন যেমনভাবে গ্রামজীবন গ্রামীণ মানুষ এবং দেশবাংলা নিয়ে উপন্যাস রচনায় সফল, তেমনি আধুনিক নগর জীবন এবং এখানকার যৌবনাশ্রয়ী মানবা-মানবীকে নিয়ে কাহিনী নির্মাণেও তিনি সমান শৈলী প্রদর্শন করতে পারেন।
ঠিক পরের বছরই ইমদাদুল হক মিলন লেখেন ‘কালোঘোড়া’ (১৯৮০)। মাত্র পঞ্চাশ পৃষ্ঠার। মুক্তিযুদ্ধের বিপুলায়তনের তুলনায় তা যথেষ্টই হ্রস্ব। হয়তো সামগ্রিক বিবেচনাতেই মিলন দীর্ঘ মহাকাব্যিক কোন রচনায় অগ্রসর হন নি মুক্তযুদ্ধ নিয়ে। ‘কালোঘোড়া’-ই তি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিলন রচিত প্রথম উপন্যাস? তবে এতে উপন্যাসিক যে মাত্রাটি সচেতনভাবে যোগ করেছেন তা হলো বর্ণনাভঙ্গীতে আঞ্চলিকতার অনুপ্রবেশ। ‘যাবজ্জীবন’-এও আঞ্চলিক ভাষা অর্থাৎ বিক্রমপুরের মৌখিক বয়ান ছিল তবে তা ঘটেছিল কথোপকথনে। অন্যদিকে ‘কালোঘোড়া’-তে বর্ণনাকারীর ভাষাই বিক্রমপুরের ভাষার খুব কাছাকাছি। সে বর্ণনা শুরু হয়েছে রতনলালকে দিয়ে:
হলে হবে কী, রতনলালের মন মানে না। বৃষ্টি বাদলায় গাহাক থাকে না। পিরিতির বউ ছাইরা এই দিনে ঘরের বাইরে হয় কেডা! তার মধ্যে দেশে হাঙ্গামা। জয় বাংলা, জয়, বাংলা। আকাশে ঘর থনে কেউ বাইর অয় না। তবুও রতনলালের মন মানে না। গাহাক না থাকলেই মনটা খারাপ হয়।গাহাক হইলো গিয়অ দেবতা। কথাটা কইয়া গেছে রতনলালের বাপ, মাখন লাল। দেবতার দেখা না পাইলে কার মন ভালা থাকে? 9
মনোযোগী পাঠক খেয়াল করবেন বর্ণনাকারী যেন বাইরের কেউ নয়, যেন সে রতনলালের ভেতরে বসেই নৈর্ব্যক্তিকভাবে বর্ণনা করে চলেছে তার দৃষ্টি ও ভাবনাকে।
রতনলাল মিষ্টির দোকানদার। বাড়িতে তার একমাত্র মেয়ে কালী। পঞ্চাশের রতনলালের মেয়ের বয়স ষোল, দেখে যদিও মনে হয় বছর কুড়ি। কালী তার মাকে হারিয়েছে আড়াই বছর বয়সে। সেই থেকেই বোবা, কালো কিন্তু স্বাস্থ্যবতী কালীই ওর বাপের একমাত্র আশ্রয়। এরই মধ্যে ‘দেশে জয়বাংলা রব উঠলো’। ঢাকার শহর রক্তে ভাইসা গেল। রতনলাল শুনলো দেশে কোন হিন্দু রাখবো না মেলেটারিরা। ‘শুনে ভয়ে গুটিয়ে থাকে রতনলাল। রাতের বেলা বাড়ি ফিরে কালীকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।’ আর এসবের মধ্যেই উপন্যাসের শুরু। শুরুতেই আরও উপস্থিত দোকানের কর্মচারী বারিক আর নয়না। রাতে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে উদ্বেগাকুল ওরা হল। নয়না হিন্দু; সে চিন্তাতেই সে হতাশ। আর বারিক/ চেয়ারম্যানের গোমস্তা আফাজদি দুপুরের খবর দিয়ে গিছে চেয়ারম্যান বারিককে দেখা করতে বলেছে। বারেক সব বোঝে:
পাঁচ মাইল দূরে বড়ো বাজার, লে হজং। হেইহানে মিলিটারি ক্যাম্প। সিরাজ চেয়ারম্যান দু’একদিন পরপরটই গিয়ে মিলিটারিদের সঙ্গে দেখা করে আসে। গ্রামে বলে শান্তি কমিটি বানাইবো। ঐ কামে পোলাপান লাগবো। গ্রামে তো আর ডাঙ্গর পোলাপান নাই। একজন দুইজন কইরা সব গেছে আগরতলা। মুক্তিবাহিনী অইবো, যুদ্ধ কইরা মেলেটারি খেদাইবো। বাংলাদেশ স্বাধীন অইয়া যাইবো। 10
এমন সব দুঃখ ভাবনার ভেতরই দুজনে খায়; শোয়, এবং শারীরিকভাবে কাছাকাছি আসে। পুরুষ গমনের উল্লেক কি বাংলা ভাষায় ইমদাদুল হক মিলনের কালোঘোড়া-তেই প্রথম?
পরদিনই বারিককে যেতে হলো চেয়ারম্যানের কাজে। প্রথম কাজ যেটি সে করলো তা হলো রতনলালের দোকান থেকে দাম না দিয়ে মিষ্টি নিয়ে গেল। আর সে রাতেই একলা নয়নার ঘরে বাসিন্দা হলো খোকা, আলম, মন্না আর কাদের। মুক্তিবাহিনীর এ চারজন সারা দিন বাইরে বাইরে কাটায় আর, রাতে এসে অবস্থান নেয় রতনলালের দোকানে। আগের দিনের যে চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ স্পষ্ট হয়েছিল এখন সেখানে মোড় ঘটে। চেয়ারম্যান, তার ছোট বিবি, খোকার বাবা দফাদার আর বারিক। তারা পরস্পরের সাথে কথা বলে কিন্তু ‘কেউ কারো মনের কথা টের পায় না’। চেয়ারম্যান পেতে চায় কালীকে, অথচ কালো কালীর দিকে চেয়ারম্যানের নজর এমন কেন তা বারিকের কাছে অস্পষ্ট। কেননা সে তো তখন ভাবছে: ভালা কাম পাইছি। টেকা পয়সা না দিলেও এই বাইতেই কাম করুম আমি। ছোটবিবিরে তো রোজ দেহন যাইবো।’
ওদিকে গল্প গড়ায় অন্যদিকে। চার মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে যে মুন্না তার সাথে ছিল চেয়ারম্যানের ছোটবিবির ভাব। ওরা চারজন আসে গভীর রাতে ছোটবিবির সাথে শলাপরামর্শ করতে। সিদ্ধান্ত হয় মিলিটারি আসার খবর চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নিয়ে ছোটবিবি জানাবে মন্নাদেরকে। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সহযোগিতার এক প্রীতিকর চিত্র তৈরি হয় ক্রমে ক্রমে। ইতোমধ্যে চেয়ারম্যান রতনলালের বাড়িতে গিয়ে নষ্ট করে কালীকে। আত্মপীড়নে আত্মহন্তারক হয় কালী। কিছুদিন পর চেয়ারম্যানের ডাকে নয়নাকে যেতে হয় তার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ বার বার আশায় নয়নার উপর শুরু হয় অত্যাচার। মুক্তিযুদ্ধে কিশোরের ভূমিকার একটি অতুল্য চিত্রণ নয়না। শেষ পর্যন্ত সে জীবনই দেয়, কিন্তু কোন সংবাদ দেয় না। সামগ্রিক পরিস্থিতি এমনই হয় যে ঘোড়ায় চড়ে লৌহজং যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধারা চেয়ারম্যানকে হত্যা করে। এভাবেই একদিন দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কিন্তু মিলনের ভিন্নতা এই তাঁর উপন্যাস আরও খানিকটা অগ্রবর্তী যেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হতাশ। এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর হতাশ সমাজের এমন চিত্র মিলনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাসগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য বৈকি।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলো নিয়ে তাঁর আলাদা একটি বই বেরিয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত সে গ্রন্থটিতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল ‘ঘেরাও’, ‘মহাযুদ্ধ’, ‘নিরাপত্তা হই’, ‘বালকের অভিমান’ এবং পূর্বে আলোচিত ‘কালোঘোড়া’। কাছাকাছি সময়েই এদের কোন কোনটি গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে এর পরেও যে মিলন আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস লেখেন নি তা নয়, যেমন ঐ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস গ্রন্থটিতে গ্রন্থিত সবকটিকেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস অভিধা দিতে দ্বিধা লাগে।
হয়তো তাঁর কোন উপন্যাসই বিশাল ক্যানভাসে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে পারে নি কিন্তু কোন কোনটির গল্পের সাথে মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্তি রীতিমত প্রীতিকর। কোন কোনটি আবার বড়গল্প অভিধা পাওয়ারই যোগ্র। যেমন ধরা যাক ঘেরাও-এর কথা। এ বড় গল্পটির মূল চরিত্র বুলবুল; যদিও পঁয়তাল্লিশ পৃষ্ঠার গল্পটিতে বুলবুলকে সে অবস্থানে পৌঁছতে ত্রিশ পৃষ্ঠা শেষ। প্রথমে তা মনে হয় বিলু অর্থাৎ ১০-১২ বছরের রাস্তার ছেলেটাই বোধহয় প্রধান। জন্ম সম্পর্কে কিচুই জানা না থাকায় বিলু না হিন্দু না মুসলমান যা তার জন্য দিয়েছে অবাধ গতি – হিন্দু-মুসলমান সকলের বাড়িতেই। মুন্সিগঞ্জ শহরে যেদিন মিলিটারি আক্রমণ হলো সেদিন সকালেই সুবলরা রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে, বুলবুলরা মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে। এভাবেই উপন্যাসটির পরিপ্রেক্ষিত নির্মিত হয়েছে। তীব্র হয়েছে যখন ঐ দিনই বিলু মিলিটারির গুলিতে নিহত হলো। মামাবাড়িতে যাওয়ার আগে বুলবুল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ঘর ছাড়তে পারে নি, যদিও ওর বয়সীকলেজ পড়ুয়া সব বন্ধুরাই গেছে। মামাবাড়িতে যেয়ে সমবয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে বুলবুলের সে আকাক্সক্ষা তীব্রতর হয়। বাবা-মা’র বাধা পূর্বে তার জন্র ছিল অলঙ্ঘনীয়, পরে তার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়া চম্পা, এম এ পড়–য়া খালাত বোন। বকুলতলীতে নামার দিনই মেয়েটির মধ্যে একটি ‘খাই খাই ভাব’ লক্ষ করেছিল বুলবুল। আর এরপর থেকে ঐ মেয়েটিই যেন বুলবুলকে ঘেড়াও করে রাখল তার শরীরী আহ্বান দিয়ে। অনভ্যস্ত বুলবুলের পক্ষে যে আহ্বানে সাড়া না দেয়া হয়ে উঠলো অসম্ভব। উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি নগ্ন চম্পাকে শারীরিক প্রহারের মাধ্যমে বুলবুল তার প্রতিহিংসা নিচ্ছে এবং ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে।
‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’-এর বাকি তিনটি উপন্যাস মহাযুদ্ধ, নিরাপত্তা হই এবং বালকের অভিমান কোনমতেই মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস অভিধা দাবি করতে পারে ন্ াএ তিনটি উপন্যাসই মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে হতাশ যুব সমাজের কথা আছে। আছে সে সময়ের কথা যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা সমাজে অপাংক্তেয়, আর মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত বা অসম্পৃক্ত দুর্বৃত্তরা সমাজে প্রতাপশালী। এ তিনটি উপন্যাসেই গভীর উপলব্ধি হয়তো নেই, হয়তো উপন্যাসের ঐতিহ্যিক প্রত্যাশা এতে পূরণ হয় নি, কিন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের হতাশ একটি সময়ের চিত্রণ এরা।
‘বালকের অভিমান’-এর কাহিনী তো বাহাত্তর জানুয়ারি মাসেরই। ষোল সতেরো বছরের নীলু যখন দেখলো শিমুদের ছাদে আরও চারটি ছেলেকে, ওরা সিগারেট খায়, মাথায় বাবরী চুল ওদের। নীলু যখন জানলো বখাটে ঐ ছেলেগুলোকেই শিমু পছন্দ করে কিছুতেই নীলু নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। খারাপ হওয়ার পথ সামনে পড়তেই যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল সে – সিগারেট ধরল, পিস্তল রাখল, মৃতসঞ্জীবনী খেলো। তারপর হাইজ্যাকিও করলো। আর তারপর:
নীলু তারপর কখন যে শিমুদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারে নি। যখন বুঝতে পারলো, আপাদমস্তক কেঁপে উঠলো নীলু। কোত্থেকে যে তখন আবার সেই তীব্র অভিমান এসে বুকে ভর করে নীলুর। শিমুদের বাড়ির সাদা দেয়াল দুহাতে চেপে ধরে নীলু তারপর হু হু করে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বিড় বিড় করে বলে, শিমু আমি নষ্ট হয়ে গেছি। নষ্ট হয়ে গেছি। তুমি আমাকে ভাল করে দিও। 11
‘নিরাপত্তা হই’ উপন্যাসের মন্টু যদিও নীলুর চেয়ে বয়সে বড়; সময়টাও আরও অগ্রবর্তী, ১৯৭৪। বোঝা যায় যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তেজিয়ান অবস্থান থেকে মন্টু নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আর তা করতে যেয়েই শুধুই যেন পিছিয়ে পড়া। বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে সাত্তার কাকা ব্যবসা করে বড়লোক হলেও এদেরকে শোনায় অন্য কথা। আর তেমনই একটা সময়ে ওর মনে পড়ে কুয়োতলার পাশের মাটিতে পুঁতে রাখা পিস্তলের কথা। কুয়োতলার দিকে যেতে যেতে মন্টু ভাবে:
আমার বন্ধু অস্ত্রবাজী করে জীবন পাল্টিয়েছে। …শালাদের চেহারায় চেকনাই ঝলমল করে আজকাল। আমি কোন লোম ফেলেছি। অনেস্টি দিয়ে কিছু হয় না। দেশ ভালোবাসি, কিন্তু দেশ আমাকে কিছু দেয়নি। না খেয়ে আমার বোনের চোখে কালি পড়ে, অসহায় মা জায়নামাজে বসে কাঁদে। আর আর পারি না। তিন বছর অপেক্ষা করেছি। আর কতোকাল! আর কেন? 12
আর এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ, আদর্শ ইত্যাদি সবকিছু মন্টু ছেঁড়ে ফেঁড়ে ফেলে। সে বুঝে ফেলে রাষ্ট্র কাউকে দেখবে না। গ্রাম থেকে হাজার হাজার অনাহারী মানুষ মঞরে এলেও, অনাহারে ুবতী মেয়েরা বেশ্যা হয়ে গেলেও রাষ্ট্র ও তার চেলা চামুণ্ডারা নির্বিকার। অথচ ঐ চেলারা কিন্তু টাকা ওড়ায়, মদ খায়, অনাহারী মেয়েদের তুলে এনে ভোগ করে। তেমন একটা দৃশথ্য দিয়েই উপন্যাসটি শেষ হয়। যখন মন্টু ওর পিস্তল দিয়েই সামাল দেয় ওর বন্ধুদের, রক্ষা করে মেয়েটিকে। সামাজিক অবক্ষয়ের এ চিত্র আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। ইমদাদুল হক মিলন তাঁর নিকট অভিজ্ঞতা থেকেই সে ইতিহাসকে সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন।
কিন্তু মন্টুর মধ্যে যে বিবেকের দংশন তা কিন্তু তার বন্ধুদের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত নয়। অমন কিছু বন্ধুদের গল্প নিয়েই মহাযুদ্ধ-র কাহিনী। তারা চারজন। হয়তো সামাজিক বিপ্রতীপ অবস্থাই তাদের অধঃপতরে জন্য দায়ী। ওরা মুক্তিযোদ্ধা ছিল একসময়, একন ডাকাতি করে বেড়ায়। লোক চারজন উপন্যাসের শুরুতে বাবুয়ার চায়ের দোকানে বসেছিল। আর পৃষ্ঠা তিরিশেক পরে দেখা গেলওরা সোবহানের ক্যাশ লুট করে ফেরার পথে বাবয়ার সন্তানহীনা স্ত্রী আলতাকে ধর্ষণ করে। আর এপর উপন্যাসের বাকি দশ পৃষ্ঠা যেন গড়িয়ে পড়ল আলতার দিকে – আলতা পোয়াতী হল, যদিও লৌহজঙের ডাক্তার বাবুয়াকে আগেই বলে দিয়েছে কোনদিন বাবা হতে পারবে না সে। উপন্যাস শেষ হয় বাবুয়া-আলতা রচনা দিয়ে যার পরিণতিতে বাবুয়া আলতাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ‘ঘেরাও’-এর মত ‘মহাযুদ্ধ’-ও শুরু হয়েছিল একটি প্রসঙ্গ দিয়ে আর শেষ হয় ভিন্ন প্রসঙ্গে।
প্রবাসী মানুষের দুঃখ-ব্যথা কাহিনী রচনাতে ইমদাদুল হক মিলন সিদ্ধহস্ত। নিজের গভীর অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত সে সব কাহিনী মানবিক গুণাবলীপুষ্ট। ‘পরবাস’ (১৯৮৭) তেমনই এক কাহিনী। পরবর্তীতে এটি ভিন্ন আর একটি কাহিনীর সাথে একই মলাটে পরাধীনতা নামেও প্রকাশিত হয়েছে। ‘পরবাস’ আবদুল্লাহর উপাখ্যান। মোটা সোটা বেয়াল্লিশ বছরের আবদুল্লাহ এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তার দুঃখগাঁথা দু’স্তরের: বর্তমানে পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থানকালে চাকরি-বাসস্থানের অভাবজনিত একটি; আর অন্যটি হলো দেশে ফেলে যাওয়া তাঁর স্ত্রী রেনু এবং দুই মেয়ে সোনালি রূপালিকে জড়িয়ে।
বাংলার অধ্যাপক আবদুল্লাহ অনেক বাধা পেরিয়ে সহপাঠিনী রেনুকে বিয়ে করতে সক্ষম হয়: পিতা হয় দু সন্তানের; চাকরিতে উন্নতি এত ত্বরা ঘটেছিল যে পঁয়ত্রিশ বছরেই প্রিন্সিপাল। তার ভেতরেই ষড়যন্ত্রের শিকার হলো সে – কলেজের একাউন্ট থেকে টাকা তসরুফ হলো। এ্যারেস্ট হলো সে, জামিন হলেও স্পষ্ট হয়ে গেল শাস্তি তার হবেই। আর তাতেই বহুজনের পরামর্শে একসময় পশ্চিম জার্মানির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো। আর প্রবাসের প্রতিটি পথই তো তাকে জ্বালায়। হ্যাঁ, উপন্যাসটিতে দেশপ্রেমের চিত্র আছে – আর তাই আবদুল্লাহ এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় সে দেশে ফিরে আসবে। ‘আসবে দেশের জেলখানাও ভালো’ বাক্য দিয়ে মিলন তাঁর উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটান।
‘পরবাস’-এ ঔপন্যাসিক অতীত কাহিনী বর্ণনায় সময়ানুক্রমকে মান্য করেন নি যা উপস্থাপনায় উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। আর সেভাবেই আবদুল্লাহর দুঃখ ভারাক্রান্ত এক স্বামী ও পিতৃ হৃদয় পাঠকের সামনে প্রকাশিত হয়। আরও যে একটি কৌশল লক্ষ করা যায় তা হলো তৃতীয় পুরুষের বর্ণনার ভেতর যখন আবদুল্লাহর অতীত ব্যক্তিজীবন প্রবিষ্ট হয় তখন আবদুল্লাহ নিজেই উত্তম পুরুষের বক্তায় পরিণতহন যা সাদামাটা গল্পকথনের ক্লিষ্টতা থেকে পাঠককে অভিনবত্বের সন্ধান দেয়।
ইমদাদুল হক মিলনের যে সব উপন্যাসের আলোকে বর্তমান প্রবন্ধ দাঁড় করানো চেষ্টা করা হয়েছে তার মধ্যে শুরুতে উল্লিখিত ‘ভূমিপুত্র’ প্রধান। এ উপন্যাসটির গভীর পাঠ অন্তত অধিকাংশ পাঠককে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত করবে যে ‘যাবজ্জীবন’ দিয়ে যে ঔপন্যাসিক তাঁর লেখক জীবন শুরু করেছিলেন আট বছর পর প্রকাশিত অন্তত ‘ভূমিপুত্র’ পর্যন্ত তাঁর শক্তিমত্তার কোন ক্ষয় ঘটে নি। জনপ্রিয়তার মোহ তাঁকে চটুল কাহিনী রচনায় প্রবুদ্ধ করলেও তিনি যে প্রথম সারির একজন ঔপন্যাসিকের দৃষ্টি ও শৈলী উভয়ই ধারণা করেন তার নিদর্শন ‘ভূমিপুত্র’।
‘ভূমিপুত্র’ বেলদারদের দুঃখভারাক্রান্ত জীবনের কাহিনী – সে কাহিনীর ভেতর লুকিয়ে আছে বেলদারদের জমিজমা-বাড়ি হারিয়ে যাবার কথা, তেমনি বেপারীদের উত্থানের কাহিনীও এ উপন্যাস। যাদের আশ্রয়ে বেপারীরা এক সময় দিনযাপন করত এখনতারাই বেপারীদের কৃপাপ্রার্থী। বেপারীদের কৃপা ছাড়া বেলদারদের মুখে ভাত জোটে না; তার জন্যে প্রয়োজনে কুদ্দুস বেপারীর রতিসুখ মেটাতেও যেন যে কোন বেদদারনি প্রস্তুত। আতরীকেও তাই করতে হয়েছিল। সমস্যাটা হয়েছিল যখন হজু আতরীর প্রেমে মশগুল হয়ে ওকে বিয়ে করে বসল। আতরী চাই নি, কিন্তু কাউকেও বলতে পারে নি। তারপর বিয়ে হয়ে পাঁচ মাস না যেতেই বাদলার জন্ম। শেষে গলায় দড়ি দিয়ে মরল আতরী। সেই যে মরে যাওয়া আতরী, ওর সন্তান বাদলা, বাদলার মামী পোয়াতী বইচি এদের সবাইকে নিয়েই ভূমিপুত্র পরিপুষ্ট।
আতরী কুদ্দুস বেপারীর বাঁদী ছিল। আর তাই পেটের জ্বালায় তার সন্তানও নিয়েছিল পেটে। সেজন্যেই সে হজুকে বিয়ে করতে চায় নি। আতরী মারা যাওয়ার পর হজু অজুফাকে বিয়ে করে। এখন –
আতরীর লাহান অজুফারেও ধরছে কুদ্দুস ব্যাপারী। নিটাল দুইফরে কাছাড়ি বাড়িত ডাইকা নেয় অজুফারে। কাছারি ঘরে অজুফারে লইয়া দোড় লাগায়। হজু বেবাক জানে। চোক্কের সামনে দেহে। দেইখাও কথা কইতে পারে না। কথা কইলে কামেতথন দুজনরেঐ ছাড়াইয়া দিবে বেপারী।…
হজু গিয়া অজূফার দিয়ে আহে। সব বোঝে, সব দেহে। সইয়া যায়। কথা কইতে পারে না। অজূফারে চাইর পাঁচটা পোলাপানের মইদ্যে কোনডা হজুর কোনডা কুদ্দুস বেপারীর কেহা কইবো।
আর এসবের ভেতরই বাদলাটা মারা গেল। কাদেরের সাথে মাছ ধরতে ধরতে শিং মাছের কাটা কেয়ে ক’দনি ভুগে ওর মৃত্যু। বাদলার মৃত্যু যেন কাদেরের ভেতর এনে দিল এক পরিবর্তন। কুদ্দুস বেপারী বাদলাকে স্বীকার করে নি বলে ওরা শবদেহটা নদীতে ভাসিয়েচে, বেপারীর জমিতে দেয় নি। তার মধ্যে এসে গেল ধান কাটার মরসুম। কুদ্দুস বেপারী জানালো কাটার জন্য এবার দশভাগা একভাগা। চিরকালের সাতভাগা একভাগা এক পরিবর্তনের বেলদারদের বিদ্রোহী চেতনাটা যেন নড়েচড়ে বসে। লাঠিতে তেল মালিশ শুরু করে ওরা। পরে ধানের জমিতে কুদ্দুস বেপারীর ভাড়া করার চরের লোকজনের সড়কির সাথে লড়াই করতে করতে কাদেরের মৃত্যু ঘটে। সমাপ্তি ঘটে উপন্যাসের।
সমকালীন বাংলাদেশের প্রশ্নে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে গ্রামীণ চিত্র অর্থবহ, শিল্পসম্মত ও আবশ্যিকতার প্রশ্নে খুব কম উপন্যাসেই উপস্থিত। গ্রামীণ বাস্তবতায় রচিত মিলনের অন্যান্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘যাবজ্জীবন’ এবং ‘ভূমিপুত্র’ সর্বাগ্রে স্মরণযোগ্য হলেও ‘নূরজাহান’ (প্রথম পর্ব ১৯৯৫; দ্বিতীয় পর্ব ২০০২) বোধহয় সে-জীবন নির্মাণে তাঁর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হিসাবে উল্লেখ পাবার যোগ্য। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত প্রথম পর্ব দুটিতে (অনুমান করতে কষ্ট হয় না লেখক এর তৃতীয় পর্বের দিকে এগুবেন) যে সুবিশাল কলেবরে (২৬৯ + ৪৩২ = মোট ৭০১ পৃষ্ঠা) তিনি যৌক্তিকভাবে বিবিধ কাহিনীর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সামগ্রিক এক জীবন চিত্রকে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন তা বহুবিধ কারণেই সমকালীন বাংলাদেশের কথাসাহিত্য ধারায় ‘অনন্য সাধারণ’ অভিধা লাভের যোগ্য। আর সে সব উপকাহিনীর জটাজালের ভেতর দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিময়তায় প্রকাশিত হয়েচে যে বিদ্রোহী সত্তাটি তার নাম নূরজাহান – একজন সাধারণ নারী।
নূরজাহান দবির গাছির মেয়ে। ওর মা হামি। মিলন এদেরকে নিয়েই উপন্যাসের উপক্রমনিকা করেছেন। আর আছে বিক্রমপুর অঞ্চলের প্রকৃতি। সে প্রকৃতির প্রথম প্রতিনিধি হলো খেজুর -গাছগুলো যাদের নিঃসারিত রস বিক্রি করে দবির গাছির অন্ন জোটে। শেষ হেমন্তে উত্তুরে হাওয়ার প্রবাহ শুরু হতেই দবির গাছি বোঝে সময় হয়েছে – গাছেদের রস দেওয়ার সময় হচ্ছে এবার। কাঁধের হাড়ি ভাড় যখন সে খেজুর গাছতলায় নামায় পিতৃবৎ এক প্রীতি আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে:
একবার এই গাছটির গায়ে পিঠে হাত বুলায় আরেকবার ওই গাছটির। পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলে,মা মাগো, মা সগল কেমুন আছ তোমরা? শইল ভাল তো? কেঐর কোন ব্যারাম আজাব নাই তো, বালা মসিবত নাই তো? উত্তুরে হাওয়ায় শনশন করে খেজুরডগা। সেই শব্দে দবির গাছি শোনে গাছেরা তার কথার পিঠে কথা চলছে। ভাল আছি বাজান ভাল আছি। ব্যারাম আজাব নাই, বালা মসিবত নাই (পৃ. ১৫)।
প্রকৃতির এই যে সন্নিকট দবির মাঝি এবং তার পারিপার্শ্ব সেখানে একটি হিংস্র আগন্তুক হলো ঢাকা থেকে বিক্রমপুরের দিকে আসা বিশাল উঁচু সড়কটি। নগরায়নের এই ইঙ্গিত ঔপন্যাসিক প্রারম্ভিক পর্যায়েই দিয়েছেন যার ভবিষ্যত অনেক অশুভের সম্ভাবনাকেই স্পষ্ট করেছে। সবচেয়ে তীব্রতরটি হয়েছে শরীরী নূরজাহানের উপর। কথা আর আচরণে শিশুবৎ:
এই ফাল্গুনে তেরো পূর্ণ নূরজাহানের। কিন্তু তাকে দেখায় বয়সের চেয়ে অনেক বড়। নূরজাহানের শরীর বেশ বাড়ন্ত। সীতারামপুরের হাতপাকা কারিগরদের তৈরি ডুরা শাড়ি পড়ছে বছর দুয়েক হল। শাড়ি পড়লে বাড়ন্ত শরীরের কিশোরী চোখের পলকে যুবতী হয়ে যায়। তেমন নূরজাহান হয়েছে বছর দুয়েক আগে (পৃ. ০৯)।
এই যে খেজুর গাছ পরিবেষ্টিত দবির গাছি আর নূরজাহান ঔপন্যাসিক কিন্তু ওদেরকে পূর্ণ সমাজবাস্তবতার উপস্থাপ করেছেন।
আবার ঐ যে নূরজাহানের শরীর তাই কিন্তু ওকে প্রথম থেকেই বিপদের দিকে ঠেলতে থাকে। প্রথম বিপদ আমরা দেখতে পাই বড় রাস্তার মাটির কাজে সাব-কন্ট্রাক্টর আলী আমজাদের দিক থেকে। গালে-মুখে বসন্তের ভয়াবহ দাগওয়ালা দশাসই শরীরের আলী আমজাদ প্রথম থেকে টোপ ফেলতে থাকে ওর উপর। খুব যে সফলতার দিকে এগোয় তাও কিন্তু না – লেখক নূরজাহানের বিদ্রোহী চেতনাটাকে ক্রমে ক্রমে তুলে এনেছেন প্রথম থেকেই। আলী আমজাদ একজন বৃদ্ধ মাটিয়ালকে লাাথি মারলে নূরজাহান কটমট করে ওঠে ‘আপনেও একটা খাবিস। আপনে মানুষ না।’ ওর এই বিদ্রোহী সত্তা শুধু এমন অন্যায় আর বিপদের বিরুদ্ধেই না, সামাজিক বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধেও। ও যে পুরুষ নয় সে বুঝ ওকে দেয়ার জন্য ওর মা হামির কত না চেষ্টা। হামির প্রলাপ: ‘এমুন মাইয়া আল্লার দুইন্নইতে দেহি নাই। এমুন আজাজিল (আজরাইল) আমার পেডে অইছে। বুইড়া মাগি অইয়া গেছে তাও সবাব (স্বভাব) বদলায় না। ঐ গোলামের ঝি তুই কী বেডা যে সব জাগায় তর যাওন লাগব!’ শাসনের গলায় হামি আরও বলে ‘বাড়ির বাইরে এখন পাও তুই দিতে পারবি না। তর বাপে হেদিন আমারে কইচে আমি যেমতে তোরে চালামু অমতেঐ তর চলন লাগব।’ কিন্তু এ নিষেধের বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ ঘটায় নূরজাহান ‘না আমি চলুম না, তোমার ইচ্ছায় আমি চলুম না, আমি আমার ইচ্ছায় চলুম’ (পৃ. ৫০)। নূরজাহানের দ্রোহী সত্তার প্রথম এ প্রকাশ থেকে পাঠক ক্রমাগত আশান্বিত হতে থাকেন ভবিতব্য নূরজাহানের জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
পাঠকের সে আশঙ্কা তীব্রতর হয়ে উঠে পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতেই। নূরজাহানের সাথে ওর মা’র বিতণ্ডার একটি পরিচ্ছেদ পরই উপন্যাসে মাওলানা মান্নানের অনুপ্রবেশ। এখানেই প্রথমবারের মত একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ঘটেছে। শুধু উপস্থিতিই নয় নূরজাহানের সাথে তাঁর সংঘাতও ঘটে গেছে তাৎক্ষণিকভাবে। সন্দেহ নেই নূরজাহান ও মাওলানা মান্নানের প্রথম সংঘাতের চিত্রটি ঔপন্যাসিক এঁকেছেন যথেষ্ট মর্মস্পর্শী করে। তাদের সংলাপের মূল বাক্যগুলো এমন:
দউবরার মাইয়া না তুই?
…
আমার বাপের নাম দইবরা না, দবির গাছি।
…আমার বাপরে কোনওদিন দউবরা কইবেন না।
কইলে কী হইব?
নূরজাহানের প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল, কইলে দাড়ি টাইন্না ছিড়া ফালামু।…
এতবড় মাইয়া এত ফরফর কইরা বেড়াচ ক্যা? যেহেনে যাই ওহেনেই দেহি তরে!…
আর যাইতে পারবি না।
…ইঃ যাইতে পারব না। আপনে কি আমার বাপ লাগেন যে আপনের কথা আমার হোনন লাগব?
…আমার মুখের উপরে এতবড় কথা! তরে তো আমি জবেহ কইরা ফালামু। তরে তো কেঐ বাচাইতে পারব না। মজিদের ইমাম অইলে অহনঐ সাল্লিশ (সালিশ) ডাকাইয়া আমি, ল্যাংটা কইরা তর পিডে দোররা মারতাম।…
…আপনে আমার এইডা করবেন। পচা মলবি কিচ্ছু জানে না খালি বড় বড় কথা!… আপনেরে দেখলে মনে হয় একখানা খাডাস (খাটাস), রাজাকার।
না নূরজাহান মান্নান মাওলানার সামনে আর দাঁড়ায় নি। ছুটতে ছুটতে চলে গেছে মনে আনন্দ নিয়ে – বাপকে দউবরা বলার যথার্থ প্রতিশোধ নিয়েছে সে। তবে পাঠককে সে নিমজ্জিত করে গেছে অতল এক আতঙ্কে। পাঠক বুঝে গেছে ‘দোররা’ থেকে বাংলাদেশের নূরজাহানকে কেউ বাঁচাতে পারবেন না। যদিও সেটি অনেক পরের ঘটনা। দ্বিতীয় পর্বের শেষ পর্যন্ত কাহিনী সেখানে পৌঁছায় নি। দুটি পর্ব ধরেই যেন পরিপ্রেক্ষিত নির্মিত হয়ে চলেছে।
এই নূরজাহান কিন্তু এমন শিশুটি থাকছে না খুব বেশি দিন। প্রকুতিগত যে অগ্রসরণ সেটা তো আছেই ভাল লাগার মানুষ মজনু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলে শরীরের ভেতর অদ্ভুত রোমাঞ্চ বোধ করে সে (পৃ. ৬৮)। আবার অন্যদিকে মা হামি তো তাকে জ্ঞান দিয়েই চলেছেÑ শরীর বিষয়ক জ্ঞান, নারীর শারীরিক পবিত্রতা বিষয়ক জ্ঞান। দেহ নিয়ে গ্রামীণ নারীর সংস্কার এবং একজন বাঙালি সাধারণ নারীর যে উদ্বেগ নূরজাহান ও হামির কথোপকথনে প্রকাশ পেয়েছে তা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। হামির শেষ কথা হলো: ‘মনে রাখিচ, স্বামীর ঘর একদিন যাইতে হইব, শইলডা বাচায় রাখিচ। নষ্ট শইল স্বামীরে দেওনের থিকা বড় পাপ এই দুইন্নাতে নাই। ঐ পাপখান কোনওদিন করিচ না।’ (প. ১১৯)
ইতোমধ্যে ঔপন্যাসিক যে কাজটি করেছেন তা হলো মাওলানা মান্নারে কুৎসিত চরিত্রটিতে প্রয়োজনমত ঘৃণ্য করে তুলেছেন। সামগ্রিকভাবেই মাওলানা মান্নান একটি ঘৃণ্য প্রাণীতে রূপান্তরিত হলেও কয়েকটি বিশেষ ঘটনা চরিত্রটির নির্মাণে প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। তার বাড়ি কাজের লোক কাশেমের সাথে মাওলানার জঘন্য ব্যবহার এবং দবির গাছির কাছ থেকে নেয়া রসের দাম না দেওয়া সে সকলের অন্যতম। দাবির মাঝির সাথে বাক বিতণ্ডার এক পর্যায়ে চেতে ওঠে মাওলানা:
নিজে যেমুন মাইয়াডাও অমুন বানাইছন। ডাঙ্গর মাইয়া, দিন নাই রাইত নাই যেহেনে ইচ্ছা ওহেনে যায়, যার লগে ইচ্ছা তার লগে রঙ্গম করে। আমারে কয় রাজাকার। হেইদিনের ছেমড়ি ও রাজাকারের দেখছে কী? হ আমি রাজাকার আছিলাম, কী হইছে? আমি অহনও রাজাকার, কী হইছে? আমার এখখান পশমও তো কেউ ছিঁড়তে পারে না। কোনওদিন পারবও না। রাজাকারগ জোরের তরা দেকছস কী? জোর আছে দেইখাই প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজাকারগ কিছু করতে পারে নাই, এরশাদ কিছু করতে পারে নাই। উল্টা রাজাকারগ মন্ত্রিমিনিস্টার বানাইছে। (পৃ. ১৬৭)
এবং এ ঘটনাটির শেষ পর্যায়ের নূরজাহানের নিয়তি যেন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে যখন মাওলানা মান্নান বলে: ‘বাপ বেডি দুইডাই শয়তান। বাপে কয় আমি মানুষ ঠকাই মাইরায় কয় রাজাকার। রাজাকার যহন কইছ রাজাকারের’ কাম আমি কইরা ছাড়–ম। ল্যাংটা কইরা এ ছেমড়ির পাছায় আমি বেতামু।’
দবির মাঝির সাথে মান্নান মাওলানা এই বিতণ্ডা যেন নূরজাহানের বিদ্রোহী সত্তটিকে আরও তেজিয়ান করে তোলে। মাওলানা তার বাপকে অপমান করেছে জানার পর নূরজাহানের বার বার ইচ্ছে হতে থাকে মান্নান মাওলানাকে অপমান করতে। আর সে ভাবনারই এক পর্যায়ে ওর চাপা ক্ষোভে: ‘আমি যে কেন পোলা হই নাই!’ তার সে ক্ষোভ কিন্তু প্রকাশ পেতে খুব বেশি দেরি হয় নি। মাকুন্দা কাশেমকে যখন মান্নান মাওলানা শয়তানি করে গরু চুরির দায়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় ভয়াবহ সে ঘটনাটি ঘটে তখনই। কাশেমকে পুলিশ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে শুনতে পেয়ে নূরজাহান দৌড়ায় সেদিকে। এতক্ষণ কাউকে কিছু না বললেও নূরজাহানের প্রশ্নের উত্তরে কাশেম আদ্যপান্ত ঘটনা খুলে বলে যার ভেথর ছিল গ্রামের প্রতি ওর সত্যিকার ভালবাসা। বুজের ভেতর ফুঁসে ওঠে তীব্র ঘৃণা। অনেক তীক্ষè কথা বেড়িয়ে আসবে চায়। কিন্তু সে ঘরের কিছুই না বলে নূরজাহান মাকুন্দা কাশেমের মাথার উপর দিয়ে একদলা থুতু ছিটিয়ে দেয় মান্নান মাওলানার মুখে। গ্রাম্য এক কিশোরীর শতশত লোককে স্তব্ধ করে দেয়া এই ঘটনা দিয়ে শেষ হয় ‘নূরজাহান’ ১ম পর্ব।
ঘটনাটির পরিণতি ভাবনা মুহূর্তেই শক্সিক্ষত করে তোলে নূরজাহানকে। আতঙ্কিত সে আশ্রয় নেয় মজনুর মা (প্রকৃতপক্ষে খালা) মরনির কাছে। নূরজাহান-মরনি-দবির গাছি-হামিদার শাসরুদ্ধকর এবং আতঙ্কগ্রস্ত এই পর্যায়টি উপন্যাসটির জয় পর্বের শুরুটিকে অত্যন্ত গতিশীল করে তুলেছে। যদিও কলেবর বিবেচনায় ২য় পবটি দীর্ঘতর হলেও নূরজাহান আশ্রিত মুল কাহিনীর বিস্তার সেখানে কম। তুলনায় বেশি প্রসার লাভ করেছে আনুষঙ্গিক উপাখ্যানগুলো। তবে সূক্ষ্মভাবে নূরজাহান চরিত্রের যে বিকাশ ঘটেছে তা হলো ওর পুরুষ হতে চাওয়ার গভীর আকাক্সক্ষা। প্রথম পর্বের সাব-কন্ট্রাক্টর আলী আমজাদ, মান্নান মাওলানা এবং মাওলানা পুত্র আতাহার সবাই ২য় পর্বটিতে অধিতর সক্রিয়। তবে মাওলানার সক্রিয়তার চূড়ান্ত সম্ভব হয় তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর। মাওলানা পুত্র আতাহারের জন্য বিয়ের কনের সন্ধান দিতে এসে ঘটক বসির যখন মাওলানাকে ধর্ম অনুযায়ী আরও একটি বিয়ের অনুরোধ জানায় তখনই কথা প্রসঙ্গে বেড়িয়ে আসে হিংস্র মান্নানের গোপন অভিসন্ধি। জানা যায়, সে বিয়ে করতে আগ্রহী একই গ্রামের দবির গাছির মেয়ে নূরজাহানকে।
২য় পর্বে নূরজাহানের চেতনাগত সমৃদ্ধি তত স্পষ্ট নয়। তবে তাকে দূরে রেখে সুকৌশলে উপন্যাসিক ওর চেতনার একটি প্রতীকী সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন হাসুর ভেতর দিয়ে। হাসু এবং তার ফুফু রহিমার আখ্যানটির ২য় পর্বে যথেষ্ট বিস্তারেই রচিত হয়েছে। রহিমা এসেছিল মাওলানা মান্নানের বাড়িতে কাজের মেয়ে হয়ে। বাড়ির পুরুষগুলোর অনাচারে ক্লিষ্ট সে। পরে এসেছে হাসু। দারিদ্রের কশাঘাতে উপায়হীন হাসুও রহিমার অবস্থানেই, যদিও মননগত শক্তিতে ভিন্ন। রহিমা নিজেকে রক্ষা করতে পারে নি পুরুষ পরিবার সদস্যদের হাত থেকে, তবে হাসু পেয়েছে। সন্ত্রস্ত হাসু আল্লাহর কাছে রহম চেয়েছে, প্রার্থনা করেছে তাকে পুরুষ করে দেওয়ার জন্য। এবং ২য় পর্বের সমাপ্তির নিকটবর্তিকালে আমরা জানতে পারি হাসু এখন আর মেয়ে নয়, সে পুরোপুরিই একজন পুরুষ। পুরুষের জামা-কাপড় পরিহিত হাসুর বক্তব্য: ‘অহন আমার কেন ডর নাই। যহন যেহেনে ইচ্ছা আমি যাইতে পারুম, যেহেনে ইচ্ছা হুইতে পারুত, যেই কাম ইচ্ছা করতে পারুম, আমার মিহি কেই চাইয়াও দেকব না। অহর পুরা দুইন্নাডাঐ আমার। … এই দুইন্নাডা মাইয়া ছেইলার না, এই দুইন্নাডা অইল পোলার। আমি অহন পুরুষ পোলা’ (পৃ. ৪১২)। লিঙ্গান্তরের এমন ঘটনা সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম ‘নূরজাহান’ এই ঘটেছে।
এ উপন্যাসের একটি অপ্রতিরোধ্য অনুযজ্ঞ হলো দারিদ্র। গ্রামীণ সমাজে দারিদ্রের যে দুর্বহ চিত্র তা এ উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। তবে সবচেয়ে বেশি বোধ হয় অনুভব করা গেছে আজিজ গাওয়ালের পরিবারের কাহিনীতে। ওর মা ছনুবুড়ি শুধু দুমুঠো ভাতের জন্য কত না ছলচাতুরী মিথ্যাচার করেছে আপনজনদের সাথেও। শেষে মারা গেছে মেটে তেল খেয়ে। ক্ষুধার জ্বালা ছনুবুড়ি মেটে তেল খেয়ে পেট ভরাতে উৎসাহিত করেছিল। দারিদ্রের এমন চরমতম দ্বিতীয় উদাহরণটি হলো আজিজের স্ত্রীর বানেছার শিশু সন্তানের মৃত্যু। আজিজ সদ্যজাত ঐ কন্যাসন্তানটি অসুস্থ হলেও ডাক্তারের কাছে নেয় নি। শেষে মৃত্যু হলে তাকে দাফন না দিয়েই ভাসিয়ে দেয় পানিতে। দাফন ও কাফনে টাকা খরচ করে কী হবে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এমনটি ভেবেছিল। পরিবারে অনেক সন্তানের আগমনক্লিষ্ট এই আজিজ শেষ পর্যন্ত শহরের হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাসেকটামি করায়।
‘নূরজাহান’ উপন্যাসটিতে লেখকের একটি প্রচেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি শুধুমাত্র একটি চরিত্রকে প্রয়োজনানুগ প্রেক্ষাপটে চিত্রিত করেন নি, বরং সামগ্রিক একটি গ্রামীণ চরিত্র নিয়ে বেড়িয়ে আসতে চায়। এই যে আজিজ, তার স্ত্রী বানেছা, ওদের মা ছনুবুড়ি এরা সবাই আসলে নূরজাহানদের সাথে সম্পর্কিত। প্রতিবেশি অথবা পারস্পরিক সম্পর্কের আরও অনেকগুলো এমন মানুষ কিন্তু উপন্যাসটি নতুন নতুন আলাদা আলাদা আখ্যান নির্মাণে সচেষ্ট যাদের সামগ্রিক রূপটি হলো ‘নূরজাহান’ নামের উপন্যাসটি। প্রথম পর্বের এমন আরও একটি আখ্যান রচিত হয়েছে তছিকে ঘিরে।
তছি পাগলিনী। ঢাকায় থাকা গ্রামের যুবক এনামুল রিকসা নিয়ে এলে তছির ইচ্ছে হয় রিকসায় চড়তে। রিকসাওয়ালা রুস্তম ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে নিয়ে গেল মুরলিভাজা খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে দূরের বাজার কোলাপাড়ায়। সেখানেই ঘটল ঘটনাটি। তছির সরলতার সুযোগে রিকসাওয়ালা আসলে ওর শরীরটাকে ভোগ করতে চাইছিল। আর তা বুঝাতেই চেহারা বদলে গেল তছির। রুস্তমের গলার গামছাটা এমনভাবে গিট দিয়ে ফেলল সে যে ফাঁসে আটকে মারা গেল রিকসাওয়ালা। তখন থেকেই তছি আর ওর মার আশঙ্কা কখন পুলিশ এসে তছিকে খুনের মামলার আসামী হিসেবে ধরে নিয়ে যায়। আর সে ভাবনাতেই যেন তছির পাগলামী আর বেড়ে যায়। মাথা আরও বেশি গরম মনে হয় ওর। মার কাছে বায়না ধরে মাথা নেড়ে করে দেয়ার জন্য। কিন্তু মা যখন ওকে মাথা নেড়ে না করার জন্য বোলাতে থাকে রাগ হয়ে যায় তছির। চেঁচিয়ে বলে; ‘ঐ মাগি এত প্যাঁচাইল পারচ ক্যা! নাইড়া করতে কইছি কর, নাইলে তরেঐ আমি নাইড়া কইরা দিমু’ (পৃ. ২৫৯)। তার তখনই যেন াঠকের মন জয় করতে কথাকারের খেলা। তাই ঔপন্যাসিক তখন লেখেন: ‘তছির এই রাগারাগিতে নয়, নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টায়, বাঁচিয়ে রাখবার আশায় পাগল মেয়েটির যে অসহায় আকুতি সে কথা ভেবে জলে চোখ ভরে গেল তছির মায়ের। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে তছির চুলে কাচি চালাতে লাগল সে।’ ২য় পর্বে তছির কাহিনী আর বিশেষ এগোয় নি। কিন্তু ১ম পর্বে তছি কাহিনী যে মর্মান্তিকতায় বর্ণিত হয়েছে তা যে কোন পাঠককে স্পর্শ করে সহজেই।
২য় পর্বে অন্য যে আর একটি উপকাহিনী বিস্তার লাভ করেছে সেটি হলো আতাহারকে নিয়ে। মান্নান মাওলানার ছেলে আতাহারকে লেখক মান্নানের একটি সত্যিকারের সম্পূরক হিসাবে চিত্রিত করেছেন। কুৎসিত এই চরিত্রটি যেন তার লালসাকে নিবৃত করতেই প্রচেষ্টা। চারপাশের যে কোন নারীর অবস্থানই তাকে যেন ভোগস্পৃহায় উন্মত্ত করে তোলে। বড়ভায়ের স্ত্রী পারুর সাথেও তার একই সম্পর্ক। স্ত্রী গর্ভজাত সন্তানরাও প্রকৃতপক্ষে আতাহারেরই। আর এ তথ্য মাওলানারও অজানা নয়। মাওলানা-পত্নী তা জানে বলেই আতাহরের জন্যে যখন বিয়ের কনে দেখার প্রশ্ন উঠেছে সে প্রস্তাব করেছে আতাহার বড় ভায়ের বিধবা স্ত্রী পারুকে বিয়ে করুক। কিন্তু মান্নান মাওলানা গররাজি। পুত্রকেও সে এ ব্যাপারে নিজের দলে টেনেছে প্রধান যে যক্তি দিয়ে তা হলো আতাহার সম্পন্ন ঘরের একটি মেয়েকে বিয়ে করলে অর্থ সম্পদ আসবে, সামাজিক সমৃদ্ধি আসবে।
ইমদাদুল হক মিলন তাঁর ‘নূরজাহান’-এর কাহিনী নির্মাণ করেছেন বিক্রমপুর এবং সংলগ্ন অঞ্চলের পরিপ্রেক্ষিতে। সে অঞ্চলের ভাষার সাথে সাথে মানুষের আচরণ, সংস্কার ও বিশেষ পেশার মানুষগুলোর পরিচয়ও উঠে আসে ক্রমে ক্রমে। ‘নূরজাহান’ এ গাওয়াল বা হাজাম পেশা তেমনই উদাহরণ। আর এভাবেই উপন্যাসটি সামাজিক স্তর বিন্যাসেরও একটি অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে।
‘যাবজ্জীবন’ এর লেখক যখন ‘ভূমিপুত্র’ (১৯৮৫) লিখেছিলেন তখন সে উপন্যাসের ভাষা, বর্ণনাভঙ্গী এবং গ্রামজ জীবন সব কিছু মিলে যে অদ্ভুত এক রস ইমদাদুল হক মিলন সৃষ্টি করেছিলেন তা বিশেষভাবে নন্দিত হয় ‘নূরজাহান’ (প্রথম পর্ব ১৯৯৫, দ্বিতীয় পর্ব ২০০২) প্রকাশের ভেতর দিয়ে। বিশালকায় সে উপন্যাস উভয় বাংলাতেই বিপুলভাবে পঠিত। সে উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের অপেক্ষার অধীর বাঙালি পাঠকের সংখ্যাও কম নয়। এমন মন্তব্যও অনেক সমালোচকের মুখে সমীচীন যে মিলন আর কোন উপন্যাস না লিখলেও শুধুমাত্র নূরজাহান-এর জন্যই বাংলা কথাসাহিত্যে স্থায়ী আসন পেতে পারতেন। অন্যদিকে কম জনপ্রিয় কিন্তু বিষয়ভারে গুরুত্বপূর্ণ মিলনের অন্যান্য উপন্যাস হলো ‘রাজাকারতন্ত্র’, ‘ঘেরাও’, ‘দ্বিতীয় পর্বের শুরু’, ‘মহাযুদ্ধ’, ‘একজন নিরাপত্তা হই’, ‘বালকের অভিমান’, ‘কালোঘোড়া’, ‘সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি’ ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সে সকল গ্রন্থ মহৎ সাহিত্য নজির না হলেও ভালো প্রয়াস হিসেবে নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবীদার। প্রবাস জীবন নিয়ে রচিত ‘পরাধীনতা’ (১৯৮৫) বা ‘পরবাস’ (১৯৮৭)ও অনেক পাঠকের চোখে জল আনতে সক্ষম হয়েছিলও বলে জানা যায়। কিন্তু এ সবের বাইরেও রয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের অধিক গ্রহনযোগ্যতা। সরলরৈখিক তরল তেমন উপন্যাসও মিলন রচনা শুরু করেন আশির দশকের শেষ দিকে। ১৯৮২ তে তেমন উপন্যাস ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ এবং ‘দুঃখকষ্ট’। সে তালিকা দীর্ঘ হয়ে চলে যত দূরে যাই, যদি ভালবাসা পাই, কেউ কথা রাখেনি, ভালবাসার সুখদুঃখ প্রভৃতি দিয়ে। তরুণ-তরুণীর প্রেমকে আশ্রয় করে রচিত এমন উপন্যাসের ধারাটিও কিন্তু বাংলা ভাষার সাহিত্যে খুব বেশি প্রতুল নয়। আর সে ধারাতে খুব দ্রুত ইমদাদুল হক মিলনের বিক্রিবাটা বেড়ে যাওয়ায় রচিত হতে থাকে একের পর এক প্রেমকাহিনী এবং ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে পড়তে থাকে সে সবের লেখকই প্রকৃতপক্ষে ‘যাবজ্জীবন’ বা ‘ভূমিপুত্র’-র লেখক। জীবনযাপনের একমাত্র আশ্রয় হিসেবে গ্রন্থরচনার দুঃসাহসী প্রয়াস কি ইমদাদুল হক মিলনই বাংলা সাহিত্যে প্রথম দেখিয়েছিলেন? হুমায়ূন আহমেদ বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও এ কাজে মিলনের অনুজ বটে।
এই বহু ধারার সফল নির্মাতা মিলন, তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস জীবনপুর ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘কেমন আছ সবুজপাতা’ এবং ‘মৌসুমী’র পরবর্তী প্রযোজনা। স্মৃতিকাতরতার উপন্যাস হিসেবে যে দুটির উপন্যাসের সাথে আমাদের আলোচিতব্য জীবনপুরও একই তালের, তবে সন্দেহাতীত যে ‘জীবনপুর’ অধিক মনোগ্রাহী, ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট, বাস্তবনিষ্ঠ।
‘জীবনপুর’ প্রকৃতপক্ষে দুটি ঘটনার বুনোনে তৈরি। যে ঘটনা দিয়ে উপন্যাসটির শুরু ও শেষ সেটি লালু নামের এক বেকারত্ব জর্জরিত যুবকের দেশত্যাগের কাহিনী। সে কাহিনি এক মর্মন্তুদ মাত্রা ধারণ করে যেহেতু দেশ ত্যাগ করে সে আসলে চলেছে পাকিস্তানের উদ্দ্যেশে; শেষ পর্যন্ত তাদের গন্তব্য দুবাই হলেও আপত গন্তব্য পাকিস্তান তার জন্য সৃষ্টি করে চলেছে অসহনীয় এক যন্ত্রণা কেননা লালু নিজে জড়িত ছিল মুক্তিযুদ্ধে যে যুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তিই ছিল পাকিস্তান নামের দেশটিই। এবং উপন্যাসটি লালুর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কে আশ্রয় করার ফলে হয়ে ওঠে অধিকতর মূল্যবান। তবে গ্রন্থটি শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গটিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেটি চলে যায় আরও অতীতে যেখানে লালুর শৈশব তার শৈশবিক দুঃখবেদনা, ক্রমে কৈশোরত্বে উত্তোরণ, কৈশোরিক স্মৃতিসমূহ ইত্যাদিও ফ্ল্যাসব্যাকে সহজেই উঠে আসে।
[…] আমি পাকিস্তানে চলে যাচ্ছি।
ভাবা যায়, একজন মুক্তিযোদ্ধা চলে যাচ্ছে পাকিস্তানে! যে দেশ আমাদের সবচাইতে বড় শত্র“, যে দেশের বিরুদ্ধে নয় নয়টি মাস যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, একাত্তোর সালে যে দেশের শুকরছানাগুলো হত্যা করেছে আমাদের তিরিশলক্ষ মানুষ, সম্ভ্রমহানী করেছে তিনলক্ষ মা বোনের, আমি চলে যাচ্ছি সেই দেশে!
আমি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করিনি। আসলে করার চান্স পাইনি। করতে চেয়েছি, কমান্ডার করতে দেননি। তিনি আমাকে লাগিয়েছিলেন অন্যকাজে।
শুধু অস্ত্র হাতে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁরাই কি মুক্তিযোদ্ধা?
তাঁদেরকে যাঁরা সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা না? শত্র“ শিবিরের খবর যাঁরা এনে দিয়েছেন, কোথা দিয়ে কীভাবে আক্রমণ চালালে ধ্বংস করা যাবে শত্র“শিবির, হাতের তালুতে জীবন নিয়ে যাঁরা এই কাজ করেছেন তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা না?
আমি সেই রকম এক মুক্তিযোদ্ধা।
একাত্তোর সালে আমার বয়স সতেরো আঠারো। (পৃষ্ঠা ০৯)
আর যেদিন উপন্যাসের কাহিনি উন্মোচিত হয়, লালু পাকিস্তানের পথে সে তারিখটি হলো ২৩ মার্চ ১৯৮২। অর্থাৎ লালুর আটাশ উনত্রিশ বছর বয়সে জীবনপুর গ্রন্থটি উন্মোচন, একটি কাহিনি সামনে এগোয় কয়েকমাস, আর একটি এগিয়ে পুরো এক দশকের বেশি লালুর জীবনে। আয়তনের দিক দিয়ে ফ্ল্যাসব্যাক দীর্ঘ – বর্তমানের কাহিনির প্রায় দ্বিগুণ। উপন্যাসটি বর্তমান যে চলা ঢাকা থেকে রাজশাহী হয়ে ভারতের পশ্চিমবাংলা হয়ে দিল্লী হয়ে অমৃতসর … এ এক অনাস্বাদিত ভ্রমণ। ১১টি অধ্যায় বিভাজনে পুরো গ্রন্থটি নির্মিত। অধিকাংশ সময়ে বিভাজনগুলির শুরু হয় যাত্রাপথে অবস্থান নির্দেশ করে। একটু হিসেব কষে দেখা যেতে পারে এ প্রসঙ্গে:
(১) আমি পাকিস্তানে চলে যাচ্ছি
(২) রাজশাহী পৌঁছালাম সন্ধ্যার পর
(৩) ভগবান গোলা থেকে কোলকাতা
(৪) [ট্রেনে চলেছে কথকসহ দলবল]
(৫) দিল্লী পৌঁছালাম দুদিনপর
(৬) [দিল্লীতেই অবস্থান]
(৭) [দিল্লীতেই অবস্থান]
(৮) অমৃতসরে আমাদেরকে তোলা হলো এক শিখের বাড়ীতে।
(৯) [অমৃতসর থেকে পাকিস্তানের পথে]
(১০) আমাদের পুরো দলটিকে পাকিস্তান আর্মি তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল
(১১) ওয়াগা বর্ডার জায়গাটা দেখলেই ভয় লাগে।
লালুদের যাত্রাপথ আমাদের অধিকাংশেরই অচেনা। কখনো কখনো কারো শ্র“তিনির্ভর অভিজ্ঞতা থাকলেও বাস্তবে সে পথে মারাই করার অভিজ্ঞতা ইমদাদুল হক মিলন পেলেন কি ভাবে! সে কারণেই কি সে ঔপন্যাসিকের কলমকে সালাম করতে দ্বিধা করেন না বাংলা ভাষার সমকালীন বয়োজ্যেষ্ঠ প্রধান লেখকরাও।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের সেই দিনটির বর্ণনা পড়া যাক:
… খোরশেদ বলল, এখন হইতাছে আসল কাম। খাল সাঁতরাইয়া ওই পারে যাইতে হইব। যে যেই ভাবে পারো সাঁতরাইয়া পার হও। কাপড় চোপড় ভিজাইতে না চাইলে খুইল্লা হাতে লও। এখন আর লজ্জা শরম কইরা লাভ নাই।
আশ্চর্য ব্যাপার, মেয়েগুলো পর্যন্ত নিঃশব্দে তাদের শাড়ি ছায়া ব্লাউজ সব খুলে ফেলল। একহাতে শাড়ি ছায়া ব্লাউজ ধরে অন্যহাত দিয়ে ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে পানিতে নেমে গেল। কোলের বাচ্চাগুলোর একটাকে নিয়েছে খোরশেদ, একটাকে মোফাজ্জল আর একটা দেখি মনোয়ারের কোলে। জামাকাপড়ের সঙ্গে এক একটা বাচ্চাকে এক হাতে উঁচু করে ধরে নিঃশব্দে খাল পেরোচ্ছে তারা।
আমিও দিগম্বর হয়েই খালে নেমেছি। সঙ্গের ছোট্ট ব্যাগটা আর লুঙ্গি শার্ট একহাতে ধরে ধীরে ধীরে পানি ভাঙছি। কী যে কষ্টকর ব্যাপারটা। স্বাভাবিক অবস্থায় এইটুকু খাল পার হতে এক দেড় মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না। আমাদের লেগে গেল চার পাঁচমিনিট।
ওপারে এসে যে যার কাপড় চোপড় পরছি। সার্চলাইট ধীরে ধীরে ঘুরে আসছে আমাদের দিকে। সেই আগের কায়দায় মাটিতে শুয়ে পড়েছি আমরা। সার্চলাইট ঘুরে যাওয়ার পর আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে সামনে দাঁড়িয়ে বাঘের মতো হুংকার ছাড়া গলায় কে যেন বলল, হল্ট। (পৃষ্ঠা ১৮৩)
এমন একটি দৃশ্যের অভিজ্ঞতা পাঠকের জন্য রোমহর্ষক। দৃশ্যটি পড়ার সময় বারবার লোকনাথ ভট্টাচার্যের (১৯২৭-২০০১) ‘বাবুঘাটের কুমারী মাছ’ (১৯৭২) উপন্যাসটির নগ্ন মানুষদের চিত্রকল্পনাটি পাঠকের মস্তিষ্কের অলিগলিতে উঁকিঝুঁকি মারবে।
রোমহর্ষক অনুরূপ আর একটি ঘটনা উপন্যাসটিতে রয়েছে সামান্য আগেই। অমৃতসরে সেই শিখ পরিবারে লালূসহ সকলের রাত যাপনের পরদিন সকাল সেটি। অন্যান্যের মত লালুও গিয়েছে লোটা হাতে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর প্রাতঃকার্য সারতে। প্রাতঃকার্য চলাকালে লালুর প্রথম চোখে পড়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে লম্বা গলার দুটো শকুন এগোয় তার দিকে। তারপর?
… সেই দুটো শকুনের জায়গায় তখন চারদিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়েছে পঞ্চাশ ষাটটা শকুন। চারপাশ থেকে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে আমার দিকে।
আরে, শকুনে কী জ্যান্তই খেয়ে ফেলবে আমাকে? এগুলো কী ভারতীয় শকুন, নাকি পাকিস্তান থেকে গোপনে এসে ওৎ পেতে আছে এই জঙ্গলে? বাংলাদেশী পেলেই জ্যান্ত ঠুকরে খাবে?
এ এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমার।
কেন শকুনগুলো ওইভাবে চারদিকে এগুচ্ছিল একজন মানুষের দিকে?
কী উদ্দেশ্য তাদের?
শকুনগুলো কি আমাদের আসলে লাশ মনে করেছিলো? মরে পচে গলে যাওয়া মানুষের লাশ? লাশ মনে করেই কি আমাকে ঠুকরে খেতে ওভাবে এগুচ্ছিলো?
ভয়ে আমার তখন কলিজা শুকিয়ে গেছে। অর্ধেক হওয়ার পর পায়খানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও রকমে পানি খরচা করে লোটা হাতে নিয়ে একটা দৌড় দিলাম। একদৌড়ে সোজা সেই শিখের বাড়িতে। (পৃষ্ঠা ১৭১)
পাকিস্তান যাত্রায় লালুর যে কিন্নতা তা যে কোন সংবেদনশীল পাঠককেই স্পর্শ করতে বাধ্য। সে যাত্রার পথে পথে কত বিভীষিকা, কত অভাবিত ঘটনারাজী। জীবনপুর যদি শুধু সে যাত্রার কাহিনি নিয়েই বিকশিত হত তা হলেও একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস হতে কোন বাধা থাকত না কেননা সে উপন্যাসেও অন্তর্ভুক্ত থাকতো সেই সব আতঙ্কসৃষ্টিকারী ব্যাপারস্যাপার যা লালু প্রত্যক্ষ করে। বাংলাদেশের মেয়ে পাচার হয়ে যাওয়ার যে সংবাদ পত্রপত্রিকায় আমরা পড়ি, মিলন তেমন জিনিসকে উপন্যাসে তুলেছেন মমতা দিয়ে। কেমন করে পাচার প্রক্রিয়াধীন সে মেয়েরা লালুদের যাত্রাকালে সহজেই শয্যাশায়ী হতে থাকে দালাল থেকে শুরু করে সীমান্তরক্ষীদের তার অনবদ্য চিত্রায়ন জীবনপুর-এর পাঠক আবিষ্ট করে। যাত্রাপথের বিঘ্ন দূর করতে সে সকল মেয়েদের ব্যবহৃত হওয়ার বিষয়টি কিন্তু লালুকে দ্রোহী করেছে বারবার। জ্বলে উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা লালুর অন্তর্গত চেতনা, যে চেতনা কিশোর লালুকে ১৯৭১ সালের দিনগুলোতেও উদ্যোমী ও সক্রিয় রেখেছিল পুরো দশমাস ধরে।
একাত্তরে লালু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেনি। সুযোগ পায় নি সে। রোগা পটকা থাকায় কমান্ডার তাকে অস্ত্র ধরাননি। লাগিয়েছিলেন অন্য কাজে। এসব জানান লালু উপস্থাপন করেছে শুরুর পৃষ্ঠাগুলোতেই। আর তাই লালুকে নিয়ে একটি ধারণা মাথায় রেখেই পাঠকের যাত্রা। অগ্রসর পাঠক হয়তো এর ফলে কাহিনির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নিয়েও অনুমান করতে থাকেন সহজেই।
তবে এই যে দেশ ছেড়ে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যের রওনা, তার ভেতরে মুক্তিযুদ্ধে লালুর অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ ইত্যাদির সাথে সাথে আরও যে একটি ব্যাপার প্রবিষ্ট হয় তা হলো বিলুর কথা। বিলুর সাথে লালুর যে ভাব ভালোবাসা ছিল তা স্পষ্ট হয়। বিলুর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় লালুর যে অন্তরীন ক্রোধ সে সবও ভূমিকা রাখে দেশত্যাগে লালুর সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ব্যাপারে। যদিও আমরা বুঝতে পারি আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের যুবসমাজের জন্য যে হতাশার ব্যাপকতা বিস্তার লাভ করেছিল সে সবও ছিল অন্য সব যুবা বয়সের মানুসের মত লালুর জন্য প্ররোচনা। ভাগ্যানুসন্ধানে দেশান্তরিত হতে চাওয়া।
লালুর পাকিস্তান যাত্রার কাহিনিতে প্রথম ফ্ল্যাসব্যাক এসেছে ২৩ পৃষ্ঠা পর (৩২ পৃষ্ঠাতে)। ‘আমাদের বাড়ি ছিল বিক্রমপুর’ বলে সে আখ্যানের শুরু। এমন শুরু কি স্পষ্টতই এজন্য যে বিক্রমপুরের কিশোর লাল মিয়া ওরফে লালুর ভেতর প্রচ্ছন্নে রয়েছেন কথাকার মিলন নিজেই। অন্তত লালুর বেড়ে ওঠার ভেতর যে মিলনের বেড়ে ওঠাকে প্রত্যক্ষ করতে দোষ নেই তা স্পষ্ট। লেখকের বেড়ে ওঠার স্মৃতিবাহী সে ধারাটি যা জার্মান শব্দ ‘Bildungsroman’ নামে পরিচিত তা কি ইমদাদুল হক মিলনের আর কোন উপন্যাসে লক্ষিত? সে স্মৃতিরচনার ভেতর একসময় আসে বিলু নামের সেই মেয়েটি।
শৈশবের বর্ণনা ইমদাদুল হক মিলন দিয়েছেন সরল ভাষ্যে। আত্মকথনের ভঙ্গীতে। উত্তম পুরুষে। প্রথম ১০/১২ পৃষ্ঠার বর্ণনায় খুব পরিকল্পিতভাবে না হলেও এসেছে পরিবারের মানুষদের কথাÑ বিশেষ করে তার মা ও বড় ভাইয়ের কথা। অন্য ভাইবোনদের কথাও আসতে থাকে। সে বর্ণনারাশির দ্বিতীয় অংশ শুরু হয়েছে ৫৬ পৃষ্ঠাতে। বাবা-মা-ভাই-বোনসহ গ্রামীন যে পরিবেশ লালুর কৈশোরকে মথিত করেছে তা বিবৃত হয়েছে পূর্ণ বিস্তারে, তবে এসবের ভেতর দিয়ে উপন্যাসটি নতুন যে মাত্রা পেয়েছে তা হলো শৈশব কৈশোরের লালুর সময় ছিল সরলতায় ভরা আর যে লালু বর্তমানে মানুষ পাচারের মত পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ব্যবসার শিকার।
বিলু নামের মিষ্টি মেয়েটি যে কিনা শিশু বয়সেই লালুর হাত ধরে বলেছিল ‘এই হাত কখনও ছাড়বো না’ সেই বিলুর প্রসঙ্গটি সাজিয়ে গুছিয়ে ঔপন্যাসিক শুরু করেন ৮১ পৃষ্ঠায়। কেমন করে কৈশোরকালীন মারামারির ভেতর দিয়ে তাদের মুখ চেনা এবং পরবর্তীতে তাদের ভাব ভালবাসা। এক সময় এমন হলো বিলুকে ছাড়া লালু থাকতে পারতো না। রাতে পড়াশোনা শেষে লালু চলে যেত বিলুর ঘরে। দুজনে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যেত যা ক্রমে লালুর ‘নেশা’ হয়ে যায় যদিও লেখক জানিয়েছেন ‘দুজনে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আমাদের কারও মধ্যেই কোন ফাজিল আচরণ নেই। শরীর ইত্যাদি আমাদের ভাবনায় আসে না। আমি ছেলে, বিলু মেয়ে এই বোধটাই কাজ করে না। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি। এ ওর ওপর তুলে দিই পা। শুধু এইটুকুই’ (পৃষ্ঠা ৮৭)। যদিও আধুনিক পাঠক লেখকের এই সারল্যকে কপটতা ভাবলে তেমন ভাবনাতে নিশ্চয়ই দোষের কিছু হবে না। তারপর একদিন গভীর রাতে বিলুর বাবা বিষয়টি আবিষ্কার করলেন, কোন নাটকীয়তা ছাড়াই বিলুকে তিনি কিশোরগঞ্জে নিয়ে গেলেন। কিশোর লালুর মাথায় ভেঙে পড়লো বিশাল এক আকাশ। তারপর ক্রমে ক্রমে অনেক চড়াই উৎড়াই এর ভেতর দিয়ে আজকের দিন।
উপন্যাসের ভেতর সরবে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিটির বিকাশ ঘটেছে ১১৩ পৃষ্ঠায়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। ঈশ্বরগঞ্জ থানা কম্পাউন্ডে ট্রেনিং শুরু হয়েছে। ট্রেইনার বজলু ভাই। ইপিআর (বর্তমান বিডিআর) এর গুলি খাওয়া এক সৈনিক এসে শুরু করলেন ট্রেনিং যেখানে শামিল লালুর মত ৫০/৬০ জন। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া না যাওয়া, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ নিয়ে লালুর দশমাস। সে সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধে যাবে, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসবে; কিন্তু পরে ‘আমার অসহায় মাকে আমি কার কাছে ফেলে যাবো’ (পৃষ্ঠা ১৩১) ভেবে সে আর যেতে পারে না।
এই যে দুটি গল্পের সুতো ক্রমে ক্রমে বুনতে বুনতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, ১৯৭১ এর পাকিস্তানি সৈন্যের প্রসঙ্গ চলে আসে ভারত-পাকিস্তান বর্ডার পার হওয়ার সময়। সবচেয়ে বেশি রক্ত হিম করা অধ্যায় বোধ হয় নয়। অমৃতসর থেকে পাকিস্তানের পথে লালুদের দলটি। ক্লান্তিহীন হাটার এক পর্যায়ে অন্ধকার রাতে দলটি ধরা পড়ে যায়। লেখকের ভাষ্য ‘পুরো দলটা আমরা ধরা পড়ে গেলাম…’ এবং মুহূর্তেই লেখক বলেন আমি একদিন আর্মির হাতে ধরা পড়ে গেলাম। চলে আসে ১৯৭১ সালে লালুর ধরা পড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটি। সে যাত্রায় লালুরা রক্ষা পেলেও রক্ষা পায়নি কর্ণেল তাহরের শ্বশুর বাড়ির পরিবার। মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল তার ডাক্তার শ্বশুর এবং শালিকাকে।
‘জীবনপুর’ উপন্যাসে ইমদাদুল হক মিলন যে বর্ণনাকৌশল ব্যবহার করেছেন তা বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যে খুব বেশি অভিনব নয়। তবে মানুষ পাচারের যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা অভিনবত্বের দাবীদার। সে অভিজ্ঞতার এমন বাস্তব সাহিত্যাচরণ সন্দেহাতীত ভাবেই প্রশংসার দাবীদার। জনপ্রিয় সাহিত্যের রুঢ় সমালোচকেরাও মিলনের এ প্রয়াসকে অভিনন্দন জানাবেন বলেই মনে হয়। সে প্রয়াস পরিকল্পনায় যুক্ত হয়েছে লালুর হয়ে ওঠার সময়কাল এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিসমূহ। আর এভাবেই জীবনপুর সকল ঘরানার পাঠকের কাছেই আদরনীয় হওয়ার সম্ভাবনায় উজ্জ্বল। ‘নূরজাহান’ ২য় খণ্ডের পর জীবনপুর তাই সত্যিকার অর্থেই মনোযোগী পাঠকের আকর্ষণে সক্ষম।
ইমদাদুল হক মিলন কোন মহৎ উপন্যাস লিখেছেন কি না সে তর্কে না যেয়েও বলা যায় তিনি অনেকগুলো ভাল উপন্যাস লিখিছেন – বর্তমান আলোচনার অনেকগুলোকেই সে তালিকায় স্থান দেয়া সম্ভব। তাঁর বিশাল রচনাসম্ভারে ‘যাবজ্জীবন’, ‘ভূমিপুত্র’ এবং ‘নূরজাহান’-এর মত উপন্যাস যে আরও রয়েছে তেমনটিও অনুমান করা যেতে পারে। আর সে সবের আলোকেই এমনটি প্রত্যাশা করা হয়তো বাতুলতা হবে না যে তিনি ভাল উপন্যাস লেখার ব্যাপারে অধিক মনোযোগী হবেন এবং বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাসে তাঁর স্থানকে সুনিশ্চিত করবেন।
টীকা:
- ‘ভূমিপুত্র’, ইমদাদুল হক মিলন, প্রগতি প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৮৪ পৃ. ৯ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ১০. ↩
- প্রাগুক্ত ↩
- ‘উপন্যাস সমগ্র’, ১, ইমদাদুল হক মিলন, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৯, ফ্ল্যাপ লিখন ↩
- ‘যাবজ্জীবন’, উপন্যাস সমগ্র ১, প্রাগুক্ত পৃ. ২২ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ৮১ ↩
- ‘কালোঘোড়া’, উপন্যাস সমগ্র ১, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭০ ↩
- প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৪ ↩
- ‘বালকের অভিমান’, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, পল্পব পাবলিশার্স, ১৯৮৮, পৃ. ১৯১ ↩
- ‘নিরাপত্তা হই’, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৫ ↩